স্বপঞ্জয় চৌধুরী
এক
পদ্মা নদী থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ উঠছে। ভরা পূর্ণিমায় মাছের রুপোলি আঁশগুলো জ¦লজ¦ল করছে। ইঞ্জিনচালিত নৌকোয় কয়েক ঘণ্টা পর পর তেল ঢালে হাসমত। ওদিকে নৌকোতে চুলো ধরাচ্ছে কেতন দাস।
- “এ হাসমত ক্ষুধোয় যে পেট চটচট করছে। দু’খানা ইলিশ দেকিনি, মচমচা করে ভেজে খাই।”
হাসমত কোনো কথা বলেনা। আজ মাছ উঠেছে বেশ; তবে যখন মহাজনের ঋণের কথা তার মাথায় আসে তখন তার উজ্জ্বল মুখখানা চুপসে যায়। কোনো কিছু উপভোগ্য মনে হয় না। হাসমতের আরেক সঙ্গী কেরামত দু’পাটি দাঁত বের করে বলে- “অত মাছ খেতে হবেনারে হাসমত। আজ তো আমরা মাংস খাব, হুরমতি মাংস। শুনেছিস ওই প্রমোদপাড়ায় গত হপ্তায় এক টসটসা মাল এসেছে। ডাকাত দল ধইরে এনে বেইচে গেছে সুবিতা দিদির কাছে। বেচারি বুড়ো মানুষ আয় রোজগার নাই। এইবার বুঝি দু-একখানা কাস্টমার টাস্টমার পেয়ে ভাগ্য খুলে। ওপাড়ার সবইতো বুড়ো, আধবুড়ো। কচি মাংসের স্বাদ নিতে মন চায়রে কেতন। হাসমত একটা চড় কসিয়ে দেয় কেরামতের গালে।
- “ওই শুয়োরের ছাওয়াল, পাঠার বাচ্চা পাঠা। মাল খাতি চাও। ঘরের বউকে একটা কাপড় দিতে পারিস না আবার মাল খাবি?”
হাসমত কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে- নিজের বউ বাচ্চা তো নদীতে খুইয়েছো। এখন অন্যের সুখ সহ্য হচ্ছিনা তাই না?
হাসমত এবার কেরামতের ঘাড় চেপে ধরে আর একটা কথা বললে পদ্মাতে ডুবিয়ে মারবো।
কেতন হাসমতের হাত থেকে কেরামতকে ছাড়িয়ে নেয়। “কতবার বলিছি এই পাগলাকে খেপাসনে বাপু এবার হলো তো, কেন যে ওলট-পালট বলিস ওর সামনে।
মাঝ রাতে নদীতে বাতাস বইছে, হিম হিম বাতাস। হাসমতের বউ বাচ্চার কথা মনে পড়ে। উজানচরে ছিল তাদের ছোট্ট একটা ঘর। মাছ ধরা শেষ করে যখন গভীর রাতে বাড়ি ফিরে যেত তখন বাড়ির চারিধারে ঢোলকলমি ফুলগুলো জোছনার আলোয় যেন জ¦লজ¦ল করতো, আলতো বাতাসে ফুলগুলো দুলে দুলে উঠতো। একদিন কোনো এক কালবোশেখির রাতে তাদের ছোট্ট ঘরখানা কোথায় যে উড়ে গিয়ে নদীতে মিলিয়ে যায় তার খোঁজ মেলে না। মা-মেয়েকে গিলে খেয়েছে পদ্মা নদী। তাদের লাশও খুঁজে পায়নি সে। এখনো হাসমতের মনে হয় তার জন্য তার বউ পথ চেয়ে জেগে আছে। কুপির আলো সিথানে নিভু নিভু করে জ¦ালিয়ে প্রহর গুনছে- কখন দরজায় কড়া নাড়বে। তার হাত থেকে দুখানা ইলিশ, আলতা, পাউডার আর তাতের শাড়ি বোঝাই ব্যাগটা তার আট বছরের মেয়ে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে। কি আনিছো বাবা, দেখি দেখি। মাটির টিয়া পাখি দেখে মেয়ে আয়নার সুখ আর ধরেনা। পারলে এখনই পাখির সাথে উড়ে বেড়ায় পদ্মার ঢেউয়ের উপর। তার কল্পনার ভেতরে এক জ্যান্ত পাখি নিশিদিন ওড়াওড়ি করে তাই হয়তো সেও পাখির মতো একদিন তার মাকে নিয়ে গেছে কোনো এক নিরুদ্দেশে। হাসমতের চোখ ভারি হয়ে আসে ক্লান্তিতে। রাত পার হয়ে ফজরের ওয়াক্ত হয়। ইঞ্জিনের নৌকোটি ঘাটে ভিড়ে। বিগত রাতে তেমন কিছু খাওয়া হয়নি এই তিন মল্লার। তার উপর কেরামতের সাথে একচোট হয়ে গেল। বেচারা কেরামত মুখ ভার করে আছে। ঝাঁকাভর্তি ইলিশ মাছগুলো মাথায় নিয়ে কোমর নাচাতে নাচাতে মহাজনের আড়তের দিকে যাচ্ছে হাসমত আর কেরামত। চরের ছাপড়া মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে- আসসালাতু খাইরুন মিনান নাওম।
দুই
মহাজনকে মাছ বুঝিয়ে দিয়ে এসে দাঁতে কয়লা ডলতে ডলতে নদীর তীরে আসছে হাসমত। প্রতিবার মাছ দেয়ার সময় মহাজন যখন তার ঋণের টাকা কেটে নেয় তখন হাসমতের বুক থেকে যেন ছোট্ট নুড়ি পাথর গড়াগড়ি করে সাগর তীরে গড়িয়ে পড়ার অনুভূতি হয়। গেল শুক্রবার পাশের পাড়ার জলিল মিয়া একটা বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিল। মেয়ে শ্যামবর্ণের ভালো ঘরের মেয়ে। স্বামী নেশাখোর তাই সংসার টিকেনি। হাসমত গায়েগতরে খাটা মানুষ, বাজে কোনো অভ্যেস নাই; এই যেমন কেরামত মাঝে মাঝে নিষিদ্ধ পাড়ায় ছুটে যান ঘরে বউ থাকা সত্ত্বেও। মাঝে মাঝে মদ খেয়ে শুকনো জালের গাদার উপর পড়ে পড়ে ঘুমান। হাসমতের বদ অভ্যেস বলতে ওই মহাজনের সাজানো হুক্কায় দু’এক টান মারা ছাড়া আর কিছু নেই। তাও প্রতিবার ঋণের টাকা কাটা যাবার পর স্বস্তিতে একটা টান মারেন।
মাইকে ঘোষণা হচ্ছে মেলা মেলা মেলা। পু-্রবাড়ির হাটে এক বিশাল চৈত্র মেলার আয়োজন করা হয়েছে। দলে দলে মেলায় আসেন আজ বিকালবেলায়। মেলার বিশেষ আকর্ষণ করিমন বিবির যাত্রাপালা। মেলায় যাইরে, মেলায় যাইরে গান বাজতে থাকে মাইকে। হাসমতের মেয়ের কথা মনে পড়ে। দু’বছর আগে এক দিনে উজানচরের পাশে কাশিমপুরের মেলায় মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন। মেলা থেকে মেয়েকে মাটির হাঁড়ি-পাতিল কিনে দিয়েছিলেন। বউ জয়তুনের জন্য কিনেছিলেন একটি টাঙ্গাইলের শাড়ি। বউ বাচ্চা নিয়ে ভ্যানে চড়ে ঘুরেছিলেন সারা গ্রাম। আজ আর সেই উজান চড় নেই, পদ্মার পেটে চুপচাপ ঘুমোচ্ছে। তার বউ বাচ্চা কেমন আছেন সেটিও জানেন না। জলিল মিয়া পান চিবুতে চিবুতে হাসমতকে ডাক দেয়- “ও হাসেম মিয়া এদিকে আহো, সুখবর আছে। আরে মেয়ের বাপতো রাজি, এহন তুমি গিরিন সিগনাল দিলেই সানাই বাজাইতে পারি।” হাসমত শুকনো হাসি দিয়ে বলে- “আমার চাল নেই, চুলো নেই আমাগ কে বিয়ে কইরবে চাচা। দেখো তোমরা মুরুব্বি মানুষ যা ভালো মনে করো। জলিল মিয়া ছাতা ফুটাতে ফুটাতে বলে- “শুকুর আলহামদুল্লিহা, তা বাবা চা-পান খাওয়ার কিছু পয়সাকড়ি দেও।” হাসমত পকেট