alt

সাময়িকী

ভাঙা ছাদ

গোপাল দাশ

: বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫

ঢাকায় গত কিছুদিন যাবত ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে রাস্তাঘাটগুলো কাদাপানি আর ধুলাবালি মিশে একাকার হয়ে যায়। ঢাকার চিরচেনা বিষয়- বর্ষাকালে সকল পরিসেবা দপ্তরের রাস্তা কাটাকাটির দৃশ্য। মোদ্দা কথা হলো ঢাকায় থাকবেন আর প্যাককাদা পাড়াবেন না তাই কি হয়? এসব ভেবে ভেবে সায়রা খুবই বিরক্ত হয়। আবার হঠাৎ বলাকওয়া নাই বিদ্যুৎ চলে যায়। তারপর উপরে সম্প্রতি ট্রাফিক পুলিশের রোড ডাইভারসন নিয়ে গবেষণা চরম পর্যায়ে, যখন তখন ইউটার্ন নিয়ে বাড়াবাড়ি বা বন্ধ করে দেয়। তাবে সায়রা ভাবে পুলিশ হয়তো ট্রাফিক জ্যাম কমানোর জন্য করেছে।

সায়রা যখন মনিপুরী পাড়ার বাড়ি থেকে বের হয়, তখন আকাশে বৃষ্টি ছিলনা কিন্তু আকাশে কালো কালো মেঘ ছিল। অনেক রাত হয়ে গেছে। এর মধ্যে শ্রাবণের বর্ষণ শুরু হলো, পেছন থেকে বৃষ্টির ঝাপটা এসে সায়রার কাঁধে লেগে হাঁটু পর্যন্ত গড়িয়ে পড়েছে। ফোনে চার্জ নেই বললেই চলে, ৫% দেখাচ্ছে। এই অবস্থায় গুগল ম্যাপ কাজ করছে না। আবার রাস্তায় বিদ্যুৎ নাই। সে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় পুরান ঢাকায় চলে এসেছে। এই এলাকায় বেশি বৃষ্টি হলে বেশি রাত অবধি আর রিকশাও চলাচল না বন্ধ হয়ে যায়, যেন শহরে কপাট পড়ে।

সায়রা হাঁটছে আর হাঁটছে, পুরান ঢাকার অলিগলি সে খুব বেশি চিনে না। আরো খানিকটা হাঁটার পর সে দেখতে পেল একটা বইয়ের দোকনের সাইনবোর্ড লেখা-বি, কে, দাস লেন। বইয়ের দোকান হতে সামনে বাঁ দিকে মোড় নিতেই সে একটি লোহার গেট দেখতে পায়। লোকজন মনে হয় আগেভাগে বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। আর হবেই না কেন, এখন রাত বাজে একটা। সায়রা জিন্সের প্যান্ট আর টপস পরেছে, গলায় চিকুন মাফলার জাতীয় তবে সেটা ওড়না নয়। আর রাত-বিরাতে সায়রা’র হাঁটাচলা করতে তেমন অসুবিধা হয় না। রাস্তার বখাটে ছেলেরা তাকে একটু সমীহ-ই করে। লোহার গেটটার দক্ষিণ পাশে বড় একটি হলুদ কালো রঙের কুকুর শুয়ে আছে, জানালার উপরে কার্নিশ থাকায় বৃষ্টির জল না পড়ায় তেমন সমস্যা হচ্ছে না। লোহার গেটটা নিচু লালচে রঙের, কালচে দাগ পড়া। একটুখানি ঠেলে দেখল, খোলা। সে একটু অবাক হলো এত রাত্রেও খোলা!

আবার বৃষ্টির ঝাপটার তাড়া খেয়ে সে পা রাখল ভেতরে। দুইতলা বাড়ি। পুরনো ধাঁচের লোহার কারুকাজ করা ঝুল বারান্দা, ভাঙা করিডোর, দেয়ালে ধুলো জমে ছাঁচ ধরেছে। সিঁড়ির কোণে ছোট একটা কাঠের কুলি বাক্স পড়া রয়েছে, কতগুলো ছেঁড়া কাপড়ের পাশে। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার, কিন্তু বাইরে থেকে আসা রাস্তার আলো একটু একটু করে দেয়ালে পড়ছে। সায়রা তার ভিজে মাফলার সামলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল- পা ফেলতেই কেঁপে উঠল কাঠের সিঁড়ির ধাপ। একবার চেয়ে দেখল চারপাশে কেউ নেই। ঘরের ভিতর কোনো শব্দ নেই, তবে বাইরে থেকে শুধু বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে আর ঘরে পুরনো কাঠের শুকিয়ে যাওয়া গন্ধ। দ্বিতীয় তলায় পৌঁছে দরজার ফাঁক গলে ভিতরে তাকাতেই হঠাৎ সে ভয় পেয়ে গেল। আলো নেই কিন্তু একটা ছায়া নড়ে উঠল ভেতরে।

