alt

সাময়িকী

আবুল হাসানের কবিতা

প্রেম, অস্তিত্ববাদ ও বেদনার দোলাচল

শাহেদ কায়েস

: শুক্রবার, ০৮ আগস্ট ২০২৫

আবুল হাসান / জন্ম : ৪ আগস্ট ১৯৪৭; মৃত্যু : ২৬ নভেম্বর ১৯৭৫ প্রতিকৃতি : মাসুক হেলাল

রাত্রির স্তব্ধতায় স্টেশন ছেড়ে ট্রেন চলে যায় দূরে, যেমন চলে যায় কোনো এক সময়ের প্রিয় মুখ। আবুল হাসানের প্রেম ঠিক এই ট্রেনের মতোই- চলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া, কিংবা যাকে ধরে রাখা যায় না, এমন কিছু। তাঁর প্রেমের কবিতাগুলো পড়ে মনে হয়, শহরের কোনো শীতার্ত জানালার পাশে বসে কবি কাঁপতে কাঁপতে প্রেম লিখছেন; লিখছেন বিচ্ছেদ, অনুপস্থিতি, অবসাদ, আর মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া এক বিষণœ ভালোবাসা।

তিনি লিখেছেন-

“প্রিয়তম পাতাগুলি ঝরে যাবে মনেও রাখবে না

আমি কে ছিলাম, কী ছিলাম- কেন আমি

সংসারী না হয়ে খুব রাগ করে হয়েছি সন্ন্যাসী

হয়েছি হিরণদাহ, হয়েছি বিজনব্যথা, হয়েছি আগুন!...”

(সেই মানবীর কণ্ঠ/ যে তুমি হরণ করো)

“অবশেষে জেনেছি মানুষ একা!

জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!

দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনোদিন।...”

(পাখি হয়ে যায় প্রাণ/ রাজা যায় রাজা আসে)

এই একা থাকার ভাষা আবুল হাসান প্রেম দিয়ে নয়, প্রেমহীনতা দিয়ে নির্মাণ করেছেন। তাঁর কবিতায় প্রেম আলো হয়ে আসে না, আসে কষ্টের ঘন ছায়া হয়ে। পুরোনো প্রেমিকার দীর্ঘশ্বাস হয়ে, কিংবা যে চোখে জল জমে না, কিন্তু ভিজে থাকে গভীরভাবে- তেমন এক চাহনির মতো। কবির কাছে প্রেম চুম্বনের উষ্ণতা নয়, বরং যেন ঠোঁটে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ।

বাংলা কবিতার ইতিহাসে আবুল হাসান এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম। মাত্র ২৯ বছর বয়সে এই কবি আমাদের ছেড়ে গেলেও, রেখে গেছেন এক গভীর, যন্ত্রণাময়, অথচ চিরন্তন কাব্যভুবন। তাঁর কবিতায় প্রেম শুধুমাত্র হৃদয়ের আকর্ষণ নয়, বরং অস্তিত্বের সংকট, আত্মবিরোধ, মৃত্যুচিন্তা ও ভাঙনের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে। তাই আবুল হাসানের প্রেমবোধ গড়ে উঠেছে এক অনিবার্য বিষণœতা ও নিঃসঙ্গতার মিশেলে।

আবুল হাসানের প্রেমের কবিতাগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে- কীভাবে তাঁর প্রেম বিষাদের সঙ্গে যুক্ত, কীভাবে নাগরিক নিঃসঙ্গতা ও ব্যক্তিগত অসুখ তাঁর প্রেমচেতনায় ঢুকে পড়ে, এবং কীভাবে এই প্রেম আমাদের সময়ের গভীর বাস্তবতার প্রতীক হয়ে ওঠে।

আবুল হাসান জন্মগ্রহণ করেন গোপালগঞ্জে। জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে শহুরে একাকিত্বে, সাংবাদিকতার চাপে, আর আত্মহননের সন্নিকটে দাঁড়িয়ে কবিতা লিখে। তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থ- ‘রাজা যায় রাজা আসে’, ‘যে তুমি হরণ করো’ এবং ‘পৃথক পালঙ্ক’র অনেক কবিতায় প্রেম কেন্দ্রে থাকা সত্ত্বেও, তা কখনোই রোমান্টিক প্রেমে পরিণত হয়নি। বরং প্রতিটি প্রেমের পেছনে লুকিয়ে থাকে অনুপস্থিতি, না পাওয়ার বেদনা, তীব্র আকাক্সক্ষা ও মৃত্যু-স্মৃতি।

