alt

সাময়িকী

লোরকার দেশে

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ

: বৃহস্পতিবার, ০৫ জুন ২০২৫

ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-৯

(পূর্ব প্রকাশের পর)

ফুয়েন্তে বাকেরোজ গ্রামে লোরকার জন্মভিটা দেখার সময় গাইড বললেন, তাঁর স্মৃতি এখানেই শেষ নয়। মাত্র ৩ মাইল দুরের ভালদাররুবিও গ্রামেও লোরকার স্মৃতি মিশে আছে। এত কাছে, সেখানে না যেয়ে কি পারা যায়

ভালদাররুবিও-র এক বাড়িতে লোরকার পরিবার ১৯০৬ থেকে ১৯০৮ সালের মাঝে বাস করেছেন, আর সেটি তাদের গ্রীষ্মনিবাস ছিল ১৯২৬ সাল পর্যন্ত। লোরকার পিতা ছিলেন সম্পন্ন ভূস্বামী, বাড়িটি তাঁর ব্যবসার প্রয়োজনে কেনা হয়েছিল। তাই এটি ছিল মূলত খামারবাড়ি- কৃষিকাজের অনেক হাতিয়ার এখনো রাখা আছে কয়েকটি কামরায়।

বাড়িটিতে ঢুকে দেখি খামারবাড়ির গোলাঘর, দোতলায়। পেছনে বাঁধানো উঠান, পাশে বাগান। নিচে প্রথমে বসার ঘর, তারপর শোয়ার ঘর, খাবার ঘর, রান্নাঘর- সবকিছুতেই ঐতিহ্যের ছোঁয়া। সবচেয়ে সুন্দর ঘরে দেখি একটি নকশা-করা পিয়ানো, যা বাজাতেন লোরকার মা, আর মার সাথে প্রায়ই যোগ দিতেন লোরকা। তাঁর স্বপ্ন ছিল মা’র মতো তিনি একজন পিয়ানোবাদক হবেন। তবে পিয়ানো ছিল তাঁর আজীবনের সাথী- যেখানেই ছিলেন সেখানেই ছিল একটি সুন্দর পিয়ানো। তাই লোরকার কবিতার আত্মায় মিশে আছে গানের সুর।

আট বছর আগে ফুয়েন্তে বাকেরোজ-এ লোরকার জন্ম হলেও এ ভালদাররুবিও গ্রামেই তাঁর শৈশব কাটে, যার কথা তিনি বলেছেন: আমি বেড়ে উঠেছিলাম প্রকৃতির সঙ্গে, অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে। দুনিয়ার সমস্ত শিশুর মত, প্রত্যেকটি জিনিস, আসবাবপত্র, লতাগুল্মবৃক্ষ আর পাথরগুলো, অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ছিল আমার কাছে। ...অবিরাম কথা বলতাম তাদের সঙ্গে। ...”১

শৈশব ফিরে ফিরে এসেছে লোরকার স্মৃতিতে, তাঁর কবিতায়:

আমি চলে যেতে চাই ছোট্টবেলাতে

আর ছোট্টবেলা থেকে ছায়ায়।

বুলবুল, তুইও যাবি

যাওয়াই ভালো!

আমি ফিরতে চাই ছায়ায়

আর ছায়া থেকে যাবো ফুলে।

আতর তুইও যাবি

যাওয়াই ভালো!

আমি ফিরতে চাই ফুলে

আর ফুল থেকে

আমার হৃদয়ে। ২

ফুয়েন্তে বাকেরোজ ও ভালদাররুবিও- এ দুটি গ্রামে ঘুরে ঘুরে লোরকার অনেক স্মৃতি জমা করে রেখেছি। মনে হলো গ্রানাদা আসা সার্থক হলো, এরপর আর কিছু না দেখলেও চলবে।

হোটেলে ফিরে নিত্যদিনের মতো সবাই বসলাম ঘরোয়া সভায়, আলোচনার উদ্দেশ্য- আজ কী দেখলাম, কাল কী দেখব। সাথে, আজ কী খেলাম, কাল কী খাব। এক পর্যায়ে নাবিল বলল, তোমার মিস্টার লোরকার আর ক’টা জায়গা বাকি আছে

আমি বললাম, শুরু হলো মাত্র, আরো অনেক বাকি আছে। লোরকা সারা গ্রানাদায় মিশে আছেন। শুধু কি গ্রানাদায় তা ছাড়িয়ে আন্দালুসিয়ায়, এবং পুরো স্পেনে লোরকা ছড়িয়ে আছেন। আগে গ্রানাদার স্মৃতিগুলি শেষ করি, এরপর আন্দালুসিয়ার অন্য শহরে, পরে পুরো স্পেনে তা খুঁজে বেড়াব।

এরা একটু হতাশ হয়ে বলল- মিস্টার লোরকাকে দেখতে দেখতে আর অন্য কিছু দেখা হবে না। আমি একটু হালকা প্রতিবাদের সুরে বললাম- সবই দেখা সম্ভব, যদি আমাদের টাইম ম্যানেজমেন্ট ভাল হয়। তাছাড়া, লোরকার লেখায় উঠে এসেছে গ্রানাদা। তাঁর দেখা গ্রানাদার সাথে তোমাদের দেখা গ্রানাদাকে মিলিয়ে দেখ। তাঁর কবিতা পছন্দ কর দু’জনেই একস্বরে বলে উঠল ‘না’। বললাম, কেন

যেরকম আশা করেছিলাম সেরকম উত্তরই এলো। বলল, মিস্টার লোরকার কবিতা আমরা বুঝি না। আমি মনে মনে বললাম, আমিও যে ভাল বুঝি, তা নয়, তবে বোঝার চেষ্টা করি। তবে মুখে বললাম, লোরকার কবিতা বুঝতে সহজ হবে, যদি আমরা যাই তাঁর স্মৃতি-জড়ানো জায়গায়- কোথায় তিনি জন্ম নিয়েছেন, বড় হয়েছেন, কোন স্কুলে গিয়েছেন, কোথায় ঘোরাঘুরি করেছেন, আড্ডা দিয়েছেন, পিয়ানো বাজিয়েছেন, নাটক করেছেন, কোন টেবিলে বসে কবিতা লিখেছেন- তা আমাদের দেখতে হবে, জানতে হবে। লোরকার দেখা গ্রানাদার সাথে আমাদের দেখা গ্রানাদাকে মিলিয়ে দেখতে হবে। তাছাড়া, লোরকার জীবনে এক বড় ট্র্যাজেডি আছে, তা গ্রানাদারও ট্র্যাজেডি, স্পেনেরও ট্র্যাজেডি, আমাদেরও ট্র্যাজেডি। তা-ও জানতে হবে।

