সাপের এত আঁকাবাঁকা গাঁয়ের পথ। শেষ বিকেলে ধুলো উড়িয়ে চলছে একটা ছইওয়ালা গরুর গাড়ি। সন্ধ্যার আগেই গন্তব্যে পৌঁছতে হবে। গাড়োয়ান বারবার তাগাদা দিচ্ছে বলদজোড়াকে, হাঁট হাঁট। ক্লান্তি মানুষের এত গরুরও আছে। কাকডাকা ভোর থেকে একটানা হেঁটে চলেছে। একটু ঢিল দেওয়ার জো নেই, গতি কমালেই গাড়োয়ানের লাঠির শপাং শাপাং বাড়ি পড়বে পিঠে। ছইয়ের ভেতরে শিশুছেলাটাকে কোলে নিয়ে বসে আছেন গাঁয়ের বধূ।
গাড়ির চাকায় কর্কশ শব্দ, যেন বিরামহীন পথচলায় সে প্রতিবাদ করছে। তবু থামবে না গাড়োয়ান। কখনো কোলাহলমুখর হাটের ভেতর দিয়ে, কখনো লোকালয়ের পাশ দিয়ে ধীরগতিতে এগিয়ে চলেছে গাড়োয়ান। বটতলায় খেলছে একদল ছেলেমেয়ে। দুষ্টু ছেলের দল হাল ছাড়ে না। ছুটে এসে গাড়ির পেছন ধরে ঝুলতে থাকে। ঝুলতে ঝুলতে গাড়ির সওয়ারী হয় কিছুক্ষণের জন্য। গাড়োয়ান বিরক্ত। ‘তবে রে ব্যাটা’ বলে তেড়ে আসে। ধমক খেয়ে নেমে পড়ে দুষ্টু ছেলের দল। আবার পথচলা শুরু। সন্ধ্যায় শেষ হয় সারা দিনের যাত্রা। বধূ তখন বাপের বাড়িতে পৌঁছে মহাখুশি। উৎকণ্ঠা কাটে তার পথ চেয়ে থাকা স্বজনদেরও। এ গল্প খুব বেশিদিন আগের নয়। মাত্র ২৫-৩০ বছর আগেও বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে প্রধান বাহনই ছিল গরুর গাড়ি। গরুর গাড়ি বাঙালি ঐতিহ্যের অন্যতম প্রতীক। বাঙালি সভ্যতার শুরু থেকেই এ দেশে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল। আমাদের উপমহাদেশের প্রথম মানব সভ্যতা গড়ে ওঠে সিন্ধু নদের তীরে। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা সভ্যতা। সেখানে গরুর গাড়ির ব্যবহার ছিল বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা। পৃথিবীতে গরুর গাড়ির সবচেয়ে প্রাচীন নমুনা পাওয়া যায় ফ্রান্সের আল্পস পর্বতমালার একটা গুহায়। সেখানকার দেয়ালচিত্রে গরুর গাড়ির ছবি আছে। ঐতিহাসিকদের ধারণা, এই দেয়ালচিত্র ব্রোঞ্জ যুগে খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০ বছর আগে আঁকা।
সম্রাট বাবর তখন উজবেকিন্তান ও আফগানিস্তানের বিরাট অঞ্চল দখল করে পা বাড়িয়েছেন ভারতবর্ষের দিকে। দিল্লির সম্রাট তখন ইব্রাহীম লোদি। ভারতবর্ষ আক্রমণের সাহস তখন বিশ্বের অনেক হাঁক-ডাকওয়ালা সম্রাটেরও ছিল না। কিন্তু ছোট্টবেলা থেকেই রাজ্যহারা, পথে পথে ঝটিকা আক্রমণ করে বেড়ানো বাবরের বহুদিনের স্বপ্ন ভারতবর্ষ দখল করার। ইরানের বাদশাহর সঙ্গে তার ভারি ভাব। তিনিই বাবরকে দিয়েছিলেন পৃথিবীর প্রথম মারণাস্ত্র কামান। ইয়া বড় আর বিশাল ভারী কামানগুলো বহন করা হতো গরুর গাড়িতে করে। বাবর কামান নিয়ে হাজির হলেন সিন্ধু