alt

সাময়িকী

ইংরেজি থেকে অনুবাদ : খায়রুল আলম সবুজ

প্রলোভন এবং ধৈর্যের গল্প

লেভ টলস্টয়

: শুক্রবার, ০৮ আগস্ট ২০২৫

সেই প্রাচীন কালে একজন চমৎকার এবং দারুণ দয়ালু মানুষ এই জগতে বাস করতেন। জাগতিক সম্পদের কোনও অভাব তাঁর ছিল না। শুধু তাঁকে দেখাশোনা করার জন্যই বেশ কয়েকজন ক্রীতদাস দিনরাত নিয়োজিত থাকত। ক্রীতদাসেরা তাঁকে ভালোবসত; তারা তাদের প্রভুকে নিয়ে গর্ব করত।

বলত: আমাদের প্রভুর চেয়ে ভালো প্রভু এই পৃথিবীতে নেই। তিনি আমাদের যতœ করেন খাওয়ান-পরান; শক্তি সামর্থ্য বিবেচনা করে আমাদের কর্তব্য দায়িত্ব বণ্টন করে দেন। তাঁর মনে কোনও মালিন্য নেই এবং কাউকে কখনও কর্কশ ভাষায় কিছু বলেন না। যারা তাদের ক্রীতদাসদের মানুষ বলে গণ্য করে না, তিনি তাদের মতো নন; যারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে কিনা সেটা বিচার না করেই একজনকে শাস্তি দেয় এবং কখনও সুন্দর করে একটা কথাও বলে না, তিনি তাদের মতো নন। আমাদের প্রভু আমাদের মঙ্গল কামনা করেন; আমাদের সঙ্গে মধুর স্বরে কথা বলেন। এর চেয়ে ভালো কোনও জীবন আমরা চাইও না।

ক্রীতদাসরা এভাবে প্রভুর গুণ কীর্তন করে দেখে শয়তান মনে মনে ভারি রুষ্ট হলো। ক্রীতদাসরা এতো আদর-যতœ পাচ্ছে, প্রভুর সঙ্গে এভাবে মিলেমিশে জীবন যাপন করছে- এতে শয়তান অত্যন্ত বিরক্ত হলো এবং এখনই জরুরিভাবে এর একটা বিহিত করা দরকার বলে তার মনে হলো। ক্রীতদাসদের মধ্যে আলেব নামে একজনকে আয়ত্বের মধ্যে পেয়ে শয়তান তাকে অন্য দাসদের লোভ দেখানোর জন্য নির্দেশ দিলো।

এরপর একদিন সবাই যখন একত্রে বসে কথাবার্তা বলছিল আর বিশ্রাম নিচ্ছিল আলেব উচ্চকণ্ঠে অন্যদের উদ্দেশ্যে বলল, আমাদের প্রভুকে নিয়ে এতোসব ভালো কিছু বলার কি কোনো কারণ আছে? আমাদের প্রভুকে আমরা যত প্রশংসা করি এতোটা যদি শয়তানকে করতাম তাহলে শয়তানও আমাদের ভালোবাসতো বুঝলে? তার হুকুম মতো কাজ করলে সেও আমাদের দয়া করত। আমাদের প্রভুকে আমরা আন্তরিকভাবে সেবা যতœ করি এবং সব কিছুতেই তাকে আমরা আনন্দে কুশলে রাখতে চাই। তার মনে একটা চিন্তা আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তার মনের খবর পেয়ে যাই এবং তড়িৎ গিয়ে সে কাজটা করে ফেলি। তাঁর মনের সব কথা আমরা আগেই জেনে ফেলি। আমাদের প্রতি সদয় না হয়ে তার উপায় কী? কিন্তু একদিন অন্য রকম করে দেখো; একদিনের জন্য তাঁকে খোশমেজাজে না রেখে বিপরীত কিছু করে দেখো, দেখবে সেও অন্য সবার মতো ব্যবহার করবে। খারাপের বদলে খারাপ আচরণই করবে, সবচেয়ে খারাপ প্রভুটি যেমন করবে আমাদের প্রভুও তাই করবেন।

