alt

সাময়িকী

কল্পগল্প

মোহাম্মদ আবদুল মাননান

: বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

মায়ের অনিবার কান্না দেখে ভড়কে চুপ হয়ে আছে সামিয়া। বছরতিনেক আগে নানার মৃত্যুর পর মাকে একবার বহুক্ষণ কাঁদতে দেখেছে সামিয়া-লামিয়া; সামিয়া তখন এগারো-বারো পেরুচ্ছিল। এরপর ঢাকার বাইরে মায়ের বদলির পরও একদিন দুইমেয়েকে কান্নাকণ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল মা, ‘তোদের আর তোদের বাবাকে নিয়েই যত চিন্তা। নয় তো হুট করেই চলে যেতে পারি রে, মা, আমাদের জন্য লোভনীয় পোস্টিং এটা।’ তখনো মাকে ঠিক কাঁদতে দেখেনি সামিয়া। মা মন খারাপ করেছিল বটে। তবে সেই যাত্রায় মাকে রাজশাহী যেতে হয়নি শেষমেশ। ব্যাংকার স্বামী আর দুই মেয়ে নিয়ে ঢাকাতেই থাকছেন পুলিশের এই অফিসার সাজিয়া করিম। পুলিশের চাকরিতে অভিজাত পদেই শুরু করেছেন সাজিয়া-চাকরিতে ছোটো দিয়েই শুরু করতে হয়; ধীরে ধীরে বড় হওয়ার পালা। সেটাই সাজিয়া করিমের ক্ষেত্রে হয়েছে-এখন তিনি এসপি পর্যায়ের কর্মকর্তা। এরই মধ্যে ছোটো ভাইও আর-এক অভিজাত শ্রেণির সদস্য, সরকারের উপসচিব, বদলি হয়ে ঢাকায় চলে এসেছেন-এতদিন এই ভাই স্ত্রীর অধ্যাপনার জন্য খুলনা ছাড়তে পারেননি। এবার স্ত্রীসহ ঢাকায়। সাজিয়ার বিধবা মাও ছেলের বাসায় আছে।

মাকে বছরদুয়েক আগেও একবার কাঁদতে দেখেছে বড়মেয়ে সামিয়া। তবে সেই কান্নার সঙ্গে বিরক্তি আর রাগ ছিল কেবল বাবার উপর। বাবার একই কথা, ‘এখানে আমার দোষটা কী। আমার করারই-বা কী আছে!’ সেদিন ছিল দু’বোনের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিন। ছোটো মেয়ে লামিয়া তখন ফাইভে। ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলেই পড়ছিল লামিয়া। পড়া আর কী! লামিয়াকে স্কুলে পাঠানোই বাবা-মায়ের জন্য এক-প্রকারের যুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন। স্কুলে যাবে না লামিয়া। স্কুলের নির্ধারিত বইয়ের পঠনে মন নেই তার।

‘স্কুলে যেতে ভালো লাগে না, মা।’

‘অশিক্ষিত থাকবি, লামিয়া?’

‘স্কুলে না গিয়ে বুঝি পড়া যায় না!’

‘তাও তো পড়ছিস না। সারাদিন কী সব নিয়ে থাকিস!’

‘জ্ঞান কি কেবল ওই ক’খানা বইয়ের মধ্যেই আটকে আছে, মা?’ মেয়ের মুখে এসব শুনে সাজিয়া আর কথা বাড়ান না।

ক্লাস ফাইভের বাচ্চাকে কী বলবেন মা! কিছু বললেন না। কেবল লামিয়ার বাবাকে বললেন মেয়ের এইসব কথা; সেটা মেয়ের বাবাও জানেন। ওদিকে স্কুল থেকে অব্যাহত ফোন আর ক’দিন বাদেই ডাকাডাকি, ‘লামিয়া আজও স্কুলে আসেনি। এমন হলে তো নাম কেটে দিতে হবে, ম্যাডাম। আপনার বড় মেয়ে কিন্তু ভালোই আছে, ম্যাম। ওর কিন্তু কোনো কমপ্লেইন নেই।’ বর তৌফিকের সঙ্গে বসে একটা প্ল্যান করেন সাজিয়া। তৌফিকও বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি নেয়ার আগে একটি ইংরেজি স্কুলে পড়াতেন। দু’জনে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আর সেটা লামিয়াকে বলেও দেয়া হয়েছে-‘ফাইভটা এই স্কুলে শেষ করো। এরপর একটা সাধারণ স্কুলে ভর্তি করা হবে, যেখানে নিয়মিত ক্লাস ছাড়াই পরীক্ষায় বসতে পারবে ফি বছর।’ একজন পরিচিত প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা হয়ে আছে তৌফিকের। অফিস থেকে একজন মেয়ে-কনস্টেবল নিয়ে এসেছেন সাজিয়া; সে কেবল মেয়েকে স্কুলে নেয়ার জন্য। তাতেও খুব কাজ হয়নি; একদিন যায় তো তিনদিন যায় না। আর স্কুলেও শিক্ষকের শ্রেণিকক্ষের পাঠে বিন্দুবিসর্গ মনোযোগ নেই লামিয়ার।

ধানম-ির এই ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের নাম-ডাক আছে। এখানেই সামিয়া-লামিয়া পড়ছে। আজ স্কুলের সামনে বেশ ভিড়। অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে। শনিবার বলেই ছুটি নিতে হয়নি। বাড়তি কোনো ডিউটি রাখেননি সাজিয়া করিম। তিনি স্কুলের হেডের রুমে বসে আছেন। আজকে এই ভিড়ের মধ্যে কারোর এই রুম অবধি পৌঁছতে পারার কথা না। কিন্তু পুলিশের জন্য অনেক কিছুই ভাঙতে হয় স্কুল কর্তৃপক্ষকে। অধিকন্তু স্কুলটির মালিকপক্ষের একজন প্রাক্তন পুলিশআমলা। তৌফিকও আছেন স্ত্রীর সঙ্গে। এক-পর্যায়ে লামিয়াদের রেজাল্ট দেয়া শুরু হয়েছে। অধ্যক্ষ একজনকে ডেকে লামিয়ার রেজাল্ট কার্ড চাইলেন। বিলম্ব দেখে নিজেই উঠে গেলেন এবং একটু পর টিচার্স রুম থেকে রেজাল্ট কার্ড নিয়ে ফিরলেন। কিন্তু একি! রেজাল্ট কার্ডের সবটুকুনই ফাঁকা। পাঁচ মাস আগের ফলাফল থেকেও অবনতি। তখন কিন্তু লামিয়া কোনো কোনো সাবজেক্টে কিছু নম্বর পেয়েছিল। মেয়েকে তখন মা-বাবা বুঝিয়েছিল, ‘এবারের পরীক্ষাটা ঠিকভাবে দাও। এরপর না চাইলে আর স্কুলেই দেয়া হবে না।’ লামিয়া কিন্তু মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছিল তখন।

তৌফিক তাকাচ্ছেন সাজিয়ার দিকে। সাজিয়া তৌফিকের দিকে। ভেজা চোখ নিয়ে দু’জনেই আবার তাকিয়ে আছেন স্কুলের অধ্যক্ষের দিকে-তিনিও বিব্রত। একটি মেয়ের ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফল বিবরণীতে কিছুই নেই। তৃতীয় দফায় কফি দিতে নির্দেশ করলেন অধ্যক্ষ, বললেন, ‘আজ সবাই একটু অন্যরকমের ব্যস্ত। নয়তো সবক’টি সাবজেক্টের খাতা দেখিয়ে দিতে পারতাম।’

-আমরা না হয় আরো একটু বসি, ম্যাডাম। তৌফিক বললেন।

-সে ঠিক আছে। কিন্তু আজ আমার ক্লাস টিচার ফুরসত পাবেন কি! দেখি।

চুপচাপ বসে আছেন তৌফিক-সাজিয়া দম্পতি। অধ্যক্ষ তাদের চলে যেতেও বলতে পারছেন না। আবার লামিয়াদের ক্লাস টিচারকে ডেকে খাতাগুলোও চাইতে পারছেন না। এভাবেই দু-তিনঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর রেজাল্ট দেয়া শেষ হলো। বাইরে কোলাহলটা নেই আর। তখন লামিয়াদের ক্লাস টিচার লামিয়ার বার্ষিক পরীক্ষার সবক’টি খাতাসমেত অধ্যক্ষের কক্ষে প্রবেশ করে অধ্যক্ষের সামনে খাতাগুলো রাখলেন। অধ্যক্ষ খাতাগুলো নিজে দেখলেন না। ম্যাডাম-সাজিয়ার দিকে ঠেলে দিলেন। সাজিয়া দেখার আগেই তৌফিক খাতাগুলো টেনে নিয়ে দেখতে লাগলেন। একটি খাতাও সাদা না। ভেতরে লেখাজোখা আছে। কিন্তু প্রতিটি খাতার স্কোর ০০। কী লিখেছে তাদের ছোটো মেয়ে! খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন প্রাক্তন এই শিক্ষক। লিখেছে অনেককিছুই-গল্প আছে, ছবি আছে, জটিল গণিতের সমাধান আছে, আছে ইংরেজিতে নানা কিছুর বিবরণ, চমৎকার আর শুদ্ধ ইংরেজি। মা-বাবা দু’জনই ইংরেজি পড়ুয়া; কিন্তু খাতার লেখার কোনোটাই পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পরীক্ষার পর লামিয়ার সব ক’টি পরীক্ষার প্রশ্নই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখেছিলেন তৌফিক।

সেদিন বাসায় ফেরার পরও দুই মেয়ের রেজাল্টকার্ড হাতে নিয়ে মাকে কাঁদতে দেখেছিল সামিয়া। কিন্তু আজকের ব্যাপার তো সম্পূর্ণ আলাদা। রাতের শেষ প্রহর। তামাম অস্থিরতা চলছে এই বাসায়। আছে এক-সাগর উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ। এর শেষ কোথায় আর কীভাবে, ভাবছে সামিয়া। সে খাটের এককোণে চুপচাপ বসে আছে। প্রথম ঝড়টা তার ওপর দিয়েই বইছিল।

‘তুই কী করছিলি, একটা মানুষ চোখের সামনে দিয়ে উধাও হয়ে গেল!’

