alt

সাময়িকী

বাঘাডাঙা গাঁও

জুয়েল আশরাফ

: বৃহস্পতিবার, ০৫ জুন ২০২৫

অনেকখন হইল, ওসমানের কান দুইডা চুলকায় চুলকায় গরম হইতাছে। বসে আছে খেজুর গাছতলাতে, খালি গা, গায়ে লুঙ্গি আর মুখে বিশ্রী ভাঁজ। কান চুলকায় পালক দিয়া- মুরগির পালক। হাততালি দিয়া গাছতলার মাটি থেকে পালক কুড়াইছে সকালেই, আর এখন হেইডা দিয়া কানের ভেতর চাঁটাই দিতাছে।

আহারে রে... মাগো... আরাম তো! একেবারে কানের বেটারিতে চার্জ হইয়া যাইতাছে!

কাছে থাইকা বাইচন কাকা পান্তাভাত খাইতে খাইতে জিগায়, তোর কান এতো চুলকায় ক্যান রে ওসু

ওসমান মুখ ঘুইরা কইলো, চুলকায় মানে বুঝোস না আগাম বিপদের বার্তা। কান চুলকায় মানেই কুনু গ্যাঞ্জাম ঘটবার লাইগ্যা রেডি!

বাইচন কাকা হাই তুলে কয়, তোর জীবনে যদি গ্যাঞ্জাম না ঘটে, তাইলে দুনিয়ার সব পিঁপড়া হুজুর হইয়া যায়!

ওসমান তখন লাফ দিয়া ওঠে- কিন্তু কাকা, এইডা অন্যরকম চুলকানি। ইচ্ছে করতাছে কিছু চুরি করি। মোবাইলটা ধরতে মন চাইতাছে খুব!

মোবাইল চুরি করবি তুই তো ডালভাত চোর, হ্যান্ডসেটের কী বুঝিস

ওসমান চোখ ঘুরায়া কয়, ভালো মোবাইল মানেই লাক্সারি। আর লাক্সারি মানেই সুযোগ। আমি মোবাইল চুরি করুম। তাও আবার মসজিদের হুজুরের মোবাইল!

অরে ওসু, হুজুরের মোবাইল চুরি করলে তোর তো জানে জান্নাত নাইরে!

তাইলে দোযখে গিয়া চার্জার বসাইব।

তিন দিন পর... গ্রামে চাউর হইয়া গেল- হুজুরের মোবাইল গায়েব! শুক্রবার নামাজের ঠিক আগে মোবাইল ছিল, পরে নাই। আর অমনি ওসমানরে দেখা গেল স্যামসাং হাতে লুঙ্গি উঁচাইয়া ঘুরে বেড়াইতাছে।

গাঁয়ের বাচ্চা পোলাপান জিগায়, ওসু ভাই, এই মোবাইল কই পেলেন

ঢাকায় গেছি, ভাই একখান মার্কেট থাইকা নিয়া আইছি।

বাইচন কাকা পেছন থাইকা চ্যাঁচায়, ঢাকায় গেলি কবে রে গামছা

ওসমান চুপচাপ মুখ ঘুরায়।

ওইদিকে হুজুর ঘোষণা দিলেন, মোবাইল যিনি নিয়েছেন, ফেরত দিলে মাফ করবো। না দিলে আগামীকাল রাতে মিলাদে তার নাম উঠবে।

সেই রাত। মিলাদের ভেতর, আলো নিভে গেল হঠাৎ। তারপরই হুজুর কইলেন, আল্লাহ রহমত করুক, এখনই যার মনে পাপ আছে, সে যেন মোবাইলটা ফেরত দেয়।

সবাই চুপ। হঠাৎ একটা পলিথিনে মোড়া মোবাইল ঝুপ করে নামাজঘরের দরজার পাশে পড়ল। সবাই তাকায়। আর হুজুর কইলেন, -আল্লাহ মহান।

ওদিকে বাইচন কাকা পেছন থাইকা ফিসফিস করে, এইটা হইলো হুজুরের মোবাইল। চোর তো ভয় পাইছে!

