alt

সাময়িকী

‘তারপরে, তারকার হাসি’

আধুনিক-উত্তর সময়ের নির্মিতি

কামরুল ইসলাম

: বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫

কবিতা শেষমেশ ভাষারই খেলা। আধার ও আধেয়কে আকীর্ণ করে এই ভাষাই গড়ে তোলে কবিতা। কবিতা কবির নিজস্ব জগতের আলো-আঁধারির খেলা যেমন, তেমনি তার নিভৃত ভূগোলের রক্তক্ষরণের ইতিহাসও বটে। কবিকে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখতে হয় জল-মাটি-শস্য-পুরাণ কিংবা ঈশ্বর ও তার প্রচ্ছন্ন জ্যামিতি। কয়েক দশক ধরে বাংলা কবিতায় এক ধরনের কাহিনী কিংবা বিবরণধর্মী কবিতারই চর্চা হয়েছে বেশি। উচ্চকণ্ঠ কিংবা স্লোগানধর্মিতাই ছিল কবিতার দেহজুড়ে। রাজনীতি, সামাজিক অনাচার, যৌনতাও এসেছে একেবারে খোলা তলোয়ার হাতে। এইসব ন্যারেটিভ অকাব্যিকতা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে আশির দশকের কিছু কবির মধ্যে এক ধরনের প্রত্যয় লক্ষ্য করা যায়। নব্বইয়ের দশকে এসে এই প্রত্যয় আরও শাণিত হয়, কবিতায় ফিরে আসে বহুমাত্রিকতা এবং চিন্তা ও দর্শনের নানামুখী গুঞ্জরণ। দেখা যায় আত্মসমীক্ষার প্রবণতা এবং নতুন ভাষা নির্মাণের জন্য কবিদের ইতিহাস ও উপকথা, প্রাচীন লোককথা লোক-ইতিহাস কিংবা বাউলতত্ত্ব, সুফিবাদসহ নানা ক্ষেত্রে পরিভ্রমণ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি থেকেও শুরু হলো প্রবল শোষণ।

যা হোক, সে সব বিষয়ে বিশুদ্ধ আলোচনায় না গিয়ে শুধু এটুকু বলা যায়, নব্বইয়ের কবিরা আধুনিক-উত্তর সময়ের কবিতা নির্মাণে এগিয়ে আসলেন। অল্পসংখ্যক কবির মধ্যে দেখা গেল নিরীক্ষার প্রবল প্রয়াস। তারা চাইলেন বাংলা কবিতায় নতুনত্ব আনতে। যে ক’জন কবির কবিতায় ভেসে উঠলো আলাদা কণ্ঠস্বর, নতুন প্রাকরণিক বৈশিষ্ট্য এবং চিন্তনের নতুন ধরন, তাদের মধ্যে কবি ওবায়েদ আকাশ অন্যতম। ওবায়েদ আকাশের কবিতা পড়লেই বোঝা যায় এটা একান্তই তার। কারণ অন্য কারও কবিতা তার মতো নয়; কিংবা তিনি অন্য কারো মতো করে লিখেন না। তিনি শুধু ব্যতিক্রম ধারার কবিই নন, তার ভাষা ও শৈলী তার নির্মিতে নিয়ে এসেছে স্বাতন্ত্র্য যা অভিনবভাবে পাঠকের ভাবনার জগতকে নাড়া দেয়। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পতন গুঞ্জনে ভাসে খরস্রোতা চাঁদ’-এ আমরা তার ব্যতিক্রমধর্মী কাব্যপ্রত্যয়ের আভাস পাই। ‘তারপরে, তারকার হাসি’ কবি ওবায়েদ আকাশের ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ। মাঝখানের আরও চারটি কাব্যগ্রন্থে তিনি নিরলসভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন আধুনিক-উত্তর সময়ের কবিতা নির্মাণে। ‘তারপরে, তারকার হাসি’ কাব্যগ্রন্থের বাম ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছে, ‘আবহমান সবুজ বাংলার মাটিগন্ধময় নিসর্গ বর্ণনার মধ্য দিয়ে তিনি ফুটিয়ে তোলেন আধুনিকোত্তর মানুষের বিচিত্র ও জটিলতম মানস সাম্রাজ্য। ভাষা বর্ণনা ও সাম্প্রতিকতম ফর্ম বিন্যাসে তার সাবলীলতা তরুণতর পাঠকের কাছেও এক ভিন্ন ঘ্রাণময় অনুভূতি।’

তার কবিতার নিবিড় পাঠে এ-কথার সত্যতা মেলে এবং তিনি কবিতাকে টেক্সট করতে চেয়েছেন সর্বোত্তম পঠন-পাঠন ও চর্চায়। তিনিই প্রকৃত শিল্পী, যিনি বার বার নিজেকে অতিক্রম করতে জানেন। এটিকে আমরা ‘creative dznamism’ বলতে পারি। এই creative dznamism একজন প্রকৃত শিল্পীর জন্য একটি অপরিহার্য বিষয় ‘তারপরে, তারকার হাসি’তে এসে আমরা দেখি, কবি ওবায়েদ আকাশ তার আগের কাব্যগ্রন্থগুলো থেকে বেরিয়ে এসে কিছুটা হলেও নতুনত্বের সন্ধান দিয়েছেন। চিন্তনের বহুমাত্রিকতা, ভাষার কারুকাজ এবং নিজস্ব শৈলীর অন্তর্জালে যে কবিতাগুলো এই গ্রন্থে আশ্রয় পেয়েছে, সেগুলো কবির নিরন্তর চর্চা ও অনুধ্যানের পরিচয় বহন করে। গ্রন্থ-শিরোনামটি তিনি নিয়েছেন ‘গন্ধ’ কবিতা থেকে। এই কবিতায় কবির শিল্পভাবনার গতানুগতিক অথচ বৈচিত্র্যে উন্মুখর ইমেজের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় : ‘ধূসর পালকের হাঁস, এই কালে/মেঘ হয়ে ওড়ে/তারপরে, তারকার হাসি.../যদি বলি গন্ধই অমোঘ ছিল/বাসি ছিল ফুল/মেঘের ওপারে কিছু ফুটে আছে তারা/গন্ধে শুধু ভেসেছে দু’কূল’ (গন্ধ : পৃ: ৩৫)

