আনিস রহমান
মাটি খুঁড়ে কেঁচো তুলছিল হিজল। তখুনি দেখল ওদের। শহুরে লোক। সবার গায়েই দামি কাপড়। একজনের মাথায় হ্যাট। কারও পিঠে হ্যাভারসেক, কেউ আবার ক্রসবেল্ট নামিয়ে দিয়েছে বুক আড়াআড়ি। ব্যাগের সাইট পকেট থেকে জলের বোতল, চিপ্সের প্যাকেট উঁকি দিচ্ছে। ওরা হিজলদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছিলো আর হাত-পা নেড়ে বকছিলো শুধু। কথার মাথামু-ু কিছুই বুঝতে পারে না, ওরা ইংরেজিতে কথা বলছিলো। মাঝেমধ্যে এক-আধটু বাংলার মিশেল শুধু।
আসলে ওর চোখ তখন কচুবনের ভেজা স্যাঁতসেঁতে মাটির গভীরে প্রবেশ করছিলো একটু একটু করে। তখনই বেশ কিছু মানুষের কণ্ঠ কানে এলো ওর। নানা বয়েসের কণ্ঠ। কণ্ঠ ছাপিয়ে উঠে আসা কথার ধরনও ভিন্ন। কারও কণ্ঠ চিকন, কারও মিহিকণ্ঠ, কারও কণ্ঠ আবার রাশভারি, কোনোটা খসখসে না হয় ফিচেল ধরনের! হিজলের কৌতূহলী মন ও চোখ দেখলো একদঙ্গল লোক। অচেনা। কখনও কাউকে দেখেছে বলেও মনে পড়ে না! এদিককার নয় ওরা! তবে আগন্তুকরা যে ওদের বাড়ি লক্ষ্য করেই কথা বলছিলো এটা নিশ্চিত হিজল। কী কথা ওদের! ভাবনা নিয়ে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার কেঁচো তুলতে থাকে হিজল। কেঁচো তোলা হলে চোখে হাত রেখে ওদিকে আরেকবার তাকিয়ে ছিপ হাতে মাছ ধরতে চলে যায় বিলের দিকে। ফিরে এলে তবে মা রান্না চড়াবে।
এদিকে আগন্তুকদের মুখ, কথা ওর ভাবনা থেকে একেবারে ছেঁটে ফেলতে পারে না। ছায়া হয়ে মাথায় মিশে থাকে নিবিড়ভাবে। হিজল নিশ্চিত লোকগুলো ওদের বাড়ি যাবে না! অন্তত ওদের পোশাক-আশাক দেখে এমনটিই মনে হয় ওর। কারণ ওদের বাড়ির যা শ্রী! কারও ঘরে দরোজা নেই বললেই চলে! এবাড়ির প্রায় সবাই ঝাঁপ দিয়ে দুয়োর লাগায়। ওদিকে মজি কাকাদের ঘরের পুবে একটা দরজা আছে শুধু। তাও ঘুণে খেয়ে নিয়েছে। দরজার পাল্লা ধরে ভালো করে নাড়া দিলে কাঠের গুড়ো ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়ে। বুঝ হতে কখনও দেখেনি ওদের।
বুঝ হতে কখনো ও ঘরের দরজা খোলা চোখে পড়েনি। দরজার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে কৌতূহলী চোখ মেলে তাকাতো ভেতরে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছু স্পষ্ট দেখা যায় না। শুধু সামনে একটা দেয়াল ঘড়ি চোখে পড়ে। কাটা থেমে আছে। ডায়ালটা কেমন ঘোলাটে। আলনায় দু-একটা পুরনো কাপড় ঝুলে আছে। এছাড়া অন্ধকারে বাড়তি কিছুই চোখে পড়েনি ওর।
অথচ ওঘরের দরজা আজ অমন হাট্ করে খোলা- আশ্চর্য! বিল থেকে ফেরার পথে বেশ দূর থেকেই চোখে পড়ে ব্যাপারটি! কী এক অজানা আশঙ্কায় দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ির কাছাকাছি চলে আসে ও। ভেতর বাড়ি না গিয়ে উঠোনের সিঁদুরে আমগাছটার আড়ালে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করে হিজল। শহুরে লোকগুলোকে এখানে দেখে কেমন যেন হকচকিয়ে যায় সে। হ্যাট পরা লোকটা ঘরের চালা নাড়াচাড়া করে দেখে কিছুক্ষণ। পরে হাতের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, টাবলু- টিনগুলো একেবারে বাদ হয়ে গেছে। দাম খুব একটা আসবে বলে মনে হচ্ছে না। এক বান নতুন টিনের দাম এখন কতো রে?
ওদের সামনে বাড়ির ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে এসে ভিড় করেছে তখন। সবাই আদুল গা। গায়ে তেল-জলের ছোঁয়া নেই অনেক দিন। গা জুড়ে খড়িমাটির ছোপ। পায়ে কাদা শুকিয়ে আছে। শুধু জেগে আছে ওদের চোখ দুটো। সে চোখে বিস্ময়, কৌতূহল আর ভয়। মাঝে মাঝে ভেতর বাড়ি থেকে দু-একজন মহিলাও মুখে আঁচল চেপে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে অচেনা মুখগুলো। হিজল ওদের সামনে এসে ধমকে ওঠে, “এ-ই পোলাপান। তগো কাম নাই। এহানে কী দেহস? তামশা পাইছস্? বাড়ি যা! কামে যা।”
ছোটরা সব ভেতর বাড়ির দিকে দৌড়ে চলে যায় মুহূর্তে। হিজল লোকগুলোর দিকে একবারও না তাকিয়ে খেজুরগাছের ছায়ায় গিয়ে উত্তুরে মুখ করে বসে থাকে। মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখে লোকগুলোকে। দেখে ওদের কা-কীর্তি। চোখে-মুখে ওর চরম বিরক্তি। দুর্বোধ্যতার ছায়া সেসঙ্গে শংকাও।
একজন লোক ঘুরে ঘুরে শরীর দুলিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে উঠোনের আশপাশ দেখছে। বাড়ির সামনেই খড়ের গাঁদা-গোয়াল ঘর। পেশাবের তীব্র ঝাঁজে কপালের ভাঁজ ফুলে ওঠে। বাঁশে শুকাতে দেয়া কাঁথাগুলো থেকেও পেচ্ছাবের চ্যাংটা গন্ধ এসে নাকে লাগতেই ভ্রƒ-জোড়া কুঁচকে ওঠে লোকটার। বারান্দার সামনে এসে বলল, দ্যাখ্ টাবলু—বাড়িটার যা ছিরি! বমি আসতে চায় দেখলে। বলে একমুখ থু থু মাটিতে ফেলে লোকটা। গা রি রি করছে ওর! সারা শরীর কেমন মুচড়ে মুচড়ে ওঠে বারবার!
ওদের কথাগুলো হিজলের গায়ে বেঁধে কাঁটার মতো। হিজলের বয়স খুব বেশি হয়নি। গেলো পৌষে চৌদ্দতে পা দিয়েছে কেবল। কিন্তু তাই বলে সে যে একেবারেই কিছুই বোঝেনি, তা তো নয়! অন্তত তাদের নিয়ে যে কথাগুলো বলছে ওরা সেটা দিব্যি বুঝতে পারে।
হিজল কাজে চলে গেলে ছোটরা আবার এসে ভিড় করে। টাবলু ছোট এক মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞেস করে নাম কী তোর?
আমেনা।
ইস্কুলে যাস?
আমি যাই না। আমার বড় দাদা যায়। থিরিতে পড়ে।
টাবলু এভাবে অনেককে জিজ্ঞেস করে দেখল যে, বাড়ি জুড়ে মাত্তর দুতিনজন পড়–য়া আছে।
এদিকে রোদে চারদিকে পুড়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে একঝলক বাতাস এসে লাগছে গায়ে। তাও রোদের আঁচে তেতে আছে। কেমন যেনো হাঁফফাঁস লাগে ওদের। চোখ-মুখ কেমন লালচে দেখাচ্ছে। কপালে ঘাম চিক চিক করছে। গরম ভাঁপ বেরুচ্ছে শরীর থেকে! হ্যাট পরা লোকটা টুপি খুলে বেদম বাতাস করছে! টুপি নেড়ে বাতাস! তার দৌড় আর কদ্দুর! শেষে টেকা দায় হলে সবাই ঘরে চলে আসে। ধৈর্য ওদের শেষ তলানিতে তখন! টাবলু কণ্ঠে ঝাঁজ ছড়িয়ে বলে, তাকিয়ে সবাই কী দেখছিস! তোদের ঘরে পাখা নেই। পাখা!