আবুল হাসানের কবিতায় প্রেম বারবার একটি শূন্যতার দিকে ঠেলে দেয়। প্রেমিকা সেখানে অনুপস্থিত অথবা অনতিক্রান্ত দূরত্বে। উদাহরণস্বরূপ, তাঁর ‘প্রতীক্ষার শোকগাথা’ কবিতায় কবি লেখেন-

“তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ পড়ে আছে দ্যাখো প্রশান্ত টেবিলে

আর আমার হাতঘড়ি

নীল ডায়ালের তারা জ্বলছে মৃদু আমারই কব্জিতে!

ট্যুরিস্টের মতো লাগছে দেখতে আমাকে

সাংবাদিকের মতো ভীষণ উৎসাহী

এ মুহূর্তে সিগ্রেটের ছাই থেকে

শিশিরের মতো ন¤্র অপেক্ষার কষ্টগুলি ঝেড়ে ফেলেছি কালো অ্যাসট্রেতে!

রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসবে না আজ স্বাতী?...”

(প্রতীক্ষার শোকগাথা/ রাজা যায় রাজা আসে)

এই হারিয়ে ফেলার মধ্য দিয়েই প্রেম জন্ম নেয়। প্রেমিকার স্পর্শ নয়, বরং তাঁর অনুপস্থিতিই আবুল হাসানের প্রেমের প্রধান চালিকাশক্তি। এই অনুপস্থিতি কখনো হয়ে ওঠে অতীতের নস্টালজিয়া, কখনো বা ভবিষ্যতের ব্যর্থ স্বপ্ন। আবুল হাসানের প্রেম কখনোই নিছক একটি সম্পর্ক নয়। তা হয়ে ওঠে অস্তিত্বের সংকট, শরীরের ক্ষয়, এবং এক অনিবার্য মৃত্যুর দিকে যাত্রা। তাঁর কবিতায় প্রেমের চিত্র আরাধনার নয়- এ প্রেম বাস্তব, বিষাক্ত, অগ্নিময়, আত্মবিনাশী। এই প্রেম আরাধ্য কোনো অমরতা চায় না, চায় শুধু একসাথে পোড়ার, দংশনের, বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা।

“... দেখা হলো যদি আমাদের দুর্দিনে

আমি চুম্বনে চাইব না অমরতা!

আমাদের প্রেম হোক বিষে জজর...

সর্পচূড়ায় আমরা তো বাঁধি বাসা!

ফুটুক তোমার অঙ্গে অগ্নিফুল

ক্ষতি কী, শরীরগ্রন্থিতে গেঁথে নেব

আমাদের প্রেম না পেল কবির ভাষা

কাব্যচূড়ায় আমরা তো বাঁধি বাসা।”

(যুগলসন্ধি/ অগ্রন্থিত কবিতা)

আবুল হাসানের কবিতায় প্রেমিক ও প্রেমিকা মিলিত হয় ‘দুর্দিনে’, এক সংকটের, এক অন্ধকার সময়ের মধ্যে। তাই চুম্বন হবে না মোক্ষপ্রাপ্তির প্রতীক, হবে না কোনো স্বর্গীয় আনন্দ- বরং হবে এক ধ্বংসযাত্রার নিঃশ্বাস। চুম্বনের মাঝে প্রেমিক অমরতার বাসনা ত্যাগ করছেন- এখানে প্রেম চিরকালীন নয়, বরং ক্ষণস্থায়ী, বেদনাময়।