তারা কোনো উত্তর দিল না। আমি ‘মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ’ ধরে নিয়ে লোরকাকে দেখার, জানার প্রচেষ্টা চালু রাখলাম।

পরদিন, রোদ ঝলমলে শীতের সকালে, টেক্সি নিয়ে সবাই পৌঁছলাম হুয়ার্তা দে সান বিসেন্তে ভবনে। হুয়ার্তা অর্থ হলো বাগানবাড়ী। এটি সত্যিই ছিল এক বাগানবাড়ি- ১৯২৬ থেকে ১৯৩৬ পর্যন্ত এটি ছিল লোরকা পরিবারের গ্রীষ্ম-নিবাস। লোরকার পিতা ফেদেরিকো গার্সিয়া রদরিগাজ ২৭ মে ১৯২৫ সালে বাড়িটি কিনেছিলেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ‘বিসেন্তে লোরকা রোমেরো’, তাঁর নামে এ বাড়িটির নাম দেন ‘হুয়ার্তা দে সান বিসেন্তে’। কবি তাঁর লোরকা পদবী পেয়েছেন মায়ের কাছ থেকে, আর বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন ফেদেরিকো গার্সিয়া।

সে সময় বাগানবাড়িটি ছিল শহরের বাইরে গাছপালা ঘেরা সবুজ এলাকা ভেগায়। পরে শহর সম্প্রসারিত হলে এটি এসে পড়ে গ্রানাদা শহর এলাকায়। নগর সম্প্রসারণের সময় কর্তৃপক্ষ এ বাড়িটি ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করে। পরে জনগণের প্রতিবাদের মুখে জানুয়ারি ১৯৭৬ এ বাড়িটি সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

‘হুয়ার্তা দে সান বিসেন্তে’বাড়িটি ঘিরে লোরকার অনেক সুন্দর স্মৃতি আছে। বাড়িটির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে লোরকা দেখতেন- সিয়েরা নেভাদা, আলহাম্বরা, আলবাইসিন- যার কথা চিঠিতে বলেছেন এক বন্ধুকে: ‘আমার ব্যালকনির সামনে গ্রানাদা, অনন্য সৌন্দর্যে দূরে প্রসারিত’। এ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েই কি লোরকা লিখেছিলেন:

মৃত্যু ঘনিয়ে এলে

ব্যালকনি সরিয়ে দেবেন।

দোহাই।

ছেলেটা কমলালেবু খাচ্ছে।

আমার বারান্দা থেকে স্পষ্ট দেখা যায়।

চাষী কাস্তে দিয়ে ফসল কাটছে।

আমার বারান্দা থেকে স্পষ্ট শোনা যায়।

মৃত্যু ঘনিয়ে এলে

ব্যালকনি সরিয়ে দেবেন।

দোহাই আপনার।২

বাসার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে লোরকা যে দৃশ্য দেখেছেন তা দেখার ভাগ্য আমাদের হলো না। সময়ের ব্যবধানে সে ব্যালকনির দিকে অনেক সুউচ্চ ভবন নির্মিত হওয়ায় গ্রানাদার এ ল্যান্ডমার্কগুলি এখান থেকে আর দেখা যায় না। এ বাড়িতে বসে লোরকা রচনা করেছেন দু’টি ট্রাজিক নাটক- ১৯৩২ সালে বোদাস দে সাংগ্রে (রক্ত বিবাহ) এবং ১৯৩৪ সালে ইয়ের্মা।

লোরকার বোন ইসাবেল গার্সিয়া লোরকা ৬ এপ্রিল ১৯৮৫ তারিখে হুয়ার্তা দে সান বিসেন্তে বাড়িটি শহর কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করেন, লক্ষ্য- লোরকা স্মৃতি যাদুঘর করা। ১০ মে ১৯৯৫ সালে উদ্বোধন করা হয় এ স্মৃতি যাদুঘর-কাসা মুজেও ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা: হুয়ার্তা দে সান বিসেন্তে।

টিকেট কেটে প্রবেশ করলাম হুয়ার্তা দে সান বিসেন্তে ভবনে। মিনিট পনের পরে পরবর্তী গাইডেড ট্যুর শুরু হবে। এক একটি গ্রুপে ১০ জন, ৪৫ মিনিট পর এক একটি ট্যুর। লেইলা সেলেজার- আমাদের চটপটে সুন্দরী ট্যুর গাইড, এসে নিজের পরিচয় দিয়ে আমাদেরকে স্বাগত জানাল। বসার ঘর থেকে ট্যুর শুরু, এখানে পুরনো কিন্তু অভিজাত আসবাবপত্র। এরপর খাবার ঘর, রান্নাঘর- সবখানেই সেই বনেদি পরিবারের রুচির ছাপ। তারপর দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। সেখানে প্রথম কক্ষটি বসার ঘর। এরপর লোরকার শোবার ঘর, সেখানে তার ব্যবহৃত খাট। পাশে লেখার ডেস্ক, এর ওপর এক পোস্টার ‘আল বারাকা’। প্রজাতন্ত্রী সরকারের সহায়তায় ১৯৩২ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার দল ‘আল বারাকা’কে নিয়ে লোরকা স্পেনের বিভিন্ন গ্রামে ২০০টি নাটক মঞ্চস্থ করেন। এ দলের উদ্দেশ্য নিয়ে লোরকা বলেন: ‘আমরা নাটককে- লাইব্রেরী থেকে বের করে আনব, আর প-িতদের কাছ থেকে সরিয়ে নেব, আর প্রদর্শন করব গ্রামের মাঠে বিশুদ্ধ বাতাস ও সূর্যালোকে’।

এর পরে পিয়ানো রুম। এখানে ঢুকতেই চোখে পড়ল জানালার পাশে সুন্দর এক পিয়ানো, এক কোণে একটি গ্রামোফোন, যাতে লোরকা বাজাতেন বিটোফেন ও বাখ-এর সিম্ফনি। আর দেয়ালে টাঙানো অনেকগুলি ছবি। তার মাঝে একটি চিত্র লোরকাকে দেয়া সালভাদর দালির এক উপহার- তাঁর আঁকা এক পেইন্টিং। সালভাদর দালির সাথে লোরকার ছিল গভীর বন্ধুত্ব, যার প্রতিধ্বনি করেছেন লোরকা: ‘দালির পেইন্টিং থাকবে আমার রুমে, আমার হৃদয়ের পাশে’।