‘আমি তো ঘুমিয়ে, মা। ওকে তো শেষ পর্যন্ত জাগতেই দেখেছি। মোবাইলে কী যেন দেখছিল।’

‘পাশাপাশি বেডে শুয়ে আছিস। দুই বেডের মধ্যিখানে দুই হাত ফাঁকও হবে না। কিছুই বুঝলি নে!’

‘আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। সকালে আমার স্কুল আছে, মা। তোমার মেয়েকে পাহারা দিতে কি সারারাত জেগে থাকব?

মা-মেয়ের কথা এখন উঁচুতে উঠে যাচ্ছে দেখে তৌফিক বললেন, ‘তোমরা একটু থামো এবার।’

ফজরের আজান হয়ে গেছে। সামিয়া-লামিয়ার মামা নিজেই ড্রাইভ করে সোবাহানবাগ থেকে মাকে নিয়ে চলে এসেছে বোনের আজিমপুরের বাসায়। মাকে দেখে আবার কাঁদছেন সাজিয়া। মামা সফিক করিম এবার ধীরে ধীরে শুনতে লাগলেন সামিয়াকে;

‘মোবাইলে তখন ঠিক সোয়াতিনটা, মামা। আমি উঠে ওয়াশরুমে গেলাম। রুমের বাতিও জ্বালাইনি। ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই ওয়াশরুমের আলোর খানিকটা লামিয়ার বেডে পড়লো। দেখলাম, ও নেই। প্রথমে ভাবলাম, ও হয়তো ওয়াশরুমেই যেতে পারে। অ্যাটাচডটা খালি না পেয়ে কমনটাতে গেছে হয়তো। আমাদের দরজা খোলাই থাকে; রাতে বাবা এসে দেখে যান কখনো-সখনো। অপেক্ষা করলাম। ফিরলো না। উঠে কমন ওয়াশরুমে টোকা দিলাম। কোনো শব্দ নেই। হালকা ধাক্কা দিলাম। খুলে গেল। ভেতরটা অন্ধকার। সুইচ অন করলাম। কিন্তু ভেতরে ও নেই, মামা।’

‘তারপর কী করলি, সামি?’

‘ড্রয়িংরুমে ঢুকলাম। আগে একাধিকবার দেখেছি, আমার ঘুমের ডিসটার্ব না দিতে গভীররাতে ড্রয়িংরুমে বসে পড়ে আর এটাসেটা করে। কিন্তু নেই। এরপর মায়ের অফিস রুমটাতে যেতে চাইলাম, ভয় করলো। কিন্তু মূল দরজার দিকে তাকিয়ে দেখেছি, ভেতর থেকে লক্ করাই আছে, যেটা বাবা প্রতিদিনই ঘুমানোর আগে লক্ করেন।’

‘চাবি কোথায়?’

‘ওটা বাবার কাছেই থাকে, মামা। বাবা কোনো-কোনোদিন ফজর পড়তে মসজিদে যান। নিজেই খুলে যান। নিজেই এসে বন্ধ করেন।’

‘পুলিশের একজন ওয়ার্ডলি আছে না আপার, সে কোথায়?’

‘আপুটা সন্ধ্যার পরই চলে যান। আর ভাইয়াকে মা অফিস থেকেই ফিরেই ছেড়ে দেন।’

‘মেয়েটা না রাতেও থাকে, শুনেছি।’

‘আপু আগে থাকতেন। এখন মেহমান আসলে একটু বেশি সময় থাকেন, কিন্তু চলে যান। বাবা তার থাকাটা পছন্দ করেন না। লামিয়াও এই নিয়ে একদিন কথা শুনিয়েছে।’

‘কথা শুনিয়েছে! লামিয়া! কী কথা রে মা?’

‘বলছিল, অফিসের লোক দিনরাত আটকে রাখতে হবে কেনো?’

‘যাক ওসব। এরপর তুই কী করলি?’

‘মাকে ডাকলাম। আব্বুকে ডাকলাম।’

‘লামি কি মাঝেমাঝেই দেরি করে ঘুমায়?’

‘হ্যাঁ, মামা। কোনো কোনোদিন সকাল হলেই কেবল ঘুমিয়ে যায়।’

‘সারা রাত কী করে ও?’

‘স্পেসিফিক জানিনে, মামা। তবে মোবাইল, ল্যাপটপ কিংবা আই-প্যাডেই পড়ে থাকতো।’

উপসচিব সফিক এবার দুলাভাইয়ের দিকে তাকালেন; মনে মনে বললেন, আপু-দুলাভাইর আর কাজ নেই, ওইটুকুন মেয়ের হাতে সবই তুলে দিয়েছে।

‘সামিয়ার ডাক শুনেই তো হন্তদন্ত হয়ে বের হলাম। ছোটো নেই। মূল দরোজা ভেতর থেকে লক্; বাইরে বেরোনোর একটাই দরজা। বেরুনোর অন্য কোনো রাস্তাও নেই এই বাসায়। সকল জানালা অক্ষত আছে। তাছাড়া ও বের হবেই-বা কেনো, সফিক! না বলে কিন্তু দিনের বেলাতেও লামিয়া বাইরে বের হয় না।’ একশ্বাসে বললেন তৌফিক।

সকাল হয়ে গেছে। সতেরো মিনিটের ব্যবধানে দুই থানার দুই ওসি চলে এসেছেন এসপি সাজিয়া করিমের আজিমপুর কলোনির বাসায়। দুই মেয়েরই পুলিশের কাছাকাছি থাকতে আপত্তি বলেই রমনায় পুলিশী-বাসা পেতে চাননি সাজিয়া। ধানমন্ডির স্কুলও আজিমপুর কলোনির কিছুটা সন্নিকটে। এই কলোনি লালবাগ থানায় হলেও নিউমার্কেট থানার সঙ্গে কার্যকারণ সম্পর্ক বেশি। নিউমার্কেট থানার বর্তমান ওসি সাজিয়া ম্যাডামের সঙ্গে আগে কাজ করেছেন, ফলে শুনেই চলে এসেছেন। দুই ওসিই বাসার নানা পরীক্ষা করলেন। কোনো খুঁত বের হলো না। বাসার ভেতর থেকে কারোর বেরুনোর বিন্দুমাত্র আলামত নেই। সে রকমের সুযোগও নেই। ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করতে সাহস হলো না-এমনিতেই তার মন বর্ণনাতীত বিষাদাকীর্ণ। সেটাও মেয়ের বাবারও। তারপরও কিছু বিষয় জানতেই হয়।

‘রাতে ঘুমুনোর আগে কোথাও কি ও বের হয়েছিল, স্যার?

‘একদমই না। রাতে ঘুমানোর আগে আমি একবার দুই মেয়ের রুমে যাই। কিছুক্ষণ বসে কথা বলি।’ ওসি লালবাগের প্রশ্নের জবাবে বললেন তৌফিক।

‘আপনি কি নিশ্চিত, স্যার, যে প্রতিদিনের মতো গতকাল রাতেও দরজার চাবি ঠিকঠাক লাগিয়েছেন?’

‘আমার কোনো ভুল হয়নি। ঠিকই দরজা লক করেছি।’

‘চাবির কি কোনো ডুপ্লিকেট আছে?’

‘এসব কী প্রশ্ন, ওসি সাহেব?’ সফিক একটু ধমকের সুরেই বললেন। বললেন,

‘ডুপ্লিকেট যদিও থাকেও দরজা কিন্তু ভেতর থেকে লক্ ছিল। আমি আসার পরই দুলাভাই ভেতর থেকে খুলে দিলেন। আমার বড় ভাগ্নিও কিন্তু ছিটকানি আটকানোই দেখেছে। দরজা লক্ও দেখতে পেয়েছে ও।’

বেলা একটু বাড়তেই ডিবির টিম এসে পড়েছে। তারাও নানাকিছু পরীক্ষা করেছে। সামিয়া আর সামিয়ার বাবাকে নানা কিছু জিজ্ঞেস করেছে। সাজিয়াকে কী একটা জিজ্ঞেস করতে এক-ধমকে ওদিকে কেউ যাচ্ছে না আর। ফোন করেছেন এসবির প্রধান। তিনি কয়েকবছর আগে সাজিয়ার সরাসরি বস ছিলেন। বললেন, ‘সব শুনেছি। ব্যাপারটা একটু অ্যাবনর্মাল মনে হচ্ছে। ধৈর্য ধরতে হবে, সাজিয়া। আমি উচ্চতর গোয়েন্দা পরিদপ্তরকেও সম্পৃক্ত করার কথা ভাবছি।’ এসব কারোর কথায় সাজিয়ার মধ্যে আনন্দের রেশমাত্র উদয় হলো না। মেয়েকে এখনি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না সাজিয়া। তিনি বেশ মুষড়ে পড়েছেন-ঠিক বড় সার্জন যেমন নিকটজনের অপারেশনের সময় যে রকমের টেনশনে থাকে। দিনটা এভাবেই কেটে গেল। রাতের দিকে ডিজিএফআইয়ের একজন কর্নেল এলেন। এসেই বললেন, ‘সাজিয়া আমার এই আসাটা কিন্তু অ-দাপ্তরিক। শুনে না এসে পারলাম না, মা।’ এই কর্নেল তৌফিকের মামা। তিনি সাজিয়ার সঙ্গে একবার দেখা দিয়েই ভাগ্নের সঙ্গে বসলেন। তিনি কিছু জানতে চাইছেন।

‘হ্যাঁ, মামা কিছু অ্যাবনর্মাল আই মিন উল্টাপাল্টা আচরণ তো ছিলোই।’

‘যেমন?’

‘সামিয়া তিন ক্লাস উপরে হলেও সামিয়ার অংক বইয়ের সবটা লামিয়া মুখে মুখে করে দিতে পারত। সামিয়াই সেটা একদিন বলেছিল।’

‘সামিয়া ঠিক কী কথা বলেছিল, তৌফিক?’

‘বলেছিল, মামা, ‘‘বাবা, আমার ইংরেজি বইটার সবটাই লামিয়ার নখদর্পণে। স্কুলের হোমটাস্কও ও বলে দিতে পারে। আর ফিজিক্স বইয়ের সবটাতেই ওর স্পষ্ট ধারণা আছে’’।’

‘বউমা জানে?’

‘জানে, মামা।’

‘আর কিছু?’