ছেলেমেয়েরা এর-ওর দিকে তাকিয়ে শেষে গলা ছেড়ে দৌড় দেয়- “মা গো পাংখা চায়, বেডারা পাংখা চায় গো মা!”
মায়েরা পাখা বাড়িয়ে দেয়। এঘর-ওঘর থেকে। চার-পাঁচটা পাখা মুহূর্তেই যোগাড় হয়ে যায়। বাচ্চারা চারদিক থেকে ওদের বাতাস করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাতাসের আবেশে চোখ মুঁদে এলেও ব্যাগ থেকে স্যান্ডউইচ, বিস্কুট, কলা, আপেল, ডিম-সেদ্ধ বের করে খেতে ভোলে না শহুরে লোকগুলো। জলের বোতলগুলো একপাশে সরিয়ে রাখে। ঘামেভেজা ছেলেমেয়ের দিকে ভ্রƒক্ষেপ নেই ওদের। অথচ ওদের হাতের বাতাস খাচ্ছে কেমন আয়েশ করে। বাচ্চারা বিস্ময় চোখে দেখছে আর ঢোঁক গিলছে মাঝে মাঝে। রুটি মুখে দিয়ে হ্যাট পরা লোকটা জিজ্ঞেস করল- টাবলু, রহিম বক্সের আসার কথা ছিলো যেন কখন?
তিনটের দিকে!
ঘড়ির দিকে একবার চোখ রেখে, জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকিয়ে পরে আস্ত কলায় কামড় বসিয়ে বলল, অপেক্ষা না করে তারচে বরং গুদারাঘাটে গিয়ে রহিম বক্সকে ধরি। যাবার সময় একবার বাজার হয়ে গেলেও মন্দ হয় না!
হ্যাট পরা লোকটা টাবলুর মামা আতর। এমনিতে নাম আকতার হলেও লোকে ডাকতো আতর বলে! রহিম বক্সের সঙ্গে মামার খেয়াঘাটেই কথা হয়েছে। ওর সঙ্গে রহিম বক্সের পরিচয় অনেক দিনের। মামা নদীর ওপারে জুট মিলে পাট সাপ্লাই দিচ্ছে আজ প্রায় বছরপাঁচেক। সে সুবাদে মিলের কোনো কাজে, না হয় কারণ ছাড়াই সময় করে একবার নদীর এপারে এসে বাজারটা ঘুরে যায় আতর মামা। তখন থেকেই রহিম বক্সের সঙ্গে মামার আলাপ। আজ যখন খেয়াঘাটে এসে নেমেছে ওরা, তখন রহিম বক্সের সঙ্গে দেখা। কথা প্রসঙ্গে ওর কাছেই আসল কথাটা পাড়লো মামা- টাবলুদের ভিটিসহ ঘরটা বিক্রি হবে। সে সঙ্গে দেয়াল ও ভিটির ইটগুলোও। জানাশোনা লোক থাকলে যেন খোঁজ দেয়।
রহিম বক্স অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, দেশের বাড়িতে অমন একটা ঘর নষ্ট করার কী দরকার! ভিটিটাও বিক্রি করলে লোকে কইবো কী! পরধাইন্যা বাড়ির ঐতিহ্য এই ঘরটা। কতো পুরানা ঘর!
মামা কপালে পুরু ভাঁজ একে বলে দেশের বাড়ির পরিবেশ যা হয়েছে কারো কাছে যে ও বাড়ির পরিচয় দেবো- সে সুযোগটিও নেই। তাই টাবলুর বাবা চাচ্ছেন, শেষ চিহ্ন ঐ ঘরটা ভিটিসহ বিক্রি করে ওবাড়ির সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলতে।
জমিগুলা! জামাই বাবার তো অনেক জমি আছে শুনি!
এর মধ্যে কিছু বিক্রি করেছে দুলোভাই! বাকি জমিও ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছে!
শেকড় ছেন্ন করা কী বালা দেখায়!
রহিম বক্স কিছুক্ষণ চুপ থেকে বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। বেশ, যখন বলছ বিক্রি করবে তখন আর অন্য মানুষের দরকার কী। আমি না হয় আজ দুপুরের পর একবার গিয়ে দামটা ঠিক করে আসব। সম্ভব হলে কিছু বায়নাও করে আসবো।
ওরা বাজার হয়ে খেয়াঘাট এল। রহিম বক্সের দেখা মেলেনি কোথাও। কথা বলতে বলতে ওরা যখন ঘাটের কাছে এলো তখন পাশের খড়ির দোকানে একজন লোককে দেখিয়ে মামা বলল- দেখ, টাবলু উনি তোর কাকা। তোর বাবার আপন কাকাতো ভাই। মনা কাকা। টাবলু দেখে, একজন লোক বসে আছে দোকানে। পরনে ময়লা পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি। কালো কালো চিতির ফোটা টুপি জুড়ে। মুখে পান। দুপাশ থেকে রস বেয়ে পড়ছে ঠোঁটের কষ ধরে। আঙুল থেকে জিভের ডগায় চুন লাগাতে লাগাতে কৌতূহলী চোখে ওদের দেখছে লোকটা। টাবলু কেমন উদাস হয়ে যায়। টাবলুর মনে পড়ে মায়ের কথাগুলো। মা বলেছে, এই মনা কাকা নাকি ছোটবেলায় ভারি দুষ্টু ছিল। স্কুল কামাই দিত প্রায়ই। স্কুলে যাওয়ার নাম করে নাকি গাছে চড়ে বসে থাকত। যখন স্কুল ছুটি হতো তখন গাছ থেকে সুড়সুড় করে নেমে বাড়ি ফিরত। একদিন নাকি এভাবে গাছ থেকে নামার সময় কে যেন দেখে ফেলে। খুব পিটুনি খেয়েছিল সেদিন। এরপর পড়ালেখার ল্যাঠা চিরদিনের জন্যে চুকিয়ে ফেলে। সেই থেকে মিলেই কাজ করছিল। কিন্তু এ ধকল আর শরীরে সইছে না। শিফটিং ডিউটি। কখনও সারা রাত জেগে জেগে ডিউটি করতে হয়। তাই কিছুদিন হয় কাজ ছেড়ে দিয়ে খড়ির দোকান বসিয়েছে।
কাকা একটু আয়েশ করে বসেছিলো গদিতে। এবার একটু শরীর ঝুঁকে ভালো করে নিরীক্ষণ করলো ওদের- কী মনে করে হাঁক দেয়- এ-ই তুমি আতর না! মানে আকতার না! একসময় এ বাড়িতে বোনের কাছে থেকেই পড়ালেখা করেছে ও। সে অনেক-অনেক দিন আগের কথা! এখন আতরও যেন বেশ বয়সের টানাপোড়েনে খানিকটা হেলে পড়েছে পশ্চিমে। বেলায় বেলায় বয়েস তো কম হলো না! আতর এগিয়ে যায়- কে মনা ভাই না!
চিনছো তাহলে! তা কী মনে কইরা এফি (এদিকে) আইছো! তারপর টাবলুর দিকে চোখ ফিরিয়ে এইডা-মজির পুত না!
আতর মাথা নেড়ে সায় দেয়।
আমি ওর মুখের ছাট দেইখাই বুঝছি- এইডা মজির পোলাই অইবো। তা ভাতিজার পড়ালখা শেষ!!
টাবলু কিছু বলে না। মামা যেচে বলে, এ লেভেল শেষ করলো!
তোমাগ, এইসব লেভেল-টেবেল বুঝি না বাবা, আমরা মুখ্যসুখ্য মানুষ!
