বরগুনার বেতাগী পৌর শহরে সাপ্তাহিক হাটের দিন খাস-কাচারি মাঠে বাঁশ-বেত শিল্পের তৈরিকৃত পণ্যসামগ্রী বিক্রি করছেন। ছবিটি বেতাগী খাস-কাচারি মাঠ থেকে তোলা হয়েছে
আধুনিক সভ্যতার প্লাস্টিকসামগ্রীর দাপটে হারাতে বসেছে বাঁশ ও বেত শিল্পের আবহমান গ্রাম বাংলার তৈরিকৃত সামগ্রীর নান্দনিক ব্যবহার। বাঁশ আর বেতের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় ভালো নেই এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগররা। তবুও বাপ-দাদার এই পেশাকে এখনও জীবিকার প্রধান বাহক হিসেবে আঁকড়ে রেখেছে বরগুনার বেতাগী উপজেলা ও পৌর শহরের কিছুসংখ্যক পরিবার।
কয়েক দশক আগে বেতাগী পৌর শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হতো কারিগরদের তৈরি এসব
বাঁশ ও বেতের পণ্য
সরেজমিনে দেখা গেছে, বর্তমানে বেতাগী পৌরসভা ও উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের ১১৫টি পরিবারই বর্তমানে এই শিল্পটি ধরে রেখেছেন। যেখানে একযুগ আগেও এ উপজেলায় চার শতাধিক পরিবার এ পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। পুরুষদের পাশাপাশি সংসারের কাজ শেষ করে নারী কারিগররাই বাঁশ দিয়ে এই সব পণ্য বেশি তৈরি করে থাকেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বাঁশ ও বেত দ্বারা এইসব গৃহসামগ্রীর নান্দনিক পণ্য তৈরি করে থাকেন। বর্তমানে বেত তেমন সহজলভ্য না হওয়ায় বাঁশ দিয়েই বেশি এই সব চিরচেনা পণ্য তৈরি করছেন এইসব কারিগররা।
হোসনাবাদ ইউনিয়নের জলিসা গ্রামের সত্তর বছর বয়স্ক নিরোধ বেপারী বলেন, ‘তাদের ইউনিয়নে ১৮টি পরিবার জীবিকা র্নিবাহে বেঁচে আছে।’
এ বিষয় পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. সন্তোষ কুমার বসু বলেন, বাঁশ ও বেত শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে আসা দরকার। এ পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত কৃষক ও কারিকরদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে এবং যথাযথ প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করানো একান্ত প্রয়োজন।
কয়েক দশক আগে বেতাগী পৌর শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হতো এই কারিগরদের তৈরি এইসব বাঁশ ও বেতের পণ্যগুলো। গৃহের বাঁশ ও বেত শিল্পের আগের অনেকটাই নান্দনিক পণ্যসামগ্রীর ব্যবহার হারাতে বসেছে। শিশুদের জন্য ‘ডালীরা’ নান্দনিক পণ্যসামগ্রী বিক্রির জন্য গ্রামে গ্রামে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতো। ডালীর এখন আর দেখা মেলে না গ্রামে। তবে এখনও বাঁশ-বেত শিল্পের তৈরিকৃত পণ্যে সামগ্রী সৌখিন প্রিয় মানুষের কাছে চাহিদা রয়েছে। শিশুদের দোলনা, র্যাগ, পাখা, ঝাড়ু, টোপা। এছাড়া গৃহস্থলী কাজে সাজি, ওরা, কুলা, মোরা, পুরা, দাড়িপাল্লা, ঝাঁপি, ফুলদানি, ফুলের ডালি, খাবার ঘরের ডাইনিং টেবিল, চেয়ার, টেবিল, সোফা সেট, খাট, মাছ ধরার পোলোসহ বিভিন্ন প্রকার আসবাবপত্র গ্রামাঞ্চলের সর্বত্র নান্দনিক ব্যবহার ছিল এক সময়।
