alt

সারাদেশ

প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপের পর আত্মঘাতী প্রকল্পের বহর : ভবদহ অঞ্চলে দুর্বিষহ জীবনের শেষ কোথায়

রুকুনউদ্দৌলাহ, যশোর অফিস : বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪

ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পানিবন্দী ভবদহ বিলপাড়ের মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে-সংবাদ

খুলনা বিভাগের তিন জেলার ছয় উপজেলার পাঁচ শতাধিক গ্রামের দুঃখের নাম ‘ভবদহ’। ছয় দশক আগে প্রকৃতির ওপর হস্তক্ষেপ করে এই অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতির উপর যে কুঠারাঘাত করা হয়েছে-তার ফল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভোগ করছেন পনের লক্ষাধিক মানুষ। এর মধ্যে স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার অন্তত চার লাখ মানুষ। প্রায় চার দশক ধরে দুর্ভোগ যেনো নিত্যসঙ্গী তাদের।

কী ভীষণ দুর্বিষহ জীবন যাপন তারা করছেন, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন! মাসের পর মাস জলাবদ্ধতায় গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগিকে সঙ্গী করে সাপ-ব্যাঙের সঙ্গে বসবাস। বিলের পর বিল, গ্রামের পর গ্রাম, হাট-বাজার পানিতে তলিয়ে থাকায় কাজ নেই; নেই ঘরে খাবার। খাবারের জন্য কাঁদছে সন্তান; মায়ের চোখে শুধুই অশ্রু। মারা গেলে সৎকার বা কবরের জায়গা নেই। পানির মধ্যেই বসবাস, তবু খাবার পানি নেই। শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। ছড়িয়ে পড়ছে রোগ-বালাই। অন্তঃসত্ত্বা নারী, প্রসূতি মা, শিশু-বৃদ্ধ সবাই মিলে একত্রে এক-একটি দিন পার করছেন দুর্বিষহ নরক-যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে। অথচ এই জলাবদ্ধতা নিরসনে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে-তা কার্যত কোনো কাজে আসেনি। প্রকল্পের পর প্রকল্পের নামে জলে গেছে হাজার কোটি টাকা-এমনই অভিমত এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের।

শুরুর কথা

১৯৫৫ সালে দক্ষিণাঞ্চলে প্রবল বন্যায় ব্যাপক প্রাণহানি হয় এবং ফসলের ক্ষতি হয়। জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে এই অঞ্চল। এই সঙ্কট নিরসনে ১৯৫৯ সালে কোস্টাল ইমব্যাকমেন্ট প্রজেক্ট- সিইএফ প্রকল্প চালু করা হয়। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল জলোচ্ছ্বাস বা প্লাাবনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে মানুষ এবং ফসল রক্ষ করা। একই লক্ষ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড-ওয়াপদা’র সৃষ্টি করা হয়। এই প্রকল্প-দপ্তরের হাত ধরে যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের ভবদহ এলাকায় ১৯৬৩ সালে নির্মাণ করা হয় স্লুইস গেট। এরপরই ধীরে ধীরে যশোরের তিন উপজেলা মণিরামপুর, কেশবপুর, অভয়নগর, খুলনার দুই উপজেলা ফুলতলা ও ডুমুরিয়া এবং পরে সাতক্ষীরার তালা উপজেলা জলাবদ্ধতার কবলে পড়তে শুরু করে। ১৯৮৬ সাল থেকে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এর মূল কারণ ভবদহের ভাটিতে থাকা নদ-নদীর নাব্য হারানো।

বর্তমান পরিস্থিতি

এ বছর টানা অতিবৃষ্টিতে ভবদহের জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যশোরের মণিরামপুর, কেশবপুর ও অভয়নগর, খুলনার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া এবং সাতক্ষীরার তালা উপজেলার পাঁচ শতাধিক গ্রাম জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন অন্তত চার লাখ মানুষ।

ভবদহ অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, ভবদহের জলাবদ্ধতা এবার প্রকট রূপ নিয়ে জনজীবনে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। বিলের পর বিল, গ্রাম-হাটবাজার তলিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছেন অন্তত ১৫ লাখ মানুষ। হুমকির মুখে পড়েছে জীবন জীবিকা। দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। প্রায় দুমাস ধরে জলাবদ্ধতার ভয়াবহতায় গরু-ছাগল, সাপ-ব্যাঙের সঙ্গে বসবাস করতে হচ্ছে। এমনিতেই বছরের পর বছর ধরে এই পানির সঙ্গেই তাদের এ যুদ্ধ করেই যেতে হয়। উঠানে পানি, ঘরে পানি। তার মধ্যে কী এক অমানবিক জীবন যাপন!

মণিরামপুর উপজেলার জলাবদ্ধ কুলটিয়া গ্রামের রীতা ম-ল নৌকায় বসেছিলেন, পাশে পানিতে নেমে মাছ ধরছিলেন স্বামী আনন্দ ম-ল ও ১৩ বছরের মেয়ে। আরেকটি নৌকায় শহরের মানুষ দেখে বললেন, ‘আমাগের জন্য কিছু নিয়ে আইনছেন?’

সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বললেন, ‘জাগায় (জায়গা মত) একটু কয়ে দিয়েন, আমাগের জন্যি য্যানো কোনো ব্যবস্থা অ্যারে (করে)। এই দ্যাখেন, জলে ভিজে হাত-পায়ের কী অবস্থা! পাক (পচন) ধরেছে।’

একটু এগিয়ে দেখা গেল চারদিকে পানিবেষ্টিত একটি ঘরে উঁচুতে খাট বেঁধে পঙ্গু স্বামীকে নিয়ে বসে আছেন স্বপ্না শিকদার। বললেন, ঘর-বাড়ি ভাইঙে পইড়তেছে। অনেক কষ্টে রান্না কইরে খাচ্ছি আমরা। আমাগের কিছু চাইনে, আমাগের এই জলডাই শুকোয় দেও।

অভয়নগরের জলাবদ্ধ কোটা পশ্চিমপাড়া এলাকার ইয়াসিন শেখের শোয়ার ঘরে পানি ঢুকে গেছে। তিনি বলেন, ‘পরিবার-পরিজন নিয়ে খুব কষ্টে আছি। রান্না করার জায়গাটুকুও নেই।’

টয়লেটে যেতে পারছি না, খেতেও পারছি না। রাতে খাটের নিচে পানি থাকছে, সাপ-ব্যাঙ, পোকামাকড়ের ভয় নিয়ে খাটের উপরে আমরা থাকছি।

অভয়নগর উপজেলা ঘের মালিক সমিতির সভাপতি মো. রবিউল আলম বলেন, ঘেরগুলো ভেসে গেছে, মালিকরা সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন। তাদের পুনর্বাসন দরকার; সরকারি সহায়তা না পেলে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না।

আত্মঘাতী প্রকল্পের খেসারত
ভবদহ অঞ্চলের বাসিন্দাদের দাবি, ছয় দশক আগে প্রকৃতির উপর হস্তক্ষেপ করে এই অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতির উপর যে কুঠারাঘাত করা হয়েছে-তার ফল ভোগ করছেন তারা। স্লুইস গেট-বাঁধ নির্মাণ, নদী শাসনের নামে প্রকৃতির উপরে যে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে তারই দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া এই ভবদহ সঙ্কট। এর সঙ্গে এখন একের পর এক ‘আত্মঘাতী’ প্রকল্পের খেসারত দিতে হচ্ছে ভবদহের মানুষদের। বুঝে-না বুঝে নেয়া এসব প্রকল্প ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে বলে মনে করেন জলাবদ্ধ-উপদ্রুত মানুষ।

স্থানীয়দের ভাষ্য, পুরো এ অঞ্চল জলাবদ্ধতায় ধুঁকছে অনেক বছর ধরে। এর সমাধানে বারবার নেয়া ‘ভুল প্রকল্প’ শুধু রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকারই অপচয় করেনি; বাড়িয়েছে ভুক্তভোগীদের কষ্টের দিন। যে কারণে একটু ভারি বৃষ্টি হলেই ফসলের মাঠ, মাছের ঘের, পুকুর, খাল-বিল উপচে পানি উঠে যায় উঠানে, ঘরে, মসজিদে-মন্দিরে, স্কুলে-কলেজে।

এ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনে কয়েক দশকে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ১৯৯০ থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ভবদহ ঘিরে নেওয়া ২১টি প্রকল্পে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। তারপরও নিরসন হয়নি জলাবদ্ধতা।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই এলাকার পানি ওঠা-নামা করে মুক্তেশ্বরী, টেকা ও হরি নদী দিয়ে। পলি পড়ে এসব নদী হারিয়েছে নাব্য, ভারি বৃষ্টি হলে তা আর ধারণ করতে পারে না নদীগুলো; নদীর চলার পথে শত বাঁধ আর বাধা পানি নামতে দেয় না দক্ষিণে-বঙ্গোপসাগর অভিমুখে।

ভবদহের ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী, এর উত্তরে যশোরের উঁচু অঞ্চল, পলি পড়ে দক্ষিণে খুলনার নিচু অঞ্চলও এখন উঁচু হয়ে গেছে; আর পূর্বে ভৈরব নদের পূর্ব অববাহিকা আগে থেকেই উঁচু এবং পশ্চিমে কপোতাক্ষের পশ্চিম অববাহিকাও অপেক্ষাকৃত উঁচু। ফলে ভবদহ এখন ‘বেসিন’ হয়ে উঠেছে। চার দিকের পানি এই বেসিনে জমে; অথচ নেমে যাওয়ার পথ নেই।

‘ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি’র যুগ্ম আহ্বায়ক গাজী আব্দুল হামিদ বলেন, দীর্ঘ ৪৪ বছর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এই জনপদের মানুষ স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার। ভবদহ স্লুইসগেট প্রস্তাবসহ নদী পানি ব্যবস্থাপনার প্রাকৃতিক ব্যবস্থার উপর হস্তক্ষেপ এর কারণ। এই জনপদে ভবদহ স্লুইসগেট একটি মরণ ফাঁদ, এর কোন কার্যকারিতা এবং তার পানি নিষ্কাশনের ক্ষমতাও নেই। পাম্পের মাধ্যমে সেচ প্রকল্প তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। ২০০/৩০০ ফিট প্রশস্ত ও সুগভীর নদী হত্যা করা হয়েছে। বর্তমানে প্রশস্ত ১৫ থেকে ২৫ ফুট ও নদী ভরাট হয়ে গেছে। ৪৪ বছরে সংস্কারের নামে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় পানি উন্নয়ন বোর্ড ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ও ঠিকাদার চক্রের সিন্ডিকেট লুটপাটের সুবিধার্থেই তা করা হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে।