পরদিন সকালে ওসমানের চেহারা কেমন জানি ফ্যাকাশে। মুখে শব্দ নাই। শুধু কানে পালক ঢুকায় আর মুখটারে এমন করে ভাঁজায়, যেন কোনোদিন আর মাটির পিঁপড়া ধইরাও মারবে না।

বাইচন কাকা ধুপ কইরা পাশে বসে কইলো, চুরির মোবাইল ফেরত দিয়া লাভ হইছে

ওসমান মুখটা কাঁচুমাচু কইরা কয়, কাকা, মসজিদের ভেতর মোবাইল ভাইব্রেট করতেছিল। কানে লাগাইতেই একটা আরবি অ্যাপ খুইলা গেল! মনে হইল আমারে ‘ইয়া চোর!’ কইতাছে... আমার গায়ের সব লোম খাড়া!

বাইচন কাকা হা কইরা থাকল।

সেই থেইকা ওসমান কানে আর পালক ঢোকায় না। এখন মোবাইল দেখলেই ভয়ে গলা শুকায়। আর সবাই যখন বলে, ওসু ভাই, একটা সেলফি দেন তো!

ওসমান কইয়ে উঠে, আমি চোর না ভাই, আমি ফকির! আমাগো ছবি তুললে ফোনও হারায়!

ভোরবেলা, গাঁয়ের পুকুরপাড়ে ওসমান বসে লুঙ্গি ধুইতেছে। ধুয়ে আবার নিজেই পরে নিচ্ছে। আর মাথার চুল ঝাঁকায়া কইতাছে, এই লুঙ্গিটা না থাকলে জীবনে আমি মদনা ম-ল হইয়া যাইতাম।

এই কথা শুনেই বাইচন কাকা চা হাতে হাজির।

তোরে মদনা ম-ল বানাইতে বেশি কিছু লাগে না। দুইডা বুদ্ধি আর একচিমটি লজ্জা- এই দুটোই তোরে আল্লাহ দেয় নাই।

ওসমান চা দেখে চোখ কপালে তুলে, এইডা কই পাইলি রে কাকা গাঁয়ের নতুন দোকান থাইক্যা নাকি

না, হুজুরের বাড়ি থাইক্যা! চুরি না, খেয়ে বাইর হইছি।

ওসমান গম্ভীর হইয়া কইলো, কাজের কথা কই কাকা। কাল রাইতে আমি আবার স্বপ্ন দেখছি- আমি নাকি চেয়ারম্যান হইয়া গেছি। কাঁধে গামছা, হাতে মাইক। বলতাছি- ‘জনগণের টাকা, জনগণের ধান, ওসমানের তোষামোদে সব হানাহান!’

বাইচন কাকা হাসতে হাসতে চা ঢেলে ফেলে।

তুই চেয়ারম্যান হবি তোরে লোকে এখনো নাম রাখছে ‘ওসমান চোর’! জানস না

জানি কাকা। কিন্তু চোরে পির হইলে সবাই মুরিদ হয়। তোরই তো একবার সাইকেল গায়েব হইছিল, পরে দেখলি খড়ের গাদার নিচে।

ওটা তো তুই লুকায়ছিলি রে ব্যাটা!

ওসমান চুপ। গলা খাঁকরায়া কইলো, ঠিক আছে। আজ থেইকা আমি চুরি ছাইড়া কাম করুম- ইজ্জত দিয়া। মানুষ হইবার সময় আইসে।

তিনদিন পর। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় হুজুরের বাড়ি থাইকা আওয়াজ উঠল, ওরে বাবা! গোডাউন থাইকা এক হাঁড়ি গাওয়া দুধ চুরি গেছে!

পুরা গ্রাম চুপচাপ। ওদিকে ওসমান হাটে ঢুকতাছে, মুখে দুধের গন্ধ। আর পেটটা যেন লাফাইতাছে। বাইচন কাকা চোখ রাঙ্গায়া জিগায়, দুধ খাইছোস

না কাকা! এইটা তো মশার কামড়ের ঘা!

তয় পেট ফুলা ক্যান

ডায়েট করছি। চিড়া আর জল খাইতাছি। ফোলাফুলি স্বাভাবিক।

বাইচন কাকা তখন ওর লুঙ্গির দিকে তাকায়- ভেজা।

লুঙ্গিটা ভেজা ক্যান রে

ওইটা... মানে... ওটা পুকুরের ধারে বসছিলাম তো...

তয় পুকুর তো শুকায়া গেছে রে!

ওটা... মানে হালকা বৃষ্টির পানি!