থেকে একশত টাকার তিনটে নোট বের করে জলিলকে দেয়। জলিল হাত পা দুলিয়ে দুলিয়ে ধুলো ওড়াতে ওড়াতে হেঁটে চলে যায়। চড়ের ওপাশটায় তরমুজ বুনেছে মহাজন। এবার বেশ ভালো ফলন হয়েছে। তরমুজ থাবড়ে থাবড়ে পাকা বাত্তি তরমুজগুলো কাঁটা হচ্ছে একটু দূরে ঘাটে ট্রলার বাঁধা আছে। এই তরমুজ ঢাকার পাইকারি বাজারে যাবে। হাসমত হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাশে চলে যায়। পদ্মার জল বালুতীরে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। হাসমত নদীর জলের ভেতরে যেন নিজের মেয়ের ছবি দেখছে। তার চোখে ভাসছে তার বউকে আড়কোলা করে জ্যোৎ¯œারাতে উজানচড়ের বালুর ভেতর দিয়ে হেঁটে বেড়ানো আর খুনসুটির শব্দ। তার কল্পনাকে শান্ত পুকুরের জলে ঢিল ছোড়ার মতো দুলিয়ে দিয়ে যায় দূরে বিকট শব্দে ছুটে যাওয়া একটা স্টীমার।
তিন
চরে অনেক বাহারি রঙের ফুল ফুটেছে। এসব বুনোফুল নয়, আবার ঘাসফুলও নয়; এক অদ্ভুত ধরনের বেগুনি রঙের ফুল কলমি ফুলের মতো। কয়েকটি ফুল হাসেমের পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে যায়। হাসেম এখন আর আগের মতো ফুল পছন্দ করেন না। তার ঘুমঘোরে ধরা দেয় বিগত দিনের স্মৃতি। তার শৈশব, প্রথম প্রেম, পাঠশালা থেকে ফিরে এসে ডাংগুলি খেলা। ডাংগুলির ছোট্ট গুটিটা সপাটে আঘাত করেছিল ওপাড়ার মোড়লকে। বাপের কাছে নালিশ করে মোড়ল। ঠিক সেদিন থেকেই বন্ধ হয়েছিল হাসমতের পড়াশোনা। বাবার সাথে সেই যে দরিয়ায় গেলো এরপর থেকে এই দরিয়ার সাথে এক আত্মার বন্ধন হয়ে গেল। একদিন মাছ ধরতে ধরতে একটা চরে নৌকো ভিড়ে সেই চরের নাম ফুলচর। বাহারি রঙের নাম না জানা ফুল ফুটেছে চরে। সেসব ফুল তুলতে তুলতে গান ধরেছে জয়তুন- “আইলো মিয়া ভাই মাথায় টোপর দিয়া, আইতাছে শুক্কুরবার মিয়া ভাইর বিয়া”। হাসমতের চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় পালিয়ে যায় জয়তুন। হাসমতের বুকের ভেতর এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়। এরকম অনুভূতি তার আগে কখনো হয়নি। হয়তো একেই বলে প্রেম- যা ব্যাখ্যা করা যায়না, যা শুধু অনুভব করা যায় একান্ত নিজেই। হাসমতের ঘন ঘন এই চরে আসার বিষয়টি তার বাবার চোখ এড়ায় না। তাই ঘটক পাঠিয়ে এই ছন্নছাড়া কপোতকপোতি দুটোকে একহাত করে দিল।
বছর ঘুরতেই তাদের কোল জুড়ে আসে মেয়ে আয়না। তাদের সংসার খুব ভালোই কাটছিল। কিন্তু নদী আর আগুন এ দুটো কখনো কাউকে ক্ষমা করেনা। ছোট্ট চরে তাদের দিন ভালোই কাটছিল। গভীর রাতে টর্চ লাইট মারতে মারতে আর গান গাইতে গাইতে ঘরে ফিরতো হাসেম। হাসমতের বউ মোটা দানার ভাত ঢেকে রাখতো থালা দিয়ে। টিনের থালায় খটখট শব্দ হতো আর মেয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে ঘুম থেকে জেগে উঠতো। আব্বা কী আনছো আমার জন্য। হাসেম পটেক থেকে চার আনা দামের দশ বারোটা তিতাস চকোলেট মেয়ের হাতে দিত। চকোলেট চুষতে চুষতে মেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়তো। একদিন এক ঝড় সবকিছু ল-ভ- করে দিল। হাসমত সেই ঝড়ে তার মেয়ে, বউ, ঘর সব হারিয়েছে। এরপর থেকে কেমন যেন হয়ে গেছে সে। তার জীবনটা ছন্নছাড়া পাখির মতো হয়ে গেছে।
চার
নৌকার ইঞ্জিনের তেল ফুরিয়েছে। ওই প্রমোদপাড়ার ধারেই তেলের দোকান। তেলের দোকানের পাশেই সুবিতা দিদির ঘর। সেই ঘরে নতুন একটা মেয়ে এসেছে। তার সান্নিধ্য পেতে মর্দ পুরুষের ভিড় জমেছে। সুবিতা দিদির দিনকাল ভালো যাচ্ছে। নতুন পণ্য ভোক্তার চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে ঠিকঠিক মতো। তবে একে প্রথম অবস্থায় বাগে আনতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। হাসমত তেলের গ্যালন এগিয়ে দেয় ওই লতিফ তেলের গ্যালনডা ভইরে দে। লতিফ গ্যালনের গলা পর্যন্ত ভরে। এবার একটু ক্ষেপে যান হাসমত- কিরে তোক টাকা আমি কম দেই নাকি? গলা পর্যন্ত দিলি কেনে, পুরো ভইরে দে। যা দিয়েছিল নিলে নে না নিলে ভাগ দেখিনি। হাসমত এবার মারমুখী হয়ে যায়- শুয়োরের ছাওয়াল! তোর এত বড় সাহস! আমার মুখের উপরে কথা বলিস! লতিফকে দোকান থেকে কলার ধরে টেনে বের করে আনে হাসমত। বালুর মধ্যে খুব ধস্তাধস্তি চলছে। নতুন মেয়েটি জানালা আলতো করে খুলে দেখতে চাচ্ছে কী হচ্ছে বাইরে। হাসমতকে দেখেই সে চমকে যায়। চট করে জানালাটি লাগিয়ে দেয়। কিছু জোয়ান ছেলে পেলে এসে হাসমতের কাছ থেকে উদ্ধার করে লতিফকে। লতিফ হুংকার দিতে থাকে আমি তোক দেইখে নেব হাসমত। কাজটা ভালো করলিনে। হাসমত হাঁপিয়ে উঠেছে। তার শরীর থেকে ঘাম ছুটছে। হঠাৎ তার পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখে কেতন। কি গুরু এতো চেত কেনে? কথায় কথায় রাইগে যাচ্ছ। তা বাপু যাই বলো বিয়ে থা করা তোমার জন্য ফরজ হইয়ে গেছে।
হাসমত চেতনের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে বলে- তা তুই এখানে কী জন্যে আয়েছিস।
- শরীরে জুত পাচ্ছিনা বাবু। সুবিতাদির ঘর থেকে শরীরটা একটু বানায়ে নিয়ে আসি।
- তোর খাছলত পরিবর্তন হলো নারে কেতন। সাধেকি তোর ওপর ক্ষেপি আমি। তা দেহিস একদিন কোন মরণব্যাধি বাধায়ে নিয়ে আসিস।
- সবই ভগবানের খেলারে হাসমত, খেললেও মরবি, না খেললেও মরবি।
কেতন তার দেহতরী সুবিতাদির ঘরে ভিড়ায়। নতুন মেয়েটি অনুভূতিহীন হয়ে যেন তার আকাক্সক্ষা মিটাচ্ছে।
- কিরে বাপু মন খারাপ কেনে, তা এদিকে তো একটু নেক নজর দিবি নাকি। পয়সাটা তো উসুল করতি হবি।
- তা তোর নাম কী?