কিন্তু আলেবের কথায় বেশিরভাগই সমর্থন জানালো না। তারা বরং বাজি ধরল। আলেব তার প্রভুকে ক্ষ্যাপানোর বুদ্ধি আঁটলো। এই বুদ্ধির খেলায় যদি সে হেরে যায় তাহলে ছুটিকালীন যে পোশাক তারা পায় আলেব সে কাপড় নেবে না, আর যদি সে জিতে যায় তাহলে ছুটিতে প্রাপ্য সবার পোশাক সে একা পাবে। অধিকন্তু, প্রভুর সামনে তার হয়ে তারা ওকালতি করবে। হেরে গেলে, অন্যরা শপথ করল, প্রভুকে তারা বলবে এবং যদি হাতে-পায়ে শিকল পরিয়েও রাখা হয় কিংবা জেল জরিমানা করা হয় তাহলেও সেখান থেকে বিজোতারা তাকে মুক্ত করে আনবে। বাজির ব্যবস্থা পাকা হবার পরদিন সকালেই আলেব প্রভুকে বিরক্ত করার পরিকল্পনা পাকা করে ফেলল।

আলেব রাখালের কাজ করত। শতভাগ বিশুদ্ধ জাতের বহুমূল্যবান কিছু ভেড়া ছিল তার জিম্মায়। মালিক তাদের খুব ভালোবাসতেন। পরদিন সকালে কয়েকজন সঙ্গী সাথী নিয়ে মালিক যখন ভেড়ার ঘেরে ঢুকলেন তখন আলেব তার বন্ধুদের চোখটিপ দিল- যেন বলতে চাইছে এবার দেখো কি পরিমাণ রাগে সে।

দল বেঁধে ক্রীতদাসেরা ফটকের কাছে সমবেত হয়েছে। তারা কেউ গেটের ফাঁকফোকর দিয়ে কেউ আবার বেড়ার উপর দিয়ে তাকিয়ে আছে। এদিকে শয়তান একলাফে একটা গাছের মগডালে উঠে বসলো- সেখান থেকে সে দেখতে চায় তার সাগরেদ কীভাবে কাজটা করে। প্রভু ঘেরের মধ্যে ঘুরে ঘুরে দারুণ দারুণ সব ভেড়া-ভেড়ি তার সাথীদের দেখাতে লাগলেন। হঠাৎ তার ইচ্ছে হলো সবচেয়ে সুন্দর ভেড়ার বাচ্চাটা সে তার অতিথিদের দেখাবেন। বললেন, এখানে সব ভেড়ার বাচ্চাই দামী। তবে একটা আমার বিশেষ আছে, শিং দুটো তার একটা আরেকটার সঙ্গে যুক্ত। এটার সাধারণ ভাবে কোনও দাম ধরা যাচ্ছে না। বলতে পারেন অমূল্য। সে তো আমার চোখের মনি। প্রভু তার অতিথিদের বিশেষ বাচ্চাটা দেখাতে গেলেন। সব অচেনা মানুষ দেখে ঘাবড়ে গিয়ে ভেড়ার বাচ্চাটা ঘেরের চারপাশে ছোটাছুটি শুরু করল। ফলে, অতিথিরা খুব ভালো করে ওকে দেখতে পেলো না। ভেড়ার বাচ্চাটা এক জায়গায় স্থির হয়ে যখনই দাঁড়ায়, সঙ্গে সঙ্গে আলেব আবার বাচ্চাটাকে ভয় দেখায় যেন কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে, বাচ্চাগুলো সব আবার মেশামিশি হয়ে গেল। কোন্ বাচ্চাটা অতিমাত্রায় দামী সে আর কিছুতেই বোঝা গেল না। শেষমেশ মালিক বেচারা একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন।মালিক বললেন, আলেব, ব›ধু আমার, সবচেয়ে ভালো হয় যুক্ত শিঙের বাচ্চাটাকে ধরে আনো। খুব সাবধানে ধরবে কিন্তু। ধরে মুহূর্তের জন্য একটু স্থির রাখো। মালিক এই কথা বলে সারতেও পারেনি, এর মধ্যেই আলেব ভেড়ার পালের মধ্যে সিংহের মতো ঢুকে অমূল্য রতœটিকে আটকে ফেলল। পশম শক্ত করে ধরে সে এক হাত দিয়ে বাচ্চাটার পিছনের বাঁ পাটা উঁচু করে ফেলল এবং মালিকের চোখের সামনেই শূন্যে তুলে তাকে এমনভাবে ঝাঁকি দিল যে ভেড়ার পা’টা গাছের শুকনো ডালের মতো মট্ করে ভেঙে যাবার শব্দ হলো। উপস্থিত সবাই সে শব্দ শুনতে পেলো। সে ভেড়ার পা’টা ভেঙে ফেলেছে। ভ্যাঁ ভ্যাঁ করতে করতে বাচ্চাটা তার হাঁটুর উপর বসে পড়ল। এরপর আলেব পিছনের ডান পা-টা ধরল। বাঁ পা তখন ভেঙে গেছে আর বাচ্চাটা খোঁড়াতে শুরু করেছে।