চায়ের নিমন্ত্রণ ছিলো মনার দিক থেকে। ওরা অপারগতা প্রকাশ করে বাজারের দিকে এগিয়ে যায়।
সন্ধের আগে আগেই বাড়ির দিকে রওনা দেয় ওরা। তার আগে বাজারেই এক স্টলে চা পর্ব সেরে নেয়। রিকশা করে আসতে আসতে চারদিক দেখছিল টাবলু। রাস্তার বেশ উন্নতি হয়েছে। এ কতোক্ষণে দু-তিনটে ব্যাংকের সাইনবোর্ড চোখে পড়েছে ওর। সরকারি বাংলো হয়েছে। সরকারি কলোনি হয়েছে অনেকগুলো। প্রাইমারি-হাই ইশকুল, মেয়েদের ইশকুল, কলেজ কোনোটি বাকি নেই। অনেক বাসার ছাদে টিভির এন্টিনাও দেখা যাচ্ছে।
টাবলু বুঝতে পারে না যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া সবখানে সেখানে ওদের বাড়িটি এতো পিছিয়ে কেন? কাকার ছেলেগুলো নাকি গেরস্তালির কাজ করছে। বাবার বয়েসিরা অনেক আগেই লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে গেরস্তালির হাল ধরে। সেই পাঠ-বিমুখ হাওয়া বইছে এখনো। তা না হলে অমন বড় হয়েও ইশকুলে যায় না কেউ? আসলে ইনহেরিট করছে- অস্ফুটে বলে টাবলু।
ওদের বাড়ির কথা ভেবে ভীষণ কষ্ট হয় ওর। সমস্ত বাড়িতে একটি ভালো ঘরও নেই কারো। সবারই ছোট্টছোট্ট চালা ঘর। দু-একটা মাটির ঘর আছে। দেয়াল ফেটেপড়পড়। অনেকদিন লেপা-পোছা হয়নি। ওপরের চাল শন অথবা তালপাতার। বাড়িজুড়ে সচ্ছলতার ছিটেফোঁটাও নেই। দারিদ্র্যের ছাপ পুরো বাড়িতেই। অভাব তো লেগেই আছে সারাবছর- শরীরের ছায়ার মতো। থাকবেইবা না কেন? সবারই ভরসা দু-তিন খ- জমির ফসল। অথচ বছরে বছরে ঘরে ঘরে বিয়োচ্ছে প্রতিযোগিতা দিয়ে।
এর মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা থেকে মজির ‘পোলাপান’ এসেছে। হিজলের কানেও সে খবর এসে পৌঁছোয়। পোলাপান মানে টাবলু ছাড়াও ওর ছোট্ট ভাই ডাবলু। আতর মামার ছেলে ভিভান। মামার ছোটবেলার বন্ধু অঞ্জন। আরেকজন কে যেন। পরিচয় জানে না কেউ। এছাড়া গাড়ির ড্রাইভার তো আছেই!
ওরা ঘরে ফিরে এলে একটা কুপিতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে যায় হিজল। মাঠ থেকে ফিরে বাড়ির দু-একজন মুরুব্বী এসে কথা বলে যায় ওদের সঙ্গে। এখনো ইলেকট্রিসিটি আসেনি এ বাড়িতে। জিজ্ঞেস করলে কেউ কেউ বললো টাবলুকে, অতো টাকা কোথায়?
সেভাবে ওদের রাতে খেতে কেউ বলেনি। দু-একজন জিভে নুন ছোঁয়ানোর মতো করে হালকাচালে একটু কথা পেড়েছিলো শুধু! মামা বললো, খাবার এসে যাবে। হোটেলে বলা আছে! ওরাই সাইকেল করে এসে দিয়ে যাবে। সম্ভব হলে আমাদের গোটা ছয় প্লেট পাঠিয়ে দেন।
সাঈদ তখুনি নিতুকে ডেকে পাঠায়- যা ছয়টা চিনির (কাচের) প্লেটে দিয়ে যা।
ছয়ডা! আমাগো আছে বাবা মাত্তর দুইডা।
যোগাড় কর, যোগাড় কর! ফিসফিসিয়ে মেয়ের সংগে কথা বলে সাঈদ।
মিতু উঠোন দাপিয়ে এদিক-ওদিক ছুটে যাচ্ছে আর বলছে, কার কার চিনির বাসন আছে গো! কয়ডা চিনির বাসন দরকার! ঢাকাইল্যারা চিনির বাসন ছাড়া খায় না!
বেশ সময় বাদে কতগুলো কাচের প্লেট নিয়ে আসে মিতু! তখনও প্লেটের গা থেকে জল ঝরছে টুপটাপ! টুপটাপ!
টাবলু-ডাবলু চেয়ে দেখে একেকটা প্লেট একেক রকম। কোনোটা গর্ত মতন, কোনোটা চ্যাপটা। কোনোটা ছোট আবার কোনোটা বড়। ডিজাইনের মিল নেই। রঙের মিল নেই! তার ওপর চটা উঠে গেছে কোথাও কোথাও!
আতর একটু অবাক হয়! একই রকম ছটা প্লেট দিতে পারলো না কেউ! বাড়ির কী হাল্ দেখেছিস!
বস্তিবাড়িকেও হার মানিয়েছে! টাবলুর অস্ফুটে উচ্চারণ।
রাত যখন আরো গড়িয়ে গেল তখুনি সঙ্গীসহ এলো রহিম বক্স। ওর এক হাতে লাঠি, অন্য হাতে হারিকেন। আরেকজনের হাতে বাঁশের সড়কি। ঘর-ভিটির দামদর ঠিক হলে রহিম বক্স চলে যায়। সেসঙ্গে ঘরের আসবাবপত্তরগুলোও নেড়েচেড়ে ভালো করে পরখ করে শেষে কিনবে বলে কথা দিয়ে গেল রহিম বক্স।
হিজল খুব সকাল সকাল পুবে একটা ক্ষেতে জ্বালা পাট লাগাতে গিয়েছিলো। বেলা কিছু গড়িয়ে গেলে বাড়িমুখো হয় সে। বাঁশঝাড়ের কাছে এসে দেখে, ওদের উঠোন কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আরো কিছুপথ এগিয়ে এলে কানে আসতে থাকে একটানা শব্দ। ঠুক ঠুক। ঠ্যাক ঠ্যাক। খটাক্ খটাক্ রুখু সেসব শব্দ ছাপিয়ে মাঝে মাঝে কানে আসছিলো পাখির অস্থির চিড়ি চিড়িক ডাক!
হিজল দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। দুচোখে বিস্ময় মেখে উঠোনের এককোণে এসে দাঁড়ায় ও। এক আকাশ চিন্তা কিংবা আশঙ্কার ভিড়। চালের উত্তরের সারির টিনগুলো বাদে বাকি সব টিন খুলে ফেলা হয়েছে। হিজল শূন্য চালা ছুঁয়ে শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ ওর চোখ যায় উঠোনের এককোণে। দুটো চড়–ই। মুখে দু-একটা করে খড়কুটো নিয়ে পাশের ঘরের ঘুলঘুলিতে রেখে আসছে। আবার নিচ্ছে। আর কিচকিচ করে ডেকে উঠছে বার বার। সে ডাকে কেমন এক ব্যথা মিশে রয়েছে। হিজল অনেকক্ষণ ধরে দেখছিলো চড়–ই পাখি দুটোর ব্যস্ততা। ওদের ভাঙা ঘর জুড়ে নিতে কী তাদের আকুলতা। কী যেনো ভাবছিল উদাস হয়ে। তখুনি ধুপ করে শব্দ হতে চেয়ে দেখে, দেয়ালের একটা বড় চাঁই-গাঁথুনি থেকে আলগা হয়ে পড়েছে হুড়মুড় করে। ওদিকে রহিম বক্সের মুটেরা খাট আলমারি, মিটসেফ এমনি সব আসবাবপত্তর মাথায় নিয়ে ক্ষেতের আল ধরে দক্ষিণে হাঁটা দিয়েছে ততক্ষণে।
সব কাজ চুকিয়ে নিতে নিতে বিকেল গড়িয়ে যায়। রহিম বক্স মুটেদের হাতে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেছে অনেকক্ষণ। টাবলুর মামাও কথামতো আগাম টাকা বুঝে পেয়েছে। তখন আর দেরি কেন! কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে মাথায় টুপি এঁটে রওনা দেয় ভাগ্নেদের নিয়ে। হিজল- টাবলুর ব্যাগটা হাতে নিয়ে হাঁটতে থাকে ওদের পিছু পিছু। কবুতরের বাচ্চার মতো কেমন চুপসে রয়েছে সে। চোখে-মুখে কী এক বিষণœতা।
পাকা পথের শুরুতে কলাগাছের ঝাড়। কেমন ছায়া ছায়া ঠা-া পরিবেশ। সবাই এসে দাঁড়ায় ওখানটায়। গাড়ি ওদের অনেকটা দূরে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কম্পাউন্ডে রাখা আছে। সরু রাস্তা বলে বাড়ি অবধি গাড়ি আসেনি। রিকশা আগে থেকে ডাকাই ছিল। রিকশা যখন ঝিরঝির করে সামনে এগোচ্ছিলো তখন টাবলুর মামা পেছনে মুখো হয়ে হিজলকে বলে, লেখাপড়া না শিখে হয়েছিস গরু। আর বাড়িটাকে বানিয়েছিস গোয়াল ঘর। সারা বেলা ক্ষেতে পড়ে না থেকে বাড়ির ছোটগুলোর দিকে নজর রাখিস, আবার তোর মতো দুপেয়ে গরু বানাসনে ওদের।
হিজল যখন বাড়ি ফেরে চারদিকে তখন ঘন অন্ধকার। পুরো বাড়ি যেন শ্মশান। ও এসে দাঁড়ায় উঠোনের সিঁদুরে আমগাছ তলায়। নেংটো ঘরটার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। এদিক-সেদিক পড়ে আছে ভাঙা টিনের টুকরো। এর মধ্যে অর্ধেক ভিটির ইট তুলে ফেলা হয়েছে। সেখানে কুকুর মাটিতে আঁচড় কাঁটছে নখ দিয়ে। এসব দেখে ওর চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। উঠোনের শূন্যতা ওর বুকে আছড়ে পড়ছে যেন। আর দাঁড়ায় না সে। চলে আসে ঘরে।
ওর কানে কেবলই বাজছে- হয়েছিস গরু! গরু! গরু!