- আমার আবার নাম, নাম দিয়ে কী হবি, শরীর লাগবি শরীর নিয়ে ভাগ।
- তা তোর সুনাম শুনেছিলাম তা এখানে এসে দেখছি ভিন্নরূপ।
- আমার কিছু টাকা দরকার, বেশ কিছু টাকা বাড়িয়ে পাঠাতে হবে।
- কত টাকা?
- কেতনের মাথার চুলে পাক মারতে মারতে সুষমা বলে তা ধরো হাজার বিশেক।
- এত টাকা আমি পাবো কনে?
- আমার কাছে একজোড়া বালা আছে, বালাজোড়া বেইচে দিতে পারবা?
- তা পারবো, একমাত্র মহাজনই পারবে এর ন্যায্য দাম দিতে।
পাঁচ
এরপর প্রায় মাসখানেক পার হয়ে যায়। হাসমতের বিয়ের আয়োজন চলছে। বাড়িঘর সাজানো হচ্ছে নানা বাহারের ঝকমকে কাগজ দ্বারা। আলতো বাতাসে সেইসব রঙিন কাগজ রঙিন পাখির মতো আকাশ ছুঁতে চায় যেন। পাত্রী মহাজনের কন্যা। এই কন্যারও অবশ্য এর আগে বিয়ে হয়েছে একটা। স্বামী সাপের কামড়ে মরেছে। তাই মহাজন এই অভাগা মেয়ের জন্য হাসমতের চেয়ে আর ভালো পাত্র এ মুল্লুকে পাননি। গায়েগতরে খাটতে পারে সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ ছেলে এই চরে খুব কমই আছে। চারিদিকে প্যান্ডেল, চেয়ার-টেবিল সাজানো আছে। এই মুল্লুকের অনেক মানুষ এসেছে হাসমতের বিয়েতে। মহাজনের মেয়ের বিয়ে বলে কথা। কাজী সাহেব এসেছেন তার হাতে একটা রেজিস্ট্রি খাতা। খাতার প্রায় অর্ধেক শেষ। এই চরাঞ্চলের বিয়ে পড়ান এই কাজী সাহেব। বিয়ে পড়ানোতে তার একযুগের অভিজ্ঞতা। হাসমত আর জয়তুনের বিয়েও তিনি পড়িয়েছিলেন। আবার মহাজনের মেয়ে হরুমতিরও বিয়ে তিনি পড়িয়েছিলেন। নিয়তির কী খেলা একই কাজী দুই পাত্র-পাত্রীরই দ্বিতীয় বিয়ে পড়াচ্ছেন। বিয়ে পড়ানো শেষ হলো। সবাই যার যার মতো ভূরিভাজ করে বাড়ি ফিরে গেল।
রাত বাড়তে থাকে পাত্রপাত্রীকে বাসর ঘরে পৌঁছে দেয়া হয়। মহাজনের ভাইয়ের মেয়ে লাবণী এসে রুমে একগ্লাস গরম দুধ রেখে যায়। শালী বলে কথা।
- দুলাভাই এই নেন গোলাবারুদ। যুদ্ধে যাওয়ার আগে একটু শানাইয়া লন।
- হুরমতি বোনকে ঘর থেকে বের করে দেয়, যা ছেমরি কী কস না কস। মুখে কিছু আটকায়নারে তোর?
রাত বাড়ছে দুজনের গল্প জমে ওঠে। হাসমত হুরমতির হাত ধরে। তার হাতে একটা সুন্দর পুরু আকৃতির নকশা করা বালা।
বালাটিতে হাত পড়তেই চমকে ওঠে হাসমত। এ বালা যে তার বহুদিনের পরিচিত। কিন্তু এ বালা হুরমতির কাছে আসলো কীভাবে।
- আচ্ছা একটা কথা জিগাতি পারি তোমাক কিছু মনে করবে নাতো।
- না-না কয়া ফালাও।
- এই বালা তুমি কনে পেলে
- বা-রে বিয়ের কনেকে তার বাবা ছাড়া কে দিবে এই বালা।
হাসমতের চোখে ঘুম নেই। হাসমত এপাশ ওপাশ করছে। হুরমতি হাসমতকে জড়িয়ে ধরলেও সে হাত সরিয়ে যাচ্ছে। কখন রাত পোহাবে আর মহাজনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে এই বালার কথা। যদি জয়তুনের ব্যাপারে কিছু জানা যায়।
ছয়
পরদিন ভোরবেলা হাসমত ছুটে গেল মহাজনের কাছারি ঘরে। খুব সজোরে দরজার কড়া নাড়ছে।
- মহাজন ও মহাজন দরজা খুলেন।
মহাজন চোখ কচলাতে কচলাতে দরজা খোলেন।
- ও মা জামাই বাবা যে, এত সকালে কি জন্যি এসিছো। এখনও মহাজন ডাইকপে, আব্বা কবার পারনো।
- তা ঠিক হয়ে যাবে নে সময়ের সাথে সাথে। আমি একটা কথা জাইনবার আসছি।
- হুরমতির হাতে যে বালাজোড়া দেখলু তা কনে পাইছেন আব্বা।
আর এই কথা জানার জন্য এই সাতসকালে হাজির হয়েছো? যাও হাত মুখে ধুয়ে আসো। নবিনের হোটেলে গিয়ে নাস্তা করি।
- না আব্বা নাস্তা এখন করবো না। আপনি খালি কন কনে পাইছেন এই বালা। এই বালার সাথে আমার অনেক কিছু জড়িত।
- তোমার নায়ের সাগরেত কেতন এনে বেচিছে। কম দামে পেয়েছিলাম। তাই কিনে নিয়েছি। ও কইত্তে এনেছে জানিনে।
- ঠিক আছে আব্বা আমি যাই। এই বলে দৌড়াতে থাকে হাসমত।
- ও হাসমত নাস্তা কইরে গেলে না। এই পাগল ছাওয়াল কখন মনে কী ধরে কে জানে।
কেতন গান গাইতে জাল মেলছে। ভোরের বাতাসে মাছের তীব্র গন্ধ যেন জাল থেকে দূর নদীর মোহনায় পালিয়ে যাচ্ছে।
- কেতন ওই বালাখান কই পেয়েছিস ভাই বল।
- সে বিরাট বিরাট হিসটোরি। তোমাক কব কেন?
