alt

সারাদেশ

তরমুজে স্বপ্ন বুনছেন খুলনার চাষিরা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক, খুলনা : রোববার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

খুলনা : তরমুজ খেতে ব্যস্ত শ্রমিকরা -সংবাদ

অল্প সময় আর কম বিনিয়োগে বেশি লাভ হওয়ায় খুলনার উপকূলীয় পাঁচ উপজেলার বিস্তৃর্ণ এলাকার কৃষিজমিতে এখন চলছে তরমুজ আবাদের কর্মযজ্ঞ। কোথাও বীজ রোপণের কাজ চলছে, কোথাও আবার সার, পানি ও কীটনাশক ছিটাচ্ছেন কৃষক। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মাঠে মাঠে চলছে এমন ব্যস্ততা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবং ভালো দাম মিললে অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকার তরমুজ বিক্রির আশা সংশ্লিষ্টদের।

জেলার কয়েকটি উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, তরমুজ আবাদে জমি প্রস্তুতির কাজ শেষে বীজ রোপণ করা হচ্ছে। নারীরা সারিবদ্ধভাবে জমিতে তরমুজের বীজ বসিয়ে দিচ্ছেন। কিছু জমিতে বীজ রোপণ শেষ হওয়ায় সেখানে অনবরত পানি ছিটানো হচ্ছে। দূরের খালে কিংবা পুকুরে জমা পানি সেচযন্ত্রের সাহায্যে পাইপ দিয়ে আনা হচ্ছে খেতে। অনেকে তরমুজ খেত পাহারা দিতে খেতের মধ্যে থাকার জন্য ছোট ছোট ঘর করেছেন।

খুলনার সুন্দরবন-সংলগ্ন কয়রা উপজেলার হরিনগর বিলের একটি খেতে বীজ রোপণ করতে থাকা এক নারী বলেন, সারা বেলা ৪০০ টাকা মজুরিতে কাজ করছেন তারা। তিনি বলেন, তরমুজ চাষের মৌসুম শুরু হলে এই এলাকার নারীরা ঘরের কাজ শেষে প্রতিদিনের মজুরিতে কাজ করে কয়েক হাজার টাকা আয় করেন। উপজেলাটির মহারাজপুর, মহেশ্বরীপুর, আমাদী, চণ্ডীপুর, খিরোল, কিনুকাটি, পাটনিখালীর বিলে তরমুজ চাষ হচ্ছে বলে জানান তিনি।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ধান চাষের চেয়ে তরমুজে লাভ বেশি। ধানের বীজ বোনা থেকে শুরু করে ফসল ঘরে তুলতে অন্তত পাঁচ মাস সময় লাগে। এরপর খরচ বাদে এক বিঘা জমির ধান বিক্রি করে লাভ হয় সর্বোচ্চ ৯ হাজার টাকা। অন্যদিকে তরমুজের বীজ রোপণ থেকে পাকা তরমুজ সংগ্রহ পর্যন্ত সময় লাগে সর্বোচ্চ আড়াই মাস। প্রতি বিঘায় খরচ হয় ২০-২৫ হাজার টাকা। আর ভাগ্য ভালো হলে তরমুজ বিক্রি হয় ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায়। তরমুজ উপকূলীয় কৃষি অর্থনীতি সমৃদ্ধির পাশাপাশি প্রন্তিক মানুষেরও মৌসুমী কাজের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, গত কয়েক বছর এ অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতির সমৃদ্ধিতে নতুনমাত্রা যোগ করেছে তরমুজ। বিভাগের মধ্যে খুলনা জেলায় সবচেয়ে বেশি তরমুজের চাষ হয়। এখানকার তরমুজ মিষ্টি ও সুস্বাদু হওয়ায় জনপ্রিয় সারাদেশে। ভালো লাভ হওয়ায় চাষও বাড়ছে। খুলনায় ড্রাগন, ড্রাগন সুপার, আস্থা, আস্থা প্লাস, পাকিজা, মালিক-১, এশিয়া সুপার, থাই রেড কিং, বিগ সুপার কিং ও বাংলালিংক জাতের তরমুজ চাষ করছে চাষিরা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ রবি মৌসুমে জেলায় আবাদকৃত জমির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৩ হাজার হেক্টর। যেখানে তরমুজ উৎপাদন হয় ৫ লাখ ৩৩ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন। যার বাজারমূল্য ছিল ১ হাজার ৪৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। চলতি মৌসুমেও গত বছরের মতো একই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