দর্শনার্থী ও ক্রীতদাসেরা তখন মন খারাপ করে উহ্ আহ্ বিস্ময়কর শব্দ করে উঠল আর শয়তানটা তখন গাছের ডালে বসে উৎফুল্ল হয়ে ভাবল আলেব চতুরের মতোই কাজটা সম্পন্ন করেছে। মালিককে বজ্রের মতো কালো লাগছিল তাঁর কপালে দুশ্চিন্তার রেখা স্পষ্ট ফুটে আছে, তিনি মাথা হেঁট করে থাকলেন- একটি কথাও বললেন না। অতিথি এবং ক্রীতদাসেরা সব চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগল- আগে কী ঘটে সেটা দেখার জন্য। কিছুক্ষণ গম্ভীরভাবে চুপ থাকার পর প্রভু নিজেকে একটা ঝাঁকি দিলেন যেন ঘাড় থেকে একটা বোঝা নামিয়ে রাখলেন। তারপর তিনি চোখ দুটো আকাশের দিকে তুলে একটু সময় স্থির থাকলেন। তখন তখনই তার কপালের বলিরেখা উধাও হয়ে গেল। হাসি মুখে আলেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, আরে আলেব, আলেব-! তোমার প্রভু আমাকে খেপাবার জন্য তোমাকে নির্দেশ দিয়েছিল, কিন্তু আমার প্রভু তোমার প্রভুর চেয়েও শক্তিশালী। তোমার সঙ্গে আমার রাগের কিছু নেই। কিন্তু আমি তোমার প্রভুকে রাগাবো। তোমার ভয় হচ্ছে আমি তোমাকে শাস্তি দেব। এতো দিন ধরে তুমি আমার কাছে মুক্তি চেয়ে এসেছ। এটা জেনে রেখো আলেব আমি তোমাকে শাস্তি দেব না; কিন্তু যেহেতু তুমি মুক্ত হতে চাও, আমি তোমাকে মুক্তি দেব। এখানে এই অচেনা অতিথিদের সামনে তোমাকে আমি মুক্তি দিলাম। এখন তুমি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারো। যাওয়ার সময় তোমার ছুটির কাপড়গুলো সঙ্গে নিয়ে যেও। দয়ালু প্রভু তার অতিথিদের নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন, কিন্তু শয়তানটা দাঁতে দাঁত ঘঁষে গাছ থেকে নিচে পড়ে মাটিতে গেঁথে গেল।

ছবি

চরফুলের কন্যা

ছবি

নজরুলের গল্প ও উপন্যাস

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রসঙ্গ মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস

ছবি

প্রেম, অস্তিত্ববাদ ও বেদনার দোলাচল

ছবি

‘কবিতার যুবরাজ’ কবি আবুল হাসান

ছবি

মানুষ, প্রকৃতি ও সুলতানের স্বকীয় অভিযাত্রা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

শালুক-এর শঙ্খ ঘোষ সংখ্যা বাংলাদেশের সশ্রদ্ধ মূল্যায়ন

ছবি

‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’: কুহক ও বিভ্রমের গল্প

ছবি

কল্পগল্প

ছবি

আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা’

ছবি

প্রসঙ্গ মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস

ছবি

আনন্দদায়ক ও অপ্রত্যাশিত নোবেল পুরস্কার

ছবি

জীবনবোধ ও শিল্পকর্ম

ছবি

নজরুলের গল্প ও উপন্যাস

ছবি

কৃষ্ণাঙ্গ দাস থেকে হয়ে উঠেছিলেন খ্যাতিমান কবি

শ্রাবণ বর্ষণে

ছবি

শতবর্ষ পরে ‘মিসেস ডালোওয়ে’