‘ও স্কুলে যেতে চাইত না। বলত, ‘‘সবই আমার জানা।’’ আমি একবার পরীক্ষা করে দেখেছি। ক্লাস সিক্সের মেয়ে তখন। নাইন-টেনের কিছুই তার আটকায় না। কবে এসব পড়ল, তার কিছুই আমরা জানিনে, মামা।’

‘বাসায় টিচার দাওনি?’

‘আছে মামা।’

‘টিচারের রিডিং কী?’

‘সেও এক-অদ্ভুত ব্যাপার মামা। টিচারের সঙ্গে বসতেই চাইত না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে দুই-দশমিনিট বসত। কখনো আবার না পড়িয়েই চলে যেতে হতো টিচারকে। সাজিয়া বলত, ‘‘অভ্যেসটা যদি হয়’’, সে কারণে টিচার ছিলোই।’

‘টিচার নিয়ে কোনো মন্তব্য ছিল লামিয়ার?’

‘ছিল, মামা। সেটা আমাকে বা ওর মাকে বলেনি। বোনকে বলেছে।’

‘কী বলেছে?’

‘বলত নাকি, ‘‘টিচারই বরং কিছুদিন আমার কাছে শিখতে পারে, সামিয়াপু’’।’

‘মুশকিল। আচ্ছা বর্তমান স্কুল থেকে কোনো কমপ্লেইন এসেছে?’

‘সে তো নিয়মিতই, মামা। স্কুলের হেডস্যার আমার পরিচিত। আপনিও তাকে চেনেন মামা। ওই আমাদের পাশের গ্রামের কাদের।’

‘কী বলেছে কাদের?’

‘বলেছে, ‘‘এই রকমের মেধা নাকি আর দেখিনি। যতই জটিল বিষয় হোক না কেনো, একবার শুনেই সমাধান করে দিতে পারে’’। ওদের কোনো একজন শিক্ষক না আসাতে একদিন হেডস্যার ওদের ক্লাসে যেতেই এটা কাদেরের কাছে ধরা পড়ে। এরপর কাদের প্রায়ই লামিয়াদের ক্লাসে যেত।’

‘কাদের আর কিছু জানিয়েছে তোমায়?’

‘কাদের একদিন বাসায় এসে কথা বলে গেছে। বলেছে, ‘‘নাইন-টেনের ফিজিক্স ও গণিত দিয়ে আমি নিজেই বসেছিলাম তোর মেয়েকে নিয়ে। সবটাই করে দিল’’।’

‘পরীক্ষার রেজাল্ট কেমন ছিল? ফার্স্ট তো বটেই। নাকি!’

‘না , মামা। এখানে এসে, মানে এই স্কুলে দুটো পরীক্ষা দিয়েছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িকী। দুই পরীক্ষাতেই ডাবল জিরো পেয়েছে। প্রথম সাময়িকীকে খাতা ভরিয়েছিল হায়ার ম্যাথ আর পদার্থবিদ্যার জটিল সমীকরণ দিয়ে, যার কোনোটাই সিক্সে পাঠ্য নয়। দ্বিতীয় সাময়িকীতে সাদা খাতা জমা দিয়ে এসেছে।’

‘হুম। কোনো মনোবিজ্ঞানী, আই মিন বিশেষ কাউকে দেখিয়েছো বা কারো সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলেছো?’

‘না, মামা সে-রকমের কাউকে না। অন্য কোনো রকমের অস্বাভাবিক আচরণ ছিল না। সাজিয়া একজনকে একটু টাচ্ দিয়েছিল। মনোবিজ্ঞানী। ওরই বান্ধবী।’

‘কী বললেন তিনি।’

‘জানালেন, ‘‘কোনো সমস্যা না’’। এই রকমের অতিরিক্ত মেধা নাকি এখন অনেকের মধ্যেই দেখা যায়। তিনি একদিন বাসায় এসে লামিয়ার সঙ্গে কথা বলে গেছেন।’

‘ঠিক আছে, তৌফিক। আমাকে আরো কিছু জানতে হবে।’

‘আরো একটু বলার আছে, মামা।’

‘কী! বল।’

‘সাজনির ছেলে আমার বাসায় থেকে বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিল।’

‘তো কী হয়েছে তোমার এই ভাইগ্নার, ভর্তি হতে পারল বুয়েটে? আমাদের ওখানেও একদিন ছিল তো।’

‘হ্যাঁ, মামা, ও ত্রিপল-ই পেয়েছে।’

‘গুড। খুব ভালো।’

‘ও একটা ব্যাপার বলে গেছে ওর মামিকে।’

‘কী সেটা?’

‘ওর বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার সবটাই নাকি লামিয়া বসে বসে সলভ্ করেছিল। ও তো হতবাক। সেটাই সাজিয়াকে বলে গেছে, মামা।’

‘হুম। বহুকিছু ভাবার আছে। কিন্তু মেয়েটা গেল কোথায়? একটা কথা তৌফিক, আমার মন বলছে, লামিয়া হারিয়ে যায়নি। কেউ ওকে কিডন্যাপও করেনি। আছে কোথাও। কোথায় আর কীভাবে, এটাই প্রশ্ন, বাবা।’

‘মামা, এই কথাগুলো আপনার ভাগ্নেবউকে একটু বলে যান। ও কিন্তু কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না। সাজিয়াকে নিয়েও ভয়ের মধ্যে আছি, মামা। ওদিকে সামিয়াও কেমন জবুথবু হয়ে আছে।’

মিডিয়া বড়বেশি উত্তাল হয়ে উঠেছে। সময়ের ক্রেজ। উত্তাল হতেই হবে। কারোর ভেতরে বাঁশ ঢুকছে, কেউ আবার সেটার পরিমাপ করছে কতটা ঢুকলো! প্রিন্ট আর বৈদ্যুতিন মিডিয়ার সঙ্গে সমাজমাধ্যমে উপচে পড়ছে নানা শিরোনাম। ‘দৈনিক শেষ আলো’ শিরোনাম করেছে-ঊর্দ্ধতন পুলিশের কন্যা নিখোঁজ। ‘দৈনিক পড়তে পড়তে ফাঁক’ লিখেছে; পুলিশের নিজবাসভূমেই নিজের সন্তানই নিরাপদ নয়। ‘দৈনিক সকলের জমিন’ বলছে, কোথায় আমাদের নিরাপত্তা? ‘টিভি ছত্রিশ ঘণ্টা’ গাইছে, রাজধানীতে সিনিয়র পুলিশ অফিসারের মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ‘চ্যানেল দেখে নেব’ বারবার স্ক্রল দেখাচ্ছে, এখনো হদিস মেলেনি পুলিশ তনয়ার। আর একটি টিভি চ্যানেল ‘সময়ের ক্রেজ’ প্রচার করছে, গোয়েন্দারা হিমশিম খাচ্ছে, কোনো ক্লু-ই মিলছে না। সবগুলো কাগজই ঘটনার দ্বিতীয় দিনে খবর ছেপেছে এই নিয়ে। আর গতকাল থেকেই ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এই বিষয়ে খবর দিতে গলদঘর্ম ঘেমেই যাচ্ছে। ফেসবুকের লোকজন আরো বেশি সোচ্চার; নানা মন্তব্যে ভরপুর উঠেছে। এই দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি কিংবা সরকারি আধিকারিকদের ব্যক্তি বা পারিবারিক বিষয়ে মানুষের আগ্রহ বরাবরই বেশি আর খামোকাই। পুলিশের কন্যা লামিয়ার নিখোঁজেও এই আগ্রহ যেন তুঙ্গে উঠে গেছে। মন্তব্য হচ্ছে অফিসারের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েও-অনধিকার চর্চাই নয়, মিথ্যাতেও ভরপুর এসব। ঘর পেড়ার মধ্যে আলু খেতে চাইছে কেউ কেউ। একটু আগে পুলিশপ্রধান ফোন করেছিলেন। এই ফোনটা সাজিয়াকে নিতে হলো। আইজিপি সাহেব নানা সান্ত¡নার কথা শোনালেন-

‘পুলিশ তোমার মেয়েকে খুঁজে বার করবেই।’ এও শোনালেন, ‘বলেছিলাম, রমনা কমপ্লেক্সে বাসা নাও। শোনোনি।’

সাজিয়ার কথা বলতে বিশেষ ইচ্ছে হলো। জি, হ্যাঁ আর স্যার দিয়েই কথা শেষ করলেন।

লামিয়াবিহীন চতুর্থ রাত আজ। সাজিয়া-তৌফিকের মধ্যে বিন্দুমাত্র স্বস্তি ফিরে আসেনি। কোনো তরফের কোনো আশ্বাসই বাবা-মায়ের মধ্যে একরত্তি আশা জাগাতে পারছে না। সে সম্ভবও না। স্বস্তি তো একমাত্র মেয়েকে বুকে ফিরে পাওয়া। সেই পথ কোনো সংস্থাই দেখাতে পারছে না। বরং এক-একটি ঘণ্টার পর বিষয়টি আরো জটিল হচ্ছে বলেই সাজিয়ার মনে হতে থাকে। নিজেরও গোয়েন্দা প্রশিক্ষণ আছে। সবটাই বুঝতে পারেন তিনি। পুলিশ যেভাবে এগুচ্ছে বা যা করতে চাইছে তাতে মেয়েকে পাওয়ার আশা যে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে সে বোঝার ক্ষমতা সাজিয়ার এখনো উবে যায়নি। পুলিশের কোনো সংস্থাই সামান্য ক্লু উদ্ধার করতে পারেনি। সামিয়াও বোনের জন্য ব্যকুল হয়ে উঠছে। অতি প্রয়োজনে খাচ্ছে বটে, কিন্তু কিছুই বলছে না। তৌফিকের শাশুড়ি মেয়ের বাসাতেই পড়ে আছেন। সাজিয়ার ভাই-ভাবিও দু’বেলা এসে কিছু সময় কাটিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাতে কী! লামিয়া কোথায়?