এ পেশার সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আকারভেদে একটি বাঁশ ৮০-১৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। একটি বাঁশ থেকে ৫-৭টি সাজি, ৭-৯টি কুলা, ৫-৭টি ঝাঁপি তৈরি হচ্ছে। সাজির আকারভেদে প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে ৭৫-১০ টাকা, কুলা ৬০-৯০ টাকা, ঝাঁপি ৮০-১০০ টাকা। এছাড়া গ্রাম থেকে শহরে হাটের দিনে বাজারে পরিবহন এবং খাজনা খরচ দিয়ে লাভের অংশ তেমন থাকে না বলে জানান একাধিক ব্যক্তি।
উপজেলার বেতাগী সদর ইউনিয়নের বাসন্ডা গ্রামের বিবেকানন্দ বিশ্বাস বলেন, বাসন্ডা গ্রামে হাতে গোনা আমরা ১৫টি পরিবার আজও এ কাজে নিয়োজিত আছি। একটি বাঁশ থেকে ১০-১২টি ডালি তৈরি হয়। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতিটি পণ্য থেকে ২০-৩০ টাকা করে লাভ থাকে। তবে বর্তমানে আগের মতো আর বেশি লাভ হয় না। নিজেদেরই বিভিন্ন হাটে গিয়ে ও গ্রামে গ্রামে ফেরি করে এসব পণ্য বিক্রি করতে হয়।’
মোকামিয়া ইউনিয়নের কিসমত করুনা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব শ্রীকৃষ্ণ সমাদ্দার বলেন, অতি কষ্টে তাদের বাপ-দাদার পূর্বপুরুষের এই পেশাকে টিকে রাখতে হয়েছে। এতে ধারদেনা ও বিভিন্ন সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে কাজ করছি।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তানজিলা আহমেদ বলেন, এখনও এই উপজেলায় কিছু পরিবার তাদের পূর্বপুরুষের বাঁশ ও বেত শিল্পের তৈরি পন্যসামগ্রী শেঁকড় আঁকড়ে ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এই পেশাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে কৃষকদের সুদমুক্ত ঋণ দেয়া প্রয়োজন।
বরগুনার বেতাগী পৌর শহরে সাপ্তাহিক হাটের দিন খাস-কাচারি মাঠে বাঁশ-বেত শিল্পের তৈরিকৃত পণ্যসামগ্রী বিক্রি করছেন। ছবিটি বেতাগী খাস-কাচারি মাঠ থেকে তোলা হয়েছে
শনিবার, ১২ এপ্রিল ২০২৫
আধুনিক সভ্যতার প্লাস্টিকসামগ্রীর দাপটে হারাতে বসেছে বাঁশ ও বেত শিল্পের আবহমান গ্রাম বাংলার তৈরিকৃত সামগ্রীর নান্দনিক ব্যবহার। বাঁশ আর বেতের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় ভালো নেই এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগররা। তবুও বাপ-দাদার এই পেশাকে এখনও জীবিকার প্রধান বাহক হিসেবে আঁকড়ে রেখেছে বরগুনার বেতাগী উপজেলা ও পৌর শহরের কিছুসংখ্যক পরিবার।
কয়েক দশক আগে বেতাগী পৌর শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হতো কারিগরদের তৈরি এসব
বাঁশ ও বেতের পণ্য
সরেজমিনে দেখা গেছে, বর্তমানে বেতাগী পৌরসভা ও উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের ১১৫টি পরিবারই বর্তমানে এই শিল্পটি ধরে রেখেছেন। যেখানে একযুগ আগেও এ উপজেলায় চার শতাধিক পরিবার এ পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। পুরুষদের পাশাপাশি সংসারের কাজ শেষ করে নারী কারিগররাই বাঁশ দিয়ে এই সব পণ্য বেশি তৈরি করে থাকেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বাঁশ ও বেত দ্বারা এইসব গৃহসামগ্রীর নান্দনিক পণ্য তৈরি করে থাকেন। বর্তমানে বেত তেমন সহজলভ্য না হওয়ায় বাঁশ দিয়েই বেশি এই সব চিরচেনা পণ্য তৈরি করছেন এইসব কারিগররা।
