alt

সারাদেশ

পাথারিয়া বনাঞ্চলের এক হাজার বর্গ কিমি. পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিপন্ন

প্রতিনিধি, শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) : শনিবার, ১০ মে ২০২৫

সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তরেখার মধ্যবর্তী চারটি বনবিট নিয়ে গঠিত পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্টের বনভূমি একশ্রেণীর প্রভাব প্রতিপত্তিশালী লোকজন এক হাজার বর্গ কিলোমিটারের ওপর বনভূমি দখল করে নেয়ায় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখোমুখি বলে জানা গেছে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুপম সৃষ্টি উপজেলার উত্তর ও পূর্বে পাথারিয়া পাহাড় অঞ্চল। উত্তর-দক্ষিণে প্রায় পঁচিশ মাইল বিস্তৃত। পাথারিয়ার চিরহরিৎ বনাঞ্চল বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ। পাথারিয়া পাহাড়ের জন্ম প্লায়োস্টিসিন কালের মধ্যভাগে, অর্থাৎ দেড় থেকে দুই কোটি বছর আগে। বড়লেখার পাথারিয়া বনভূমি থেকে হাকালুকি হাওর যেন বড়লেখা থানার পূর্ব-পশ্চিম পাড়ের গীতিময় কথোপকথন। পাথারিয়া পাহাড়ে আছে তিনটি উল্লেখ যোগ্য কৃঙ্গ। যথাক্রমে দূরবীনটিলা, গগনটিলা ও রাজবাড়িটিলা। এগুলোর উচ্ছতা প্রায় ২৪৪ মিটার। হাতের মাপে প্রায় ৫৩৪ হাত।

পাহাড়ের চারদিকে সবুজের পরিবেশ। ওপরে নীল আকাশ। নিচে থরে থরে সাজানো আকাশ চুম্বি পাথারিয়া পাহাড়। বিকেল পাহাড় মাথা উঁচু করে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিধাতা যেন পাহাড়টিকে তুলির অপূর্ব আঁচড়ে অপরূপ রূপে রূপায়িত করেছেন।

এই পাহাড় প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। পাথারিয়া পাহাড়ে আছে তেলকূপ। এখান থেকে তেল উত্তোলনের জন্য বার্মা অয়েল কোম্পানি (বিওসি) ১৯৩৩ সালে তেলকূপ খননের চেষ্টা চালানোর সময় পাইপ ফেটে যায়। তেলের ঊর্ধ্বচাপে তা উপত্যকা ও পাশ্ববর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে জনমনে ভীতির সঞ্চার হয়। কয়েকদিন তেলের বন্যা বয়ে যায়। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তবে এখনও তেলকূপের ঢাকনির উপর কান রাখলে তেলের গমগম শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। এক সময়ে স্থানীয় লোকেরা এই তেল সংগ্রহ করে পিদিম বা কুপির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করত।

পাথারিয়া পাহাড়ের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র সম্পর্কে এই এলাকাই বেড়ে ওঠা সন্তান বিশিষ্ট বোটানিস্ট ও অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা বলেন- পাথারিয়া পাহাড়ে বড়বড় গাছ, বাঁশঝাড়, অজগ্র জাতের লতা, ঢাউস পাতার বুনো রামকলার ঝোঁপ। ফুলের মধ্যে আছে আশোক, দেবকাঞ্চন, কনকচাঁপা, পারুল, জংলীজুঁই, নাগবাল্লী, লুটকি, নীললতা, টালি, ল্যডিস আম্ব্রেলা, ডুলিচাঁপা, ম্যাগনোলিয়া এবং আরও নানান জাতের ফুল। ফল-ফসলের মধ্যে আছে বিভিন্ন রকমের শাক, কচু, লতি, বাঁশের খোড়ল (করিল), লেবু, রামকলা, ডেউয়া, লুকলুকি, ক্ষুদিজাম, চালতা, জাম, বহেড়া, হরিতকি, বুনো আম, কাঠাল, আমলকি, গোলাপজাম, সাতকরা লেবু, তৈকর, আশফল, গুঙ্গাআলু এবং আরও নানা জাতের পাহাড়ি ফলমূল। এই পাহাড়ে রয়েছে বিচিত্র রকমের বন্যপ্রাণী জংলীহাতি, বানর, হনুমান, বাগডাস, মেছোবাঘ, বনরুই, হরিণ, খরগোস, অজগর সাপ প্রভৃতি। পাখ-পাখালির মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। বনমোরগ, শকুন, ঈগল, তিতির, শ্যামা, ভিমরাজ আরও বিভিন্নজাতের পাখি। তবে অবাধে বন্যপ্রাণী শিকার করার কারণে এখন আর আগের এত দেখতে পাওয়া যায় না।