ওর গা রি রি করে ওঠে, কী এক ঘৃণায়! বুক কেঁপে ওঠে কী এক আশঙ্কায়! প্রথমে কুপি নিয়ে বাইরে আসে হিজল। কিন্তু বাতাসের দাপট বেশ। কুপি জ্বালিয়ে বেশিদূর যাওয়া যাবে না। ও ফিরে এসে এবার হ্যারিকেন হাতে নিয়ে বের হয়। সেলু, মতি, সাদেক, মনু এমনি করে শরিক, আশপাশের পড়শি অনেকের বাড়ি বাড়ি যায় ও। তখন ও হাঁটছিলো না যেন লাফিয়ে লাফিয়ে পাহাড় ডিঙোচ্ছিলো। ক্ষীপ্র ওর হাঁটা। দীপ্ত ওর অবয়ব। এক এক ঘরে গিয়ে নতুন নতুন সংবাদ নিয়ে ফেরে হিজল। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য- রহিম বক্স শুধু ঘরই কেনেনি। টাবলুর বাবার পুরো ভিটিটাই কিনে নিয়েছে। প্রায় আধা বিঘে জায়গার ওপর ওদের ভিটে!
নিজেদের বাড়ি, ভিটি আর শরিকদের মধ্যে বলা নেই কওয়া নেই আচমকা বাইরের অজানা অচেনা এক লোক এসে শেকড় গেড়ে বসবে এ কী করে হয়! কেউ মেনে নিতে পারে না ব্যাপারটি।
পরদিন সকাল সকাল যথারীতি রহিম বক্সের লোকজন হাতুড়ি, শাবল, গাইতি, কুড়াল সব নিয়ে চলে আসে। ওরা যখন পাকা ভিটি ভেঙে ইট তুলে আনবে বলে হাত চালাচ্ছে তখনই বাড়ির লোকজন থেকে শুরু করে পুরো পাড়া যেন ঝাঁপিয়ে পড়লো মুহূর্তে। শাবলের ওপর বাঁশের পর বাঁশ এসে পড়ে, “আর একটা কোপও না। আর একটা ইটও খোলা যাইবো না! কাম বন্ধ। সব কাম বন্ধ। তোমরা রহিম বক্সকে গিয়া বলো, বাড়ির মানুষ কামে বাধা দিছে। কিন্তু আর কোনো দেয়াল ভাঙার চেষ্টা করবা না।” অনেকগুলো কণ্ঠ এবার চেঁচিয়ে ওঠে, “সাবধান! সাবধান!”
ওরা প্রথমে একটু গাঁইগুঁই করলেও শেষে মানুষের তোপের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
যার ঘরে যার উঠোনে, যার গোয়ালে পুরনো টিন রয়েছে কিংবা হোগলা, চাটাই, বস্তা যা আছে তাই দিয়ে মুহূর্তে ভাঙা ভিটি ঘিরে ফেলে বাড়ির লোকজন। “নাঃ আর একটা শাবলও ঢুকতে দিমু না! সাফ কথা!” অন্যরাও সমস্বরে বলে! সাফ কথা! সাফ কথা!
হিজল খেয়াল করে পুরো ঘটনার নেতৃত্ব কেমন করে যেন আনু পাগলার হাতে চলে গেছে। অত্যন্ত নীতিবান মানুষ হিশেবে, বিচক্ষণ মানুষ হিশেবে, সৎ শালিসকারী হিশেবে আনু পাগলার বেশ নাম-ডাক এ তল্লাটে। অথচ কুঁড়েঘরে থাকে। ভরা বর্ষায়ও ঘরের চালা ছাইতে পারে না শনপাট কেনার পয়সার অভাবে। একটা লুঙ্গি, গায়ে হাতাঅলা স্যান্ডো গেঞ্জি আর কাঁধে ডুরে একটা গামছা। এর বাইরে কখনও কোনো কাপড় ওঠেনি ওর গায়ে। সামর্থ্য থাকলে তো উঠবে!
ওর বিচারবোধ এতো তীক্ষè, যুক্তির কারিসমা এতো বিস্ময়কর, তার এ প্রতিভা নিয়ে কখনও কারও কাছে বিক্রি হয়নি আনু পাগলা! কখনও কেউ তাকে কিনে নেবার দুঃসাহসও দেখায়নি। যেকোনো অন্যায় প্রতিরোধে অপ্রতিরোধ্য আনু পাগলা! গোঁয়ার একগুঁয়ে যা ইচ্ছে তাকে বলতে পারো- কিন্তু নীতির বাইরে তাকে এক ইঞ্চিও টলানো যাবে না। যাবে না কিংবা যায় না বলেই ওকে মানুষ ভালোবেসে ‘পাগলা’ বলে ডাকে! আনু পাগলাকে সম্মান করে হাট-বাজারের সকলে। ওর আছে শক্তি, আদর্শ এবং নীতি। কথা খুব কম বলে। কিন্তু যা বলে মেপেজুকে বলে। আর আছে পাকানো এক বাঁশের লাঠি। সে অবাক করা এক লাঠি। বাদামি রঙ ধরেছে। গায়ে এলোপাতাড়ি পেরেক ঢোকানো। মাঝেমধ্যেই রোদে বসে লাঠির গায়ে তেল মাখে আনু। রোদ খাওয়া হলে পরম যতœ করে কোথায় যে লুকিয়ে রাখে সে লাঠি তা কেউ জানে না!
পুরনো টিনের ঘর সরিয়ে সেখানে দালান তোলার পরিকল্পনা রহিম বক্সের। চারদিকে পাঁচিল উঠবে। মাঝখানে দোতলা বাড়ি। ফাউন্ডেশন হবে চারতলার। এমনি পরিকল্পনার কথা লোকমুখে পাঁচ কান হয়ে এ বাড়ি অবধি এসে পৌঁছেছে।
একই সঙ্গে টাবলুর বাবার কাছে ফোন আসে রহিম বক্সের। “ঘর ভাঙার কাম বন্ধ। আপনার বাড়ির লোকজন লাঠিসড়কি নিয়া আমার লেবার সব বিদায় কইরা দিছে। হাত-পা ভাঙে নাই আমার সাত কপালের ভাগ্যি। ওর কণ্ঠে কান্না, বিরক্তি এবং ক্ষোভের মিশেল!
