কেন্দুয়া (নেত্রকোনা) : অসহায় জীবন কাটাচ্ছে ‘হিরালি’ পরিবারগুলো -সংবাদ
এক সময় কৃষক আগাম প্রাকৃতিক দুর্যোগের সতর্ক সংকেত জানতে হিরালিদের দারস্থ হতেন। তখনকার সময়ে হিরালি তারাও গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষকদের প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর পৌঁছে দিনেন। বিশেষ করে কৃষক জমিতে বোরো ধান রোপণের পর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে হিরালিরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের ফসল রক্ষায় আগাম সতর্কবার্তা দিতেন। তারা জানিয়ে আসতেন হাওরে কবে শিলাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ও ঝড়-তুফান কেমন হবে, কোনো কোনো এলাকায় বেশি হবে। কোনো কোনো হাওরের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এসব বার্তা কৃষকদের তারা দিতেন এবং তা প্রতিরোধের উপায়ও বলে দিতেন। অনেক সময় তাদের দেয়া আগাম বার্তার যথার্থতাও খুঁজে পেতেন কৃষকরা।
তাই গ্রামের কৃষকের কাছে বিশ্বস্ত ছিল হিরালি। অনেক সময় গ্রামের কৃষক হিরালিদের অপেক্ষায় থাকতেন আবার অনেক কৃষক হিরালিদের খুঁজে তারে গ্রামে গিয়ে ফসল রক্ষায় প্রতিক্ষার এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের বার্তা শুনে আসতেন। নেত্রকোনা জেলার বাংলাদেশের মধ্যে একটি হাওর অধুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত রয়েছে এই জেলায় যেমন বোর ধান উৎপাদন হয়, তেমনি মাছের রয়েছে বিশাল সমাহার।
জেলায় ১০টি থানা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম এবং বড় কেন্দুয়া উপজেলা একসময় কেন্দুয়া উপজেলার হিরালিদের কদর ছিল সারা জেলাজুড়ে।
তখন কার সময়ে কৃষক ফসল ঘরে তোলার পর হিরালিদের খুশি হয়ে তাদের ধান, চাল, মরিচ, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন পণ্য উপহার দিতেন। তা দিয়েই চলতো হিরালি পরিবারগুলোর জীবিকা।
বলছিলাম কেন্দুয়া উপজেলার কান্দিউড়া ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া গ্রামের হিরালি পরিবারের কথা। এই গ্রামটিতে এখনও সত্তর বছর বয়সি হাছু মিয়া হিরালি, পঞ্চান্ন বছর বয়সি ইদ্রিস আলী হিরালিসহ অন্তত ৭-৮টি হিরালি পরিবার রয়েছে। তারা বংশ পরম্পরায় এ পেশা ধরে রেখেছেন এখনও।
বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির বদৌলতে সহজেই সাধারণ মানুষ সব ধরণের আবহাওয়া বার্তা পেয়ে যান। তাই তন্ত্রসাধক হিরালি লোকপ্রথার আর তেমন কোনো কদর নেই। দিন দিনই বিলোপ ঘটছে এই লোকজনের পেশা।
তাই এই পরিবারগুলো চরম কষ্টে দিন কাটছে তাদের। তবে অনেকেই পেশা বদল করে অন্য পেশায় জীবিকা নির্বাহের উপায় খুঁজে নিয়েছেন।
ইদ্রিস আলী হিরালি বলেন, আমি বেশ কয়েক বছর এ পেশায় ছিলাম। এক সময় কৃষকরা আমাদের বেশ সম্মানের চোখে দেখলেও এখন কেউই আর তেমন কোনো গুরুত্ব দেয় না। আমাদের নিয়ে লোকজন হাসি-ঠাট্টা করে। তাই লজ্জায় এ পেশা ছেড়ে দিয়ে ছোট একটা ব্যবসা করে কোনো রকম জীবন চালাচ্ছি।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আবুল কাশেম জানান, মুরুব্বিদের কাছে আমরা শুনে এসেছি যে, ওসমত হিরালি একবার একটি হাওরের বোরো ধান রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
তারপর তিনি জানতে পারেন, ওই হাওরে প্রচ- শিলাবৃষ্টি হবে। শিলাবৃষ্টির কবল থেকে ফসল রক্ষার জন্য তিনি তন্ত্রসাধনা শুরু করেন। একপর্যায়ে শিলাবৃষ্টি ঠিকই শুরু হয়। কিন্তু সেই বৃষ্টি হাওরে না হয়ে সব শিলা পড়ে ওসমত হিরালির ওপর এবং তিনি মারা যান। এরকম আরও অসংখ্য জনশ্রুতি লোকমুখে ছড়িয়ে আছে হিরালিদের নিয়ে।
স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মী মনিরুজ্জামান রাফি বলেন, হাওরাঞ্চলের লোকসংস্কৃতির একটি অংশ হচ্ছে হিরালি প্রথা। এই পেশাটি বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। পেশাটি এখনও যেকজন ধরে রেখেছেন এবং অনাদর, অবহেলা ও অসহায় অব স্থায় জীবনযাপন করছেন, সরকারের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ান।