যাদুঘর থেকে বের হয়ে আসলাম সামনের পার্কে, প্রধান ফটকে লেখা ‘পার্কে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা’- গ্রানাদার সবচেয়ে বড় পার্ক, ইউরোপের অন্যতম বড় গোলাপ বাগান। মনোরম সব গোলাপ ছাড়াও বাগানে শোভা পাচ্ছে লিলি, জেসমিন, জেরানিয়াম, পপলার, বার্চ, পাইন ও বিভিন্ন লতা। থোকা থোকা পাকা কমলা নিয়ে কমলা গাছ তো আছেই! লোরকা তাঁর বাসা থেকেই বিভিন্ন ফুলের গন্ধ পেতেন, যা নিয়ে বন্ধু হোর্হে গুইয়েনকে লিখেছিলেন: ‘এখানে এত বেশি জেসমিন ও লেডি অব দি নাইট ফুল আছে যে সূর্য ওঠার আগেই আমাদের মাথা ধরে যায়’।

১৯১৯ সালে লোরকা মাদ্রিদ গমন করেন মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য, থাকতেন সে সময়ের প্রসিদ্ধ ছাত্রাবাস রেসিদেন্সিয়া দে এসতুদিয়ানতেস-এ, সেখানে ছিলেন প্রায় এক দশক। সেখানে থাকাকালীন ১৫ জুন ১৯২১ সালে, তাঁর ২৩তম জন্মবার্ষিকীর ১০ দিন পর, প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতার বই লিব্রো দে পোয়েমাস। স্পেনের গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময়ে লোরকা মাদ্রিদে ছিলেন। তখন স্পেনে অস্থিরতা শুরু হয়ে গেছে। লোরকা এ দুঃসময়ে পরিবারের সাথে থাকার জন্য গ্রানাদা ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর বন্ধু-বান্ধবরা তাঁকে বললেন দেশের বাইরে চলে যেতে, এখানে তাঁর বিপদ হতে পারে। কিন্তু পরিবারের জন্য উদ্বিগ্ন থাকাতে তিনি তাঁর নিজের বিপদের কখা ভাবেননি। তিনি গ্রানাদা ফিরে আসেন ১৪ জুলাই, ১৯৩৬, অবস্থান করতে থাকেন পারিবারের সাথে হুয়ার্তা দে সান বিসেন্তে ভবনে।

জুলাই ১৮, ১৯৩৬ সালে স্পেনে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে, যা সূচনা করে স্পেনীয় গৃহযুদ্ধের, জাতীয়তাবাদী ডানপন্থী ও প্রজাতন্ত্রীদের মধ্যে। লোরকা উদার মানবিক চিন্তার অনুসারী ছিলেন। সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না, তবে প্রজাতন্ত্রীদের প্রতি ছিল তাঁর সহানুভূতি। তাই ডানপন্থী মিলিশিয়ারা কয়েকবার সার্চ করে তাঁদের বাসা। এতে লোরকা নিরাপত্তার অভাব অনুভব করে আগস্টের ৯ তারিখে গ্রানাদায় তাঁর কবি বন্ধু লুই রোজালিস-এর পারিবারিক বাসায় চলে যান। লুই রোজালিস ও তাঁর ভাইদের সাথে ডানপন্থী মিলিশিয়াদের সখ্য ছিল। রোজালিসদের বাসা তাই নিরাপদ মনে করেছিলেন লোরকা। একদিন হঠাৎ করে ১০০ জনের অধিক সশস্ত্র মিলিশিয়া সে বাসা ঘেরাও করে, নেতৃত্বে ছিল রুইছ আলনছো, সে মন্তব্য করেছিল: ‘লোরকা কলম দিয়ে যে ক্ষতি করেছে, অনেকে তা বন্দুক দিয়েও করতে পারেনি’। সে বাসা থেকেই লোরকাকে ধরে নিয়ে যায় মিলিশিয়ারা। পরে লুই রোজালিস অনেক চেষ্টা করেছিলেন লোরকাকে বাঁচাতে, কিন্ত তিনি ব্যর্থ হন।

পরে রোজালিসদের বাসা পরিবর্তিত হয়েছে এক হোটেলে, নাম রায়না ক্রিস্টিনা হোটেল, এর অবস্থান প্লা দ্য ত্রিনিদাদ এর পাশেই। এটি লোরকার স্মৃতি বিজড়িত জানতে পেরে আমরা আগের হোটেল ছেড়ে এ হোটেলে চলে আসি। ঢুকেই লবিতে দেখি কার্ড-বোর্ডে তৈরি লোরকার পুরো দৈর্ঘ্যরে অবয়ব, যেন লোরকা দাঁড়িয়ে আছেন, আমাদের স্মিত হেসে স্বাগত জানাচ্ছেন, সামনে তাঁর ব্যবহৃত টাইপ-রাইটার। ব্যবস্থাপক আন্দি অর্তেগা-র সাথে পরিচয় হল। বললাম, লোরকার জন্যই আমরা এ হোটেলে এসেছি। শুনে আন্দি খুব খুুশি হলেন। বললেন, লোরকা এখানে আসেন ৯ আগস্ট, ১৯৩৬ এর রাতে, মাত্র ৭ দিন থাকতে পেরেছিলেন, ছিলেন দোতলার একটি কক্ষে। সে কক্ষটি কি দেখতে পারি, খুবই আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, কক্ষটি আর নাই, কারণ রোজালিসদের বাসা থেকে হোটেলে রূপান্তরের সময় সেটি ভেঙ্গে ফেলা হয়। তবে লোরকার স্মৃতিজড়িত আরো অনেক কিছু আছে। নিয়ে গেলেন হোটেলের রেস্টুরেন্টে, নাম দেয়া হয়েছে ‘এল রিনকন দে লোরকা রেস্টুরেন্তে’। আন্দি বললেন, লোরকা তাঁর জীবনের শেষ সময়ের অনেকটুকু কাটিয়েছেন এ রেস্টুরেন্টে। এর এক কোনায় লোরকার বড় ছবি। রেস্টুরেন্টের মেনুর ওপরে লোরকার ছবি, আর একটি সালাদের নাম ‘এনসালাদা লোরকা’। জানিনা লোরকা এ সালাদ খেতেন কিনা, কেউ সঠিক বলতে পারল না। তবে লাঞ্চের সময় আমরা সবাই এ সালাদটি খেলাম, চমৎকার সালাদ- সেদ্ধ স্যামন মাছের সাথে মিশ্রিত আপেল, জলপাই, চিনাবাদাম ও পালং শাক। লাঞ্চের পর আন্দি বললেন, তোমরা লোরকার স্মৃতি দেখতে এই হোটেলে এসেছ। তোমাদের এখন লোরকার এক সুন্দর স্মৃতি দেখাতে পারি। এরপর আমাদের নিয়ে গেলেন কোণায় রাখা এক পিয়ানোর কাছে; বললেন, এই পিয়ানো লোরকা বাজাতেন তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলিতে। এখানে লোরকা যে স্বরলিপি ব্যবহার করেছেন তা নিয়ে তুমি চাইলে পিয়ানো বাজাতে পার। বললাম, আমি তো পিয়ানো বাজাতে পারিনা, কিন্তু আমার মেয়ে পারে। নাতাশাকে বলতেই সে বসে গেল পিয়ানোর সামনে, লোরকার পিয়ানোতে লোরকার সুরে সুর তুলল। আমরা সবাই তন্ময় হয়ে শুনতে লাগলাম। আমি ভিডিও করার প্রস্তুতি নিতেই নাতাশা নিষেধ করে বলল, বাবা, জাস্ট এনজয় দ্য মোমেন্ট! হ্যাঁ, আমি এ মোমেন্টটি এনজয় করলাম আর স্মৃতিতে ধরে রাখলাম।