ভবদহ অঞ্চলের মানুষের এই শোচনীয় অবস্থার জন্য যশোর-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দায়ী করেছেন ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির এই নেতা।

তার অভিযোগ, ‘টাইডাল রিভার ম্যাজেমেন্ট-টিআরএম প্রকল্প বাদ দিয়ে ২০২২ সাল থেকে স্বপন ভট্টাচার্য্যরে মদদে পানি উন্নয়ন বোর্ড যে সেচ প্রকল্প গ্রহণ করেছিল, সেটাই এখন ভোগান্তির কারণ। ওই বছরের ২ জানুয়ারি ও ১৫ নভেম্বর ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকার সেচ প্রকল্প ও প্রস্তাবিত প্রায় ৪৫ কোটি টাকার ‘ভবদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ’ প্রকল্প বাতিলের দাবিতে যশোরে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছিল ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি।

আর জলাবদ্ধতা দূর করতে ‘সেচ প্রকল্প’ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন বলিদাহ-পাঁচাকড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হারুন-অর-রশিদ। তিনি বলেন, ‘তিন উপজেলার ২৭ বিলের পানি নিষ্কাশিত হয় ভবদহের ২১, ৯ ও ৩ ভেন্টের স্লুইস গেট দিয়ে হরি নদীতে। কিন্তু পলিতে ¯¬ুইস গেটগুলো অচল হয়ে থাকায় পানি যাচ্ছে না।’

বর্তমানে আবার স্লুইস গেটগুলো বন্ধ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড সেচ পাম্প বসিয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। এর পরিণতি হিসেবে এই ভয়াবহ জলাবদ্ধতা।

সঙ্কট নিরসনে করণীয় ভাবনা
দীর্ঘদিন ধরেই ভবদহ সমস্যা সমাধানে টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) বা জোয়ারাধার প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলা হচ্ছে। স্থানীয়দের মতে, টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) বা জোয়ারাধার বাস্তবায়নের জনদাবি উপেক্ষা করে সেই অনেক বছর আগে থেকে বাঁধ দেয়া, স্লুইস গেট, সেতু-কালভার্ট, পোল্ডার নির্মাণ করা; ‘ভাগবাটোয়ারা’র অপ্রয়োজনীয় সেচ পাম্প স্থাপন, খননের নামে নদীর মাটি কেটে নদীতে ফেলা; বাঁধ দিয়ে খালগুলো দখল করে নদীর সঙ্গে সংযোগ ছিন্ন করার মত প্রকল্পের জের টানতে হচ্ছে স্থানীয়দের।

স্থানীয়রা এখনও টিআরএম’কেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। টিআরএম-এর ধারণা কৃষকদের কাছ থেকেই পায় সরকার। মূলত ‘জোয়ারাধার’ বা ‘ডাকজোয়ার’ ব্যবস্থাকেই টিআরএম বলা হয়। এই ব্যবস্থায় নদীর পানি বিলে উঠিয়ে বিলের বুক পালি দিয়ে ধীরে ধীরে উঁচু করা যায়। এতে করে একদিকে জলাবদ্ধ বিল ও জনপদের মাটির উচ্চতা বাড়ে, অন্যদিকে নদীর বুক গভীর হয়; স্রোতসহ পানি দক্ষিণের নিচু অঞ্চলে নেমে যেতে পারে।

কিন্তু এখন নদীগুলো ভরাট হওয়ায় এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, টিআরএম করতে গেলে আগে নদী খনন করে জোয়ার-ভাটা স্বাভাবিক করতে হবে বলে মনে করছেন বলিদাহ-পাঁচাকড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আরেক সহকারী শিক্ষক আব্দুস সবুর।

তিনি বলেন, ‘নদী খনন না করলে এই পানি কমবে না। সেচ করে এ জলাবদ্ধতার পানি কমানো যাবে না। টিআরএম প্রকল্প ছিল একমাত্র পরিত্রাণের উপায়। কিন্তু পলি জমে এখন যে অবস্থা তাতে নদী খনন করা ছাড়া উপায় নেই।’

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ জানালেন, জলাবদ্ধতা দূরীকরণে জনগণ উদ্ভাবিত টিআরএম প্রকল্প গণআন্দোলনে গৃহীত হলেও বিগত সরকার ২০১২ সালে ‘সরকারি কর্মকর্তাদের উপর হামলার’ অজুহাতে বাতিল করে দেয়। এখন এই জনপদের মণিরামপুর, কেশবপুর বা অভয়নগর শুধু নয়, জলাবদ্ধতা বিস্তৃত হয়েছে খুলনার ডুমুরিয়া ও যশোর শহর পর্যন্ত।

তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমরা বলেছি, যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে মোহনা পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার নদী অববাহিকার ৪ শতাধিক গ্রাম আবাদ ফসল, বসত বাড়িঘর, রাস্তা-ঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবরখানা, শ্মশান, ব্যবসা-বাণিজ্য পানির তলে চলে যাবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাছে বারংবার স্মারকলিপি প্রদান, অনুরোধ উপরোধ করলেও লুটেরা সিন্ডিকেটের স্বার্থে আমাদের কথায় কর্ণপাত করা হয়নি। উপরন্তু দুর্গত শত শত নারী পুরুষকে লাঠিপেটা করে রক্তাক্ত জখম করা হয়েছে। যে বিপর্যয়ের আশঙ্কার কথা বলে আসছিলাম সে ঘটনাই ঘটে চলেছে।’

