নারায়ণগঞ্জের ব্যবসা ও পরিবহনসহ বিভিন্ন খাত গত ১৬ বছর ছিল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও তাদের সমর্থকদের দখলে। এসব খাত দখলে নিয়ে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত ছিলেন তারা। গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। আওয়ামী লীগের লোকজন বেশিরভাগই এলাকাছাড়া। তাদের শূণ্যস্থান পূরণে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিএনপির নেতা-কর্মী ও তাদের সমর্থকরা। এ নিয়ে দলটির মধ্যে তৈরি হয়েছে বিভক্তি ও বিরোধ, যা রূপ নিচ্ছে সংঘর্ষে।
শহরের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পোশাক কারখানার ঝুট, ফুটপাত, বাসস্ট্যান্ড, সিএনজিস্ট্যান্ড, বাজারসহ সব জায়গায় এখন বিএনপির লোকজনের আধিপত্য, দলটির একাধিক গ্রুপ সক্রিয়।
গত ৫ আগস্টে রাজনৈতিক পালাবদলের পর স্থানীয় বিএনপির এই গ্রুপিং-এর কারণে বেশ কয়েকটি সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় রক্ত ঝরেছে অনেকের, এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি চালানোর খবরও পাওয়া যাচ্ছে। সর্বশেষ সিদ্ধিরগঞ্জের ইপিজেডের ঝুট ব্যবসা দখলকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব।
গত ২ অক্টোবর জেলা কৃষক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ঝুটসহ ১৪ ট্রাক লুটের অভিযোগে মহানগর মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর আয়েশা আক্তার দিনা সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডাইরি করেন।
আর গত ৯ অক্টোবর আয়েশা আক্তার দিনা, মহানগর যুবদলের সদস্যসচিব শাহেদ আহমেদ, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যসচিব মমিনুর রহমান বাবুর বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগ তুলে আদালতে মামলার আবেদন করেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কৃষক দলের সভাপতি তৈয়ম।
গত ২২ সেপ্টেম্বর একটি বাস কোম্পানি দখলকে কেন্দ্র করে বিএনপির দু’টি পক্ষের মধ্যে টানা ৪ ঘন্টা সংঘর্ষ চলে। দেশীয় ধারালো অস্ত্রের পাশাপাশি দুইপক্ষ আগ্নেয়াস্ত্রও ব্যবহার করেছে। এতে অন্তত ১২ জন আহত হয়েছেন।
ওসমানদের শুন্যস্থানে বিএনপির লোক
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ‘সিটি বন্ধন পরিবহন’ দখলকে কেন্দ্র করে জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির খান ও মহানগর বিএনপির সদস্য মাহবুবুল্লাহ তপনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ওই সময় আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি চালাতেও দেখা যায়। প্রায় চার ঘন্টা পর সেনাবাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্যের টহলের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
সংঘর্ষে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মো. রাসেল নামে শহরের মাসদাইরের এক বাসিন্দাকে দেখা যায়। বিভিন্ন সূত্রমতে, তিনি বিএনপির ক্যাডার বলে পরিচিত সাবেক ছাত্রদল নেতা জাকির খানের অনুসারী। কিন্তু ষংঘর্ষের ঘটনার দায়ের করা দুই পক্ষের অভিযোগেই তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
জাকির খান সাবেক বিএনপি নেতা তৈমুর আলম খন্দকারের ছোটভাই সাব্বির আলম খন্দকার হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন জাকির। জাকির কারাগারে থাকলেও তার লোকজন নারায়ণগঞ্জ শহরে বেশ সক্রিয়। অভিযোগ, ত্বকী হত্যা মামলাসহ বেশ কয়েকটি হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত আজমেরী ওসমানের বাহিনীকেও দলে ভিড়িয়েছেন জাকিরের লোকজন।
