হোম ডেলিভারিতেও মিলছে হরিণের মাংস
বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে হরিণ শিকার ও পাচার এখন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে- যা নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও থেমে নেই। সুন্দরবেনের মাছ ও বণ্যপ্রাণীর প্রজনন মৌসুম হওয়ার কারণে জুন থেকে আগস্ট তিন মাস সুন্দরবনে জেলে-বাওয়ালীসহ পর্যাটকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি থাকলেও থামছে না হরিণ শিকারীদের তৎপরতা। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা এবং প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে গড়ে উঠেছে একাধিক হরিণ শিকারী চক্র। এই চক্র শিকার করা হরিণের মাংস স্থানীয়ভাবে বিক্রি করছে, এমনকি হোম ডেলিভারির ব্যবস্থাও চালু করেছে। বন বিভাগ ও কোস্টগার্ডের অভিযান এবং পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও থামানো যাচ্ছে না এই অবৈধ কার্যক্রম। এমন পরিস্থিতে হরিণ শিকার রুখতে স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে কমিটি গঠনসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে বন বিভাগ।
এরই মধ্যে গত ৬ মাসে সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকা থেকে ৬শ কেজি হরিণের মাংস, ৮টি হরিণের চামড়া ও ২শটি হরিণ শিকারের ফাঁদসহ ২০ জন হরিণ শিকারীকে আটক করেছে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের সদস্যরা। এ ছাড়া গত ১ মাসে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা থেকে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করেছে ২ হাজার ৬১৫টি হরিণ শিকারের ফাঁদ। এ সময় হরিণ ও বিষ দিয়ে মাছ শিকারসহ নানা অপরাধে ১২ জন চোরা শিকারিকে আটক করার পাশাপাশি ১২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে হরিণের মাংসসহ আটক করা হয় ৫ জনকে।
মোংলার চিলা ইউনিয়নের নাম প্রকাশ না করে একজন হরিণ শিকারী ও জেলে বলেন, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় জেলে-বাওয়ালিদের মধ্যে লুকিয়ে থাকে হরিণ শিকারীরা। সুন্দরবনে মাছ ধরার পাস পারমিট নিয়ে প্রবেশ করা জেলে বা বাওয়ালীরা সুযোগ পেলে হরিণ শিকার করে থাকে। এই চক্রটিকে বলা হয় সুযোগ সন্ধানী, যারা সুন্দরবনে প্রবেশ করে মাছ বা মধু সংগ্রহের জন্য কিন্তু সুযোগ পেলে হরিণও শিকার করে। এ ছাড়া একাধিক বড় চক্র রয়েছে যারা সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় নিয়োমিত হরিণ শিকার করে থাকে। ওরাই মূলত মূল শিকারী, ওরা হরিণ শিকার করে বিক্রি করে আবার চাহিদা অনুযোয়ী বাড়ি বাড়ি পৌছে দেয়। এ ছাড়া ঈদ, কোরবানীসহ বিশেষ দিন উপলক্ষ্যে সুুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে হরিণের মাংসের চাহিদা বাড়ে, তখন স্থানীয়দের পাশাপাশি প্রশাসনের লোকজনও হরিণের মাংস খায়।
মোংলার সুন্দরবন ইউনিয়নের বাসিন্দা (নিয়োমিত হরিণ শিকারী, বিভিন্ন সময় ধরা পড়েছেন, জেল খেটেছেন হরিণ শিকার করতে গিয়ে) এমন একজন বলেন, আমরা যারা নিয়োমিত হরিণ শিকারী, তারা সব সময় ৫ থেকে ৬ জনের একটি দলে যুক্ত হয়ে শিকার করে থাকি- যার মধ্যে একটি গ্রুপের কাজ থাকে বন হরিণ শিকার করে লোকালয়ে পৌঁছে দেয়া, আর অন্য দলের কাজ হয় ক্রেতাদের কাছে শিকার করা মাংস পৌছে দেয়া।