আন্দি এরপর আমাদের যা বলল ও দেখাল, তার জন্য আমরা প্রস্তত ছিলাম না। রেস্টুরেন্টটির পাশে একটি করিডোর হোটেলের সামনের লবি থেকে পেছনের দরজা পর্যন্ত চলে গেছে। তার মাঝামাঝি টাঙানো লোরকার একটি ছবি। তার সামনে যেয়ে এক দরজা দেখিয়ে আন্দি বলল, লোরকাকে তাঁর কক্ষ থেকে ধরে এনে এই দরজা দিয়েই নিয়ে যায় তার ঘাতকরা। সেদিন ছিল ১৬ আগস্ট, ১৯৩৬। এরপর লোরকাকে আর কেউ দেখেনি।

গভীর এক বিষাদে আমাদের সবার মন ভরে গেল। নাতাশা বলল, আমরা এই হোটেলে আর থাকব না, এখান থেকেই লোরকাকে ধরে নিয়ে গেছে, তাকে আর পাওয়া যায়নি। আমি বললাম, মন খারাপ করোনা। কালকেই আমরা অন্য হোটেলে চলে যাব।

পরদিন উঠলাম হোটেল পেনসান সান জোয়াকুইন এ। কয়েকশ বছরের পুরনো ভবন, আন্দালুসীয় স্থাপত্যের এক মনোরম নিদর্শন। ঢুকেই মনে হবে এ আরেক আলহাম্বরা- দরজা, জানালা, দেয়াল, মেঝে, সিড়ি, কার্পেট- আলহাম্বরার ডিজাইনের ছাপ। ভবনের মাঝখানে খিলান ঘেরা বর্গাকার চত্বর, ওপরে খোলা আকাশ, মেঝেতে জ্যামিতিক নকশার টাইলের ওপর রঙ-বেরঙের ফুলের টব। অলিন্দের কেন্দ্রে রয়েছে চমৎকার এক ফোয়ারা। গ্রানাদায় আলহাম্বরা-র কী গভীর প্রভাব!

স্পেনীয়রা খুব মিশুক। এ হোটেলের ব্যবস্থাপক ফ্রান্সিককো অর্তিজ-ও এর ব্যতিক্রম নন। তবে অন্যান্যদের মতো তাঁর অবস্থাও একই- ভাল ইংরেজি বলতে পারেন না। বরাবরের মতোই নাতাশা দোভাষীর কাজ করল। তাই তেমন অসুবিধে হল না। অর্তিজ এক বয়োবৃদ্ধ অমায়িক লোক, তাঁর সাথে অনেক আলাপ হল। কথায় কথায় নাতাশা বলল, আমার বাবা একজন লেখক, তোমাদের শ্রেষ্ট কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার উপর এক বই লিখছেন। তিনি খুব বিস্মিত, একই সাথে আনন্দিত হলেন। বললেন, তোমার জন্য কী করতে পারি মনে মনে বললাম, আমাদের হোটেলের ভাড়া মাফ করে দিতে পার। মুখে বললাম, ‘গ্রাসিয়াস’! আশে পাশে লোরকার স্মৃতিমূলক কিছু স্থান থাকলে বলতে পারেন। এ কথা শুনে নড়ে চড়ে বসলেন অর্তিজ। বুঝতে পারলাম লোরকার উপর বড় সড় এক বক্তৃতা দেবেন। গ্রানাদার লোকদের এক বড় বাতিক। লোরকা বা আলহাম্বরা-র কথা জিজ্ঞেস করলেই তারা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভা-ার নিয়ে বসবেন। এর সাথে সময় ও সুযোগ বুঝে অনেকে কল্পনার মাধুরীও মিশিয়ে দেন। কেউ ভাব দেখাবেন যেন লোরকার সাথে মোড়ের বারে বসে বিয়ার পান করেছেন, অথবা আলহাম্বরা-য় হানিমুনের কয়েকটি দিন কাটিয়ে এসেছেন।

অর্তিজ অবশ্য সে ধারায় গেলেন না। শুধু বললেন, তার হোটেলটির সামনের গলি-‘কায়ে মেনো দে হিয়ারো’- এর ওপর লোরকা প্রায়ই হেঁটে যেতেন, সেখান থেকে কুয়েস্তা দে গোমেরেছ রাস্তা ধরে যেতেন আলহাম্বরা-র বাগানে।

নাবিল আমাকে আস্তে করে বলল, লোরকা ও আলহাম্বরা এখানেও- লোরকাকে গলি দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে গেল আলহাম্বরা-য়।

তবে এ কথাটি দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে গ্রানাদাবাসীর সবচেয়ে গৌরবের দুটি জিনিস- লোরকা ও আলহাম্বরা; আবার সবচেয়ে দুঃখের দুটি জিনিস- লোরকা ও আলহাম্বরা। (চলবে)

Ref:

১. আমি গার্সিয়া লোরকা, কবি, অনুবাদ: এমদাদ রহমান

২ . Recodo, অনুবাদ: গৌতম দত্ত

৩. Despedida, বিদায়, অনুবাদ: অমিতাভ দাশগুপ্ত

ছবি

জীবনবোধ ও শিল্পকর্ম

ছবি

নজরুলের গল্প ও উপন্যাস

ছবি

কৃষ্ণাঙ্গ দাস থেকে হয়ে উঠেছিলেন খ্যাতিমান কবি

শ্রাবণ বর্ষণে

ছবি

শতবর্ষ পরে ‘মিসেস ডালোওয়ে’

ছবি

স্কাল্পচারের জগতটা আস্তে আস্তে ব্যাপকতা পাচ্ছে

ছবি

চব্বিশের অভ্যুত্থান নিয়ে গ্রন্থ

ছবি

ভিন্নচোখ: নুতন কবিতা সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকা: মৃত্যুর রূপক এবং আন্দালুসিয়ার লোকজ বিশ্বাস