- বল না ভাই। তোক আমি তাড়ি খাওয়াব বল।
- তা তাড়ির লোভ যখন দেখালু, তাতো বলতেই হয়। ওই সুবিতাদির ঘরে যে মক্ষী আয়েছে তার কাছ থেকে পেয়েছি। বলল টাকা দরকার তাই বালাজোড়া বেইচবে।
হাসমতের মনে এক অজানা সম্ভাবনা উঁকি দেয়। ওই মেয়ে কি তবে জয়তুন। জয়তুন এই পথে নেমেছে। হাসমত দৌড়ে সুবিতাদির ঘরের দিকে যেতে থাকে। কেতনও তার পেছন পেছন দৌড়ায়।
- এ হাসমত কনে যাচ্ছিস। এ যচ্ছিস কনে দাড়া। নতুন জামাই লোকে মন্দ কবে।
হাসমত লোকলজ্জার মাথা খেয়ে সুবিতার ঘরে কড়া নাড়ে। সুবিতাদি দরজা খোলে।
- সুবিতাদি তোমার ঘরের ওই মেয়েটাকে একটু ডাকো। ওকে জরুরি দরকার।
- সুবিতাদি পান খেতে খেতে বলে। ওকেতো সব মরদেরই জুরুরি দরকার। পয়সা খসাও দেখা দাও।
- হাসমত অসহায়ের মতো সুবিতাদির হাত ধরে বলে দয়া করো দিদি।
- সুবিতাদির মায়া হয় হাসমতের মুখ দেখে। ঘর থেকে মেয়েটি বেরিয়ে আসে।
- বলেন কী কইরতে পারি আপনার জইন্যে।
- হাসমত যা ভেবেছিল তা নয়। এ এক অন্য মেয়ে। জয়তুন না।
- আচ্ছা বোন তুমি ওই বালাজোড়া কই পেয়েছো।
- সুবিতাদি এবার রেগে যায়। কীসের বালা কীসের কী। এই ছাওয়াল যদি কাজ করবার মন চায় কর নয়তো ভাগ। এই বলে মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দেয়। হাসমত মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে আসে।
কেতন হাসমতের কাঁধে হাত রেখে বলে, রাইতে মোড়লবাড়ির বটগাছের নিচে থাইকো। আমি ওই মক্ষীকে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে আসবো নে।
সাত
মোড়লবাড়ির পাশেই বটগাছ। তারপাশেই বয়ে গেছে পদ্মা নদী। শতবর্ষী এই গাছটি একটু উঁচু ঢিবির উপরে থাকায় সব ডুবে গেলেও গাছটি মাথা উঁচু করে জেগে থাকে। আজ পূর্ণিমা রাত। নদীর জলে চাঁদের আলো যেন স্বর্গ নামিয়ে এনেছে। ছোট ঢেউয়ের ভেতরে আলোর আভা যৌবনা নারীর মতো খিলখিল করে হেসে উঠছে যেন। হাসমত নতুন বউ রেখে অপেক্ষা করছে নদীর পাড়ে। কিছুক্ষণ পড়েই কেতন এসে হাজির মক্ষীকে নিয়ে।
মক্ষী আলতো করে ঘোমটাটা খুলে। যা জানতে চাও তাড়াতাড়ি বলো। সুবিতাদি আমাক না দেখতি পেলে দুনিয়া আউলায়ে নেবেনে।
- মক্ষী, কাছে যে বালাজোড়া ছিল তা আমার বউয়ের।
- কার? জয়তুনের?
- হাসমতের চোখ চকচক করে ওঠে জয়তুন কনে, জয়তুন কনে মক্ষী, আমার জয়তুন। আমার মাইয়েডাও কই হারাইলো জানিনা।
মক্ষী নদীর দিকে তাকিয়ে একটু দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বলে। জয়তুন নেই হাসমত ভাই। আমরা একসাথেই ছিলাম। ডাকাত দল জয়তুনের সাথে আমাকেও তুইলে নেয়। নদীর একটা ছোট্ট চড়ের ধারে জয়তুন জ্ঞানহীন ছিল। ডাকাত সর্দার ওকে নৌকোয় তুলে নেয়। আমাকে তুলে আনে একটা লঞ্চ থেকে। একলাই যাচ্ছিলাম বাড়ি। জগতের কারো সাথে আমার যোগাযোগ নেই। জয়তুন আর আমাকে ডাকাত সর্দার মজনু বেইচে দেয় সুবিতাদির কাছে। প্রথম রাইতে যখন তোমরা মাছ ধইরে ফিরছিলে গান গাইতে গাইতে, তখন তোমার কণ্ঠ শুনে জয়তুন আকুলি বিকুল করতে থাকে। কিন্তু এক বণিকবাবু তোমার জয়তুনরে সেই সময়ে ভোগ করতেছিল। বেচারি নিজের স্বামী ছাড়া অন্য কাউরে মাইনে নিতে পারেনি। পরের দিন ওর কাছে লুকানো বালা দুটো আমার হাতে পরাইয়া দেয়। কী মনে কইরে জানিনা। পরে সন্ধ্যার সময় ইন্দুরের ওষুধ খেয়ে মইরে পড়ে থাকে ঘরের কোনায়। ওই চরফুলের চরে ওরে খাড়ামাটি দেয়া হয়।
হাসমত পাগলের মতো হয়ে যায়। চরফুলের মাঝখানে হালকা উঁচু একটু ডিবি দেখতে পায়। ডিবির উপরে ঘাস জন্মেছে। ফুটেছে ছোট ঘাসফুল।
হাসমতের চিৎকার আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠে । জয়তুন আমার জয়তুন, উঠেক বউ। আইজ ভরা পূর্ণিমা। প্রলাপ করতে করতে হাসমত মাটি খুঁড়তে থাকে। দূর থেকে দৌড়ে আসে কেতন। নতুন বউ হুরমতিও হাসমতের পিছু নিয়েছিল। হুরমতির চোখও ভিজে ওঠে হাসমতের আহাজারিতে। মাটি খুঁড়াখুঁড়ির ফলে জয়তুনের চুল ভেসে যায়।
- না , আমার জয়তুন খারাপ মাইয়ে মানুষ না। ও আমার বউ। জয়তুনের অর্ধগলিত লাশ উঠিয়ে তাকে আবার স্বাভাবিক মানুষের মতো কবর দেয়া হয়।
হাসমত নিথর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে। হুরমতি তার কাঁধে মাথা রেখে বলে। জয়তুন তোমার ভালোবাসার অতীত। আমি তোমার বর্তমান। আইজ থেকে মনে করো আমিই তোমার জয়তুন। হাসমতের চোখের জল মুছে দেয় হুরমতি। রাত বাড়তে থাকে। চাঁদের আকৃতি আরও বড় হতে থাকে। এই চড়ের বুকেই শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে চরফুলের কন্যা।
স্বপঞ্জয় চৌধুরী
শুক্রবার, ০৮ আগস্ট ২০২৫
এক
পদ্মা নদী থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ উঠছে। ভরা পূর্ণিমায় মাছের রুপোলি আঁশগুলো জ¦লজ¦ল করছে। ইঞ্জিনচালিত নৌকোয় কয়েক ঘণ্টা পর পর তেল ঢালে হাসমত। ওদিকে নৌকোতে চুলো ধরাচ্ছে কেতন দাস।
- “এ হাসমত ক্ষুধোয় যে পেট চটচট করছে। দু’খানা ইলিশ দেকিনি, মচমচা করে ভেজে খাই।”
হাসমত কোনো কথা বলেনা। আজ মাছ উঠেছে বেশ; তবে যখন মহাজনের ঋণের কথা তার মাথায় আসে তখন তার উজ্জ্বল মুখখানা চুপসে যায়। কোনো কিছু উপভোগ্য মনে হয় না। হাসমতের আরেক সঙ্গী কেরামত দু’পাটি দাঁত বের করে বলে- “অত মাছ খেতে হবেনারে হাসমত। আজ তো আমরা মাংস খাব, হুরমতি মাংস। শুনেছিস ওই প্রমোদপাড়ায় গত হপ্তায় এক টসটসা মাল এসেছে। ডাকাত দল ধইরে এনে বেইচে গেছে সুবিতা দিদির কাছে। বেচারি বুড়ো মানুষ আয় রোজগার নাই। এইবার বুঝি দু-একখানা কাস্টমার টাস্টমার পেয়ে ভাগ্য খুলে। ওপাড়ার সবইতো বুড়ো, আধবুড়ো। কচি মাংসের স্বাদ নিতে মন চায়রে কেতন। হাসমত একটা চড় কসিয়ে দেয় কেরামতের গালে।
- “ওই শুয়োরের ছাওয়াল, পাঠার বাচ্চা পাঠা। মাল খাতি চাও। ঘরের বউকে একটা কাপড় দিতে পারিস না আবার মাল খাবি?”