কান্দিউড়া ইউনিয়নের তারাকান্দিয়া গ্রামের, হয়দার আলী, সেলিম মিয়া, সালাম মিয়া, মাজু মিয়া, তারা জানান, আমরা এখন সময় বোর ধান রোপণের পর হিরালিদের অপেক্ষায় থাকতাম। তারা কখন আমাদের গ্রামে আসবেন তাদের কাছ থেকে শিলাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ও ঝড়-তুফান কেমন হবে, তা শুনার পর, তাদের কাছ থেকে তার প্রতিক্ষার জেনে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতাম। এখন আর হিরালি গ্রামে আসেনা আমরাও তাদের দেখি না। আর যেহেতু হাতে মোবাইল ফোন রয়েছে এখন আবহাওয়া আগাম বার্তা মোবাইলে শুনেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখি। তবে এই পেশার লোকজনকে এখনও আমরা মূল্যায়ন করি।
কেন্দুয়া উপজেলার ১০ নং কান্দিউড়া ইউনিয়ন বিএনপি সাবেক সাধারণ সম্পাদক, দীঘলকুর্শা গ্রামের বাসিন্দা রিপন মল্লিক, জানান, বর্তমান হিরালি পরিবারগুলো আমরা একই ইউনিয়নের বাসিন্দা।
এক সময় তারা আমাদের গ্রামে আসতেন আমরা তাদের কাছ থেকে ফসল রক্ষায় অনেক পরামর্শ পেতাম কিন্তু যুগের পরিবর্তনে তারা অনেকে এই পেশায় নেই। তার মানে এই নয় যে, আমরা তাদের ভুলে গেছি আমরা তাদের এখনও সম্মান করি। আমি বর্তমান সরকারের কাছে দাবি জানাই এই পেশার লোকজনের পাশে দাঁড়ানোর।
এ বিষয়ে কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এমদাদুল হক তালুকদার জানান, বাংলা ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে এমন অনেক পেশা কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে। উন্নত বিশ্বে এমন পেশা সাধারণত নানা ফরমেটে সংরক্ষণ করা হয় এবং তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়।
আমাদের মতো অর্থনৈতিকভাবে সীমাবদ্ধতাসম্পন্ন দেশে এটা অনেক কঠিন। তদুপরি, তাদের কীভাবে পুনর্বাসনের ব্যাবস্থা করা যায় তার যথাসাধ্য চেষ্টা থাকবে সরকারের পক্ষ থেকে।
কেন্দুয়া (নেত্রকোনা) : অসহায় জীবন কাটাচ্ছে ‘হিরালি’ পরিবারগুলো -সংবাদ
রোববার, ২০ এপ্রিল ২০২৫
এক সময় কৃষক আগাম প্রাকৃতিক দুর্যোগের সতর্ক সংকেত জানতে হিরালিদের দারস্থ হতেন। তখনকার সময়ে হিরালি তারাও গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষকদের প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর পৌঁছে দিনেন। বিশেষ করে কৃষক জমিতে বোরো ধান রোপণের পর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে হিরালিরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের ফসল রক্ষায় আগাম সতর্কবার্তা দিতেন। তারা জানিয়ে আসতেন হাওরে কবে শিলাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ও ঝড়-তুফান কেমন হবে, কোনো কোনো এলাকায় বেশি হবে। কোনো কোনো হাওরের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এসব বার্তা কৃষকদের তারা দিতেন এবং তা প্রতিরোধের উপায়ও বলে দিতেন। অনেক সময় তাদের দেয়া আগাম বার্তার যথার্থতাও খুঁজে পেতেন কৃষকরা।
তাই গ্রামের কৃষকের কাছে বিশ্বস্ত ছিল হিরালি। অনেক সময় গ্রামের কৃষক হিরালিদের অপেক্ষায় থাকতেন আবার অনেক কৃষক হিরালিদের খুঁজে তারে গ্রামে গিয়ে ফসল রক্ষায় প্রতিক্ষার এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের বার্তা শুনে আসতেন। নেত্রকোনা জেলার বাংলাদেশের মধ্যে একটি হাওর অধুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত রয়েছে এই জেলায় যেমন বোর ধান উৎপাদন হয়, তেমনি মাছের রয়েছে বিশাল সমাহার।
জেলায় ১০টি থানা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম এবং বড় কেন্দুয়া উপজেলা একসময় কেন্দুয়া উপজেলার হিরালিদের কদর ছিল সারা জেলাজুড়ে।
তখন কার সময়ে কৃষক ফসল ঘরে তোলার পর হিরালিদের খুশি হয়ে তাদের ধান, চাল, মরিচ, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন পণ্য উপহার দিতেন। তা দিয়েই চলতো হিরালি পরিবারগুলোর জীবিকা।