তিন দিন পর ফের টাবলু ওর মামা আতর আরও নতুন দুজন আসে শহর থেকে। তাদের একজন ঢাকার উকিল। অন্যজনের পরিচয় জানতে পারেনি এখনও। ওদের চলাফেরা, চোখের চাউনি এবং চোয়ালের ওঠানামা, কখনও চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠার মধ্যে কিছু কথা কিছু অভিব্যক্তি এবং কিছু বিক্ষিপ্ত চিত্র ফুটে ওঠে। যার অনুবাদ বলছে, “হাভাতে রাস্তার নেড়ি কুত্তাগুলোর সাহস তো কম নয়। রহিম বক্সকে ঘর করতে দেবে না। জায়গার দখল বুঝে নিতে দেবে না! কুত্তাগুলো সাপের পাঁচপা দেখেছে। মাঝা বরাবর এমন লাঠি ঝাড়বো না, আর কোনোদিন সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে না। ঘাড়ে এমন ছ্যাঁচা দেবো না, যাতে আর ওপরে তাকাতে না পারে। প্রয়োজনে জিভ টেনে খুলে ফেলবো, যাতে প্রতিবাদের ভাষা আর কোনোদিন মুখে না আসে। ওদের ঠোঁটগুলো অস্থির হাতির কান ঝাপটানোর মতো কে যেন ঝাপটে দিচ্ছে আর অস্ফুটে বলে যাচ্ছে মনের ক্ষোভের কথা! (আগামী সংখ্যায় বাকি অংশ)
আনিস রহমান
বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫
মাটি খুঁড়ে কেঁচো তুলছিল হিজল। তখুনি দেখল ওদের। শহুরে লোক। সবার গায়েই দামি কাপড়। একজনের মাথায় হ্যাট। কারও পিঠে হ্যাভারসেক, কেউ আবার ক্রসবেল্ট নামিয়ে দিয়েছে বুক আড়াআড়ি। ব্যাগের সাইট পকেট থেকে জলের বোতল, চিপ্সের প্যাকেট উঁকি দিচ্ছে। ওরা হিজলদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছিলো আর হাত-পা নেড়ে বকছিলো শুধু। কথার মাথামু-ু কিছুই বুঝতে পারে না, ওরা ইংরেজিতে কথা বলছিলো। মাঝেমধ্যে এক-আধটু বাংলার মিশেল শুধু।
আসলে ওর চোখ তখন কচুবনের ভেজা স্যাঁতসেঁতে মাটির গভীরে প্রবেশ করছিলো একটু একটু করে। তখনই বেশ কিছু মানুষের কণ্ঠ কানে এলো ওর। নানা বয়েসের কণ্ঠ। কণ্ঠ ছাপিয়ে উঠে আসা কথার ধরনও ভিন্ন। কারও কণ্ঠ চিকন, কারও মিহিকণ্ঠ, কারও কণ্ঠ আবার রাশভারি, কোনোটা খসখসে না হয় ফিচেল ধরনের! হিজলের কৌতূহলী মন ও চোখ দেখলো একদঙ্গল লোক। অচেনা। কখনও কাউকে দেখেছে বলেও মনে পড়ে না! এদিককার নয় ওরা! তবে আগন্তুকরা যে ওদের বাড়ি লক্ষ্য করেই কথা বলছিলো এটা নিশ্চিত হিজল। কী কথা ওদের! ভাবনা নিয়ে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার কেঁচো তুলতে থাকে হিজল। কেঁচো তোলা হলে চোখে হাত রেখে ওদিকে আরেকবার তাকিয়ে ছিপ হাতে মাছ ধরতে চলে যায় বিলের দিকে। ফিরে এলে তবে মা রান্না চড়াবে।
এদিকে আগন্তুকদের মুখ, কথা ওর ভাবনা থেকে একেবারে ছেঁটে ফেলতে পারে না। ছায়া হয়ে মাথায় মিশে থাকে নিবিড়ভাবে। হিজল নিশ্চিত লোকগুলো ওদের বাড়ি যাবে না! অন্তত ওদের পোশাক-আশাক দেখে এমনটিই মনে হয় ওর। কারণ ওদের বাড়ির যা শ্রী! কারও ঘরে দরোজা নেই বললেই চলে! এবাড়ির প্রায় সবাই ঝাঁপ দিয়ে দুয়োর লাগায়। ওদিকে মজি কাকাদের ঘরের পুবে একটা দরজা আছে শুধু। তাও ঘুণে খেয়ে নিয়েছে। দরজার পাল্লা ধরে ভালো করে নাড়া দিলে কাঠের গুড়ো ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়ে। বুঝ হতে কখনও দেখেনি ওদের।
বুঝ হতে কখনো ও ঘরের দরজা খোলা চোখে পড়েনি। দরজার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে কৌতূহলী চোখ মেলে তাকাতো ভেতরে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছু স্পষ্ট দেখা যায় না। শুধু সামনে একটা দেয়াল ঘড়ি চোখে পড়ে। কাটা থেমে আছে। ডায়ালটা কেমন ঘোলাটে। আলনায় দু-একটা পুরনো কাপড় ঝুলে আছে। এছাড়া অন্ধকারে বাড়তি কিছুই চোখে পড়েনি ওর।
অথচ ওঘরের দরজা আজ অমন হাট্ করে খোলা- আশ্চর্য! বিল থেকে ফেরার পথে বেশ দূর থেকেই চোখে পড়ে ব্যাপারটি! কী এক অজানা আশঙ্কায় দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ির কাছাকাছি চলে আসে ও। ভেতর বাড়ি না গিয়ে উঠোনের সিঁদুরে আমগাছটার আড়ালে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করে হিজল। শহুরে লোকগুলোকে এখানে দেখে কেমন যেন হকচকিয়ে যায় সে। হ্যাট পরা লোকটা ঘরের চালা নাড়াচাড়া করে দেখে কিছুক্ষণ। পরে হাতের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, টাবলু- টিনগুলো একেবারে বাদ হয়ে গেছে। দাম খুব একটা আসবে বলে মনে হচ্ছে না। এক বান নতুন টিনের দাম এখন কতো রে?
ওদের সামনে বাড়ির ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে এসে ভিড় করেছে তখন। সবাই আদুল গা। গায়ে তেল-জলের ছোঁয়া নেই অনেক দিন। গা জুড়ে খড়িমাটির ছোপ। পায়ে কাদা শুকিয়ে আছে। শুধু জেগে আছে ওদের চোখ দুটো। সে চোখে বিস্ময়, কৌতূহল আর ভয়। মাঝে মাঝে ভেতর বাড়ি থেকে দু-একজন মহিলাও মুখে আঁচল চেপে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে অচেনা মুখগুলো। হিজল ওদের সামনে এসে ধমকে ওঠে, “এ-ই পোলাপান। তগো কাম নাই। এহানে কী দেহস? তামশা পাইছস্? বাড়ি যা! কামে যা।”
ছোটরা সব ভেতর বাড়ির দিকে দৌড়ে চলে যায় মুহূর্তে। হিজল লোকগুলোর দিকে একবারও না তাকিয়ে খেজুরগাছের ছায়ায় গিয়ে উত্তুরে মুখ করে বসে থাকে। মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখে লোকগুলোকে। দেখে ওদের কা-কীর্তি। চোখে-মুখে ওর চরম বিরক্তি। দুর্বোধ্যতার ছায়া সেসঙ্গে শংকাও।
একজন লোক ঘুরে ঘুরে শরীর দুলিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে উঠোনের আশপাশ দেখছে। বাড়ির সামনেই খড়ের গাঁদা-গোয়াল ঘর। পেশাবের তীব্র ঝাঁজে কপালের ভাঁজ ফুলে ওঠে। বাঁশে শুকাতে দেয়া কাঁথাগুলো থেকেও পেচ্ছাবের চ্যাংটা গন্ধ এসে নাকে লাগতেই ভ্রƒ-জোড়া কুঁচকে ওঠে লোকটার। বারান্দার সামনে এসে বলল, দ্যাখ্ টাবলু—বাড়িটার যা ছিরি! বমি আসতে চায় দেখলে। বলে একমুখ থু থু মাটিতে ফেলে লোকটা। গা রি রি করছে ওর! সারা শরীর কেমন মুচড়ে মুচড়ে ওঠে বারবার!
ওদের কথাগুলো হিজলের গায়ে বেঁধে কাঁটার মতো। হিজলের বয়স খুব বেশি হয়নি। গেলো পৌষে চৌদ্দতে পা দিয়েছে কেবল। কিন্তু তাই বলে সে যে একেবারেই কিছুই বোঝেনি, তা তো নয়! অন্তত তাদের নিয়ে যে কথাগুলো বলছে ওরা সেটা দিব্যি বুঝতে পারে।
হিজল কাজে চলে গেলে ছোটরা আবার এসে ভিড় করে। টাবলু ছোট এক মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞেস করে নাম কী তোর?
আমেনা।
ইস্কুলে যাস?
আমি যাই না। আমার বড় দাদা যায়। থিরিতে পড়ে।
টাবলু এভাবে অনেককে জিজ্ঞেস করে দেখল যে, বাড়ি জুড়ে মাত্তর দুতিনজন পড়–য়া আছে।
এদিকে রোদে চারদিকে পুড়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে একঝলক বাতাস এসে লাগছে গায়ে। তাও রোদের আঁচে তেতে আছে। কেমন যেনো হাঁফফাঁস লাগে ওদের। চোখ-মুখ কেমন লালচে দেখাচ্ছে। কপালে ঘাম চিক চিক করছে। গরম ভাঁপ বেরুচ্ছে শরীর থেকে! হ্যাট পরা লোকটা টুপি খুলে বেদম বাতাস করছে! টুপি নেড়ে বাতাস! তার দৌড় আর কদ্দুর! শেষে টেকা দায় হলে সবাই ঘরে চলে আসে। ধৈর্য ওদের শেষ তলানিতে তখন! টাবলু কণ্ঠে ঝাঁজ ছড়িয়ে বলে, তাকিয়ে সবাই কী দেখছিস! তোদের ঘরে পাখা নেই। পাখা!