আর, মাহবুবুল্লাহ তপন ২০০৪ সালে র্যাবের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত যুবদলের ক্যাডার মমিনুল্লাহ ডেভিডের ভাই। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন তপন নারায়ণগঞ্জ শহরের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন। তবে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে পরিবহন খাতটির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের দখলে।
পরিবহন শ্রমিক, মালিক ও পুলিশের সাথে কথা বলে জানা যায়, সিটি বন্ধন পরিবহনের ৫৪টি বাস ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচল করে। আগে একই রুটে বন্ধন ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির নামে বাসগুলো চলাচল করতো। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাস কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে তার নিয়ন্ত্রণ নেয় আওয়ামী লীগের লোকজন। সিটি বন্ধন পরিবহনের মালিক সমিতির সভাপতিও ছিলেন শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ অনুসারী মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি জুয়েল।
নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘একটি বাস কোম্পানি দখলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে যৌথ বাহিনী তৎপর রয়েছে। পরিস্থিতি কেউ ঘোলাটে করতে চাইলে তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।’
ঝুট ব্যবসা দখলে সংঘর্ষ
গত ১১ সেপ্টেম্বর ফতুল্লায় ঝুট ব্যবসা দখলকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত ৪০ জন আহত হন। দুইপক্ষের লোকজনের হাতেই রাম দা, রড ও লাঠিসোটা দেখা গেছে। সংঘর্ষ নিয়ে থানা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক একে অন্যকে দুষছেন।
ওইদিন দুটি গার্মেন্ট কারখানা ভাঙচুর ও একটি ডাইং কারখানায় ঢুকে কাপড়ের গাইডে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। একটি কারখানার কাপড় রাস্তায় ফেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় বলে জানান স্থানীয়রা।
ক্ষতিগ্রস্ত কারখানার মালিকদের অভিযোগ, ঝুট (পরিত্যক্ত কাপড়) ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে রাখতে তালিকা দেয় ফতুল্লা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াদ মোহাম্মদ চৌধুরী। সেই তালিকা অনুযায়ী ব্যবসা না দেওয়ায় কারখানায় হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে।
এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রিয়াদ চৌধুরী। তার অভিযোগ, জেলা বিএনপির সভাপতি ‘গিয়াস উদ্দিনের অনুসারীরা’ ফতুল্লা ও বিসিক অঞ্চলের পোশাক কারখানাগুলোর ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এইসব কাজ করছেন। এতে ‘আওয়ামী লীগের কয়েকজনও’ জড়িত বলে অভিযোগ রিয়াদের।
গিয়াসউদ্দিনের অনুসারী ফতুল্লা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি হাসান মাহমুদ পলাশের দাবি, তারা এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে কাজ করছেন।
গত ২৯ আগস্ট ঝুট ব্যবসা দখলকে কেন্দ্র করে ফতুল্লার বিসিক শিল্পাঞ্চল এলাকায় বিএনপি’র দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে ছুরিকাঘাতে আহত হন দু’জন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায় , দীর্ঘদিন ওসমান পরিবারে অধীনে থাকা ঝুট ব্যবসা তাদের অনুপস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা রাসেল মাহমুদ এবং ফতুল্লা থানা বিএনপি সহ-শ্রম বিষয়ক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম। কয়েকদিন ধরেই বিসিকে মহড়া দেয় দুই পক্ষের লোকজন। ওইদিন রাসেলের পক্ষ একটি কারখানার ঝুট দাবি করলে জাহাঙ্গীর অনুসারীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিসিকে অবস্থান নিলে দুইপক্ষ পালিয়ে যায়।
ব্যবসায়িদের কাছ থেকে চাঁদা, পরে ‘ফেরত’