কেউ আছেন? তার কণ্ঠে ভয়ে জড়ানো মতো দ্বিধা ছিল।

একটা কাশির শব্দ এল ভেতর থেকে। ধীরে নিঃশ্বাস ফেলা কণ্ঠে, বয়েস হলে যা হয়। তারপর সেই কণ্ঠ বলল-

তুমি তো অনেক দেরিতে এলে, রাত এখন একটা।

সায়রা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। ঠিক জানল না এটা উত্তর না অভিযোগ। আর অন্ধকারে মহিলা কীভাবে ঘড়ি দেখছে! আর আজতো তার এখানে আসার কথা না।

আমি বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্যই খোলা পেয়ে ঢুকে পড়েছি, বৃষ্টি থামলেই আমি চলে যাব, বলল সে।

অন্ধকার থেকে বলল, বৃষ্টি তো আর আজ থামবে না। মেয়েমানুষ এত রাতে কোথায় যাবে?

এবার কণ্ঠটা যেন ধোঁয়ার মতো গড়িয়ে এলো। তাতে আতিথ্য ছিল, আবার রহস্যও। সায়রা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছিল- তবে কি কেউ থাকে এখানে? এত পুরনো বাড়িতে? কেউ এই একা অন্ধকারে রাত কাটায়? সে পা রাখল ভিতরে। ছেঁড়া কার্পেট, পুরনো কাঠের চেয়ার, এক কোণে ছোট টেবিলে চায়ের কাপ। যেন এখানে কেউ আজকেই বসে ছিল। ছোট্ট একটা হারিকেন জ্বলছে। কাচে ধুলোর পরত, তবু আগুনের আলোয় একজোড়া চোখ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একচন বৃদ্ধা ধবধবে সাদা শাড়ি পরে চুপচাপ বসে আছেন। চুল সাদা, খোঁপা করা। চোখে ভারি চশমা তবে ফ্রেম দুটো সোনার চেইনে আটকানো।

বসে পড়ো, তিনি বললেন।

যেন সায়রা তার নাতনি, কিংবা আরো পুরোনো কেউ আপনজন।

সায়রা চুপ করে বসল। তার মুখে কোনো কথা নেই। শুধু নিজের হৃৎপি-ের শব্দ সে শুনতে পাচ্ছিল। সে কি ভুল জায়গায় আসল? কিংবা কোনো পেতœীর খপ্পরে পড়ল! সে ছোটবেলায় নানীর কাছে গল্প শুনেছিল-পেতœীরা সাদা শাড়ি পরে আর অনেক সুন্দর করে কথা বলে। দেয়ালের এক কোনা দিয়ে পানি চুইয়ে পড়ছে। ছাদে অসংখ্য ফাটল, ফাটল দিয়ে আসা সেই বৃষ্টির পানির টুপটাপ শব্দ যেন তার হৃদ স্পন্দন বাড়িয়ে দিচ্ছে। সায়রা একটু একটু করে তাকাল চারপাশে, সব কিছু যেন আছে অথচ কালের গহ্বরে।

আপনি এখানে থাকেন? সায়রা অবশেষে জিজ্ঞেস করল।

বৃদ্ধা মাথা নাড়লেন না। শুধু বললেন,

আমার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই আর।

রাজেশ্বরী বালা ও সায়রার মধ্যে গভীর কথোপকথন শুরু হয়- জীবন, ক্ষতি, ভালোবাসা, ও স্মৃতি নিয়ে। আলো-অন্ধকারের খেলার মাঝে, দু’জন নারীর জীবনের ভাঙন একে অপরের মধ্যে প্রতিবিম্ব খুঁজে পায়। রাজেশ্বরী বালার একমাত্র ছেলে কৃষ্ণ পদের পালায়ন ইত্যাদি সববিষয় আলোচনায় স্থান পেলো।