এই কথা শুনেই পাশের পোলাপান হেসে কুটি কুটি।

ওসমান চাচা, আপনি না কইলেন চুরি ছাড়ছেন

ছাড়ছি তো! শুধু হালকা পান চুরি আর দুধ চুরি। এইডা তো প্রাকৃতিক অধিকার!

পরদিন গাঁয়ে নতুন পোস্টার লাগল- চোর ধরা প্রতিযোগিতা। যে চোর ধইরা দিবে, সে পুরস্কার পাইবে এক হাঁড়ি দুধ, একজোড়া হাওয়াই চটি, আর একখান নতুন গামছা।

ওসমান এই পোস্টার পড়েই মাথায় হাত দিলো। গামছার লোভে যদি নিজেরেই ধরায়া দেই, কেউ কি বুঝবে

বাইচন কাকা পাশ থেইকা ফিসফিস করে, তুই ধরাও, আমরা তোদেরে দুইজনেই পুরস্কার দিবো- তোকে চটি, আর গাঁয়ে শান্তি!

ওসমান নিজেই নিজেরে ধইরা গাঁয়ের মোড়ে গেল। কইলো, আমি চোর! আমিই দুধ চুরি করছি। কিন্তু আমি দুধ খাইছি এই গরিব দেহে, চেয়ারম্যানের বাসার মতন পেট না আমার! অন্তত চটিটা দিয়া যান।

সবাই একসাথে হাসে। হুজুর দুধ ফেরত নেয় না, কইলেন, এই চোররে চেয়ারম্যান বানাইলেও গাঁয়ে আম কুড়াইয়া খাইতে দিব না।

আর ওসমান এখন বাজারে গিয়া চিৎকার করে, ভাইরে! চোরেরাও মানুষ! কদ্দিনে গাঁয়ের মোবাইল ফিরাইছি, দুধ খাইছি- এইবার হাওয়াই চটির লাইগা ভিক্ষা দিছি।

গাঁয়ের মোড়ের পাশেই এবার নতুন একটা গাড়ি দাঁড়ায়- সাদা রঙের প্রাইভেটকার। খাঁচার মতো জানালা খুলে ভেতর থেইক্যা মাথা বের হয়। একটা হলুদ সালোয়ার-কামিজ পরা, কালো চশমা ধরা, ময়না পাখির মতো সুন্দরী মেয়ে। মেয়েটা বলল, এইটা কি বাঘাডাঙা গ্রাম

লোকজন হাঁ করে তাকায়। বাইচন কাকা তো চায়ে চুমুক দিতে ভুলে যায়।

ওসমান তক্ষুনি গামছা গলায় ঝুলায়া গিয়া দাঁড়ায়, জ্বি আপ্নে ঠিক জায়গায় আইছেন। আমি গাইড... মানে, স্থানীয় সচেতন নাগরিক।

মেয়েটা গাড়ি থেইক্যা নামতেই বোরখা পরা এক মহিলা পিছে পিছে নামে।

আমার নাম রওশন আরা তিশা। আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়াই। সোশিওলজি। আসলে আমরা গাঁয়ের লোকের ওপর গবেষণা করতেছি- ‘গ্রামীণ চোর ও সমাজভাবনা’। একটা ফিল্ডওয়ার্ক করতে আসছি।

গাঁয়ের লোকজন গাছের নিচে জড়ো হয়। কারা যেন ফিসফিস করে, এই তিশা আপা তো দেখতেও সুন্দর!

ঢাকার মানুষ, রে বাবা! কতা কইলে ফুলের গন্ধ আসে।

আচ্ছা, এই মাইয়ার চোখ ওসমানের দিকে গেলো না ওসমান নিজের পেট চিপা ধরল, ওরে বাবা, যেন দুধ খাওয়ার পুরনো গন্ধ না বের হয়!

তিশা পাশে এগিয়ে এসে কইলো, আপনি কি এখানে সবচে বেশি পরিচিত মুখ

ওসমান বুক ফুলায়ে বলল, মুই গাঁয়ের সর্বজনশ্রদ্ধেয়... মানে, ‘সাবেক অপবাদপ্রাপ্ত’ চোর। এখন সচেতন লোক।

তিশা খাতা খুলে লেখে, আপনার জীবনে কোনো ঘটনার পর আপনি চুরি ছাড়লেন

ওসমান একবার বাইচনের দিকে তাকায়, আরেকবার নিজের চটি জোড়ার দিকে। তারপর বলে, চটি পাইবার পর। মানে, আমি উপলব্ধি করছি- মানুষরে পায়ের নিচের জুতা দিতে পারলে তার মন কাঁধের উপর উঠবার সাহস পায়।

তিশার মুখে এক টুকরো হাসি খেলে গেল- ভবিষ্যতে কী করতে চান

আমি স্বপ্ন দেখি... গাঁয়ের চেয়ারম্যান হইবার, স্কুল বানাইবার, যেন গাঁয়ের মাইয়া-বুড়িরা আর গরুরে এক ঘাটে দাঁড়ায়া পানি খাইতে না হয়!

