লালমাই (কুমিল্লা) : লালমাই পাহাড়ের পাদদেশে ভাসমান বেদে পরিবার -সংবাদ
আমাদের দেশে বেদে সম্প্রদায়ের প্রায় ৮ লাখেরও বেশি জনসংখ্যা বসবাস করে। দেশের অতি পরিচিত প্রান্তিক যাযাবর গোষ্ঠী হলো বেদে সম্প্রদায়। বেদেদেরকে সাধারণত বাইদ্যা বলে ডাকা হয়। কেউ কেউ এদেরকে জলের জিপসিও বলে থাকে। তারা জীবনের অধিকাংশ সময়ই নদীতে নৌকায় ভেসে বেড়ায়। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সব নদীতেই এরা ছুটে বেড়ায়। তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আবেগ-অনুভূতি সবকিছু জড়িয়ে থাকে নৌকা আর নদীকে কেন্দ্র করে। নৌকার মধ্যেই চলে তাদের ঘর-সংসার।
তাদের জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে সবকিছুই নদীতেই হয়ে থাকে। জোয়ার ভাটার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাদের জীবনের গল্প। তাদের নিজস্ব কোনো ভূমি নেই। ঘাটে ঘাটে নৌকা ফেলা আবার নোঙর তুলে নিয়ে অন্যত্র ছুটে চলাই তাদের প্রতিদিনের চিত্র। তারা নাগরিক জীবনের অধিকাংশ সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বেদে সম্প্রদায়ের প্রায় ৯৮ শতাংশ সদস্য দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এ সম্প্রদায়ের বিশুদ্ধ পানি কিংবা স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থার তীব্র সংকট। ভাসমান জীবনযাপনের ফলে বেদেরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। সাধারণ মানুষ বেদেদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞার চোখে দেখে। এদের সঙ্গে কেউ মিশতে চায় না।
কুমিল্লায় ভাসমান ২৫ পরিবার : ভাসমান মুসলিম পরিবারের মানুষগুলো কষ্টে জীবন পার করছেন। অভাব অনটনে দিন যাচ্ছে তাদের। স্থায়ী ঠিকানা ছিল ঢাকার বিক্রমপুর ও মুন্সিগঞ্জ কিন্তু নিয়তির টানে এখন জীবন পার করছেন কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার লালমাই পাহাড়ের পাদদেশের কুমিল্লা বরুড়া সড়কের সঙ্গে। চন্ডি মন্দিরের পূর্ব পাশে। একটি বাগানে ঝুপড়ি ঘরে। দীর্ঘ দেড় মাস যাবৎ এখানে রয়েছেন। স্বল্প আয়ের মানুষগুলো সর্বস্ব হারিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। ৫০ জন নারী পুরুষ ও ৪৫জন শিশু আর ১১ জন কিশোর থাকেন এখানে। রমজান মাসে মানুষগুলোর মানবেতর জীবনযাপন নিয়ে দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে এগিয়ে আসেন সদর দক্ষিণ উপজেলা ইউএনও। ব্যবস্থা করেন চাউলের।
তাদের আয়ের উৎস্য : ২৫টি পরিবারের ২৫ জন নারী গ্রামে গ্রামে ঘুরে শিঙ্গা লাগানো ও দাঁতের পোকা খুলে থাকে আর পুরুষদের মধ্যে কেউ কেউ স্বর্ণ হারিয়ে গেলে খুঁজে দেয়া কাজ করে থাকে, আবার কেউ কেউ বিভিন্ন মালা, কড়ি, বাজারের গ্রামগঞ্জে গিয়ে বিক্রি করে থাকে।
শিশুদের শিক্ষা জীবন : এখানে শিশুদের জীবনের প্রদীপ শুরুর আগেই নিবে যায় কেননা, কোন প্রকার পড়ালেখা ছাড়াই বড় হচ্ছেন এখানকার শিশুরা। সারাদিন ক্রিকেট বল খেলা, লুকোচুরি খেলা, রাজা রানী খেলাসহ বিভিন্ন প্রকার খেলাধুলা করে বড় হচ্ছেন তারা। যাযাবর জনগোষ্ঠী হওয়াতে একাধিক স্থানে থাকতে হয় তাদের সে জন্য শিশুদেরও সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। আর তাই শিক্ষার আলো থেকে দূরে থাকতে হয় শিশুদের। যার ফলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মও গড়ে উঠেছে তাদের মতো করে। সরকার কিংবা সচেতনমহলের প্রচেষ্টায় এই শিশুদের শিক্ষাদান কার্যক্রম চালু করা প্রয়োজন।
