মিঠুন রাকসাম
কবি ও কথাসাহিত্যিক শাহ্নাজ মুন্নীর ২০২৫ সালের বইমেলায় প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’। প্রাথমিকপাঠে মনে হয়েছে-‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’ মূলত কুহক ও বিভ্রমের গল্প। যে কুহকের জালে এই পৃথিবীর মানুষ আটকে আছেন, প্রতিনিয়ত ছটফট করছেন আবার পিংপং বলের মতো এপার থেকে ওপারে গড়িয়ে পড়ছেন।এই বিভ্রম আসলে মায়ার বিভ্রম। যে বিভ্রম অর্থসম্পদ, ক্ষমতা কিংবা আত্মঅহমের- পৃথিবীর মানব সম্প্রদায় যে বিভ্রমরের পিছনে ছুটছে তো ছুটছেই। এটাও তো রাজনীতি নাকি? শাহ্নাজ মুন্নীর প্রতিটা গল্পেই রাজনীতির সূক্ষ্ম খেলা দেখতে পাওয়া যায়; সে রাজনীতি রাষ্ট্রযন্ত্রের কিংবা নারীপুরুষের কিংবা ক্ষমতাদম্ভের।
‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’ গল্পগ্রন্থের ১৭টি গল্পে আমরা সতের কাপ কফির আস্বাদ পাবো। এখন কথা হচ্ছে- কেউ কফি দুধ চিনি দিয়ে খেতে পছন্দ করে, কেউ দুধ চিনি ছাড়া খেতে পছন্দ করে। কেউ আবার কফি দুধসহযোগে চিনি ছাড়া খেতে পছন্দ করে আবার কেউবা কম-বেশি খেতে পছন্দ করে। শাহনাজ মুন্নীর গল্পগুলো পাঠকের কাছে কীভাবে গৃহীত হলো- সেটা পাঠকই অধিক জানেন।
গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’-এর মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে কয়েদখানার স্বাদ নিতে নিতে বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ মো. রুহুল আমিনের বীরত্বগাথা (গল্প-সমুদ্রের ঘ্রাণ) শুনতে শুনতে বেরিয়ে যেতে পারেন। নয়তো ‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’ গল্পের মতো টিকিট কেটে প্রবেশ করে বের হতে নাও পারেন। আপনার যাত্রা মাত্র শুরু হতে পারে কিংবা নেক্সট...
আমরা কেউ তালগাছ উড়ে যেতে দেখিনি। কিন্তু তালগাছ নিয়ে নানান মুখরোচক ভৌতিক গালগপ্প শুনেছি। সেই তালগাছ যখন শাহ্নাজ মুন্নীর গল্পে উড়ে চলে তখন নড়েচড়ে বসতে হয়- ঘটনা বোঝার জন্যে। দাদাভাইয়ের দাদিআম্মার লাগানো তালগাছটি একসময় বিশাল মহীরূহে পরিণত হয়। কিন্তু ফল না দেয়ায় কাটার সিদ্ধান্ত হলেও কাটে না। কারণ গাঠটি ফল না দিলেও ছায়া তো দেয়, পাখিরা বসে, বাসাবাঁধে, ঝড়বৃষ্টিবজ্র থেকে মানুষকে রক্ষা করে। একসময় রসও তোলা হয়। আর তালগাছকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ নানান কাহিনি বলে যান গল্পকার। গল্পের শেষে দেখি তালগাছটির অস্থিমজ্জা ঝলসে যায় বজ্রাঘাতে। পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে গ্রামজুড়ে। গ্রামীণ মিথ এবং বাস্তবতার নিরিখে লেখা গল্পটি এই পৃথিবীতে মানুষ ছাড়াও বৃক্ষরাজি-প্রাণপ্রকৃতির অপরিহার্যতার কথা উঠে এসেছে।