ছবি

কবিতার শিল্পনিষ্ঠ রূপকার ফারুক মাহমুদ

ছবি

কাফকাকে পড়া কাফকাকে পড়ানো

ছবি

কবি নওশাদ নূরী

ছবি

আঁধার পেরিয়ে আলোর উদ্ভাষণ

ছবি

সন্জীদা খাতুন : কৃতি ও কৃতিত্ব

ছবি

ব্রেশায় উড়োজাহাজ

ছবি

মননশস্যের অমৃত মন্থন

ছবি

অনুবাদ ও ভূমিকা : আলী সিদ্দিকী

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বড়শি

ছবি

কাফকাকে পড়া, কাফকাকে পড়ানো

এ মুখর বরষায়

ছবি

রক্তে লেখা প্রেম: রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বিপ্লব

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

শঙ্খজীবন: যাপিত জীবনের অন্তর্গূঢ় প্রতিকথা

ছবি

ওসামা অ্যালোমার এক ঝুড়ি খুদে গল্প

ছবি

প্রযুক্তির আলোয় বিশ্বব্যাপী বইবাণিজ্য

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ব্রেশায় উড়োজাহাজ

ছবি

কাফকার কাছে আমাদের ঋণ স্বীকার

ছবি

কাফকাকে পড়া, কাফকাকে পড়ানো

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

সূর্যের দেশ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

লড়াই

সাময়িকী কবিতা

tab

সাময়িকী

লোরকার দেশে

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ

ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-৯

বৃহস্পতিবার, ০৫ জুন ২০২৫

(পূর্ব প্রকাশের পর)

ফুয়েন্তে বাকেরোজ গ্রামে লোরকার জন্মভিটা দেখার সময় গাইড বললেন, তাঁর স্মৃতি এখানেই শেষ নয়। মাত্র ৩ মাইল দুরের ভালদাররুবিও গ্রামেও লোরকার স্মৃতি মিশে আছে। এত কাছে, সেখানে না যেয়ে কি পারা যায়

ভালদাররুবিও-র এক বাড়িতে লোরকার পরিবার ১৯০৬ থেকে ১৯০৮ সালের মাঝে বাস করেছেন, আর সেটি তাদের গ্রীষ্মনিবাস ছিল ১৯২৬ সাল পর্যন্ত। লোরকার পিতা ছিলেন সম্পন্ন ভূস্বামী, বাড়িটি তাঁর ব্যবসার প্রয়োজনে কেনা হয়েছিল। তাই এটি ছিল মূলত খামারবাড়ি- কৃষিকাজের অনেক হাতিয়ার এখনো রাখা আছে কয়েকটি কামরায়।

বাড়িটিতে ঢুকে দেখি খামারবাড়ির গোলাঘর, দোতলায়। পেছনে বাঁধানো উঠান, পাশে বাগান। নিচে প্রথমে বসার ঘর, তারপর শোয়ার ঘর, খাবার ঘর, রান্নাঘর- সবকিছুতেই ঐতিহ্যের ছোঁয়া। সবচেয়ে সুন্দর ঘরে দেখি একটি নকশা-করা পিয়ানো, যা বাজাতেন লোরকার মা, আর মার সাথে প্রায়ই যোগ দিতেন লোরকা। তাঁর স্বপ্ন ছিল মা’র মতো তিনি একজন পিয়ানোবাদক হবেন। তবে পিয়ানো ছিল তাঁর আজীবনের সাথী- যেখানেই ছিলেন সেখানেই ছিল একটি সুন্দর পিয়ানো। তাই লোরকার কবিতার আত্মায় মিশে আছে গানের সুর।

আট বছর আগে ফুয়েন্তে বাকেরোজ-এ লোরকার জন্ম হলেও এ ভালদাররুবিও গ্রামেই তাঁর শৈশব কাটে, যার কথা তিনি বলেছেন: আমি বেড়ে উঠেছিলাম প্রকৃতির সঙ্গে, অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে। দুনিয়ার সমস্ত শিশুর মত, প্রত্যেকটি জিনিস, আসবাবপত্র, লতাগুল্মবৃক্ষ আর পাথরগুলো, অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ছিল আমার কাছে। ...অবিরাম কথা বলতাম তাদের সঙ্গে। ...”১

শৈশব ফিরে ফিরে এসেছে লোরকার স্মৃতিতে, তাঁর কবিতায়:

আমি চলে যেতে চাই ছোট্টবেলাতে

আর ছোট্টবেলা থেকে ছায়ায়।

বুলবুল, তুইও যাবি

যাওয়াই ভালো!

আমি ফিরতে চাই ছায়ায়

আর ছায়া থেকে যাবো ফুলে।

আতর তুইও যাবি

যাওয়াই ভালো!

আমি ফিরতে চাই ফুলে

আর ফুল থেকে

আমার হৃদয়ে। ২

ফুয়েন্তে বাকেরোজ ও ভালদাররুবিও- এ দুটি গ্রামে ঘুরে ঘুরে লোরকার অনেক স্মৃতি জমা করে রেখেছি। মনে হলো গ্রানাদা আসা সার্থক হলো, এরপর আর কিছু না দেখলেও চলবে।

হোটেলে ফিরে নিত্যদিনের মতো সবাই বসলাম ঘরোয়া সভায়, আলোচনার উদ্দেশ্য- আজ কী দেখলাম, কাল কী দেখব। সাথে, আজ কী খেলাম, কাল কী খাব। এক পর্যায়ে নাবিল বলল, তোমার মিস্টার লোরকার আর ক’টা জায়গা বাকি আছে

আমি বললাম, শুরু হলো মাত্র, আরো অনেক বাকি আছে। লোরকা সারা গ্রানাদায় মিশে আছেন। শুধু কি গ্রানাদায় তা ছাড়িয়ে আন্দালুসিয়ায়, এবং পুরো স্পেনে লোরকা ছড়িয়ে আছেন। আগে গ্রানাদার স্মৃতিগুলি শেষ করি, এরপর আন্দালুসিয়ার অন্য শহরে, পরে পুরো স্পেনে তা খুঁজে বেড়াব।

এরা একটু হতাশ হয়ে বলল- মিস্টার লোরকাকে দেখতে দেখতে আর অন্য কিছু দেখা হবে না। আমি একটু হালকা প্রতিবাদের সুরে বললাম- সবই দেখা সম্ভব, যদি আমাদের টাইম ম্যানেজমেন্ট ভাল হয়। তাছাড়া, লোরকার লেখায় উঠে এসেছে গ্রানাদা। তাঁর দেখা গ্রানাদার সাথে তোমাদের দেখা গ্রানাদাকে মিলিয়ে দেখ। তাঁর কবিতা পছন্দ কর দু’জনেই একস্বরে বলে উঠল ‘না’। বললাম, কেন