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিৎ বাওয়ালি বলছিলেন, ভবদহের পানিবন্দী মানুষের দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৯৮ সালে তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রীর উপস্থিতিতে সরকার এক কনভেনশনে পর্যায়ক্রমে বিলগুলোতে ‘জোয়ারাধার’ বা টিআরএম প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু স্থানীয় লোকজন এবং মাছের ঘের মালিকরা টিআরএমের বিরোধী ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে সরকারি দলের একাংশ ও ঘের মালিকরা জোটবদ্ধ হয়।

তখন টিআরএম-বিরোধীদের সশস্ত্র আক্রমণে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের তৎকালীন হুইপ আব্দুল ওহাব এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা আহত হন। সরকারি গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। সরকার হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং টিআরএম প্রকল্প বাতিল করে দেয়। আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায় ভবদহ জলাবদ্ধ পরিস্থিতি।

কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ‘২০১২ সালের পর আবার নিরঙ্কুশ জনমতের ভিত্তিতে ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে একটি জাতীয় কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।’

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং-আইডব্লিউএম ব্যাপক জরিপ ও জনমত যাচাই করে বিল কপালিয়া ও পর্যায়ক্রমে বিলে বিলে টিআরএম প্রকল্প গ্রহণ করে। ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আকস্মিকভাবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ওই প্রকল্প বাতিল করে নতুন প্রকল্প প্রণয়নের নির্দেশ দেয়।

পানিসম্পদ সচিবের আশ্বাস
সর্বশেষ অন্তর্র্বর্তী সরকারের পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের নির্দেশে গত ১০ অক্টোবর’২৪ জলাবদ্ধতার শিকার হওয়া গ্রামগুলো পরিদর্শন করেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান। তার এই সফরে ছিল সমস্যা সমাধানের টেকনিক্যাল টিমও। তারা দিনভর একদিকে যেমন ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেছেন; অন্যদিকে সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। দ্রুত এই সমস্যা সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাসে ভুক্তভোগীরাও আশান্বিত হয়েছেন।

এদিন বিকেলে যশোর জেলা প্রশাসকের সভাকক্ষে ভবদহপাড়ের বাসিন্দা ও জেলার সুধীসমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান বলেন, ভবদহ এলাকার সমস্যা দীর্ঘ দিনের। গত কয়েক বছরে এ জলাবদ্ধতা বেশি দেখা না দিলেও; এ বছর প্রকট আকারে ধারণ করেছে। আমরা সরেজমিনে ভবদহবাসী দুঃখ দেখেছি। ভুক্তভোগীদের দাবি শুনেছি। দ্রুত পানি নিষ্কাশন দাবির পাশাপাশি ভাটি থেকে নদী খনন, টিআরএম চালু, আমডাঙ্গা খাল খননসহ বিভিন্ন দাবি উঠে এসেছে। টেকনিক্যাল টিম সমস্যা-সঙ্কট ও প্রস্তাবনা সবকিছুই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করবে। এবার স্থায়ীভাবে এই সমস্যা সমাধান করার জন্য বড় প্রকল্প নেওয়া হবে। সেই প্রকল্পেই ভবদহের স্থায়ী সমাধানের হবে বলে তিনি আশ্বাস প্রদান করেন।

খাগড়াছড়ির পানছড়িতে আঞ্চলিক সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে গোলাগুলি, নিহত-১

ছবি

পিলখানা হত্যাকান্ডে ভারত জড়িত ছিলো : এ্যাডভোকেট রাকিন আহমেদ

ছবি

উখিয়ায় ৩১ হাজার ইয়াবাসহ রোহিঙ্গা মাদককারবারী আটক

ছবি

‘সেন্টমার্টিনে রাত্রীযাপন নিষিদ্ধকরণ ও ভ্রমণ সীমিতকরন পর্যটন শিল্পের জন্য হুমকি’

ছবি

গোপালগঞ্জে দুই চেয়ারম্যানের সমর্থকদের সংঘর্ষে ১৫ জন আহত

ছবি

সাভারে কবর থেকে উত্তোলন, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরীর পরিচয় নিশ্চিত করতে ডিএনএ পরীক্ষা

ছবি

শ্রমিকদের পেনশন দিতে শিল্প মালিকদের সহযোগিতা চেয়েছেন শ্রম উপদেষ্টা

ছবি

মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা, দালাল-রোহিঙ্গাসহ আটক ২০

ছবি

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ, দীর্ঘ যানজট

ছবি

প্রথম মোবাইল অপারেটর কোম্পানি সিটিসেল লাইসেন্স ফেরত চায়

ছবি

ফরিদপুর-মীরসরাই : সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের ৩ জন সহ ৮ জনের মৃত্যু

ছবি

মহালছড়িতে প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে বিশেষ নিরাপত্তা সমন্বয় সভা

ছবি

শরীয়তপুরে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানে কঠোর অবস্থানে প্রশাসন

ছবি

বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনে দারাজ

ছবি

রাখাইনে সংঘাত : ওপারে বিস্ফোরণের শব্দ, আকাশে যুদ্ধবিমানের চক্কর

ছবি

আখাউড়া সীমান্ত এলাক‌ায় বি‌জি‌বি অ‌ভিযানে কোটি টাক‌ার চোরাচালান জব্দ

ছবি

আরাকান আর্মি থেকে ১৬ জেলেকে ফেরত আনলো বিজিবি

ছবি

সাবেক এমপি শিখর ও তার স্ত্রীর বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা

ছবি

পূজামণ্ডপে ইসলামি গান: জামিন পেলেন দুই শিল্পী

ছবি

টঙ্গী পূর্ব থানায় দুই মাসে ৪ ওসি

গাজীপুরে শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক টাকা আদায়ের অভিযোগ

ছবি

৬ দিন পর হিলি বন্দরে আমদানি-রপ্তানি শুরু

ছবি

কোন বোর্ডে জিপিএ-৫ কত

ছবি

পাবনায় মদপানে প্রাণ গেলো দুই বন্ধুর

ছবি

ফরিদপুরে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ৫

ছবি

টঙ্গীতে বিটিসিএলের মালামাল চুরিতে পুলিশের জড়িত থাকার অভিযোগ

ছবি

শেরপুর সদর হাসপাতালে ‘মাস হিস্টিরিয়ায়’ আক্রান্ত ৩০ নারী রোগী

ছবি

চুনতি অভয়ারণ্যে ট্রেনের ধাক্কায় আহত মাদি হাতি, পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা

ছবি

সেন্টমার্টিন থেকে ফেরার পথে স্পিডবোট ডুবি, শিশু নিখোঁজ-জীবিত উদ্ধার ৮

ছবি

রাখাইনে সংঘাত : ওপারে বিস্ফোরণের শব্দ, আকাশে যুদ্ধবিমান

ছবি

পূজামণ্ডপে ‘ইসালামী গান’: জামিন শুনানিতে আইনজীবীদের হট্টগোল

ছবি

সীমান্তে বিজিবির পৃথক অভিযানে মালিকবিহীন বার্মিজ গরু ও মালামাল উদ্ধার

ছবি

আখাউড়ায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় দুর্গাপূজা উদযাপিত হয়েছে: ৬০ বিজিবি অধিনায়ক

ছবি

আজ থেকে শুরু হচ্ছে ইলিশ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা

ছবি

৯ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন জাহাজে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে, ৩১ নাবিক জীবিত উদ্ধার

ছবি

টেকনাফ সৈকতে ভেসে এলো পরপইস

tab

সারাদেশ

প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপের পর আত্মঘাতী প্রকল্পের বহর : ভবদহ অঞ্চলে দুর্বিষহ জীবনের শেষ কোথায়

রুকুনউদ্দৌলাহ, যশোর অফিস

ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পানিবন্দী ভবদহ বিলপাড়ের মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে-সংবাদ

বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪

খুলনা বিভাগের তিন জেলার ছয় উপজেলার পাঁচ শতাধিক গ্রামের দুঃখের নাম ‘ভবদহ’। ছয় দশক আগে প্রকৃতির ওপর হস্তক্ষেপ করে এই অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতির উপর যে কুঠারাঘাত করা হয়েছে-তার ফল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভোগ করছেন পনের লক্ষাধিক মানুষ। এর মধ্যে স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার অন্তত চার লাখ মানুষ। প্রায় চার দশক ধরে দুর্ভোগ যেনো নিত্যসঙ্গী তাদের।

কী ভীষণ দুর্বিষহ জীবন যাপন তারা করছেন, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন! মাসের পর মাস জলাবদ্ধতায় গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগিকে সঙ্গী করে সাপ-ব্যাঙের সঙ্গে বসবাস। বিলের পর বিল, গ্রামের পর গ্রাম, হাট-বাজার পানিতে তলিয়ে থাকায় কাজ নেই; নেই ঘরে খাবার। খাবারের জন্য কাঁদছে সন্তান; মায়ের চোখে শুধুই অশ্রু। মারা গেলে সৎকার বা কবরের জায়গা নেই। পানির মধ্যেই বসবাস, তবু খাবার পানি নেই। শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। ছড়িয়ে পড়ছে রোগ-বালাই। অন্তঃসত্ত্বা নারী, প্রসূতি মা, শিশু-বৃদ্ধ সবাই মিলে একত্রে এক-একটি দিন পার করছেন দুর্বিষহ নরক-যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে। অথচ এই জলাবদ্ধতা নিরসনে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে-তা কার্যত কোনো কাজে আসেনি। প্রকল্পের পর প্রকল্পের নামে জলে গেছে হাজার কোটি টাকা-এমনই অভিমত এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের।

শুরুর কথা

১৯৫৫ সালে দক্ষিণাঞ্চলে প্রবল বন্যায় ব্যাপক প্রাণহানি হয় এবং ফসলের ক্ষতি হয়। জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে এই অঞ্চল। এই সঙ্কট নিরসনে ১৯৫৯ সালে কোস্টাল ইমব্যাকমেন্ট প্রজেক্ট- সিইএফ প্রকল্প চালু করা হয়। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল জলোচ্ছ্বাস বা প্লাাবনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে মানুষ এবং ফসল রক্ষ করা। একই লক্ষ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড-ওয়াপদা’র সৃষ্টি করা হয়। এই প্রকল্প-দপ্তরের হাত ধরে যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের ভবদহ এলাকায় ১৯৬৩ সালে নির্মাণ করা হয় স্লুইস গেট। এরপরই ধীরে ধীরে যশোরের তিন উপজেলা মণিরামপুর, কেশবপুর, অভয়নগর, খুলনার দুই উপজেলা ফুলতলা ও ডুমুরিয়া এবং পরে সাতক্ষীরার তালা উপজেলা জলাবদ্ধতার কবলে পড়তে শুরু করে। ১৯৮৬ সাল থেকে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এর মূল কারণ ভবদহের ভাটিতে থাকা নদ-নদীর নাব্য হারানো।

