কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের অতীত ঐতিহ্য। আর যা কিছু টিকে আছে তাও শতাব্দীর কঙ্কাল হয়ে। রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার যোগীপাড়া ইউয়িনের বীরকুৎসা জমিদার বাড়িটি দেশের একমাত্র ‘হাজার দুয়ারী’ জমিদার বাড়ি। সংরক্ষনের অভাবে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে এটি। জমিদারি প্রথা চালু থাকাকালীন সময়ে বীরকুৎসা ছিল একটি পরগনা। এর জমিদার ছিলেন ভারতের কাশী থেকে আসা বিরেশ্বর বন্দোপাধ্যায় বিরু বাবু। জানা গেছে, পার্শ্ববর্তী আত্রাই উপজেলার আমরুল ডিহি বিশার রাজা ছিলেন গোপাল ধাম। প্রভাতী রানী নামে তার এক রুপসী কন্যা ছিল। রাজ জামাতা হবার সুবাদে রাজা গোপাল ধাম বিরেশ্বর বন্দোপাধ্যায় ও রাজকন্যা প্রভাতী রানীর নামে বীরকুৎসা পরগনা হস্তান্তর করেন। প্রভাতী রানী ছিলেন খুবই সৌখিন। তার পছন্দ মত স্বামী বিরু বাবু বীরকুৎসায় গড়ে তোলেন একটি সুরম্য অট্টালিকা। এই বিশাল বাড়িটিতে আছে হাজারটি দুয়ার। আর একারনেই এটি হাজার দুয়ারী নামে পরিচিতি লাভ করে। দুয়ারগুলো সেগুন কাঠে কারকার্য খচিত। অট্রালিকার পুরো মেঝে ছিল শ্বেত পাথরে ঢাঁকা। দরজা গুলো তিন স্তরে আবৃত ছিল। প্রথমে কাঠের,পরে লোহারগ্রীলের ও শেষে দামি কাঁচে আবৃত ছিল। জমিদার বিরেশ্বর বন্দোপাধ্যায়ের স্ত্রী প্রভাতী রানী প্রাসাদের সমস্ত দরজা, মেঝে এবং আসবাবপত্র চাকর-বাকরদের দ্বারা সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখতেন। বিরু বাবুর দুই ভাই দুর্গা বাবু ও রমা বাবু এই হাজার দুয়ারীতেই থাকতেন। প্রাসাদের সামনে ছিল ফুলের বাগান। জমিদার পরিবার সেখানে বিকেলটা কাটাতেন।
জানা যায়, আঠারোশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে জমিদার অবিনাশ বাবু বীরকুৎসা গ্রামে ৫০ বিঘা জমির ওপর একতলা বিশিষ্ট এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জমিদার অবিনাশ বাবুর কোন পুত্র সন্তান ছিল না। এই কারণে তিনি ভারতের হুগলী জেলার চন্দন নগরে তার ভাগ্নে পঞ্চানন বাবুর সঙ্গে তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেন। এরপর জামাই ও মেয়েকে এই বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং জামাই পঞ্চানন বাবুকে তার জমিদারির দায়িত্বভার প্রদান করেন। এরপর পঞ্চানন বাবু এই বাড়িতে থেকেই সংসার জীবন শুরু করেন। কিন্তু জমিদার অবিনাশ বাবুর মৃত্যুর পর তিনিই এই বাড়ির মালিক হন। সংসার জীবনে পঞ্চানন বাবু ৩ ছেলে সন্তানের জনক হওয়ার সৌভাগ্যও অর্জন করেন। তার ছেরেদের নাম রামাবাবু, দূর্গাবাবু ও বীরবাবু। তবে এই ৩ ছেলের মধ্যে পঞ্চানন বাবুর প্রিয় পুত্র ছিলেন বীরবাবু। তিনিই পরবর্তীকালে তার বাবার জমিদারীত্বের সূত্র ধরে রাজার দায়িত্ব পালন করেন। বীরকুরসা গ্রামের শতবর্ষী রমাকান্ত ঠাকুর বলেন, বীরবাবু রাজার দায়িত্ব পাওয়ার পর একতলা বিশিষ্ট এই বাড়িটিকে সংষ্কার করেন এবং ১ হাজার দরজা ও জানালা বিশিষ্ট দ্বিতল বাড়িতে রূপান্তর করেন। প্রাসাদের পশ্চিমে খিড়কি দরজা পার