প্রেমিক আকাক্সক্ষা করছেন এমন এক প্রেম, যা বিষময়, বিপজ্জনক, অথচ গভীর ও অনিবার্য। সাপের ফণা- যেখানে বিষ সর্বাধিক, ভয়ানক এবং অস্থির, সেখানেই তারা বাসা বাঁধেন! এই প্রেম তাই কুসুমকোমল নয়- এই প্রেম আত্মধ্বংসী, এই প্রেম এক বিষাক্ত নির্ভরতা। প্রেমিক-প্রেমিকা চূড়ান্ত বিপদের জায়গাকে বেছে নিয়েছেন নিজেদের আশ্রয় হিসেবে। এটি একধরনের নিঃশব্দ আত্মত্যাগ, আত্মহীন প্রেম, যেখানে আবেগ নিজেকে দংশন করে আবারো নিজেকেই বাঁচায়। প্রেমিকা যেন আগুন, তাঁর শরীরে ফুটে উঠুক “অগ্নিফুল”- অর্থাৎ এমন কামনা ও যন্ত্রণা, যা দগ্ধ করে, পোড়ায়, জ্বালিয়ে দেয়। তবু প্রেমিক ভয় পান না। বরং সেই দহনকেও তিনি শরীরের গ্রন্থিতে ধারণ করতে চান। এ এক তীব্র কামনা- যেখানে প্রেম ও ব্যথা একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। আবুল হাসানের প্রেম কেবল অন্তর্জগতে সীমাবদ্ধ নয়। শহর, রাস্তা, শ্রমজীবী মানুষ, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ- সবই তাঁর প্রেমের পটভূমিতে উপস্থিত। ফলে তাঁর প্রেম-প্রত্যাশা ও বিফলতা রাজনৈতিক অর্থও বহন করে।

নগর সভ্যতা প্রেমকে নিরস্ত করে, অথচ সেই প্রেমই কবিকে বাঁচিয়ে রাখে। এই দ্বৈত অবস্থান আবুল হাসানের কাব্যিক মনোভঙ্গিকে গভীরতা দেয়। আবুল হাসানের জীবনে ব্যক্তিগত ব্যর্থতা, শারীরিক অসুস্থতা, এবং আত্মহননের প্রবণতা তাঁর প্রেমবোধকে আচ্ছন্ন করেছে। ফলে, তাঁর প্রেম কখনোই পরিপূর্ণ নয়, কখনোই মধুর নয়। বরং তা এক আত্মঘাতী আকুলতা।

“যেখানেই যাই আমি, সেখানেই রাত!

স্টেডিয়ামের খোলা আকাশের নিচে রেস্তোরাঁয়

অসীমা যেখানে তার অত নীল চোখের ভিতর

ধরেছে নিটোল দিন নিটোল দুপুর

সেখানে গেলেও তবু আমার কেবলই রাত

আমার কেবলই রাত হয়ে যায়!”

(অপরিচিতি/ অগ্রন্থিত কবিতা)

আবুল হাসানের প্রেম এমন এক অস্তিত্ব যেখানে প্রেমিক নিজেকেই ধ্বংস করতে চায়, শুধু ভালোবাসার চিহ্ন বাঁচিয়ে রাখার জন্য। আবুল হাসান প্রেমিক, কিন্তু তিনি নিছক ভালোবাসার কবি নন। তিনি যন্ত্রণার কবি, অস্তিত্বের সংকটের কবি, এবং এক নিঃসঙ্গ প্রহরের রাত্রির কবি। তাঁর প্রেমিকসত্তা সমাজ, সময়, মৃত্যু ও আত্মপরিচয়ের সংকটকে ধারণ করে। তাঁর কবিতায় প্রেম পাঠকের কাছে তাই ব্যক্তিগত নয়, বরং একটি সামষ্টিক বেদনার অংশ হয়ে ওঠে।

আবুল হাসানের প্রেমের কবিতা এক ধরনের বিষণœ আত্মসমর্পণ, যেখানে প্রেম মানে একাকীত্ব। প্রেমিকা চলে যায়, আর কবি পড়ে থাকেন ধূসর নগরীতে, রক্তবর্ণ বিকেলে, কিংবা ট্রামে করে ফেরা জনতার চোখে। আবুল হাসানের কাছে প্রেম মানে-মৃত্যুপুরীর শেষ আলো, একটি নিঃসঙ্গ হৃদয়ের চিৎকার, একটি অশ্রুপাতের শব্দহীন কাব্য। তাঁর কবিতায় প্রেম শুধুমাত্র ভালোবাসা নয়, বরং এক ধরনের চিৎকার, আত্মপ্রকাশ, এবং ধ্বংসের আগে শেষ জাগরণ। সেই কারণেই, আবুল হাসানের প্রেমের কবিতা চিরকালের, চিরবিষাদময়, চিরসংবেদী।