হাসমত কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে- নিজের বউ বাচ্চা তো নদীতে খুইয়েছো। এখন অন্যের সুখ সহ্য হচ্ছিনা তাই না?
হাসমত এবার কেরামতের ঘাড় চেপে ধরে আর একটা কথা বললে পদ্মাতে ডুবিয়ে মারবো।
কেতন হাসমতের হাত থেকে কেরামতকে ছাড়িয়ে নেয়। “কতবার বলিছি এই পাগলাকে খেপাসনে বাপু এবার হলো তো, কেন যে ওলট-পালট বলিস ওর সামনে।
মাঝ রাতে নদীতে বাতাস বইছে, হিম হিম বাতাস। হাসমতের বউ বাচ্চার কথা মনে পড়ে। উজানচরে ছিল তাদের ছোট্ট একটা ঘর। মাছ ধরা শেষ করে যখন গভীর রাতে বাড়ি ফিরে যেত তখন বাড়ির চারিধারে ঢোলকলমি ফুলগুলো জোছনার আলোয় যেন জ¦লজ¦ল করতো, আলতো বাতাসে ফুলগুলো দুলে দুলে উঠতো। একদিন কোনো এক কালবোশেখির রাতে তাদের ছোট্ট ঘরখানা কোথায় যে উড়ে গিয়ে নদীতে মিলিয়ে যায় তার খোঁজ মেলে না। মা-মেয়েকে গিলে খেয়েছে পদ্মা নদী। তাদের লাশও খুঁজে পায়নি সে। এখনো হাসমতের মনে হয় তার জন্য তার বউ পথ চেয়ে জেগে আছে। কুপির আলো সিথানে নিভু নিভু করে জ¦ালিয়ে প্রহর গুনছে- কখন দরজায় কড়া নাড়বে। তার হাত থেকে দুখানা ইলিশ, আলতা, পাউডার আর তাতের শাড়ি বোঝাই ব্যাগটা তার আট বছরের মেয়ে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে। কি আনিছো বাবা, দেখি দেখি। মাটির টিয়া পাখি দেখে মেয়ে আয়নার সুখ আর ধরেনা। পারলে এখনই পাখির সাথে উড়ে বেড়ায় পদ্মার ঢেউয়ের উপর। তার কল্পনার ভেতরে এক জ্যান্ত পাখি নিশিদিন ওড়াওড়ি করে তাই হয়তো সেও পাখির মতো একদিন তার মাকে নিয়ে গেছে কোনো এক নিরুদ্দেশে। হাসমতের চোখ ভারি হয়ে আসে ক্লান্তিতে। রাত পার হয়ে ফজরের ওয়াক্ত হয়। ইঞ্জিনের নৌকোটি ঘাটে ভিড়ে। বিগত রাতে তেমন কিছু খাওয়া হয়নি এই তিন মল্লার। তার উপর কেরামতের সাথে একচোট হয়ে গেল। বেচারা কেরামত মুখ ভার করে আছে। ঝাঁকাভর্তি ইলিশ মাছগুলো মাথায় নিয়ে কোমর নাচাতে নাচাতে মহাজনের আড়তের দিকে যাচ্ছে হাসমত আর কেরামত। চরের ছাপড়া মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে- আসসালাতু খাইরুন মিনান নাওম।
দুই
মহাজনকে মাছ বুঝিয়ে দিয়ে এসে দাঁতে কয়লা ডলতে ডলতে নদীর তীরে আসছে হাসমত। প্রতিবার মাছ দেয়ার সময় মহাজন যখন তার ঋণের টাকা কেটে নেয় তখন হাসমতের বুক থেকে যেন ছোট্ট নুড়ি পাথর গড়াগড়ি করে সাগর তীরে গড়িয়ে পড়ার অনুভূতি হয়। গেল শুক্রবার পাশের পাড়ার জলিল মিয়া একটা বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিল। মেয়ে শ্যামবর্ণের ভালো ঘরের মেয়ে। স্বামী নেশাখোর তাই সংসার টিকেনি। হাসমত গায়েগতরে খাটা মানুষ, বাজে কোনো অভ্যেস নাই; এই যেমন কেরামত মাঝে মাঝে নিষিদ্ধ পাড়ায় ছুটে যান ঘরে বউ থাকা সত্ত্বেও। মাঝে মাঝে মদ খেয়ে শুকনো জালের গাদার উপর পড়ে পড়ে ঘুমান। হাসমতের বদ অভ্যেস বলতে ওই মহাজনের সাজানো হুক্কায় দু’এক টান মারা ছাড়া আর কিছু নেই। তাও প্রতিবার ঋণের টাকা কাটা যাবার পর স্বস্তিতে একটা টান মারেন।
মাইকে ঘোষণা হচ্ছে মেলা মেলা মেলা। পু-্রবাড়ির হাটে এক বিশাল চৈত্র মেলার আয়োজন করা হয়েছে। দলে দলে মেলায় আসেন আজ বিকালবেলায়। মেলার বিশেষ আকর্ষণ করিমন বিবির যাত্রাপালা। মেলায় যাইরে, মেলায় যাইরে গান বাজতে থাকে মাইকে। হাসমতের মেয়ের কথা মনে পড়ে। দু’বছর আগে এক দিনে উজানচরের পাশে কাশিমপুরের মেলায় মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন। মেলা থেকে মেয়েকে মাটির হাঁড়ি-পাতিল কিনে দিয়েছিলেন। বউ জয়তুনের জন্য কিনেছিলেন একটি টাঙ্গাইলের শাড়ি। বউ বাচ্চা নিয়ে ভ্যানে চড়ে ঘুরেছিলেন সারা গ্রাম। আজ আর সেই উজান চড় নেই, পদ্মার পেটে চুপচাপ ঘুমোচ্ছে। তার বউ বাচ্চা কেমন আছেন সেটিও জানেন না। জলিল মিয়া পান চিবুতে চিবুতে হাসমতকে ডাক দেয়- “ও হাসেম মিয়া এদিকে আহো, সুখবর আছে। আরে মেয়ের বাপতো রাজি, এহন তুমি গিরিন সিগনাল দিলেই সানাই বাজাইতে পারি।” হাসমত শুকনো হাসি দিয়ে বলে- “আমার চাল নেই, চুলো নেই আমাগ কে বিয়ে কইরবে চাচা। দেখো তোমরা মুরুব্বি মানুষ যা ভালো মনে করো। জলিল মিয়া ছাতা ফুটাতে ফুটাতে বলে- “শুকুর আলহামদুল্লিহা, তা বাবা চা-পান খাওয়ার কিছু পয়সাকড়ি দেও।” হাসমত পকেট থেকে একশত টাকার তিনটে নোট বের করে জলিলকে দেয়। জলিল হাত পা দুলিয়ে দুলিয়ে ধুলো ওড়াতে ওড়াতে হেঁটে চলে যায়। চড়ের ওপাশটায় তরমুজ বুনেছে মহাজন। এবার বেশ ভালো ফলন হয়েছে। তরমুজ থাবড়ে থাবড়ে পাকা বাত্তি তরমুজগুলো কাঁটা হচ্ছে একটু দূরে ঘাটে ট্রলার বাঁধা আছে। এই তরমুজ ঢাকার পাইকারি বাজারে যাবে। হাসমত হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাশে চলে যায়। পদ্মার জল বালুতীরে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। হাসমত নদীর জলের ভেতরে যেন নিজের মেয়ের ছবি দেখছে। তার চোখে ভাসছে তার বউকে আড়কোলা করে জ্যোৎ¯œারাতে উজানচড়ের বালুর ভেতর দিয়ে হেঁটে বেড়ানো আর খুনসুটির শব্দ। তার কল্পনাকে শান্ত পুকুরের জলে ঢিল ছোড়ার মতো দুলিয়ে দিয়ে যায় দূরে বিকট শব্দে ছুটে যাওয়া একটা স্টীমার।