বর্তমান পরিস্থিতি

এ বছর টানা অতিবৃষ্টিতে ভবদহের জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যশোরের মণিরামপুর, কেশবপুর ও অভয়নগর, খুলনার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া এবং সাতক্ষীরার তালা উপজেলার পাঁচ শতাধিক গ্রাম জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন অন্তত চার লাখ মানুষ।

ভবদহ অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, ভবদহের জলাবদ্ধতা এবার প্রকট রূপ নিয়ে জনজীবনে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। বিলের পর বিল, গ্রাম-হাটবাজার তলিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছেন অন্তত ১৫ লাখ মানুষ। হুমকির মুখে পড়েছে জীবন জীবিকা। দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। প্রায় দুমাস ধরে জলাবদ্ধতার ভয়াবহতায় গরু-ছাগল, সাপ-ব্যাঙের সঙ্গে বসবাস করতে হচ্ছে। এমনিতেই বছরের পর বছর ধরে এই পানির সঙ্গেই তাদের এ যুদ্ধ করেই যেতে হয়। উঠানে পানি, ঘরে পানি। তার মধ্যে কী এক অমানবিক জীবন যাপন!

মণিরামপুর উপজেলার জলাবদ্ধ কুলটিয়া গ্রামের রীতা ম-ল নৌকায় বসেছিলেন, পাশে পানিতে নেমে মাছ ধরছিলেন স্বামী আনন্দ ম-ল ও ১৩ বছরের মেয়ে। আরেকটি নৌকায় শহরের মানুষ দেখে বললেন, ‘আমাগের জন্য কিছু নিয়ে আইনছেন?’

সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বললেন, ‘জাগায় (জায়গা মত) একটু কয়ে দিয়েন, আমাগের জন্যি য্যানো কোনো ব্যবস্থা অ্যারে (করে)। এই দ্যাখেন, জলে ভিজে হাত-পায়ের কী অবস্থা! পাক (পচন) ধরেছে।’

একটু এগিয়ে দেখা গেল চারদিকে পানিবেষ্টিত একটি ঘরে উঁচুতে খাট বেঁধে পঙ্গু স্বামীকে নিয়ে বসে আছেন স্বপ্না শিকদার। বললেন, ঘর-বাড়ি ভাইঙে পইড়তেছে। অনেক কষ্টে রান্না কইরে খাচ্ছি আমরা। আমাগের কিছু চাইনে, আমাগের এই জলডাই শুকোয় দেও।

অভয়নগরের জলাবদ্ধ কোটা পশ্চিমপাড়া এলাকার ইয়াসিন শেখের শোয়ার ঘরে পানি ঢুকে গেছে। তিনি বলেন, ‘পরিবার-পরিজন নিয়ে খুব কষ্টে আছি। রান্না করার জায়গাটুকুও নেই।’

টয়লেটে যেতে পারছি না, খেতেও পারছি না। রাতে খাটের নিচে পানি থাকছে, সাপ-ব্যাঙ, পোকামাকড়ের ভয় নিয়ে খাটের উপরে আমরা থাকছি।

অভয়নগর উপজেলা ঘের মালিক সমিতির সভাপতি মো. রবিউল আলম বলেন, ঘেরগুলো ভেসে গেছে, মালিকরা সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন। তাদের পুনর্বাসন দরকার; সরকারি সহায়তা না পেলে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না।

আত্মঘাতী প্রকল্পের খেসারত
ভবদহ অঞ্চলের বাসিন্দাদের দাবি, ছয় দশক আগে প্রকৃতির উপর হস্তক্ষেপ করে এই অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতির উপর যে কুঠারাঘাত করা হয়েছে-তার ফল ভোগ করছেন তারা। স্লুইস গেট-বাঁধ নির্মাণ, নদী শাসনের নামে প্রকৃতির উপরে যে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে তারই দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া এই ভবদহ সঙ্কট। এর সঙ্গে এখন একের পর এক ‘আত্মঘাতী’ প্রকল্পের খেসারত দিতে হচ্ছে ভবদহের মানুষদের। বুঝে-না বুঝে নেয়া এসব প্রকল্প ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে বলে মনে করেন জলাবদ্ধ-উপদ্রুত মানুষ।

স্থানীয়দের ভাষ্য, পুরো এ অঞ্চল জলাবদ্ধতায় ধুঁকছে অনেক বছর ধরে। এর সমাধানে বারবার নেয়া ‘ভুল প্রকল্প’ শুধু রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকারই অপচয় করেনি; বাড়িয়েছে ভুক্তভোগীদের কষ্টের দিন। যে কারণে একটু ভারি বৃষ্টি হলেই ফসলের মাঠ, মাছের ঘের, পুকুর, খাল-বিল উপচে পানি উঠে যায় উঠানে, ঘরে, মসজিদে-মন্দিরে, স্কুলে-কলেজে।

এ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনে কয়েক দশকে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ১৯৯০ থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ভবদহ ঘিরে নেওয়া ২১টি প্রকল্পে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। তারপরও নিরসন হয়নি জলাবদ্ধতা।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই এলাকার পানি ওঠা-নামা করে মুক্তেশ্বরী, টেকা ও হরি নদী দিয়ে। পলি পড়ে এসব নদী হারিয়েছে নাব্য, ভারি বৃষ্টি হলে তা আর ধারণ করতে পারে না নদীগুলো; নদীর চলার পথে শত বাঁধ আর বাধা পানি নামতে দেয় না দক্ষিণে-বঙ্গোপসাগর অভিমুখে।

