বর্ষা বৃষ্টি কিংবা ভালোবাসার কবিতা
মহাদেব সাহা
এই একখ- সাদা কাগজের উপর মেঘ এসে যখন
দাঁড়ায়
তখন প্রতিটি অক্ষর হয়ে ওঠে একেকটি বৃষ্টির
ফোঁটা,
শব্দগুলি বর্ষাকাল
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি বিন্দু বিন্দু অশ্রুর কবিতা।
মেঘ ভাঙতে ভাঙতে দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে
উত্তর গোলার্ধে যায়।
সাদা কাগজের উপর পড়ে থাকে স্মৃতি,
ভালোবাসার গন্ধ
আমি হাত বাড়িয়ে সেই মেঘবৃষ্টির
স্বর্ণমুদ্রা কুড়াতে থাকি,
এই শাদা কাগজ মুহূর্তে হয়ে ওঠে বিরহী মেঘদূত
অথই গীতবিতান।
কাগজ আবিষ্কারের পূর্বে মানুষ প্রেমের কবিতা
লিখে রেখেছে আকাশে
সেই ভালোবাসার কবিতা এই বৃষ্টি,
এই ভরা বর্ষা।
বৃষ্টিবিনাশী তুমি
নাসির আহমেদ
কার পাপে বৃষ্টি এসে ফিরে যায় বারবার!
আউশ-বোরোর ক্ষেত জলহীন অপেক্ষায় পোড়ে।
নদীকে করেছে নিঃস্ব-কে নিসর্গ নিধনকারী-কে!
নৃশংসতার দায় কাকে দেবে তুমি?
উত্তর অজানা নয়-অভিশপ্ত! নিসর্গের খুনি
নিজেই নিজের হন্তারক।
একদিন তোমার জোনাকি ছিল, পাখি ছিল,
ফুলেফলে সুশোভন লতাগুল্মে সাজানো উদ্যান।
আজ কোনো পাখি নেই, ফলাহার নেই।
আলোকায়নের অঙ্গীকারে একদিন
পিতৃপুরুষের এই ঐতিহ্যের রক্ষাকারী ছিলে
এখন নিজেই তুমি অঙ্গীকার ভঙ্গকারী মরু নাগরিক!
জোনাকিরা অভিমানে নিভিয়ে দিয়েছে নিসর্গের বাতিঘর।
যন্ত্র সভ্যতার কাছে জিম্মি তুমি করেছো স্বাধীন প্রকৃতিকে
বাঘের খাঁচার মুখ খুলে দিলে হরিণ-উদ্যানে!
কী করে তাহলে বৃষ্টি নামে জীবনানন্দের প্রিয় রূপসী বাংলায়!
পাতার ঝালরে আনো রোদ-বৃষ্টি সম্মিলিত নৈসর্গিক সুর
আসবে আবার বৃষ্টি সংগীতের মূর্ছনায়
শ্রাবণের রাত্রি আর সকাল দুপুর।
ঝড়, খড় ও পাখির ছানা
হাসান কল্লোল
ঘরের ভেতর খড়ের গল্প
বর্ষায় ভেজা হুকোর তাপে ঝিমুচ্ছে রাত
খুলে সব পরিতাপ তুমি যাচ্ছ কোথায়
নীল ছাতা সাথে এমন কাল অমাবস্যায়
মোষের দুধের মত গাঢ় দুঃখগুলো
চরের দীর্ঘ ঘাসে কোন আশ্বাসে দুলছে
কে খেলছে কানামাছি কে দেয় সাহসকে
জড়িয়ে আগুনের হাততালি
চলি ভাই আমি ছাপোষা করুণ
কেরানী; এসবের কিছু একটাও কখনো জানিনি
তাই বলে রক্ষা পাবো
ভাবি না, কেননা চরে যখন ঝড় ছোটে
তখন মাথাল জোয়াল কৃষকের
চোয়াল আর কাচা ঘরের খড় একসাথে
ওড়ে অজানার পথে!
সাথে আছ এই বিশ্বাসে ছিলাম নিরালা নদীতে
জলোচ্ছ্বাসের গভীর নাভীতে গিয়ে
জেনেছি মানুষ কতটা অসহায়হতে পারে
ঝড়ে দোলা পাখির ছানাদের মতো!
শ্রাবণ ভোরের রোদ
জিললুর রহমান
ভোরের রোদে, দেখেছিলাম, নাকি সেসব কল্পনাতে,
রামধনুকে তোমার পিঠে আছড়ে পড়ে, রঙ মাখাতে!
দেখেছিলাম! নাকি স্বপ্ন! কাঠবিড়ালী, মাকড়সাকে-
পেরিয়ে যেতে তরতরিয়ে- পুলসেরাতে, ভুল সে রাতে!
দেখেছিলাম, নাকি সেসব কল্পনাতে!
আধেক আলো- মোমের বাতি, দমকা ঝড়ে নেভার ছলে
তোমার নত চোখ রাঙানো প্রাণের জলে ঢেউ জাগালে
দেখেছিলাম, ঝরঝরিয়ে- কান্নাধারা টিনের চালা-
বুক জুড়িয়ে দেয় জমিয়ে, পথের ধারে কোন কুয়াশা।
দেখেছিলাম, নাকি সেসব কল্পনাতে!
তারও পরে ডাকলে তুমি, শোঁশোঁ হাওয়া নায়ের পালে
বুকের কোণে বাজাও বাঁশি মন ভিজিয়ে বৃষ্টি এলে,
দেখেছিলাম, নাকি সেসব কল্পনাতে!
আরেক শ্রাবণের উপান্তে
মাহফুজ আল-হোসেন
শ্রাবণের বৃষ্টিবিরহিত মনের প্রাকার ভিজে ওঠে
মেঘের পলেস্তারা খসে পড়ে ইতিহাসের মতন,
আর আমি হাঁটি রৌদ্রের সিঁড়ি ধরে
অথচ সেখানে আর কিছুই যেন নিশ্চিত নয় হিমশীতল উড়ানের মতোন
এখন আর কেউ আমায় শীতল করে না বৃষ্টিভেজা কলমের মতো
কিংবা অধুনাবাদী চায়ের কাপে ঝড় তোলা উত্তর মানবিকতা
তবুও শ্রাবণের কার্নিশ ধরে এগিয়ে যাক
নাক্ষত্রিক উদবেড়ালের নির্বাক কোমলতা...