পাথারিয়া পাহাড়ের বুকে সৃষ্ট বড়লেখার ঐতিহ্য মাধবতীর্থ মাধবকুন্ড দেশের তথা বিশ্বের পর্যটন মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের ধারাপতনের অবিরাম শব্দ সৃষ্টি করছে মায়াময় পরিবেশের। প্রকৃতি যেন বর্ণনার উৎস নিয়ে সামনে দাঁড়ায়। পাথারিয়া পাহাড় কঠিন পাথরে গঠিত। পাহাড়ের বিস্তৃত এলাকাজুড়ে প্রবহমান ছড়া রয়েছে। উপরের অংশ গঙ্গামারা আর নিচের অংশ মাধবছড়া। মাধবছড়া পাথারিয়া পাহাড়ের গঙ্গামারা থেকে গড়িয়ে আসা জল প্রায় দুশত ফুট উঁচু থেকে নিচে খাড়াভাবে গড়িয়ে পড়ছে।

একশ্রেণীর প্রভাব প্রতিপত্তিশালী লোকজন অবৈধভাবে দখল করে জনবসতি স্থাপনের কারণে বিগত অর্ধশত বছরে পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্ট বনাঞ্চলের আয়তন ১ হাজার ১৫২ বর্গ কিলোমিটার থেকে মাত্র ১৩৫ বর্গকিলোমিটারে নেমে এসেছে বলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছেÑ যা বন্যপ্রাণী ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।

আবাসস্থল সংকটে ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে এই বনের বিভিন্ন প্রজাতির জীববৈচিত্র্য। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এখনও টিকে আছে প্রায় ৩৮ প্রজাতির স্থন্যপায়ী প্রাণী। এগুলোও খাবার সংকটে বন ছেড়ে ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। বনাঞ্চল রক্ষা ও বন্যপ্রাণীর আবাস্থল নিরাপদ রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়ায় বর্তমানে যেটুকু আছে সেটিও হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে বনাঞ্চল, প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য কঠিন বিপর্যয়ের মুখোমুখি।

ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র হটস্পটের মিশ্র চিরসবুজ বনাঞ্চল পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্টের পূর্ব দিকে ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ, উত্তরে শাহবাজপুর আর দক্ষিণ ও পশ্চিমে চা-বাগান। পাহাড়ের মাঝে মাঝে একশ্রেণীর মানুষের বসতি। পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্ট নামটি এখনও অনেকের কাছে পরিচিত নয়। কিন্তু মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের কথা দেশ-বিদেশের সবার কাছেই পরিচিত। মাধবকুন্ড জলপ্রপাত পাথারিয়া পাহাড়ে পরিবেশগতভাবে মিশ্র চিরসবুজ বনাঞ্চলের এ অংশটি ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্য হটস্পটের অংশ।

১৯২০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে এই বনকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৭ সালে পাথারিয়া পাহাড়ের আয়তন ছিল ১ হাজার ১৫২ বর্গকিলোমিটার ছিল বলে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছে। ক্রমশ মানুষের বসতি বেড়ে এই বনের আয়তন দিন দিন কমছে। বর্তমানে পাথারিয়া পাহাড়ের সম্মিলিত আয়তন মাত্র ১৩৫ বর্গকিলোমিটারে এসেছে বলে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানা গেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৮৮ বর্গকিলোমিটার আর ৪৭ বর্গকিলোমিটার পড়েছে ভারত অংশে।

পাথারিয়া বনে বুনো মোষ, বাঘ, জলার হরিণ, গন্ডারসহ বড় আকারের অনেক বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ছিল।

বিগত দুই বছর আগেও ক্যামেরা ট্র্যাপিং করে এই বনে এশীয় হাতি, বিপন্ন ফেরেট ব্যাজার, বাঁশ ভাল্লুক, সজারু, হলদে গলা মারটেন, আসামি বানরসহ অনেক বিপন্ন প্রাণী দেখা গেছে।

সর্বশেষ ২০০৭ সালে বনের সুরমা বাঁশমহাল এলাকায় চিতা বাঘের আক্রমণে একটি গরু মারা যায়। তখন গরুর মালিক ক্ষিপ্ত হয়ে মৃত গরুর শরীরে বিষটোপ দেন। সেই চিতাবাঘটি মৃত গরুর মাংস খেয়ে মারা যায়। বিষয়টি হঠাৎ মধু শিকারির দৃষ্টিগোচর হয়। তারপর লোকমুখে জানাজানি হলে বাঘটি দেখতে এলাকার উৎসুক মানুষ ভিড় জমায়। পরে বন বিভাগ বাঘটি তারা উদ্ধার করে নিয়ে যায়। এর পর থেকে স্থানীয়দের চোখে বাঘ দেখা কিংবা বাঘে গরু ধরার এমন দৃশ্য আর কখনও চোখে পড়েনি বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

নিবিড় পর্যবেক্ষণে সম্প্রতি এই বনে প্রায় ৩৮ প্রজাতির স্থন্যপায়ী প্রাণীর অস্থিত্ব পাওয়া গেছে।

মাঝারি মাংসাশী প্রাণীদের মধ্যে সোনালী বিড়াল ও মেছো বিড়ালের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। এগুলো দেখে কিছু আনন্দিত হলেও চিতাবাঘ অথবা মেঘলা চিতার কোন অস্থিত্ব পাওয়া যায়নি।