ভবদহের ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী, এর উত্তরে যশোরের উঁচু অঞ্চল, পলি পড়ে দক্ষিণে খুলনার নিচু অঞ্চলও এখন উঁচু হয়ে গেছে; আর পূর্বে ভৈরব নদের পূর্ব অববাহিকা আগে থেকেই উঁচু এবং পশ্চিমে কপোতাক্ষের পশ্চিম অববাহিকাও অপেক্ষাকৃত উঁচু। ফলে ভবদহ এখন ‘বেসিন’ হয়ে উঠেছে। চার দিকের পানি এই বেসিনে জমে; অথচ নেমে যাওয়ার পথ নেই।

‘ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি’র যুগ্ম আহ্বায়ক গাজী আব্দুল হামিদ বলেন, দীর্ঘ ৪৪ বছর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এই জনপদের মানুষ স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার। ভবদহ স্লুইসগেট প্রস্তাবসহ নদী পানি ব্যবস্থাপনার প্রাকৃতিক ব্যবস্থার উপর হস্তক্ষেপ এর কারণ। এই জনপদে ভবদহ স্লুইসগেট একটি মরণ ফাঁদ, এর কোন কার্যকারিতা এবং তার পানি নিষ্কাশনের ক্ষমতাও নেই। পাম্পের মাধ্যমে সেচ প্রকল্প তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। ২০০/৩০০ ফিট প্রশস্ত ও সুগভীর নদী হত্যা করা হয়েছে। বর্তমানে প্রশস্ত ১৫ থেকে ২৫ ফুট ও নদী ভরাট হয়ে গেছে। ৪৪ বছরে সংস্কারের নামে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় পানি উন্নয়ন বোর্ড ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ও ঠিকাদার চক্রের সিন্ডিকেট লুটপাটের সুবিধার্থেই তা করা হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে।

ভবদহ অঞ্চলের মানুষের এই শোচনীয় অবস্থার জন্য যশোর-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দায়ী করেছেন ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির এই নেতা।

তার অভিযোগ, ‘টাইডাল রিভার ম্যাজেমেন্ট-টিআরএম প্রকল্প বাদ দিয়ে ২০২২ সাল থেকে স্বপন ভট্টাচার্য্যরে মদদে পানি উন্নয়ন বোর্ড যে সেচ প্রকল্প গ্রহণ করেছিল, সেটাই এখন ভোগান্তির কারণ। ওই বছরের ২ জানুয়ারি ও ১৫ নভেম্বর ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকার সেচ প্রকল্প ও প্রস্তাবিত প্রায় ৪৫ কোটি টাকার ‘ভবদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ’ প্রকল্প বাতিলের দাবিতে যশোরে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছিল ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি।

আর জলাবদ্ধতা দূর করতে ‘সেচ প্রকল্প’ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন বলিদাহ-পাঁচাকড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হারুন-অর-রশিদ। তিনি বলেন, ‘তিন উপজেলার ২৭ বিলের পানি নিষ্কাশিত হয় ভবদহের ২১, ৯ ও ৩ ভেন্টের স্লুইস গেট দিয়ে হরি নদীতে। কিন্তু পলিতে ¯¬ুইস গেটগুলো অচল হয়ে থাকায় পানি যাচ্ছে না।’

বর্তমানে আবার স্লুইস গেটগুলো বন্ধ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড সেচ পাম্প বসিয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। এর পরিণতি হিসেবে এই ভয়াবহ জলাবদ্ধতা।

সঙ্কট নিরসনে করণীয় ভাবনা
দীর্ঘদিন ধরেই ভবদহ সমস্যা সমাধানে টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) বা জোয়ারাধার প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলা হচ্ছে। স্থানীয়দের মতে, টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) বা জোয়ারাধার বাস্তবায়নের জনদাবি উপেক্ষা করে সেই অনেক বছর আগে থেকে বাঁধ দেয়া, স্লুইস গেট, সেতু-কালভার্ট, পোল্ডার নির্মাণ করা; ‘ভাগবাটোয়ারা’র অপ্রয়োজনীয় সেচ পাম্প স্থাপন, খননের নামে নদীর মাটি কেটে নদীতে ফেলা; বাঁধ দিয়ে খালগুলো দখল করে নদীর সঙ্গে সংযোগ ছিন্ন করার মত প্রকল্পের জের টানতে হচ্ছে স্থানীয়দের।

স্থানীয়রা এখনও টিআরএম’কেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। টিআরএম-এর ধারণা কৃষকদের কাছ থেকেই পায় সরকার। মূলত ‘জোয়ারাধার’ বা ‘ডাকজোয়ার’ ব্যবস্থাকেই টিআরএম বলা হয়। এই ব্যবস্থায় নদীর পানি বিলে উঠিয়ে বিলের বুক পালি দিয়ে ধীরে ধীরে উঁচু করা যায়। এতে করে একদিকে জলাবদ্ধ বিল ও জনপদের মাটির উচ্চতা বাড়ে, অন্যদিকে নদীর বুক গভীর হয়; স্রোতসহ পানি দক্ষিণের নিচু অঞ্চলে নেমে যেতে পারে।