লোকজন বিস্মিত! ওসমান এত গভীর কথা কইল কেমনে তিশা একবার চুপ করে থাকে। তারপর গাড়ির জানালার পাশে দাঁড়ায়া কইলো, আপনারে নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখলে অসুবিধা আছে

না আপা। দরকার হইলে ছবিও তুলেন। শুধু আমার চোখের গর্তে ফোকাস কইরেন না- ওখানে স্বপ্নের নোঙর।

পরদিন, গাঁয়ে গুঞ্জন- ঢাকাই মাইয়া তিশা আপা ওসমানের প্রেমে পড়ছে।

বাইচন কাকা রীতিমতো ঈর্ষায় পুড়ে যায়- একদিনের ফিল্ডওয়ার্কে প্রেম হয় একহালি দুধের প্রেমে পড়ে থাকলেই ভালো হইতো।

তিশা চলে গেল। গাড়ির ভেতর থেইক্যা শেষবার জানালা খুলে বলল, আপনার কথাগুলো মন ছুঁয়েছে। একদিন যদি শহরে আসেন, যোগাযোগ করবেন।

ওসমান গামছাটা মাথায় বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে। মুখে তখন পুরা হেমন্ত মুখার্জীর গান- চোখের জলে কথা কয়, দুঃখ কইরে চইলে যায়...

কয়েক সপ্তাহ পরে... ঢাকা থেইকা একখান পত্র আসে। চিঠিতে লেখা- আপনার জীবন কাহিনী আমাদের ফাইনাল থিসিসের অংশ হইতেছে। আপনাকে সম্মানিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হইতেছে। আপনি প্রধান অতিথি। - রওশন আরা তিশা

ওসমান তখন হাঁ করে বাইচন কাকারে কইলো, আমি কি তবে সত্যিই মানুষ হইছি কাকা

বাইচন ধুপ করে বসে পড়ে- ওরে ভাগ্য! চোর থেইকা চেয়ারম্যান, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তা আল্লাহ তোরে অটোবায়োগ্রাফি বানাইতেছে রে!

ওসমান এখন গাঁয়ের স্কুল মাঠে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেয়- ভাইসব, চুরি একটা অস্থায়ী নেশা। প্রেম, সমাজ আর গামছা- এই তিনটা জিনিস মানুষরে বদলাইতে পারে।

লোকজন দাঁত কেলিয়ে হাসে। কেউ কেউ চোখ মুছে।

তিশা ইউনিভার্সিটি থেইকা একটা থিসিস ছাপায়- ‘ওসমান: এক চোরের রূপান্তর।’ বইয়ের শেষ লাইনে লেখা- যে মানুষ নিজের ভুলে হাসে, সে আরেকজনকে কাঁদাতে পারে না।

ছবি

জীবনবোধ ও শিল্পকর্ম

ছবি

নজরুলের গল্প ও উপন্যাস

ছবি

কৃষ্ণাঙ্গ দাস থেকে হয়ে উঠেছিলেন খ্যাতিমান কবি

শ্রাবণ বর্ষণে

ছবি

শতবর্ষ পরে ‘মিসেস ডালোওয়ে’

ছবি

স্কাল্পচারের জগতটা আস্তে আস্তে ব্যাপকতা পাচ্ছে

ছবি

চব্বিশের অভ্যুত্থান নিয়ে গ্রন্থ

ছবি

ভিন্নচোখ: নুতন কবিতা সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকা: মৃত্যুর রূপক এবং আন্দালুসিয়ার লোকজ বিশ্বাস