ছেলেমেয়েরা এর-ওর দিকে তাকিয়ে শেষে গলা ছেড়ে দৌড় দেয়- “মা গো পাংখা চায়, বেডারা পাংখা চায় গো মা!”
মায়েরা পাখা বাড়িয়ে দেয়। এঘর-ওঘর থেকে। চার-পাঁচটা পাখা মুহূর্তেই যোগাড় হয়ে যায়। বাচ্চারা চারদিক থেকে ওদের বাতাস করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাতাসের আবেশে চোখ মুঁদে এলেও ব্যাগ থেকে স্যান্ডউইচ, বিস্কুট, কলা, আপেল, ডিম-সেদ্ধ বের করে খেতে ভোলে না শহুরে লোকগুলো। জলের বোতলগুলো একপাশে সরিয়ে রাখে। ঘামেভেজা ছেলেমেয়ের দিকে ভ্রƒক্ষেপ নেই ওদের। অথচ ওদের হাতের বাতাস খাচ্ছে কেমন আয়েশ করে। বাচ্চারা বিস্ময় চোখে দেখছে আর ঢোঁক গিলছে মাঝে মাঝে। রুটি মুখে দিয়ে হ্যাট পরা লোকটা জিজ্ঞেস করল- টাবলু, রহিম বক্সের আসার কথা ছিলো যেন কখন?
তিনটের দিকে!
ঘড়ির দিকে একবার চোখ রেখে, জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকিয়ে পরে আস্ত কলায় কামড় বসিয়ে বলল, অপেক্ষা না করে তারচে বরং গুদারাঘাটে গিয়ে রহিম বক্সকে ধরি। যাবার সময় একবার বাজার হয়ে গেলেও মন্দ হয় না!
হ্যাট পরা লোকটা টাবলুর মামা আতর। এমনিতে নাম আকতার হলেও লোকে ডাকতো আতর বলে! রহিম বক্সের সঙ্গে মামার খেয়াঘাটেই কথা হয়েছে। ওর সঙ্গে রহিম বক্সের পরিচয় অনেক দিনের। মামা নদীর ওপারে জুট মিলে পাট সাপ্লাই দিচ্ছে আজ প্রায় বছরপাঁচেক। সে সুবাদে মিলের কোনো কাজে, না হয় কারণ ছাড়াই সময় করে একবার নদীর এপারে এসে বাজারটা ঘুরে যায় আতর মামা। তখন থেকেই রহিম বক্সের সঙ্গে মামার আলাপ। আজ যখন খেয়াঘাটে এসে নেমেছে ওরা, তখন রহিম বক্সের সঙ্গে দেখা। কথা প্রসঙ্গে ওর কাছেই আসল কথাটা পাড়লো মামা- টাবলুদের ভিটিসহ ঘরটা বিক্রি হবে। সে সঙ্গে দেয়াল ও ভিটির ইটগুলোও। জানাশোনা লোক থাকলে যেন খোঁজ দেয়।
রহিম বক্স অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, দেশের বাড়িতে অমন একটা ঘর নষ্ট করার কী দরকার! ভিটিটাও বিক্রি করলে লোকে কইবো কী! পরধাইন্যা বাড়ির ঐতিহ্য এই ঘরটা। কতো পুরানা ঘর!
মামা কপালে পুরু ভাঁজ একে বলে দেশের বাড়ির পরিবেশ যা হয়েছে কারো কাছে যে ও বাড়ির পরিচয় দেবো- সে সুযোগটিও নেই। তাই টাবলুর বাবা চাচ্ছেন, শেষ চিহ্ন ঐ ঘরটা ভিটিসহ বিক্রি করে ওবাড়ির সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলতে।
জমিগুলা! জামাই বাবার তো অনেক জমি আছে শুনি!
এর মধ্যে কিছু বিক্রি করেছে দুলোভাই! বাকি জমিও ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছে!
শেকড় ছেন্ন করা কী বালা দেখায়!
রহিম বক্স কিছুক্ষণ চুপ থেকে বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। বেশ, যখন বলছ বিক্রি করবে তখন আর অন্য মানুষের দরকার কী। আমি না হয় আজ দুপুরের পর একবার গিয়ে দামটা ঠিক করে আসব। সম্ভব হলে কিছু বায়নাও করে আসবো।
ওরা বাজার হয়ে খেয়াঘাট এল। রহিম বক্সের দেখা মেলেনি কোথাও। কথা বলতে বলতে ওরা যখন ঘাটের কাছে এলো তখন পাশের খড়ির দোকানে একজন লোককে দেখিয়ে মামা বলল- দেখ, টাবলু উনি তোর কাকা। তোর বাবার আপন কাকাতো ভাই। মনা কাকা। টাবলু দেখে, একজন লোক বসে আছে দোকানে। পরনে ময়লা পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি। কালো কালো চিতির ফোটা টুপি জুড়ে। মুখে পান। দুপাশ থেকে রস বেয়ে পড়ছে ঠোঁটের কষ ধরে। আঙুল থেকে জিভের ডগায় চুন লাগাতে লাগাতে কৌতূহলী চোখে ওদের দেখছে লোকটা। টাবলু কেমন উদাস হয়ে যায়। টাবলুর মনে পড়ে মায়ের কথাগুলো। মা বলেছে, এই মনা কাকা নাকি ছোটবেলায় ভারি দুষ্টু ছিল। স্কুল কামাই দিত প্রায়ই। স্কুলে যাওয়ার নাম করে নাকি গাছে চড়ে বসে থাকত। যখন স্কুল ছুটি হতো তখন গাছ থেকে সুড়সুড় করে নেমে বাড়ি ফিরত। একদিন নাকি এভাবে গাছ থেকে নামার সময় কে যেন দেখে ফেলে। খুব পিটুনি খেয়েছিল সেদিন। এরপর পড়ালেখার ল্যাঠা চিরদিনের জন্যে চুকিয়ে ফেলে। সেই থেকে মিলেই কাজ করছিল। কিন্তু এ ধকল আর শরীরে সইছে না। শিফটিং ডিউটি। কখনও সারা রাত জেগে জেগে ডিউটি করতে হয়। তাই কিছুদিন হয় কাজ ছেড়ে দিয়ে খড়ির দোকান বসিয়েছে।
কাকা একটু আয়েশ করে বসেছিলো গদিতে। এবার একটু শরীর ঝুঁকে ভালো করে নিরীক্ষণ করলো ওদের- কী মনে করে হাঁক দেয়- এ-ই তুমি আতর না! মানে আকতার না! একসময় এ বাড়িতে বোনের কাছে থেকেই পড়ালেখা করেছে ও। সে অনেক-অনেক দিন আগের কথা! এখন আতরও যেন বেশ বয়সের টানাপোড়েনে খানিকটা হেলে পড়েছে পশ্চিমে। বেলায় বেলায় বয়েস তো কম হলো না! আতর এগিয়ে যায়- কে মনা ভাই না!
চিনছো তাহলে! তা কী মনে কইরা এফি (এদিকে) আইছো! তারপর টাবলুর দিকে চোখ ফিরিয়ে এইডা-মজির পুত না!
আতর মাথা নেড়ে সায় দেয়।
আমি ওর মুখের ছাট দেইখাই বুঝছি- এইডা মজির পোলাই অইবো। তা ভাতিজার পড়ালখা শেষ!!
টাবলু কিছু বলে না। মামা যেচে বলে, এ লেভেল শেষ করলো!
তোমাগ, এইসব লেভেল-টেবেল বুঝি না বাবা, আমরা মুখ্যসুখ্য মানুষ!