বৃষ্টির উস্কানি
ভাগ্যধন বড়ুয়া
উন্মাদনা আমার ভালো লাগে, সবকিছুতে একটু বেশি বেশি যেমন প্রেম, বৃষ্টি, রোদে। শিয়ালের বিয়ে বৃষ্টির চেয়ে ভালো লাগে বান তোলা একটানা বৃষ্টি, আরাম রোদের চেয়ে ভালো লাগে ইঁদুরপোড়া রোদ। বৃষ্টির গভীরতায় বনের সবুজ যেন আরো ঘন গভীর, বৃষ্টির বলয়ে মনে ঢেউ জাগে, স্মৃতি বন্যার মতো তোলপাড় করা তরঙ্গ তোলে, এমন দিনে তারে বলা হয়নি যেসব কথা তারাও উদয় হয় আবার বিলীন হয়ে যায় গতি¯্রােতে...
ফিজিক্সে পড়েছি পৃথিবীতে পরম গতি কিংবা পরম স্থিতি বলে কিছু নেই, সবই আপেক্ষিক কিন্তু আমার কাছে পরমে পূর্ণ প্রাপ্তি, বিশেষ করে প্রমত্ত প্রেম কিংবা টানা বৃষ্টির উসকানি।
কিন্তু এইসব পরমে চরমেও বোবাকান্নার গভীরতা জানে শুধু মন যেখানে আছে স্বপ্নভঙ্গের শ্রাবণ...
অশ্রুবিন্দুর প্রণয়পত্র
যাকিয়া সুমি সেতু
প্রিয়তমা আমার! কান্নাভেজা পৃথিবীর মেয়ে
ব্যথাভরা শ্রাবণের নীল অতল অঝোর ধারা!
তুমি কি জানো, কতো শত হাজার বছর ধরে
আমি ভিজিনি, তোমার জলকথার পদাবলিতে
কতো দিনরাত মুছে গেছে তুমি লিখোনি চিঠি
মেঘফুলখামে, ভেজা কদমফুল চন্দন পাতায়
জানোতো আমি ধানচাষী সবুজশিল্প মৃত্তিকায়
আকাশকান্নায় খুঁজি তোমার বাড়ি জলঘর
মেঘ যখন নদীতে কথা বলে মন্দ্রকণ্ঠে বিজুরি
আমি তখন পারাশর, সত্যবতীর কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন
যতোদূর মনে পড়ে বলেছিলে যেন মেঘচোখে
তুমি এসেছো শ্রবণা নক্ষত্রের রাত পূর্ণিমায়
সপ্তপথ, দ্যুপথ,সুরপথ, বজ্রদ্যুতিপথ পেরিয়ে
তুমি এসেছো জলফুলে নানা মেঘস্বরের সুরে
ম্যামেটাস,ফগ, নক্টিলুসেন্ট, লেন্টিকুলারে
এসেছো আষাঢ় শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে বাংলায়
পু-্রনগর, বরেন্দ্র, রাঢ় হরিকেল গৌড় সমতটে
তোমার জলছায়ায় সিক্ত অর্জুন শাল বৃক্ষবন
তোমারই জলের মধুরিমায় ভিজেছে যুগযুগ
ভিজেছে অমরকণ্টক, বিন্ধ্য পর্বত, দশপুর,
বিদিশা, রেবা মালবিকা, অভিরাম, উজ্জয়িনী
পৃথিবীর জলঘরে তুমি চিরদিন বেদনার মিথ
মুখর বৃষ্টিতে ভিজে তবু কুড়াই অমৃত ধারা
যদি আসো এই শ্রাবণে ধানচাষীর নীল ব্যথায়
দেখবে বুকের পাশেই জলভরা করবী ফুল
পরম যতেœ রেখেছি সব অশ্রুবিন্দুর প্রণয়পত্র
আমোদিত রাত
হাদিউল ইসলাম
আকাশ মেঘলা ক্ষণেক জোছনা
তীব্র কামিনী
আমার ইচ্ছে ছড়ায় বাতাসে
মনটা উতলা
বেভোলা বঁধুয়া শোনো কান পেতে
ঝিঁঝিঁর মন্ত্র
দূরে ধানখেত শরীরে জোছনা
হেলছে দুলছে
তোমার উপমা গড়ন পেয়েছে
চাঁদ ষোলোকলা
মেঘ ঘিরে রয় যেন আমোদিত
রানি মৌমাছি
আমি গান গাই ওগো শিহরণ
খোলো মখমল
গূঢ় বাতায়ন শিখা বিদ্যুৎ
জোনাকি নাচছে
অলাতচক্রে আজ উচাটন
তামার উদয়
পথে উন্মুখ বাসনা মদিরা
আকাশ খিলানে
বুঝি টিপ পরা বুঝি চোখ মারো
ওগো বিদ্যুৎ
রাতের বাংলা কী যে বাঙ্ময়
আছো তো ছড়িয়ে
এমন সত্য জড়োয়া শরীরে
প্রণয় বিলাসী
তোমাকে জড়িয়ে ভাবনা শিখরে
ভাঙছে খোয়ারি
এই অশান্ত শ্রাবণে
ওবায়েদ আকাশ
মাইলস্টোন কলেজের নিহত-আহত শিশুদের প্রতি ক্ষমাপ্রার্থনা
পৃথিবী চাইলেও আর পুনর্জন্ম নিতে পারবে না
যা কিছু হাহাকার, সম্মোহন, মায়া-
কিছুটা মা আর কিছুটা ভ্রাতৃপিতৃভগ্নি সকাশে ফেলে
ওই যে উড়ে গেল বিধ্বস্ত বিমানের ক্রূরতায়
এইসব ফুলেদের অনন্ত ছুটি কি আর
শেষ হবে কোনোদিন?
তুমি কি সাজবে পৃথিবী আবার
হারানো শিশুদের মুখর পরিভাষায়?