জেলার আবাদ হওয়া উপজেলাগুলোর কৃষি সম্প্রসারণ অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত দাকোপে ৮ হাজার হেক্টর, কয়রায় ৪ হাজার ২০০ হেক্টর, পাইকগাছায় ১ হাজার ৬০০ হেক্টর, ডুমুরিয়ায় ৫০০ হেক্টর, বটিয়াঘাটায় ২ হাজার ৭০০ হেক্টর জমি চাষাবাদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। জেলায় সব মিলিয়ে ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হতে যাচ্ছে। সে হিসেবে তরমুজ উৎপাদন হবে ৭ লাখ মেট্রিক টন।

গত বছরের দর হিসেবে যার বাজারমূল্য দাঁড়াবে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনার উপপরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা, কয়রা, পাইকগাছা ও ডুমুরিয়ার তরমুজ চাষিরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। মহাসমারোহে শুরু হয়েছে তরমুজ চাষের কর্মযজ্ঞ। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের মাধ্যমে কৃষকদের নিয়ে উঠান বৈঠক, ভ্রাম্যমাণ কৃষি পরামর্শ এবং কৃষকদের নিয়ে ব্লকভিত্তিক মিটিং করা হচ্ছে।

জাহাঙ্গীর হোসেন আরও বলেন, শুষ্ক মৌসুমে উপকূলের মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যায়। গত পাঁচ বছর আগেও জমিগুলো আমন ধান চাষের পর অনাবাদি পড়ে থাকত। এখন সেই জমিগুলোই স্বপ্ন দেখাচ্ছে উপকূলের কয়েকটি উপজেলার চাষিদের। অল্প সময়ে বিনিয়োগের তিনগুণ লাভ হওয়ায় দিন দিন কৃষক ঝুঁকছেন তরমুজ চাষে। তরমুজে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে খুলনার লবণাক্ত উপকূলের কৃষি অর্থনীতি। আশা করছি এবারও কৃষকরা লাভবান হবেন।

দাকোপ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, জেলার মোট উৎপাদিত তরমুজের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ চাষ হয় এ উপজেলায়। গত মৌসুমে দাকোপে ৫ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হলেও এবার ২ হাজার ৩০০ হেক্টর বেড়ে চাষাবাদ হচ্ছে ৮ হাজার হেক্টর জমিতে। তিনি বলেন, কৃষকদের সার্বিক পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি আমরা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বাম্পার ফলন হবে।

দাকোপ উপজেলার বাজুয়া ইউনিয়নের রায়বাড়ি এলাকার তরমুজচাষি সবুজ রায় বলেন, বিভাগের মধ্যে দাকোপেই প্রথমে তরমুজের চাষ শুরু হয়। এখানকার তরমুজ মিষ্টি ও সুস্বাদু হওয়ায় জনপ্রিয় সারাদেশে। তার খেতে তরমুজের চারা থেকে ৩-৪টি করে পাতা বের হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবারও ফলন ভালো আশা করছেন তিনি।

এ উপজেলার কৈলাশগঞ্জ এলাকার সিন্ধু রায় বলেন, স্থানীয় দালাল, ফড়িয়া, পরিবহন সিন্ডিকেট, ফেরিঘাটে যানযটে ট্রাকের দীর্ঘ লাইন এবং ঘাটে অতিরিক্ত টোল আদায় না হলে চাষিরা প্রতি বছর তরমুজ মৌসুমে আরও লাভবান হতেন। বাজারে ভালো বীজের সহজলভ্যতা নিশ্চিতের পাশাপাশি নদী-খালের ইজারা অবুমক্ত এবং খনন করে তরমুজ চাষের জন্য সেচ ব্যবস্থার দাবি জানান তিনি।

পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের দারুণ মল্লিক গ্রামের বরুণ মন্ডল বলেন, গতবছর ১১ বিঘা জমিতে তরমুজের চাষ করেছিলাম। ফলন ভালো হওয়ায় এবার ২০ বিঘা জমিতে আবাদ করেছি। তবে গত বছরের তুলনায় এবার খরচ অনেক বেড়েছে।

এ উপজেলার গড়ইখালী ইউপির দক্ষিণ আমীরপুর গ্রামের সনত সরদার বলেন, কম বিনিয়োগ আর কম পরিশ্রমে বেশি লাভ হওয়ায় তরমুজ চাষে আগ্রহও বাড়ছে কৃষকদের। তরমুজ চাষের শেষ সময়ে সেচ সংকট তীব্র হয়ে ওঠে। তখন উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। তবে এর বিপণন ব্যবস্থাও তেমন উন্নত নয়।

কয়রার সাতালিয়া পূর্ব বিলের কৃষক মিজানুর রহমান বাবু বলেন, ভালো ফলনের আশায় ধার দেনা করে এ বছর ৩৬ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছি। খেতে বীজ থেকে ছোট ছোট পাতা বের হওয়া শুরু হয়েছে। আবহাওয়া শেষ পর্যন্ত অনুকূলে থাকলে উৎপাদনও ভালো হবে বলে আশা করছি।

এ উপজেলার কৃষি দপ্তর সূত্রে জানা যায়, সুন্দরবন-সংলগ্ন উপজেলাটির অধিকাংশ জমির লবণাক্ততার মাত্রা বেশি। ফলে একসময় শুধু আমন ধান ছাড়া কোনো ফসল হতো না। তবে এখন লবণসহিষ্ণু জাতের তরমুজ চাষ হচ্ছে। ২০২০ সালে এ উপজেলায় ৬৫ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছিল।

২০২১ সালে চাষ হয় ৬৫০ হেক্টর জমিতে। ২০২২ সালে তরমুজ আবাদের জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৯৫ হেক্টরে। ২০২৩ সালে আবাদ হয় ১ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে। আর ২০২৪ সালে আবাদের জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৯৩০ হেক্টরে। আর চলতি বছর সবচেয়ে বেশি ৪ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করছেন কৃষকরা।

ছবি

গ্রামগঞ্জে বাঁশি বিক্রি করেই চলে আমিরের সংসার

ছবি

বেড়িবাঁধ কেটে রাস্তা: অভিযোগ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে

ছবি

ক্যাম্পসের ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে সেবা পেল প্রায় ৩৫০০ মানুষ

সোনারগাঁয়ে এসি বিষ্ফোরণে ২ জন নিহত

ছবি

নেত্রকোনায় বাঁশি তৈরির কারিগর আমিরের মানবেতর জীবনযাপন

ছবি

পলাশে আমের মুকুলের মৌ মৌ গন্ধে সুরভিত চারিদিক

ছবি

চা শিল্পের অগ্রগতির প্রতীক শ্রীমঙ্গলের ‘ফিনলে রানওয়ে’

সৈয়দপুরে সতীর্থের ৩ দিনের বইমেলার সমাপ্তি

নোয়াখালীতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেমাই তৈরি, জরিমানা

ছবি

জাতীয় পতাকা নিয়ে হেঁটে দেশ ভ্রমণে দুই হাফেজ

মোরেলগঞ্জে এক গৃহবধূর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

রাজবাড়ী আ’লীগের সহসভাপতি জব্বার ফকির গ্রেপ্তার

নিখোঁজের তিন দিন পর ইমামের মরদেহ উদ্ধার

চাঁপাইনবাবগঞ্জে কেঁচো সার উদ্বুদ্ধকরণে কৃষক প্রশিক্ষণ

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হত্যাচেষ্টা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ

মান্দার নিভৃত পল্লীতে অনন্য বইমেলা

গ্রাম আদালত সক্রিয়করণে বিভাগীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত

ডিমলায় ছাত্রলীগের দুই নেতা গ্রেপ্তার

পারিবারিক পুষ্টি বাগান স্থাপনে উঠান বৈঠক

চলন্ত বাসে ডাকাতি ও শ্লীলতাহানির ২ আসামি জবানবন্দির পর কারাগারে

পিরোজপুরে বৈঠাকাটা নামে নতুন উপজেলা গঠনের উদ্যোগ

‘বিচার বিভাগ সংস্কার কার্যক্রমে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছে’

সুন্দরবনে মাছ ধরার দায়ে ৮ নৌকাসহ ১৮ জেলে আটক

ছবি

ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা শেষ করে কুমিল্লা-নোয়াখালী সড়কের কাজ সম্পন্নের দাবি

ছবি

আট বছরেও স্থায়ী ক্যাম্পাস পায়নি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়

কলারোয়ায় সাজাপ্রাপ্ত যুবদল নেতা গ্রেপ্তার

পত্নীতলা রাস্তায় গাছ ফেলে ভয়াবহ ডাকাতি

যৌনপল্লী থেকে বিদেশি পিস্তলসহ গ্রেপ্তার ১

ডেভিল হান্ট অভিযান বাগেরহাটে গ্রেপ্তার ৮

ধর্মপাশায় ঘরের আড়ায় ঝুলে যুবকের আত্মহত্যা

ছবি

খোকসায় অপর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকায় ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্প ব্যর্থ হতে বসেছে

ছবি

সিংড়ায় পানি সেচে বাধা, তিন ফসলি জমি অনাবাদি

বিয়ে বাড়িতে উচ্চস্বরে গান বাজানো নিয়ে সংঘর্ষ, নিহত ১

লিবিয়ায় মাফিয়াদের বিষাক্ত ইনজেকশন নাসিরনগরের যুবকের মৃত্যু

বোয়ালখালীতে পোশাক কারখানায় আগুন

ছবি

রোভার স্কাউটসের চার সদস্য চট্টগ্রাম থেকে হেঁটে যাবেন কক্সবাজার

tab

সারাদেশ

তরমুজে স্বপ্ন বুনছেন খুলনার চাষিরা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক, খুলনা

খুলনা : তরমুজ খেতে ব্যস্ত শ্রমিকরা -সংবাদ

রোববার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

অল্প সময় আর কম বিনিয়োগে বেশি লাভ হওয়ায় খুলনার উপকূলীয় পাঁচ উপজেলার বিস্তৃর্ণ এলাকার কৃষিজমিতে এখন চলছে তরমুজ আবাদের কর্মযজ্ঞ। কোথাও বীজ রোপণের কাজ চলছে, কোথাও আবার সার, পানি ও কীটনাশক ছিটাচ্ছেন কৃষক। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মাঠে মাঠে চলছে এমন ব্যস্ততা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবং ভালো দাম মিললে অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকার তরমুজ বিক্রির আশা সংশ্লিষ্টদের।

জেলার কয়েকটি উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, তরমুজ আবাদে জমি প্রস্তুতির কাজ শেষে বীজ রোপণ করা হচ্ছে। নারীরা সারিবদ্ধভাবে জমিতে তরমুজের বীজ বসিয়ে দিচ্ছেন। কিছু জমিতে বীজ রোপণ শেষ হওয়ায় সেখানে অনবরত পানি ছিটানো হচ্ছে। দূরের খালে কিংবা পুকুরে জমা পানি সেচযন্ত্রের সাহায্যে পাইপ দিয়ে আনা হচ্ছে খেতে। অনেকে তরমুজ খেত পাহারা দিতে খেতের মধ্যে থাকার জন্য ছোট ছোট ঘর করেছেন।