মাস্টার বেডে সাজিয়াকে নিয়ে মা শুয়েছেন। বাবা মেয়ের সঙ্গে অপর কক্ষে। লামিয়া ভয় পাচ্ছে একা ঘুমাতে। চতুর্থ রাতে সাজিয়ার ভাই-ভাবিও রাতে থেকে গেছেন। কেবলই একটু তন্দ্রার মতো এসেছে সাজিয়ার; লামিয়া হারিয়ে যাওয়া থেকেই মায়ের ঘুম হারিয়ে গেছিল। আজ বরং সামান্য একটু ঘুমের দেখা মিললো। হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেল সাজিয়ার। কী এক-শব্দে সেটা। ওয়ালে চোখ পড়তেই আবছা আলোয় দেখলো, রাত তিনটে সাতচল্লিশ।

‘মা, এই যে এখানে আমি।’ সে কী! এ তো লামিয়া কথা বলছে! সাজিয়া উঠে বসতে চাইলেন। পারলেন না। এদিক-সেদিক তাকালেন। নিষ্প্রভ ভালব জ্বলছে। কিন্তু ঘরের কোথাও লামিয়াকে দেখতে পেলেন না।

‘তুমি ঠিক এখনই আমাকে দেখতে পাবে না, মা। আমি তোমাকে দেখছি। যা বলছি, শোনো, মা। মন দিয়ে শোন।’

সাজিয়া কিছুই বললেন না। তার দারুণ পিপাসা পেয়েছে। কিন্তু উঠতে পারছেন না। তার চেয়ে জরুরি মেয়ের কথা শোনা। পানির পিপাসাও উবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

‘সংক্ষেপে শোন। আমার মধ্যে এক-প্রকারের সুপার ন্যাচারাল ক্ষমতার আধার চলে এসেছে, মানে ভর করেছে, মা। এই সময়ের পৃথিবীতে এটি কেবল আমারই আছে। সেটা এমনই যে, পুরো পৃথিবী ধ্বংস করে দিতে আমার একার মাথাই দুনিয়াসুদ্ধ সকল মানুষের সমান। আমার মস্তিষ্কে আছে এমন এক-শক্তি, যা দিয়ে একনিমিষে এই পৃথিবী যেমন চুরমার করে দেয়া যায়; আবার এমন একাধিক পৃথিবী সেকেন্ডেই গড়ে দিতে পারি।’

ঘেমে যাচ্ছেন সাজিয়া। সামান্য শ্বাসকষ্টও অনুভূত হচ্ছে তার।

‘কর্নেল-নানা বাবাকে কিছু বলেননি! জানেন তো। বলতে পারতেন। অবশ্য তার বলতেও সমস্যা ছিল। তিনিসহ যারাই বাসায় এসেছেন সবটাই মনিটর করা হচ্ছে। এসব খবর নিমিষেই পৌঁছে যাচ্ছে সর্বাধিক ক্ষমতাধর দেশের গোয়েন্দা সংস্থার হাতে। পথে আরো কয়েকটা জায়গা হয়েই তবে যায়। পুলিশেরও জানার কথা নয়, গত দুই সপ্তাহ ধরেই আমাদের বাসার চারদিকে শতচোখের নজরদাারি চলছেই। পৃথিবীর এক-নম্বরের সুপার পাওয়ারের পক্ষে এটা করছে আমাদের প্রতিবেশি দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। ওরা নিজেরাই করতে পারত, কিন্তু ওদের দেখে তো মানুষ চিনে ফেলবে; সেটা সুপার পাওয়ারের দেশটি চায়নি। কেনো আর কী হয়েছে, মা? সেটাই বলছি।’

মন্ত্রমুগ্ধের মতোই শুনে যাচ্ছেন সাজিয়া। এবার মনে হচ্ছে,লাামিয়া যেনো পাশে বসেই সবটা বলছে। মেয়ের উপস্থিতি এবার শতভাগ অনুভূত হচ্ছে মায়ের কাছে।

‘প্রতিবেশি দেশের গোয়েন্দারা আমাকে ক’দিনেই পহেলা সুপার পাওয়ারের হাতে তুলে দিত। আমার মেধা তাদের দরকারই দরকার। আমার মস্তিষ্ক প্রথমে ওই শক্তিধর দেশটি নিউট্রাল করতে চেয়েছিল, সেটা করে দিতে পারলে আমাকে তুলে নেয়ার দরকার হতো না ওদের। কিন্তু ততদিনে আমি এক-বিশেষ শক্তির অধিকারী হওয়ায় সে দেশের বিজ্ঞানীরা আমার মাথার অভূতপূর্ব শক্তিকে নিউট্রাল করতে পারেনি। এখন তারা আমাকে বিজ্ঞানের কাজে লাগাতে তুলে নিতে চায়। সেটা টের পেয়েই আমি আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করেছি। আমার মাথা বিবদমান দুই সুপার পাওয়ারের সকল গবেষণা-আবিষ্কার খেয়ে নিতে পারে বলেই আমাকে নিয়ে ওদের এতা দুঃশ্চিন্তা। আমি এখন এআইর চেয়েও বহুগুণ এগিয়ে থাকা এক-প্রযুক্তির আধার। মানুষকে এই অবস্থায় যেতে সহ¯্র বছর লেগে যাবে। তারপরও আদৌ পৌঁছতে পারবে কিনা বলা দুরূহ।’

অনেক কষ্টে উঠে বসলেন সাজিয়া।

‘মা, ভয় পেয়ো না। ওরা আমাকে নিতে পারবে না। কিন্তু এখনি আমার প্রকাশ্যে থাকা ঠিক হবে না- আমি যে কোনো অবস্থায়, যে কোনা জায়গায় থাকার শক্তি অর্জন করেছি; আমি শূন্যে ঘুমাতে পারি, হাঁটতে পারি, দৌড়াতে পারি। আমাকে তুলে নেয়ার নেয়ার ওদের সকল শক্তি নিউট্রাল করে দিয়েই ফিরে আসব। বলি, আমাদের সরকারের একটা পর্যায় কিন্তু আমাকে তুলে নেয়ার এসব খবর জানত। তারা প্রথমে আমাকে প্রটেক্ট করতে চেয়েছিল। কিন্তু পৃথিবীর সেরা সুপার পাওয়ারের চাওয়ার সঙ্গে তাদের হার মানতে হয়েছে। সেই সুপার পাওয়ারের চাপেই একটি প্রতিবেশি দেশ কাজটিতে ইনভলভ্ হয়েছে। আমার মস্তিষ্কের এই অতি-অস্বাভাবিক ক্ষমতা আরো দু’একটি ক্ষমতাধর দেশও জেনে গেছিল। কিন্তু তাদের একটু দেরি হয়ে গেছে। আমাদের সরকার দেখেছে, একে রেখে আমাদের কী! আমরা এর মেধার কিছুই ব্যবহার করতে পারব না। বৃহৎ শক্তিধর দেশ খুশি থাকলেই আমাদের মঙ্গল। আরো একটু বলি, মা একবছর তিনমাস আগে আমি এআইকে একটা কঠিন গাণিতিক-পদার্থ বিদ্যার জটিলতা দিয়ে সমাধান চেয়েছিলাম। এআই সময় নিয়েও পারেনি। ওটার সমাধান আমিই করে দিয়েছি আর তখনই আমার এই অস্বাভাবিক প্রতিভার খবর প্রথমে আটলান্টিকের ওপারের দেশটির ন্যাশনাল সাইন্স ইনস্টিটিউট এবং পরে পৃথিবীর দ্বিতীয় শক্তিধর দেশটির কেন্দ্রীয় সাইন্স ল্যাব জেনে যায়।’

মা, মা লামি বলে ডুকরে কেঁদে উঠলেন সাজিয়া।

‘একদম কেঁদো না। এই আমি। হাতটা ধরো। আমার কোনো ক্ষুধা কাজ করে না, দরকার হয় না মানবীয় কিছুর। তারপরও গিয়ে দেখো, ফ্রিজ থেকে রান্না করা ইলিশের ডিমটা কিন্তু খেয়ে নিয়েছি। তুমি রাতে খাওনি। কেঁদে কেঁদে রেখে দিয়েছো, ওটা আমার অতি পছন্দ বলেই। বলছি মা, শীঘ্রই ফিরে আসছি। এখনো কিন্তু বাসার আশেপাশেই আছি। হয়তো বাসাতেই। ভালো আছি, মা। তুমি একদমই টেনশন করো না। বাবাকে আপাতত কিছু বলার দরকার নেই। আমি এআইর সুপার-ডুপার ভার্শন বলে ওরাই পরাস্ত হবে। দেখবে, চারপাশে আর কেউ নেই, তখন আমি সাধারণ জীবনে ফিরে আসব, মা। কাল তো তোমার একটা ভালো খবর পাওয়ার আছে। ফিরে আসি, ওটার সেলিব্রেট হবে।’

মেয়ে হারিয়ে যাওয়ার পঞ্চমদিনে অফিসে এসেছেন সাজিয়া। এসেই খবরটা জানলেন। তিনি অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। কিছুক্ষণ পরেই ওয়েবে আদেশ দেখা যাবে। এই খবর শুনেও সাজিয়ার মধ্যে আনন্দের রেশটুকু নেই। তিনি অনিমিখ চেয়ে আছেন কেবল। মুখেও কোনো শব্দ নেই। লামিয়ার ফেরাতেই তার সবকিছু আটকে আছে যেন। দীর্ঘ ছুটির কথা ভাবছেন সাজিয়া-তিনি খুবই বিপর্যস্ত-বিমর্ষ আর ততোধিক ক্লান্ত।

সাময়িকী কবিতা

ছবি

শালুক-এর শঙ্খ ঘোষ সংখ্যা বাংলাদেশের সশ্রদ্ধ মূল্যায়ন

ছবি

‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’: কুহক ও বিভ্রমের গল্প

ছবি

আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা’

ছবি

প্রসঙ্গ মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস

ছবি

আনন্দদায়ক ও অপ্রত্যাশিত নোবেল পুরস্কার

ছবি

জীবনবোধ ও শিল্পকর্ম

ছবি

নজরুলের গল্প ও উপন্যাস

ছবি

কৃষ্ণাঙ্গ দাস থেকে হয়ে উঠেছিলেন খ্যাতিমান কবি

শ্রাবণ বর্ষণে

ছবি

শতবর্ষ পরে ‘মিসেস ডালোওয়ে’

ছবি

স্কাল্পচারের জগতটা আস্তে আস্তে ব্যাপকতা পাচ্ছে

ছবি

চব্বিশের অভ্যুত্থান নিয়ে গ্রন্থ

ছবি

ভিন্নচোখ: নুতন কবিতা সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকা: মৃত্যুর রূপক এবং আন্দালুসিয়ার লোকজ বিশ্বাস