ঘন কালো অন্ধকার নাচতে নাচতে
বিদগ্ধ চিৎকার দিয়ে এ কী নিষ্ঠুরতায় বাজাল বিধ্বংসী বাঁশি!
যে শিশুটি আগুনে গলতে গলতে বলেছিল:
‘হাসপাতাল এতদূর কেন মা? তুমি থাকবে তো পাশে?’
সে কেন জাগল না আর এই অশান্ত শ্রাবণে
‘আমি জানতাম তুমি আসবে’- এই শেষ উচ্চারণ করলো যে
বন্ধুটি: আচ্ছা তার বয়স কি
মহাকাশের প্রবীণতর নক্ষত্রের চেয়ে ঢের ঢের বেশি?
অন্যথা কী করে শুনতে পেয়েছিল সু-সখার আগমন ধ্বনি?
জানো মা, যারা দগ্ধ হলো, নিভে গেল, স্তব্ধ হলো, শূন্য...
আমাকে প্রতিটি মুহূর্ত আগলে রাখে এমনি নিষ্পাপ সন্তান যুগল
কেবল ওদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সব কিছু ভুলে যেতে পারি
হ্যাঁ, পারি!! শুধু ভুলতে পারছি না
২১শে জুলাই ২০২৫, সারি সারি ছাইভস্ম, গলিত শিশুদের লাশ
রক্ত, চিৎকার, মা-বাবার বিদীর্ণ আহাজারি!!
আকাশের চিবুকে জমে আছে মেঘ
আদিত্য নজরুল
সম্পাদক মহোদয়
একটি বর্ষার কবিতা লিখতে বললেন
বর্ষা মানেই তো
বৃষ্টির উন্মাতাল নাচ
নদীর মোহন কোমর জুড়ে
যৌবন আকৃষ্ট করা ঢেউ!
পুঁটিমাছ পেটে
রঙধনুর ছাপ নিয়ে
উজানে সাঁতার দিলেই তো বর্ষাকাল!
মেঘের কার্তুজ
শব্দ করতেই
হৈ হৈ রৈ রৈ করে
মাঠ থেকে রাখাল দৌড়ে না পালালে
সাবলীল বর্ষা আসে
আমি সেই কবে থেকেই
বর্ষার তৃষ্ণায়
চেয়ে আছি আকাশে
শুধু দেখি গাভিন গাইয়ের ওলানের মতো
জমে আছে সাদা সাদা মেঘ!
বৃষ্টিঘটিত
পিয়াস মজিদ
বৃষ্টি ঠেকিয়ে রাখছে ছাতা
কিন্তু পৃথিবীর তলে
পাশাপাশি হেঁটে চলা
কোনও দু’জনের
হৃদয় তো ভিজে যাচ্ছেই
বিবর্ণ বর্ণিল জলসা
মুমির সরকার
বৃষ্টি বিঘিœত বর্ণিল জলসায়
বৃষ্টিবন্দী- সুরা আর সাকী,
কী ভীষণ বিবর্ণ এখন!
অথচ জানালার পর্দা সরতেই বাহিরে দেখা-
পত্র-পুষ্প-শিরায় জলের নাচন;
শীতল পরশে ওরা বুঝিবা
কামজ্বরে আরক্ত ছিল এতকাল!
বর্ণিল জলসায় আরক্ত আমিও যেন-বা
নির্বিকার কোনো এক প্রতœমুখ-
বিবর্ণ, কী ভীষণ!
বৃষ্টির নিচে দাঁড়িয়ে
রওশন রুবী
একজন মানুষ ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন-
ছাতার কাপড়ে লেখা ছিল: মনোগ্যামি।
তাকে ধীরে ভিজিয়ে দেয় বৃষ্টি,
যেন অভ্যন্তরীণ নির্ঘোষ ধুয়ে দেয় নামফলক।
তিনি কিছু বলেননি, প্রশ্নও করেননি,
শুধু দেখছিলেন-
শিশুরা কাদায় হাত রেখে আঁকছে প্রতিকৃতি,
যার চোখ ছিল না, ছিল দীর্ঘ নাক-
তাকিয়ে থাকলে বোঝা যায়
সেখানে বাস করে বেদনা।
আরেকজন ওধারে বসেছিলেন হাঁটু মুড়ে,
গায়ে ছিল পত্রমোচড়, ছিন্ন বিষাদবর্ণ,
কপালে লেখা- আমি সুধা নই, আমি প্রশ্ন।
তবু বৃষ্টি তাঁর বুকেই বেশি ঝরেছিল,
কারণ ইতিহাস শুষে নেয় উপেক্ষিত সুর।
আমি থমকে ছিলাম বৃষ্টিরেণু মেখে,
দেখছিলাম- তাঁদের ভক্তদের কোল থেকে
খসে পড়ছে কমলার মতো রোদ।
আমি আমাকে প্রশ্ন করি-
তাঁরা কে আমি কে তঁাঁরা কি বৃষ্টি
আমার সাথে তাঁদের কখনও আলাপ ছিল
ছিল হয়ত, না হলে বৃষ্টির গন্ধ মাতাল করে কেন
দৃশ্য শিকার
মঈনুল হাসান
মেঘ থেকে ঝরে পড়ছে জলের চোখা তীর
সশব্দ পতনে বুঁদ সাগর কিংবা হ্রদে
কিছু নামছে শ্যাওলাজমা কুয়ায়, নিঝুম নদে;
তুমি দেখছ এ এক মায়াবী দৃশ্য
পরিচিত ও চিরাচরিত।
অথচ মেঘ থেকে ছেঁড়া জল
চেয়ে এনেছে বানসম্ভবা নদী-
ডেকে এনেছে বজ্র গম্ভীর কথা