ছবি

স্কাল্পচারের জগতটা আস্তে আস্তে ব্যাপকতা পাচ্ছে

ছবি

চব্বিশের অভ্যুত্থান নিয়ে গ্রন্থ

ছবি

ভিন্নচোখ: নুতন কবিতা সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকা: মৃত্যুর রূপক এবং আন্দালুসিয়ার লোকজ বিশ্বাস

ছবি

কবিতার শিল্পনিষ্ঠ রূপকার ফারুক মাহমুদ

ছবি

কাফকাকে পড়া কাফকাকে পড়ানো

ছবি

কবি নওশাদ নূরী

ছবি

আঁধার পেরিয়ে আলোর উদ্ভাষণ

ছবি

সন্জীদা খাতুন : কৃতি ও কৃতিত্ব

ছবি

ব্রেশায় উড়োজাহাজ

ছবি

মননশস্যের অমৃত মন্থন

ছবি

অনুবাদ ও ভূমিকা : আলী সিদ্দিকী

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বড়শি

ছবি

কাফকাকে পড়া, কাফকাকে পড়ানো

এ মুখর বরষায়

tab

সাময়িকী

ইংরেজি থেকে অনুবাদ : খায়রুল আলম সবুজ

প্রলোভন এবং ধৈর্যের গল্প

লেভ টলস্টয়

শুক্রবার, ০৮ আগস্ট ২০২৫

সেই প্রাচীন কালে একজন চমৎকার এবং দারুণ দয়ালু মানুষ এই জগতে বাস করতেন। জাগতিক সম্পদের কোনও অভাব তাঁর ছিল না। শুধু তাঁকে দেখাশোনা করার জন্যই বেশ কয়েকজন ক্রীতদাস দিনরাত নিয়োজিত থাকত। ক্রীতদাসেরা তাঁকে ভালোবসত; তারা তাদের প্রভুকে নিয়ে গর্ব করত।

বলত: আমাদের প্রভুর চেয়ে ভালো প্রভু এই পৃথিবীতে নেই। তিনি আমাদের যতœ করেন খাওয়ান-পরান; শক্তি সামর্থ্য বিবেচনা করে আমাদের কর্তব্য দায়িত্ব বণ্টন করে দেন। তাঁর মনে কোনও মালিন্য নেই এবং কাউকে কখনও কর্কশ ভাষায় কিছু বলেন না। যারা তাদের ক্রীতদাসদের মানুষ বলে গণ্য করে না, তিনি তাদের মতো নন; যারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে কিনা সেটা বিচার না করেই একজনকে শাস্তি দেয় এবং কখনও সুন্দর করে একটা কথাও বলে না, তিনি তাদের মতো নন। আমাদের প্রভু আমাদের মঙ্গল কামনা করেন; আমাদের সঙ্গে মধুর স্বরে কথা বলেন। এর চেয়ে ভালো কোনও জীবন আমরা চাইও না।

ক্রীতদাসরা এভাবে প্রভুর গুণ কীর্তন করে দেখে শয়তান মনে মনে ভারি রুষ্ট হলো। ক্রীতদাসরা এতো আদর-যতœ পাচ্ছে, প্রভুর সঙ্গে এভাবে মিলেমিশে জীবন যাপন করছে- এতে শয়তান অত্যন্ত বিরক্ত হলো এবং এখনই জরুরিভাবে এর একটা বিহিত করা দরকার বলে তার মনে হলো। ক্রীতদাসদের মধ্যে আলেব নামে একজনকে আয়ত্বের মধ্যে পেয়ে শয়তান তাকে অন্য দাসদের লোভ দেখানোর জন্য নির্দেশ দিলো।