ছবি

কবিতার শিল্পনিষ্ঠ রূপকার ফারুক মাহমুদ

ছবি

কাফকাকে পড়া কাফকাকে পড়ানো

ছবি

কবি নওশাদ নূরী

ছবি

আঁধার পেরিয়ে আলোর উদ্ভাষণ

ছবি

সন্জীদা খাতুন : কৃতি ও কৃতিত্ব

ছবি

ব্রেশায় উড়োজাহাজ

ছবি

মননশস্যের অমৃত মন্থন

ছবি

অনুবাদ ও ভূমিকা : আলী সিদ্দিকী

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বড়শি

ছবি

কাফকাকে পড়া, কাফকাকে পড়ানো

এ মুখর বরষায়

ছবি

রক্তে লেখা প্রেম: রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বিপ্লব

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

শঙ্খজীবন: যাপিত জীবনের অন্তর্গূঢ় প্রতিকথা

ছবি

ওসামা অ্যালোমার এক ঝুড়ি খুদে গল্প

ছবি

প্রযুক্তির আলোয় বিশ্বব্যাপী বইবাণিজ্য

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ব্রেশায় উড়োজাহাজ

ছবি

কাফকার কাছে আমাদের ঋণ স্বীকার

tab

সাময়িকী

কল্পগল্প

মোহাম্মদ আবদুল মাননান

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫

মায়ের অনিবার কান্না দেখে ভড়কে চুপ হয়ে আছে সামিয়া। বছরতিনেক আগে নানার মৃত্যুর পর মাকে একবার বহুক্ষণ কাঁদতে দেখেছে সামিয়া-লামিয়া; সামিয়া তখন এগারো-বারো পেরুচ্ছিল। এরপর ঢাকার বাইরে মায়ের বদলির পরও একদিন দুইমেয়েকে কান্নাকণ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল মা, ‘তোদের আর তোদের বাবাকে নিয়েই যত চিন্তা। নয় তো হুট করেই চলে যেতে পারি রে, মা, আমাদের জন্য লোভনীয় পোস্টিং এটা।’ তখনো মাকে ঠিক কাঁদতে দেখেনি সামিয়া। মা মন খারাপ করেছিল বটে। তবে সেই যাত্রায় মাকে রাজশাহী যেতে হয়নি শেষমেশ। ব্যাংকার স্বামী আর দুই মেয়ে নিয়ে ঢাকাতেই থাকছেন পুলিশের এই অফিসার সাজিয়া করিম। পুলিশের চাকরিতে অভিজাত পদেই শুরু করেছেন সাজিয়া-চাকরিতে ছোটো দিয়েই শুরু করতে হয়; ধীরে ধীরে বড় হওয়ার পালা। সেটাই সাজিয়া করিমের ক্ষেত্রে হয়েছে-এখন তিনি এসপি পর্যায়ের কর্মকর্তা। এরই মধ্যে ছোটো ভাইও আর-এক অভিজাত শ্রেণির সদস্য, সরকারের উপসচিব, বদলি হয়ে ঢাকায় চলে এসেছেন-এতদিন এই ভাই স্ত্রীর অধ্যাপনার জন্য খুলনা ছাড়তে পারেননি। এবার স্ত্রীসহ ঢাকায়। সাজিয়ার বিধবা মাও ছেলের বাসায় আছে।

মাকে বছরদুয়েক আগেও একবার কাঁদতে দেখেছে বড়মেয়ে সামিয়া। তবে সেই কান্নার সঙ্গে বিরক্তি আর রাগ ছিল কেবল বাবার উপর। বাবার একই কথা, ‘এখানে আমার দোষটা কী। আমার করারই-বা কী আছে!’ সেদিন ছিল দু’বোনের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিন। ছোটো মেয়ে লামিয়া তখন ফাইভে। ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলেই পড়ছিল লামিয়া। পড়া আর কী! লামিয়াকে স্কুলে পাঠানোই বাবা-মায়ের জন্য এক-প্রকারের যুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন। স্কুলে যাবে না লামিয়া। স্কুলের নির্ধারিত বইয়ের পঠনে মন নেই তার।

‘স্কুলে যেতে ভালো লাগে না, মা।’

‘অশিক্ষিত থাকবি, লামিয়া?’

‘স্কুলে না গিয়ে বুঝি পড়া যায় না!’

‘তাও তো পড়ছিস না। সারাদিন কী সব নিয়ে থাকিস!’

‘জ্ঞান কি কেবল ওই ক’খানা বইয়ের মধ্যেই আটকে আছে, মা?’ মেয়ের মুখে এসব শুনে সাজিয়া আর কথা বাড়ান না।

ক্লাস ফাইভের বাচ্চাকে কী বলবেন মা! কিছু বললেন না। কেবল লামিয়ার বাবাকে বললেন মেয়ের এইসব কথা; সেটা মেয়ের বাবাও জানেন। ওদিকে স্কুল থেকে অব্যাহত ফোন আর ক’দিন বাদেই ডাকাডাকি, ‘লামিয়া আজও স্কুলে আসেনি। এমন হলে তো নাম কেটে দিতে হবে, ম্যাডাম। আপনার বড় মেয়ে কিন্তু ভালোই আছে, ম্যাম। ওর কিন্তু কোনো কমপ্লেইন নেই।’ বর তৌফিকের সঙ্গে বসে একটা প্ল্যান করেন সাজিয়া। তৌফিকও বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি নেয়ার আগে একটি ইংরেজি স্কুলে পড়াতেন। দু’জনে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আর সেটা লামিয়াকে বলেও দেয়া হয়েছে-‘ফাইভটা এই স্কুলে শেষ করো। এরপর একটা সাধারণ স্কুলে ভর্তি করা হবে, যেখানে নিয়মিত ক্লাস ছাড়াই পরীক্ষায় বসতে পারবে ফি বছর।’ একজন পরিচিত প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা হয়ে আছে তৌফিকের। অফিস থেকে একজন মেয়ে-কনস্টেবল নিয়ে এসেছেন সাজিয়া; সে কেবল মেয়েকে স্কুলে নেয়ার জন্য। তাতেও খুব কাজ হয়নি; একদিন যায় তো তিনদিন যায় না। আর স্কুলেও শিক্ষকের শ্রেণিকক্ষের পাঠে বিন্দুবিসর্গ মনোযোগ নেই লামিয়ার।

ধানম-ির এই ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের নাম-ডাক আছে। এখানেই সামিয়া-লামিয়া পড়ছে। আজ স্কুলের সামনে বেশ ভিড়। অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে। শনিবার বলেই ছুটি নিতে হয়নি। বাড়তি কোনো ডিউটি রাখেননি সাজিয়া করিম। তিনি স্কুলের হেডের রুমে বসে আছেন। আজকে এই ভিড়ের মধ্যে কারোর এই রুম অবধি পৌঁছতে পারার কথা না। কিন্তু পুলিশের জন্য অনেক কিছুই ভাঙতে হয় স্কুল কর্তৃপক্ষকে। অধিকন্তু স্কুলটির মালিকপক্ষের একজন প্রাক্তন পুলিশআমলা। তৌফিকও আছেন স্ত্রীর সঙ্গে। এক-পর্যায়ে লামিয়াদের রেজাল্ট দেয়া শুরু হয়েছে। অধ্যক্ষ একজনকে ডেকে লামিয়ার রেজাল্ট কার্ড চাইলেন। বিলম্ব দেখে নিজেই উঠে গেলেন এবং একটু পর টিচার্স রুম থেকে রেজাল্ট কার্ড নিয়ে ফিরলেন। কিন্তু একি! রেজাল্ট কার্ডের সবটুকুনই ফাঁকা। পাঁচ মাস আগের ফলাফল থেকেও অবনতি। তখন কিন্তু লামিয়া কোনো কোনো সাবজেক্টে কিছু নম্বর পেয়েছিল। মেয়েকে তখন মা-বাবা বুঝিয়েছিল, ‘এবারের পরীক্ষাটা ঠিকভাবে দাও। এরপর না চাইলে আর স্কুলেই দেয়া হবে না।’ লামিয়া কিন্তু মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছিল তখন।

তৌফিক তাকাচ্ছেন সাজিয়ার দিকে। সাজিয়া তৌফিকের দিকে। ভেজা চোখ নিয়ে দু’জনেই আবার তাকিয়ে আছেন স্কুলের অধ্যক্ষের দিকে-তিনিও বিব্রত। একটি মেয়ের ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফল বিবরণীতে কিছুই নেই। তৃতীয় দফায় কফি দিতে নির্দেশ করলেন অধ্যক্ষ, বললেন, ‘আজ সবাই একটু অন্যরকমের ব্যস্ত। নয়তো সবক’টি সাবজেক্টের খাতা দেখিয়ে দিতে পারতাম।’

-আমরা না হয় আরো একটু বসি, ম্যাডাম। তৌফিক বললেন।

-সে ঠিক আছে। কিন্তু আজ আমার ক্লাস টিচার ফুরসত পাবেন কি! দেখি।

চুপচাপ বসে আছেন তৌফিক-সাজিয়া দম্পতি। অধ্যক্ষ তাদের চলে যেতেও বলতে পারছেন না। আবার লামিয়াদের ক্লাস টিচারকে ডেকে খাতাগুলোও চাইতে পারছেন না। এভাবেই দু-তিনঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর রেজাল্ট দেয়া শেষ হলো। বাইরে কোলাহলটা নেই আর। তখন লামিয়াদের ক্লাস টিচার লামিয়ার বার্ষিক পরীক্ষার সবক’টি খাতাসমেত অধ্যক্ষের কক্ষে প্রবেশ করে অধ্যক্ষের সামনে খাতাগুলো রাখলেন। অধ্যক্ষ খাতাগুলো নিজে দেখলেন না। ম্যাডাম-সাজিয়ার দিকে ঠেলে দিলেন। সাজিয়া দেখার আগেই তৌফিক খাতাগুলো টেনে নিয়ে দেখতে লাগলেন। একটি খাতাও সাদা না। ভেতরে লেখাজোখা আছে। কিন্তু প্রতিটি খাতার স্কোর ০০। কী লিখেছে তাদের ছোটো মেয়ে! খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন প্রাক্তন এই শিক্ষক। লিখেছে অনেককিছুই-গল্প আছে, ছবি আছে, জটিল গণিতের সমাধান আছে, আছে ইংরেজিতে নানা কিছুর বিবরণ, চমৎকার আর শুদ্ধ ইংরেজি। মা-বাবা দু’জনই ইংরেজি পড়ুয়া; কিন্তু খাতার লেখার কোনোটাই পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পরীক্ষার পর লামিয়ার সব ক’টি পরীক্ষার প্রশ্নই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখেছিলেন তৌফিক।

সেদিন বাসায় ফেরার পরও দুই মেয়ের রেজাল্টকার্ড হাতে নিয়ে মাকে কাঁদতে দেখেছিল সামিয়া। কিন্তু আজকের ব্যাপার তো সম্পূর্ণ আলাদা। রাতের শেষ প্রহর। তামাম অস্থিরতা চলছে এই বাসায়। আছে এক-সাগর উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ। এর শেষ কোথায় আর কীভাবে, ভাবছে সামিয়া। সে খাটের এককোণে চুপচাপ বসে আছে। প্রথম ঝড়টা তার ওপর দিয়েই বইছিল।

‘তুই কী করছিলি, একটা মানুষ চোখের সামনে দিয়ে উধাও হয়ে গেল!’

