alt

সারাদেশ

ভালুকায় বিলুপ্ত হচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ

প্রতিনিধি ভালুকা (ময়মনসিংহ) : বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

ভরা মৌসুমে ভালুকার বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রাম গুলিতে খাল বিলে মিলছে না দেশীয় প্রজাতির কোনো ধরনের মাছ। ফলে এক সময়ের মাছে ভাতে বাঙালি এ অঞ্চলের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষদের খাদ্য তালিকায় শাকসবজি, কচুর লতি, আলু ভর্তা, মশুর ডাল ইত্যাদি প্রাধান্য পেয়েছে। সব গ্রামে খাল বিলে মাছ ধরার জন্য প্রত্যেক বাড়িতে মাটির দেয়ালে খাড়া থাকতো বাঁশের তৈরি তিন কাঠির হাত জালি ও মাছ রাখার খালই (ডোলা)। বাড়ির পাশের বিল খাল ডোবায় কিছু সময় হাত জালি দিয়ে মাছ ধরলে দেশীয় প্রজাতির শিং, মাগুর, কৈ, টাকি, পুঁটি, টেংরা, চাটা, মলা, বেদাইরা, চান্দা ইত্যাদি ছোট মাছে ডোলা ভরে বাড়ি ফিরতেন গ্রামের গৃহস্থ লোকেরা। নিজের ক্ষেতে উৎপাদিত বেগুন, ঝিংগা, বরবটি, শসা, কুমড়া, রেগা, কচু ইত্যাদি সবজি দিয়ে আমিষ জাতীয় তরকারী পাক করে পরিবারের ছেলে মেয়েদের নিয়ে তৃপ্তি সহ দু’বেলা খাবার খেতেন।

মিল ফ্যাক্টরি থেকে বর্জ্য মিশ্রিত বিষাক্ত কালো পানি খীরু নদী সহ বিভিন্ন খাল বিলে ছড়িয়ে যাওয়ায় দেশীয় প্রায় ৫০ প্রজাতির মাছ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অন্যদিকে প্রভাবশালীরা ছোট বড় খাস ও মালিকানাধীন খাল বিল জলাশয়ে অপরিকল্পিত ভাবে রুই কাতল ও পাঙ্গাস মাছের চাষ করায় দেশীয় মাছের বিলুপ্তি ঘটছে। খাল বিল পুকুরে মাছ চাষ করার সময় ক্ষতিকর পোকা মাকড় নিধনের জন্য জলাশয় গুলিতে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিষ প্রয়োগ করে থাকে। যে কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছ সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ফলে এলাকার মানুষ প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ হারিয়ে আমিষ জাতীয় খাদ্য হতে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে মুক্ত জলাশয়ে মাছ শিকারের সঙ্গে জড়িত পেশাজীবি জেলেরাও আয় রোজগারের পথ হারিয়ে অন্য পেশার দিকে ছুটতে বাধ্য হচ্ছে। এ ছাড়া শুকনা মৌসুমে উপজেলার ভালুকা, ভরাডোবা ও হবিরবাড়ী ইউনিয়নের জামিরদিয়া ও কাশর এলাকার অসংখ্য ডাইং মিল থেকে বিরামহীন দুর্গন্ধযুক্ত ঘন কালোপানি লাউতি ও বেতিয়া হাঙ্গুন খাল দিয়ে খীরু নদীতে নামায় পানি বিষাক্ত হয়ে মাছসহ সব রকম পোকা মাকর মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়রা জানায় নদীর কিনার সহ মাটি আলকাতরার মত কিচকিচে কালো হয়ে গেছে। এসব কালো পানিতে নামলে শরীরে চুলকানিসহ নানা রকম চর্ম রোগের সৃষ্টি হয়।

অভিজ্ঞজনের মতে দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হওয়ার পিছনে মিল ফ্যক্টরির বর্জ্য পানির সঙ্গে খাল বিল ও প্লাবন ভূমিতে বাঁধ দিয়ে ব্যক্তি মালিকানায় মৎস্য চাষ, খীরু নদীর সঙ্গে খাল বিলের সংযোগ স্থলে বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহের গতিপথ অবরুদ্ধ করা বিলের কচুরিপানা ও ঘাস পরিষ্কার করে মাছের প্রজনন ও আবাস স্থল নষ্ট করে ফেলা উল্লেখযোগ্য কারণ। গ্রাম এলাকার খাল বিল ও প্লাবন ভূমিগুলো ব্যক্তি মালিকানায় মৎস্য চাষ হওয়ার কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছগুলি আর জন্মাতে পারছে না। ফলে সারা বছর মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ ধরা হতে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকার জন সাধারণ। এক সময় বর্ষা এলে খীরু নদীর মিঠা পানিতে পাওয়া যেত অনেক প্রজাতির সুস্বাদু দেশীয় মাছ। যেমন রুই, কাতল, বাউস, কালি বাউস, বোয়াল, গোলসা, টেংরা, কাচকি, চাপিলা, পাবদা, বাইলা, বড় বাইন, তারা বাইন, মলা, ঢেলা, ছেলা, বাঘাই, আইড়, বাছা, বড়চিংড়ি, বাইলা, কাইক্কা আরও অনেক প্রজাতির মাছ। বর্ষা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব মাছ প্রচুর ধরা পরতো জেলেদের জালে।