তিন
চরে অনেক বাহারি রঙের ফুল ফুটেছে। এসব বুনোফুল নয়, আবার ঘাসফুলও নয়; এক অদ্ভুত ধরনের বেগুনি রঙের ফুল কলমি ফুলের মতো। কয়েকটি ফুল হাসেমের পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে যায়। হাসেম এখন আর আগের মতো ফুল পছন্দ করেন না। তার ঘুমঘোরে ধরা দেয় বিগত দিনের স্মৃতি। তার শৈশব, প্রথম প্রেম, পাঠশালা থেকে ফিরে এসে ডাংগুলি খেলা। ডাংগুলির ছোট্ট গুটিটা সপাটে আঘাত করেছিল ওপাড়ার মোড়লকে। বাপের কাছে নালিশ করে মোড়ল। ঠিক সেদিন থেকেই বন্ধ হয়েছিল হাসমতের পড়াশোনা। বাবার সাথে সেই যে দরিয়ায় গেলো এরপর থেকে এই দরিয়ার সাথে এক আত্মার বন্ধন হয়ে গেল। একদিন মাছ ধরতে ধরতে একটা চরে নৌকো ভিড়ে সেই চরের নাম ফুলচর। বাহারি রঙের নাম না জানা ফুল ফুটেছে চরে। সেসব ফুল তুলতে তুলতে গান ধরেছে জয়তুন- “আইলো মিয়া ভাই মাথায় টোপর দিয়া, আইতাছে শুক্কুরবার মিয়া ভাইর বিয়া”। হাসমতের চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় পালিয়ে যায় জয়তুন। হাসমতের বুকের ভেতর এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়। এরকম অনুভূতি তার আগে কখনো হয়নি। হয়তো একেই বলে প্রেম- যা ব্যাখ্যা করা যায়না, যা শুধু অনুভব করা যায় একান্ত নিজেই। হাসমতের ঘন ঘন এই চরে আসার বিষয়টি তার বাবার চোখ এড়ায় না। তাই ঘটক পাঠিয়ে এই ছন্নছাড়া কপোতকপোতি দুটোকে একহাত করে দিল।
বছর ঘুরতেই তাদের কোল জুড়ে আসে মেয়ে আয়না। তাদের সংসার খুব ভালোই কাটছিল। কিন্তু নদী আর আগুন এ দুটো কখনো কাউকে ক্ষমা করেনা। ছোট্ট চরে তাদের দিন ভালোই কাটছিল। গভীর রাতে টর্চ লাইট মারতে মারতে আর গান গাইতে গাইতে ঘরে ফিরতো হাসেম। হাসমতের বউ মোটা দানার ভাত ঢেকে রাখতো থালা দিয়ে। টিনের থালায় খটখট শব্দ হতো আর মেয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে ঘুম থেকে জেগে উঠতো। আব্বা কী আনছো আমার জন্য। হাসেম পটেক থেকে চার আনা দামের দশ বারোটা তিতাস চকোলেট মেয়ের হাতে দিত। চকোলেট চুষতে চুষতে মেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়তো। একদিন এক ঝড় সবকিছু ল-ভ- করে দিল। হাসমত সেই ঝড়ে তার মেয়ে, বউ, ঘর সব হারিয়েছে। এরপর থেকে কেমন যেন হয়ে গেছে সে। তার জীবনটা ছন্নছাড়া পাখির মতো হয়ে গেছে।
চার
নৌকার ইঞ্জিনের তেল ফুরিয়েছে। ওই প্রমোদপাড়ার ধারেই তেলের দোকান। তেলের দোকানের পাশেই সুবিতা দিদির ঘর। সেই ঘরে নতুন একটা মেয়ে এসেছে। তার সান্নিধ্য পেতে মর্দ পুরুষের ভিড় জমেছে। সুবিতা দিদির দিনকাল ভালো যাচ্ছে। নতুন পণ্য ভোক্তার চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে ঠিকঠিক মতো। তবে একে প্রথম অবস্থায় বাগে আনতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। হাসমত তেলের গ্যালন এগিয়ে দেয় ওই লতিফ তেলের গ্যালনডা ভইরে দে। লতিফ গ্যালনের গলা পর্যন্ত ভরে। এবার একটু ক্ষেপে যান হাসমত- কিরে তোক টাকা আমি কম দেই নাকি? গলা পর্যন্ত দিলি কেনে, পুরো ভইরে দে। যা দিয়েছিল নিলে নে না নিলে ভাগ দেখিনি। হাসমত এবার মারমুখী হয়ে যায়- শুয়োরের ছাওয়াল! তোর এত বড় সাহস! আমার মুখের উপরে কথা বলিস! লতিফকে দোকান থেকে কলার ধরে টেনে বের করে আনে হাসমত। বালুর মধ্যে খুব ধস্তাধস্তি চলছে। নতুন মেয়েটি জানালা আলতো করে খুলে দেখতে চাচ্ছে কী হচ্ছে বাইরে। হাসমতকে দেখেই সে চমকে যায়। চট করে জানালাটি লাগিয়ে দেয়। কিছু জোয়ান ছেলে পেলে এসে হাসমতের কাছ থেকে উদ্ধার করে লতিফকে। লতিফ হুংকার দিতে থাকে আমি তোক দেইখে নেব হাসমত। কাজটা ভালো করলিনে। হাসমত হাঁপিয়ে উঠেছে। তার শরীর থেকে ঘাম ছুটছে। হঠাৎ তার পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখে কেতন। কি গুরু এতো চেত কেনে? কথায় কথায় রাইগে যাচ্ছ। তা বাপু যাই বলো বিয়ে থা করা তোমার জন্য ফরজ হইয়ে গেছে।
হাসমত চেতনের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে বলে- তা তুই এখানে কী জন্যে আয়েছিস।
- শরীরে জুত পাচ্ছিনা বাবু। সুবিতাদির ঘর থেকে শরীরটা একটু বানায়ে নিয়ে আসি।
- তোর খাছলত পরিবর্তন হলো নারে কেতন। সাধেকি তোর ওপর ক্ষেপি আমি। তা দেহিস একদিন কোন মরণব্যাধি বাধায়ে নিয়ে আসিস।
- সবই ভগবানের খেলারে হাসমত, খেললেও মরবি, না খেললেও মরবি।
কেতন তার দেহতরী সুবিতাদির ঘরে ভিড়ায়। নতুন মেয়েটি অনুভূতিহীন হয়ে যেন তার আকাক্সক্ষা মিটাচ্ছে।
- কিরে বাপু মন খারাপ কেনে, তা এদিকে তো একটু নেক নজর দিবি নাকি। পয়সাটা তো উসুল করতি হবি।
- তা তোর নাম কী?