ঘড়িতে রাত প্রায় তিনটা বাজে। ঘরের ভেতরে এখনো হারিকেন জ্বলছে, কিন্তু আলো নিস্তেজ। রাজেশ্বরী বালা একটা পুরনো কম্বলের ভাঁজে বসে, কাঁধে শাল চাপিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন কিনা বোঝা যায় না। চোখ আধো খোলা, কিন্তু অনড়।

সায়রা ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। বাতাস ধীরে ধীরে থেমে আসছে। কিন্তু বৃষ্টি এখনও ঝরছে পাশের বাড়ির ভাঙা টিনের চালের ওপরে।

সে হঠাৎ বলল, খুব নিচু গলায়-

আপনি কি জানেন, আমি এখানে আসার আগের রাতে গতকাল কী করেছিলাম?

রাজেশ্বরী বালা উত্তর দিলেন না। তবু সায়রা কথা চালিয়ে গেল, যেন কথাগুলো শুধু শোনানোর জন্য নয়- কোনো বোঝা নিজের শরীর থেকে নামানোর মতো। তাকে বলতে পারলে হয়তো মনের ভার কিছুটা কমবে।

আমি নিজের সমস্ত কাগজ, সিভি, সার্টিফিকেট- সব কিছু ছিঁড়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছি। আসলে একটা বয়েসের পরে এই সার্টিফিকোট বোঝা হয়ে যায়, খুব বেশি কি কাজে লাগে? তাই পুড়িয়ে নিজেকে হালকা লাগবে ভেবেছিলাম। কিন্তু লাগেনি কেমন যেন অদ্ভুত একটা শূন্যতা হয়ে গেল আমার মাঝে। আমি যেন কোনো নামহীন, প্রমাণপ্রত্রহীন মানুষ হয়ে গেলাম।

সে থামল। বাইরে তাকাল। আবার বলতে লাগলো-

আমি আসলে আপনার ছেলের মতোই পালিয়েছিলাম, তফাৎ একটাই, আমি এখনো ফিরিনি।

রাজেশ্বরী ধীরে ধীরে মাথা তুললেন।

তুমি এখনো ফিরতে পারো। তোমার জন্য কেউ হয়তো এখনো জানালায় বসে, ভাবছে তুমি কেমন আছো।

কিন্তু আমি তো তার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছি। ফোন, ইমেইল, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর সব।

‘তবু একজন অপেক্ষা করলেই হয়। তুমি কি নিজের জন্য অপেক্ষা করতে পারো?’

সায়রা চুপ করে গেল। কেমন যেন একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন রাজেশ^রী বালা।

একটা ছোট শব্দ হলো- টপ! তারপর আরেকটা- টপ টপ।

সে উপরে তাকাল। ছাদ থেকে বড় একটা ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে তার কাঁধে এসে পড়ল। বৃষ্টির ফোঁটা অনেক ঠা-া এবং ভারি মনে হলো তার কাছে।

আমি... এখানেই রাতটা কাটাতে চাই, সে বলল।

তুমি পারবে? রাজেশ্বীরর কণ্ঠে প্রশ্ন নয়, ছিল এক ধরনের স্নেহময় মমতা।

আমি তো ঠিক জানি না, কোথায় যাব। এই ভাঙা ছাদটায় যতটা ছিদ্র আছে, ততটাই জায়গা আছে আমি কোথাও ঢুকতে পারি কিনা দেখার। রাজেশ্বরী বালা ধীরে ধীরে উঠে এলেন।সায়রার গায়ে পাতালা কম্বল চাপালেন তারপর বললেন-

ছাদটা যতই ভাঙা হোক, মানুষ থাকলে সেটা ঘর হয়ে যায়। তুমি আজ ঘরে আছো।

সায়রা তার দিকে চেয়ে থাকল। ধীরে, খুবই ধীরে বলল,

আপনি কি জানেন, আজ আমি প্রথম বার কাউকে বললাম এসব কথা?