একটি কবিতা তখনই সার্থক হয়, যখন কবির অনুভূতিগুলো ভাষা কিংবা শব্দের আশ্রয়ে খাপ খেয়ে যায়। ‘মহাকালের কাব্যধ্বনির’ স্বীকৃতি পাওয়া নিয়ে কবির ভেতরে এক ধরনের সংশয়ের জন্ম হয়েছে। পৃথিবীর সব সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যেই দেখা গেছে, এই সংশয়। সংশয় যেমন কোনো বস্তু সম্পর্কে জানার দুর্নিবার আকর্ষণ সৃষ্টি করে, তেমনি মানুষের যে কোনো কর্মকা-কেও এগিয়ে নিয়ে যায় সামনের দিকে সঠিক ধারণার যোগান দিয়ে। ‘এত বিষাদ এত নিনাদ’ এই গ্রন্থের একটি উৎকৃষ্ট কবিতা। স্বরবৃত্তের ঝোঁকে কবিতাটি আমাদের এক আলাদা কাব্যপাঠের অনুভূতি যোগায় : ‘এত বিষাদ এত নিনাদ তরুণ কবির রক্তে কি তা বর্ণমালায় ভাষা পেলেই লেখা হবে অমর কাব্যগ্রন্থখানি আমরা দু’জন পরস্পরের যা যা জানি উঠে এলেই নিভৃতে তা স্বীকৃতি কি পাবে বলো মহাকালের কাব্যধ্বনির’। (পৃ. ১৬)

এই কবিতার কোথাও কবি কোনো বিরাম চিহ্ন ব্যবহার করেননি। তারপরও এই কবিতা পাঠে কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না পাঠককে।

বাংলা কবিতার তিনটি ট্র্যাডিশনাল ছন্দ যারা চর্চা করেননি, তারা ছন্দের ভাঙচুর কিংবা গদ্যে কবিতা রচনায় নৈপুণ্য দেখাতে যে ব্যর্থ হবেন, এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়। ছন্দই কবিতা নয়, শুধু কবিতার একটি শর্ত মাত্র- তথাপিও ছন্দ চর্চার প্রয়োজন রয়েছে। ওবায়েদ আকাশ ছন্দে যেমন, গদ্যেও তেমন স্বচ্ছন্দ। তার টানাগদ্যের কবিতায়ও ছন্দস্পন্দন সাবলীল। অভিজ্ঞতা ও ঐতিহ্যের মিথস্ক্রিয়া তার কবিতার সাত্তিক আশ্রয়। ঐতিহ্য ও শেকড় অনুসন্ধানী এই কবি বলতে পারেন- ‘একদিন নদীতীর ধরে যে সকল জনপদ ভেসে ভেসে ফিরে পেল যথার্থ সিন্ধুর মানে, তারা জানে আরণ্যক অন্ধকারে মরাফুল নির্জনতা নাটাইয়ের সুতোছেঁড়া আকাশে প্রতিবার ঘুড়ির ঠিকানা’ (স্যাঁতসেঁতে জীবনের মানে : পৃ-২১)

ওবায়েদ আকাশের কবিতার স্বচ্ছ আলো-আঁধারীর জগতে পাঠক সহজেই ঢুকে যেতে পারেন, তবে পা ফেলতে হয় অতি সাবধানে। তার কিছু কিছু কবিতায় এই আলো-আঁধারির জগত এতটাই রহস্যঘন যে, পাঠককে তার মর্মোদ্ধারে হোঁচট খেতে হয় বার বার। মালার্মে এই দুর্বোধ্যতাকে বলেছিলেন কবিতার ঢাল (Shield)। বুদ্ধদেব বসুও মনে করতেন Obscurity-ই উত্তীর্ণ কবিতার লক্ষণ। কখনো কখনো দুর্বোধ্যতাও এক ধরনের মুগ্ধতা- তবে সে মুগ্ধতার বিষয়টিও আপেক্ষিক। টিএস এলিয়ট বলেছিলেন, পৃথিবীর অনেক উৎকৃষ্ট কবিতা শেষ পর্যন্ত আমি বুঝে উঠতে পারিনি। এখানে বলা প্রয়োজন যে, বোঝা না-বোঝা দিয়ে ভালো কবিতাকে মূল্যায়ন করা যায় না। কবিতার এটুকুই যথেষ্ট, কবির অনুভূতি কিংবা দার্শনিক প্রত্যয় যদি পাঠকের অনুভূতিকে নাড়া দেয় কিংবা আরো খোলাসা করে বলা যেতে পারে, ভালো কবিতা বোঝার আগে তা ‘কমিউনিকেট’ করবে। তবে কখনো কখনো কবিরা অযথাই কবিতাকে জটিল করে ফেলেন- যেটিকে আমরা ‘ননসেন্স পোয়েট্রি’ বলতে পারি। উল্লেখ্য যে, দুর্বোধ্যতা আর অবোধ্যতা এক জিনিস নয়। ওবায়েদ আকাশের কিছু কিছু কবিতা কিংবা পঙ্ক্তিতে দুর্বোধ্যতা আছে, কিন্তু অবোধ্যতা নেই। কবির ব্যক্তিগত জটিল মনস্তাত্ত্বিক অনুধ্যান থেকে উঠে আসা দৃশ্য বা ইমেজ কিংবা শব্দবন্ধ সরাসরি পাঠককে কোনো বিশেষ অর্থের ইঙ্গিত করে না, বরং এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় বিনির্মিত হয়ে তা পাঠককে বহুমাত্রিক অর্থযোজনায় পথ প্রদর্শন করে। কিছু উদ্ধৃতি:

(ক) কাল বিদ্যালয় ছুটি, বাতাসে ঘুমের শর্করা

(ঘুম ফুল ও বিদ্যালয় বিষয়ক : পৃ-২০)

(খ) বর্ষণের দৈর্ঘ্যরে ভেতর আত্মঘাতী স্বপ্নগুলো ফিরে আসুক উদ্যানের ফোয়ারার রোদে

(স্যাঁতসেঁতে জীবনের মানে : পৃ-২১)

(গ) রাষ্ট্রপতির মেয়ে মুখভর্তি আলো নিয়ে পাঠশালায় যায়

(রাষ্ট্রপতির মেয়ে : পৃ-৩১)

(ঘ) শ্রেণিকক্ষে অধ্যয়নকৃত এই সর্বনাম বহুকাল হলো কান ফুটো, চোখ ফুটো করে সাপের মন্ত্র জপ করে করে দিনান্তে রিকশায় চেপে অন্ধকারে অভিসারে যায়