চায়ের নিমন্ত্রণ ছিলো মনার দিক থেকে। ওরা অপারগতা প্রকাশ করে বাজারের দিকে এগিয়ে যায়।
সন্ধের আগে আগেই বাড়ির দিকে রওনা দেয় ওরা। তার আগে বাজারেই এক স্টলে চা পর্ব সেরে নেয়। রিকশা করে আসতে আসতে চারদিক দেখছিল টাবলু। রাস্তার বেশ উন্নতি হয়েছে। এ কতোক্ষণে দু-তিনটে ব্যাংকের সাইনবোর্ড চোখে পড়েছে ওর। সরকারি বাংলো হয়েছে। সরকারি কলোনি হয়েছে অনেকগুলো। প্রাইমারি-হাই ইশকুল, মেয়েদের ইশকুল, কলেজ কোনোটি বাকি নেই। অনেক বাসার ছাদে টিভির এন্টিনাও দেখা যাচ্ছে।
টাবলু বুঝতে পারে না যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া সবখানে সেখানে ওদের বাড়িটি এতো পিছিয়ে কেন? কাকার ছেলেগুলো নাকি গেরস্তালির কাজ করছে। বাবার বয়েসিরা অনেক আগেই লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে গেরস্তালির হাল ধরে। সেই পাঠ-বিমুখ হাওয়া বইছে এখনো। তা না হলে অমন বড় হয়েও ইশকুলে যায় না কেউ? আসলে ইনহেরিট করছে- অস্ফুটে বলে টাবলু।
ওদের বাড়ির কথা ভেবে ভীষণ কষ্ট হয় ওর। সমস্ত বাড়িতে একটি ভালো ঘরও নেই কারো। সবারই ছোট্টছোট্ট চালা ঘর। দু-একটা মাটির ঘর আছে। দেয়াল ফেটেপড়পড়। অনেকদিন লেপা-পোছা হয়নি। ওপরের চাল শন অথবা তালপাতার। বাড়িজুড়ে সচ্ছলতার ছিটেফোঁটাও নেই। দারিদ্র্যের ছাপ পুরো বাড়িতেই। অভাব তো লেগেই আছে সারাবছর- শরীরের ছায়ার মতো। থাকবেইবা না কেন? সবারই ভরসা দু-তিন খ- জমির ফসল। অথচ বছরে বছরে ঘরে ঘরে বিয়োচ্ছে প্রতিযোগিতা দিয়ে।
এর মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা থেকে মজির ‘পোলাপান’ এসেছে। হিজলের কানেও সে খবর এসে পৌঁছোয়। পোলাপান মানে টাবলু ছাড়াও ওর ছোট্ট ভাই ডাবলু। আতর মামার ছেলে ভিভান। মামার ছোটবেলার বন্ধু অঞ্জন। আরেকজন কে যেন। পরিচয় জানে না কেউ। এছাড়া গাড়ির ড্রাইভার তো আছেই!
ওরা ঘরে ফিরে এলে একটা কুপিতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে যায় হিজল। মাঠ থেকে ফিরে বাড়ির দু-একজন মুরুব্বী এসে কথা বলে যায় ওদের সঙ্গে। এখনো ইলেকট্রিসিটি আসেনি এ বাড়িতে। জিজ্ঞেস করলে কেউ কেউ বললো টাবলুকে, অতো টাকা কোথায়?
সেভাবে ওদের রাতে খেতে কেউ বলেনি। দু-একজন জিভে নুন ছোঁয়ানোর মতো করে হালকাচালে একটু কথা পেড়েছিলো শুধু! মামা বললো, খাবার এসে যাবে। হোটেলে বলা আছে! ওরাই সাইকেল করে এসে দিয়ে যাবে। সম্ভব হলে আমাদের গোটা ছয় প্লেট পাঠিয়ে দেন।
সাঈদ তখুনি নিতুকে ডেকে পাঠায়- যা ছয়টা চিনির (কাচের) প্লেটে দিয়ে যা।
ছয়ডা! আমাগো আছে বাবা মাত্তর দুইডা।
যোগাড় কর, যোগাড় কর! ফিসফিসিয়ে মেয়ের সংগে কথা বলে সাঈদ।
মিতু উঠোন দাপিয়ে এদিক-ওদিক ছুটে যাচ্ছে আর বলছে, কার কার চিনির বাসন আছে গো! কয়ডা চিনির বাসন দরকার! ঢাকাইল্যারা চিনির বাসন ছাড়া খায় না!
বেশ সময় বাদে কতগুলো কাচের প্লেট নিয়ে আসে মিতু! তখনও প্লেটের গা থেকে জল ঝরছে টুপটাপ! টুপটাপ!
টাবলু-ডাবলু চেয়ে দেখে একেকটা প্লেট একেক রকম। কোনোটা গর্ত মতন, কোনোটা চ্যাপটা। কোনোটা ছোট আবার কোনোটা বড়। ডিজাইনের মিল নেই। রঙের মিল নেই! তার ওপর চটা উঠে গেছে কোথাও কোথাও!
আতর একটু অবাক হয়! একই রকম ছটা প্লেট দিতে পারলো না কেউ! বাড়ির কী হাল্ দেখেছিস!
বস্তিবাড়িকেও হার মানিয়েছে! টাবলুর অস্ফুটে উচ্চারণ।
রাত যখন আরো গড়িয়ে গেল তখুনি সঙ্গীসহ এলো রহিম বক্স। ওর এক হাতে লাঠি, অন্য হাতে হারিকেন। আরেকজনের হাতে বাঁশের সড়কি। ঘর-ভিটির দামদর ঠিক হলে রহিম বক্স চলে যায়। সেসঙ্গে ঘরের আসবাবপত্তরগুলোও নেড়েচেড়ে ভালো করে পরখ করে শেষে কিনবে বলে কথা দিয়ে গেল রহিম বক্স।
হিজল খুব সকাল সকাল পুবে একটা ক্ষেতে জ্বালা পাট লাগাতে গিয়েছিলো। বেলা কিছু গড়িয়ে গেলে বাড়িমুখো হয় সে। বাঁশঝাড়ের কাছে এসে দেখে, ওদের উঠোন কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আরো কিছুপথ এগিয়ে এলে কানে আসতে থাকে একটানা শব্দ। ঠুক ঠুক। ঠ্যাক ঠ্যাক। খটাক্ খটাক্ রুখু সেসব শব্দ ছাপিয়ে মাঝে মাঝে কানে আসছিলো পাখির অস্থির চিড়ি চিড়িক ডাক!
হিজল দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। দুচোখে বিস্ময় মেখে উঠোনের এককোণে এসে দাঁড়ায় ও। এক আকাশ চিন্তা কিংবা আশঙ্কার ভিড়। চালের উত্তরের সারির টিনগুলো বাদে বাকি সব টিন খুলে ফেলা হয়েছে। হিজল শূন্য চালা ছুঁয়ে শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ ওর চোখ যায় উঠোনের এককোণে। দুটো চড়–ই। মুখে দু-একটা করে খড়কুটো নিয়ে পাশের ঘরের ঘুলঘুলিতে রেখে আসছে। আবার নিচ্ছে। আর কিচকিচ করে ডেকে উঠছে বার বার। সে ডাকে কেমন এক ব্যথা মিশে রয়েছে। হিজল অনেকক্ষণ ধরে দেখছিলো চড়–ই পাখি দুটোর ব্যস্ততা। ওদের ভাঙা ঘর জুড়ে নিতে কী তাদের আকুলতা। কী যেনো ভাবছিল উদাস হয়ে। তখুনি ধুপ করে শব্দ হতে চেয়ে দেখে, দেয়ালের একটা বড় চাঁই-গাঁথুনি থেকে আলগা হয়ে পড়েছে হুড়মুড় করে। ওদিকে রহিম বক্সের মুটেরা খাট আলমারি, মিটসেফ এমনি সব আসবাবপত্তর মাথায় নিয়ে ক্ষেতের আল ধরে দক্ষিণে হাঁটা দিয়েছে ততক্ষণে।
সব কাজ চুকিয়ে নিতে নিতে বিকেল গড়িয়ে যায়। রহিম বক্স মুটেদের হাতে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেছে অনেকক্ষণ। টাবলুর মামাও কথামতো আগাম টাকা বুঝে পেয়েছে। তখন আর দেরি কেন! কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে মাথায় টুপি এঁটে রওনা দেয় ভাগ্নেদের নিয়ে। হিজল- টাবলুর ব্যাগটা হাতে নিয়ে হাঁটতে থাকে ওদের পিছু পিছু। কবুতরের বাচ্চার মতো কেমন চুপসে রয়েছে সে। চোখে-মুখে কী এক বিষণœতা।
পাকা পথের শুরুতে কলাগাছের ঝাড়। কেমন ছায়া ছায়া ঠা-া পরিবেশ। সবাই এসে দাঁড়ায় ওখানটায়। গাড়ি ওদের অনেকটা দূরে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কম্পাউন্ডে রাখা আছে। সরু রাস্তা বলে বাড়ি অবধি গাড়ি আসেনি। রিকশা আগে থেকে ডাকাই ছিল। রিকশা যখন ঝিরঝির করে সামনে এগোচ্ছিলো তখন টাবলুর মামা পেছনে মুখো হয়ে হিজলকে বলে, লেখাপড়া না শিখে হয়েছিস গরু। আর বাড়িটাকে বানিয়েছিস গোয়াল ঘর। সারা বেলা ক্ষেতে পড়ে না থেকে বাড়ির ছোটগুলোর দিকে নজর রাখিস, আবার তোর মতো দুপেয়ে গরু বানাসনে ওদের।
হিজল যখন বাড়ি ফেরে চারদিকে তখন ঘন অন্ধকার। পুরো বাড়ি যেন শ্মশান। ও এসে দাঁড়ায় উঠোনের সিঁদুরে আমগাছ তলায়। নেংটো ঘরটার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। এদিক-সেদিক পড়ে আছে ভাঙা টিনের টুকরো। এর মধ্যে অর্ধেক ভিটির ইট তুলে ফেলা হয়েছে। সেখানে কুকুর মাটিতে আঁচড় কাঁটছে নখ দিয়ে। এসব দেখে ওর চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। উঠোনের শূন্যতা ওর বুকে আছড়ে পড়ছে যেন। আর দাঁড়ায় না সে। চলে আসে ঘরে।
ওর কানে কেবলই বাজছে- হয়েছিস গরু! গরু! গরু!