তথ্যসূত্র

আবুল হাসান, প্রেমের কবিতা সমগ্র (সংকলন ও ভূমিকা: ফারুক মাহমুদ), কবি প্রকাশনী, ২০১৯

আবুল হাসান, আবুল হাসান রচনা সমগ্র (ভূমিকা: শামসুর রাহমান), বিদ্যাপ্রকাশ, ১৯৯৪

রাইনহার্ট হেভিকে, আবুল হাসান, বাঙালি কবি জার্মান শিল্পী: এক অবিশ্বাস্য বন্ধুত্ব, প্রথমা, ২০২৩

ছবি

চরফুলের কন্যা

ছবি

নজরুলের গল্প ও উপন্যাস

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রলোভন এবং ধৈর্যের গল্প

ছবি

প্রসঙ্গ মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস

ছবি

‘কবিতার যুবরাজ’ কবি আবুল হাসান

ছবি

মানুষ, প্রকৃতি ও সুলতানের স্বকীয় অভিযাত্রা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

শালুক-এর শঙ্খ ঘোষ সংখ্যা বাংলাদেশের সশ্রদ্ধ মূল্যায়ন

ছবি

‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’: কুহক ও বিভ্রমের গল্প

ছবি

কল্পগল্প

ছবি

আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা’

ছবি

প্রসঙ্গ মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস

ছবি

আনন্দদায়ক ও অপ্রত্যাশিত নোবেল পুরস্কার

ছবি

জীবনবোধ ও শিল্পকর্ম

ছবি

নজরুলের গল্প ও উপন্যাস

ছবি

কৃষ্ণাঙ্গ দাস থেকে হয়ে উঠেছিলেন খ্যাতিমান কবি

শ্রাবণ বর্ষণে

ছবি

শতবর্ষ পরে ‘মিসেস ডালোওয়ে’

ছবি

স্কাল্পচারের জগতটা আস্তে আস্তে ব্যাপকতা পাচ্ছে

ছবি

চব্বিশের অভ্যুত্থান নিয়ে গ্রন্থ

ছবি

ভিন্নচোখ: নুতন কবিতা সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকা: মৃত্যুর রূপক এবং আন্দালুসিয়ার লোকজ বিশ্বাস

ছবি

কবিতার শিল্পনিষ্ঠ রূপকার ফারুক মাহমুদ

ছবি

কাফকাকে পড়া কাফকাকে পড়ানো

ছবি

কবি নওশাদ নূরী

ছবি

আঁধার পেরিয়ে আলোর উদ্ভাষণ

ছবি

সন্জীদা খাতুন : কৃতি ও কৃতিত্ব

ছবি

ব্রেশায় উড়োজাহাজ

ছবি

মননশস্যের অমৃত মন্থন

ছবি

অনুবাদ ও ভূমিকা : আলী সিদ্দিকী

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বড়শি

ছবি

কাফকাকে পড়া, কাফকাকে পড়ানো

এ মুখর বরষায়

tab

সাময়িকী

আবুল হাসানের কবিতা

প্রেম, অস্তিত্ববাদ ও বেদনার দোলাচল

শাহেদ কায়েস

আবুল হাসান / জন্ম : ৪ আগস্ট ১৯৪৭; মৃত্যু : ২৬ নভেম্বর ১৯৭৫ প্রতিকৃতি : মাসুক হেলাল

শুক্রবার, ০৮ আগস্ট ২০২৫

রাত্রির স্তব্ধতায় স্টেশন ছেড়ে ট্রেন চলে যায় দূরে, যেমন চলে যায় কোনো এক সময়ের প্রিয় মুখ। আবুল হাসানের প্রেম ঠিক এই ট্রেনের মতোই- চলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া, কিংবা যাকে ধরে রাখা যায় না, এমন কিছু। তাঁর প্রেমের কবিতাগুলো পড়ে মনে হয়, শহরের কোনো শীতার্ত জানালার পাশে বসে কবি কাঁপতে কাঁপতে প্রেম লিখছেন; লিখছেন বিচ্ছেদ, অনুপস্থিতি, অবসাদ, আর মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া এক বিষণœ ভালোবাসা।