হয়ে শান-বাঁধানো একটি বিরাট পুকুর আছে। পুকুরটিতে কেবল জমিদার পরিবারের লোকজন ব্যাবহার পূর্বের দেউড়ি পার হয়ে আরেকটি বড় পুকুর। সেখানে করতো আমলা, পেয়াদা ও বরকন্দাজরা। প্রাসাদের ভেতরের একপার্শ্বে ছিল জলসা ঘর। সেখানে গানের আসর বসতো। কলকাতা ভোলানাথ অপেরা এসে গান-বাজনা করে যেতো। পূর্ব দিকের দেউড়ির দুই দিকে ছয়জন করে বারোজন বরকন্দাজ থাকতো। দেউড়ির পাশে ছিল মালখানা এবং এর কিছুদুর ছিল মহাফেজ খানা। এই প্রতিবেদককে পুরো জমিদার বাড়ী ঘুরে দেখান বিরু বাবুর ঘনিষ্ঠ সহচর বয়োঃবৃদ্ধ কালিপদ সরকার। যৌবনাদিপ্ত প্রাসাদটির জীর্ণতা ও পুরাতন স্মৃতি মনে করে একসময় কেঁদে ফেলেন কালিপদ। দামি শ্বেত পাথর, রংধনু রঙের কাঁচ এবং লোহার গ্রীলসহ মূল্যবান আসবাব পত্র সবই চুরি হয়ে গেছে তার চোঁখের সামনেই।
জমিদার বিরেশ্বর বন্দোপাধ্যায়ের দাদা অবিনাশ্বরের নামানুসারে প্রাসাদ সংলগ্ন জমিতে ১৯১৭ সালে বীরকুৎসা অবিনাশ উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এখন সেখানে কলেজ সংযুক্ত করা হয়েছে। জমিদারের সিংহভাগ জমি দখলে নিয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া এই হাজার দুয়ারী জমিদার বিরেশ্বর বন্দোপাধ্যায়ের এর নামে বীরকুৎসা রেল ষ্টেশন নাম করন হয়। দেশ বিভক্তির পর ১৯৫০ সালে রেন্ট রোল অ্যাক্টের বলে জমিদারী প্রথা বিলুপ্তি ঘোষিত হবার পর এই বিশাল অট্রালিকা, জমি-জমা এবং মূল্যবান জিনিসপত্র ফেলে বিরেশ্বর বন্দোপাধ্যায়ের বিরু বাবু স্বপরিবারে ভারতে চলে যান। জমিদারের আততায়ির কালিপদ সরকারের নামে কিছু জমি লিখে দিতে চেয়েছিলেন বিরু বাবু। প্রানের ভয়ে তিনি তা নেননি বলে জানান। জমিদারবাড়ীর পাশেই ২ বিঘা জমি নিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি। বর্তমানে বাড়িটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসলেও বিগত ৭ যুগ ধরে এই বাড়িটিতে স্থায়ীভাবে কোনো লোকজন বসবাস না করায় এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে অযতনে-অবহেলায় পড়ে থাকায় প্রাচীন বিলাশবহুল এই রাজবাড়িটির সৌন্দর্য আজ ক্রমেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। তবে এলাকাবাসীর কাছে হাজার দুয়ারী এই রাজবাড়িটিকে ঘিরে জড়িয়ে রয়েছে নানা স্মৃতি। বীরকুৎসা বাজারের আব্দুল মোতালেব নামে এক ব্যবসায়ী জানান, তিনি তার দাদা-দাদির কাছে থেকে গল্প শুনেছেন যে রাজা বীরবাবুর নামানুসারে এই এলাকার নাকি নামকরণ হয়েছে বীরকুৎসা। অন্যমতে, বীরবাবু ছিলেন অত্যন্ত কালো কুৎসিত চেহারার একজন সাহশী ও শক্তিশালী যোদ্ধা। এই কারনেই নাকি এ এলাকার নামকরণ হয়েছে বীরকুৎসা। তাছাড়া তার নামানুসারে এই এলাকার বিল, রেল স্টেশন, স্কুল ও কলেজসহ সব কিছুরই নামকরণ হয় বীবকুৎসা। এই নামগুলো আজোও বীরবাবুর নামের পরিচিতি জানান দিয়ে আসছে এবং রাজা বীরবাবুর নানা স্নৃতি বহন করে সেগুলো আজোও কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে রাজবাড়িটি পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, রাজাবাড়ির