ওর গা রি রি করে ওঠে, কী এক ঘৃণায়! বুক কেঁপে ওঠে কী এক আশঙ্কায়! প্রথমে কুপি নিয়ে বাইরে আসে হিজল। কিন্তু বাতাসের দাপট বেশ। কুপি জ্বালিয়ে বেশিদূর যাওয়া যাবে না। ও ফিরে এসে এবার হ্যারিকেন হাতে নিয়ে বের হয়। সেলু, মতি, সাদেক, মনু এমনি করে শরিক, আশপাশের পড়শি অনেকের বাড়ি বাড়ি যায় ও। তখন ও হাঁটছিলো না যেন লাফিয়ে লাফিয়ে পাহাড় ডিঙোচ্ছিলো। ক্ষীপ্র ওর হাঁটা। দীপ্ত ওর অবয়ব। এক এক ঘরে গিয়ে নতুন নতুন সংবাদ নিয়ে ফেরে হিজল। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য- রহিম বক্স শুধু ঘরই কেনেনি। টাবলুর বাবার পুরো ভিটিটাই কিনে নিয়েছে। প্রায় আধা বিঘে জায়গার ওপর ওদের ভিটে!
নিজেদের বাড়ি, ভিটি আর শরিকদের মধ্যে বলা নেই কওয়া নেই আচমকা বাইরের অজানা অচেনা এক লোক এসে শেকড় গেড়ে বসবে এ কী করে হয়! কেউ মেনে নিতে পারে না ব্যাপারটি।
পরদিন সকাল সকাল যথারীতি রহিম বক্সের লোকজন হাতুড়ি, শাবল, গাইতি, কুড়াল সব নিয়ে চলে আসে। ওরা যখন পাকা ভিটি ভেঙে ইট তুলে আনবে বলে হাত চালাচ্ছে তখনই বাড়ির লোকজন থেকে শুরু করে পুরো পাড়া যেন ঝাঁপিয়ে পড়লো মুহূর্তে। শাবলের ওপর বাঁশের পর বাঁশ এসে পড়ে, “আর একটা কোপও না। আর একটা ইটও খোলা যাইবো না! কাম বন্ধ। সব কাম বন্ধ। তোমরা রহিম বক্সকে গিয়া বলো, বাড়ির মানুষ কামে বাধা দিছে। কিন্তু আর কোনো দেয়াল ভাঙার চেষ্টা করবা না।” অনেকগুলো কণ্ঠ এবার চেঁচিয়ে ওঠে, “সাবধান! সাবধান!”
ওরা প্রথমে একটু গাঁইগুঁই করলেও শেষে মানুষের তোপের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
যার ঘরে যার উঠোনে, যার গোয়ালে পুরনো টিন রয়েছে কিংবা হোগলা, চাটাই, বস্তা যা আছে তাই দিয়ে মুহূর্তে ভাঙা ভিটি ঘিরে ফেলে বাড়ির লোকজন। “নাঃ আর একটা শাবলও ঢুকতে দিমু না! সাফ কথা!” অন্যরাও সমস্বরে বলে! সাফ কথা! সাফ কথা!
হিজল খেয়াল করে পুরো ঘটনার নেতৃত্ব কেমন করে যেন আনু পাগলার হাতে চলে গেছে। অত্যন্ত নীতিবান মানুষ হিশেবে, বিচক্ষণ মানুষ হিশেবে, সৎ শালিসকারী হিশেবে আনু পাগলার বেশ নাম-ডাক এ তল্লাটে। অথচ কুঁড়েঘরে থাকে। ভরা বর্ষায়ও ঘরের চালা ছাইতে পারে না শনপাট কেনার পয়সার অভাবে। একটা লুঙ্গি, গায়ে হাতাঅলা স্যান্ডো গেঞ্জি আর কাঁধে ডুরে একটা গামছা। এর বাইরে কখনও কোনো কাপড় ওঠেনি ওর গায়ে। সামর্থ্য থাকলে তো উঠবে!
ওর বিচারবোধ এতো তীক্ষè, যুক্তির কারিসমা এতো বিস্ময়কর, তার এ প্রতিভা নিয়ে কখনও কারও কাছে বিক্রি হয়নি আনু পাগলা! কখনও কেউ তাকে কিনে নেবার দুঃসাহসও দেখায়নি। যেকোনো অন্যায় প্রতিরোধে অপ্রতিরোধ্য আনু পাগলা! গোঁয়ার একগুঁয়ে যা ইচ্ছে তাকে বলতে পারো- কিন্তু নীতির বাইরে তাকে এক ইঞ্চিও টলানো যাবে না। যাবে না কিংবা যায় না বলেই ওকে মানুষ ভালোবেসে ‘পাগলা’ বলে ডাকে! আনু পাগলাকে সম্মান করে হাট-বাজারের সকলে। ওর আছে শক্তি, আদর্শ এবং নীতি। কথা খুব কম বলে। কিন্তু যা বলে মেপেজুকে বলে। আর আছে পাকানো এক বাঁশের লাঠি। সে অবাক করা এক লাঠি। বাদামি রঙ ধরেছে। গায়ে এলোপাতাড়ি পেরেক ঢোকানো। মাঝেমধ্যেই রোদে বসে লাঠির গায়ে তেল মাখে আনু। রোদ খাওয়া হলে পরম যতœ করে কোথায় যে লুকিয়ে রাখে সে লাঠি তা কেউ জানে না!
পুরনো টিনের ঘর সরিয়ে সেখানে দালান তোলার পরিকল্পনা রহিম বক্সের। চারদিকে পাঁচিল উঠবে। মাঝখানে দোতলা বাড়ি। ফাউন্ডেশন হবে চারতলার। এমনি পরিকল্পনার কথা লোকমুখে পাঁচ কান হয়ে এ বাড়ি অবধি এসে পৌঁছেছে।
একই সঙ্গে টাবলুর বাবার কাছে ফোন আসে রহিম বক্সের। “ঘর ভাঙার কাম বন্ধ। আপনার বাড়ির লোকজন লাঠিসড়কি নিয়া আমার লেবার সব বিদায় কইরা দিছে। হাত-পা ভাঙে নাই আমার সাত কপালের ভাগ্যি। ওর কণ্ঠে কান্না, বিরক্তি এবং ক্ষোভের মিশেল!
তিন দিন পর ফের টাবলু ওর মামা আতর আরও নতুন দুজন আসে শহর থেকে। তাদের একজন ঢাকার উকিল। অন্যজনের পরিচয় জানতে পারেনি এখনও। ওদের চলাফেরা, চোখের চাউনি এবং চোয়ালের ওঠানামা, কখনও চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠার মধ্যে কিছু কথা কিছু অভিব্যক্তি এবং কিছু বিক্ষিপ্ত চিত্র ফুটে ওঠে। যার অনুবাদ বলছে, “হাভাতে রাস্তার নেড়ি কুত্তাগুলোর সাহস তো কম নয়। রহিম বক্সকে ঘর করতে দেবে না। জায়গার দখল বুঝে নিতে দেবে না! কুত্তাগুলো সাপের পাঁচপা দেখেছে। মাঝা বরাবর এমন লাঠি ঝাড়বো না, আর কোনোদিন সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে না। ঘাড়ে এমন ছ্যাঁচা দেবো না, যাতে আর ওপরে তাকাতে না পারে। প্রয়োজনে জিভ টেনে খুলে ফেলবো, যাতে প্রতিবাদের ভাষা আর কোনোদিন মুখে না আসে। ওদের ঠোঁটগুলো অস্থির হাতির কান ঝাপটানোর মতো কে যেন ঝাপটে দিচ্ছে আর অস্ফুটে বলে যাচ্ছে মনের ক্ষোভের কথা! (আগামী সংখ্যায় বাকি অংশ)