জলের কি সিঁড়ি হয়? যে সিঁড়ি বেয়ে কেউ চলে যাবে? তবে বাইবেলে যিশুর কথা জানি, তিনি জলের উপর দিয়ে হেঁটে এসেছিলেন। কিন্তু শাহ্নাজ মুন্নীর ‘জলের সিঁড়ি বেয়ে’ গল্পটি একটি আধা-ভৌতিক একজন ছোট মেয়ের (জলি) গল্প। যে মেয়ে জলের উপর দিয়ে হাঁটতে পারে (‘আমি জলি। জলের উপরে দিয়া হাঁটি’), নদীর লঞ্চগুলো ডুবিয়ে দিতে পারে। ‘শোন, তোমারে বলি, কাউকে বইল্যে না, আমি হইলাম লঞ্চ ডুবাইন্যা পেতনি, ওই যে দেহো না নদীর মধ্যে ছোটো ছোটো লঞ্চ, সবগুলি আমি ডুবায়া দিতে পারি’। লেখকের কথায় গল্পের নায়ক(রাজিব) জানতে পারে, জলের পেতিœ জলি লঞ্চ দুর্ঘটনায় মারা গেছে। কিন্তু লেখকের লঞ্চভ্রমণে কিচ্ছুক্ষণের জন্য সঙ্গী হয়েছিলো। গল্পে নায়কের যখন ভালো ঠেকে না, তখন বরিশাল চলে যায় লঞ্চে করে। সেই লঞ্চে করে ফেরার সময়কার গল্প এটি। গল্প পাঠে লেখকের সাথে সাথে জলির জন্যে আমাদেরও হৃদয় আর্দ্র হয়।
‘ওই শোন বৃংহিত’ গল্পে মানুষ ও পশুর বেছে থাকার লড়াই জারির গল্প বলেছেন গল্পকার। গারো অধ্যুষিত অঞ্চল দিঘলাকোনা গ্রামের বাসিন্দা অঞ্জলী সাংমা, তার ছেলে রঙ্গন কিংবা রঙ্গনের আম্বির কথায় উঠে এসেছে গারো ভাষায় মংমাদের বন ছেড়ে হাতির লোকালয়ে আসার কারণ।
গারো সমাজে গারো সাহিত্যে হাতিদের নিয়ে নানা লোকগল্প নানা কাহিনি রয়েছে। হাতি আর গারোদের সম্পর্ক হলো মামা-ভাগ্নের। গারোরা হাতিকে নাম ধরে ডাকে না, মামা বলে ডাকে। গল্পে লেখক আম্বি বা অঞ্জলী সাংমার মাধ্যমে সেই মিথ কিংবা লোকগল্প বলার চেষ্টা করেছেন। যেমন- গারোদের প্রধান পানীয় চু খেয়ে মাতাল হয়ে নাচানাচি কিংবা ডিগবাজি খেয়ে হেলেদুলে আনন্দ করার কথা কিংবা পৃথিবীটাকে আটটি হাতি চারদিক থেকে শূন্যে ধরে রেখেছে। গল্পে গারো ভাষার শুদ্ধ ব্যবহার নিখাঁদ উচ্চারণ মুগ্ধ হবার মতোই।
‘মানুষের মেয়ে’ গল্পে রক্ত-মাংসের মেয়ের সাথে কাকাতুয়ার প্রেম-পরিণয়ের গল্পটি কাল্পনিক হলেও এই সমাজের পুরুষ নামক প্রাণিদের থেকে বিতৃষ্ণা প্রকাশ পেয়েছে অন্যদিকে হঠাৎ কাকাতুয়ার নারীর প্রতি বাসনা উদ্রেক হবার গল্পে পাঠক হঠাৎ উৎসুক হয়ে উঠবেন।
‘বিভ্রম’ গল্পটি পড়তে পড়তে মনে পড়ে যেতে পারে রমানাথ রায়ের-উপন্যাসের কথা। যে উপন্যাসে ঔপন্যাসিক রাজনীতিবিদদের দলের জন্যে নিজের বিবেক বুদ্ধি বিসর্জনের কথা বলেছেন একটি রূপক ব্যবহার করে। কিন্তু শাহনাজ মুন্নীর বিভ্রম গল্পটির বিষয় একই ঘরানার হলেও স্থান কাল পাত্র ভিন্ন ভিন্ন। এই গল্পের মধ্য দিয়ে লেখক দেখাতে চেয়েছেন, প্রত্যেক মানুষের ভেতর দুইটি রূপ দুইটি চরিত্র খেলা করে যে চরিত্রগুলো প্রতিনিয়ত অভিনয় করে যাচ্ছে। আবার সুযোগ বুঝে বেরিয়ে পড়ে তাদের লকলকে জিভ। বিভ্রম গল্পের মাধ্যমে লেখক মানুষের ভেতরের প্রকৃত মানুষটাকে উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন।
‘মশকরা’ গল্পটি একজন লেখকযশপ্রার্থীর নব্যলেখা উপন্যাসকে কেন্দ্র করে লিখিত। গল্পটি পড়তে শুরু করলে মজা পাবেন কিন্তু শেষ দৃশ্যে আপনার মনকে মোচড় দিয়ে দেখিয়ে দেবে- সব মশকরা আসলে মশকরা ঠিক না। যখন মশকরা জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়ায় তখন ‘দুই হাতে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে আমার’। তখন মশকরাও আপনাকে চোখ টিপে মশকরাই করবে।
‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’ গল্পগ্রন্থের মোট ১৭টি গল্পে ১৭ রকমের বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে।শাহনাজ মুন্নীর প্রথম গল্পগ্রন্থ‘জ্বীনের কন্যা’কে যতটা কাব্যময় বা কাব্যিক মনে হয়েছে ‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’ গল্পগ্রন্থটি সে তুলনায় একটু ঢিলেমি একটু রয়েসয়ে রসেবসে লেখা মনে হয়েছে। তবে ‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’ গল্প পাঠে একটা উপলব্ধির বিষয় আছে। সেটা হলো- ১৭টি গল্পের ১০টি গল্পই সরাসরি মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বা মৃত্যু বিষয়ক গল্প। গল্পকার মৃত্যুকে নানাভাবে দেখার কিংবা দেখানোর চেষ্টা করেছেন।
আবার কিছু গল্প আছে যেটাকে গল্পকার অনায়াসেই উপন্যাসে টেনে নিয়ে যেতে পারবেন বলে মনে হয়। এ ক্ষেত্রে মনে পড়ছে প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এবং অভিজিৎ সেনের নাম, যারা নিজেদের ছোটগল্পকে উপন্যাসে রূপ দিয়েছেন।
এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, কথাসাহিত্যিক শাহ্নাজ মুন্নীর এই গল্পগ্রন্থের গল্পগুলো শুধু গল্পকারের বয়ান না হয়ে পাঠকেরওবয়ান হয়ে উঠতে পেরেছে।
গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে কথা প্রকাশ। দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদটি করেছেন সব্যসাচী হাজরা। বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ৪০০ টাকা। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০২৫।
মিঠুন রাকসাম
বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫
কবি ও কথাসাহিত্যিক শাহ্নাজ মুন্নীর ২০২৫ সালের বইমেলায় প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’। প্রাথমিকপাঠে মনে হয়েছে-‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’ মূলত কুহক ও বিভ্রমের গল্প। যে কুহকের জালে এই পৃথিবীর মানুষ আটকে আছেন, প্রতিনিয়ত ছটফট করছেন আবার পিংপং বলের মতো এপার থেকে ওপারে গড়িয়ে পড়ছেন।এই বিভ্রম আসলে মায়ার বিভ্রম। যে বিভ্রম অর্থসম্পদ, ক্ষমতা কিংবা আত্মঅহমের- পৃথিবীর মানব সম্প্রদায় যে বিভ্রমরের পিছনে ছুটছে তো ছুটছেই। এটাও তো রাজনীতি নাকি? শাহ্নাজ মুন্নীর প্রতিটা গল্পেই রাজনীতির সূক্ষ্ম খেলা দেখতে পাওয়া যায়; সে রাজনীতি রাষ্ট্রযন্ত্রের কিংবা নারীপুরুষের কিংবা ক্ষমতাদম্ভের।
‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’ গল্পগ্রন্থের ১৭টি গল্পে আমরা সতের কাপ কফির আস্বাদ পাবো। এখন কথা হচ্ছে- কেউ কফি দুধ চিনি দিয়ে খেতে পছন্দ করে, কেউ দুধ চিনি ছাড়া খেতে পছন্দ করে। কেউ আবার কফি দুধসহযোগে চিনি ছাড়া খেতে পছন্দ করে আবার কেউবা কম-বেশি খেতে পছন্দ করে। শাহনাজ মুন্নীর গল্পগুলো পাঠকের কাছে কীভাবে গৃহীত হলো- সেটা পাঠকই অধিক জানেন।
গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’-এর মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে কয়েদখানার স্বাদ নিতে নিতে বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ মো. রুহুল আমিনের বীরত্বগাথা (গল্প-সমুদ্রের ঘ্রাণ) শুনতে শুনতে বেরিয়ে যেতে পারেন। নয়তো ‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’ গল্পের মতো টিকিট কেটে প্রবেশ করে বের হতে নাও পারেন। আপনার যাত্রা মাত্র শুরু হতে পারে কিংবা নেক্সট...