হোসনাবাদ ইউনিয়নের জলিসা গ্রামের সত্তর বছর বয়স্ক নিরোধ বেপারী বলেন, ‘তাদের ইউনিয়নে ১৮টি পরিবার জীবিকা র্নিবাহে বেঁচে আছে।’
এ বিষয় পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. সন্তোষ কুমার বসু বলেন, বাঁশ ও বেত শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে আসা দরকার। এ পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত কৃষক ও কারিকরদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে এবং যথাযথ প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করানো একান্ত প্রয়োজন।
কয়েক দশক আগে বেতাগী পৌর শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হতো এই কারিগরদের তৈরি এইসব বাঁশ ও বেতের পণ্যগুলো। গৃহের বাঁশ ও বেত শিল্পের আগের অনেকটাই নান্দনিক পণ্যসামগ্রীর ব্যবহার হারাতে বসেছে। শিশুদের জন্য ‘ডালীরা’ নান্দনিক পণ্যসামগ্রী বিক্রির জন্য গ্রামে গ্রামে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতো। ডালীর এখন আর দেখা মেলে না গ্রামে। তবে এখনও বাঁশ-বেত শিল্পের তৈরিকৃত পণ্যে সামগ্রী সৌখিন প্রিয় মানুষের কাছে চাহিদা রয়েছে। শিশুদের দোলনা, র্যাগ, পাখা, ঝাড়ু, টোপা। এছাড়া গৃহস্থলী কাজে সাজি, ওরা, কুলা, মোরা, পুরা, দাড়িপাল্লা, ঝাঁপি, ফুলদানি, ফুলের ডালি, খাবার ঘরের ডাইনিং টেবিল, চেয়ার, টেবিল, সোফা সেট, খাট, মাছ ধরার পোলোসহ বিভিন্ন প্রকার আসবাবপত্র গ্রামাঞ্চলের সর্বত্র নান্দনিক ব্যবহার ছিল এক সময়।
এ পেশার সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আকারভেদে একটি বাঁশ ৮০-১৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। একটি বাঁশ থেকে ৫-৭টি সাজি, ৭-৯টি কুলা, ৫-৭টি ঝাঁপি তৈরি হচ্ছে। সাজির আকারভেদে প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে ৭৫-১০ টাকা, কুলা ৬০-৯০ টাকা, ঝাঁপি ৮০-১০০ টাকা। এছাড়া গ্রাম থেকে শহরে হাটের দিনে বাজারে পরিবহন এবং খাজনা খরচ দিয়ে লাভের অংশ তেমন থাকে না বলে জানান একাধিক ব্যক্তি।
উপজেলার বেতাগী সদর ইউনিয়নের বাসন্ডা গ্রামের বিবেকানন্দ বিশ্বাস বলেন, বাসন্ডা গ্রামে হাতে গোনা আমরা ১৫টি পরিবার আজও এ কাজে নিয়োজিত আছি। একটি বাঁশ থেকে ১০-১২টি ডালি তৈরি হয়। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতিটি পণ্য থেকে ২০-৩০ টাকা করে লাভ থাকে। তবে বর্তমানে আগের মতো আর বেশি লাভ হয় না। নিজেদেরই বিভিন্ন হাটে গিয়ে ও গ্রামে গ্রামে ফেরি করে এসব পণ্য বিক্রি করতে হয়।’
মোকামিয়া ইউনিয়নের কিসমত করুনা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব শ্রীকৃষ্ণ সমাদ্দার বলেন, অতি কষ্টে তাদের বাপ-দাদার পূর্বপুরুষের এই পেশাকে টিকে রাখতে হয়েছে। এতে ধারদেনা ও বিভিন্ন সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে কাজ করছি।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তানজিলা আহমেদ বলেন, এখনও এই উপজেলায় কিছু পরিবার তাদের পূর্বপুরুষের বাঁশ ও বেত শিল্পের তৈরি পন্যসামগ্রী শেঁকড় আঁকড়ে ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এই পেশাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে কৃষকদের সুদমুক্ত ঋণ দেয়া প্রয়োজন।