নদীর তীরে। নদীর অপর পাড়ে বিশাল সৈন্যবহর নিয়ে হাজির ইব্রাহীম লোদি। সেই বাহিনীর কাছে বাবরের বাহিনী একেবারে নস্যি। তখনই বাবরের গরুর গাড়ি থেকে গর্জে উঠল কামান। ঠিক লক্ষ্যভেদ। প্রথম আঘাতেই ধরাশায়ী ইব্রাহীম লোদি। কামান আর বলদে টানা গরুর গাড়ি দিয়ে মাত্র মিনিট বিশেকের যুদ্ধে বাবর ধুলোয় মিশিয়ে দিলেন বিশ্বের সবচেয়ে প্রতাপশালী স¤্রাটের মসনদ। ষাঁড়ে টানা সেই কামানবাহী গাড়িগুলোই মধ্যযুগের যুদ্ধ ময়দানে আতঙ্ক সৃষ্টি করত প্রতিপক্ষের শিবিরে।
বগুড়ার শেরপুরেও এক সময় দেখা মিলতো গরুর গাড়ি। বিভিন্ন পণ্য পরিবহন করা হতো গরুর গাড়ি দিয়ে। আমরা ছোট বেলায় দেখেছি শেরপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বরোদুয়ারী হাট ও মির্জাপুর হাটে শত শত গরুর গাড়ি আসতো ধান নিয়ে। গরুর গাড়িতে চড়ে বৌও-ঝিয়েরা বাপের বাড়ি আসা যাওয়া করতো। এখন আর এমন দৃশ্য তেমন চোখে পড়ে না।
গরুর গাড়ি তৈরি হয় বাঁশ আর কাঠ দিয়ে। গাড়ির পুরো কাঠামো বাঁশের। চাকা আর এক্সেল তৈরি হয় বাবলা কাঠ দিয়ে। বাবলা কাঠ ভীষণ শক্ত। অনেক ওজন সইতে পারে। গরুর গাড়ির চাকা বেশ বড় হয়। চাকায় কোনো বল-বেয়ারিং থাকে না। কাঠের শক্ত কাঠি এক্সেলে ঢুকিয়ে চাকা ধরে রাখা হয়। গরুর গাড়ির সামনের দিকে বাঁশের তৈরি জোয়াল থাকে। জোয়াল গরুর ঘাড়ে আটকে দেয়া হয়। গাড়োয়ান গরুকে তাগাদা দেন হাঁটার জন্য। গরু হাঁটে, তার কাঁধের ধাক্কায় গাড়িও চলতে থাকে সামনের দিকে। ছই তৈরি হয় বাঁশ, পাটের চট, বেতের পাটি ইত্যাদি দিয়ে। ছইয়ে আলকাতরা মাখিয়ে চট কিংবা পাটির ছিদ্রগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে ছই মজবুত হয়। পানির হাত খেকেও বাঁচে গাড়ির যাত্রীরা। ছইয়ের এত আরেকটা জিনিস ব্যবহার করা হয় গরুর গাড়িতে। একে বলে ধরাট। বাঁশের মাচা দিয়ে তৈরি এই ধরাট বসানো গাড়ির দুপাশে। মাঝখানে রাখা হয় আলু, কুমড়ো ইত্যাদি গড়িয়ে পড়ে যায় এমন ফসল। ধান, পাট, গম ইত্যাদি ফসলের জন্য ধরাটের দরকার হয় না। বাঁশ এবং দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিলেই হয়।
পৃথিবী দিন দিন আধুনিক হচ্ছে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে এ দেশের গ্রাম-গঞ্জেও। গরুর গাড়ির স্থান দখল করে নিয়েছে ব্যাটারীচালিত অটোরিকশা, অটোভ্যান, শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নছিমন ভটভটি ইত্যাদি। সেই ধারাবাহিকতায় প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে গরুর গাড়ি। গরুর গাড়িও হয়তো আশ্রয় নেবে মহাকালের গহিনে ইতিহাসের পাতায়।
বুধবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৫
সাপের এত আঁকাবাঁকা গাঁয়ের পথ। শেষ বিকেলে ধুলো উড়িয়ে চলছে একটা ছইওয়ালা গরুর গাড়ি। সন্ধ্যার আগেই গন্তব্যে পৌঁছতে হবে। গাড়োয়ান বারবার তাগাদা দিচ্ছে বলদজোড়াকে, হাঁট হাঁট। ক্লান্তি মানুষের এত গরুরও আছে। কাকডাকা ভোর থেকে একটানা হেঁটে চলেছে। একটু ঢিল দেওয়ার জো নেই, গতি কমালেই গাড়োয়ানের লাঠির শপাং শাপাং বাড়ি পড়বে পিঠে। ছইয়ের ভেতরে শিশুছেলাটাকে কোলে নিয়ে বসে আছেন গাঁয়ের বধূ।
গাড়ির চাকায় কর্কশ শব্দ, যেন বিরামহীন পথচলায় সে প্রতিবাদ করছে। তবু থামবে না গাড়োয়ান। কখনো কোলাহলমুখর হাটের ভেতর দিয়ে, কখনো লোকালয়ের পাশ দিয়ে ধীরগতিতে এগিয়ে চলেছে গাড়োয়ান। বটতলায় খেলছে একদল ছেলেমেয়ে। দুষ্টু ছেলের দল হাল ছাড়ে না। ছুটে এসে গাড়ির পেছন ধরে ঝুলতে থাকে। ঝুলতে ঝুলতে গাড়ির সওয়ারী হয় কিছুক্ষণের জন্য। গাড়োয়ান বিরক্ত। ‘তবে রে ব্যাটা’ বলে তেড়ে আসে। ধমক খেয়ে নেমে পড়ে দুষ্টু ছেলের দল। আবার পথচলা শুরু। সন্ধ্যায় শেষ হয় সারা দিনের যাত্রা। বধূ তখন বাপের বাড়িতে পৌঁছে মহাখুশি। উৎকণ্ঠা কাটে তার পথ চেয়ে থাকা স্বজনদেরও। এ গল্প খুব বেশিদিন আগের নয়। মাত্র ২৫-৩০ বছর আগেও বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে প্রধান বাহনই ছিল গরুর গাড়ি। গরুর গাড়ি বাঙালি ঐতিহ্যের অন্যতম প্রতীক। বাঙালি সভ্যতার শুরু থেকেই এ দেশে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল। আমাদের উপমহাদেশের প্রথম মানব সভ্যতা গড়ে ওঠে সিন্ধু নদের তীরে। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা সভ্যতা। সেখানে গরুর গাড়ির ব্যবহার ছিল বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা। পৃথিবীতে গরুর গাড়ির সবচেয়ে প্রাচীন নমুনা পাওয়া যায় ফ্রান্সের আল্পস পর্বতমালার একটা গুহায়। সেখানকার দেয়ালচিত্রে গরুর গাড়ির ছবি আছে। ঐতিহাসিকদের ধারণা, এই দেয়ালচিত্র ব্রোঞ্জ যুগে খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০ বছর আগে আঁকা।
সম্রাট বাবর তখন উজবেকিন্তান ও আফগানিস্তানের বিরাট অঞ্চল দখল করে পা বাড়িয়েছেন ভারতবর্ষের দিকে। দিল্লির সম্রাট তখন ইব্রাহীম লোদি। ভারতবর্ষ আক্রমণের সাহস তখন বিশ্বের অনেক হাঁক-ডাকওয়ালা সম্রাটেরও ছিল না। কিন্তু ছোট্টবেলা থেকেই রাজ্যহারা, পথে পথে ঝটিকা আক্রমণ করে বেড়ানো বাবরের বহুদিনের স্বপ্ন ভারতবর্ষ দখল করার। ইরানের বাদশাহর সঙ্গে তার ভারি ভাব। তিনিই বাবরকে দিয়েছিলেন পৃথিবীর প্রথম মারণাস্ত্র কামান। ইয়া বড় আর বিশাল ভারী কামানগুলো বহন করা হতো গরুর গাড়িতে করে। বাবর