এরপর একদিন সবাই যখন একত্রে বসে কথাবার্তা বলছিল আর বিশ্রাম নিচ্ছিল আলেব উচ্চকণ্ঠে অন্যদের উদ্দেশ্যে বলল, আমাদের প্রভুকে নিয়ে এতোসব ভালো কিছু বলার কি কোনো কারণ আছে? আমাদের প্রভুকে আমরা যত প্রশংসা করি এতোটা যদি শয়তানকে করতাম তাহলে শয়তানও আমাদের ভালোবাসতো বুঝলে? তার হুকুম মতো কাজ করলে সেও আমাদের দয়া করত। আমাদের প্রভুকে আমরা আন্তরিকভাবে সেবা যতœ করি এবং সব কিছুতেই তাকে আমরা আনন্দে কুশলে রাখতে চাই। তার মনে একটা চিন্তা আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তার মনের খবর পেয়ে যাই এবং তড়িৎ গিয়ে সে কাজটা করে ফেলি। তাঁর মনের সব কথা আমরা আগেই জেনে ফেলি। আমাদের প্রতি সদয় না হয়ে তার উপায় কী? কিন্তু একদিন অন্য রকম করে দেখো; একদিনের জন্য তাঁকে খোশমেজাজে না রেখে বিপরীত কিছু করে দেখো, দেখবে সেও অন্য সবার মতো ব্যবহার করবে। খারাপের বদলে খারাপ আচরণই করবে, সবচেয়ে খারাপ প্রভুটি যেমন করবে আমাদের প্রভুও তাই করবেন।

কিন্তু আলেবের কথায় বেশিরভাগই সমর্থন জানালো না। তারা বরং বাজি ধরল। আলেব তার প্রভুকে ক্ষ্যাপানোর বুদ্ধি আঁটলো। এই বুদ্ধির খেলায় যদি সে হেরে যায় তাহলে ছুটিকালীন যে পোশাক তারা পায় আলেব সে কাপড় নেবে না, আর যদি সে জিতে যায় তাহলে ছুটিতে প্রাপ্য সবার পোশাক সে একা পাবে। অধিকন্তু, প্রভুর সামনে তার হয়ে তারা ওকালতি করবে। হেরে গেলে, অন্যরা শপথ করল, প্রভুকে তারা বলবে এবং যদি হাতে-পায়ে শিকল পরিয়েও রাখা হয় কিংবা জেল জরিমানা করা হয় তাহলেও সেখান থেকে বিজোতারা তাকে মুক্ত করে আনবে। বাজির ব্যবস্থা পাকা হবার পরদিন সকালেই আলেব প্রভুকে বিরক্ত করার পরিকল্পনা পাকা করে ফেলল।

আলেব রাখালের কাজ করত। শতভাগ বিশুদ্ধ জাতের বহুমূল্যবান কিছু ভেড়া ছিল তার জিম্মায়। মালিক তাদের খুব ভালোবাসতেন। পরদিন সকালে কয়েকজন সঙ্গী সাথী নিয়ে মালিক যখন ভেড়ার ঘেরে ঢুকলেন তখন আলেব তার বন্ধুদের চোখটিপ দিল- যেন বলতে চাইছে এবার দেখো কি পরিমাণ রাগে সে।