- আমার আবার নাম, নাম দিয়ে কী হবি, শরীর লাগবি শরীর নিয়ে ভাগ।
- তা তোর সুনাম শুনেছিলাম তা এখানে এসে দেখছি ভিন্নরূপ।
- আমার কিছু টাকা দরকার, বেশ কিছু টাকা বাড়িয়ে পাঠাতে হবে।
- কত টাকা?
- কেতনের মাথার চুলে পাক মারতে মারতে সুষমা বলে তা ধরো হাজার বিশেক।
- এত টাকা আমি পাবো কনে?
- আমার কাছে একজোড়া বালা আছে, বালাজোড়া বেইচে দিতে পারবা?
- তা পারবো, একমাত্র মহাজনই পারবে এর ন্যায্য দাম দিতে।
পাঁচ
এরপর প্রায় মাসখানেক পার হয়ে যায়। হাসমতের বিয়ের আয়োজন চলছে। বাড়িঘর সাজানো হচ্ছে নানা বাহারের ঝকমকে কাগজ দ্বারা। আলতো বাতাসে সেইসব রঙিন কাগজ রঙিন পাখির মতো আকাশ ছুঁতে চায় যেন। পাত্রী মহাজনের কন্যা। এই কন্যারও অবশ্য এর আগে বিয়ে হয়েছে একটা। স্বামী সাপের কামড়ে মরেছে। তাই মহাজন এই অভাগা মেয়ের জন্য হাসমতের চেয়ে আর ভালো পাত্র এ মুল্লুকে পাননি। গায়েগতরে খাটতে পারে সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ ছেলে এই চরে খুব কমই আছে। চারিদিকে প্যান্ডেল, চেয়ার-টেবিল সাজানো আছে। এই মুল্লুকের অনেক মানুষ এসেছে হাসমতের বিয়েতে। মহাজনের মেয়ের বিয়ে বলে কথা। কাজী সাহেব এসেছেন তার হাতে একটা রেজিস্ট্রি খাতা। খাতার প্রায় অর্ধেক শেষ। এই চরাঞ্চলের বিয়ে পড়ান এই কাজী সাহেব। বিয়ে পড়ানোতে তার একযুগের অভিজ্ঞতা। হাসমত আর জয়তুনের বিয়েও তিনি পড়িয়েছিলেন। আবার মহাজনের মেয়ে হরুমতিরও বিয়ে তিনি পড়িয়েছিলেন। নিয়তির কী খেলা একই কাজী দুই পাত্র-পাত্রীরই দ্বিতীয় বিয়ে পড়াচ্ছেন। বিয়ে পড়ানো শেষ হলো। সবাই যার যার মতো ভূরিভাজ করে বাড়ি ফিরে গেল।
রাত বাড়তে থাকে পাত্রপাত্রীকে বাসর ঘরে পৌঁছে দেয়া হয়। মহাজনের ভাইয়ের মেয়ে লাবণী এসে রুমে একগ্লাস গরম দুধ রেখে যায়। শালী বলে কথা।
- দুলাভাই এই নেন গোলাবারুদ। যুদ্ধে যাওয়ার আগে একটু শানাইয়া লন।
- হুরমতি বোনকে ঘর থেকে বের করে দেয়, যা ছেমরি কী কস না কস। মুখে কিছু আটকায়নারে তোর?
রাত বাড়ছে দুজনের গল্প জমে ওঠে। হাসমত হুরমতির হাত ধরে। তার হাতে একটা সুন্দর পুরু আকৃতির নকশা করা বালা।
বালাটিতে হাত পড়তেই চমকে ওঠে হাসমত। এ বালা যে তার বহুদিনের পরিচিত। কিন্তু এ বালা হুরমতির কাছে আসলো কীভাবে।
- আচ্ছা একটা কথা জিগাতি পারি তোমাক কিছু মনে করবে নাতো।
- না-না কয়া ফালাও।
- এই বালা তুমি কনে পেলে
- বা-রে বিয়ের কনেকে তার বাবা ছাড়া কে দিবে এই বালা।
হাসমতের চোখে ঘুম নেই। হাসমত এপাশ ওপাশ করছে। হুরমতি হাসমতকে জড়িয়ে ধরলেও সে হাত সরিয়ে যাচ্ছে। কখন রাত পোহাবে আর মহাজনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে এই বালার কথা। যদি জয়তুনের ব্যাপারে কিছু জানা যায়।
ছয়
পরদিন ভোরবেলা হাসমত ছুটে গেল মহাজনের কাছারি ঘরে। খুব সজোরে দরজার কড়া নাড়ছে।
- মহাজন ও মহাজন দরজা খুলেন।
মহাজন চোখ কচলাতে কচলাতে দরজা খোলেন।
- ও মা জামাই বাবা যে, এত সকালে কি জন্যি এসিছো। এখনও মহাজন ডাইকপে, আব্বা কবার পারনো।
- তা ঠিক হয়ে যাবে নে সময়ের সাথে সাথে। আমি একটা কথা জাইনবার আসছি।
- হুরমতির হাতে যে বালাজোড়া দেখলু তা কনে পাইছেন আব্বা।
আর এই কথা জানার জন্য এই সাতসকালে হাজির হয়েছো? যাও হাত মুখে ধুয়ে আসো। নবিনের হোটেলে গিয়ে নাস্তা করি।
- না আব্বা নাস্তা এখন করবো না। আপনি খালি কন কনে পাইছেন এই বালা। এই বালার সাথে আমার অনেক কিছু জড়িত।
- তোমার নায়ের সাগরেত কেতন এনে বেচিছে। কম দামে পেয়েছিলাম। তাই কিনে নিয়েছি। ও কইত্তে এনেছে জানিনে।
- ঠিক আছে আব্বা আমি যাই। এই বলে দৌড়াতে থাকে হাসমত।
- ও হাসমত নাস্তা কইরে গেলে না। এই পাগল ছাওয়াল কখন মনে কী ধরে কে জানে।
কেতন গান গাইতে জাল মেলছে। ভোরের বাতাসে মাছের তীব্র গন্ধ যেন জাল থেকে দূর নদীর মোহনায় পালিয়ে যাচ্ছে।
- কেতন ওই বালাখান কই পেয়েছিস ভাই বল।
- সে বিরাট বিরাট হিসটোরি। তোমাক কব কেন?