তিনি বলেন, প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় আমরা হরিণ শিকার করে থাকি, এটা সম্পূর্ণ ঠিক না। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক নেতারা আমাদের কাছ থেকে ফ্রি হরিণের মাংস নিয়ে থাকে- যার বিনিময়ে হরিণ শিকার করে এলাকায় আসলে তাদের ভয়ে স্থানীয় গ্রামবাসী আমাদের কিছু বলতে সাহস পায় না, শুধুমাত্র এই সুবিধাটুকু তাদের কাছ থেকে আমরা পেয়ে থাকি।
হরিণের মাংসের ক্রেতা কারা এবং কত টাকা কেজি বিক্রি করেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো হরিণের মাংস বেশি কিনে থাকে। সুন্দরবন সংলগ্ন স্থানীয় বাসিন্দা হলে তাদের কাছ থেকে চাহিদা ভেদে ৮শ, ৯শ ও ১ হাজার টাকা কেজি রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে দাম নির্ভর করে তিনি কত কেজি নিচ্ছেন তার ওপর। তিনি বলেন, আমরা অপরিচিত কারো কাছে মাংস বিক্রি করি নাÑ যারা কিনতে আসে এরা আমাদের মতো কারো না কারো সঙ্গে পরিচিত হতে হয়।
হরিণের মাংস বলে অনেক সময় শুকর ও কুকুরের মাংস আপনারা বিক্রি করেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কিছু ক্ষেত্রে এটা ঠিক, যেমন আমরা যখন হরিণ শিকারের জন্য ফাঁদ ব্যবহার করি তখন সুন্দরবনের বেশ বড় এলাকাজুড়ে ফাঁদ পাততে হয়। অনেক সময় ওই ফাঁদে বণ্য শুকরও ধরা পরে তখন আমাদের অনেকেই হরিণের সঙ্গে শুকরও জবাই করে মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করে। এ ছাড়া অনেক নতুন ক্রেতা আছে যারা বন সংলগ্ন এলাকায় প্রতারকদের ক্ষপ্পরে পরে এবং কম দামের প্রলোভনে পরে কুকুরের মাংস কিনে থাকে। তবে এখন হরিণের মাংসের ক্রেতারাও সচেতন হয়ে গেছে, তারা এখন হরিণের চামড়ার একটি অংশসহ মাংস ক্রয় করতে চান।
শিকার পদ্ধতিতে সম্পর্কে বলেন, মানুষের শব্দ পেলেই ঘন বনে লুকিয়ে পরে লাজুক প্রকৃতির এ প্রাণীটি। পূর্ব সুন্দরবনে সব থেকে বেশি হরিণ শিকার করা হয় দুবলার চর, বঙ্গবন্ধুর চর, কবরখালী, মানিকখালী, কালামিয়ার ভারানী, মক্তোর ট্যাগ, হিরণ পয়েন্ট, কটকা, তালপট্টি, কচিখালি, দুবলা চান্দেরশ্বর, বগি, চরখালি এলাকায়। এসব এলাকায় হরিণের চলাচলের পথে নাইলনের সুতা ফাঁদ, স্প্রিং বসানো ফাঁদ, কলার সঙ্গে বড়শি ঝুলিয়ে, চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে ও গুলি ছুড়ে হরিণ শিকার করা হয়। এসব এলাকায় শিকারীরা এক রাতে ফাঁদ পেতে আসে এবং পরের রাতে গিয়ে আবার ফাঁদ দেখা হয়।
সুন্দরবন সংলগ্ন যে সব এলাকায় মেলে হরিণের মাংস
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের কর্মকর্তা জানান, বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, গত ৫ আগস্টের পর থেকে সারাদেশে আইনকৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এ সুযোগে সুন্দরবনে হরিণ শিকারাও তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করে। তবে এখন পরিস্থিতি ভিন্ন, হরিণ শিকারীদের ধরতে বর্তমানে বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের কর্মকর্তাসহ বনরক্ষীরা ব্যাপক তৎপর রয়েছে। এরই মধ্যে হরিণ শিকার প্রতিরোধে জেলে ও মৌয়ালদের সুন্দরবনে হরিণ শিকারের ফাঁদ পেলে সেটা উদ্ধার করে জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব ফাঁদ জমা দিলে প্রতি কেজি ফাঁদের জন্য দুই হাজার টাকা পুরুস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে বন বিভাগের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি হরিণ শিকারের ফাঁদ উদ্ধারে সহযোগিতা করায় ৮ জনকে নগদ অর্থ প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া সুন্দরবন সংলগ্ন চরদুয়ানি ও জ্ঞানপাড়া এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে ১০ সদস্য বিশিষ্ট দুটি কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটির সদস্যরা সব সময় বন বিভাগের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে, কোথায় হরিণ শিকারীরা অবস্থান করছে তা চিহ্নিত করাসহ সুন্দরবন কেন্দ্রীক অপতৎপরতা রোধে কাজ করবে এ কমিটির সদস্যরা। এ কমিটির সদস্যরা স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে আমাদের সঙ্গে কাজ করবে। এ ছাড়া সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে স্থানীয় প্রভাবশলী ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল জেলে-বাওয়ালীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে লিফলেট বিতারন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের স্মার্ট পেট্রোলিংটিম তো রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, শুধু শিকারি নয়, যারা হরিণের মাংস খান, এমন ভোক্তাদেরও চিহ্নিত করে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। শিকার বন্ধ করা গেলে হরিণ বাড়বে, আর হরিণ বাড়লে বাঘওটিকবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বাগেরহাট জেলা সভাপতি ও ‘সুন্দরবন রক্ষায় আমরা’ সংগঠনের প্রধান সমন্বয়কারী মোহাম্মদ নূর আলম শেখ গণমাধ্যমকে বলেন, আমি মনে করি হরিণ শিকারে বন বিভাগের অসাধু ব্যক্তিদের হাত রয়েছে।
তা না হলে হরিণ শিকার এত বাড়তে পারে না। এ ছাড়া বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন নতুন শিকারী চক্র গড়ে উঠেছে। তারা এতোটা বেপরোয়া যে, তারা বন বিভাগকেও তোয়াক্কা করে না। বলতে গেলে ভয়ে বনরক্ষীরা তাদের থেকে দূরত্ব রেখে চলে।
হোম ডেলিভারিতেও মিলছে হরিণের মাংস
রোববার, ২৯ জুন ২০২৫
বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে হরিণ শিকার ও পাচার এখন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে- যা নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও থেমে নেই। সুন্দরবেনের মাছ ও বণ্যপ্রাণীর প্রজনন মৌসুম হওয়ার কারণে জুন থেকে আগস্ট তিন মাস সুন্দরবনে জেলে-বাওয়ালীসহ পর্যাটকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি থাকলেও থামছে না হরিণ শিকারীদের তৎপরতা। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা এবং প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে গড়ে উঠেছে একাধিক হরিণ শিকারী চক্র। এই চক্র শিকার করা হরিণের মাংস স্থানীয়ভাবে বিক্রি করছে, এমনকি হোম ডেলিভারির ব্যবস্থাও চালু করেছে। বন বিভাগ ও কোস্টগার্ডের অভিযান এবং পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও থামানো যাচ্ছে না এই অবৈধ কার্যক্রম। এমন পরিস্থিতে হরিণ শিকার রুখতে স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে কমিটি গঠনসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে বন বিভাগ।
এরই মধ্যে গত ৬ মাসে সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকা থেকে ৬শ কেজি হরিণের মাংস, ৮টি হরিণের চামড়া ও ২শটি হরিণ শিকারের ফাঁদসহ ২০ জন হরিণ শিকারীকে আটক করেছে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের সদস্যরা। এ ছাড়া গত ১ মাসে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা থেকে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করেছে ২ হাজার ৬১৫টি হরিণ শিকারের ফাঁদ। এ সময় হরিণ ও বিষ দিয়ে মাছ শিকারসহ নানা অপরাধে ১২ জন চোরা শিকারিকে আটক করার পাশাপাশি ১২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে হরিণের মাংসসহ আটক করা হয় ৫ জনকে।