‘আমি তো ঘুমিয়ে, মা। ওকে তো শেষ পর্যন্ত জাগতেই দেখেছি। মোবাইলে কী যেন দেখছিল।’

‘পাশাপাশি বেডে শুয়ে আছিস। দুই বেডের মধ্যিখানে দুই হাত ফাঁকও হবে না। কিছুই বুঝলি নে!’

‘আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। সকালে আমার স্কুল আছে, মা। তোমার মেয়েকে পাহারা দিতে কি সারারাত জেগে থাকব?

মা-মেয়ের কথা এখন উঁচুতে উঠে যাচ্ছে দেখে তৌফিক বললেন, ‘তোমরা একটু থামো এবার।’

ফজরের আজান হয়ে গেছে। সামিয়া-লামিয়ার মামা নিজেই ড্রাইভ করে সোবাহানবাগ থেকে মাকে নিয়ে চলে এসেছে বোনের আজিমপুরের বাসায়। মাকে দেখে আবার কাঁদছেন সাজিয়া। মামা সফিক করিম এবার ধীরে ধীরে শুনতে লাগলেন সামিয়াকে;

‘মোবাইলে তখন ঠিক সোয়াতিনটা, মামা। আমি উঠে ওয়াশরুমে গেলাম। রুমের বাতিও জ্বালাইনি। ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই ওয়াশরুমের আলোর খানিকটা লামিয়ার বেডে পড়লো। দেখলাম, ও নেই। প্রথমে ভাবলাম, ও হয়তো ওয়াশরুমেই যেতে পারে। অ্যাটাচডটা খালি না পেয়ে কমনটাতে গেছে হয়তো। আমাদের দরজা খোলাই থাকে; রাতে বাবা এসে দেখে যান কখনো-সখনো। অপেক্ষা করলাম। ফিরলো না। উঠে কমন ওয়াশরুমে টোকা দিলাম। কোনো শব্দ নেই। হালকা ধাক্কা দিলাম। খুলে গেল। ভেতরটা অন্ধকার। সুইচ অন করলাম। কিন্তু ভেতরে ও নেই, মামা।’

‘তারপর কী করলি, সামি?’

‘ড্রয়িংরুমে ঢুকলাম। আগে একাধিকবার দেখেছি, আমার ঘুমের ডিসটার্ব না দিতে গভীররাতে ড্রয়িংরুমে বসে পড়ে আর এটাসেটা করে। কিন্তু নেই। এরপর মায়ের অফিস রুমটাতে যেতে চাইলাম, ভয় করলো। কিন্তু মূল দরজার দিকে তাকিয়ে দেখেছি, ভেতর থেকে লক্ করাই আছে, যেটা বাবা প্রতিদিনই ঘুমানোর আগে লক্ করেন।’

‘চাবি কোথায়?’

‘ওটা বাবার কাছেই থাকে, মামা। বাবা কোনো-কোনোদিন ফজর পড়তে মসজিদে যান। নিজেই খুলে যান। নিজেই এসে বন্ধ করেন।’

‘পুলিশের একজন ওয়ার্ডলি আছে না আপার, সে কোথায়?’

‘আপুটা সন্ধ্যার পরই চলে যান। আর ভাইয়াকে মা অফিস থেকেই ফিরেই ছেড়ে দেন।’

‘মেয়েটা না রাতেও থাকে, শুনেছি।’

‘আপু আগে থাকতেন। এখন মেহমান আসলে একটু বেশি সময় থাকেন, কিন্তু চলে যান। বাবা তার থাকাটা পছন্দ করেন না। লামিয়াও এই নিয়ে একদিন কথা শুনিয়েছে।’

‘কথা শুনিয়েছে! লামিয়া! কী কথা রে মা?’

‘বলছিল, অফিসের লোক দিনরাত আটকে রাখতে হবে কেনো?’

‘যাক ওসব। এরপর তুই কী করলি?’

‘মাকে ডাকলাম। আব্বুকে ডাকলাম।’

‘লামি কি মাঝেমাঝেই দেরি করে ঘুমায়?’

‘হ্যাঁ, মামা। কোনো কোনোদিন সকাল হলেই কেবল ঘুমিয়ে যায়।’

‘সারা রাত কী করে ও?’

‘স্পেসিফিক জানিনে, মামা। তবে মোবাইল, ল্যাপটপ কিংবা আই-প্যাডেই পড়ে থাকতো।’

উপসচিব সফিক এবার দুলাভাইয়ের দিকে তাকালেন; মনে মনে বললেন, আপু-দুলাভাইর আর কাজ নেই, ওইটুকুন মেয়ের হাতে সবই তুলে দিয়েছে।

‘সামিয়ার ডাক শুনেই তো হন্তদন্ত হয়ে বের হলাম। ছোটো নেই। মূল দরোজা ভেতর থেকে লক্; বাইরে বেরোনোর একটাই দরজা। বেরুনোর অন্য কোনো রাস্তাও নেই এই বাসায়। সকল জানালা অক্ষত আছে। তাছাড়া ও বের হবেই-বা কেনো, সফিক! না বলে কিন্তু দিনের বেলাতেও লামিয়া বাইরে বের হয় না।’ একশ্বাসে বললেন তৌফিক।

সকাল হয়ে গেছে। সতেরো মিনিটের ব্যবধানে দুই থানার দুই ওসি চলে এসেছেন এসপি সাজিয়া করিমের আজিমপুর কলোনির বাসায়। দুই মেয়েরই পুলিশের কাছাকাছি থাকতে আপত্তি বলেই রমনায় পুলিশী-বাসা পেতে চাননি সাজিয়া। ধানমন্ডির স্কুলও আজিমপুর কলোনির কিছুটা সন্নিকটে। এই কলোনি লালবাগ থানায় হলেও নিউমার্কেট থানার সঙ্গে কার্যকারণ সম্পর্ক বেশি। নিউমার্কেট থানার বর্তমান ওসি সাজিয়া ম্যাডামের সঙ্গে আগে কাজ করেছেন, ফলে শুনেই চলে এসেছেন। দুই ওসিই বাসার নানা পরীক্ষা করলেন। কোনো খুঁত বের হলো না। বাসার ভেতর থেকে কারোর বেরুনোর বিন্দুমাত্র আলামত নেই। সে রকমের সুযোগও নেই। ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করতে সাহস হলো না-এমনিতেই তার মন বর্ণনাতীত বিষাদাকীর্ণ। সেটাও মেয়ের বাবারও। তারপরও কিছু বিষয় জানতেই হয়।

‘রাতে ঘুমুনোর আগে কোথাও কি ও বের হয়েছিল, স্যার?

‘একদমই না। রাতে ঘুমানোর আগে আমি একবার দুই মেয়ের রুমে যাই। কিছুক্ষণ বসে কথা বলি।’ ওসি লালবাগের প্রশ্নের জবাবে বললেন তৌফিক।

‘আপনি কি নিশ্চিত, স্যার, যে প্রতিদিনের মতো গতকাল রাতেও দরজার চাবি ঠিকঠাক লাগিয়েছেন?’

‘আমার কোনো ভুল হয়নি। ঠিকই দরজা লক করেছি।’

‘চাবির কি কোনো ডুপ্লিকেট আছে?’

‘এসব কী প্রশ্ন, ওসি সাহেব?’ সফিক একটু ধমকের সুরেই বললেন। বললেন,

‘ডুপ্লিকেট যদিও থাকেও দরজা কিন্তু ভেতর থেকে লক্ ছিল। আমি আসার পরই দুলাভাই ভেতর থেকে খুলে দিলেন। আমার বড় ভাগ্নিও কিন্তু ছিটকানি আটকানোই দেখেছে। দরজা লক্ও দেখতে পেয়েছে ও।’

বেলা একটু বাড়তেই ডিবির টিম এসে পড়েছে। তারাও নানাকিছু পরীক্ষা করেছে। সামিয়া আর সামিয়ার বাবাকে নানা কিছু জিজ্ঞেস করেছে। সাজিয়াকে কী একটা জিজ্ঞেস করতে এক-ধমকে ওদিকে কেউ যাচ্ছে না আর। ফোন করেছেন এসবির প্রধান। তিনি কয়েকবছর আগে সাজিয়ার সরাসরি বস ছিলেন। বললেন, ‘সব শুনেছি। ব্যাপারটা একটু অ্যাবনর্মাল মনে হচ্ছে। ধৈর্য ধরতে হবে, সাজিয়া। আমি উচ্চতর গোয়েন্দা পরিদপ্তরকেও সম্পৃক্ত করার কথা ভাবছি।’ এসব কারোর কথায় সাজিয়ার মধ্যে আনন্দের রেশমাত্র উদয় হলো না। মেয়েকে এখনি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না সাজিয়া। তিনি বেশ মুষড়ে পড়েছেন-ঠিক বড় সার্জন যেমন নিকটজনের অপারেশনের সময় যে রকমের টেনশনে থাকে। দিনটা এভাবেই কেটে গেল। রাতের দিকে ডিজিএফআইয়ের একজন কর্নেল এলেন। এসেই বললেন, ‘সাজিয়া আমার এই আসাটা কিন্তু অ-দাপ্তরিক। শুনে না এসে পারলাম না, মা।’ এই কর্নেল তৌফিকের মামা। তিনি সাজিয়ার সঙ্গে একবার দেখা দিয়েই ভাগ্নের সঙ্গে বসলেন। তিনি কিছু জানতে চাইছেন।

‘হ্যাঁ, মামা কিছু অ্যাবনর্মাল আই মিন উল্টাপাল্টা আচরণ তো ছিলোই।’

‘যেমন?’