ছবি

কবিতার শিল্পনিষ্ঠ রূপকার ফারুক মাহমুদ

ছবি

কাফকাকে পড়া কাফকাকে পড়ানো

ছবি

কবি নওশাদ নূরী

ছবি

আঁধার পেরিয়ে আলোর উদ্ভাষণ

ছবি

সন্জীদা খাতুন : কৃতি ও কৃতিত্ব

ছবি

ব্রেশায় উড়োজাহাজ

ছবি

মননশস্যের অমৃত মন্থন

ছবি

অনুবাদ ও ভূমিকা : আলী সিদ্দিকী

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বড়শি

ছবি

কাফকাকে পড়া, কাফকাকে পড়ানো

এ মুখর বরষায়

ছবি

রক্তে লেখা প্রেম: রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বিপ্লব

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

শঙ্খজীবন: যাপিত জীবনের অন্তর্গূঢ় প্রতিকথা

ছবি

ওসামা অ্যালোমার এক ঝুড়ি খুদে গল্প

ছবি

প্রযুক্তির আলোয় বিশ্বব্যাপী বইবাণিজ্য

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ব্রেশায় উড়োজাহাজ

ছবি

কাফকার কাছে আমাদের ঋণ স্বীকার

ছবি

কাফকাকে পড়া, কাফকাকে পড়ানো

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

সূর্যের দেশ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

লড়াই

সাময়িকী কবিতা

tab

সাময়িকী

বাঘাডাঙা গাঁও

জুয়েল আশরাফ

বৃহস্পতিবার, ০৫ জুন ২০২৫

অনেকখন হইল, ওসমানের কান দুইডা চুলকায় চুলকায় গরম হইতাছে। বসে আছে খেজুর গাছতলাতে, খালি গা, গায়ে লুঙ্গি আর মুখে বিশ্রী ভাঁজ। কান চুলকায় পালক দিয়া- মুরগির পালক। হাততালি দিয়া গাছতলার মাটি থেকে পালক কুড়াইছে সকালেই, আর এখন হেইডা দিয়া কানের ভেতর চাঁটাই দিতাছে।

আহারে রে... মাগো... আরাম তো! একেবারে কানের বেটারিতে চার্জ হইয়া যাইতাছে!

কাছে থাইকা বাইচন কাকা পান্তাভাত খাইতে খাইতে জিগায়, তোর কান এতো চুলকায় ক্যান রে ওসু

ওসমান মুখ ঘুইরা কইলো, চুলকায় মানে বুঝোস না আগাম বিপদের বার্তা। কান চুলকায় মানেই কুনু গ্যাঞ্জাম ঘটবার লাইগ্যা রেডি!

বাইচন কাকা হাই তুলে কয়, তোর জীবনে যদি গ্যাঞ্জাম না ঘটে, তাইলে দুনিয়ার সব পিঁপড়া হুজুর হইয়া যায়!

ওসমান তখন লাফ দিয়া ওঠে- কিন্তু কাকা, এইডা অন্যরকম চুলকানি। ইচ্ছে করতাছে কিছু চুরি করি। মোবাইলটা ধরতে মন চাইতাছে খুব!

মোবাইল চুরি করবি তুই তো ডালভাত চোর, হ্যান্ডসেটের কী বুঝিস

ওসমান চোখ ঘুরায়া কয়, ভালো মোবাইল মানেই লাক্সারি। আর লাক্সারি মানেই সুযোগ। আমি মোবাইল চুরি করুম। তাও আবার মসজিদের হুজুরের মোবাইল!

অরে ওসু, হুজুরের মোবাইল চুরি করলে তোর তো জানে জান্নাত নাইরে!

তাইলে দোযখে গিয়া চার্জার বসাইব।

তিন দিন পর... গ্রামে চাউর হইয়া গেল- হুজুরের মোবাইল গায়েব! শুক্রবার নামাজের ঠিক আগে মোবাইল ছিল, পরে নাই। আর অমনি ওসমানরে দেখা গেল স্যামসাং হাতে লুঙ্গি উঁচাইয়া ঘুরে বেড়াইতাছে।

গাঁয়ের বাচ্চা পোলাপান জিগায়, ওসু ভাই, এই মোবাইল কই পেলেন

ঢাকায় গেছি, ভাই একখান মার্কেট থাইকা নিয়া আইছি।

বাইচন কাকা পেছন থাইকা চ্যাঁচায়, ঢাকায় গেলি কবে রে গামছা

ওসমান চুপচাপ মুখ ঘুরায়।

ওইদিকে হুজুর ঘোষণা দিলেন, মোবাইল যিনি নিয়েছেন, ফেরত দিলে মাফ করবো। না দিলে আগামীকাল রাতে মিলাদে তার নাম উঠবে।