বলছিলাম কেন্দুয়া উপজেলার কান্দিউড়া ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া গ্রামের হিরালি পরিবারের কথা। এই গ্রামটিতে এখনও সত্তর বছর বয়সি হাছু মিয়া হিরালি, পঞ্চান্ন বছর বয়সি ইদ্রিস আলী হিরালিসহ অন্তত ৭-৮টি হিরালি পরিবার রয়েছে। তারা বংশ পরম্পরায় এ পেশা ধরে রেখেছেন এখনও।
বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির বদৌলতে সহজেই সাধারণ মানুষ সব ধরণের আবহাওয়া বার্তা পেয়ে যান। তাই তন্ত্রসাধক হিরালি লোকপ্রথার আর তেমন কোনো কদর নেই। দিন দিনই বিলোপ ঘটছে এই লোকজনের পেশা।
তাই এই পরিবারগুলো চরম কষ্টে দিন কাটছে তাদের। তবে অনেকেই পেশা বদল করে অন্য পেশায় জীবিকা নির্বাহের উপায় খুঁজে নিয়েছেন।
ইদ্রিস আলী হিরালি বলেন, আমি বেশ কয়েক বছর এ পেশায় ছিলাম। এক সময় কৃষকরা আমাদের বেশ সম্মানের চোখে দেখলেও এখন কেউই আর তেমন কোনো গুরুত্ব দেয় না। আমাদের নিয়ে লোকজন হাসি-ঠাট্টা করে। তাই লজ্জায় এ পেশা ছেড়ে দিয়ে ছোট একটা ব্যবসা করে কোনো রকম জীবন চালাচ্ছি।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আবুল কাশেম জানান, মুরুব্বিদের কাছে আমরা শুনে এসেছি যে, ওসমত হিরালি একবার একটি হাওরের বোরো ধান রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
তারপর তিনি জানতে পারেন, ওই হাওরে প্রচ- শিলাবৃষ্টি হবে। শিলাবৃষ্টির কবল থেকে ফসল রক্ষার জন্য তিনি তন্ত্রসাধনা শুরু করেন। একপর্যায়ে শিলাবৃষ্টি ঠিকই শুরু হয়। কিন্তু সেই বৃষ্টি হাওরে না হয়ে সব শিলা পড়ে ওসমত হিরালির ওপর এবং তিনি মারা যান। এরকম আরও অসংখ্য জনশ্রুতি লোকমুখে ছড়িয়ে আছে হিরালিদের নিয়ে।
স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মী মনিরুজ্জামান রাফি বলেন, হাওরাঞ্চলের লোকসংস্কৃতির একটি অংশ হচ্ছে হিরালি প্রথা। এই পেশাটি বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। পেশাটি এখনও যেকজন ধরে রেখেছেন এবং অনাদর, অবহেলা ও অসহায় অব স্থায় জীবনযাপন করছেন, সরকারের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ান।
কান্দিউড়া ইউনিয়নের তারাকান্দিয়া গ্রামের, হয়দার আলী, সেলিম মিয়া, সালাম মিয়া, মাজু মিয়া, তারা জানান, আমরা এখন সময় বোর ধান রোপণের পর হিরালিদের অপেক্ষায় থাকতাম। তারা কখন আমাদের গ্রামে আসবেন তাদের কাছ থেকে শিলাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ও ঝড়-তুফান কেমন হবে, তা শুনার পর, তাদের কাছ থেকে তার প্রতিক্ষার জেনে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতাম। এখন আর হিরালি গ্রামে আসেনা আমরাও তাদের দেখি না। আর যেহেতু হাতে মোবাইল ফোন রয়েছে এখন আবহাওয়া আগাম বার্তা মোবাইলে শুনেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখি। তবে এই পেশার লোকজনকে এখনও আমরা মূল্যায়ন করি।
কেন্দুয়া উপজেলার ১০ নং কান্দিউড়া ইউনিয়ন বিএনপি সাবেক সাধারণ সম্পাদক, দীঘলকুর্শা গ্রামের বাসিন্দা রিপন মল্লিক, জানান, বর্তমান হিরালি পরিবারগুলো আমরা একই ইউনিয়নের বাসিন্দা।
এক সময় তারা আমাদের গ্রামে আসতেন আমরা তাদের কাছ থেকে ফসল রক্ষায় অনেক পরামর্শ পেতাম কিন্তু যুগের পরিবর্তনে তারা অনেকে এই পেশায় নেই। তার মানে এই নয় যে, আমরা তাদের ভুলে গেছি আমরা তাদের এখনও সম্মান করি। আমি বর্তমান সরকারের কাছে দাবি জানাই এই পেশার লোকজনের পাশে দাঁড়ানোর।
এ বিষয়ে কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এমদাদুল হক তালুকদার জানান, বাংলা ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে এমন অনেক পেশা কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে। উন্নত বিশ্বে এমন পেশা সাধারণত নানা ফরমেটে সংরক্ষণ করা হয় এবং তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়।
আমাদের মতো অর্থনৈতিকভাবে সীমাবদ্ধতাসম্পন্ন দেশে এটা অনেক কঠিন। তদুপরি, তাদের কীভাবে পুনর্বাসনের ব্যাবস্থা করা যায় তার যথাসাধ্য চেষ্টা থাকবে সরকারের পক্ষ থেকে।