রাজেশ্বরী বালা হাসলেন।

আমি জানি। কারণ আমিও তো আমার গল্পটা আজ প্রথম কাউকে বললাম।

সায়রা নিচে মেঝেতে বসে পড়ল। তার পাশে রাজেশ্বরী বালা বসে থাকলেন, দুইজনের মাঝখানে শুধু হারিকেনের আলো। বাইরে আকাশ একটু একটু করে সাদা হয়ে আসছে। সায়রা জানত, এই শহর পালানোর মতো জায়গা দেয় না। কিন্তু ওই রাতের ভেতর, এই একফালি ছাদের নিচে, এক অপরিচিত মুখের পাশে বসে, সে যেন ধীরে ধীরে বুঝতে পারল- সব পালানো মানেই হারিয়ে যাওয়া নয়।

কখনো কখনো, পালাতে গিয়ে যে জায়গায় গিয়ে মানুষ দাঁড়ায় সেটাই আসল ঘর হয়ে যায় এই পার্থিব জীবনে।

ছবি

চন্দ্রাবতী : মধ্যযুগের প্রথম মহিলা কবি

ছবি

আধুনিক-উত্তর সময়ের নির্মিতি

ছবি

বংশধারা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

আবুবকর সিদ্দিকের ছোট গল্পে রাজনীতি

ছবি

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসের তুলনামূলক বিচার

ছবি

সমকালীন কাব্যভাষায় কবি শহীদ কাদরী

ছবি

চরফুলের কন্যা

ছবি

নজরুলের গল্প ও উপন্যাস

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রলোভন এবং ধৈর্যের গল্প

ছবি

প্রসঙ্গ মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস

ছবি

প্রেম, অস্তিত্ববাদ ও বেদনার দোলাচল

ছবি

‘কবিতার যুবরাজ’ কবি আবুল হাসান

ছবি

মানুষ, প্রকৃতি ও সুলতানের স্বকীয় অভিযাত্রা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

শালুক-এর শঙ্খ ঘোষ সংখ্যা বাংলাদেশের সশ্রদ্ধ মূল্যায়ন

ছবি

‘প্রিজন ডিলাক্স ট্যুর’: কুহক ও বিভ্রমের গল্প

ছবি

কল্পগল্প

ছবি

আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা’

ছবি

প্রসঙ্গ মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস

ছবি

আনন্দদায়ক ও অপ্রত্যাশিত নোবেল পুরস্কার

ছবি

জীবনবোধ ও শিল্পকর্ম

ছবি

নজরুলের গল্প ও উপন্যাস

ছবি

কৃষ্ণাঙ্গ দাস থেকে হয়ে উঠেছিলেন খ্যাতিমান কবি

শ্রাবণ বর্ষণে

ছবি

শতবর্ষ পরে ‘মিসেস ডালোওয়ে’

ছবি

স্কাল্পচারের জগতটা আস্তে আস্তে ব্যাপকতা পাচ্ছে

ছবি

চব্বিশের অভ্যুত্থান নিয়ে গ্রন্থ

ছবি

ভিন্নচোখ: নুতন কবিতা সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকা: মৃত্যুর রূপক এবং আন্দালুসিয়ার লোকজ বিশ্বাস

ছবি

কবিতার শিল্পনিষ্ঠ রূপকার ফারুক মাহমুদ

ছবি

কাফকাকে পড়া কাফকাকে পড়ানো

ছবি

কবি নওশাদ নূরী

ছবি

আঁধার পেরিয়ে আলোর উদ্ভাষণ

tab

সাময়িকী

ভাঙা ছাদ

গোপাল দাশ

বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫

ঢাকায় গত কিছুদিন যাবত ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে রাস্তাঘাটগুলো কাদাপানি আর ধুলাবালি মিশে একাকার হয়ে যায়। ঢাকার চিরচেনা বিষয়- বর্ষাকালে সকল পরিসেবা দপ্তরের রাস্তা কাটাকাটির দৃশ্য। মোদ্দা কথা হলো ঢাকায় থাকবেন আর প্যাককাদা পাড়াবেন না তাই কি হয়? এসব ভেবে ভেবে সায়রা খুবই বিরক্ত হয়। আবার হঠাৎ বলাকওয়া নাই বিদ্যুৎ চলে যায়। তারপর উপরে সম্প্রতি ট্রাফিক পুলিশের রোড ডাইভারসন নিয়ে গবেষণা চরম পর্যায়ে, যখন তখন ইউটার্ন নিয়ে বাড়াবাড়ি বা বন্ধ করে দেয়। তাবে সায়রা ভাবে পুলিশ হয়তো ট্রাফিক জ্যাম কমানোর জন্য করেছে।