সেই রাত। মিলাদের ভেতর, আলো নিভে গেল হঠাৎ। তারপরই হুজুর কইলেন, আল্লাহ রহমত করুক, এখনই যার মনে পাপ আছে, সে যেন মোবাইলটা ফেরত দেয়।

সবাই চুপ। হঠাৎ একটা পলিথিনে মোড়া মোবাইল ঝুপ করে নামাজঘরের দরজার পাশে পড়ল। সবাই তাকায়। আর হুজুর কইলেন, -আল্লাহ মহান।

ওদিকে বাইচন কাকা পেছন থাইকা ফিসফিস করে, এইটা হইলো হুজুরের মোবাইল। চোর তো ভয় পাইছে!

পরদিন সকালে ওসমানের চেহারা কেমন জানি ফ্যাকাশে। মুখে শব্দ নাই। শুধু কানে পালক ঢুকায় আর মুখটারে এমন করে ভাঁজায়, যেন কোনোদিন আর মাটির পিঁপড়া ধইরাও মারবে না।

বাইচন কাকা ধুপ কইরা পাশে বসে কইলো, চুরির মোবাইল ফেরত দিয়া লাভ হইছে

ওসমান মুখটা কাঁচুমাচু কইরা কয়, কাকা, মসজিদের ভেতর মোবাইল ভাইব্রেট করতেছিল। কানে লাগাইতেই একটা আরবি অ্যাপ খুইলা গেল! মনে হইল আমারে ‘ইয়া চোর!’ কইতাছে... আমার গায়ের সব লোম খাড়া!

বাইচন কাকা হা কইরা থাকল।

সেই থেইকা ওসমান কানে আর পালক ঢোকায় না। এখন মোবাইল দেখলেই ভয়ে গলা শুকায়। আর সবাই যখন বলে, ওসু ভাই, একটা সেলফি দেন তো!

ওসমান কইয়ে উঠে, আমি চোর না ভাই, আমি ফকির! আমাগো ছবি তুললে ফোনও হারায়!

ভোরবেলা, গাঁয়ের পুকুরপাড়ে ওসমান বসে লুঙ্গি ধুইতেছে। ধুয়ে আবার নিজেই পরে নিচ্ছে। আর মাথার চুল ঝাঁকায়া কইতাছে, এই লুঙ্গিটা না থাকলে জীবনে আমি মদনা ম-ল হইয়া যাইতাম।

এই কথা শুনেই বাইচন কাকা চা হাতে হাজির।

তোরে মদনা ম-ল বানাইতে বেশি কিছু লাগে না। দুইডা বুদ্ধি আর একচিমটি লজ্জা- এই দুটোই তোরে আল্লাহ দেয় নাই।

ওসমান চা দেখে চোখ কপালে তুলে, এইডা কই পাইলি রে কাকা গাঁয়ের নতুন দোকান থাইক্যা নাকি

না, হুজুরের বাড়ি থাইক্যা! চুরি না, খেয়ে বাইর হইছি।

ওসমান গম্ভীর হইয়া কইলো, কাজের কথা কই কাকা। কাল রাইতে আমি আবার স্বপ্ন দেখছি- আমি নাকি চেয়ারম্যান হইয়া গেছি। কাঁধে গামছা, হাতে মাইক। বলতাছি- ‘জনগণের টাকা, জনগণের ধান, ওসমানের তোষামোদে সব হানাহান!’

বাইচন কাকা হাসতে হাসতে চা ঢেলে ফেলে।

তুই চেয়ারম্যান হবি তোরে লোকে এখনো নাম রাখছে ‘ওসমান চোর’! জানস না

জানি কাকা। কিন্তু চোরে পির হইলে সবাই মুরিদ হয়। তোরই তো একবার সাইকেল গায়েব হইছিল, পরে দেখলি খড়ের গাদার নিচে।

ওটা তো তুই লুকায়ছিলি রে ব্যাটা!

ওসমান চুপ। গলা খাঁকরায়া কইলো, ঠিক আছে। আজ থেইকা আমি চুরি ছাইড়া কাম করুম- ইজ্জত দিয়া। মানুষ হইবার সময় আইসে।

তিনদিন পর। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় হুজুরের বাড়ি থাইকা আওয়াজ উঠল, ওরে বাবা! গোডাউন থাইকা এক হাঁড়ি গাওয়া দুধ চুরি গেছে!