- বল না ভাই। তোক আমি তাড়ি খাওয়াব বল।
- তা তাড়ির লোভ যখন দেখালু, তাতো বলতেই হয়। ওই সুবিতাদির ঘরে যে মক্ষী আয়েছে তার কাছ থেকে পেয়েছি। বলল টাকা দরকার তাই বালাজোড়া বেইচবে।
হাসমতের মনে এক অজানা সম্ভাবনা উঁকি দেয়। ওই মেয়ে কি তবে জয়তুন। জয়তুন এই পথে নেমেছে। হাসমত দৌড়ে সুবিতাদির ঘরের দিকে যেতে থাকে। কেতনও তার পেছন পেছন দৌড়ায়।
- এ হাসমত কনে যাচ্ছিস। এ যচ্ছিস কনে দাড়া। নতুন জামাই লোকে মন্দ কবে।
হাসমত লোকলজ্জার মাথা খেয়ে সুবিতার ঘরে কড়া নাড়ে। সুবিতাদি দরজা খোলে।
- সুবিতাদি তোমার ঘরের ওই মেয়েটাকে একটু ডাকো। ওকে জরুরি দরকার।
- সুবিতাদি পান খেতে খেতে বলে। ওকেতো সব মরদেরই জুরুরি দরকার। পয়সা খসাও দেখা দাও।
- হাসমত অসহায়ের মতো সুবিতাদির হাত ধরে বলে দয়া করো দিদি।
- সুবিতাদির মায়া হয় হাসমতের মুখ দেখে। ঘর থেকে মেয়েটি বেরিয়ে আসে।
- বলেন কী কইরতে পারি আপনার জইন্যে।
- হাসমত যা ভেবেছিল তা নয়। এ এক অন্য মেয়ে। জয়তুন না।
- আচ্ছা বোন তুমি ওই বালাজোড়া কই পেয়েছো।
- সুবিতাদি এবার রেগে যায়। কীসের বালা কীসের কী। এই ছাওয়াল যদি কাজ করবার মন চায় কর নয়তো ভাগ। এই বলে মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দেয়। হাসমত মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে আসে।
কেতন হাসমতের কাঁধে হাত রেখে বলে, রাইতে মোড়লবাড়ির বটগাছের নিচে থাইকো। আমি ওই মক্ষীকে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে আসবো নে।
সাত
মোড়লবাড়ির পাশেই বটগাছ। তারপাশেই বয়ে গেছে পদ্মা নদী। শতবর্ষী এই গাছটি একটু উঁচু ঢিবির উপরে থাকায় সব ডুবে গেলেও গাছটি মাথা উঁচু করে জেগে থাকে। আজ পূর্ণিমা রাত। নদীর জলে চাঁদের আলো যেন স্বর্গ নামিয়ে এনেছে। ছোট ঢেউয়ের ভেতরে আলোর আভা যৌবনা নারীর মতো খিলখিল করে হেসে উঠছে যেন। হাসমত নতুন বউ রেখে অপেক্ষা করছে নদীর পাড়ে। কিছুক্ষণ পড়েই কেতন এসে হাজির মক্ষীকে নিয়ে।
মক্ষী আলতো করে ঘোমটাটা খুলে। যা জানতে চাও তাড়াতাড়ি বলো। সুবিতাদি আমাক না দেখতি পেলে দুনিয়া আউলায়ে নেবেনে।
- মক্ষী, কাছে যে বালাজোড়া ছিল তা আমার বউয়ের।
- কার? জয়তুনের?
- হাসমতের চোখ চকচক করে ওঠে জয়তুন কনে, জয়তুন কনে মক্ষী, আমার জয়তুন। আমার মাইয়েডাও কই হারাইলো জানিনা।
মক্ষী নদীর দিকে তাকিয়ে একটু দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বলে। জয়তুন নেই হাসমত ভাই। আমরা একসাথেই ছিলাম। ডাকাত দল জয়তুনের সাথে আমাকেও তুইলে নেয়। নদীর একটা ছোট্ট চড়ের ধারে জয়তুন জ্ঞানহীন ছিল। ডাকাত সর্দার ওকে নৌকোয় তুলে নেয়। আমাকে তুলে আনে একটা লঞ্চ থেকে। একলাই যাচ্ছিলাম বাড়ি। জগতের কারো সাথে আমার যোগাযোগ নেই। জয়তুন আর আমাকে ডাকাত সর্দার মজনু বেইচে দেয় সুবিতাদির কাছে। প্রথম রাইতে যখন তোমরা মাছ ধইরে ফিরছিলে গান গাইতে গাইতে, তখন তোমার কণ্ঠ শুনে জয়তুন আকুলি বিকুল করতে থাকে। কিন্তু এক বণিকবাবু তোমার জয়তুনরে সেই সময়ে ভোগ করতেছিল। বেচারি নিজের স্বামী ছাড়া অন্য কাউরে মাইনে নিতে পারেনি। পরের দিন ওর কাছে লুকানো বালা দুটো আমার হাতে পরাইয়া দেয়। কী মনে কইরে জানিনা। পরে সন্ধ্যার সময় ইন্দুরের ওষুধ খেয়ে মইরে পড়ে থাকে ঘরের কোনায়। ওই চরফুলের চরে ওরে খাড়ামাটি দেয়া হয়।
হাসমত পাগলের মতো হয়ে যায়। চরফুলের মাঝখানে হালকা উঁচু একটু ডিবি দেখতে পায়। ডিবির উপরে ঘাস জন্মেছে। ফুটেছে ছোট ঘাসফুল।
হাসমতের চিৎকার আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠে । জয়তুন আমার জয়তুন, উঠেক বউ। আইজ ভরা পূর্ণিমা। প্রলাপ করতে করতে হাসমত মাটি খুঁড়তে থাকে। দূর থেকে দৌড়ে আসে কেতন। নতুন বউ হুরমতিও হাসমতের পিছু নিয়েছিল। হুরমতির চোখও ভিজে ওঠে হাসমতের আহাজারিতে। মাটি খুঁড়াখুঁড়ির ফলে জয়তুনের চুল ভেসে যায়।
- না , আমার জয়তুন খারাপ মাইয়ে মানুষ না। ও আমার বউ। জয়তুনের অর্ধগলিত লাশ উঠিয়ে তাকে আবার স্বাভাবিক মানুষের মতো কবর দেয়া হয়।
হাসমত নিথর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে। হুরমতি তার কাঁধে মাথা রেখে বলে। জয়তুন তোমার ভালোবাসার অতীত। আমি তোমার বর্তমান। আইজ থেকে মনে করো আমিই তোমার জয়তুন। হাসমতের চোখের জল মুছে দেয় হুরমতি। রাত বাড়তে থাকে। চাঁদের আকৃতি আরও বড় হতে থাকে। এই চড়ের বুকেই শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে চরফুলের কন্যা।