সায়রা যখন মনিপুরী পাড়ার বাড়ি থেকে বের হয়, তখন আকাশে বৃষ্টি ছিলনা কিন্তু আকাশে কালো কালো মেঘ ছিল। অনেক রাত হয়ে গেছে। এর মধ্যে শ্রাবণের বর্ষণ শুরু হলো, পেছন থেকে বৃষ্টির ঝাপটা এসে সায়রার কাঁধে লেগে হাঁটু পর্যন্ত গড়িয়ে পড়েছে। ফোনে চার্জ নেই বললেই চলে, ৫% দেখাচ্ছে। এই অবস্থায় গুগল ম্যাপ কাজ করছে না। আবার রাস্তায় বিদ্যুৎ নাই। সে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় পুরান ঢাকায় চলে এসেছে। এই এলাকায় বেশি বৃষ্টি হলে বেশি রাত অবধি আর রিকশাও চলাচল না বন্ধ হয়ে যায়, যেন শহরে কপাট পড়ে।

সায়রা হাঁটছে আর হাঁটছে, পুরান ঢাকার অলিগলি সে খুব বেশি চিনে না। আরো খানিকটা হাঁটার পর সে দেখতে পেল একটা বইয়ের দোকনের সাইনবোর্ড লেখা-বি, কে, দাস লেন। বইয়ের দোকান হতে সামনে বাঁ দিকে মোড় নিতেই সে একটি লোহার গেট দেখতে পায়। লোকজন মনে হয় আগেভাগে বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। আর হবেই না কেন, এখন রাত বাজে একটা। সায়রা জিন্সের প্যান্ট আর টপস পরেছে, গলায় চিকুন মাফলার জাতীয় তবে সেটা ওড়না নয়। আর রাত-বিরাতে সায়রা’র হাঁটাচলা করতে তেমন অসুবিধা হয় না। রাস্তার বখাটে ছেলেরা তাকে একটু সমীহ-ই করে। লোহার গেটটার দক্ষিণ পাশে বড় একটি হলুদ কালো রঙের কুকুর শুয়ে আছে, জানালার উপরে কার্নিশ থাকায় বৃষ্টির জল না পড়ায় তেমন সমস্যা হচ্ছে না। লোহার গেটটা নিচু লালচে রঙের, কালচে দাগ পড়া। একটুখানি ঠেলে দেখল, খোলা। সে একটু অবাক হলো এত রাত্রেও খোলা!

আবার বৃষ্টির ঝাপটার তাড়া খেয়ে সে পা রাখল ভেতরে। দুইতলা বাড়ি। পুরনো ধাঁচের লোহার কারুকাজ করা ঝুল বারান্দা, ভাঙা করিডোর, দেয়ালে ধুলো জমে ছাঁচ ধরেছে। সিঁড়ির কোণে ছোট একটা কাঠের কুলি বাক্স পড়া রয়েছে, কতগুলো ছেঁড়া কাপড়ের পাশে। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার, কিন্তু বাইরে থেকে আসা রাস্তার আলো একটু একটু করে দেয়ালে পড়ছে। সায়রা তার ভিজে মাফলার সামলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল- পা ফেলতেই কেঁপে উঠল কাঠের সিঁড়ির ধাপ। একবার চেয়ে দেখল চারপাশে কেউ নেই। ঘরের ভিতর কোনো শব্দ নেই, তবে বাইরে থেকে শুধু বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে আর ঘরে পুরনো কাঠের শুকিয়ে যাওয়া গন্ধ। দ্বিতীয় তলায় পৌঁছে দরজার ফাঁক গলে ভিতরে তাকাতেই হঠাৎ সে ভয় পেয়ে গেল। আলো নেই কিন্তু একটা ছায়া নড়ে উঠল ভেতরে।

কেউ আছেন? তার কণ্ঠে ভয়ে জড়ানো মতো দ্বিধা ছিল।

একটা কাশির শব্দ এল ভেতর থেকে। ধীরে নিঃশ্বাস ফেলা কণ্ঠে, বয়েস হলে যা হয়। তারপর সেই কণ্ঠ বলল-