(সর্বনাম : পৃ-৩৬)

এরকম অনেক উদ্ধৃতি দেয়া যায় ওবায়েদ আকাশের কবিতা থেকে কিংবা কোনো কোনো পুরো কবিতার কথাই বলা যায়, যেখানে খুব সাধারণ শব্দ ব্যবহার করেও এক অসাধারণ ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করা হয়েছে, যা আপাত দুর্বোধ্য মনে হলেও communicate করে before it is understood এবং পাঠককে ভাববার অবকাশ তৈরি করে দেয়। আমি মনে করি, এটাই কবিতার মূল শক্তি এবং কবিত্বের মৌল উপার্জন। এই উপার্জন কবি ওবায়েদ আকাশের রয়েছে বললে কোনো অত্যুক্তি হয় না।

ওবায়েদ আকাশের অনেক কবিতায়ই জীবন-ঘনিষ্ঠ নস্টালজিয়া বা স্মৃতিবিধুরতার দিকগুলো লক্ষ্য করা যায়। নস্টালজিয়াও জীবনের অংশ। নস্টালজিয়া, হতাশা-নৈরাশ্য, নিঃসঙ্গতা কিংবা রোমন্টিকতা ইত্যাদি যেমন জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলা যাবে না, তেমনি কবিতায় যদি এগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে তাতে কবিতার জাত যাবে বলে মনে হয় না। কারণ, কবি বা কোনো শিল্পী তো রোবট নয় (যদিও আজকাল অনেক রোবোটিক কবির আবির্ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে)। জালাল উদ্দিন রুমীর সাথে আমরা একমত, ‘বাঁশি কাঁদে কারণ সে শেকড়ে ফিরতে চায়’। বাংলাদেশের অনেক কবিই ঢাকায় বাস করছেন জীবন-জীবিকার তাগিদে, তাদের অনেকেরই শেকড় প্রোথিত গ্রামে কিংবা কোনো মফস্বল শহরে। শেকড়ের মায়াবী টান তো আর অস্বীকার করা যায় না, ফলে তাদের কবিতায় ফিরে ফিরে আসে ফেলে আসা গ্রাম, তার জনপদ ও প্রকৃতি। মেধার রসায়নে কিংবা শব্দের যাদুমন্ত্রে ওবায়েদ আকাশের সেই সব স্মৃতিবিধুরতাও উত্তীর্ণ কবিতায় সমীকৃত হয়।

যেমন : ‘রূপনগর আমার হাত থেকে একদিন কেড়ে নিয়ে গেছে চালতার ব্যাগ। আমার প্রিয় চালতাফুল, যাকে বড় হতে দিয়ে একদিন ছ’টাকায় উঠে পড়ি এই নগরের ট্রেনে; সঙ্গে ইলিশ পোড়ার ঘ্রাণ, কাগজী লেবু, অথৈ দীর্ঘশ্বাস... বাঁশবাগান, ঘাসফুল, প্রাচীন হালটের ঢালে বাতাবিলেবুর ফুলে এমন আষাঢ়ের দিনে, একদিন মৌমাছি তুলেছিল বৃষ্টির ভাষা; অথৈ সবুজ থেকে নুয়ে পড়া স্নেহের গভীরে বসে চালতাফুল, ক্রমে তারা ফিরে পায় বহুরঙ মানুষের রূপ।’ (রূপনগর : পৃ-৯)

রাজনীতি ও সমাজ-সচেতন এই কবি সামাজিক অনাচার, রাজনৈতিক কূটকৌশল ও সাম্প্রতিক বাংলাদেশের রাজনীতিকদের ভ-ামি ও নোংরামির চিত্র এঁকেছেন আবেগঘন অথচ সংযত কাব্যিকতায়। ‘গেটলক : একটি সংবর্ধনা স্মারক’ কবিতায় আমরা এক নিদারুণ সমাজ বাস্তবতার চিত্র দেখি, যেখানে তিনি উচ্চকণ্ঠ নন কিংবা স্লোগানধর্মিতায় পর্যবসিত হয়নি কবিতার অবয়ব। কবি হিসেবে এটি যে তার এক ধরনের মুন্সিয়ানা এটা মানতেই হবে। কবিতা থেকে উদ্ধৃতি : ‘... প্রিয় সমাজপতি, পুরনো চা-পাতা, সিগারেটের দগ্ধ ফিল্টার, কফি আর ব্যবহৃত কনডমের খোসায় তড়পাচ্ছে আমাদের ঘরভর্তি প্লাস্টিকের ঝুড়ি; আজকাল যত্রতত্র ডাস্টবিন থেকেও শোনা যায় ভাগ্যাহত নবাগতের আর্তচিৎকার।... আমাদের আস্থা করুণ সমাজপতি, আমরা জল থেকে জলস্তরে, ঘুম থেকে ঘুমান্তরে অগাধ সমুদ্র থেকে ব্যাপক চরায় এসে দাঁড়িয়েছি।... আমরা হরিজন, অচ্ছ্যুৎ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, জাতকুলহীনা, লঘু,... সামান্য বিদ্যুচ্চমকে দেখুন, কেঁপে ওঠে আমাদের পাঁজরের হাড়; এক আঁজলা কেরোসিনের বরাদ্দ দিন; জ্বেলে দিন আমাদের শনবাতার ঘর, ছেঁড়া বস্ত্র, ছালাচটি- আমাদের অযতœ অভুক্ত সন্তানের খসখসে বিশুষ্ক ফাটা ত্বক।’ (গেটলক : একটি সংবর্ধনা স্মারক : পৃ-৪৫)

রাজনীতিও কবিতার একটি ক্ষেত্র। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত আমেরিকান কবি ইমামু আমিরি বরাকা তাই বলেছিলেন, অন্য সবকিছুর মত কবিতাও ‘পলিটিক্যাল’। সুতরাং রাজনীতি দেখে কিংবা সমাজবাস্তবতার বিষয় নিয়ে কবিদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। শুধু মনে রাখতে হবে, প্রকৃত কবির হাতে যে কোনো বিষয়ই কবিতা হয়ে উঠতে পারে। নেরুদাসহ অনেক কবির ক্ষেত্রেই আমরা তা লক্ষ্য করেছি। ‘নেতা’ (পৃ-১২) কবিতায় ‘তস্কর’ শব্দটি পুরনো হলেও সম্পূর্ণ নতুন ব্যঞ্জনা পেয়েছে এখানে।

‘যেন তস্করের পকেট ছিঁড়ে ঝুর ঝুর করে পড়ে যাচ্ছে সিকি আধলা সব’ পঙ্ক্তিটি উপমা ও ইজেমের এক অনবদ্য কোলাজ। তার কবিতায় কীট-পতঙ্গ-মাছ ইত্যাদির আধিক্য দেখা যায়। যেমন-

ক. আমাদের কোনো বাড়ি নেই, তাই/সারি সারি পিঁপড়ের দেখা/আজকাল মেলে না খুব

(আমাদের প্রতিবেশী পিঁপড়েদের কথা : পৃ-৪০)

খ. লিখে নাও সমুদ্রসেনানী- পৃথিবীর সকল জোনাকি আমার গর্ভধারিণী

(নির্বাসন : পৃ-৪৬)

(গ) মাছেরা জন্মেছে শুধু চিলের ঔরসে বেড়ে।...