মোংলার চিলা ইউনিয়নের নাম প্রকাশ না করে একজন হরিণ শিকারী ও জেলে বলেন, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় জেলে-বাওয়ালিদের মধ্যে লুকিয়ে থাকে হরিণ শিকারীরা। সুন্দরবনে মাছ ধরার পাস পারমিট নিয়ে প্রবেশ করা জেলে বা বাওয়ালীরা সুযোগ পেলে হরিণ শিকার করে থাকে। এই চক্রটিকে বলা হয় সুযোগ সন্ধানী, যারা সুন্দরবনে প্রবেশ করে মাছ বা মধু সংগ্রহের জন্য কিন্তু সুযোগ পেলে হরিণও শিকার করে। এ ছাড়া একাধিক বড় চক্র রয়েছে যারা সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় নিয়োমিত হরিণ শিকার করে থাকে। ওরাই মূলত মূল শিকারী, ওরা হরিণ শিকার করে বিক্রি করে আবার চাহিদা অনুযোয়ী বাড়ি বাড়ি পৌছে দেয়। এ ছাড়া ঈদ, কোরবানীসহ বিশেষ দিন উপলক্ষ্যে সুুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে হরিণের মাংসের চাহিদা বাড়ে, তখন স্থানীয়দের পাশাপাশি প্রশাসনের লোকজনও হরিণের মাংস খায়।
মোংলার সুন্দরবন ইউনিয়নের বাসিন্দা (নিয়োমিত হরিণ শিকারী, বিভিন্ন সময় ধরা পড়েছেন, জেল খেটেছেন হরিণ শিকার করতে গিয়ে) এমন একজন বলেন, আমরা যারা নিয়োমিত হরিণ শিকারী, তারা সব সময় ৫ থেকে ৬ জনের একটি দলে যুক্ত হয়ে শিকার করে থাকি- যার মধ্যে একটি গ্রুপের কাজ থাকে বন হরিণ শিকার করে লোকালয়ে পৌঁছে দেয়া, আর অন্য দলের কাজ হয় ক্রেতাদের কাছে শিকার করা মাংস পৌছে দেয়া।
তিনি বলেন, প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় আমরা হরিণ শিকার করে থাকি, এটা সম্পূর্ণ ঠিক না। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক নেতারা আমাদের কাছ থেকে ফ্রি হরিণের মাংস নিয়ে থাকে- যার বিনিময়ে হরিণ শিকার করে এলাকায় আসলে তাদের ভয়ে স্থানীয় গ্রামবাসী আমাদের কিছু বলতে সাহস পায় না, শুধুমাত্র এই সুবিধাটুকু তাদের কাছ থেকে আমরা পেয়ে থাকি।
হরিণের মাংসের ক্রেতা কারা এবং কত টাকা কেজি বিক্রি করেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো হরিণের মাংস বেশি কিনে থাকে। সুন্দরবন সংলগ্ন স্থানীয় বাসিন্দা হলে তাদের কাছ থেকে চাহিদা ভেদে ৮শ, ৯শ ও ১ হাজার টাকা কেজি রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে দাম নির্ভর করে তিনি কত কেজি নিচ্ছেন তার ওপর। তিনি বলেন, আমরা অপরিচিত কারো কাছে মাংস বিক্রি করি নাÑ যারা কিনতে আসে এরা আমাদের মতো কারো না কারো সঙ্গে পরিচিত হতে হয়।
হরিণের মাংস বলে অনেক সময় শুকর ও কুকুরের মাংস আপনারা বিক্রি করেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কিছু ক্ষেত্রে এটা ঠিক, যেমন আমরা যখন হরিণ শিকারের জন্য ফাঁদ ব্যবহার করি তখন সুন্দরবনের বেশ বড় এলাকাজুড়ে ফাঁদ পাততে হয়। অনেক সময় ওই ফাঁদে বণ্য শুকরও ধরা পরে তখন আমাদের অনেকেই হরিণের সঙ্গে শুকরও জবাই করে মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করে। এ ছাড়া অনেক নতুন ক্রেতা আছে যারা বন সংলগ্ন এলাকায় প্রতারকদের ক্ষপ্পরে পরে এবং কম দামের প্রলোভনে পরে কুকুরের মাংস কিনে থাকে। তবে এখন হরিণের মাংসের ক্রেতারাও সচেতন হয়ে গেছে, তারা এখন হরিণের চামড়ার একটি অংশসহ মাংস ক্রয় করতে চান।