তুমি তো অনেক দেরিতে এলে, রাত এখন একটা।

সায়রা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। ঠিক জানল না এটা উত্তর না অভিযোগ। আর অন্ধকারে মহিলা কীভাবে ঘড়ি দেখছে! আর আজতো তার এখানে আসার কথা না।

আমি বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্যই খোলা পেয়ে ঢুকে পড়েছি, বৃষ্টি থামলেই আমি চলে যাব, বলল সে।

অন্ধকার থেকে বলল, বৃষ্টি তো আর আজ থামবে না। মেয়েমানুষ এত রাতে কোথায় যাবে?

এবার কণ্ঠটা যেন ধোঁয়ার মতো গড়িয়ে এলো। তাতে আতিথ্য ছিল, আবার রহস্যও। সায়রা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছিল- তবে কি কেউ থাকে এখানে? এত পুরনো বাড়িতে? কেউ এই একা অন্ধকারে রাত কাটায়? সে পা রাখল ভিতরে। ছেঁড়া কার্পেট, পুরনো কাঠের চেয়ার, এক কোণে ছোট টেবিলে চায়ের কাপ। যেন এখানে কেউ আজকেই বসে ছিল। ছোট্ট একটা হারিকেন জ্বলছে। কাচে ধুলোর পরত, তবু আগুনের আলোয় একজোড়া চোখ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একচন বৃদ্ধা ধবধবে সাদা শাড়ি পরে চুপচাপ বসে আছেন। চুল সাদা, খোঁপা করা। চোখে ভারি চশমা তবে ফ্রেম দুটো সোনার চেইনে আটকানো।

বসে পড়ো, তিনি বললেন।

যেন সায়রা তার নাতনি, কিংবা আরো পুরোনো কেউ আপনজন।

সায়রা চুপ করে বসল। তার মুখে কোনো কথা নেই। শুধু নিজের হৃৎপি-ের শব্দ সে শুনতে পাচ্ছিল। সে কি ভুল জায়গায় আসল? কিংবা কোনো পেতœীর খপ্পরে পড়ল! সে ছোটবেলায় নানীর কাছে গল্প শুনেছিল-পেতœীরা সাদা শাড়ি পরে আর অনেক সুন্দর করে কথা বলে। দেয়ালের এক কোনা দিয়ে পানি চুইয়ে পড়ছে। ছাদে অসংখ্য ফাটল, ফাটল দিয়ে আসা সেই বৃষ্টির পানির টুপটাপ শব্দ যেন তার হৃদ স্পন্দন বাড়িয়ে দিচ্ছে। সায়রা একটু একটু করে তাকাল চারপাশে, সব কিছু যেন আছে অথচ কালের গহ্বরে।

আপনি এখানে থাকেন? সায়রা অবশেষে জিজ্ঞেস করল।

বৃদ্ধা মাথা নাড়লেন না। শুধু বললেন,

আমার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই আর।

রাজেশ্বরী বালা ও সায়রার মধ্যে গভীর কথোপকথন শুরু হয়- জীবন, ক্ষতি, ভালোবাসা, ও স্মৃতি নিয়ে। আলো-অন্ধকারের খেলার মাঝে, দু’জন নারীর জীবনের ভাঙন একে অপরের মধ্যে প্রতিবিম্ব খুঁজে পায়। রাজেশ্বরী বালার একমাত্র ছেলে কৃষ্ণ পদের পালায়ন ইত্যাদি সববিষয় আলোচনায় স্থান পেলো।

ঘড়িতে রাত প্রায় তিনটা বাজে। ঘরের ভেতরে এখনো হারিকেন জ্বলছে, কিন্তু আলো নিস্তেজ। রাজেশ্বরী বালা একটা পুরনো কম্বলের ভাঁজে বসে, কাঁধে শাল চাপিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন কিনা বোঝা যায় না। চোখ আধো খোলা, কিন্তু অনড়।

সায়রা ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। বাতাস ধীরে ধীরে থেমে আসছে। কিন্তু বৃষ্টি এখনও ঝরছে পাশের বাড়ির ভাঙা টিনের চালের ওপরে।

সে হঠাৎ বলল, খুব নিচু গলায়-

আপনি কি জানেন, আমি এখানে আসার আগের রাতে গতকাল কী করেছিলাম?