পূর্ব দিকের আংশিক ভেঙে পড়া দরজা-জানালা বিহীন একটি কক্ষের মেঝেতে গামছা বিছিয়ে শুয়ে আছেন কালীপদ সাহা নামের এক বৃদ্ধ। তিনি বলেন, জমিদার বীববাবু যখন এই এলাকায় রাজত্ব করেছিলেন তখন থেকেই তিনি এই জমিদারের একজন নিম্নশ্রেণির কর্মচারী হিসাবে এই বাড়িটি পাহারা দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালে রাজা বীরবাবু এবং তার পরিবারবর্গ ভারতের হুগলী জেলার চন্দননগরে চলে যান। এরপর এই বাড়িটি সরকারের দখলে চলে আসে। কালীপদ শাহা আরো জানান, এই জমিদাররর এলাকার অর্ধশত লোক তার কর্মচারী ছিলেন। কিন্তু জমিদার দেশত্যাগ করার পর ওইসব কর্মচারীরা সবাই একে একে এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন এবং বর্তমানে তিনি ছাড়া সবাই পরলোক গমন করেছেন। কিন্তু এই বাড়িটির নানান স্মৃতি এবং অত্যন্ত সহজ-সরল ও শান্ত প্রকৃতির মানুষ রাজা বীরবাবুর আদর-স্নেহ এখনোও তিনি ভুলতে পারেন নি। এ কারণে আজোও তিনি এই বাড়িটি বিনা বেতনে পাহারা দিয়ে আসছেন। তবে বাগমারার প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন এই পুরাতন হাজার দুয়ারী রাজবাড়িটি বর্তমানে যেহেতু সরকারের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে তাই একে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করাও সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কাজেই এই ব্যাপারে সংশি¬ষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন এলাকাবাসী।
শনিবার, ০১ মার্চ ২০২৫
কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের অতীত ঐতিহ্য। আর যা কিছু টিকে আছে তাও শতাব্দীর কঙ্কাল হয়ে। রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার যোগীপাড়া ইউয়িনের বীরকুৎসা জমিদার বাড়িটি দেশের একমাত্র ‘হাজার দুয়ারী’ জমিদার বাড়ি। সংরক্ষনের অভাবে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে এটি। জমিদারি প্রথা চালু থাকাকালীন সময়ে বীরকুৎসা ছিল একটি পরগনা। এর জমিদার ছিলেন ভারতের কাশী থেকে আসা বিরেশ্বর বন্দোপাধ্যায় বিরু বাবু। জানা গেছে, পার্শ্ববর্তী আত্রাই উপজেলার আমরুল ডিহি বিশার রাজা ছিলেন গোপাল ধাম। প্রভাতী রানী নামে তার এক রুপসী কন্যা ছিল। রাজ জামাতা হবার সুবাদে রাজা গোপাল ধাম বিরেশ্বর বন্দোপাধ্যায় ও রাজকন্যা প্রভাতী রানীর নামে বীরকুৎসা পরগনা হস্তান্তর করেন। প্রভাতী রানী ছিলেন খুবই সৌখিন। তার পছন্দ মত স্বামী বিরু বাবু বীরকুৎসায় গড়ে তোলেন একটি সুরম্য অট্টালিকা। এই বিশাল বাড়িটিতে আছে হাজারটি দুয়ার। আর একারনেই এটি হাজার দুয়ারী নামে পরিচিতি লাভ করে। দুয়ারগুলো সেগুন কাঠে কারকার্য খচিত। অট্রালিকার পুরো মেঝে ছিল শ্বেত পাথরে ঢাঁকা। দরজা গুলো তিন স্তরে আবৃত ছিল। প্রথমে কাঠের,পরে লোহারগ্রীলের ও শেষে দামি কাঁচে আবৃত ছিল। জমিদার বিরেশ্বর বন্দোপাধ্যায়ের স্ত্রী প্রভাতী রানী প্রাসাদের সমস্ত দরজা, মেঝে এবং আসবাবপত্র চাকর-বাকরদের দ্বারা সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখতেন। বিরু বাবুর দুই ভাই দুর্গা বাবু ও রমা বাবু এই হাজার দুয়ারীতেই থাকতেন। প্রাসাদের সামনে ছিল ফুলের বাগান। জমিদার পরিবার সেখানে বিকেলটা কাটাতেন।