আমরা কেউ তালগাছ উড়ে যেতে দেখিনি। কিন্তু তালগাছ নিয়ে নানান মুখরোচক ভৌতিক গালগপ্প শুনেছি। সেই তালগাছ যখন শাহ্নাজ মুন্নীর গল্পে উড়ে চলে তখন নড়েচড়ে বসতে হয়- ঘটনা বোঝার জন্যে। দাদাভাইয়ের দাদিআম্মার লাগানো তালগাছটি একসময় বিশাল মহীরূহে পরিণত হয়। কিন্তু ফল না দেয়ায় কাটার সিদ্ধান্ত হলেও কাটে না। কারণ গাঠটি ফল না দিলেও ছায়া তো দেয়, পাখিরা বসে, বাসাবাঁধে, ঝড়বৃষ্টিবজ্র থেকে মানুষকে রক্ষা করে। একসময় রসও তোলা হয়। আর তালগাছকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ নানান কাহিনি বলে যান গল্পকার। গল্পের শেষে দেখি তালগাছটির অস্থিমজ্জা ঝলসে যায় বজ্রাঘাতে। পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে গ্রামজুড়ে। গ্রামীণ মিথ এবং বাস্তবতার নিরিখে লেখা গল্পটি এই পৃথিবীতে মানুষ ছাড়াও বৃক্ষরাজি-প্রাণপ্রকৃতির অপরিহার্যতার কথা উঠে এসেছে।
জলের কি সিঁড়ি হয়? যে সিঁড়ি বেয়ে কেউ চলে যাবে? তবে বাইবেলে যিশুর কথা জানি, তিনি জলের উপর দিয়ে হেঁটে এসেছিলেন। কিন্তু শাহ্নাজ মুন্নীর ‘জলের সিঁড়ি বেয়ে’ গল্পটি একটি আধা-ভৌতিক একজন ছোট মেয়ের (জলি) গল্প। যে মেয়ে জলের উপর দিয়ে হাঁটতে পারে (‘আমি জলি। জলের উপরে দিয়া হাঁটি’), নদীর লঞ্চগুলো ডুবিয়ে দিতে পারে। ‘শোন, তোমারে বলি, কাউকে বইল্যে না, আমি হইলাম লঞ্চ ডুবাইন্যা পেতনি, ওই যে দেহো না নদীর মধ্যে ছোটো ছোটো লঞ্চ, সবগুলি আমি ডুবায়া দিতে পারি’। লেখকের কথায় গল্পের নায়ক(রাজিব) জানতে পারে, জলের পেতিœ জলি লঞ্চ দুর্ঘটনায় মারা গেছে। কিন্তু লেখকের লঞ্চভ্রমণে কিচ্ছুক্ষণের জন্য সঙ্গী হয়েছিলো। গল্পে নায়কের যখন ভালো ঠেকে না, তখন বরিশাল চলে যায় লঞ্চে করে। সেই লঞ্চে করে ফেরার সময়কার গল্প এটি। গল্প পাঠে লেখকের সাথে সাথে জলির জন্যে আমাদেরও হৃদয় আর্দ্র হয়।
‘ওই শোন বৃংহিত’ গল্পে মানুষ ও পশুর বেছে থাকার লড়াই জারির গল্প বলেছেন গল্পকার। গারো অধ্যুষিত অঞ্চল দিঘলাকোনা গ্রামের বাসিন্দা অঞ্জলী সাংমা, তার ছেলে রঙ্গন কিংবা রঙ্গনের আম্বির কথায় উঠে এসেছে গারো ভাষায় মংমাদের বন ছেড়ে হাতির লোকালয়ে আসার কারণ।
গারো সমাজে গারো সাহিত্যে হাতিদের নিয়ে নানা লোকগল্প নানা কাহিনি রয়েছে। হাতি আর গারোদের সম্পর্ক হলো মামা-ভাগ্নের। গারোরা হাতিকে নাম ধরে ডাকে না, মামা বলে ডাকে। গল্পে লেখক আম্বি বা অঞ্জলী সাংমার মাধ্যমে সেই মিথ কিংবা লোকগল্প বলার চেষ্টা করেছেন। যেমন- গারোদের প্রধান পানীয় চু খেয়ে মাতাল হয়ে নাচানাচি কিংবা ডিগবাজি খেয়ে হেলেদুলে আনন্দ করার কথা কিংবা পৃথিবীটাকে আটটি হাতি চারদিক থেকে শূন্যে ধরে রেখেছে। গল্পে গারো ভাষার শুদ্ধ ব্যবহার নিখাঁদ উচ্চারণ মুগ্ধ হবার মতোই।
‘মানুষের মেয়ে’ গল্পে রক্ত-মাংসের মেয়ের সাথে কাকাতুয়ার প্রেম-পরিণয়ের গল্পটি কাল্পনিক হলেও এই সমাজের পুরুষ নামক প্রাণিদের থেকে বিতৃষ্ণা প্রকাশ পেয়েছে অন্যদিকে হঠাৎ কাকাতুয়ার নারীর প্রতি বাসনা উদ্রেক হবার গল্পে পাঠক হঠাৎ উৎসুক হয়ে উঠবেন।