ছেঁকে এনেছে ধ্বংসের কারুকাজ।
নদীতলে এখন মাছেদের রাজধানী
সেখানেও আছে বাণিজ্য, বিনিময় ও বিপণি
রুপালি স্বর্গের মতো ক্রমে গড়ে উঠছে
সুউচ্চ ইমারত, বহু দোকান, মোহনীয় আবাস;
শ্যাওলা লতা ও জলজ পাতাদের ফাঁকে।
অজ¯্র গলিঘুজি রাস্তায় কী অবিরাম চলাচল
জলে নেমে তাই চিৎকার করো না-
সাবধানে হেঁটো, ডুব দিয়ে পা রেখো নিঃশব্দে।
মেঘজলের মতো সংক্ষুব্ধ হয়ো না
প্রক্ষালন ও দোকান ধসে যাবে
প্রাার্থনাঘরের মিনার খসে যাবে
বাণিজ্যের ইমারত ভেঙে যাবে।
ডাঙায় বসে বসে আমরা কুশীলব
কেবল এইসব দৃশ্যের বন্দনা করি,
পতনোন্মুখ জলের মতো উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ি
হিতাহিত জ্ঞান দূরে রেখে শিহরিত হই শুধু।
নদীতলে অথচ স্বপ্ন ভেঙে যায়
চুরমার হয়ে যায় দুধারের তীর
ভেসে যায় বহু মিলন যাপনদৃশ্য
সেসবের কথা কেউ কখনও ভাবেনি।
রাতদিন এমনই দারুণ বর্ষণে
জলের পতনে প্লাবনে ভাঙনে
তুমি দেখছ জলের চুম্বন, রাত্রিদিন
আমি ভাবছি দৃশ্য অদৃশ্যে, হচ্ছে বিলীন।
মরফিউসের সাথে কিছুক্ষণ
আশরাফুল কবীর
এইসব চলমান বৃত্তান্ত ছেড়ে চলো পালিয়ে যাই
থলকমলের কাছে, আজ্ঞাবহ হয়ে শিখে ফেলি
সকল ক্যামোফ্লেজ ছিন্ন করার মূল সূত্রগুলো-
দ্যাখো মিস্টিসিজম ভুলে কীভাবে নদীগুলো মিশে যাচ্ছে
সাগরের বুকে, আর এক পশলা বৃষ্টি দিয়ে কীভাবে
পুরাকালের আকাশ ভিজিয়ে দিচ্ছে সমস্ত মহাতত্ত্বকে
ঝরাকালের ট্র্যাডিশনে থমকে আছে
একটি পরিযায়ী দুপুর, সে দুপুরের ঠাকঠমক ভেদ
করার চেষ্টায় ঝুঁকে আছে জড়সড় ভারুই
কাছে আসার তাড়নায় জঙ্গলে কারফিউ জারি
করেছে এরটিক্ বাতাস;
আকাশের গর্জন পাখিরা বোঝে না,
কিংবা পাখিদের ডানার সম্প্রসারণ ঐ আকাশ
উদভ্রান্ত সময়ে সবকিছু কেমন যেন অগোছালো
যতটা অনুবাদ করার চেষ্টায় সামনে এগোই ঠিক
ততোটাই অনূদিত হয়ে পড়ি, পেছনে টেনে ধরে রাখে
সময়ের প্যাঁচানো অক্টোপাস
খেঁকশিয়াল হয়ে বুকের পাঁজরে ঢুকে যেতে চায়
গোপন ঝড়-বিষাদ, মনঃসমীক্ষণের বিফল চেষ্টায় অযথা
বাগবিত-ায় জড়ায় বাঘা দ্যাবাপৃথিবী
তুমি কি শ্রাবণের ঝড় নাকি সে ঝড়ের আদিরূপ
পলকে উড়েছো, ঘুরেফিরে দ্বীপান্তরিত হয়েছো
দ্যুতিমান প্রহেলিকায়
আমি অযথা খোঁজাখুঁজি করে হয়রান
শতবর্ষী দেবদারুদ্রুম
চলো পালিয়ে যাই, পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় খুঁজে নেই
পরবর্তী অনুচ্ছেদে, দাড়ি-কমা দিয়ে অর্থবোধক
করে নেই একটি সুস্থির দেবালয়
তুমি যাকে ফোটাও
সৌম্য সালেক
তুমি যাকে ফোটাও এ-ফুলে ও-ফুলে
স্তনবৃন্তে অলকায়
এবং তুমি যাকে সাজাও সুফলে
মাংসে ও মদে, উষ্ণ আলতায়
এবং তুমি যাকে রাঙাও নিশিথে
শীত ও শিহরনে রম্য-ক্ষরতায়!
এবং তুমি যাকে নাচাও ছন্দে
নিবিড় নন্দনে মুখর কবিতায়-
তার তারে বৃষ্টি ঝরে নিশিদিন আষাঢ়-শ্রাবণে
তার তরে পুষ্প হাসে অবিরাম প্রেমের ফাগুনে
নাম তার মায়বিনী, সুহাসিনী শ্যামল-সাধিকা
মিথিলের হংস খুশি, তার সখি সকল রাধিকা।
মাইলস্টোনে কাঁদে মন
মোহাম্মদ বিলাল
হাওয়ায় লেগেছে কাঁদন
মাটিতে রক্তের ফোয়ারা
নাড়িছেঁড়া হায় যাদুধন
কান্নায় দেশ মাতোয়ারা!
একালের শোকের ফুরাত
পামর মানুষও পায় দুঃখ
মা-বা কারো মোনাজাত
ছাবাল-সুরাকে কাতর বুক!