জানা যায়, আঠারোশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে জমিদার অবিনাশ বাবু বীরকুৎসা গ্রামে ৫০ বিঘা জমির ওপর একতলা বিশিষ্ট এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জমিদার অবিনাশ বাবুর কোন পুত্র সন্তান ছিল না। এই কারণে তিনি ভারতের হুগলী জেলার চন্দন নগরে তার ভাগ্নে পঞ্চানন বাবুর সঙ্গে তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেন। এরপর জামাই ও মেয়েকে এই বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং জামাই পঞ্চানন বাবুকে তার জমিদারির দায়িত্বভার প্রদান করেন। এরপর পঞ্চানন বাবু এই বাড়িতে থেকেই সংসার জীবন শুরু করেন। কিন্তু জমিদার অবিনাশ বাবুর মৃত্যুর পর তিনিই এই বাড়ির মালিক হন। সংসার জীবনে পঞ্চানন বাবু ৩ ছেলে সন্তানের জনক হওয়ার সৌভাগ্যও অর্জন করেন। তার ছেরেদের নাম রামাবাবু, দূর্গাবাবু ও বীরবাবু। তবে এই ৩ ছেলের মধ্যে পঞ্চানন বাবুর প্রিয় পুত্র ছিলেন বীরবাবু। তিনিই পরবর্তীকালে তার বাবার জমিদারীত্বের সূত্র ধরে রাজার দায়িত্ব পালন করেন। বীরকুরসা গ্রামের শতবর্ষী রমাকান্ত ঠাকুর বলেন, বীরবাবু রাজার দায়িত্ব পাওয়ার পর একতলা বিশিষ্ট এই বাড়িটিকে সংষ্কার করেন এবং ১ হাজার দরজা ও জানালা বিশিষ্ট দ্বিতল বাড়িতে রূপান্তর করেন। প্রাসাদের পশ্চিমে খিড়কি দরজা পার হয়ে শান-বাঁধানো একটি বিরাট পুকুর আছে। পুকুরটিতে কেবল জমিদার পরিবারের লোকজন ব্যাবহার পূর্বের দেউড়ি পার হয়ে আরেকটি বড় পুকুর। সেখানে করতো আমলা, পেয়াদা ও বরকন্দাজরা। প্রাসাদের ভেতরের একপার্শ্বে ছিল জলসা ঘর। সেখানে গানের আসর বসতো। কলকাতা ভোলানাথ অপেরা এসে গান-বাজনা করে যেতো। পূর্ব দিকের দেউড়ির দুই দিকে ছয়জন করে বারোজন বরকন্দাজ থাকতো। দেউড়ির পাশে ছিল মালখানা এবং এর কিছুদুর ছিল মহাফেজ খানা। এই প্রতিবেদককে পুরো জমিদার বাড়ী ঘুরে দেখান বিরু বাবুর ঘনিষ্ঠ সহচর বয়োঃবৃদ্ধ কালিপদ সরকার। যৌবনাদিপ্ত প্রাসাদটির জীর্ণতা ও পুরাতন স্মৃতি মনে করে একসময় কেঁদে ফেলেন কালিপদ। দামি শ্বেত পাথর, রংধনু রঙের কাঁচ এবং লোহার গ্রীলসহ মূল্যবান আসবাব পত্র সবই চুরি হয়ে গেছে তার চোঁখের সামনেই।
জমিদার বিরেশ্বর বন্দোপাধ্যায়ের দাদা অবিনাশ্বরের নামানুসারে প্রাসাদ সংলগ্ন জমিতে ১৯১৭ সালে বীরকুৎসা অবিনাশ উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এখন সেখানে কলেজ সংযুক্ত করা হয়েছে। জমিদারের সিংহভাগ জমি দখলে নিয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া এই হাজার দুয়ারী জমিদার বিরেশ্বর বন্দোপাধ্যায়ের এর নামে বীরকুৎসা রেল ষ্টেশন নাম করন হয়। দেশ বিভক্তির পর ১৯৫০ সালে রেন্ট রোল অ্যাক্টের বলে জমিদারী প্রথা বিলুপ্তি ঘোষিত হবার পর এই বিশাল অট্রালিকা, জমি-জমা এবং মূল্যবান জিনিসপত্র ফেলে বিরেশ্বর বন্দোপাধ্যায়ের বিরু বাবু স্বপরিবারে