স্থানীয় মধু শিকারিরা স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, বিগত ২০১৭-১৮ সালের দিকে ভারত থেকে একদল আদিবাসী শিকারি বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে পাখি, বানর, গুইসাপ, চশমাপরা ও মুখপোড়া হনুমানসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাণী শিকার করলেও তখন বন বিভাগ অজ্ঞাত কারণে নিরব ভূমিকা পালন করে।

সিলেট বিভাগের একমাত্র বন পাথারিয়ায় মাত্র চারটি মেয়ে বন্যহাতি জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে আজো এই বনেটিকে আছে। কখনো বনে তাদের তাজা পদচিহ্ন দেখা যায় বলে জানা গেছে। বুনো হাতিগুলো আজো মানুষের পৃথিবীতে দুই দেশের কাঁটাতারের বাধার সম্মুখীন। এই দলের একটি হাতি বৃদ্ধ হয়ে গেছে। খাবার হজম হয় না যেভাবে আহার করে সেভাবে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে থাকে। কিছুদিন আগে জামকান্দি এলাকার একটি সবজি বাগানে এই দৃশ্যটি দেখা গেছে।

স্থানীয়রা গণমাধ্যম কর্মীদের বলেছেন, সব সময় এমন দেখা যায়। পুরুষ হাতি না পেলে খুব শিঘ্রই হাতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। হাতিগুলোর বিলুপ্তি ঠেকাতে এখনই পাথারিয়া পাহাড়ে অন্তত পুরুষ হাতি অবমুক্ত করা প্রয়োজন।

বিগত ২০২২-২৩ সালে দেখা গেছে, অস্বাভাবিকভাবে বন্যপ্রাণীরা বন ছেড়ে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। এতে মানুষের সঙ্গে সংঘাতের পাশাপাশি বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে প্রাণিরা নিয়মিত মারা যায়। তাদের চিরচেনা প্রিয় আবাস্থল ছেড়ে লোকালয়ে আসার কারণ হিসেবে জানা গেছে বনের মূল ভূখ-ে বন বিভাগের কৃত্রিম বনায়ন। এসব কারণে তাদের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। স্থানান্তরিত হতে গিয়ে বন্যপ্রাণিরা অস্থিত্ব হারাচ্ছে। বনের প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধস্থানে ২০২০ সালে একটি জরিপে দেখা গিয়েছিল চারটি উল্লুকের পরিবার। কিন্তু বনায়নের কারণে বিভিন্ন ফলজ গাছ কাটা পড়ায় এবং লতাগুল্ম গুড়া কেটে ফেলার কারণে বন্যপ্রাণীদের খাবারের সংকট দেখা দেয়। এসব কারণে বর্তমানে তারা হুমকির সম্মুখীন।

সুরমা বাঁশমহালের বনায়নকৃত এই এলাকায় এখন আর কোন বন্যপ্রাণীর দেখা মেলে না। ফলশূন্য আকাঁশমনি গাছ দিয়ে বনায়ন করায় বন্যপ্রাণীর জীবন যাপন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

১১ মার্চ ২০২৩ মিশ্র চিরসবুজ সমনভাগ বিটের ধলছড়ি ও মাকাল জোরা এলাকায় এলাকায় প্রায় ৪০ হেক্টর বন ভূমি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এক পাশে এখন দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। আগুনে পুড়ে অজগর সাপ, চশমাপরা হনুমান, মায়া হরিণ, কচ্চপ, বনরুই, সজারুসহ বিভিন্ন সরীসৃপ প্রজাতির বিরল কীটপতঙ্গ এবং বেশ কিছু প্রজাতির বৃক্ষের ক্ষতি হয়েছে। এদিকে বনের একপাশে অবাধে চলছে বাঁশ কাটার মহোৎসব। প্রায় ৪০ জন শ্রমিক দিয়ে সরকারি সম্পত্তি গুলোকে বিনষ্ট করা হয় বলে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার খবরে জানা গেছে।

বড়লেখার সাবেক এক প্রভাবশালী মন্ত্রী, তার ছেলে আত্মীয়-স্বজন ও অনুসারীরা মিলে বন ধ্বংস করতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ও বন পুড়িয়ে দখলে নিয়েছেন হাজার হাজার একর সরকারি ভূমি। আবার কেউ কেউ আইনের তোয়াক্কা না করে সাবাড় করছেন বনের গাছ। বিগত কয়েক বছর পূর্বে জুড়ীর পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্টের আওতাধীন সমনভাগ বিটের ধলছড়ি ও মাকালজোড়ায় ৪০ হেক্টর বনভূমি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। প্রায় চার দিন বন আগুনে পুড়লেও তৎকালীন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী কোনো পদক্ষেপ নেননি বলে মৌলভীবাজার জেলা শহর থেকে প্রকাশিত পাতাকুঁড়ির দেশ ১ অক্টোবর ২০২৪ সালে ‘সাবেক পরিবেশ মন্ত্রীর ছেলে ও স্বজনরা মিলে হরিলুট, হাজার কোটি টাকা লুপাট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