‘বিভ্রম’ গল্পটি পড়তে পড়তে মনে পড়ে যেতে পারে রমানাথ রায়ের-উপন্যাসের কথা। যে উপন্যাসে ঔপন্যাসিক রাজনীতিবিদদের দলের জন্যে নিজের বিবেক বুদ্ধি বিসর্জনের কথা বলেছেন একটি রূপক ব্যবহার করে। কিন্তু শাহনাজ মুন্নীর বিভ্রম গল্পটির বিষয় একই ঘরানার হলেও স্থান কাল পাত্র ভিন্ন ভিন্ন। এই গল্পের মধ্য দিয়ে লেখক দেখাতে চেয়েছেন, প্রত্যেক মানুষের ভেতর দুইটি রূপ দুইটি চরিত্র খেলা করে যে চরিত্রগুলো প্রতিনিয়ত অভিনয় করে যাচ্ছে। আবার সুযোগ বুঝে বেরিয়ে পড়ে তাদের লকলকে জিভ। বিভ্রম গল্পের মাধ্যমে লেখক মানুষের ভেতরের প্রকৃত মানুষটাকে উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন।
‘মশকরা’ গল্পটি একজন লেখকযশপ্রার্থীর নব্যলেখা উপন্যাসকে কেন্দ্র করে লিখিত। গল্পটি পড়তে শুরু করলে মজা পাবেন কিন্তু শেষ দৃশ্যে আপনার মনকে মোচড় দিয়ে দেখিয়ে দেবে- সব মশকরা আসলে মশকরা ঠিক না। যখন মশকরা জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়ায় তখন ‘দুই হাতে নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে আমার’। তখন মশকরাও আপনাকে চোখ টিপে মশকরাই করবে।
‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’ গল্পগ্রন্থের মোট ১৭টি গল্পে ১৭ রকমের বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে।শাহনাজ মুন্নীর প্রথম গল্পগ্রন্থ‘জ্বীনের কন্যা’কে যতটা কাব্যময় বা কাব্যিক মনে হয়েছে ‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’ গল্পগ্রন্থটি সে তুলনায় একটু ঢিলেমি একটু রয়েসয়ে রসেবসে লেখা মনে হয়েছে। তবে ‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’ গল্প পাঠে একটা উপলব্ধির বিষয় আছে। সেটা হলো- ১৭টি গল্পের ১০টি গল্পই সরাসরি মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বা মৃত্যু বিষয়ক গল্প। গল্পকার মৃত্যুকে নানাভাবে দেখার কিংবা দেখানোর চেষ্টা করেছেন।
আবার কিছু গল্প আছে যেটাকে গল্পকার অনায়াসেই উপন্যাসে টেনে নিয়ে যেতে পারবেন বলে মনে হয়। এ ক্ষেত্রে মনে পড়ছে প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এবং অভিজিৎ সেনের নাম, যারা নিজেদের ছোটগল্পকে উপন্যাসে রূপ দিয়েছেন।
এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, কথাসাহিত্যিক শাহ্নাজ মুন্নীর এই গল্পগ্রন্থের গল্পগুলো শুধু গল্পকারের বয়ান না হয়ে পাঠকেরওবয়ান হয়ে উঠতে পেরেছে।
গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে কথা প্রকাশ। দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদটি করেছেন সব্যসাচী হাজরা। বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ৪০০ টাকা। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০২৫।