যেরকম আশা করেছিলাম সেরকম উত্তরই এলো। বলল, মিস্টার লোরকার কবিতা আমরা বুঝি না। আমি মনে মনে বললাম, আমিও যে ভাল বুঝি, তা নয়, তবে বোঝার চেষ্টা করি। তবে মুখে বললাম, লোরকার কবিতা বুঝতে সহজ হবে, যদি আমরা যাই তাঁর স্মৃতি-জড়ানো জায়গায়- কোথায় তিনি জন্ম নিয়েছেন, বড় হয়েছেন, কোন স্কুলে গিয়েছেন, কোথায় ঘোরাঘুরি করেছেন, আড্ডা দিয়েছেন, পিয়ানো বাজিয়েছেন, নাটক করেছেন, কোন টেবিলে বসে কবিতা লিখেছেন- তা আমাদের দেখতে হবে, জানতে হবে। লোরকার দেখা গ্রানাদার সাথে আমাদের দেখা গ্রানাদাকে মিলিয়ে দেখতে হবে। তাছাড়া, লোরকার জীবনে এক বড় ট্র্যাজেডি আছে, তা গ্রানাদারও ট্র্যাজেডি, স্পেনেরও ট্র্যাজেডি, আমাদেরও ট্র্যাজেডি। তা-ও জানতে হবে।

তারা কোনো উত্তর দিল না। আমি ‘মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ’ ধরে নিয়ে লোরকাকে দেখার, জানার প্রচেষ্টা চালু রাখলাম।

পরদিন, রোদ ঝলমলে শীতের সকালে, টেক্সি নিয়ে সবাই পৌঁছলাম হুয়ার্তা দে সান বিসেন্তে ভবনে। হুয়ার্তা অর্থ হলো বাগানবাড়ী। এটি সত্যিই ছিল এক বাগানবাড়ি- ১৯২৬ থেকে ১৯৩৬ পর্যন্ত এটি ছিল লোরকা পরিবারের গ্রীষ্ম-নিবাস। লোরকার পিতা ফেদেরিকো গার্সিয়া রদরিগাজ ২৭ মে ১৯২৫ সালে বাড়িটি কিনেছিলেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ‘বিসেন্তে লোরকা রোমেরো’, তাঁর নামে এ বাড়িটির নাম দেন ‘হুয়ার্তা দে সান বিসেন্তে’। কবি তাঁর লোরকা পদবী পেয়েছেন মায়ের কাছ থেকে, আর বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন ফেদেরিকো গার্সিয়া।

সে সময় বাগানবাড়িটি ছিল শহরের বাইরে গাছপালা ঘেরা সবুজ এলাকা ভেগায়। পরে শহর সম্প্রসারিত হলে এটি এসে পড়ে গ্রানাদা শহর এলাকায়। নগর সম্প্রসারণের সময় কর্তৃপক্ষ এ বাড়িটি ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করে। পরে জনগণের প্রতিবাদের মুখে জানুয়ারি ১৯৭৬ এ বাড়িটি সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

‘হুয়ার্তা দে সান বিসেন্তে’বাড়িটি ঘিরে লোরকার অনেক সুন্দর স্মৃতি আছে। বাড়িটির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে লোরকা দেখতেন- সিয়েরা নেভাদা, আলহাম্বরা, আলবাইসিন- যার কথা চিঠিতে বলেছেন এক বন্ধুকে: ‘আমার ব্যালকনির সামনে গ্রানাদা, অনন্য সৌন্দর্যে দূরে প্রসারিত’। এ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েই কি লোরকা লিখেছিলেন:

মৃত্যু ঘনিয়ে এলে

ব্যালকনি সরিয়ে দেবেন।

দোহাই।

ছেলেটা কমলালেবু খাচ্ছে।

আমার বারান্দা থেকে স্পষ্ট দেখা যায়।

চাষী কাস্তে দিয়ে ফসল কাটছে।

আমার বারান্দা থেকে স্পষ্ট শোনা যায়।

মৃত্যু ঘনিয়ে এলে

ব্যালকনি সরিয়ে দেবেন।

দোহাই আপনার।২

বাসার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে লোরকা যে দৃশ্য দেখেছেন তা দেখার ভাগ্য আমাদের হলো না। সময়ের ব্যবধানে সে ব্যালকনির দিকে অনেক সুউচ্চ ভবন নির্মিত হওয়ায় গ্রানাদার এ ল্যান্ডমার্কগুলি এখান থেকে আর দেখা যায় না। এ বাড়িতে বসে লোরকা রচনা করেছেন দু’টি ট্রাজিক নাটক- ১৯৩২ সালে বোদাস দে সাংগ্রে (রক্ত বিবাহ) এবং ১৯৩৪ সালে ইয়ের্মা।

লোরকার বোন ইসাবেল গার্সিয়া লোরকা ৬ এপ্রিল ১৯৮৫ তারিখে হুয়ার্তা দে সান বিসেন্তে বাড়িটি শহর কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করেন, লক্ষ্য- লোরকা স্মৃতি যাদুঘর করা। ১০ মে ১৯৯৫ সালে উদ্বোধন করা হয় এ স্মৃতি যাদুঘর-কাসা মুজেও ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা: হুয়ার্তা দে সান বিসেন্তে।

টিকেট কেটে প্রবেশ করলাম হুয়ার্তা দে সান বিসেন্তে ভবনে। মিনিট পনের পরে পরবর্তী গাইডেড ট্যুর শুরু হবে। এক একটি গ্রুপে ১০ জন, ৪৫ মিনিট পর এক একটি ট্যুর। লেইলা সেলেজার- আমাদের চটপটে সুন্দরী ট্যুর গাইড, এসে নিজের পরিচয় দিয়ে আমাদেরকে স্বাগত জানাল। বসার ঘর থেকে ট্যুর শুরু, এখানে পুরনো কিন্তু অভিজাত আসবাবপত্র। এরপর খাবার ঘর, রান্নাঘর- সবখানেই সেই বনেদি পরিবারের রুচির ছাপ। তারপর দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। সেখানে প্রথম কক্ষটি বসার ঘর। এরপর লোরকার শোবার ঘর, সেখানে তার ব্যবহৃত খাট। পাশে লেখার ডেস্ক, এর ওপর এক পোস্টার ‘আল বারাকা’। প্রজাতন্ত্রী সরকারের সহায়তায় ১৯৩২ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার দল ‘আল বারাকা’কে নিয়ে লোরকা স্পেনের বিভিন্ন গ্রামে ২০০টি নাটক মঞ্চস্থ করেন। এ দলের উদ্দেশ্য নিয়ে লোরকা বলেন: ‘আমরা নাটককে- লাইব্রেরী থেকে বের করে আনব, আর প-িতদের কাছ থেকে সরিয়ে নেব, আর প্রদর্শন করব গ্রামের মাঠে বিশুদ্ধ বাতাস ও সূর্যালোকে’।