খুলনার সুন্দরবন-সংলগ্ন কয়রা উপজেলার হরিনগর বিলের একটি খেতে বীজ রোপণ করতে থাকা এক নারী বলেন, সারা বেলা ৪০০ টাকা মজুরিতে কাজ করছেন তারা। তিনি বলেন, তরমুজ চাষের মৌসুম শুরু হলে এই এলাকার নারীরা ঘরের কাজ শেষে প্রতিদিনের মজুরিতে কাজ করে কয়েক হাজার টাকা আয় করেন। উপজেলাটির মহারাজপুর, মহেশ্বরীপুর, আমাদী, চণ্ডীপুর, খিরোল, কিনুকাটি, পাটনিখালীর বিলে তরমুজ চাষ হচ্ছে বলে জানান তিনি।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ধান চাষের চেয়ে তরমুজে লাভ বেশি। ধানের বীজ বোনা থেকে শুরু করে ফসল ঘরে তুলতে অন্তত পাঁচ মাস সময় লাগে। এরপর খরচ বাদে এক বিঘা জমির ধান বিক্রি করে লাভ হয় সর্বোচ্চ ৯ হাজার টাকা। অন্যদিকে তরমুজের বীজ রোপণ থেকে পাকা তরমুজ সংগ্রহ পর্যন্ত সময় লাগে সর্বোচ্চ আড়াই মাস। প্রতি বিঘায় খরচ হয় ২০-২৫ হাজার টাকা। আর ভাগ্য ভালো হলে তরমুজ বিক্রি হয় ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায়। তরমুজ উপকূলীয় কৃষি অর্থনীতি সমৃদ্ধির পাশাপাশি প্রন্তিক মানুষেরও মৌসুমী কাজের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, গত কয়েক বছর এ অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতির সমৃদ্ধিতে নতুনমাত্রা যোগ করেছে তরমুজ। বিভাগের মধ্যে খুলনা জেলায় সবচেয়ে বেশি তরমুজের চাষ হয়। এখানকার তরমুজ মিষ্টি ও সুস্বাদু হওয়ায় জনপ্রিয় সারাদেশে। ভালো লাভ হওয়ায় চাষও বাড়ছে। খুলনায় ড্রাগন, ড্রাগন সুপার, আস্থা, আস্থা প্লাস, পাকিজা, মালিক-১, এশিয়া সুপার, থাই রেড কিং, বিগ সুপার কিং ও বাংলালিংক জাতের তরমুজ চাষ করছে চাষিরা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ রবি মৌসুমে জেলায় আবাদকৃত জমির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৩ হাজার হেক্টর। যেখানে তরমুজ উৎপাদন হয় ৫ লাখ ৩৩ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন। যার বাজারমূল্য ছিল ১ হাজার ৪৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। চলতি মৌসুমেও গত বছরের মতো একই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

জেলার আবাদ হওয়া উপজেলাগুলোর কৃষি সম্প্রসারণ অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত দাকোপে ৮ হাজার হেক্টর, কয়রায় ৪ হাজার ২০০ হেক্টর, পাইকগাছায় ১ হাজার ৬০০ হেক্টর, ডুমুরিয়ায় ৫০০ হেক্টর, বটিয়াঘাটায় ২ হাজার ৭০০ হেক্টর জমি চাষাবাদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। জেলায় সব মিলিয়ে ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হতে যাচ্ছে। সে হিসেবে তরমুজ উৎপাদন হবে ৭ লাখ মেট্রিক টন।

গত বছরের দর হিসেবে যার বাজারমূল্য দাঁড়াবে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনার উপপরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা, কয়রা, পাইকগাছা ও ডুমুরিয়ার তরমুজ চাষিরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। মহাসমারোহে শুরু হয়েছে তরমুজ চাষের কর্মযজ্ঞ। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের মাধ্যমে কৃষকদের নিয়ে উঠান বৈঠক, ভ্রাম্যমাণ কৃষি পরামর্শ এবং কৃষকদের নিয়ে ব্লকভিত্তিক মিটিং করা হচ্ছে।

জাহাঙ্গীর হোসেন আরও বলেন, শুষ্ক মৌসুমে উপকূলের মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যায়। গত পাঁচ বছর আগেও জমিগুলো আমন ধান চাষের পর অনাবাদি পড়ে থাকত। এখন সেই জমিগুলোই স্বপ্ন দেখাচ্ছে উপকূলের কয়েকটি উপজেলার চাষিদের। অল্প সময়ে বিনিয়োগের তিনগুণ লাভ হওয়ায় দিন দিন কৃষক ঝুঁকছেন তরমুজ চাষে। তরমুজে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে খুলনার লবণাক্ত উপকূলের কৃষি অর্থনীতি। আশা করছি এবারও কৃষকরা লাভবান হবেন।