বন আগুনে পোড়ানোর প্রতিবাদে সামাজিক সংগঠন পাথারিয়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ টিম মানববন্ধনের আয়োজন করলেও মন্ত্রীর অনুসারী, ভূমি-বন দখলদারদের কারণে আয়োজকরা মানববন্ধন করতে পারেননি। মানববন্ধনের উদ্যোক্তা কামরুল হাসান নোমান তৎকালীন স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, দেশ, মানুষ এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য মানববন্ধন করতে পারিনি। মন্ত্রীর ছেলেসহ স্বজনরা সরকারি জমি দখলে নিয়ে পাহাড় কেটে বাংলো নির্মাণ করেছেন। সরেজমিন সেখানে দেখা যায়, পাহাড়ের মাটি কেটে সমতল থেকে অনেক উঁচুতে আলিশান বাড়ি বানানো হয়েছে পাতাকুঁড়ির দেশ তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।

বন্যপ্রাণী গবেষকদের মতে, এই বনের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল যতটুকু এখনোটিকে আছে, সঠিকভাবে তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিলে এসব প্রাণীকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। মাধবছড়া ও লাঠিটিলা বনবিটের সীমান্তবর্তী প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের সঙ্গে সমনবাগের কিছু এলাকাজুড়ে এখনই সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে বন্যপ্রাণী শিকারি ও গাছ চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া জরুরি বলে অনেকের অভিমত।

পাথারিয়া পাহাড় এখন আর আগের এত নেই। এখন এখানে রাস্তা তৈরি হয়েছে। ট্রাক ও নানান জাতের গাড়ি চলছে। পাহাড়ের শান্ত পরিবেশ, পাখিদের গুঞ্জন নানান রকমের গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে। ট্রাক্টর ও টেম্পু ইঞ্জিনের শব্দের সঙ্গে ছাড়ছে বিষাক্ত ধোঁয়া। পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি তেরি হচ্ছে। চলছে পুকুর খনন। উঠছে দালান, অপরিকল্পিত দোকান পাট ইটভাটা আর করাতকল। বন ছাই হচ্ছে ইটলোকার জ্বালানি হয়ে। অবাধে চলছে বৃক্ষ নিধন। দেখার লোক আছে। কিন্তু ঠেকানোর কেউ নেই।

বিভিন্ন পত্রপত্রিকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীুবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বন্যপ্রাণী গবেষক ড. এমএ আজিজকে উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছে যে, পাথারিয়া পাহাড়ে মানুষের আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। একে ছেড়ে দিতে হবে প্রকৃতির ওপর। এতে যে পাথারিয়া ধীরে ধীরে বিরল বন্যপ্রাণীর শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে উঠবে, এটি নিশ্চিত করে বলা যায়। অতীতে কতটুকু কী হয়েছে, সেদিকে তাকিয়ে আর লাভ নেই। সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, বন বিভাগ ও স্থানীয় জনসাধারণকে এখন নতুন করে এই বনাঞ্চলটি রক্ষা করার ব্যাপারে উদ্যোগী হবে। পাথারিয়া পাহাড় রক্ষা করতে না পারলে প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্যসহ পরিবেশের ওপর কঠিন বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতে পারে।

জমি নিয়ে সংঘর্ষে বসতঘর ভাঙচুর, আহত ১০

ছবি

সিয়ামের মৃত্যুর প্রতিবাদে মহাসড়ক অবরোধ, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি শিক্ষার্থীদের

গাংনীতে ট্রলিচাপায় শিশু নিহত

আকিকার মাংস নিয়ে সংঘর্ষ বাড়িঘর ভাঙচুর, আহত ১৫

ভারতীয় তোতাপুরি ছাগল-দুম্বাসহ পাচারকারী আটক

শরণখোলায় সুন্দরবন থেকে আসা হরিণ উদ্ধার

স্বামীর নির্যাতনে গৃহবধূর মৃত্যু

এক হাজার টাকায় স্ত্রীকে বিক্রি, নির্যাতনের পর হত্যা, গ্রেপ্তার ৪

স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ায় আগুনে পুড়ল ভাড়া বাড়ির ৫ কক্ষ

ফিলিং স্টেশনে যানবাহনের গ্যাস যাচ্ছে কলকারখানা বাসাবাড়ি ও হোটেল-রেস্তোরাঁয়

চুয়াডাঙ্গার বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু

বাঁকখালী নদীতে ডুবে কলেজছাত্রের মৃত্যু

ছবি

রাঙ্গুনিয়ায় কৃষিজমির মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়, খালের গতিপথ বিপন্ন