শহরে যখন বর্ষা
পূর্ণিয়া সামিয়া
এ শহরে বর্ষা এলে
জলে ধুয়ে যায় কংক্রিটের মন,
ডাস্টবিনের স্রোতে ভেসে যায় ব্যস্ততার ঘাম।
এ শহরে বর্ষা এলে
কাকের চোখে নামে রাজ্যের হতাশা
তিয়াসার জলে ভিজে যায় স্বপ্ন
তবুও লুটপাট হয় না নিখাঁদ প্রেম,
কেবল অযাচিত দাপটে
হুঙ্কার তোলে লোভাতুর ক্ষুধা
আর নিশিগন্ধারা অভিমান ভুলে
ঘুমকে দেয় ছুটি।
এ শহরে বর্ষা যখন আসে
চুপচাপ গলির বাঁকে আঁধার কাছে ডাকে,
আর কদমগুচ্ছ হাতে
হেঁটে বেড়ায় মৃত অথবা জীবিত কোনো কিছু
বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫
বর্ষা বৃষ্টি কিংবা ভালোবাসার কবিতা
মহাদেব সাহা
এই একখ- সাদা কাগজের উপর মেঘ এসে যখন
দাঁড়ায়
তখন প্রতিটি অক্ষর হয়ে ওঠে একেকটি বৃষ্টির
ফোঁটা,
শব্দগুলি বর্ষাকাল
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি বিন্দু বিন্দু অশ্রুর কবিতা।
মেঘ ভাঙতে ভাঙতে দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে
উত্তর গোলার্ধে যায়।
সাদা কাগজের উপর পড়ে থাকে স্মৃতি,
ভালোবাসার গন্ধ
আমি হাত বাড়িয়ে সেই মেঘবৃষ্টির
স্বর্ণমুদ্রা কুড়াতে থাকি,
এই শাদা কাগজ মুহূর্তে হয়ে ওঠে বিরহী মেঘদূত
অথই গীতবিতান।
কাগজ আবিষ্কারের পূর্বে মানুষ প্রেমের কবিতা
লিখে রেখেছে আকাশে
সেই ভালোবাসার কবিতা এই বৃষ্টি,
এই ভরা বর্ষা।
বৃষ্টিবিনাশী তুমি
নাসির আহমেদ
কার পাপে বৃষ্টি এসে ফিরে যায় বারবার!
আউশ-বোরোর ক্ষেত জলহীন অপেক্ষায় পোড়ে।
নদীকে করেছে নিঃস্ব-কে নিসর্গ নিধনকারী-কে!
নৃশংসতার দায় কাকে দেবে তুমি?
উত্তর অজানা নয়-অভিশপ্ত! নিসর্গের খুনি
নিজেই নিজের হন্তারক।
একদিন তোমার জোনাকি ছিল, পাখি ছিল,
ফুলেফলে সুশোভন লতাগুল্মে সাজানো উদ্যান।
আজ কোনো পাখি নেই, ফলাহার নেই।
আলোকায়নের অঙ্গীকারে একদিন
পিতৃপুরুষের এই ঐতিহ্যের রক্ষাকারী ছিলে
এখন নিজেই তুমি অঙ্গীকার ভঙ্গকারী মরু নাগরিক!
জোনাকিরা অভিমানে নিভিয়ে দিয়েছে নিসর্গের বাতিঘর।
যন্ত্র সভ্যতার কাছে জিম্মি তুমি করেছো স্বাধীন প্রকৃতিকে
বাঘের খাঁচার মুখ খুলে দিলে হরিণ-উদ্যানে!
কী করে তাহলে বৃষ্টি নামে জীবনানন্দের প্রিয় রূপসী বাংলায়!
পাতার ঝালরে আনো রোদ-বৃষ্টি সম্মিলিত নৈসর্গিক সুর
আসবে আবার বৃষ্টি সংগীতের মূর্ছনায়
শ্রাবণের রাত্রি আর সকাল দুপুর।
ঝড়, খড় ও পাখির ছানা
হাসান কল্লোল
ঘরের ভেতর খড়ের গল্প
বর্ষায় ভেজা হুকোর তাপে ঝিমুচ্ছে রাত
খুলে সব পরিতাপ তুমি যাচ্ছ কোথায়
নীল ছাতা সাথে এমন কাল অমাবস্যায়
মোষের দুধের মত গাঢ় দুঃখগুলো
চরের দীর্ঘ ঘাসে কোন আশ্বাসে দুলছে
কে খেলছে কানামাছি কে দেয় সাহসকে
জড়িয়ে আগুনের হাততালি
চলি ভাই আমি ছাপোষা করুণ
কেরানী; এসবের কিছু একটাও কখনো জানিনি
তাই বলে রক্ষা পাবো
ভাবি না, কেননা চরে যখন ঝড় ছোটে
তখন মাথাল জোয়াল কৃষকের
চোয়াল আর কাচা ঘরের খড় একসাথে
ওড়ে অজানার পথে!
সাথে আছ এই বিশ্বাসে ছিলাম নিরালা নদীতে
জলোচ্ছ্বাসের গভীর নাভীতে গিয়ে
জেনেছি মানুষ কতটা অসহায়হতে পারে
ঝড়ে দোলা পাখির ছানাদের মতো!
শ্রাবণ ভোরের রোদ
জিললুর রহমান
ভোরের রোদে, দেখেছিলাম, নাকি সেসব কল্পনাতে,
রামধনুকে তোমার পিঠে আছড়ে পড়ে, রঙ মাখাতে!
দেখেছিলাম! নাকি স্বপ্ন! কাঠবিড়ালী, মাকড়সাকে-
পেরিয়ে যেতে তরতরিয়ে- পুলসেরাতে, ভুল সে রাতে!
দেখেছিলাম, নাকি সেসব কল্পনাতে!
আধেক আলো- মোমের বাতি, দমকা ঝড়ে নেভার ছলে
তোমার নত চোখ রাঙানো প্রাণের জলে ঢেউ জাগালে
দেখেছিলাম, ঝরঝরিয়ে- কান্নাধারা টিনের চালা-
বুক জুড়িয়ে দেয় জমিয়ে, পথের ধারে কোন কুয়াশা।
দেখেছিলাম, নাকি সেসব কল্পনাতে!
তারও পরে ডাকলে তুমি, শোঁশোঁ হাওয়া নায়ের পালে
বুকের কোণে বাজাও বাঁশি মন ভিজিয়ে বৃষ্টি এলে,
দেখেছিলাম, নাকি সেসব কল্পনাতে!
আরেক শ্রাবণের উপান্তে
মাহফুজ আল-হোসেন
শ্রাবণের বৃষ্টিবিরহিত মনের প্রাকার ভিজে ওঠে
মেঘের পলেস্তারা খসে পড়ে ইতিহাসের মতন,
আর আমি হাঁটি রৌদ্রের সিঁড়ি ধরে
অথচ সেখানে আর কিছুই যেন নিশ্চিত নয় হিমশীতল উড়ানের মতোন
এখন আর কেউ আমায় শীতল করে না বৃষ্টিভেজা কলমের মতো
কিংবা অধুনাবাদী চায়ের কাপে ঝড় তোলা উত্তর মানবিকতা
তবুও শ্রাবণের কার্নিশ ধরে এগিয়ে যাক
নাক্ষত্রিক উদবেড়ালের নির্বাক কোমলতা...