কামান নিয়ে হাজির হলেন সিন্ধু নদীর তীরে। নদীর অপর পাড়ে বিশাল সৈন্যবহর নিয়ে হাজির ইব্রাহীম লোদি। সেই বাহিনীর কাছে বাবরের বাহিনী একেবারে নস্যি। তখনই বাবরের গরুর গাড়ি থেকে গর্জে উঠল কামান। ঠিক লক্ষ্যভেদ। প্রথম আঘাতেই ধরাশায়ী ইব্রাহীম লোদি। কামান আর বলদে টানা গরুর গাড়ি দিয়ে মাত্র মিনিট বিশেকের যুদ্ধে বাবর ধুলোয় মিশিয়ে দিলেন বিশ্বের সবচেয়ে প্রতাপশালী স¤্রাটের মসনদ। ষাঁড়ে টানা সেই কামানবাহী গাড়িগুলোই মধ্যযুগের যুদ্ধ ময়দানে আতঙ্ক সৃষ্টি করত প্রতিপক্ষের শিবিরে।
বগুড়ার শেরপুরেও এক সময় দেখা মিলতো গরুর গাড়ি। বিভিন্ন পণ্য পরিবহন করা হতো গরুর গাড়ি দিয়ে। আমরা ছোট বেলায় দেখেছি শেরপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বরোদুয়ারী হাট ও মির্জাপুর হাটে শত শত গরুর গাড়ি আসতো ধান নিয়ে। গরুর গাড়িতে চড়ে বৌও-ঝিয়েরা বাপের বাড়ি আসা যাওয়া করতো। এখন আর এমন দৃশ্য তেমন চোখে পড়ে না।
গরুর গাড়ি তৈরি হয় বাঁশ আর কাঠ দিয়ে। গাড়ির পুরো কাঠামো বাঁশের। চাকা আর এক্সেল তৈরি হয় বাবলা কাঠ দিয়ে। বাবলা কাঠ ভীষণ শক্ত। অনেক ওজন সইতে পারে। গরুর গাড়ির চাকা বেশ বড় হয়। চাকায় কোনো বল-বেয়ারিং থাকে না। কাঠের শক্ত কাঠি এক্সেলে ঢুকিয়ে চাকা ধরে রাখা হয়। গরুর গাড়ির সামনের দিকে বাঁশের তৈরি জোয়াল থাকে। জোয়াল গরুর ঘাড়ে আটকে দেয়া হয়। গাড়োয়ান গরুকে তাগাদা দেন হাঁটার জন্য। গরু হাঁটে, তার কাঁধের ধাক্কায় গাড়িও চলতে থাকে সামনের দিকে। ছই তৈরি হয় বাঁশ, পাটের চট, বেতের পাটি ইত্যাদি দিয়ে। ছইয়ে আলকাতরা মাখিয়ে চট কিংবা পাটির ছিদ্রগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে ছই মজবুত হয়। পানির হাত খেকেও বাঁচে গাড়ির যাত্রীরা। ছইয়ের এত আরেকটা জিনিস ব্যবহার করা হয় গরুর গাড়িতে। একে বলে ধরাট। বাঁশের মাচা দিয়ে তৈরি এই ধরাট বসানো গাড়ির দুপাশে। মাঝখানে রাখা হয় আলু, কুমড়ো ইত্যাদি গড়িয়ে পড়ে যায় এমন ফসল। ধান, পাট, গম ইত্যাদি ফসলের জন্য ধরাটের দরকার হয় না। বাঁশ এবং দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিলেই হয়।
পৃথিবী দিন দিন আধুনিক হচ্ছে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে এ দেশের গ্রাম-গঞ্জেও। গরুর গাড়ির স্থান দখল করে নিয়েছে ব্যাটারীচালিত অটোরিকশা, অটোভ্যান, শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নছিমন ভটভটি ইত্যাদি। সেই ধারাবাহিকতায় প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে গরুর গাড়ি। গরুর গাড়িও হয়তো আশ্রয় নেবে মহাকালের গহিনে ইতিহাসের পাতায়।