তিনি লিখেছেন-

“প্রিয়তম পাতাগুলি ঝরে যাবে মনেও রাখবে না

আমি কে ছিলাম, কী ছিলাম- কেন আমি

সংসারী না হয়ে খুব রাগ করে হয়েছি সন্ন্যাসী

হয়েছি হিরণদাহ, হয়েছি বিজনব্যথা, হয়েছি আগুন!...”

(সেই মানবীর কণ্ঠ/ যে তুমি হরণ করো)

“অবশেষে জেনেছি মানুষ একা!

জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!

দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনোদিন।...”

(পাখি হয়ে যায় প্রাণ/ রাজা যায় রাজা আসে)

এই একা থাকার ভাষা আবুল হাসান প্রেম দিয়ে নয়, প্রেমহীনতা দিয়ে নির্মাণ করেছেন। তাঁর কবিতায় প্রেম আলো হয়ে আসে না, আসে কষ্টের ঘন ছায়া হয়ে। পুরোনো প্রেমিকার দীর্ঘশ্বাস হয়ে, কিংবা যে চোখে জল জমে না, কিন্তু ভিজে থাকে গভীরভাবে- তেমন এক চাহনির মতো। কবির কাছে প্রেম চুম্বনের উষ্ণতা নয়, বরং যেন ঠোঁটে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ।

বাংলা কবিতার ইতিহাসে আবুল হাসান এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম। মাত্র ২৯ বছর বয়সে এই কবি আমাদের ছেড়ে গেলেও, রেখে গেছেন এক গভীর, যন্ত্রণাময়, অথচ চিরন্তন কাব্যভুবন। তাঁর কবিতায় প্রেম শুধুমাত্র হৃদয়ের আকর্ষণ নয়, বরং অস্তিত্বের সংকট, আত্মবিরোধ, মৃত্যুচিন্তা ও ভাঙনের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করে। তাই আবুল হাসানের প্রেমবোধ গড়ে উঠেছে এক অনিবার্য বিষণœতা ও নিঃসঙ্গতার মিশেলে।

আবুল হাসানের প্রেমের কবিতাগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে- কীভাবে তাঁর প্রেম বিষাদের সঙ্গে যুক্ত, কীভাবে নাগরিক নিঃসঙ্গতা ও ব্যক্তিগত অসুখ তাঁর প্রেমচেতনায় ঢুকে পড়ে, এবং কীভাবে এই প্রেম আমাদের সময়ের গভীর বাস্তবতার প্রতীক হয়ে ওঠে।

আবুল হাসান জন্মগ্রহণ করেন গোপালগঞ্জে। জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে শহুরে একাকিত্বে, সাংবাদিকতার চাপে, আর আত্মহননের সন্নিকটে দাঁড়িয়ে কবিতা লিখে। তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থ- ‘রাজা যায় রাজা আসে’, ‘যে তুমি হরণ করো’ এবং ‘পৃথক পালঙ্ক’র অনেক কবিতায় প্রেম কেন্দ্রে থাকা সত্ত্বেও, তা কখনোই রোমান্টিক প্রেমে পরিণত হয়নি। বরং প্রতিটি প্রেমের পেছনে লুকিয়ে থাকে অনুপস্থিতি, না পাওয়ার বেদনা, তীব্র আকাক্সক্ষা ও মৃত্যু-স্মৃতি।

আবুল হাসানের কবিতায় প্রেম বারবার একটি শূন্যতার দিকে ঠেলে দেয়। প্রেমিকা সেখানে অনুপস্থিত অথবা অনতিক্রান্ত দূরত্বে। উদাহরণস্বরূপ, তাঁর ‘প্রতীক্ষার শোকগাথা’ কবিতায় কবি লেখেন-

“তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ পড়ে আছে দ্যাখো প্রশান্ত টেবিলে

আর আমার হাতঘড়ি

নীল ডায়ালের তারা জ্বলছে মৃদু আমারই কব্জিতে!

