গাইবান্ধা : ভাঙনকবলিত এলাকা -সংবাদ
তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র যমুনা নদী বৈষ্টিত উত্তর জনপদের মানুষজনের জীবনযাত্রার উন্নয়নে অন্যতম অন্তরায় নদীভাঙন। বাৎসরিক নদীর ভাঙনে চরাঞ্চলের মানুষজনের বাড়িঘর টানাটানি আর আবাদি জমি বালু পড়ে অনবাদি হওয়ায় জীবনযাত্রার উন্নয়নে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। এতে করে দারিদ্র্যতার চরম বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না রংপুর বিভাগের অন্ততপক্ষে ২০ লাখ মানুষ।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণউন্নয়ন কেন্দ্র (জিইউকে) এর চর জরিপের তথ্য অনুযায়ী রংপুর বিভাগের তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর চরাঞ্চলে ৪১৬টি গ্রামে প্রায় ২০ লাখ মানুষ বসবাস। প্রতিবছর অন্ততপক্ষে ১০ হাজার মানুষ নদীভাঙনের শিকার হয়। সারাবছর নদীভাঙনে শিকার মানুষজন অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় জীবন দারিদ্র্যতার সূচক থেকে মুক্ত হতে পারছে না। এতে করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) সূচক অর্জনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার মোল্লারচর গ্রামের হামিদা বেগম। গ্রামের একজন সাধারণ নারী থেকে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ৪৫ বছরের জীবনে হামিদা বেগম ২০ বার নদীভাঙনে বিভিন্ন শিকার হয়েছেন। এই সময়ে আবাদি কৃষি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে নানা চরের ঘুরে ফিরেই কোনোমতে বেঁচে আছেন।
কামারজানি ইউনিয়নের সাবিনা বেগম জানান, ১০ বছর বয়সে পিতা-মাতা আমাকে বিয়ে দেয়। চরাঞ্চলের সামাজিক রীতি অনুযায়ী বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে জীবন চলার পথের কষ্ট আমি বুঝি। শুধুমাত্র দারিদ্র্যতার কারণে পিতা-মাতা আমাকে বিয়ে দেয়। কিন্তু আমি সেই ভুল করেনি। আমাদের সন্তানদের পড়ালেখা করাচ্ছি। তিনি বলেন নারীদের সমস্যাগুলো কেউ শুনতে চায় না।
এই চরের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন জানান, চরের মানুষজনের নানা দুর্ভোগ। নদীভাঙন, বন্যা, খরা, যাতায়াত, কৃষিপণ্য পরিবহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা-এসব নানা দুর্ভোগ নিয়েই চলতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নানা ধরণের নতুন নতুন দুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো মোকাবিলা করার সক্ষমতা ও জ্ঞানও নেই মানুষজনের।
গাইবান্ধা সাঘাটা উপজেলার দিঘলকানি চরের নুর ইসলাম প্রামানিক বলেন, নদীভাঙন বড় আতঙ্কে গত দু’বছরে চার বাড়িঘর সরাতে হয়েছে।
কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুরের চাষী আমিনুল ইসলাম জানান, নদীভাঙনের মতিগতি এখন আর বোঝা যায় না। এ কারণে আবাদী জমি নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে। আবার চরের জমি এক বছর চাষাবাদ করা গেলেও পরের বছর বালু পড়ে অনাবাদি হয়ে পড়ছে। এই গ্রামের কুদ্দুস বিশ্বাস জানান, কেন সারাবছর নদীভাঙন হচ্ছে, চরে বেশিরভাগ মানুষ জানেন না, এজন্য তিনি জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করছেন। তিনি বলেন, জলবায়ুর ক্ষতির সাথে সম্পৃক্ত দেশগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
রংপুরের পীরগাছা উপজেলার পাওটানা গ্রামের তাজুল ইসলাম জানান, নদীভাঙনে চর ও নদী পাড়ের মানুষজন সোঁজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবে এসব হচ্ছে বলে তিনি জানলেও প্রতিরোধ কোন কাজ হচ্ছে না বলে তিনি অভিযোগ করেন।
বিশিষ্ট লেখক জহুরুল কাইয়ুম জানান, উত্তরজনপদের মানুষজনের জীবনযাত্রা নির্ভর করে কৃষি চাষাবাদের ওপর। কিন্তু প্রতিবছর নদীভাঙন কৃষিতে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। এজন্য তিনি নদীভাঙনকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নত করে পদক্ষেপ গ্রহণ পরামর্শ প্রদান করেন।
উত্তরাঞ্চলভিত্তিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণউন্নয়ন কেন্দ্রের নির্বাহী প্রধান এম. আবদুস সালাম জানান, বন্যাকে দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও নদীভাঙনকে সেভাবে চিহ্নিত করা হয়। এ কারণে নদীভাঙনের শিকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ সহায়তাও পায় না। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত জানান, চরের মানুষজনের উন্নয়নে কোনো টেকসই প্রকল্প নেই। ভাঙন একটি অন্যতম সমস্যা হলেও চরের গ্রামগুলো রক্ষায় তেমন পদক্ষেপ নেই। এতে মানুষজন বিভিন্ন চরের স্থায়ীভাবে বসতি গড়ার পরিকল্পনা করতে পারে না। ফলে, স্থায়ী অনেক পরিকল্পনাই জনগণ করতে পারে না।
উত্তর জনপদের মানুষজন ও উন্নয়ন গবেষকেরা চরের উন্নয়নে নদীভাঙন প্রতিরোধকে প্রাধান্য দিয়ে টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সরকারের প্রতি দাবি জানান।
গাইবান্ধা : ভাঙনকবলিত এলাকা -সংবাদ
সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫
তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র যমুনা নদী বৈষ্টিত উত্তর জনপদের মানুষজনের জীবনযাত্রার উন্নয়নে অন্যতম অন্তরায় নদীভাঙন। বাৎসরিক নদীর ভাঙনে চরাঞ্চলের মানুষজনের বাড়িঘর টানাটানি আর আবাদি জমি বালু পড়ে অনবাদি হওয়ায় জীবনযাত্রার উন্নয়নে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। এতে করে দারিদ্র্যতার চরম বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না রংপুর বিভাগের অন্ততপক্ষে ২০ লাখ মানুষ।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণউন্নয়ন কেন্দ্র (জিইউকে) এর চর জরিপের তথ্য অনুযায়ী রংপুর বিভাগের তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর চরাঞ্চলে ৪১৬টি গ্রামে প্রায় ২০ লাখ মানুষ বসবাস। প্রতিবছর অন্ততপক্ষে ১০ হাজার মানুষ নদীভাঙনের শিকার হয়। সারাবছর নদীভাঙনে শিকার মানুষজন অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় জীবন দারিদ্র্যতার সূচক থেকে মুক্ত হতে পারছে না। এতে করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) সূচক অর্জনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার মোল্লারচর গ্রামের হামিদা বেগম। গ্রামের একজন সাধারণ নারী থেকে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ৪৫ বছরের জীবনে হামিদা বেগম ২০ বার নদীভাঙনে বিভিন্ন শিকার হয়েছেন। এই সময়ে আবাদি কৃষি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে নানা চরের ঘুরে ফিরেই কোনোমতে বেঁচে আছেন।
কামারজানি ইউনিয়নের সাবিনা বেগম জানান, ১০ বছর বয়সে পিতা-মাতা আমাকে বিয়ে দেয়। চরাঞ্চলের সামাজিক রীতি অনুযায়ী বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে জীবন চলার পথের কষ্ট আমি বুঝি। শুধুমাত্র দারিদ্র্যতার কারণে পিতা-মাতা আমাকে বিয়ে দেয়। কিন্তু আমি সেই ভুল করেনি। আমাদের সন্তানদের পড়ালেখা করাচ্ছি। তিনি বলেন নারীদের সমস্যাগুলো কেউ শুনতে চায় না।
এই চরের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন জানান, চরের মানুষজনের নানা দুর্ভোগ। নদীভাঙন, বন্যা, খরা, যাতায়াত, কৃষিপণ্য পরিবহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা-এসব নানা দুর্ভোগ নিয়েই চলতে হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নানা ধরণের নতুন নতুন দুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো মোকাবিলা করার সক্ষমতা ও জ্ঞানও নেই মানুষজনের।
গাইবান্ধা সাঘাটা উপজেলার দিঘলকানি চরের নুর ইসলাম প্রামানিক বলেন, নদীভাঙন বড় আতঙ্কে গত দু’বছরে চার বাড়িঘর সরাতে হয়েছে।
কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুরের চাষী আমিনুল ইসলাম জানান, নদীভাঙনের মতিগতি এখন আর বোঝা যায় না। এ কারণে আবাদী জমি নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে। আবার চরের জমি এক বছর চাষাবাদ করা গেলেও পরের বছর বালু পড়ে অনাবাদি হয়ে পড়ছে। এই গ্রামের কুদ্দুস বিশ্বাস জানান, কেন সারাবছর নদীভাঙন হচ্ছে, চরে বেশিরভাগ মানুষ জানেন না, এজন্য তিনি জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করছেন। তিনি বলেন, জলবায়ুর ক্ষতির সাথে সম্পৃক্ত দেশগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
রংপুরের পীরগাছা উপজেলার পাওটানা গ্রামের তাজুল ইসলাম জানান, নদীভাঙনে চর ও নদী পাড়ের মানুষজন সোঁজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবে এসব হচ্ছে বলে তিনি জানলেও প্রতিরোধ কোন কাজ হচ্ছে না বলে তিনি অভিযোগ করেন।
বিশিষ্ট লেখক জহুরুল কাইয়ুম জানান, উত্তরজনপদের মানুষজনের জীবনযাত্রা নির্ভর করে কৃষি চাষাবাদের ওপর। কিন্তু প্রতিবছর নদীভাঙন কৃষিতে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। এজন্য তিনি নদীভাঙনকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নত করে পদক্ষেপ গ্রহণ পরামর্শ প্রদান করেন।
উত্তরাঞ্চলভিত্তিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণউন্নয়ন কেন্দ্রের নির্বাহী প্রধান এম. আবদুস সালাম জানান, বন্যাকে দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও নদীভাঙনকে সেভাবে চিহ্নিত করা হয়। এ কারণে নদীভাঙনের শিকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ সহায়তাও পায় না। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত জানান, চরের মানুষজনের উন্নয়নে কোনো টেকসই প্রকল্প নেই। ভাঙন একটি অন্যতম সমস্যা হলেও চরের গ্রামগুলো রক্ষায় তেমন পদক্ষেপ নেই। এতে মানুষজন বিভিন্ন চরের স্থায়ীভাবে বসতি গড়ার পরিকল্পনা করতে পারে না। ফলে, স্থায়ী অনেক পরিকল্পনাই জনগণ করতে পারে না।
উত্তর জনপদের মানুষজন ও উন্নয়ন গবেষকেরা চরের উন্নয়নে নদীভাঙন প্রতিরোধকে প্রাধান্য দিয়ে টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সরকারের প্রতি দাবি জানান।