ছবি

গাছ ও পাহাড় কেটে সীমান্তে তৈরি হচ্ছে চোরাই পথ

অপারেশন ডেভিল হান্টে আ’লীগ নেতাসহ আটক ৩

চাটখিলে সাজাপ্রাপ্ত আসামিসহ গ্রেপ্তার ৯

অনলাইন জুয়ায় সর্বস্ব হারিয়ে যুবকের দুধ দিয়ে গোসল

ছবি

তিল চাষ লাভজনক হওয়ায় আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের

মাদারগঞ্জে সংযোগ সড়কে ধস, ৫ মাসে সংস্কারের উদ্যোগ

মুন্সীগঞ্জে বৃদ্ধার মরদেহ উদ্ধার

নকল শিশু খাদ্যের কারখানায় অভিযান, জরিমানা

নাসিরনগরে পূর্বশত্রুতার জেরে নিহত ১

হবিগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ৪ ছাত্রকে পিটিয়ে আহত

ছবি

ভালুকায় বোরো ধান কাটায় শ্রমিক সংকট, হিমশিম খাচ্ছে কৃষক

ছবি

ভোলায় বাস শ্রমিকদের বাধা ও আরোপিত শর্তের প্রতিবাদে মানববন্ধন বিক্ষোভ

যশোরে ‘ছদ্মবেশে’ পালিয়ে থাকা ৩৩ মামলার আসামি কাজী তারেক আটক

পোরশায় বর্গাচাষিদের ওপর দুর্বৃত্তদের হামলা, আটক ২

রাজশাহী সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদার

লোহাগড়ায় নিখোঁজ তরুণের মরদেহ উদ্ধার

বেরোবিতে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিতে এসে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ুয়া যুবক আটক

রংপুরে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে মিছিল

ছবি

আঙুর চাষে ঝুঁকি নিয়ে সফল কালীগঞ্জের আলামিন

গৌরনদীতে রাস্তা পারাপারের সময় বৃদ্ধ পথচারীর মৃত্যু

অভিযানে আ’লীগ নেতা গ্রেপ্তার

রাউজানে আ’লীগ নেতা গ্রেপ্তার

ছবি

দামুড়হুদায় এবার ইটভাটায় পাট চাষে চমক

tab

সারাদেশ

পাথারিয়া বনাঞ্চলের এক হাজার বর্গ কিমি. পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিপন্ন

প্রতিনিধি, শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার)

শনিবার, ১০ মে ২০২৫

সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তরেখার মধ্যবর্তী চারটি বনবিট নিয়ে গঠিত পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্টের বনভূমি একশ্রেণীর প্রভাব প্রতিপত্তিশালী লোকজন এক হাজার বর্গ কিলোমিটারের ওপর বনভূমি দখল করে নেয়ায় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখোমুখি বলে জানা গেছে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুপম সৃষ্টি উপজেলার উত্তর ও পূর্বে পাথারিয়া পাহাড় অঞ্চল। উত্তর-দক্ষিণে প্রায় পঁচিশ মাইল বিস্তৃত। পাথারিয়ার চিরহরিৎ বনাঞ্চল বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ। পাথারিয়া পাহাড়ের জন্ম প্লায়োস্টিসিন কালের মধ্যভাগে, অর্থাৎ দেড় থেকে দুই কোটি বছর আগে। বড়লেখার পাথারিয়া বনভূমি থেকে হাকালুকি হাওর যেন বড়লেখা থানার পূর্ব-পশ্চিম পাড়ের গীতিময় কথোপকথন। পাথারিয়া পাহাড়ে আছে তিনটি উল্লেখ যোগ্য কৃঙ্গ। যথাক্রমে দূরবীনটিলা, গগনটিলা ও রাজবাড়িটিলা। এগুলোর উচ্ছতা প্রায় ২৪৪ মিটার। হাতের মাপে প্রায় ৫৩৪ হাত।

পাহাড়ের চারদিকে সবুজের পরিবেশ। ওপরে নীল আকাশ। নিচে থরে থরে সাজানো আকাশ চুম্বি পাথারিয়া পাহাড়। বিকেল পাহাড় মাথা উঁচু করে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিধাতা যেন পাহাড়টিকে তুলির অপূর্ব আঁচড়ে অপরূপ রূপে রূপায়িত করেছেন।

এই পাহাড় প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। পাথারিয়া পাহাড়ে আছে তেলকূপ। এখান থেকে তেল উত্তোলনের জন্য বার্মা অয়েল কোম্পানি (বিওসি) ১৯৩৩ সালে তেলকূপ খননের চেষ্টা চালানোর সময় পাইপ ফেটে যায়। তেলের ঊর্ধ্বচাপে তা উপত্যকা ও পাশ্ববর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে জনমনে ভীতির সঞ্চার হয়। কয়েকদিন তেলের বন্যা বয়ে যায়। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তবে এখনও তেলকূপের ঢাকনির উপর কান রাখলে তেলের গমগম শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। এক সময়ে স্থানীয় লোকেরা এই তেল সংগ্রহ করে পিদিম বা কুপির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করত।