(ঐ)

(ঘ) ... তুমি ঝরে যাচ্ছো/এই মরাকটালের দেশে ছাইরঙ মৃত প্রজাপতি

(তোমার অস্তিত্ব : পৃ-৩৯)

(ঙ) আমি তার প্রস্থান পথের দিকে দুটো কাক/কিংবা শেয়ালের জ্বলজ্বলে চোখ বসিয়ে রেখে ভাবি,...

(দীঘি ও চাঁদ : পৃ-২৬)

এইভাবে অনেক কীট-পতঙ্গসহ মাইনর জিনিসপত্র কিংবা নিম্নবর্গীয় মানুষের কথাও এসেছে ওবায়েদ আকাশের কবিতায়, যা আধুনিক-উত্তর সময়ের কাব্যচর্চার একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা।

ওবায়েদ আকাশের ‘তারপরে, তারকার হাসি’ কাব্যগ্রন্থের একটি চমৎকার কবিতা ‘অপেরা’। এই কবিতাটি উৎরে গেছে ‘সেদিন ঘোড়দৌড়, কূলে কূলে জাঁকালো অপেরা’ এই শেষ পঙ্ক্তিটির জন্য। এইভাবে অনেক অনবদ্য, কালজয়ী পঙ্ক্তির সন্ধান পাওয়া যাবে কবি ওবায়েদ আকাশের আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে। তার এই কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতায়ই আমরা দেখবো যে, এক নান্দনিক ধোঁয়াশার মধ্যে পাঠককে ছেড়ে দিয়ে কবি মজা দেখছেন। কবি ছাড়া আর কে জানেন, ‘...যারা সঙ্গীত ভালোবাসে, এসকল অজ্ঞাত/পরবাসী জলে তাহাদের বড়শিগুলো নুয়ে পড়ে স্বাস্থ্যবান মাছে। (নির্বাসন : পৃ-৪৬) এই কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতায় আমরা দেখি জীবন ও জগতের গূঢ়সত্যসমূহের ইঙ্গিত।

জীবনানন্দ দাশের ‘কবিতার কথা’য় কবিতার নানাদিক নিয়ে আলোচনা রয়েছে। আধুনিক-উত্তর সময়ের কবিতা নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আধুনিকদের কাল কেটে গেলে আরেক রকম স্বতন্ত্রতায় দাঁড়াবে কবিতা; সে-কবিতাকে গ্রহণ করবার জন্য অনুভূতি ও আলোচনা ঠিক আজকের ভাবনা বিচারের কোণ থেকে কাজ করতে পারবে না।’ (কবিতার কথা : পৃ-৯৮)

জীবনের পথগুলো বিসর্পিল। সেখানে ভেঙে যায় প্রথাগত ছন্দ। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট কিংবা রাজনৈতিক পরিহাসের মধ্যে এই যে পথচলা- তাও কিন্তু কবিতার বাইরের কোনো ঘটনা নয়। কবিতা সর্বভুক। সবকিছুকে আত্মস্থ করে তা হয়ে উঠতে পারে। ফিকশন কিংবা মেটাফিকশনও আজ ঢুকে পড়েছে কবিতার নিজস্ব বলয়ে।

নব্বইয়ের দশকের কিছুসংখ্যক কবির কবিতায় এসব বহুমাত্রিক, বহুস্তরিক বিন্যাসের সমারোহ চোখে পড়ছে। কবি ওবায়েদ আকাশ সেই দলেরই এক অনুরাগী যাত্রিক, যারা বাংলা কবিতার পালাবদলে নিরন্তর নিরীক্ষায় অন্বিষ্ট। ‘তারপরে, তারকার হাসি’তে সেইসব নিরীক্ষার ছাপ রয়েছে। এই কবি কবিতা চর্চার অলি-গলি পেরিয়ে উঠে এসেছেন মূল সড়কে- আমরা এখন দেখতে চাই তার অভিগমন, বেগ ও গতি কিংবা চলার প্রকৃতি।

তারপরে, তারকার হাসি ॥ ওবায়েদ আকাশ ॥ প্রকাশক : আগামী প্রকাশনী, ঢাকা ॥ প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০০৭ ॥ প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ ॥ পৃষ্ঠা : ৪৮ ॥ মূল্য : ৬০ টাকা।

ছবি

ভাঙা ছাদ

ছবি

চন্দ্রাবতী : মধ্যযুগের প্রথম মহিলা কবি

ছবি

বংশধারা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

আবুবকর সিদ্দিকের ছোট গল্পে রাজনীতি

ছবি

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসের তুলনামূলক বিচার

ছবি

সমকালীন কাব্যভাষায় কবি শহীদ কাদরী

ছবি

চরফুলের কন্যা

ছবি

নজরুলের গল্প ও উপন্যাস

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রলোভন এবং ধৈর্যের গল্প

ছবি

প্রসঙ্গ মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস

ছবি

প্রেম, অস্তিত্ববাদ ও বেদনার দোলাচল

ছবি

‘কবিতার যুবরাজ’ কবি আবুল হাসান

ছবি

মানুষ, প্রকৃতি ও সুলতানের স্বকীয় অভিযাত্রা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

শালুক-এর শঙ্খ ঘোষ সংখ্যা বাংলাদেশের সশ্রদ্ধ মূল্যায়ন

ছবি

‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’: কুহক ও বিভ্রমের গল্প

ছবি

কল্পগল্প

ছবি

আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা’