এর পরে পিয়ানো রুম। এখানে ঢুকতেই চোখে পড়ল জানালার পাশে সুন্দর এক পিয়ানো, এক কোণে একটি গ্রামোফোন, যাতে লোরকা বাজাতেন বিটোফেন ও বাখ-এর সিম্ফনি। আর দেয়ালে টাঙানো অনেকগুলি ছবি। তার মাঝে একটি চিত্র লোরকাকে দেয়া সালভাদর দালির এক উপহার- তাঁর আঁকা এক পেইন্টিং। সালভাদর দালির সাথে লোরকার ছিল গভীর বন্ধুত্ব, যার প্রতিধ্বনি করেছেন লোরকা: ‘দালির পেইন্টিং থাকবে আমার রুমে, আমার হৃদয়ের পাশে’।

যাদুঘর থেকে বের হয়ে আসলাম সামনের পার্কে, প্রধান ফটকে লেখা ‘পার্কে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা’- গ্রানাদার সবচেয়ে বড় পার্ক, ইউরোপের অন্যতম বড় গোলাপ বাগান। মনোরম সব গোলাপ ছাড়াও বাগানে শোভা পাচ্ছে লিলি, জেসমিন, জেরানিয়াম, পপলার, বার্চ, পাইন ও বিভিন্ন লতা। থোকা থোকা পাকা কমলা নিয়ে কমলা গাছ তো আছেই! লোরকা তাঁর বাসা থেকেই বিভিন্ন ফুলের গন্ধ পেতেন, যা নিয়ে বন্ধু হোর্হে গুইয়েনকে লিখেছিলেন: ‘এখানে এত বেশি জেসমিন ও লেডি অব দি নাইট ফুল আছে যে সূর্য ওঠার আগেই আমাদের মাথা ধরে যায়’।

১৯১৯ সালে লোরকা মাদ্রিদ গমন করেন মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য, থাকতেন সে সময়ের প্রসিদ্ধ ছাত্রাবাস রেসিদেন্সিয়া দে এসতুদিয়ানতেস-এ, সেখানে ছিলেন প্রায় এক দশক। সেখানে থাকাকালীন ১৫ জুন ১৯২১ সালে, তাঁর ২৩তম জন্মবার্ষিকীর ১০ দিন পর, প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতার বই লিব্রো দে পোয়েমাস। স্পেনের গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময়ে লোরকা মাদ্রিদে ছিলেন। তখন স্পেনে অস্থিরতা শুরু হয়ে গেছে। লোরকা এ দুঃসময়ে পরিবারের সাথে থাকার জন্য গ্রানাদা ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর বন্ধু-বান্ধবরা তাঁকে বললেন দেশের বাইরে চলে যেতে, এখানে তাঁর বিপদ হতে পারে। কিন্তু পরিবারের জন্য উদ্বিগ্ন থাকাতে তিনি তাঁর নিজের বিপদের কখা ভাবেননি। তিনি গ্রানাদা ফিরে আসেন ১৪ জুলাই, ১৯৩৬, অবস্থান করতে থাকেন পারিবারের সাথে হুয়ার্তা দে সান বিসেন্তে ভবনে।

জুলাই ১৮, ১৯৩৬ সালে স্পেনে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে, যা সূচনা করে স্পেনীয় গৃহযুদ্ধের, জাতীয়তাবাদী ডানপন্থী ও প্রজাতন্ত্রীদের মধ্যে। লোরকা উদার মানবিক চিন্তার অনুসারী ছিলেন। সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না, তবে প্রজাতন্ত্রীদের প্রতি ছিল তাঁর সহানুভূতি। তাই ডানপন্থী মিলিশিয়ারা কয়েকবার সার্চ করে তাঁদের বাসা। এতে লোরকা নিরাপত্তার অভাব অনুভব করে আগস্টের ৯ তারিখে গ্রানাদায় তাঁর কবি বন্ধু লুই রোজালিস-এর পারিবারিক বাসায় চলে যান। লুই রোজালিস ও তাঁর ভাইদের সাথে ডানপন্থী মিলিশিয়াদের সখ্য ছিল। রোজালিসদের বাসা তাই নিরাপদ মনে করেছিলেন লোরকা। একদিন হঠাৎ করে ১০০ জনের অধিক সশস্ত্র মিলিশিয়া সে বাসা ঘেরাও করে, নেতৃত্বে ছিল রুইছ আলনছো, সে মন্তব্য করেছিল: ‘লোরকা কলম দিয়ে যে ক্ষতি করেছে, অনেকে তা বন্দুক দিয়েও করতে পারেনি’। সে বাসা থেকেই লোরকাকে ধরে নিয়ে যায় মিলিশিয়ারা। পরে লুই রোজালিস অনেক চেষ্টা করেছিলেন লোরকাকে বাঁচাতে, কিন্ত তিনি ব্যর্থ হন।

পরে রোজালিসদের বাসা পরিবর্তিত হয়েছে এক হোটেলে, নাম রায়না ক্রিস্টিনা হোটেল, এর অবস্থান প্লা দ্য ত্রিনিদাদ এর পাশেই। এটি লোরকার স্মৃতি বিজড়িত জানতে পেরে আমরা আগের হোটেল ছেড়ে এ হোটেলে চলে আসি। ঢুকেই লবিতে দেখি কার্ড-বোর্ডে তৈরি লোরকার পুরো দৈর্ঘ্যরে অবয়ব, যেন লোরকা দাঁড়িয়ে আছেন, আমাদের স্মিত হেসে স্বাগত জানাচ্ছেন, সামনে তাঁর ব্যবহৃত টাইপ-রাইটার। ব্যবস্থাপক আন্দি অর্তেগা-র সাথে পরিচয় হল। বললাম, লোরকার জন্যই আমরা এ হোটেলে এসেছি। শুনে আন্দি খুব খুুশি হলেন। বললেন, লোরকা এখানে আসেন ৯ আগস্ট, ১৯৩৬ এর রাতে, মাত্র ৭ দিন থাকতে পেরেছিলেন, ছিলেন দোতলার একটি কক্ষে। সে কক্ষটি কি দেখতে পারি, খুবই আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, কক্ষটি আর নাই, কারণ রোজালিসদের বাসা থেকে হোটেলে রূপান্তরের সময় সেটি ভেঙ্গে ফেলা হয়। তবে লোরকার স্মৃতিজড়িত আরো অনেক কিছু আছে। নিয়ে গেলেন হোটেলের রেস্টুরেন্টে, নাম দেয়া হয়েছে ‘এল রিনকন দে লোরকা রেস্টুরেন্তে’। আন্দি বললেন, লোরকা তাঁর জীবনের শেষ সময়ের অনেকটুকু কাটিয়েছেন এ রেস্টুরেন্টে। এর এক কোনায় লোরকার বড় ছবি। রেস্টুরেন্টের মেনুর ওপরে লোরকার ছবি, আর একটি সালাদের নাম ‘এনসালাদা লোরকা’। জানিনা লোরকা এ সালাদ খেতেন কিনা, কেউ সঠিক বলতে পারল না। তবে লাঞ্চের সময় আমরা সবাই এ সালাদটি খেলাম, চমৎকার সালাদ- সেদ্ধ স্যামন মাছের সাথে মিশ্রিত আপেল, জলপাই, চিনাবাদাম ও পালং শাক। লাঞ্চের পর আন্দি বললেন, তোমরা লোরকার স্মৃতি দেখতে এই হোটেলে এসেছ। তোমাদের এখন লোরকার এক সুন্দর স্মৃতি দেখাতে পারি। এরপর আমাদের নিয়ে গেলেন কোণায় রাখা এক পিয়ানোর কাছে; বললেন, এই পিয়ানো লোরকা বাজাতেন তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলিতে। এখানে লোরকা যে স্বরলিপি ব্যবহার করেছেন তা নিয়ে তুমি চাইলে পিয়ানো বাজাতে পার। বললাম, আমি তো পিয়ানো বাজাতে পারিনা, কিন্তু আমার মেয়ে পারে। নাতাশাকে বলতেই সে বসে গেল পিয়ানোর সামনে, লোরকার পিয়ানোতে লোরকার সুরে সুর তুলল। আমরা সবাই তন্ময় হয়ে শুনতে লাগলাম। আমি ভিডিও করার প্রস্তুতি নিতেই নাতাশা নিষেধ করে বলল, বাবা, জাস্ট এনজয় দ্য মোমেন্ট! হ্যাঁ, আমি এ মোমেন্টটি এনজয় করলাম আর স্মৃতিতে ধরে রাখলাম।