পাথারিয়া পাহাড়ের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র সম্পর্কে এই এলাকাই বেড়ে ওঠা সন্তান বিশিষ্ট বোটানিস্ট ও অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা বলেন- পাথারিয়া পাহাড়ে বড়বড় গাছ, বাঁশঝাড়, অজগ্র জাতের লতা, ঢাউস পাতার বুনো রামকলার ঝোঁপ। ফুলের মধ্যে আছে আশোক, দেবকাঞ্চন, কনকচাঁপা, পারুল, জংলীজুঁই, নাগবাল্লী, লুটকি, নীললতা, টালি, ল্যডিস আম্ব্রেলা, ডুলিচাঁপা, ম্যাগনোলিয়া এবং আরও নানান জাতের ফুল। ফল-ফসলের মধ্যে আছে বিভিন্ন রকমের শাক, কচু, লতি, বাঁশের খোড়ল (করিল), লেবু, রামকলা, ডেউয়া, লুকলুকি, ক্ষুদিজাম, চালতা, জাম, বহেড়া, হরিতকি, বুনো আম, কাঠাল, আমলকি, গোলাপজাম, সাতকরা লেবু, তৈকর, আশফল, গুঙ্গাআলু এবং আরও নানা জাতের পাহাড়ি ফলমূল। এই পাহাড়ে রয়েছে বিচিত্র রকমের বন্যপ্রাণী জংলীহাতি, বানর, হনুমান, বাগডাস, মেছোবাঘ, বনরুই, হরিণ, খরগোস, অজগর সাপ প্রভৃতি। পাখ-পাখালির মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। বনমোরগ, শকুন, ঈগল, তিতির, শ্যামা, ভিমরাজ আরও বিভিন্নজাতের পাখি। তবে অবাধে বন্যপ্রাণী শিকার করার কারণে এখন আর আগের এত দেখতে পাওয়া যায় না।

পাথারিয়া পাহাড়ের বুকে সৃষ্ট বড়লেখার ঐতিহ্য মাধবতীর্থ মাধবকুন্ড দেশের তথা বিশ্বের পর্যটন মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের ধারাপতনের অবিরাম শব্দ সৃষ্টি করছে মায়াময় পরিবেশের। প্রকৃতি যেন বর্ণনার উৎস নিয়ে সামনে দাঁড়ায়। পাথারিয়া পাহাড় কঠিন পাথরে গঠিত। পাহাড়ের বিস্তৃত এলাকাজুড়ে প্রবহমান ছড়া রয়েছে। উপরের অংশ গঙ্গামারা আর নিচের অংশ মাধবছড়া। মাধবছড়া পাথারিয়া পাহাড়ের গঙ্গামারা থেকে গড়িয়ে আসা জল প্রায় দুশত ফুট উঁচু থেকে নিচে খাড়াভাবে গড়িয়ে পড়ছে।

একশ্রেণীর প্রভাব প্রতিপত্তিশালী লোকজন অবৈধভাবে দখল করে জনবসতি স্থাপনের কারণে বিগত অর্ধশত বছরে পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্ট বনাঞ্চলের আয়তন ১ হাজার ১৫২ বর্গ কিলোমিটার থেকে মাত্র ১৩৫ বর্গকিলোমিটারে নেমে এসেছে বলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছেÑ যা বন্যপ্রাণী ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।

আবাসস্থল সংকটে ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে এই বনের বিভিন্ন প্রজাতির জীববৈচিত্র্য। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এখনও টিকে আছে প্রায় ৩৮ প্রজাতির স্থন্যপায়ী প্রাণী। এগুলোও খাবার সংকটে বন ছেড়ে ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। বনাঞ্চল রক্ষা ও বন্যপ্রাণীর আবাস্থল নিরাপদ রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়ায় বর্তমানে যেটুকু আছে সেটিও হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে বনাঞ্চল, প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য কঠিন বিপর্যয়ের মুখোমুখি।

ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র হটস্পটের মিশ্র চিরসবুজ বনাঞ্চল পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্টের পূর্ব দিকে ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ, উত্তরে শাহবাজপুর আর দক্ষিণ ও পশ্চিমে চা-বাগান। পাহাড়ের মাঝে মাঝে একশ্রেণীর মানুষের বসতি। পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্ট নামটি এখনও অনেকের কাছে পরিচিত নয়। কিন্তু মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের কথা দেশ-বিদেশের সবার কাছেই পরিচিত। মাধবকুন্ড জলপ্রপাত পাথারিয়া পাহাড়ে পরিবেশগতভাবে মিশ্র চিরসবুজ বনাঞ্চলের এ অংশটি ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্য হটস্পটের অংশ।

১৯২০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে এই বনকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৭ সালে পাথারিয়া পাহাড়ের আয়তন ছিল ১ হাজার ১৫২ বর্গকিলোমিটার ছিল বলে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছে। ক্রমশ মানুষের বসতি বেড়ে এই বনের আয়তন দিন দিন কমছে। বর্তমানে পাথারিয়া পাহাড়ের সম্মিলিত আয়তন মাত্র ১৩৫ বর্গকিলোমিটারে এসেছে বলে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানা গেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৮৮ বর্গকিলোমিটার আর ৪৭ বর্গকিলোমিটার পড়েছে ভারত অংশে।

পাথারিয়া বনে বুনো মোষ, বাঘ, জলার হরিণ, গন্ডারসহ বড় আকারের অনেক বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ছিল।