ছবি

প্রসঙ্গ মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস

ছবি

আনন্দদায়ক ও অপ্রত্যাশিত নোবেল পুরস্কার

ছবি

জীবনবোধ ও শিল্পকর্ম

ছবি

নজরুলের গল্প ও উপন্যাস

ছবি

কৃষ্ণাঙ্গ দাস থেকে হয়ে উঠেছিলেন খ্যাতিমান কবি

শ্রাবণ বর্ষণে

ছবি

শতবর্ষ পরে ‘মিসেস ডালোওয়ে’

ছবি

স্কাল্পচারের জগতটা আস্তে আস্তে ব্যাপকতা পাচ্ছে

ছবি

চব্বিশের অভ্যুত্থান নিয়ে গ্রন্থ

ছবি

ভিন্নচোখ: নুতন কবিতা সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকা: মৃত্যুর রূপক এবং আন্দালুসিয়ার লোকজ বিশ্বাস

ছবি

কবিতার শিল্পনিষ্ঠ রূপকার ফারুক মাহমুদ

ছবি

কাফকাকে পড়া কাফকাকে পড়ানো

ছবি

কবি নওশাদ নূরী

ছবি

আঁধার পেরিয়ে আলোর উদ্ভাষণ

tab

সাময়িকী

‘তারপরে, তারকার হাসি’

আধুনিক-উত্তর সময়ের নির্মিতি

কামরুল ইসলাম

বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫

কবিতা শেষমেশ ভাষারই খেলা। আধার ও আধেয়কে আকীর্ণ করে এই ভাষাই গড়ে তোলে কবিতা। কবিতা কবির নিজস্ব জগতের আলো-আঁধারির খেলা যেমন, তেমনি তার নিভৃত ভূগোলের রক্তক্ষরণের ইতিহাসও বটে। কবিকে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখতে হয় জল-মাটি-শস্য-পুরাণ কিংবা ঈশ্বর ও তার প্রচ্ছন্ন জ্যামিতি। কয়েক দশক ধরে বাংলা কবিতায় এক ধরনের কাহিনী কিংবা বিবরণধর্মী কবিতারই চর্চা হয়েছে বেশি। উচ্চকণ্ঠ কিংবা স্লোগানধর্মিতাই ছিল কবিতার দেহজুড়ে। রাজনীতি, সামাজিক অনাচার, যৌনতাও এসেছে একেবারে খোলা তলোয়ার হাতে। এইসব ন্যারেটিভ অকাব্যিকতা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে আশির দশকের কিছু কবির মধ্যে এক ধরনের প্রত্যয় লক্ষ্য করা যায়। নব্বইয়ের দশকে এসে এই প্রত্যয় আরও শাণিত হয়, কবিতায় ফিরে আসে বহুমাত্রিকতা এবং চিন্তা ও দর্শনের নানামুখী গুঞ্জরণ। দেখা যায় আত্মসমীক্ষার প্রবণতা এবং নতুন ভাষা নির্মাণের জন্য কবিদের ইতিহাস ও উপকথা, প্রাচীন লোককথা লোক-ইতিহাস কিংবা বাউলতত্ত্ব, সুফিবাদসহ নানা ক্ষেত্রে পরিভ্রমণ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি থেকেও শুরু হলো প্রবল শোষণ।

যা হোক, সে সব বিষয়ে বিশুদ্ধ আলোচনায় না গিয়ে শুধু এটুকু বলা যায়, নব্বইয়ের কবিরা আধুনিক-উত্তর সময়ের কবিতা নির্মাণে এগিয়ে আসলেন। অল্পসংখ্যক কবির মধ্যে দেখা গেল নিরীক্ষার প্রবল প্রয়াস। তারা চাইলেন বাংলা কবিতায় নতুনত্ব আনতে। যে ক’জন কবির কবিতায় ভেসে উঠলো আলাদা কণ্ঠস্বর, নতুন প্রাকরণিক বৈশিষ্ট্য এবং চিন্তনের নতুন ধরন, তাদের মধ্যে কবি ওবায়েদ আকাশ অন্যতম। ওবায়েদ আকাশের কবিতা পড়লেই বোঝা যায় এটা একান্তই তার। কারণ অন্য কারও কবিতা তার মতো নয়; কিংবা তিনি অন্য কারো মতো করে লিখেন না। তিনি শুধু ব্যতিক্রম ধারার কবিই নন, তার ভাষা ও শৈলী তার নির্মিতে নিয়ে এসেছে স্বাতন্ত্র্য যা অভিনবভাবে পাঠকের ভাবনার জগতকে নাড়া দেয়। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পতন গুঞ্জনে ভাসে খরস্রোতা চাঁদ’-এ আমরা তার ব্যতিক্রমধর্মী কাব্যপ্রত্যয়ের আভাস পাই। ‘তারপরে, তারকার হাসি’ কবি ওবায়েদ আকাশের ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ। মাঝখানের আরও চারটি কাব্যগ্রন্থে তিনি নিরলসভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন আধুনিক-উত্তর সময়ের কবিতা নির্মাণে। ‘তারপরে, তারকার হাসি’ কাব্যগ্রন্থের বাম ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছে, ‘আবহমান সবুজ বাংলার মাটিগন্ধময় নিসর্গ বর্ণনার মধ্য দিয়ে তিনি ফুটিয়ে তোলেন আধুনিকোত্তর মানুষের বিচিত্র ও জটিলতম মানস সাম্রাজ্য। ভাষা বর্ণনা ও সাম্প্রতিকতম ফর্ম বিন্যাসে তার সাবলীলতা তরুণতর পাঠকের কাছেও এক ভিন্ন ঘ্রাণময় অনুভূতি।’