বৃষ্টির উস্কানি
ভাগ্যধন বড়ুয়া
উন্মাদনা আমার ভালো লাগে, সবকিছুতে একটু বেশি বেশি যেমন প্রেম, বৃষ্টি, রোদে। শিয়ালের বিয়ে বৃষ্টির চেয়ে ভালো লাগে বান তোলা একটানা বৃষ্টি, আরাম রোদের চেয়ে ভালো লাগে ইঁদুরপোড়া রোদ। বৃষ্টির গভীরতায় বনের সবুজ যেন আরো ঘন গভীর, বৃষ্টির বলয়ে মনে ঢেউ জাগে, স্মৃতি বন্যার মতো তোলপাড় করা তরঙ্গ তোলে, এমন দিনে তারে বলা হয়নি যেসব কথা তারাও উদয় হয় আবার বিলীন হয়ে যায় গতি¯্রােতে...
ফিজিক্সে পড়েছি পৃথিবীতে পরম গতি কিংবা পরম স্থিতি বলে কিছু নেই, সবই আপেক্ষিক কিন্তু আমার কাছে পরমে পূর্ণ প্রাপ্তি, বিশেষ করে প্রমত্ত প্রেম কিংবা টানা বৃষ্টির উসকানি।
কিন্তু এইসব পরমে চরমেও বোবাকান্নার গভীরতা জানে শুধু মন যেখানে আছে স্বপ্নভঙ্গের শ্রাবণ...
অশ্রুবিন্দুর প্রণয়পত্র
যাকিয়া সুমি সেতু
প্রিয়তমা আমার! কান্নাভেজা পৃথিবীর মেয়ে
ব্যথাভরা শ্রাবণের নীল অতল অঝোর ধারা!
তুমি কি জানো, কতো শত হাজার বছর ধরে
আমি ভিজিনি, তোমার জলকথার পদাবলিতে
কতো দিনরাত মুছে গেছে তুমি লিখোনি চিঠি
মেঘফুলখামে, ভেজা কদমফুল চন্দন পাতায়
জানোতো আমি ধানচাষী সবুজশিল্প মৃত্তিকায়
আকাশকান্নায় খুঁজি তোমার বাড়ি জলঘর
মেঘ যখন নদীতে কথা বলে মন্দ্রকণ্ঠে বিজুরি
আমি তখন পারাশর, সত্যবতীর কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন
যতোদূর মনে পড়ে বলেছিলে যেন মেঘচোখে
তুমি এসেছো শ্রবণা নক্ষত্রের রাত পূর্ণিমায়
সপ্তপথ, দ্যুপথ,সুরপথ, বজ্রদ্যুতিপথ পেরিয়ে
তুমি এসেছো জলফুলে নানা মেঘস্বরের সুরে
ম্যামেটাস,ফগ, নক্টিলুসেন্ট, লেন্টিকুলারে
এসেছো আষাঢ় শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে বাংলায়
পু-্রনগর, বরেন্দ্র, রাঢ় হরিকেল গৌড় সমতটে
তোমার জলছায়ায় সিক্ত অর্জুন শাল বৃক্ষবন
তোমারই জলের মধুরিমায় ভিজেছে যুগযুগ
ভিজেছে অমরকণ্টক, বিন্ধ্য পর্বত, দশপুর,
বিদিশা, রেবা মালবিকা, অভিরাম, উজ্জয়িনী
পৃথিবীর জলঘরে তুমি চিরদিন বেদনার মিথ
মুখর বৃষ্টিতে ভিজে তবু কুড়াই অমৃত ধারা
যদি আসো এই শ্রাবণে ধানচাষীর নীল ব্যথায়
দেখবে বুকের পাশেই জলভরা করবী ফুল
পরম যতেœ রেখেছি সব অশ্রুবিন্দুর প্রণয়পত্র
আমোদিত রাত
হাদিউল ইসলাম
আকাশ মেঘলা ক্ষণেক জোছনা
তীব্র কামিনী
আমার ইচ্ছে ছড়ায় বাতাসে
মনটা উতলা
বেভোলা বঁধুয়া শোনো কান পেতে
ঝিঁঝিঁর মন্ত্র
দূরে ধানখেত শরীরে জোছনা
হেলছে দুলছে
তোমার উপমা গড়ন পেয়েছে
চাঁদ ষোলোকলা
মেঘ ঘিরে রয় যেন আমোদিত
রানি মৌমাছি
আমি গান গাই ওগো শিহরণ
খোলো মখমল
গূঢ় বাতায়ন শিখা বিদ্যুৎ
জোনাকি নাচছে
অলাতচক্রে আজ উচাটন
তামার উদয়
পথে উন্মুখ বাসনা মদিরা
আকাশ খিলানে
বুঝি টিপ পরা বুঝি চোখ মারো
ওগো বিদ্যুৎ
রাতের বাংলা কী যে বাঙ্ময়
আছো তো ছড়িয়ে
এমন সত্য জড়োয়া শরীরে
প্রণয় বিলাসী
তোমাকে জড়িয়ে ভাবনা শিখরে
ভাঙছে খোয়ারি
এই অশান্ত শ্রাবণে
ওবায়েদ আকাশ
মাইলস্টোন কলেজের নিহত-আহত শিশুদের প্রতি ক্ষমাপ্রার্থনা
পৃথিবী চাইলেও আর পুনর্জন্ম নিতে পারবে না
যা কিছু হাহাকার, সম্মোহন, মায়া-
কিছুটা মা আর কিছুটা ভ্রাতৃপিতৃভগ্নি সকাশে ফেলে
ওই যে উড়ে গেল বিধ্বস্ত বিমানের ক্রূরতায়
এইসব ফুলেদের অনন্ত ছুটি কি আর
শেষ হবে কোনোদিন?
তুমি কি সাজবে পৃথিবী আবার
হারানো শিশুদের মুখর পরিভাষায়?