পুরা গ্রাম চুপচাপ। ওদিকে ওসমান হাটে ঢুকতাছে, মুখে দুধের গন্ধ। আর পেটটা যেন লাফাইতাছে। বাইচন কাকা চোখ রাঙ্গায়া জিগায়, দুধ খাইছোস

না কাকা! এইটা তো মশার কামড়ের ঘা!

তয় পেট ফুলা ক্যান

ডায়েট করছি। চিড়া আর জল খাইতাছি। ফোলাফুলি স্বাভাবিক।

বাইচন কাকা তখন ওর লুঙ্গির দিকে তাকায়- ভেজা।

লুঙ্গিটা ভেজা ক্যান রে

ওইটা... মানে... ওটা পুকুরের ধারে বসছিলাম তো...

তয় পুকুর তো শুকায়া গেছে রে!

ওটা... মানে হালকা বৃষ্টির পানি!

এই কথা শুনেই পাশের পোলাপান হেসে কুটি কুটি।

ওসমান চাচা, আপনি না কইলেন চুরি ছাড়ছেন

ছাড়ছি তো! শুধু হালকা পান চুরি আর দুধ চুরি। এইডা তো প্রাকৃতিক অধিকার!

পরদিন গাঁয়ে নতুন পোস্টার লাগল- চোর ধরা প্রতিযোগিতা। যে চোর ধইরা দিবে, সে পুরস্কার পাইবে এক হাঁড়ি দুধ, একজোড়া হাওয়াই চটি, আর একখান নতুন গামছা।

ওসমান এই পোস্টার পড়েই মাথায় হাত দিলো। গামছার লোভে যদি নিজেরেই ধরায়া দেই, কেউ কি বুঝবে

বাইচন কাকা পাশ থেইকা ফিসফিস করে, তুই ধরাও, আমরা তোদেরে দুইজনেই পুরস্কার দিবো- তোকে চটি, আর গাঁয়ে শান্তি!

ওসমান নিজেই নিজেরে ধইরা গাঁয়ের মোড়ে গেল। কইলো, আমি চোর! আমিই দুধ চুরি করছি। কিন্তু আমি দুধ খাইছি এই গরিব দেহে, চেয়ারম্যানের বাসার মতন পেট না আমার! অন্তত চটিটা দিয়া যান।

সবাই একসাথে হাসে। হুজুর দুধ ফেরত নেয় না, কইলেন, এই চোররে চেয়ারম্যান বানাইলেও গাঁয়ে আম কুড়াইয়া খাইতে দিব না।

আর ওসমান এখন বাজারে গিয়া চিৎকার করে, ভাইরে! চোরেরাও মানুষ! কদ্দিনে গাঁয়ের মোবাইল ফিরাইছি, দুধ খাইছি- এইবার হাওয়াই চটির লাইগা ভিক্ষা দিছি।

গাঁয়ের মোড়ের পাশেই এবার নতুন একটা গাড়ি দাঁড়ায়- সাদা রঙের প্রাইভেটকার। খাঁচার মতো জানালা খুলে ভেতর থেইক্যা মাথা বের হয়। একটা হলুদ সালোয়ার-কামিজ পরা, কালো চশমা ধরা, ময়না পাখির মতো সুন্দরী মেয়ে। মেয়েটা বলল, এইটা কি বাঘাডাঙা গ্রাম

লোকজন হাঁ করে তাকায়। বাইচন কাকা তো চায়ে চুমুক দিতে ভুলে যায়।

ওসমান তক্ষুনি গামছা গলায় ঝুলায়া গিয়া দাঁড়ায়, জ্বি আপ্নে ঠিক জায়গায় আইছেন। আমি গাইড... মানে, স্থানীয় সচেতন নাগরিক।

মেয়েটা গাড়ি থেইক্যা নামতেই বোরখা পরা এক মহিলা পিছে পিছে নামে।

আমার নাম রওশন আরা তিশা। আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়াই। সোশিওলজি। আসলে আমরা গাঁয়ের লোকের ওপর গবেষণা করতেছি- ‘গ্রামীণ চোর ও সমাজভাবনা’। একটা ফিল্ডওয়ার্ক করতে আসছি।

গাঁয়ের লোকজন গাছের নিচে জড়ো হয়। কারা যেন ফিসফিস করে, এই তিশা আপা তো দেখতেও সুন্দর!