দল বেঁধে ক্রীতদাসেরা ফটকের কাছে সমবেত হয়েছে। তারা কেউ গেটের ফাঁকফোকর দিয়ে কেউ আবার বেড়ার উপর দিয়ে তাকিয়ে আছে। এদিকে শয়তান একলাফে একটা গাছের মগডালে উঠে বসলো- সেখান থেকে সে দেখতে চায় তার সাগরেদ কীভাবে কাজটা করে। প্রভু ঘেরের মধ্যে ঘুরে ঘুরে দারুণ দারুণ সব ভেড়া-ভেড়ি তার সাথীদের দেখাতে লাগলেন। হঠাৎ তার ইচ্ছে হলো সবচেয়ে সুন্দর ভেড়ার বাচ্চাটা সে তার অতিথিদের দেখাবেন। বললেন, এখানে সব ভেড়ার বাচ্চাই দামী। তবে একটা আমার বিশেষ আছে, শিং দুটো তার একটা আরেকটার সঙ্গে যুক্ত। এটার সাধারণ ভাবে কোনও দাম ধরা যাচ্ছে না। বলতে পারেন অমূল্য। সে তো আমার চোখের মনি। প্রভু তার অতিথিদের বিশেষ বাচ্চাটা দেখাতে গেলেন। সব অচেনা মানুষ দেখে ঘাবড়ে গিয়ে ভেড়ার বাচ্চাটা ঘেরের চারপাশে ছোটাছুটি শুরু করল। ফলে, অতিথিরা খুব ভালো করে ওকে দেখতে পেলো না। ভেড়ার বাচ্চাটা এক জায়গায় স্থির হয়ে যখনই দাঁড়ায়, সঙ্গে সঙ্গে আলেব আবার বাচ্চাটাকে ভয় দেখায় যেন কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে, বাচ্চাগুলো সব আবার মেশামিশি হয়ে গেল। কোন্ বাচ্চাটা অতিমাত্রায় দামী সে আর কিছুতেই বোঝা গেল না। শেষমেশ মালিক বেচারা একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন।মালিক বললেন, আলেব, ব›ধু আমার, সবচেয়ে ভালো হয় যুক্ত শিঙের বাচ্চাটাকে ধরে আনো। খুব সাবধানে ধরবে কিন্তু। ধরে মুহূর্তের জন্য একটু স্থির রাখো। মালিক এই কথা বলে সারতেও পারেনি, এর মধ্যেই আলেব ভেড়ার পালের মধ্যে সিংহের মতো ঢুকে অমূল্য রতœটিকে আটকে ফেলল। পশম শক্ত করে ধরে সে এক হাত দিয়ে বাচ্চাটার পিছনের বাঁ পাটা উঁচু করে ফেলল এবং মালিকের চোখের সামনেই শূন্যে তুলে তাকে এমনভাবে ঝাঁকি দিল যে ভেড়ার পা’টা গাছের শুকনো ডালের মতো মট্ করে ভেঙে যাবার শব্দ হলো। উপস্থিত সবাই সে শব্দ শুনতে পেলো। সে ভেড়ার পা’টা ভেঙে ফেলেছে। ভ্যাঁ ভ্যাঁ করতে করতে বাচ্চাটা তার হাঁটুর উপর বসে পড়ল। এরপর আলেব পিছনের ডান পা-টা ধরল। বাঁ পা তখন ভেঙে গেছে আর বাচ্চাটা খোঁড়াতে শুরু করেছে।

দর্শনার্থী ও ক্রীতদাসেরা তখন মন খারাপ করে উহ্ আহ্ বিস্ময়কর শব্দ করে উঠল আর শয়তানটা তখন গাছের ডালে বসে উৎফুল্ল হয়ে ভাবল আলেব চতুরের মতোই কাজটা সম্পন্ন করেছে। মালিককে বজ্রের মতো কালো লাগছিল তাঁর কপালে দুশ্চিন্তার রেখা স্পষ্ট ফুটে আছে, তিনি মাথা হেঁট করে থাকলেন- একটি কথাও বললেন না। অতিথি এবং ক্রীতদাসেরা সব চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগল- আগে কী ঘটে সেটা দেখার জন্য। কিছুক্ষণ গম্ভীরভাবে চুপ থাকার পর প্রভু নিজেকে একটা ঝাঁকি দিলেন যেন ঘাড় থেকে একটা বোঝা নামিয়ে রাখলেন। তারপর তিনি চোখ দুটো আকাশের দিকে তুলে একটু সময় স্থির থাকলেন। তখন তখনই তার কপালের বলিরেখা উধাও হয়ে গেল। হাসি মুখে আলেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, আরে আলেব, আলেব-! তোমার প্রভু আমাকে খেপাবার জন্য তোমাকে নির্দেশ দিয়েছিল, কিন্তু আমার প্রভু তোমার প্রভুর চেয়েও শক্তিশালী। তোমার সঙ্গে আমার রাগের কিছু নেই। কিন্তু আমি তোমার প্রভুকে রাগাবো। তোমার ভয় হচ্ছে আমি তোমাকে শাস্তি দেব। এতো দিন ধরে তুমি আমার কাছে মুক্তি চেয়ে এসেছ। এটা জেনে রেখো আলেব আমি তোমাকে শাস্তি দেব না; কিন্তু যেহেতু তুমি মুক্ত হতে চাও, আমি তোমাকে মুক্তি দেব। এখানে এই অচেনা অতিথিদের সামনে তোমাকে আমি মুক্তি দিলাম। এখন তুমি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারো। যাওয়ার সময় তোমার ছুটির কাপড়গুলো সঙ্গে নিয়ে যেও। দয়ালু প্রভু তার অতিথিদের নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন, কিন্তু শয়তানটা দাঁতে দাঁত ঘঁষে গাছ থেকে নিচে পড়ে মাটিতে গেঁথে গেল।

back to top