বিগত দুই বছর আগেও ক্যামেরা ট্র্যাপিং করে এই বনে এশীয় হাতি, বিপন্ন ফেরেট ব্যাজার, বাঁশ ভাল্লুক, সজারু, হলদে গলা মারটেন, আসামি বানরসহ অনেক বিপন্ন প্রাণী দেখা গেছে।

সর্বশেষ ২০০৭ সালে বনের সুরমা বাঁশমহাল এলাকায় চিতা বাঘের আক্রমণে একটি গরু মারা যায়। তখন গরুর মালিক ক্ষিপ্ত হয়ে মৃত গরুর শরীরে বিষটোপ দেন। সেই চিতাবাঘটি মৃত গরুর মাংস খেয়ে মারা যায়। বিষয়টি হঠাৎ মধু শিকারির দৃষ্টিগোচর হয়। তারপর লোকমুখে জানাজানি হলে বাঘটি দেখতে এলাকার উৎসুক মানুষ ভিড় জমায়। পরে বন বিভাগ বাঘটি তারা উদ্ধার করে নিয়ে যায়। এর পর থেকে স্থানীয়দের চোখে বাঘ দেখা কিংবা বাঘে গরু ধরার এমন দৃশ্য আর কখনও চোখে পড়েনি বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

নিবিড় পর্যবেক্ষণে সম্প্রতি এই বনে প্রায় ৩৮ প্রজাতির স্থন্যপায়ী প্রাণীর অস্থিত্ব পাওয়া গেছে।

মাঝারি মাংসাশী প্রাণীদের মধ্যে সোনালী বিড়াল ও মেছো বিড়ালের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। এগুলো দেখে কিছু আনন্দিত হলেও চিতাবাঘ অথবা মেঘলা চিতার কোন অস্থিত্ব পাওয়া যায়নি।

স্থানীয় মধু শিকারিরা স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, বিগত ২০১৭-১৮ সালের দিকে ভারত থেকে একদল আদিবাসী শিকারি বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে পাখি, বানর, গুইসাপ, চশমাপরা ও মুখপোড়া হনুমানসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাণী শিকার করলেও তখন বন বিভাগ অজ্ঞাত কারণে নিরব ভূমিকা পালন করে।

সিলেট বিভাগের একমাত্র বন পাথারিয়ায় মাত্র চারটি মেয়ে বন্যহাতি জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে আজো এই বনেটিকে আছে। কখনো বনে তাদের তাজা পদচিহ্ন দেখা যায় বলে জানা গেছে। বুনো হাতিগুলো আজো মানুষের পৃথিবীতে দুই দেশের কাঁটাতারের বাধার সম্মুখীন। এই দলের একটি হাতি বৃদ্ধ হয়ে গেছে। খাবার হজম হয় না যেভাবে আহার করে সেভাবে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে থাকে। কিছুদিন আগে জামকান্দি এলাকার একটি সবজি বাগানে এই দৃশ্যটি দেখা গেছে।

স্থানীয়রা গণমাধ্যম কর্মীদের বলেছেন, সব সময় এমন দেখা যায়। পুরুষ হাতি না পেলে খুব শিঘ্রই হাতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। হাতিগুলোর বিলুপ্তি ঠেকাতে এখনই পাথারিয়া পাহাড়ে অন্তত পুরুষ হাতি অবমুক্ত করা প্রয়োজন।

বিগত ২০২২-২৩ সালে দেখা গেছে, অস্বাভাবিকভাবে বন্যপ্রাণীরা বন ছেড়ে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। এতে মানুষের সঙ্গে সংঘাতের পাশাপাশি বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে প্রাণিরা নিয়মিত মারা যায়। তাদের চিরচেনা প্রিয় আবাস্থল ছেড়ে লোকালয়ে আসার কারণ হিসেবে জানা গেছে বনের মূল ভূখ-ে বন বিভাগের কৃত্রিম বনায়ন। এসব কারণে তাদের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। স্থানান্তরিত হতে গিয়ে বন্যপ্রাণিরা অস্থিত্ব হারাচ্ছে। বনের প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধস্থানে ২০২০ সালে একটি জরিপে দেখা গিয়েছিল চারটি উল্লুকের পরিবার। কিন্তু বনায়নের কারণে বিভিন্ন ফলজ গাছ কাটা পড়ায় এবং লতাগুল্ম গুড়া কেটে ফেলার কারণে বন্যপ্রাণীদের খাবারের সংকট দেখা দেয়। এসব কারণে বর্তমানে তারা হুমকির সম্মুখীন।

সুরমা বাঁশমহালের বনায়নকৃত এই এলাকায় এখন আর কোন বন্যপ্রাণীর দেখা মেলে না। ফলশূন্য আকাঁশমনি গাছ দিয়ে বনায়ন করায় বন্যপ্রাণীর জীবন যাপন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