শিকার পদ্ধতিতে সম্পর্কে বলেন, মানুষের শব্দ পেলেই ঘন বনে লুকিয়ে পরে লাজুক প্রকৃতির এ প্রাণীটি। পূর্ব সুন্দরবনে সব থেকে বেশি হরিণ শিকার করা হয় দুবলার চর, বঙ্গবন্ধুর চর, কবরখালী, মানিকখালী, কালামিয়ার ভারানী, মক্তোর ট্যাগ, হিরণ পয়েন্ট, কটকা, তালপট্টি, কচিখালি, দুবলা চান্দেরশ্বর, বগি, চরখালি এলাকায়। এসব এলাকায় হরিণের চলাচলের পথে নাইলনের সুতা ফাঁদ, স্প্রিং বসানো ফাঁদ, কলার সঙ্গে বড়শি ঝুলিয়ে, চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে ও গুলি ছুড়ে হরিণ শিকার করা হয়। এসব এলাকায় শিকারীরা এক রাতে ফাঁদ পেতে আসে এবং পরের রাতে গিয়ে আবার ফাঁদ দেখা হয়।
সুন্দরবন সংলগ্ন যে সব এলাকায় মেলে হরিণের মাংস
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের কর্মকর্তা জানান, বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, গত ৫ আগস্টের পর থেকে সারাদেশে আইনকৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এ সুযোগে সুন্দরবনে হরিণ শিকারাও তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করে। তবে এখন পরিস্থিতি ভিন্ন, হরিণ শিকারীদের ধরতে বর্তমানে বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের কর্মকর্তাসহ বনরক্ষীরা ব্যাপক তৎপর রয়েছে। এরই মধ্যে হরিণ শিকার প্রতিরোধে জেলে ও মৌয়ালদের সুন্দরবনে হরিণ শিকারের ফাঁদ পেলে সেটা উদ্ধার করে জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব ফাঁদ জমা দিলে প্রতি কেজি ফাঁদের জন্য দুই হাজার টাকা পুরুস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে বন বিভাগের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি হরিণ শিকারের ফাঁদ উদ্ধারে সহযোগিতা করায় ৮ জনকে নগদ অর্থ প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া সুন্দরবন সংলগ্ন চরদুয়ানি ও জ্ঞানপাড়া এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে ১০ সদস্য বিশিষ্ট দুটি কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটির সদস্যরা সব সময় বন বিভাগের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে, কোথায় হরিণ শিকারীরা অবস্থান করছে তা চিহ্নিত করাসহ সুন্দরবন কেন্দ্রীক অপতৎপরতা রোধে কাজ করবে এ কমিটির সদস্যরা। এ কমিটির সদস্যরা স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে আমাদের সঙ্গে কাজ করবে। এ ছাড়া সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে স্থানীয় প্রভাবশলী ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল জেলে-বাওয়ালীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে লিফলেট বিতারন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের স্মার্ট পেট্রোলিংটিম তো রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, শুধু শিকারি নয়, যারা হরিণের মাংস খান, এমন ভোক্তাদেরও চিহ্নিত করে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। শিকার বন্ধ করা গেলে হরিণ বাড়বে, আর হরিণ বাড়লে বাঘওটিকবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বাগেরহাট জেলা সভাপতি ও ‘সুন্দরবন রক্ষায় আমরা’ সংগঠনের প্রধান সমন্বয়কারী মোহাম্মদ নূর আলম শেখ গণমাধ্যমকে বলেন, আমি মনে করি হরিণ শিকারে বন বিভাগের অসাধু ব্যক্তিদের হাত রয়েছে।
তা না হলে হরিণ শিকার এত বাড়তে পারে না। এ ছাড়া বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন নতুন শিকারী চক্র গড়ে উঠেছে। তারা এতোটা বেপরোয়া যে, তারা বন বিভাগকেও তোয়াক্কা করে না। বলতে গেলে ভয়ে বনরক্ষীরা তাদের থেকে দূরত্ব রেখে চলে।