সামাজিক ব্যবস্থা : ২৫ পরিবারের সবাই মিলে সর্বসম্মতি ক্রমে আনিসকে সর্দার বানিয়েছে। এখানে আনিস যা বলবে সবাই তা শুনবে। সর্দারের কথাই তাদের জন্য শেষ কথা। আনিসের এক ছেলে ও তিন মেয়ে সন্তান রয়েছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে আনিস বলেন, আমরা ইতোপূর্বে ব্রাহ্মণবাড়িসহ দেশের আরো দু’একটি জায়গায় ছিলাম কিন্তু এখানেই প্রথম আপনার লেখনীর মাধ্যমে কেউ আমাদের কিছু দিল। ইউএনও স্যারকেও ধন্যবাদ যে আমাদেরকে সহযোগিতা করেছে। সত্যি স্থায়ীভাবে কোথায় জায়গা পেতাম তাহলে ওইখানে থেকেই নিজেরা কাজ করতাম।
স্যানিটাইজেশন ব্যবস্থা : লালমাই পাহাড়ের কোনে নিজেরা সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে টয়লেট নির্মাণ করেছেন। তাতেই বৃদ্ধ থেকে শিশু সবাই ব্যবহার করে থাকেন।
প্রতিদিন সকালে নারীরা গ্রাম গঞ্জে চলে যায় আর বিকালের মধ্যে নীড়ে ফেরে রান্না বান্নার কাজ করে থাকেন। মূলত, বেশিরভাগ সময় মাঠ থেকে বিভিন্ন শাক-সবজি খুঁজে রান্না করে থাকে এছাড়াও মাঝে মধ্যে বাজার থেকেও মাছ মাংস ক্রয় করে খাবার ম্যানুতে অন্তর্ভুক্ত করে তারা।
একাধিক সন্তান লাভ : যাযাবর জনগোষ্ঠীর মানুষদের অধিক সন্তান লাভের কথা নতুন নয়। কিন্তু এখানে ২৫ পরিবারের নারীদেরও সন্তান রয়েছে আবার অনেকেই পরিবার পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্তান নিচ্ছেন।
বিদ্যুৎ ব্যবস্থা : নিজেদের কষ্টার্জিত টাকায় সোলার কিনেছে কয়েকটি পরিবার আর বাকীরা মোমবাতি জ্বালিয়ে বিদ্যুৎতের চাহিদা মেটায়। সারাদিন রোদে সোলার ফেলে রাখে সন্ধ্যা নামলে তা ঝুপড়ি ঘরে নিয়ে যায়। মোবাইল চার্জ দেওয়া ও রাতে বাল্প জ্বালানো সবই সোলারের মাধ্যমে করে থাকে।
লালমাই (কুমিল্লা) : লালমাই পাহাড়ের পাদদেশে ভাসমান বেদে পরিবার -সংবাদ
রোববার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫
আমাদের দেশে বেদে সম্প্রদায়ের প্রায় ৮ লাখেরও বেশি জনসংখ্যা বসবাস করে। দেশের অতি পরিচিত প্রান্তিক যাযাবর গোষ্ঠী হলো বেদে সম্প্রদায়। বেদেদেরকে সাধারণত বাইদ্যা বলে ডাকা হয়। কেউ কেউ এদেরকে জলের জিপসিও বলে থাকে। তারা জীবনের অধিকাংশ সময়ই নদীতে নৌকায় ভেসে বেড়ায়। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সব নদীতেই এরা ছুটে বেড়ায়। তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আবেগ-অনুভূতি সবকিছু জড়িয়ে থাকে নৌকা আর নদীকে কেন্দ্র করে। নৌকার মধ্যেই চলে তাদের ঘর-সংসার।
তাদের জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে সবকিছুই নদীতেই হয়ে থাকে। জোয়ার ভাটার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাদের জীবনের গল্প। তাদের নিজস্ব কোনো ভূমি নেই। ঘাটে ঘাটে নৌকা ফেলা আবার নোঙর তুলে নিয়ে অন্যত্র ছুটে চলাই তাদের প্রতিদিনের চিত্র। তারা নাগরিক জীবনের অধিকাংশ সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বেদে সম্প্রদায়ের প্রায় ৯৮ শতাংশ সদস্য দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এ সম্প্রদায়ের বিশুদ্ধ পানি কিংবা স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থার তীব্র সংকট। ভাসমান জীবনযাপনের ফলে বেদেরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। সাধারণ মানুষ বেদেদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞার চোখে দেখে। এদের সঙ্গে কেউ মিশতে চায় না।