দাকোপ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, জেলার মোট উৎপাদিত তরমুজের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ চাষ হয় এ উপজেলায়। গত মৌসুমে দাকোপে ৫ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হলেও এবার ২ হাজার ৩০০ হেক্টর বেড়ে চাষাবাদ হচ্ছে ৮ হাজার হেক্টর জমিতে। তিনি বলেন, কৃষকদের সার্বিক পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি আমরা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বাম্পার ফলন হবে।

দাকোপ উপজেলার বাজুয়া ইউনিয়নের রায়বাড়ি এলাকার তরমুজচাষি সবুজ রায় বলেন, বিভাগের মধ্যে দাকোপেই প্রথমে তরমুজের চাষ শুরু হয়। এখানকার তরমুজ মিষ্টি ও সুস্বাদু হওয়ায় জনপ্রিয় সারাদেশে। তার খেতে তরমুজের চারা থেকে ৩-৪টি করে পাতা বের হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবারও ফলন ভালো আশা করছেন তিনি।

এ উপজেলার কৈলাশগঞ্জ এলাকার সিন্ধু রায় বলেন, স্থানীয় দালাল, ফড়িয়া, পরিবহন সিন্ডিকেট, ফেরিঘাটে যানযটে ট্রাকের দীর্ঘ লাইন এবং ঘাটে অতিরিক্ত টোল আদায় না হলে চাষিরা প্রতি বছর তরমুজ মৌসুমে আরও লাভবান হতেন। বাজারে ভালো বীজের সহজলভ্যতা নিশ্চিতের পাশাপাশি নদী-খালের ইজারা অবুমক্ত এবং খনন করে তরমুজ চাষের জন্য সেচ ব্যবস্থার দাবি জানান তিনি।

পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের দারুণ মল্লিক গ্রামের বরুণ মন্ডল বলেন, গতবছর ১১ বিঘা জমিতে তরমুজের চাষ করেছিলাম। ফলন ভালো হওয়ায় এবার ২০ বিঘা জমিতে আবাদ করেছি। তবে গত বছরের তুলনায় এবার খরচ অনেক বেড়েছে।

এ উপজেলার গড়ইখালী ইউপির দক্ষিণ আমীরপুর গ্রামের সনত সরদার বলেন, কম বিনিয়োগ আর কম পরিশ্রমে বেশি লাভ হওয়ায় তরমুজ চাষে আগ্রহও বাড়ছে কৃষকদের। তরমুজ চাষের শেষ সময়ে সেচ সংকট তীব্র হয়ে ওঠে। তখন উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। তবে এর বিপণন ব্যবস্থাও তেমন উন্নত নয়।

কয়রার সাতালিয়া পূর্ব বিলের কৃষক মিজানুর রহমান বাবু বলেন, ভালো ফলনের আশায় ধার দেনা করে এ বছর ৩৬ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছি। খেতে বীজ থেকে ছোট ছোট পাতা বের হওয়া শুরু হয়েছে। আবহাওয়া শেষ পর্যন্ত অনুকূলে থাকলে উৎপাদনও ভালো হবে বলে আশা করছি।

এ উপজেলার কৃষি দপ্তর সূত্রে জানা যায়, সুন্দরবন-সংলগ্ন উপজেলাটির অধিকাংশ জমির লবণাক্ততার মাত্রা বেশি। ফলে একসময় শুধু আমন ধান ছাড়া কোনো ফসল হতো না। তবে এখন লবণসহিষ্ণু জাতের তরমুজ চাষ হচ্ছে। ২০২০ সালে এ উপজেলায় ৬৫ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছিল।

২০২১ সালে চাষ হয় ৬৫০ হেক্টর জমিতে। ২০২২ সালে তরমুজ আবাদের জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৯৫ হেক্টরে। ২০২৩ সালে আবাদ হয় ১ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে। আর ২০২৪ সালে আবাদের জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৯৩০ হেক্টরে। আর চলতি বছর সবচেয়ে বেশি ৪ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করছেন কৃষকরা।

back to top