চাঁদার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা যায় ব্যবসায়িক দুই সংগঠন বিকেএমইএ ও নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের নেতাদের। গত ৭ সেপ্টেম্বর চাঁদা দাবি ও আদায়ের অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করেন তারা।
এই সময় চেম্বারের সভাপতি মো. মাসুদুজ্জামান জানান, চেম্বারের কাছে ১০ লাখ টাকা ও বিকেএমইএ’র কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছে। এরমধ্যে চেম্বার তিন লাখ এবং বিকেএমইএ পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দিয়েছে।
তবে গত ১ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করেন তারা জানান চাঁদার টাকা ‘ফেরত পেয়েছেন’। কারা চাঁদা নিয়েছিলো বা কিভাবে তা ফেরত পেলেন সে বিষয়ে কিছু বলতে চাননি ব্যবসায়ি নেতারা।
মাসুদুজ্জামান গত মাসে বলেন, ‘কেন্দ্র থেকে রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন কোনোভাবেই চাঁদাবাজি, দখল করা যাবে না। স্থানীয় নেতারা মঞ্চে উঠে বলছে, চাঁদা দেবেন না, আবার মঞ্চ থেকে নেমেই ফোন করে বলে – ভাই ঝুটটা দিলেন না? এমন শত শত ফোন আমি পেয়েছি। আমরা ব্যাবসায়ীরা কখনও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। দিন শেষে পরিবর্তন হলে আমাদের ওপর দিয়েই ঝড়-ঝাপটা যায়।’
কী বলছে স্থানীয় বিএনপি
এইসব ঘটনায় যারা যুক্ত তারা ‘সুবিধাবাদী’ বলে বলছেন মহানগর বিএনপির আহবায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান। তাদের এমন ‘অপকর্মে’ দলের ‘ভাবমূর্তি’ ক্ষুন্ন হচ্ছে বলেও মন্তব্য তার।
সাখাওয়াত বলেন, ‘বিগত সময়ে যারা লড়াই-সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন, দেখবেন তাদের কেউ কিন্তু এইসব ঘটনায় যুক্ত না। যারা ইতোপূর্বে ক্ষমতাসীন দলের সাথে আঁতাত করে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছেন তারাই এইসব কার্যক্রম করে বেড়াচ্ছে।’
শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪
নারায়ণগঞ্জের ব্যবসা ও পরিবহনসহ বিভিন্ন খাত গত ১৬ বছর ছিল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও তাদের সমর্থকদের দখলে। এসব খাত দখলে নিয়ে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত ছিলেন তারা। গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। আওয়ামী লীগের লোকজন বেশিরভাগই এলাকাছাড়া। তাদের শূণ্যস্থান পূরণে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিএনপির নেতা-কর্মী ও তাদের সমর্থকরা। এ নিয়ে দলটির মধ্যে তৈরি হয়েছে বিভক্তি ও বিরোধ, যা রূপ নিচ্ছে সংঘর্ষে।
শহরের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পোশাক কারখানার ঝুট, ফুটপাত, বাসস্ট্যান্ড, সিএনজিস্ট্যান্ড, বাজারসহ সব জায়গায় এখন বিএনপির লোকজনের আধিপত্য, দলটির একাধিক গ্রুপ সক্রিয়।
গত ৫ আগস্টে রাজনৈতিক পালাবদলের পর স্থানীয় বিএনপির এই গ্রুপিং-এর কারণে বেশ কয়েকটি সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় রক্ত ঝরেছে অনেকের, এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি চালানোর খবরও পাওয়া যাচ্ছে। সর্বশেষ সিদ্ধিরগঞ্জের ইপিজেডের ঝুট ব্যবসা দখলকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব।
গত ২ অক্টোবর জেলা কৃষক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ঝুটসহ ১৪ ট্রাক লুটের অভিযোগে মহানগর মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর আয়েশা আক্তার দিনা সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডাইরি করেন।
আর গত ৯ অক্টোবর আয়েশা আক্তার দিনা, মহানগর যুবদলের সদস্যসচিব শাহেদ আহমেদ, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যসচিব মমিনুর রহমান বাবুর বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগ তুলে আদালতে মামলার আবেদন করেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কৃষক দলের সভাপতি তৈয়ম।