রাজেশ্বরী বালা উত্তর দিলেন না। তবু সায়রা কথা চালিয়ে গেল, যেন কথাগুলো শুধু শোনানোর জন্য নয়- কোনো বোঝা নিজের শরীর থেকে নামানোর মতো। তাকে বলতে পারলে হয়তো মনের ভার কিছুটা কমবে।

আমি নিজের সমস্ত কাগজ, সিভি, সার্টিফিকেট- সব কিছু ছিঁড়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছি। আসলে একটা বয়েসের পরে এই সার্টিফিকোট বোঝা হয়ে যায়, খুব বেশি কি কাজে লাগে? তাই পুড়িয়ে নিজেকে হালকা লাগবে ভেবেছিলাম। কিন্তু লাগেনি কেমন যেন অদ্ভুত একটা শূন্যতা হয়ে গেল আমার মাঝে। আমি যেন কোনো নামহীন, প্রমাণপ্রত্রহীন মানুষ হয়ে গেলাম।

সে থামল। বাইরে তাকাল। আবার বলতে লাগলো-

আমি আসলে আপনার ছেলের মতোই পালিয়েছিলাম, তফাৎ একটাই, আমি এখনো ফিরিনি।

রাজেশ্বরী ধীরে ধীরে মাথা তুললেন।

তুমি এখনো ফিরতে পারো। তোমার জন্য কেউ হয়তো এখনো জানালায় বসে, ভাবছে তুমি কেমন আছো।

কিন্তু আমি তো তার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছি। ফোন, ইমেইল, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর সব।

‘তবু একজন অপেক্ষা করলেই হয়। তুমি কি নিজের জন্য অপেক্ষা করতে পারো?’

সায়রা চুপ করে গেল। কেমন যেন একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন রাজেশ^রী বালা।

একটা ছোট শব্দ হলো- টপ! তারপর আরেকটা- টপ টপ।

সে উপরে তাকাল। ছাদ থেকে বড় একটা ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে তার কাঁধে এসে পড়ল। বৃষ্টির ফোঁটা অনেক ঠা-া এবং ভারি মনে হলো তার কাছে।

আমি... এখানেই রাতটা কাটাতে চাই, সে বলল।

তুমি পারবে? রাজেশ্বীরর কণ্ঠে প্রশ্ন নয়, ছিল এক ধরনের স্নেহময় মমতা।

আমি তো ঠিক জানি না, কোথায় যাব। এই ভাঙা ছাদটায় যতটা ছিদ্র আছে, ততটাই জায়গা আছে আমি কোথাও ঢুকতে পারি কিনা দেখার। রাজেশ্বরী বালা ধীরে ধীরে উঠে এলেন।সায়রার গায়ে পাতালা কম্বল চাপালেন তারপর বললেন-

ছাদটা যতই ভাঙা হোক, মানুষ থাকলে সেটা ঘর হয়ে যায়। তুমি আজ ঘরে আছো।

সায়রা তার দিকে চেয়ে থাকল। ধীরে, খুবই ধীরে বলল,

আপনি কি জানেন, আজ আমি প্রথম বার কাউকে বললাম এসব কথা?

রাজেশ্বরী বালা হাসলেন।

আমি জানি। কারণ আমিও তো আমার গল্পটা আজ প্রথম কাউকে বললাম।

সায়রা নিচে মেঝেতে বসে পড়ল। তার পাশে রাজেশ্বরী বালা বসে থাকলেন, দুইজনের মাঝখানে শুধু হারিকেনের আলো। বাইরে আকাশ একটু একটু করে সাদা হয়ে আসছে। সায়রা জানত, এই শহর পালানোর মতো জায়গা দেয় না। কিন্তু ওই রাতের ভেতর, এই একফালি ছাদের নিচে, এক অপরিচিত মুখের পাশে বসে, সে যেন ধীরে ধীরে বুঝতে পারল- সব পালানো মানেই হারিয়ে যাওয়া নয়।

কখনো কখনো, পালাতে গিয়ে যে জায়গায় গিয়ে মানুষ দাঁড়ায় সেটাই আসল ঘর হয়ে যায় এই পার্থিব জীবনে।

back to top