আন্দি এরপর আমাদের যা বলল ও দেখাল, তার জন্য আমরা প্রস্তত ছিলাম না। রেস্টুরেন্টটির পাশে একটি করিডোর হোটেলের সামনের লবি থেকে পেছনের দরজা পর্যন্ত চলে গেছে। তার মাঝামাঝি টাঙানো লোরকার একটি ছবি। তার সামনে যেয়ে এক দরজা দেখিয়ে আন্দি বলল, লোরকাকে তাঁর কক্ষ থেকে ধরে এনে এই দরজা দিয়েই নিয়ে যায় তার ঘাতকরা। সেদিন ছিল ১৬ আগস্ট, ১৯৩৬। এরপর লোরকাকে আর কেউ দেখেনি।

গভীর এক বিষাদে আমাদের সবার মন ভরে গেল। নাতাশা বলল, আমরা এই হোটেলে আর থাকব না, এখান থেকেই লোরকাকে ধরে নিয়ে গেছে, তাকে আর পাওয়া যায়নি। আমি বললাম, মন খারাপ করোনা। কালকেই আমরা অন্য হোটেলে চলে যাব।

পরদিন উঠলাম হোটেল পেনসান সান জোয়াকুইন এ। কয়েকশ বছরের পুরনো ভবন, আন্দালুসীয় স্থাপত্যের এক মনোরম নিদর্শন। ঢুকেই মনে হবে এ আরেক আলহাম্বরা- দরজা, জানালা, দেয়াল, মেঝে, সিড়ি, কার্পেট- আলহাম্বরার ডিজাইনের ছাপ। ভবনের মাঝখানে খিলান ঘেরা বর্গাকার চত্বর, ওপরে খোলা আকাশ, মেঝেতে জ্যামিতিক নকশার টাইলের ওপর রঙ-বেরঙের ফুলের টব। অলিন্দের কেন্দ্রে রয়েছে চমৎকার এক ফোয়ারা। গ্রানাদায় আলহাম্বরা-র কী গভীর প্রভাব!

স্পেনীয়রা খুব মিশুক। এ হোটেলের ব্যবস্থাপক ফ্রান্সিককো অর্তিজ-ও এর ব্যতিক্রম নন। তবে অন্যান্যদের মতো তাঁর অবস্থাও একই- ভাল ইংরেজি বলতে পারেন না। বরাবরের মতোই নাতাশা দোভাষীর কাজ করল। তাই তেমন অসুবিধে হল না। অর্তিজ এক বয়োবৃদ্ধ অমায়িক লোক, তাঁর সাথে অনেক আলাপ হল। কথায় কথায় নাতাশা বলল, আমার বাবা একজন লেখক, তোমাদের শ্রেষ্ট কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার উপর এক বই লিখছেন। তিনি খুব বিস্মিত, একই সাথে আনন্দিত হলেন। বললেন, তোমার জন্য কী করতে পারি মনে মনে বললাম, আমাদের হোটেলের ভাড়া মাফ করে দিতে পার। মুখে বললাম, ‘গ্রাসিয়াস’! আশে পাশে লোরকার স্মৃতিমূলক কিছু স্থান থাকলে বলতে পারেন। এ কথা শুনে নড়ে চড়ে বসলেন অর্তিজ। বুঝতে পারলাম লোরকার উপর বড় সড় এক বক্তৃতা দেবেন। গ্রানাদার লোকদের এক বড় বাতিক। লোরকা বা আলহাম্বরা-র কথা জিজ্ঞেস করলেই তারা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভা-ার নিয়ে বসবেন। এর সাথে সময় ও সুযোগ বুঝে অনেকে কল্পনার মাধুরীও মিশিয়ে দেন। কেউ ভাব দেখাবেন যেন লোরকার সাথে মোড়ের বারে বসে বিয়ার পান করেছেন, অথবা আলহাম্বরা-য় হানিমুনের কয়েকটি দিন কাটিয়ে এসেছেন।

অর্তিজ অবশ্য সে ধারায় গেলেন না। শুধু বললেন, তার হোটেলটির সামনের গলি-‘কায়ে মেনো দে হিয়ারো’- এর ওপর লোরকা প্রায়ই হেঁটে যেতেন, সেখান থেকে কুয়েস্তা দে গোমেরেছ রাস্তা ধরে যেতেন আলহাম্বরা-র বাগানে।

নাবিল আমাকে আস্তে করে বলল, লোরকা ও আলহাম্বরা এখানেও- লোরকাকে গলি দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে গেল আলহাম্বরা-য়।

তবে এ কথাটি দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে গ্রানাদাবাসীর সবচেয়ে গৌরবের দুটি জিনিস- লোরকা ও আলহাম্বরা; আবার সবচেয়ে দুঃখের দুটি জিনিস- লোরকা ও আলহাম্বরা। (চলবে)

Ref:

১. আমি গার্সিয়া লোরকা, কবি, অনুবাদ: এমদাদ রহমান

২ . Recodo, অনুবাদ: গৌতম দত্ত

৩. Despedida, বিদায়, অনুবাদ: অমিতাভ দাশগুপ্ত

back to top