‘সামিয়া তিন ক্লাস উপরে হলেও সামিয়ার অংক বইয়ের সবটা লামিয়া মুখে মুখে করে দিতে পারত। সামিয়াই সেটা একদিন বলেছিল।’

‘সামিয়া ঠিক কী কথা বলেছিল, তৌফিক?’

‘বলেছিল, মামা, ‘‘বাবা, আমার ইংরেজি বইটার সবটাই লামিয়ার নখদর্পণে। স্কুলের হোমটাস্কও ও বলে দিতে পারে। আর ফিজিক্স বইয়ের সবটাতেই ওর স্পষ্ট ধারণা আছে’’।’

‘বউমা জানে?’

‘জানে, মামা।’

‘আর কিছু?’

‘ও স্কুলে যেতে চাইত না। বলত, ‘‘সবই আমার জানা।’’ আমি একবার পরীক্ষা করে দেখেছি। ক্লাস সিক্সের মেয়ে তখন। নাইন-টেনের কিছুই তার আটকায় না। কবে এসব পড়ল, তার কিছুই আমরা জানিনে, মামা।’

‘বাসায় টিচার দাওনি?’

‘আছে মামা।’

‘টিচারের রিডিং কী?’

‘সেও এক-অদ্ভুত ব্যাপার মামা। টিচারের সঙ্গে বসতেই চাইত না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে দুই-দশমিনিট বসত। কখনো আবার না পড়িয়েই চলে যেতে হতো টিচারকে। সাজিয়া বলত, ‘‘অভ্যেসটা যদি হয়’’, সে কারণে টিচার ছিলোই।’

‘টিচার নিয়ে কোনো মন্তব্য ছিল লামিয়ার?’

‘ছিল, মামা। সেটা আমাকে বা ওর মাকে বলেনি। বোনকে বলেছে।’

‘কী বলেছে?’

‘বলত নাকি, ‘‘টিচারই বরং কিছুদিন আমার কাছে শিখতে পারে, সামিয়াপু’’।’

‘মুশকিল। আচ্ছা বর্তমান স্কুল থেকে কোনো কমপ্লেইন এসেছে?’

‘সে তো নিয়মিতই, মামা। স্কুলের হেডস্যার আমার পরিচিত। আপনিও তাকে চেনেন মামা। ওই আমাদের পাশের গ্রামের কাদের।’

‘কী বলেছে কাদের?’

‘বলেছে, ‘‘এই রকমের মেধা নাকি আর দেখিনি। যতই জটিল বিষয় হোক না কেনো, একবার শুনেই সমাধান করে দিতে পারে’’। ওদের কোনো একজন শিক্ষক না আসাতে একদিন হেডস্যার ওদের ক্লাসে যেতেই এটা কাদেরের কাছে ধরা পড়ে। এরপর কাদের প্রায়ই লামিয়াদের ক্লাসে যেত।’

‘কাদের আর কিছু জানিয়েছে তোমায়?’

‘কাদের একদিন বাসায় এসে কথা বলে গেছে। বলেছে, ‘‘নাইন-টেনের ফিজিক্স ও গণিত দিয়ে আমি নিজেই বসেছিলাম তোর মেয়েকে নিয়ে। সবটাই করে দিল’’।’

‘পরীক্ষার রেজাল্ট কেমন ছিল? ফার্স্ট তো বটেই। নাকি!’

‘না , মামা। এখানে এসে, মানে এই স্কুলে দুটো পরীক্ষা দিয়েছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িকী। দুই পরীক্ষাতেই ডাবল জিরো পেয়েছে। প্রথম সাময়িকীকে খাতা ভরিয়েছিল হায়ার ম্যাথ আর পদার্থবিদ্যার জটিল সমীকরণ দিয়ে, যার কোনোটাই সিক্সে পাঠ্য নয়। দ্বিতীয় সাময়িকীতে সাদা খাতা জমা দিয়ে এসেছে।’

‘হুম। কোনো মনোবিজ্ঞানী, আই মিন বিশেষ কাউকে দেখিয়েছো বা কারো সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলেছো?’

‘না, মামা সে-রকমের কাউকে না। অন্য কোনো রকমের অস্বাভাবিক আচরণ ছিল না। সাজিয়া একজনকে একটু টাচ্ দিয়েছিল। মনোবিজ্ঞানী। ওরই বান্ধবী।’

‘কী বললেন তিনি।’

‘জানালেন, ‘‘কোনো সমস্যা না’’। এই রকমের অতিরিক্ত মেধা নাকি এখন অনেকের মধ্যেই দেখা যায়। তিনি একদিন বাসায় এসে লামিয়ার সঙ্গে কথা বলে গেছেন।’

‘ঠিক আছে, তৌফিক। আমাকে আরো কিছু জানতে হবে।’

‘আরো একটু বলার আছে, মামা।’

‘কী! বল।’

‘সাজনির ছেলে আমার বাসায় থেকে বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিল।’

‘তো কী হয়েছে তোমার এই ভাইগ্নার, ভর্তি হতে পারল বুয়েটে? আমাদের ওখানেও একদিন ছিল তো।’

‘হ্যাঁ, মামা, ও ত্রিপল-ই পেয়েছে।’

‘গুড। খুব ভালো।’

‘ও একটা ব্যাপার বলে গেছে ওর মামিকে।’

‘কী সেটা?’

‘ওর বুয়েট ভর্তি পরীক্ষার সবটাই নাকি লামিয়া বসে বসে সলভ্ করেছিল। ও তো হতবাক। সেটাই সাজিয়াকে বলে গেছে, মামা।’

‘হুম। বহুকিছু ভাবার আছে। কিন্তু মেয়েটা গেল কোথায়? একটা কথা তৌফিক, আমার মন বলছে, লামিয়া হারিয়ে যায়নি। কেউ ওকে কিডন্যাপও করেনি। আছে কোথাও। কোথায় আর কীভাবে, এটাই প্রশ্ন, বাবা।’

‘মামা, এই কথাগুলো আপনার ভাগ্নেবউকে একটু বলে যান। ও কিন্তু কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না। সাজিয়াকে নিয়েও ভয়ের মধ্যে আছি, মামা। ওদিকে সামিয়াও কেমন জবুথবু হয়ে আছে।’

মিডিয়া বড়বেশি উত্তাল হয়ে উঠেছে। সময়ের ক্রেজ। উত্তাল হতেই হবে। কারোর ভেতরে বাঁশ ঢুকছে, কেউ আবার সেটার পরিমাপ করছে কতটা ঢুকলো! প্রিন্ট আর বৈদ্যুতিন মিডিয়ার সঙ্গে সমাজমাধ্যমে উপচে পড়ছে নানা শিরোনাম। ‘দৈনিক শেষ আলো’ শিরোনাম করেছে-ঊর্দ্ধতন পুলিশের কন্যা নিখোঁজ। ‘দৈনিক পড়তে পড়তে ফাঁক’ লিখেছে; পুলিশের নিজবাসভূমেই নিজের সন্তানই নিরাপদ নয়। ‘দৈনিক সকলের জমিন’ বলছে, কোথায় আমাদের নিরাপত্তা? ‘টিভি ছত্রিশ ঘণ্টা’ গাইছে, রাজধানীতে সিনিয়র পুলিশ অফিসারের মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ‘চ্যানেল দেখে নেব’ বারবার স্ক্রল দেখাচ্ছে, এখনো হদিস মেলেনি পুলিশ তনয়ার। আর একটি টিভি চ্যানেল ‘সময়ের ক্রেজ’ প্রচার করছে, গোয়েন্দারা হিমশিম খাচ্ছে, কোনো ক্লু-ই মিলছে না। সবগুলো কাগজই ঘটনার দ্বিতীয় দিনে খবর ছেপেছে এই নিয়ে। আর গতকাল থেকেই ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এই বিষয়ে খবর দিতে গলদঘর্ম ঘেমেই যাচ্ছে। ফেসবুকের লোকজন আরো বেশি সোচ্চার; নানা মন্তব্যে ভরপুর উঠেছে। এই দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি কিংবা সরকারি আধিকারিকদের ব্যক্তি বা পারিবারিক বিষয়ে মানুষের আগ্রহ বরাবরই বেশি আর খামোকাই। পুলিশের কন্যা লামিয়ার নিখোঁজেও এই আগ্রহ যেন তুঙ্গে উঠে গেছে। মন্তব্য হচ্ছে অফিসারের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েও-অনধিকার চর্চাই নয়, মিথ্যাতেও ভরপুর এসব। ঘর পেড়ার মধ্যে আলু খেতে চাইছে কেউ কেউ। একটু আগে পুলিশপ্রধান ফোন করেছিলেন। এই ফোনটা সাজিয়াকে নিতে হলো। আইজিপি সাহেব নানা সান্ত¡নার কথা শোনালেন-

‘পুলিশ তোমার মেয়েকে খুঁজে বার করবেই।’ এও শোনালেন, ‘বলেছিলাম, রমনা কমপ্লেক্সে বাসা নাও। শোনোনি।’

সাজিয়ার কথা বলতে বিশেষ ইচ্ছে হলো। জি, হ্যাঁ আর স্যার দিয়েই কথা শেষ করলেন।

লামিয়াবিহীন চতুর্থ রাত আজ। সাজিয়া-তৌফিকের মধ্যে বিন্দুমাত্র স্বস্তি ফিরে আসেনি। কোনো তরফের কোনো আশ্বাসই বাবা-মায়ের মধ্যে একরত্তি আশা জাগাতে পারছে না। সে সম্ভবও না। স্বস্তি তো একমাত্র মেয়েকে বুকে ফিরে পাওয়া। সেই পথ কোনো সংস্থাই দেখাতে পারছে না। বরং এক-একটি ঘণ্টার পর বিষয়টি আরো জটিল হচ্ছে বলেই সাজিয়ার মনে হতে থাকে। নিজেরও গোয়েন্দা প্রশিক্ষণ আছে। সবটাই বুঝতে পারেন তিনি। পুলিশ যেভাবে এগুচ্ছে বা যা করতে চাইছে তাতে মেয়েকে পাওয়ার আশা যে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে সে বোঝার ক্ষমতা সাজিয়ার এখনো উবে যায়নি। পুলিশের কোনো সংস্থাই সামান্য ক্লু উদ্ধার করতে পারেনি। সামিয়াও বোনের জন্য ব্যকুল হয়ে উঠছে। অতি প্রয়োজনে খাচ্ছে বটে, কিন্তু কিছুই বলছে না। তৌফিকের শাশুড়ি মেয়ের বাসাতেই পড়ে আছেন। সাজিয়ার ভাই-ভাবিও দু’বেলা এসে কিছু সময় কাটিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাতে কী! লামিয়া কোথায়?