ঘন কালো অন্ধকার নাচতে নাচতে
বিদগ্ধ চিৎকার দিয়ে এ কী নিষ্ঠুরতায় বাজাল বিধ্বংসী বাঁশি!
যে শিশুটি আগুনে গলতে গলতে বলেছিল:
‘হাসপাতাল এতদূর কেন মা? তুমি থাকবে তো পাশে?’
সে কেন জাগল না আর এই অশান্ত শ্রাবণে
‘আমি জানতাম তুমি আসবে’- এই শেষ উচ্চারণ করলো যে
বন্ধুটি: আচ্ছা তার বয়স কি
মহাকাশের প্রবীণতর নক্ষত্রের চেয়ে ঢের ঢের বেশি?
অন্যথা কী করে শুনতে পেয়েছিল সু-সখার আগমন ধ্বনি?
জানো মা, যারা দগ্ধ হলো, নিভে গেল, স্তব্ধ হলো, শূন্য...
আমাকে প্রতিটি মুহূর্ত আগলে রাখে এমনি নিষ্পাপ সন্তান যুগল
কেবল ওদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সব কিছু ভুলে যেতে পারি
হ্যাঁ, পারি!! শুধু ভুলতে পারছি না
২১শে জুলাই ২০২৫, সারি সারি ছাইভস্ম, গলিত শিশুদের লাশ
রক্ত, চিৎকার, মা-বাবার বিদীর্ণ আহাজারি!!
আকাশের চিবুকে জমে আছে মেঘ
আদিত্য নজরুল
সম্পাদক মহোদয়
একটি বর্ষার কবিতা লিখতে বললেন
বর্ষা মানেই তো
বৃষ্টির উন্মাতাল নাচ
নদীর মোহন কোমর জুড়ে
যৌবন আকৃষ্ট করা ঢেউ!
পুঁটিমাছ পেটে
রঙধনুর ছাপ নিয়ে
উজানে সাঁতার দিলেই তো বর্ষাকাল!
মেঘের কার্তুজ
শব্দ করতেই
হৈ হৈ রৈ রৈ করে
মাঠ থেকে রাখাল দৌড়ে না পালালে
সাবলীল বর্ষা আসে
আমি সেই কবে থেকেই
বর্ষার তৃষ্ণায়
চেয়ে আছি আকাশে
শুধু দেখি গাভিন গাইয়ের ওলানের মতো
জমে আছে সাদা সাদা মেঘ!
বৃষ্টিঘটিত
পিয়াস মজিদ
বৃষ্টি ঠেকিয়ে রাখছে ছাতা
কিন্তু পৃথিবীর তলে
পাশাপাশি হেঁটে চলা
কোনও দু’জনের
হৃদয় তো ভিজে যাচ্ছেই
বিবর্ণ বর্ণিল জলসা
মুমির সরকার
বৃষ্টি বিঘিœত বর্ণিল জলসায়
বৃষ্টিবন্দী- সুরা আর সাকী,
কী ভীষণ বিবর্ণ এখন!
অথচ জানালার পর্দা সরতেই বাহিরে দেখা-
পত্র-পুষ্প-শিরায় জলের নাচন;
শীতল পরশে ওরা বুঝিবা
কামজ্বরে আরক্ত ছিল এতকাল!
বর্ণিল জলসায় আরক্ত আমিও যেন-বা
নির্বিকার কোনো এক প্রতœমুখ-
বিবর্ণ, কী ভীষণ!
বৃষ্টির নিচে দাঁড়িয়ে
রওশন রুবী
একজন মানুষ ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন-
ছাতার কাপড়ে লেখা ছিল: মনোগ্যামি।
তাকে ধীরে ভিজিয়ে দেয় বৃষ্টি,
যেন অভ্যন্তরীণ নির্ঘোষ ধুয়ে দেয় নামফলক।
তিনি কিছু বলেননি, প্রশ্নও করেননি,
শুধু দেখছিলেন-
শিশুরা কাদায় হাত রেখে আঁকছে প্রতিকৃতি,
যার চোখ ছিল না, ছিল দীর্ঘ নাক-
তাকিয়ে থাকলে বোঝা যায়
সেখানে বাস করে বেদনা।
আরেকজন ওধারে বসেছিলেন হাঁটু মুড়ে,
গায়ে ছিল পত্রমোচড়, ছিন্ন বিষাদবর্ণ,
কপালে লেখা- আমি সুধা নই, আমি প্রশ্ন।
তবু বৃষ্টি তাঁর বুকেই বেশি ঝরেছিল,
কারণ ইতিহাস শুষে নেয় উপেক্ষিত সুর।
আমি থমকে ছিলাম বৃষ্টিরেণু মেখে,
দেখছিলাম- তাঁদের ভক্তদের কোল থেকে
খসে পড়ছে কমলার মতো রোদ।
আমি আমাকে প্রশ্ন করি-
তাঁরা কে আমি কে তঁাঁরা কি বৃষ্টি
আমার সাথে তাঁদের কখনও আলাপ ছিল
ছিল হয়ত, না হলে বৃষ্টির গন্ধ মাতাল করে কেন
দৃশ্য শিকার
মঈনুল হাসান
মেঘ থেকে ঝরে পড়ছে জলের চোখা তীর
সশব্দ পতনে বুঁদ সাগর কিংবা হ্রদে
কিছু নামছে শ্যাওলাজমা কুয়ায়, নিঝুম নদে;
তুমি দেখছ এ এক মায়াবী দৃশ্য
পরিচিত ও চিরাচরিত।
অথচ মেঘ থেকে ছেঁড়া জল
চেয়ে এনেছে বানসম্ভবা নদী-
ডেকে এনেছে বজ্র গম্ভীর কথা
ছেঁকে এনেছে ধ্বংসের কারুকাজ।
নদীতলে এখন মাছেদের রাজধানী
সেখানেও আছে বাণিজ্য, বিনিময় ও বিপণি
রুপালি স্বর্গের মতো ক্রমে গড়ে উঠছে
সুউচ্চ ইমারত, বহু দোকান, মোহনীয় আবাস;
শ্যাওলা লতা ও জলজ পাতাদের ফাঁকে।