তার কবিতার নিবিড় পাঠে এ-কথার সত্যতা মেলে এবং তিনি কবিতাকে টেক্সট করতে চেয়েছেন সর্বোত্তম পঠন-পাঠন ও চর্চায়। তিনিই প্রকৃত শিল্পী, যিনি বার বার নিজেকে অতিক্রম করতে জানেন। এটিকে আমরা ‘creative dznamism’ বলতে পারি। এই creative dznamism একজন প্রকৃত শিল্পীর জন্য একটি অপরিহার্য বিষয় ‘তারপরে, তারকার হাসি’তে এসে আমরা দেখি, কবি ওবায়েদ আকাশ তার আগের কাব্যগ্রন্থগুলো থেকে বেরিয়ে এসে কিছুটা হলেও নতুনত্বের সন্ধান দিয়েছেন। চিন্তনের বহুমাত্রিকতা, ভাষার কারুকাজ এবং নিজস্ব শৈলীর অন্তর্জালে যে কবিতাগুলো এই গ্রন্থে আশ্রয় পেয়েছে, সেগুলো কবির নিরন্তর চর্চা ও অনুধ্যানের পরিচয় বহন করে। গ্রন্থ-শিরোনামটি তিনি নিয়েছেন ‘গন্ধ’ কবিতা থেকে। এই কবিতায় কবির শিল্পভাবনার গতানুগতিক অথচ বৈচিত্র্যে উন্মুখর ইমেজের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় : ‘ধূসর পালকের হাঁস, এই কালে/মেঘ হয়ে ওড়ে/তারপরে, তারকার হাসি.../যদি বলি গন্ধই অমোঘ ছিল/বাসি ছিল ফুল/মেঘের ওপারে কিছু ফুটে আছে তারা/গন্ধে শুধু ভেসেছে দু’কূল’ (গন্ধ : পৃ: ৩৫)

একটি কবিতা তখনই সার্থক হয়, যখন কবির অনুভূতিগুলো ভাষা কিংবা শব্দের আশ্রয়ে খাপ খেয়ে যায়। ‘মহাকালের কাব্যধ্বনির’ স্বীকৃতি পাওয়া নিয়ে কবির ভেতরে এক ধরনের সংশয়ের জন্ম হয়েছে। পৃথিবীর সব সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যেই দেখা গেছে, এই সংশয়। সংশয় যেমন কোনো বস্তু সম্পর্কে জানার দুর্নিবার আকর্ষণ সৃষ্টি করে, তেমনি মানুষের যে কোনো কর্মকা-কেও এগিয়ে নিয়ে যায় সামনের দিকে সঠিক ধারণার যোগান দিয়ে। ‘এত বিষাদ এত নিনাদ’ এই গ্রন্থের একটি উৎকৃষ্ট কবিতা। স্বরবৃত্তের ঝোঁকে কবিতাটি আমাদের এক আলাদা কাব্যপাঠের অনুভূতি যোগায় : ‘এত বিষাদ এত নিনাদ তরুণ কবির রক্তে কি তা বর্ণমালায় ভাষা পেলেই লেখা হবে অমর কাব্যগ্রন্থখানি আমরা দু’জন পরস্পরের যা যা জানি উঠে এলেই নিভৃতে তা স্বীকৃতি কি পাবে বলো মহাকালের কাব্যধ্বনির’। (পৃ. ১৬)

এই কবিতার কোথাও কবি কোনো বিরাম চিহ্ন ব্যবহার করেননি। তারপরও এই কবিতা পাঠে কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না পাঠককে।

বাংলা কবিতার তিনটি ট্র্যাডিশনাল ছন্দ যারা চর্চা করেননি, তারা ছন্দের ভাঙচুর কিংবা গদ্যে কবিতা রচনায় নৈপুণ্য দেখাতে যে ব্যর্থ হবেন, এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়। ছন্দই কবিতা নয়, শুধু কবিতার একটি শর্ত মাত্র- তথাপিও ছন্দ চর্চার প্রয়োজন রয়েছে। ওবায়েদ আকাশ ছন্দে যেমন, গদ্যেও তেমন স্বচ্ছন্দ। তার টানাগদ্যের কবিতায়ও ছন্দস্পন্দন সাবলীল। অভিজ্ঞতা ও ঐতিহ্যের মিথস্ক্রিয়া তার কবিতার সাত্তিক আশ্রয়। ঐতিহ্য ও শেকড় অনুসন্ধানী এই কবি বলতে পারেন- ‘একদিন নদীতীর ধরে যে সকল জনপদ ভেসে ভেসে ফিরে পেল যথার্থ সিন্ধুর মানে, তারা জানে আরণ্যক অন্ধকারে মরাফুল নির্জনতা নাটাইয়ের সুতোছেঁড়া আকাশে প্রতিবার ঘুড়ির ঠিকানা’ (স্যাঁতসেঁতে জীবনের মানে : পৃ-২১)

ওবায়েদ আকাশের কবিতার স্বচ্ছ আলো-আঁধারীর জগতে পাঠক সহজেই ঢুকে যেতে পারেন, তবে পা ফেলতে হয় অতি সাবধানে। তার কিছু কিছু কবিতায় এই আলো-আঁধারির জগত এতটাই রহস্যঘন যে, পাঠককে তার মর্মোদ্ধারে হোঁচট খেতে হয় বার বার। মালার্মে এই দুর্বোধ্যতাকে বলেছিলেন কবিতার ঢাল (Shield)। বুদ্ধদেব বসুও মনে করতেন Obscurity-ই উত্তীর্ণ কবিতার লক্ষণ। কখনো কখনো দুর্বোধ্যতাও এক ধরনের মুগ্ধতা- তবে সে মুগ্ধতার বিষয়টিও আপেক্ষিক। টিএস এলিয়ট বলেছিলেন, পৃথিবীর অনেক উৎকৃষ্ট কবিতা শেষ পর্যন্ত আমি বুঝে উঠতে পারিনি। এখানে বলা প্রয়োজন যে, বোঝা না-বোঝা দিয়ে ভালো কবিতাকে মূল্যায়ন করা যায় না। কবিতার এটুকুই যথেষ্ট, কবির অনুভূতি কিংবা দার্শনিক প্রত্যয় যদি পাঠকের অনুভূতিকে নাড়া দেয় কিংবা আরো খোলাসা করে বলা যেতে পারে, ভালো কবিতা বোঝার আগে তা ‘কমিউনিকেট’ করবে। তবে কখনো কখনো কবিরা অযথাই কবিতাকে জটিল করে ফেলেন- যেটিকে আমরা ‘ননসেন্স পোয়েট্রি’ বলতে পারি। উল্লেখ্য যে, দুর্বোধ্যতা আর অবোধ্যতা এক জিনিস নয়। ওবায়েদ আকাশের কিছু কিছু কবিতা কিংবা পঙ্ক্তিতে দুর্বোধ্যতা আছে, কিন্তু অবোধ্যতা নেই। কবির ব্যক্তিগত জটিল মনস্তাত্ত্বিক অনুধ্যান থেকে উঠে আসা দৃশ্য বা ইমেজ কিংবা শব্দবন্ধ সরাসরি পাঠককে কোনো বিশেষ অর্থের ইঙ্গিত করে না, বরং এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় বিনির্মিত হয়ে তা পাঠককে বহুমাত্রিক অর্থযোজনায় পথ প্রদর্শন করে। কিছু উদ্ধৃতি:

(ক) কাল বিদ্যালয় ছুটি, বাতাসে ঘুমের শর্করা

(ঘুম ফুল ও বিদ্যালয় বিষয়ক : পৃ-২০)

(খ) বর্ষণের দৈর্ঘ্যরে ভেতর আত্মঘাতী স্বপ্নগুলো ফিরে আসুক উদ্যানের ফোয়ারার রোদে

(স্যাঁতসেঁতে জীবনের মানে : পৃ-২১)

(গ) রাষ্ট্রপতির মেয়ে মুখভর্তি আলো নিয়ে পাঠশালায় যায়

(রাষ্ট্রপতির মেয়ে : পৃ-৩১)

(ঘ) শ্রেণিকক্ষে অধ্যয়নকৃত এই সর্বনাম বহুকাল হলো কান ফুটো, চোখ ফুটো করে সাপের মন্ত্র জপ করে করে দিনান্তে রিকশায় চেপে অন্ধকারে অভিসারে যায়

(সর্বনাম : পৃ-৩৬)

এরকম অনেক উদ্ধৃতি দেয়া যায় ওবায়েদ আকাশের কবিতা থেকে কিংবা কোনো কোনো পুরো কবিতার কথাই বলা যায়, যেখানে খুব সাধারণ শব্দ ব্যবহার করেও এক অসাধারণ ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করা হয়েছে, যা আপাত দুর্বোধ্য মনে হলেও communicate করে before it is understood এবং পাঠককে ভাববার অবকাশ তৈরি করে দেয়। আমি মনে করি, এটাই কবিতার মূল শক্তি এবং কবিত্বের মৌল উপার্জন। এই উপার্জন কবি ওবায়েদ আকাশের রয়েছে বললে কোনো অত্যুক্তি হয় না।

ওবায়েদ আকাশের অনেক কবিতায়ই জীবন-ঘনিষ্ঠ নস্টালজিয়া বা স্মৃতিবিধুরতার দিকগুলো লক্ষ্য করা যায়। নস্টালজিয়াও জীবনের অংশ। নস্টালজিয়া, হতাশা-নৈরাশ্য, নিঃসঙ্গতা কিংবা রোমন্টিকতা ইত্যাদি যেমন জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলা যাবে না, তেমনি কবিতায় যদি এগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে তাতে কবিতার জাত যাবে বলে মনে হয় না। কারণ, কবি বা কোনো শিল্পী তো রোবট নয় (যদিও আজকাল অনেক রোবোটিক কবির আবির্ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে)। জালাল উদ্দিন রুমীর সাথে আমরা একমত, ‘বাঁশি কাঁদে কারণ সে শেকড়ে ফিরতে চায়’। বাংলাদেশের অনেক কবিই ঢাকায় বাস করছেন জীবন-জীবিকার তাগিদে, তাদের অনেকেরই শেকড় প্রোথিত গ্রামে কিংবা কোনো মফস্বল শহরে। শেকড়ের মায়াবী টান তো আর অস্বীকার করা যায় না, ফলে তাদের কবিতায় ফিরে ফিরে আসে ফেলে আসা গ্রাম, তার জনপদ ও প্রকৃতি। মেধার রসায়নে কিংবা শব্দের যাদুমন্ত্রে ওবায়েদ আকাশের সেই সব স্মৃতিবিধুরতাও উত্তীর্ণ কবিতায় সমীকৃত হয়।

যেমন : ‘রূপনগর আমার হাত থেকে একদিন কেড়ে নিয়ে গেছে চালতার ব্যাগ। আমার প্রিয় চালতাফুল, যাকে বড় হতে দিয়ে একদিন ছ’টাকায় উঠে পড়ি এই নগরের ট্রেনে; সঙ্গে ইলিশ পোড়ার ঘ্রাণ, কাগজী লেবু, অথৈ দীর্ঘশ্বাস... বাঁশবাগান, ঘাসফুল, প্রাচীন হালটের ঢালে বাতাবিলেবুর ফুলে এমন আষাঢ়ের দিনে, একদিন মৌমাছি তুলেছিল বৃষ্টির ভাষা; অথৈ সবুজ থেকে নুয়ে পড়া স্নেহের গভীরে বসে চালতাফুল, ক্রমে তারা ফিরে পায় বহুরঙ মানুষের রূপ।’ (রূপনগর : পৃ-৯)

রাজনীতি ও সমাজ-সচেতন এই কবি সামাজিক অনাচার, রাজনৈতিক কূটকৌশল ও সাম্প্রতিক বাংলাদেশের রাজনীতিকদের ভ-ামি ও নোংরামির চিত্র এঁকেছেন আবেগঘন অথচ সংযত কাব্যিকতায়। ‘গেটলক : একটি সংবর্ধনা স্মারক’ কবিতায় আমরা এক নিদারুণ সমাজ বাস্তবতার চিত্র দেখি, যেখানে তিনি উচ্চকণ্ঠ নন কিংবা স্লোগানধর্মিতায় পর্যবসিত হয়নি কবিতার অবয়ব। কবি হিসেবে এটি যে তার এক ধরনের মুন্সিয়ানা এটা মানতেই হবে। কবিতা থেকে উদ্ধৃতি : ‘... প্রিয় সমাজপতি, পুরনো চা-পাতা, সিগারেটের দগ্ধ ফিল্টার, কফি আর ব্যবহৃত কনডমের খোসায় তড়পাচ্ছে আমাদের ঘরভর্তি প্লাস্টিকের ঝুড়ি; আজকাল যত্রতত্র ডাস্টবিন থেকেও শোনা যায় ভাগ্যাহত নবাগতের আর্তচিৎকার।... আমাদের আস্থা করুণ সমাজপতি, আমরা জল থেকে জলস্তরে, ঘুম থেকে ঘুমান্তরে অগাধ সমুদ্র থেকে ব্যাপক চরায় এসে দাঁড়িয়েছি।... আমরা হরিজন, অচ্ছ্যুৎ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, জাতকুলহীনা, লঘু,... সামান্য বিদ্যুচ্চমকে দেখুন, কেঁপে ওঠে আমাদের পাঁজরের হাড়; এক আঁজলা কেরোসিনের বরাদ্দ দিন; জ্বেলে দিন আমাদের শনবাতার ঘর, ছেঁড়া বস্ত্র, ছালাচটি- আমাদের অযতœ অভুক্ত সন্তানের খসখসে বিশুষ্ক ফাটা ত্বক।’ (গেটলক : একটি সংবর্ধনা স্মারক : পৃ-৪৫)