ট্যুরিস্টের মতো লাগছে দেখতে আমাকে

সাংবাদিকের মতো ভীষণ উৎসাহী

এ মুহূর্তে সিগ্রেটের ছাই থেকে

শিশিরের মতো ন¤্র অপেক্ষার কষ্টগুলি ঝেড়ে ফেলেছি কালো অ্যাসট্রেতে!

রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসবে না আজ স্বাতী?...”

(প্রতীক্ষার শোকগাথা/ রাজা যায় রাজা আসে)

এই হারিয়ে ফেলার মধ্য দিয়েই প্রেম জন্ম নেয়। প্রেমিকার স্পর্শ নয়, বরং তাঁর অনুপস্থিতিই আবুল হাসানের প্রেমের প্রধান চালিকাশক্তি। এই অনুপস্থিতি কখনো হয়ে ওঠে অতীতের নস্টালজিয়া, কখনো বা ভবিষ্যতের ব্যর্থ স্বপ্ন। আবুল হাসানের প্রেম কখনোই নিছক একটি সম্পর্ক নয়। তা হয়ে ওঠে অস্তিত্বের সংকট, শরীরের ক্ষয়, এবং এক অনিবার্য মৃত্যুর দিকে যাত্রা। তাঁর কবিতায় প্রেমের চিত্র আরাধনার নয়- এ প্রেম বাস্তব, বিষাক্ত, অগ্নিময়, আত্মবিনাশী। এই প্রেম আরাধ্য কোনো অমরতা চায় না, চায় শুধু একসাথে পোড়ার, দংশনের, বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা।

“... দেখা হলো যদি আমাদের দুর্দিনে

আমি চুম্বনে চাইব না অমরতা!

আমাদের প্রেম হোক বিষে জজর...

সর্পচূড়ায় আমরা তো বাঁধি বাসা!

ফুটুক তোমার অঙ্গে অগ্নিফুল

ক্ষতি কী, শরীরগ্রন্থিতে গেঁথে নেব

আমাদের প্রেম না পেল কবির ভাষা

কাব্যচূড়ায় আমরা তো বাঁধি বাসা।”

(যুগলসন্ধি/ অগ্রন্থিত কবিতা)

আবুল হাসানের কবিতায় প্রেমিক ও প্রেমিকা মিলিত হয় ‘দুর্দিনে’, এক সংকটের, এক অন্ধকার সময়ের মধ্যে। তাই চুম্বন হবে না মোক্ষপ্রাপ্তির প্রতীক, হবে না কোনো স্বর্গীয় আনন্দ- বরং হবে এক ধ্বংসযাত্রার নিঃশ্বাস। চুম্বনের মাঝে প্রেমিক অমরতার বাসনা ত্যাগ করছেন- এখানে প্রেম চিরকালীন নয়, বরং ক্ষণস্থায়ী, বেদনাময়।

প্রেমিক আকাক্সক্ষা করছেন এমন এক প্রেম, যা বিষময়, বিপজ্জনক, অথচ গভীর ও অনিবার্য। সাপের ফণা- যেখানে বিষ সর্বাধিক, ভয়ানক এবং অস্থির, সেখানেই তারা বাসা বাঁধেন! এই প্রেম তাই কুসুমকোমল নয়- এই প্রেম আত্মধ্বংসী, এই প্রেম এক বিষাক্ত নির্ভরতা। প্রেমিক-প্রেমিকা চূড়ান্ত বিপদের জায়গাকে বেছে নিয়েছেন নিজেদের আশ্রয় হিসেবে। এটি একধরনের নিঃশব্দ আত্মত্যাগ, আত্মহীন প্রেম, যেখানে আবেগ নিজেকে দংশন করে আবারো নিজেকেই বাঁচায়। প্রেমিকা যেন আগুন, তাঁর শরীরে ফুটে উঠুক “অগ্নিফুল”- অর্থাৎ এমন কামনা ও যন্ত্রণা, যা দগ্ধ করে, পোড়ায়, জ্বালিয়ে দেয়। তবু প্রেমিক ভয় পান না। বরং সেই দহনকেও তিনি শরীরের গ্রন্থিতে ধারণ করতে চান। এ এক তীব্র কামনা- যেখানে প্রেম ও ব্যথা একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। আবুল হাসানের প্রেম কেবল অন্তর্জগতে সীমাবদ্ধ নয়। শহর, রাস্তা, শ্রমজীবী মানুষ, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ- সবই তাঁর প্রেমের পটভূমিতে উপস্থিত। ফলে তাঁর প্রেম-প্রত্যাশা ও বিফলতা রাজনৈতিক অর্থও বহন করে।