কুমিল্লায় ভাসমান ২৫ পরিবার : ভাসমান মুসলিম পরিবারের মানুষগুলো কষ্টে জীবন পার করছেন। অভাব অনটনে দিন যাচ্ছে তাদের। স্থায়ী ঠিকানা ছিল ঢাকার বিক্রমপুর ও মুন্সিগঞ্জ কিন্তু নিয়তির টানে এখন জীবন পার করছেন কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার লালমাই পাহাড়ের পাদদেশের কুমিল্লা বরুড়া সড়কের সঙ্গে। চন্ডি মন্দিরের পূর্ব পাশে। একটি বাগানে ঝুপড়ি ঘরে। দীর্ঘ দেড় মাস যাবৎ এখানে রয়েছেন। স্বল্প আয়ের মানুষগুলো সর্বস্ব হারিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। ৫০ জন নারী পুরুষ ও ৪৫জন শিশু আর ১১ জন কিশোর থাকেন এখানে। রমজান মাসে মানুষগুলোর মানবেতর জীবনযাপন নিয়ে দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে এগিয়ে আসেন সদর দক্ষিণ উপজেলা ইউএনও। ব্যবস্থা করেন চাউলের।
তাদের আয়ের উৎস্য : ২৫টি পরিবারের ২৫ জন নারী গ্রামে গ্রামে ঘুরে শিঙ্গা লাগানো ও দাঁতের পোকা খুলে থাকে আর পুরুষদের মধ্যে কেউ কেউ স্বর্ণ হারিয়ে গেলে খুঁজে দেয়া কাজ করে থাকে, আবার কেউ কেউ বিভিন্ন মালা, কড়ি, বাজারের গ্রামগঞ্জে গিয়ে বিক্রি করে থাকে।
শিশুদের শিক্ষা জীবন : এখানে শিশুদের জীবনের প্রদীপ শুরুর আগেই নিবে যায় কেননা, কোন প্রকার পড়ালেখা ছাড়াই বড় হচ্ছেন এখানকার শিশুরা। সারাদিন ক্রিকেট বল খেলা, লুকোচুরি খেলা, রাজা রানী খেলাসহ বিভিন্ন প্রকার খেলাধুলা করে বড় হচ্ছেন তারা। যাযাবর জনগোষ্ঠী হওয়াতে একাধিক স্থানে থাকতে হয় তাদের সে জন্য শিশুদেরও সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। আর তাই শিক্ষার আলো থেকে দূরে থাকতে হয় শিশুদের। যার ফলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মও গড়ে উঠেছে তাদের মতো করে। সরকার কিংবা সচেতনমহলের প্রচেষ্টায় এই শিশুদের শিক্ষাদান কার্যক্রম চালু করা প্রয়োজন।
সামাজিক ব্যবস্থা : ২৫ পরিবারের সবাই মিলে সর্বসম্মতি ক্রমে আনিসকে সর্দার বানিয়েছে। এখানে আনিস যা বলবে সবাই তা শুনবে। সর্দারের কথাই তাদের জন্য শেষ কথা। আনিসের এক ছেলে ও তিন মেয়ে সন্তান রয়েছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে আনিস বলেন, আমরা ইতোপূর্বে ব্রাহ্মণবাড়িসহ দেশের আরো দু’একটি জায়গায় ছিলাম কিন্তু এখানেই প্রথম আপনার লেখনীর মাধ্যমে কেউ আমাদের কিছু দিল। ইউএনও স্যারকেও ধন্যবাদ যে আমাদেরকে সহযোগিতা করেছে। সত্যি স্থায়ীভাবে কোথায় জায়গা পেতাম তাহলে ওইখানে থেকেই নিজেরা কাজ করতাম।
স্যানিটাইজেশন ব্যবস্থা : লালমাই পাহাড়ের কোনে নিজেরা সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে টয়লেট নির্মাণ করেছেন। তাতেই বৃদ্ধ থেকে শিশু সবাই ব্যবহার করে থাকেন।
প্রতিদিন সকালে নারীরা গ্রাম গঞ্জে চলে যায় আর বিকালের মধ্যে নীড়ে ফেরে রান্না বান্নার কাজ করে থাকেন। মূলত, বেশিরভাগ সময় মাঠ থেকে বিভিন্ন শাক-সবজি খুঁজে রান্না করে থাকে এছাড়াও মাঝে মধ্যে বাজার থেকেও মাছ মাংস ক্রয় করে খাবার ম্যানুতে অন্তর্ভুক্ত করে তারা।
একাধিক সন্তান লাভ : যাযাবর জনগোষ্ঠীর মানুষদের অধিক সন্তান লাভের কথা নতুন নয়। কিন্তু এখানে ২৫ পরিবারের নারীদেরও সন্তান রয়েছে আবার অনেকেই পরিবার পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্তান নিচ্ছেন।
বিদ্যুৎ ব্যবস্থা : নিজেদের কষ্টার্জিত টাকায় সোলার কিনেছে কয়েকটি পরিবার আর বাকীরা মোমবাতি জ্বালিয়ে বিদ্যুৎতের চাহিদা মেটায়। সারাদিন রোদে সোলার ফেলে রাখে সন্ধ্যা নামলে তা ঝুপড়ি ঘরে নিয়ে যায়। মোবাইল চার্জ দেওয়া ও রাতে বাল্প জ্বালানো সবই সোলারের মাধ্যমে করে থাকে।