১১ মার্চ ২০২৩ মিশ্র চিরসবুজ সমনভাগ বিটের ধলছড়ি ও মাকাল জোরা এলাকায় এলাকায় প্রায় ৪০ হেক্টর বন ভূমি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এক পাশে এখন দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। আগুনে পুড়ে অজগর সাপ, চশমাপরা হনুমান, মায়া হরিণ, কচ্চপ, বনরুই, সজারুসহ বিভিন্ন সরীসৃপ প্রজাতির বিরল কীটপতঙ্গ এবং বেশ কিছু প্রজাতির বৃক্ষের ক্ষতি হয়েছে। এদিকে বনের একপাশে অবাধে চলছে বাঁশ কাটার মহোৎসব। প্রায় ৪০ জন শ্রমিক দিয়ে সরকারি সম্পত্তি গুলোকে বিনষ্ট করা হয় বলে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার খবরে জানা গেছে।

বড়লেখার সাবেক এক প্রভাবশালী মন্ত্রী, তার ছেলে আত্মীয়-স্বজন ও অনুসারীরা মিলে বন ধ্বংস করতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ও বন পুড়িয়ে দখলে নিয়েছেন হাজার হাজার একর সরকারি ভূমি। আবার কেউ কেউ আইনের তোয়াক্কা না করে সাবাড় করছেন বনের গাছ। বিগত কয়েক বছর পূর্বে জুড়ীর পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্টের আওতাধীন সমনভাগ বিটের ধলছড়ি ও মাকালজোড়ায় ৪০ হেক্টর বনভূমি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। প্রায় চার দিন বন আগুনে পুড়লেও তৎকালীন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী কোনো পদক্ষেপ নেননি বলে মৌলভীবাজার জেলা শহর থেকে প্রকাশিত পাতাকুঁড়ির দেশ ১ অক্টোবর ২০২৪ সালে ‘সাবেক পরিবেশ মন্ত্রীর ছেলে ও স্বজনরা মিলে হরিলুট, হাজার কোটি টাকা লুপাট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

বন আগুনে পোড়ানোর প্রতিবাদে সামাজিক সংগঠন পাথারিয়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ টিম মানববন্ধনের আয়োজন করলেও মন্ত্রীর অনুসারী, ভূমি-বন দখলদারদের কারণে আয়োজকরা মানববন্ধন করতে পারেননি। মানববন্ধনের উদ্যোক্তা কামরুল হাসান নোমান তৎকালীন স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, দেশ, মানুষ এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য মানববন্ধন করতে পারিনি। মন্ত্রীর ছেলেসহ স্বজনরা সরকারি জমি দখলে নিয়ে পাহাড় কেটে বাংলো নির্মাণ করেছেন। সরেজমিন সেখানে দেখা যায়, পাহাড়ের মাটি কেটে সমতল থেকে অনেক উঁচুতে আলিশান বাড়ি বানানো হয়েছে পাতাকুঁড়ির দেশ তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।

বন্যপ্রাণী গবেষকদের মতে, এই বনের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল যতটুকু এখনোটিকে আছে, সঠিকভাবে তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিলে এসব প্রাণীকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। মাধবছড়া ও লাঠিটিলা বনবিটের সীমান্তবর্তী প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের সঙ্গে সমনবাগের কিছু এলাকাজুড়ে এখনই সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে বন্যপ্রাণী শিকারি ও গাছ চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া জরুরি বলে অনেকের অভিমত।

পাথারিয়া পাহাড় এখন আর আগের এত নেই। এখন এখানে রাস্তা তৈরি হয়েছে। ট্রাক ও নানান জাতের গাড়ি চলছে। পাহাড়ের শান্ত পরিবেশ, পাখিদের গুঞ্জন নানান রকমের গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে। ট্রাক্টর ও টেম্পু ইঞ্জিনের শব্দের সঙ্গে ছাড়ছে বিষাক্ত ধোঁয়া। পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি তেরি হচ্ছে। চলছে পুকুর খনন। উঠছে দালান, অপরিকল্পিত দোকান পাট ইটভাটা আর করাতকল। বন ছাই হচ্ছে ইটলোকার জ্বালানি হয়ে। অবাধে চলছে বৃক্ষ নিধন। দেখার লোক আছে। কিন্তু ঠেকানোর কেউ নেই।

বিভিন্ন পত্রপত্রিকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীুবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বন্যপ্রাণী গবেষক ড. এমএ আজিজকে উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছে যে, পাথারিয়া পাহাড়ে মানুষের আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। একে ছেড়ে দিতে হবে প্রকৃতির ওপর। এতে যে পাথারিয়া ধীরে ধীরে বিরল বন্যপ্রাণীর শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে উঠবে, এটি নিশ্চিত করে বলা যায়। অতীতে কতটুকু কী হয়েছে, সেদিকে তাকিয়ে আর লাভ নেই। সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, বন বিভাগ ও স্থানীয় জনসাধারণকে এখন নতুন করে এই বনাঞ্চলটি রক্ষা করার ব্যাপারে উদ্যোগী হবে। পাথারিয়া পাহাড় রক্ষা করতে না পারলে প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্যসহ পরিবেশের ওপর কঠিন বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতে পারে।

back to top