ঢাকার মানুষ, রে বাবা! কতা কইলে ফুলের গন্ধ আসে।

আচ্ছা, এই মাইয়ার চোখ ওসমানের দিকে গেলো না ওসমান নিজের পেট চিপা ধরল, ওরে বাবা, যেন দুধ খাওয়ার পুরনো গন্ধ না বের হয়!

তিশা পাশে এগিয়ে এসে কইলো, আপনি কি এখানে সবচে বেশি পরিচিত মুখ

ওসমান বুক ফুলায়ে বলল, মুই গাঁয়ের সর্বজনশ্রদ্ধেয়... মানে, ‘সাবেক অপবাদপ্রাপ্ত’ চোর। এখন সচেতন লোক।

তিশা খাতা খুলে লেখে, আপনার জীবনে কোনো ঘটনার পর আপনি চুরি ছাড়লেন

ওসমান একবার বাইচনের দিকে তাকায়, আরেকবার নিজের চটি জোড়ার দিকে। তারপর বলে, চটি পাইবার পর। মানে, আমি উপলব্ধি করছি- মানুষরে পায়ের নিচের জুতা দিতে পারলে তার মন কাঁধের উপর উঠবার সাহস পায়।

তিশার মুখে এক টুকরো হাসি খেলে গেল- ভবিষ্যতে কী করতে চান

আমি স্বপ্ন দেখি... গাঁয়ের চেয়ারম্যান হইবার, স্কুল বানাইবার, যেন গাঁয়ের মাইয়া-বুড়িরা আর গরুরে এক ঘাটে দাঁড়ায়া পানি খাইতে না হয়!

লোকজন বিস্মিত! ওসমান এত গভীর কথা কইল কেমনে তিশা একবার চুপ করে থাকে। তারপর গাড়ির জানালার পাশে দাঁড়ায়া কইলো, আপনারে নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখলে অসুবিধা আছে

না আপা। দরকার হইলে ছবিও তুলেন। শুধু আমার চোখের গর্তে ফোকাস কইরেন না- ওখানে স্বপ্নের নোঙর।

পরদিন, গাঁয়ে গুঞ্জন- ঢাকাই মাইয়া তিশা আপা ওসমানের প্রেমে পড়ছে।

বাইচন কাকা রীতিমতো ঈর্ষায় পুড়ে যায়- একদিনের ফিল্ডওয়ার্কে প্রেম হয় একহালি দুধের প্রেমে পড়ে থাকলেই ভালো হইতো।

তিশা চলে গেল। গাড়ির ভেতর থেইক্যা শেষবার জানালা খুলে বলল, আপনার কথাগুলো মন ছুঁয়েছে। একদিন যদি শহরে আসেন, যোগাযোগ করবেন।

ওসমান গামছাটা মাথায় বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে। মুখে তখন পুরা হেমন্ত মুখার্জীর গান- চোখের জলে কথা কয়, দুঃখ কইরে চইলে যায়...

কয়েক সপ্তাহ পরে... ঢাকা থেইকা একখান পত্র আসে। চিঠিতে লেখা- আপনার জীবন কাহিনী আমাদের ফাইনাল থিসিসের অংশ হইতেছে। আপনাকে সম্মানিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হইতেছে। আপনি প্রধান অতিথি। - রওশন আরা তিশা

ওসমান তখন হাঁ করে বাইচন কাকারে কইলো, আমি কি তবে সত্যিই মানুষ হইছি কাকা

বাইচন ধুপ করে বসে পড়ে- ওরে ভাগ্য! চোর থেইকা চেয়ারম্যান, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তা আল্লাহ তোরে অটোবায়োগ্রাফি বানাইতেছে রে!

ওসমান এখন গাঁয়ের স্কুল মাঠে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেয়- ভাইসব, চুরি একটা অস্থায়ী নেশা। প্রেম, সমাজ আর গামছা- এই তিনটা জিনিস মানুষরে বদলাইতে পারে।

লোকজন দাঁত কেলিয়ে হাসে। কেউ কেউ চোখ মুছে।

তিশা ইউনিভার্সিটি থেইকা একটা থিসিস ছাপায়- ‘ওসমান: এক চোরের রূপান্তর।’ বইয়ের শেষ লাইনে লেখা- যে মানুষ নিজের ভুলে হাসে, সে আরেকজনকে কাঁদাতে পারে না।

back to top