রাজনীতিও কবিতার একটি ক্ষেত্র। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত আমেরিকান কবি ইমামু আমিরি বরাকা তাই বলেছিলেন, অন্য সবকিছুর মত কবিতাও ‘পলিটিক্যাল’। সুতরাং রাজনীতি দেখে কিংবা সমাজবাস্তবতার বিষয় নিয়ে কবিদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। শুধু মনে রাখতে হবে, প্রকৃত কবির হাতে যে কোনো বিষয়ই কবিতা হয়ে উঠতে পারে। নেরুদাসহ অনেক কবির ক্ষেত্রেই আমরা তা লক্ষ্য করেছি। ‘নেতা’ (পৃ-১২) কবিতায় ‘তস্কর’ শব্দটি পুরনো হলেও সম্পূর্ণ নতুন ব্যঞ্জনা পেয়েছে এখানে।

‘যেন তস্করের পকেট ছিঁড়ে ঝুর ঝুর করে পড়ে যাচ্ছে সিকি আধলা সব’ পঙ্ক্তিটি উপমা ও ইজেমের এক অনবদ্য কোলাজ। তার কবিতায় কীট-পতঙ্গ-মাছ ইত্যাদির আধিক্য দেখা যায়। যেমন-

ক. আমাদের কোনো বাড়ি নেই, তাই/সারি সারি পিঁপড়ের দেখা/আজকাল মেলে না খুব

(আমাদের প্রতিবেশী পিঁপড়েদের কথা : পৃ-৪০)

খ. লিখে নাও সমুদ্রসেনানী- পৃথিবীর সকল জোনাকি আমার গর্ভধারিণী

(নির্বাসন : পৃ-৪৬)

(গ) মাছেরা জন্মেছে শুধু চিলের ঔরসে বেড়ে।...

(ঐ)

(ঘ) ... তুমি ঝরে যাচ্ছো/এই মরাকটালের দেশে ছাইরঙ মৃত প্রজাপতি

(তোমার অস্তিত্ব : পৃ-৩৯)

(ঙ) আমি তার প্রস্থান পথের দিকে দুটো কাক/কিংবা শেয়ালের জ্বলজ্বলে চোখ বসিয়ে রেখে ভাবি,...

(দীঘি ও চাঁদ : পৃ-২৬)

এইভাবে অনেক কীট-পতঙ্গসহ মাইনর জিনিসপত্র কিংবা নিম্নবর্গীয় মানুষের কথাও এসেছে ওবায়েদ আকাশের কবিতায়, যা আধুনিক-উত্তর সময়ের কাব্যচর্চার একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা।

ওবায়েদ আকাশের ‘তারপরে, তারকার হাসি’ কাব্যগ্রন্থের একটি চমৎকার কবিতা ‘অপেরা’। এই কবিতাটি উৎরে গেছে ‘সেদিন ঘোড়দৌড়, কূলে কূলে জাঁকালো অপেরা’ এই শেষ পঙ্ক্তিটির জন্য। এইভাবে অনেক অনবদ্য, কালজয়ী পঙ্ক্তির সন্ধান পাওয়া যাবে কবি ওবায়েদ আকাশের আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে। তার এই কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতায়ই আমরা দেখবো যে, এক নান্দনিক ধোঁয়াশার মধ্যে পাঠককে ছেড়ে দিয়ে কবি মজা দেখছেন। কবি ছাড়া আর কে জানেন, ‘...যারা সঙ্গীত ভালোবাসে, এসকল অজ্ঞাত/পরবাসী জলে তাহাদের বড়শিগুলো নুয়ে পড়ে স্বাস্থ্যবান মাছে। (নির্বাসন : পৃ-৪৬) এই কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতায় আমরা দেখি জীবন ও জগতের গূঢ়সত্যসমূহের ইঙ্গিত।

জীবনানন্দ দাশের ‘কবিতার কথা’য় কবিতার নানাদিক নিয়ে আলোচনা রয়েছে। আধুনিক-উত্তর সময়ের কবিতা নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আধুনিকদের কাল কেটে গেলে আরেক রকম স্বতন্ত্রতায় দাঁড়াবে কবিতা; সে-কবিতাকে গ্রহণ করবার জন্য অনুভূতি ও আলোচনা ঠিক আজকের ভাবনা বিচারের কোণ থেকে কাজ করতে পারবে না।’ (কবিতার কথা : পৃ-৯৮)

জীবনের পথগুলো বিসর্পিল। সেখানে ভেঙে যায় প্রথাগত ছন্দ। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট কিংবা রাজনৈতিক পরিহাসের মধ্যে এই যে পথচলা- তাও কিন্তু কবিতার বাইরের কোনো ঘটনা নয়। কবিতা সর্বভুক। সবকিছুকে আত্মস্থ করে তা হয়ে উঠতে পারে। ফিকশন কিংবা মেটাফিকশনও আজ ঢুকে পড়েছে কবিতার নিজস্ব বলয়ে।

নব্বইয়ের দশকের কিছুসংখ্যক কবির কবিতায় এসব বহুমাত্রিক, বহুস্তরিক বিন্যাসের সমারোহ চোখে পড়ছে। কবি ওবায়েদ আকাশ সেই দলেরই এক অনুরাগী যাত্রিক, যারা বাংলা কবিতার পালাবদলে নিরন্তর নিরীক্ষায় অন্বিষ্ট। ‘তারপরে, তারকার হাসি’তে সেইসব নিরীক্ষার ছাপ রয়েছে। এই কবি কবিতা চর্চার অলি-গলি পেরিয়ে উঠে এসেছেন মূল সড়কে- আমরা এখন দেখতে চাই তার অভিগমন, বেগ ও গতি কিংবা চলার প্রকৃতি।

তারপরে, তারকার হাসি ॥ ওবায়েদ আকাশ ॥ প্রকাশক : আগামী প্রকাশনী, ঢাকা ॥ প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০০৭ ॥ প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ ॥ পৃষ্ঠা : ৪৮ ॥ মূল্য : ৬০ টাকা।

back to top