অজ¯্র গলিঘুজি রাস্তায় কী অবিরাম চলাচল
জলে নেমে তাই চিৎকার করো না-
সাবধানে হেঁটো, ডুব দিয়ে পা রেখো নিঃশব্দে।
মেঘজলের মতো সংক্ষুব্ধ হয়ো না
প্রক্ষালন ও দোকান ধসে যাবে
প্রাার্থনাঘরের মিনার খসে যাবে
বাণিজ্যের ইমারত ভেঙে যাবে।
ডাঙায় বসে বসে আমরা কুশীলব
কেবল এইসব দৃশ্যের বন্দনা করি,
পতনোন্মুখ জলের মতো উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ি
হিতাহিত জ্ঞান দূরে রেখে শিহরিত হই শুধু।
নদীতলে অথচ স্বপ্ন ভেঙে যায়
চুরমার হয়ে যায় দুধারের তীর
ভেসে যায় বহু মিলন যাপনদৃশ্য
সেসবের কথা কেউ কখনও ভাবেনি।
রাতদিন এমনই দারুণ বর্ষণে
জলের পতনে প্লাবনে ভাঙনে
তুমি দেখছ জলের চুম্বন, রাত্রিদিন
আমি ভাবছি দৃশ্য অদৃশ্যে, হচ্ছে বিলীন।
মরফিউসের সাথে কিছুক্ষণ
আশরাফুল কবীর
এইসব চলমান বৃত্তান্ত ছেড়ে চলো পালিয়ে যাই
থলকমলের কাছে, আজ্ঞাবহ হয়ে শিখে ফেলি
সকল ক্যামোফ্লেজ ছিন্ন করার মূল সূত্রগুলো-
দ্যাখো মিস্টিসিজম ভুলে কীভাবে নদীগুলো মিশে যাচ্ছে
সাগরের বুকে, আর এক পশলা বৃষ্টি দিয়ে কীভাবে
পুরাকালের আকাশ ভিজিয়ে দিচ্ছে সমস্ত মহাতত্ত্বকে
ঝরাকালের ট্র্যাডিশনে থমকে আছে
একটি পরিযায়ী দুপুর, সে দুপুরের ঠাকঠমক ভেদ
করার চেষ্টায় ঝুঁকে আছে জড়সড় ভারুই
কাছে আসার তাড়নায় জঙ্গলে কারফিউ জারি
করেছে এরটিক্ বাতাস;
আকাশের গর্জন পাখিরা বোঝে না,
কিংবা পাখিদের ডানার সম্প্রসারণ ঐ আকাশ
উদভ্রান্ত সময়ে সবকিছু কেমন যেন অগোছালো
যতটা অনুবাদ করার চেষ্টায় সামনে এগোই ঠিক
ততোটাই অনূদিত হয়ে পড়ি, পেছনে টেনে ধরে রাখে
সময়ের প্যাঁচানো অক্টোপাস
খেঁকশিয়াল হয়ে বুকের পাঁজরে ঢুকে যেতে চায়
গোপন ঝড়-বিষাদ, মনঃসমীক্ষণের বিফল চেষ্টায় অযথা
বাগবিত-ায় জড়ায় বাঘা দ্যাবাপৃথিবী
তুমি কি শ্রাবণের ঝড় নাকি সে ঝড়ের আদিরূপ
পলকে উড়েছো, ঘুরেফিরে দ্বীপান্তরিত হয়েছো
দ্যুতিমান প্রহেলিকায়
আমি অযথা খোঁজাখুঁজি করে হয়রান
শতবর্ষী দেবদারুদ্রুম
চলো পালিয়ে যাই, পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় খুঁজে নেই
পরবর্তী অনুচ্ছেদে, দাড়ি-কমা দিয়ে অর্থবোধক
করে নেই একটি সুস্থির দেবালয়
তুমি যাকে ফোটাও
সৌম্য সালেক
তুমি যাকে ফোটাও এ-ফুলে ও-ফুলে
স্তনবৃন্তে অলকায়
এবং তুমি যাকে সাজাও সুফলে
মাংসে ও মদে, উষ্ণ আলতায়
এবং তুমি যাকে রাঙাও নিশিথে
শীত ও শিহরনে রম্য-ক্ষরতায়!
এবং তুমি যাকে নাচাও ছন্দে
নিবিড় নন্দনে মুখর কবিতায়-
তার তারে বৃষ্টি ঝরে নিশিদিন আষাঢ়-শ্রাবণে
তার তরে পুষ্প হাসে অবিরাম প্রেমের ফাগুনে
নাম তার মায়বিনী, সুহাসিনী শ্যামল-সাধিকা
মিথিলের হংস খুশি, তার সখি সকল রাধিকা।
মাইলস্টোনে কাঁদে মন
মোহাম্মদ বিলাল
হাওয়ায় লেগেছে কাঁদন
মাটিতে রক্তের ফোয়ারা
নাড়িছেঁড়া হায় যাদুধন
কান্নায় দেশ মাতোয়ারা!
একালের শোকের ফুরাত
পামর মানুষও পায় দুঃখ
মা-বা কারো মোনাজাত
ছাবাল-সুরাকে কাতর বুক!
শহরে যখন বর্ষা
পূর্ণিয়া সামিয়া
এ শহরে বর্ষা এলে
জলে ধুয়ে যায় কংক্রিটের মন,
ডাস্টবিনের স্রোতে ভেসে যায় ব্যস্ততার ঘাম।
এ শহরে বর্ষা এলে
কাকের চোখে নামে রাজ্যের হতাশা
তিয়াসার জলে ভিজে যায় স্বপ্ন
তবুও লুটপাট হয় না নিখাঁদ প্রেম,
কেবল অযাচিত দাপটে
হুঙ্কার তোলে লোভাতুর ক্ষুধা
আর নিশিগন্ধারা অভিমান ভুলে
ঘুমকে দেয় ছুটি।
এ শহরে বর্ষা যখন আসে
চুপচাপ গলির বাঁকে আঁধার কাছে ডাকে,
আর কদমগুচ্ছ হাতে
হেঁটে বেড়ায় মৃত অথবা জীবিত কোনো কিছু