নগর সভ্যতা প্রেমকে নিরস্ত করে, অথচ সেই প্রেমই কবিকে বাঁচিয়ে রাখে। এই দ্বৈত অবস্থান আবুল হাসানের কাব্যিক মনোভঙ্গিকে গভীরতা দেয়। আবুল হাসানের জীবনে ব্যক্তিগত ব্যর্থতা, শারীরিক অসুস্থতা, এবং আত্মহননের প্রবণতা তাঁর প্রেমবোধকে আচ্ছন্ন করেছে। ফলে, তাঁর প্রেম কখনোই পরিপূর্ণ নয়, কখনোই মধুর নয়। বরং তা এক আত্মঘাতী আকুলতা।

“যেখানেই যাই আমি, সেখানেই রাত!

স্টেডিয়ামের খোলা আকাশের নিচে রেস্তোরাঁয়

অসীমা যেখানে তার অত নীল চোখের ভিতর

ধরেছে নিটোল দিন নিটোল দুপুর

সেখানে গেলেও তবু আমার কেবলই রাত

আমার কেবলই রাত হয়ে যায়!”

(অপরিচিতি/ অগ্রন্থিত কবিতা)

আবুল হাসানের প্রেম এমন এক অস্তিত্ব যেখানে প্রেমিক নিজেকেই ধ্বংস করতে চায়, শুধু ভালোবাসার চিহ্ন বাঁচিয়ে রাখার জন্য। আবুল হাসান প্রেমিক, কিন্তু তিনি নিছক ভালোবাসার কবি নন। তিনি যন্ত্রণার কবি, অস্তিত্বের সংকটের কবি, এবং এক নিঃসঙ্গ প্রহরের রাত্রির কবি। তাঁর প্রেমিকসত্তা সমাজ, সময়, মৃত্যু ও আত্মপরিচয়ের সংকটকে ধারণ করে। তাঁর কবিতায় প্রেম পাঠকের কাছে তাই ব্যক্তিগত নয়, বরং একটি সামষ্টিক বেদনার অংশ হয়ে ওঠে।

আবুল হাসানের প্রেমের কবিতা এক ধরনের বিষণœ আত্মসমর্পণ, যেখানে প্রেম মানে একাকীত্ব। প্রেমিকা চলে যায়, আর কবি পড়ে থাকেন ধূসর নগরীতে, রক্তবর্ণ বিকেলে, কিংবা ট্রামে করে ফেরা জনতার চোখে। আবুল হাসানের কাছে প্রেম মানে-মৃত্যুপুরীর শেষ আলো, একটি নিঃসঙ্গ হৃদয়ের চিৎকার, একটি অশ্রুপাতের শব্দহীন কাব্য। তাঁর কবিতায় প্রেম শুধুমাত্র ভালোবাসা নয়, বরং এক ধরনের চিৎকার, আত্মপ্রকাশ, এবং ধ্বংসের আগে শেষ জাগরণ। সেই কারণেই, আবুল হাসানের প্রেমের কবিতা চিরকালের, চিরবিষাদময়, চিরসংবেদী।

তথ্যসূত্র

আবুল হাসান, প্রেমের কবিতা সমগ্র (সংকলন ও ভূমিকা: ফারুক মাহমুদ), কবি প্রকাশনী, ২০১৯

আবুল হাসান, আবুল হাসান রচনা সমগ্র (ভূমিকা: শামসুর রাহমান), বিদ্যাপ্রকাশ, ১৯৯৪

রাইনহার্ট হেভিকে, আবুল হাসান, বাঙালি কবি জার্মান শিল্পী: এক অবিশ্বাস্য বন্ধুত্ব, প্রথমা, ২০২৩

back to top