কিন্তু এখন নদীগুলো ভরাট হওয়ায় এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, টিআরএম করতে গেলে আগে নদী খনন করে জোয়ার-ভাটা স্বাভাবিক করতে হবে বলে মনে করছেন বলিদাহ-পাঁচাকড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আরেক সহকারী শিক্ষক আব্দুস সবুর।

তিনি বলেন, ‘নদী খনন না করলে এই পানি কমবে না। সেচ করে এ জলাবদ্ধতার পানি কমানো যাবে না। টিআরএম প্রকল্প ছিল একমাত্র পরিত্রাণের উপায়। কিন্তু পলি জমে এখন যে অবস্থা তাতে নদী খনন করা ছাড়া উপায় নেই।’

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ জানালেন, জলাবদ্ধতা দূরীকরণে জনগণ উদ্ভাবিত টিআরএম প্রকল্প গণআন্দোলনে গৃহীত হলেও বিগত সরকার ২০১২ সালে ‘সরকারি কর্মকর্তাদের উপর হামলার’ অজুহাতে বাতিল করে দেয়। এখন এই জনপদের মণিরামপুর, কেশবপুর বা অভয়নগর শুধু নয়, জলাবদ্ধতা বিস্তৃত হয়েছে খুলনার ডুমুরিয়া ও যশোর শহর পর্যন্ত।

তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমরা বলেছি, যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে মোহনা পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার নদী অববাহিকার ৪ শতাধিক গ্রাম আবাদ ফসল, বসত বাড়িঘর, রাস্তা-ঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবরখানা, শ্মশান, ব্যবসা-বাণিজ্য পানির তলে চলে যাবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাছে বারংবার স্মারকলিপি প্রদান, অনুরোধ উপরোধ করলেও লুটেরা সিন্ডিকেটের স্বার্থে আমাদের কথায় কর্ণপাত করা হয়নি। উপরন্তু দুর্গত শত শত নারী পুরুষকে লাঠিপেটা করে রক্তাক্ত জখম করা হয়েছে। যে বিপর্যয়ের আশঙ্কার কথা বলে আসছিলাম সে ঘটনাই ঘটে চলেছে।’

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিৎ বাওয়ালি বলছিলেন, ভবদহের পানিবন্দী মানুষের দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৯৮ সালে তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রীর উপস্থিতিতে সরকার এক কনভেনশনে পর্যায়ক্রমে বিলগুলোতে ‘জোয়ারাধার’ বা টিআরএম প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু স্থানীয় লোকজন এবং মাছের ঘের মালিকরা টিআরএমের বিরোধী ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে সরকারি দলের একাংশ ও ঘের মালিকরা জোটবদ্ধ হয়।

তখন টিআরএম-বিরোধীদের সশস্ত্র আক্রমণে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের তৎকালীন হুইপ আব্দুল ওহাব এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা আহত হন। সরকারি গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। সরকার হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং টিআরএম প্রকল্প বাতিল করে দেয়। আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায় ভবদহ জলাবদ্ধ পরিস্থিতি।

কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, ‘২০১২ সালের পর আবার নিরঙ্কুশ জনমতের ভিত্তিতে ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে একটি জাতীয় কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।’

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং-আইডব্লিউএম ব্যাপক জরিপ ও জনমত যাচাই করে বিল কপালিয়া ও পর্যায়ক্রমে বিলে বিলে টিআরএম প্রকল্প গ্রহণ করে। ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আকস্মিকভাবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ওই প্রকল্প বাতিল করে নতুন প্রকল্প প্রণয়নের নির্দেশ দেয়।

পানিসম্পদ সচিবের আশ্বাস
সর্বশেষ অন্তর্র্বর্তী সরকারের পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের নির্দেশে গত ১০ অক্টোবর’২৪ জলাবদ্ধতার শিকার হওয়া গ্রামগুলো পরিদর্শন করেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান। তার এই সফরে ছিল সমস্যা সমাধানের টেকনিক্যাল টিমও। তারা দিনভর একদিকে যেমন ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলেছেন; অন্যদিকে সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। দ্রুত এই সমস্যা সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাসে ভুক্তভোগীরাও আশান্বিত হয়েছেন।

এদিন বিকেলে যশোর জেলা প্রশাসকের সভাকক্ষে ভবদহপাড়ের বাসিন্দা ও জেলার সুধীসমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান বলেন, ভবদহ এলাকার সমস্যা দীর্ঘ দিনের। গত কয়েক বছরে এ জলাবদ্ধতা বেশি দেখা না দিলেও; এ বছর প্রকট আকারে ধারণ করেছে। আমরা সরেজমিনে ভবদহবাসী দুঃখ দেখেছি। ভুক্তভোগীদের দাবি শুনেছি। দ্রুত পানি নিষ্কাশন দাবির পাশাপাশি ভাটি থেকে নদী খনন, টিআরএম চালু, আমডাঙ্গা খাল খননসহ বিভিন্ন দাবি উঠে এসেছে। টেকনিক্যাল টিম সমস্যা-সঙ্কট ও প্রস্তাবনা সবকিছুই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করবে। এবার স্থায়ীভাবে এই সমস্যা সমাধান করার জন্য বড় প্রকল্প নেওয়া হবে। সেই প্রকল্পেই ভবদহের স্থায়ী সমাধানের হবে বলে তিনি আশ্বাস প্রদান করেন।

back to top