গত ২২ সেপ্টেম্বর একটি বাস কোম্পানি দখলকে কেন্দ্র করে বিএনপির দু’টি পক্ষের মধ্যে টানা ৪ ঘন্টা সংঘর্ষ চলে। দেশীয় ধারালো অস্ত্রের পাশাপাশি দুইপক্ষ আগ্নেয়াস্ত্রও ব্যবহার করেছে। এতে অন্তত ১২ জন আহত হয়েছেন।
ওসমানদের শুন্যস্থানে বিএনপির লোক
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ‘সিটি বন্ধন পরিবহন’ দখলকে কেন্দ্র করে জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির খান ও মহানগর বিএনপির সদস্য মাহবুবুল্লাহ তপনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ওই সময় আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি চালাতেও দেখা যায়। প্রায় চার ঘন্টা পর সেনাবাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্যের টহলের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
সংঘর্ষে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মো. রাসেল নামে শহরের মাসদাইরের এক বাসিন্দাকে দেখা যায়। বিভিন্ন সূত্রমতে, তিনি বিএনপির ক্যাডার বলে পরিচিত সাবেক ছাত্রদল নেতা জাকির খানের অনুসারী। কিন্তু ষংঘর্ষের ঘটনার দায়ের করা দুই পক্ষের অভিযোগেই তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
জাকির খান সাবেক বিএনপি নেতা তৈমুর আলম খন্দকারের ছোটভাই সাব্বির আলম খন্দকার হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন জাকির। জাকির কারাগারে থাকলেও তার লোকজন নারায়ণগঞ্জ শহরে বেশ সক্রিয়। অভিযোগ, ত্বকী হত্যা মামলাসহ বেশ কয়েকটি হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত আজমেরী ওসমানের বাহিনীকেও দলে ভিড়িয়েছেন জাকিরের লোকজন।
আর, মাহবুবুল্লাহ তপন ২০০৪ সালে র্যাবের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত যুবদলের ক্যাডার মমিনুল্লাহ ডেভিডের ভাই। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন তপন নারায়ণগঞ্জ শহরের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন। তবে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে পরিবহন খাতটির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের দখলে।
পরিবহন শ্রমিক, মালিক ও পুলিশের সাথে কথা বলে জানা যায়, সিটি বন্ধন পরিবহনের ৫৪টি বাস ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচল করে। আগে একই রুটে বন্ধন ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির নামে বাসগুলো চলাচল করতো। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাস কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে তার নিয়ন্ত্রণ নেয় আওয়ামী লীগের লোকজন। সিটি বন্ধন পরিবহনের মালিক সমিতির সভাপতিও ছিলেন শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ অনুসারী মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি জুয়েল।
নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘একটি বাস কোম্পানি দখলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে যৌথ বাহিনী তৎপর রয়েছে। পরিস্থিতি কেউ ঘোলাটে করতে চাইলে তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।’
ঝুট ব্যবসা দখলে সংঘর্ষ
গত ১১ সেপ্টেম্বর ফতুল্লায় ঝুট ব্যবসা দখলকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত ৪০ জন আহত হন। দুইপক্ষের লোকজনের হাতেই রাম দা, রড ও লাঠিসোটা দেখা গেছে। সংঘর্ষ নিয়ে থানা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক একে অন্যকে দুষছেন।
ওইদিন দুটি গার্মেন্ট কারখানা ভাঙচুর ও একটি ডাইং কারখানায় ঢুকে কাপড়ের গাইডে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। একটি কারখানার কাপড় রাস্তায় ফেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় বলে জানান স্থানীয়রা।