মাস্টার বেডে সাজিয়াকে নিয়ে মা শুয়েছেন। বাবা মেয়ের সঙ্গে অপর কক্ষে। লামিয়া ভয় পাচ্ছে একা ঘুমাতে। চতুর্থ রাতে সাজিয়ার ভাই-ভাবিও রাতে থেকে গেছেন। কেবলই একটু তন্দ্রার মতো এসেছে সাজিয়ার; লামিয়া হারিয়ে যাওয়া থেকেই মায়ের ঘুম হারিয়ে গেছিল। আজ বরং সামান্য একটু ঘুমের দেখা মিললো। হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেল সাজিয়ার। কী এক-শব্দে সেটা। ওয়ালে চোখ পড়তেই আবছা আলোয় দেখলো, রাত তিনটে সাতচল্লিশ।

‘মা, এই যে এখানে আমি।’ সে কী! এ তো লামিয়া কথা বলছে! সাজিয়া উঠে বসতে চাইলেন। পারলেন না। এদিক-সেদিক তাকালেন। নিষ্প্রভ ভালব জ্বলছে। কিন্তু ঘরের কোথাও লামিয়াকে দেখতে পেলেন না।

‘তুমি ঠিক এখনই আমাকে দেখতে পাবে না, মা। আমি তোমাকে দেখছি। যা বলছি, শোনো, মা। মন দিয়ে শোন।’

সাজিয়া কিছুই বললেন না। তার দারুণ পিপাসা পেয়েছে। কিন্তু উঠতে পারছেন না। তার চেয়ে জরুরি মেয়ের কথা শোনা। পানির পিপাসাও উবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

‘সংক্ষেপে শোন। আমার মধ্যে এক-প্রকারের সুপার ন্যাচারাল ক্ষমতার আধার চলে এসেছে, মানে ভর করেছে, মা। এই সময়ের পৃথিবীতে এটি কেবল আমারই আছে। সেটা এমনই যে, পুরো পৃথিবী ধ্বংস করে দিতে আমার একার মাথাই দুনিয়াসুদ্ধ সকল মানুষের সমান। আমার মস্তিষ্কে আছে এমন এক-শক্তি, যা দিয়ে একনিমিষে এই পৃথিবী যেমন চুরমার করে দেয়া যায়; আবার এমন একাধিক পৃথিবী সেকেন্ডেই গড়ে দিতে পারি।’

ঘেমে যাচ্ছেন সাজিয়া। সামান্য শ্বাসকষ্টও অনুভূত হচ্ছে তার।

‘কর্নেল-নানা বাবাকে কিছু বলেননি! জানেন তো। বলতে পারতেন। অবশ্য তার বলতেও সমস্যা ছিল। তিনিসহ যারাই বাসায় এসেছেন সবটাই মনিটর করা হচ্ছে। এসব খবর নিমিষেই পৌঁছে যাচ্ছে সর্বাধিক ক্ষমতাধর দেশের গোয়েন্দা সংস্থার হাতে। পথে আরো কয়েকটা জায়গা হয়েই তবে যায়। পুলিশেরও জানার কথা নয়, গত দুই সপ্তাহ ধরেই আমাদের বাসার চারদিকে শতচোখের নজরদাারি চলছেই। পৃথিবীর এক-নম্বরের সুপার পাওয়ারের পক্ষে এটা করছে আমাদের প্রতিবেশি দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। ওরা নিজেরাই করতে পারত, কিন্তু ওদের দেখে তো মানুষ চিনে ফেলবে; সেটা সুপার পাওয়ারের দেশটি চায়নি। কেনো আর কী হয়েছে, মা? সেটাই বলছি।’

মন্ত্রমুগ্ধের মতোই শুনে যাচ্ছেন সাজিয়া। এবার মনে হচ্ছে,লাামিয়া যেনো পাশে বসেই সবটা বলছে। মেয়ের উপস্থিতি এবার শতভাগ অনুভূত হচ্ছে মায়ের কাছে।

‘প্রতিবেশি দেশের গোয়েন্দারা আমাকে ক’দিনেই পহেলা সুপার পাওয়ারের হাতে তুলে দিত। আমার মেধা তাদের দরকারই দরকার। আমার মস্তিষ্ক প্রথমে ওই শক্তিধর দেশটি নিউট্রাল করতে চেয়েছিল, সেটা করে দিতে পারলে আমাকে তুলে নেয়ার দরকার হতো না ওদের। কিন্তু ততদিনে আমি এক-বিশেষ শক্তির অধিকারী হওয়ায় সে দেশের বিজ্ঞানীরা আমার মাথার অভূতপূর্ব শক্তিকে নিউট্রাল করতে পারেনি। এখন তারা আমাকে বিজ্ঞানের কাজে লাগাতে তুলে নিতে চায়। সেটা টের পেয়েই আমি আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করেছি। আমার মাথা বিবদমান দুই সুপার পাওয়ারের সকল গবেষণা-আবিষ্কার খেয়ে নিতে পারে বলেই আমাকে নিয়ে ওদের এতা দুঃশ্চিন্তা। আমি এখন এআইর চেয়েও বহুগুণ এগিয়ে থাকা এক-প্রযুক্তির আধার। মানুষকে এই অবস্থায় যেতে সহ¯্র বছর লেগে যাবে। তারপরও আদৌ পৌঁছতে পারবে কিনা বলা দুরূহ।’

অনেক কষ্টে উঠে বসলেন সাজিয়া।

‘মা, ভয় পেয়ো না। ওরা আমাকে নিতে পারবে না। কিন্তু এখনি আমার প্রকাশ্যে থাকা ঠিক হবে না- আমি যে কোনো অবস্থায়, যে কোনা জায়গায় থাকার শক্তি অর্জন করেছি; আমি শূন্যে ঘুমাতে পারি, হাঁটতে পারি, দৌড়াতে পারি। আমাকে তুলে নেয়ার নেয়ার ওদের সকল শক্তি নিউট্রাল করে দিয়েই ফিরে আসব। বলি, আমাদের সরকারের একটা পর্যায় কিন্তু আমাকে তুলে নেয়ার এসব খবর জানত। তারা প্রথমে আমাকে প্রটেক্ট করতে চেয়েছিল। কিন্তু পৃথিবীর সেরা সুপার পাওয়ারের চাওয়ার সঙ্গে তাদের হার মানতে হয়েছে। সেই সুপার পাওয়ারের চাপেই একটি প্রতিবেশি দেশ কাজটিতে ইনভলভ্ হয়েছে। আমার মস্তিষ্কের এই অতি-অস্বাভাবিক ক্ষমতা আরো দু’একটি ক্ষমতাধর দেশও জেনে গেছিল। কিন্তু তাদের একটু দেরি হয়ে গেছে। আমাদের সরকার দেখেছে, একে রেখে আমাদের কী! আমরা এর মেধার কিছুই ব্যবহার করতে পারব না। বৃহৎ শক্তিধর দেশ খুশি থাকলেই আমাদের মঙ্গল। আরো একটু বলি, মা একবছর তিনমাস আগে আমি এআইকে একটা কঠিন গাণিতিক-পদার্থ বিদ্যার জটিলতা দিয়ে সমাধান চেয়েছিলাম। এআই সময় নিয়েও পারেনি। ওটার সমাধান আমিই করে দিয়েছি আর তখনই আমার এই অস্বাভাবিক প্রতিভার খবর প্রথমে আটলান্টিকের ওপারের দেশটির ন্যাশনাল সাইন্স ইনস্টিটিউট এবং পরে পৃথিবীর দ্বিতীয় শক্তিধর দেশটির কেন্দ্রীয় সাইন্স ল্যাব জেনে যায়।’

মা, মা লামি বলে ডুকরে কেঁদে উঠলেন সাজিয়া।

‘একদম কেঁদো না। এই আমি। হাতটা ধরো। আমার কোনো ক্ষুধা কাজ করে না, দরকার হয় না মানবীয় কিছুর। তারপরও গিয়ে দেখো, ফ্রিজ থেকে রান্না করা ইলিশের ডিমটা কিন্তু খেয়ে নিয়েছি। তুমি রাতে খাওনি। কেঁদে কেঁদে রেখে দিয়েছো, ওটা আমার অতি পছন্দ বলেই। বলছি মা, শীঘ্রই ফিরে আসছি। এখনো কিন্তু বাসার আশেপাশেই আছি। হয়তো বাসাতেই। ভালো আছি, মা। তুমি একদমই টেনশন করো না। বাবাকে আপাতত কিছু বলার দরকার নেই। আমি এআইর সুপার-ডুপার ভার্শন বলে ওরাই পরাস্ত হবে। দেখবে, চারপাশে আর কেউ নেই, তখন আমি সাধারণ জীবনে ফিরে আসব, মা। কাল তো তোমার একটা ভালো খবর পাওয়ার আছে। ফিরে আসি, ওটার সেলিব্রেট হবে।’

মেয়ে হারিয়ে যাওয়ার পঞ্চমদিনে অফিসে এসেছেন সাজিয়া। এসেই খবরটা জানলেন। তিনি অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। কিছুক্ষণ পরেই ওয়েবে আদেশ দেখা যাবে। এই খবর শুনেও সাজিয়ার মধ্যে আনন্দের রেশটুকু নেই। তিনি অনিমিখ চেয়ে আছেন কেবল। মুখেও কোনো শব্দ নেই। লামিয়ার ফেরাতেই তার সবকিছু আটকে আছে যেন। দীর্ঘ ছুটির কথা ভাবছেন সাজিয়া-তিনি খুবই বিপর্যস্ত-বিমর্ষ আর ততোধিক ক্লান্ত।

back to top