ভারতে চলে যান। জমিদারের আততায়ির কালিপদ সরকারের নামে কিছু জমি লিখে দিতে চেয়েছিলেন বিরু বাবু। প্রানের ভয়ে তিনি তা নেননি বলে জানান। জমিদারবাড়ীর পাশেই ২ বিঘা জমি নিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি। বর্তমানে বাড়িটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসলেও বিগত ৭ যুগ ধরে এই বাড়িটিতে স্থায়ীভাবে কোনো লোকজন বসবাস না করায় এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে অযতনে-অবহেলায় পড়ে থাকায় প্রাচীন বিলাশবহুল এই রাজবাড়িটির সৌন্দর্য আজ ক্রমেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। তবে এলাকাবাসীর কাছে হাজার দুয়ারী এই রাজবাড়িটিকে ঘিরে জড়িয়ে রয়েছে নানা স্মৃতি। বীরকুৎসা বাজারের আব্দুল মোতালেব নামে এক ব্যবসায়ী জানান, তিনি তার দাদা-দাদির কাছে থেকে গল্প শুনেছেন যে রাজা বীরবাবুর নামানুসারে এই এলাকার নাকি নামকরণ হয়েছে বীরকুৎসা। অন্যমতে, বীরবাবু ছিলেন অত্যন্ত কালো কুৎসিত চেহারার একজন সাহশী ও শক্তিশালী যোদ্ধা। এই কারনেই নাকি এ এলাকার নামকরণ হয়েছে বীরকুৎসা। তাছাড়া তার নামানুসারে এই এলাকার বিল, রেল স্টেশন, স্কুল ও কলেজসহ সব কিছুরই নামকরণ হয় বীবকুৎসা। এই নামগুলো আজোও বীরবাবুর নামের পরিচিতি জানান দিয়ে আসছে এবং রাজা বীরবাবুর নানা স্নৃতি বহন করে সেগুলো আজোও কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে রাজবাড়িটি পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, রাজাবাড়ির পূর্ব দিকের আংশিক ভেঙে পড়া দরজা-জানালা বিহীন একটি কক্ষের মেঝেতে গামছা বিছিয়ে শুয়ে আছেন কালীপদ সাহা নামের এক বৃদ্ধ। তিনি বলেন, জমিদার বীববাবু যখন এই এলাকায় রাজত্ব করেছিলেন তখন থেকেই তিনি এই জমিদারের একজন নিম্নশ্রেণির কর্মচারী হিসাবে এই বাড়িটি পাহারা দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালে রাজা বীরবাবু এবং তার পরিবারবর্গ ভারতের হুগলী জেলার চন্দননগরে চলে যান। এরপর এই বাড়িটি সরকারের দখলে চলে আসে। কালীপদ শাহা আরো জানান, এই জমিদাররর এলাকার অর্ধশত লোক তার কর্মচারী ছিলেন। কিন্তু জমিদার দেশত্যাগ করার পর ওইসব কর্মচারীরা সবাই একে একে এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন এবং বর্তমানে তিনি ছাড়া সবাই পরলোক গমন করেছেন। কিন্তু এই বাড়িটির নানান স্মৃতি এবং অত্যন্ত সহজ-সরল ও শান্ত প্রকৃতির মানুষ রাজা বীরবাবুর আদর-স্নেহ এখনোও তিনি ভুলতে পারেন নি। এ কারণে আজোও তিনি এই বাড়িটি বিনা বেতনে পাহারা দিয়ে আসছেন। তবে বাগমারার প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন এই পুরাতন হাজার দুয়ারী রাজবাড়িটি বর্তমানে যেহেতু সরকারের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে তাই একে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করাও সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কাজেই এই ব্যাপারে সংশি¬ষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন এলাকাবাসী।