ক্ষতিগ্রস্ত কারখানার মালিকদের অভিযোগ, ঝুট (পরিত্যক্ত কাপড়) ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে রাখতে তালিকা দেয় ফতুল্লা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াদ মোহাম্মদ চৌধুরী। সেই তালিকা অনুযায়ী ব্যবসা না দেওয়ায় কারখানায় হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে।
এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রিয়াদ চৌধুরী। তার অভিযোগ, জেলা বিএনপির সভাপতি ‘গিয়াস উদ্দিনের অনুসারীরা’ ফতুল্লা ও বিসিক অঞ্চলের পোশাক কারখানাগুলোর ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এইসব কাজ করছেন। এতে ‘আওয়ামী লীগের কয়েকজনও’ জড়িত বলে অভিযোগ রিয়াদের।
গিয়াসউদ্দিনের অনুসারী ফতুল্লা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি হাসান মাহমুদ পলাশের দাবি, তারা এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে কাজ করছেন।
গত ২৯ আগস্ট ঝুট ব্যবসা দখলকে কেন্দ্র করে ফতুল্লার বিসিক শিল্পাঞ্চল এলাকায় বিএনপি’র দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে ছুরিকাঘাতে আহত হন দু’জন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায় , দীর্ঘদিন ওসমান পরিবারে অধীনে থাকা ঝুট ব্যবসা তাদের অনুপস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা রাসেল মাহমুদ এবং ফতুল্লা থানা বিএনপি সহ-শ্রম বিষয়ক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম। কয়েকদিন ধরেই বিসিকে মহড়া দেয় দুই পক্ষের লোকজন। ওইদিন রাসেলের পক্ষ একটি কারখানার ঝুট দাবি করলে জাহাঙ্গীর অনুসারীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিসিকে অবস্থান নিলে দুইপক্ষ পালিয়ে যায়।
ব্যবসায়িদের কাছ থেকে চাঁদা, পরে ‘ফেরত’
চাঁদার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা যায় ব্যবসায়িক দুই সংগঠন বিকেএমইএ ও নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের নেতাদের। গত ৭ সেপ্টেম্বর চাঁদা দাবি ও আদায়ের অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করেন তারা।
এই সময় চেম্বারের সভাপতি মো. মাসুদুজ্জামান জানান, চেম্বারের কাছে ১০ লাখ টাকা ও বিকেএমইএ’র কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছে। এরমধ্যে চেম্বার তিন লাখ এবং বিকেএমইএ পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দিয়েছে।
তবে গত ১ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করেন তারা জানান চাঁদার টাকা ‘ফেরত পেয়েছেন’। কারা চাঁদা নিয়েছিলো বা কিভাবে তা ফেরত পেলেন সে বিষয়ে কিছু বলতে চাননি ব্যবসায়ি নেতারা।
মাসুদুজ্জামান গত মাসে বলেন, ‘কেন্দ্র থেকে রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন কোনোভাবেই চাঁদাবাজি, দখল করা যাবে না। স্থানীয় নেতারা মঞ্চে উঠে বলছে, চাঁদা দেবেন না, আবার মঞ্চ থেকে নেমেই ফোন করে বলে – ভাই ঝুটটা দিলেন না? এমন শত শত ফোন আমি পেয়েছি। আমরা ব্যাবসায়ীরা কখনও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। দিন শেষে পরিবর্তন হলে আমাদের ওপর দিয়েই ঝড়-ঝাপটা যায়।’
কী বলছে স্থানীয় বিএনপি
এইসব ঘটনায় যারা যুক্ত তারা ‘সুবিধাবাদী’ বলে বলছেন মহানগর বিএনপির আহবায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান। তাদের এমন ‘অপকর্মে’ দলের ‘ভাবমূর্তি’ ক্ষুন্ন হচ্ছে বলেও মন্তব্য তার।
সাখাওয়াত বলেন, ‘বিগত সময়ে যারা লড়াই-সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন, দেখবেন তাদের কেউ কিন্তু এইসব ঘটনায় যুক্ত না। যারা ইতোপূর্বে ক্ষমতাসীন দলের সাথে আঁতাত করে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছেন তারাই এইসব কার্যক্রম করে বেড়াচ্ছে।’