এলাকার সব মানুষ ইচ্ছে মতো মাছ ধরায় মেতে উঠতো। শুকনা মৌসুমে ডোবা খাল বিলে পাওয়া যেত শিং, মাগুর, কৈ, শোল, গজার, টাকি, ফইলা, খৈলা, ভেদা, ছোট চিংড়ি, পুটি, টেংরা, গুলসা ইত্যাদি। গ্রামাঞ্চলের যেখানেই ছোট বড় জলাশয় চোখে পরতো সেখানেই এসব মাছ পাওয়া যেতো। অথচ ওইসব জলাশয় প্রভাবশালীরা কৌশলে নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে পোকা মাকড় মারার অজুহাতে বিষঢেলে দেশীয় প্রজাতির মাছ ধ্বংস করে তাতে থাই পাঙ্গাসের চাষ করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে মলা ঢেলা শিং মাগুর ও কৈ মাছের মতো আমিষ জাতীয় খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকার নারী শিশু সহ সর্ব সাধারণ। প্রসূতিপর মায়েদের শরীর স্বাস্থ্য পুনঃগঠনে শিং মাছ ও কাঁচা কলার ঝোল রান্না করে খাওয়ানো একটি উত্তম সেবার মধ্যে থাকতো। শিশুদের চোখের জ্যোতি বাড়াতে মলা ঢেলা মাছ খাওয়ানোর জন্য ডাক্তার পরামর্শ দিতেন। এক কথায় প্রাকৃতিক উপায়ে এসব মাছ এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। মৎস্য অধিদপ্তরের উদ্ভাবিদ কয়েক প্রজাতির মাছ বিভিন্ন খামারে চাষ হলেও চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য। তাছাড়া অধিক মূল্যের কারণে এসব মাছ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। হাওর এলাকা থেকে আমদানী করা স্থানীয় বাজারে ৬০০ টাকা কেজি শিং, ৬০০ টাকা কেজি টেংরা, ৮০০ টাকা কেজি পাবদা, ৮০০ টাকা দেশি ছোট চিংড়ি, ৬০০ টাকা কেজি মলা মাছ কিনে খাওয়া এখন গরিব ও মধ্যবিত্তদের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো। উপজেলার ভরাডোবা গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি জিন্নত আলী (৬০) জানান বৈশাখ জৈষ্ঠ মাসে যখন বৃষ্টি হতো তখন বিলের দাম ও কচুরি পানার নিচ থেকে শিং, মাগুর, কৈ, মাছ পানির ঢল পেয়ে ডাঙ্গায় উঠতে শুরু করলে ছেলে বুড়ো সবাই মেতে উঠতেন উজাই মাছ ধরায়। গ্রামের প্রচলিত ভাষায় যাকে বলা হতো উজাই মাছ ধরা। আবার অতি বৃষ্টি হলে খাল নালা দিয়ে পানি নামার সময় তিন কাঠির হাত জাল, ঝাকি জাল, শিবজাল ও হাত বরশি দিয়ে মাছ ধরায় মেতে উঠতো সকলে। গ্রামের খালে বিলে বর্ষার নতুন পানিতে বরশি দিয়ে লাল টেংড়া, পুটি পাবদা, শিং কৈ মাছ ধরা যেন উৎসবে পরিণত হতো। অথচ বর্ষার ভরা মৌসুমে নদী খালে পানি থাকলেও এখন আর মাছ ধরার দৃশ্য চোখে পরে না।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ভালুকা আঞ্চলিক শাখার সদস্য সচিব ভালুকা প্রেসক্লাব সভাপতি কামরুল হাসান পাঠান কামাল জানান খীরু নদী হতে অসংখ্য সংযোগ খাল দিয়ে উপজেলার বিভিন্ন বিল ও ডোবায় পানি প্রবাহিত হয়। দেশীয় প্রজাতির মাছের আবাস ও প্রজনন স্থল খীরু নদীতে প্রতিনিয়ত অসংখ্য ডাইং মিল হতে দূষিত বর্জ্য মিশ্রিত কালো পানি নামার কারণে ডিম ওয়ালা মা মাছ সহ সব ধরনের মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

তিনি জানান, মিল কারখানা হতে ইটিপির মাধ্যমে বর্জ্য পানি পরিশোধন করে নদীতে ফেললে দেশীয় প্রজাতির মাছগুলো ফিরে পাওয়া সম্ভব। সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতি সচেতন মহলের দাবি দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য প্রজনন স্থল সরকারি জল মহাল ও প্লাবন ভূমি মুক্ত জলাশয়গুলো প্রভাবশালীদের হাত থেকে উদ্ধার করে উন্মুক্ত রাখা ও মিল কারখানার বর্জ্যপানি নদীখালে ফেলা বন্ধ হলে পুনরায় নানা প্রজাতির দেশীয় মাছে ভরে উঠবে নদীনালা-খাল-বিল।

ছবি

পাবনায় শিক্ষকের চড়ে শিশুশিক্ষার্থীর নাক ফাটল, হাসপাতালে ভর্তি

ছবি

বান্দরবানে সেনা অভিযানে কেএনএ কমান্ডারসহ নিহত ২

ছবি

এনসিপি-‘বৈষম্যবিরোধীদের ’ আন্দোলনের মুখে পটিয়া থানার ওসি প্রত্যাহার

ছবি

বিতর্কিত মন্তব্যে চাকরি হারালেন সাবেক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট

ছবি

মধুপুর শালবনে মিলল বিরল প্রজাতির কেলিকদম গাছ

ছবি

৪৫ বছর ধরে পথে পথে বাঁশি বিক্রি করে সংসার চালান বাবলু

চকরিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ফিজিওথেরাপি সেন্টার প্রতিবন্ধীদের বিশ্বস্ত ঠিকানা

জরাজীর্ণ ঘরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন বিধবা কাজল রাণী

বিরামপুরে ৮ মাস পর মরদেহ উত্তোলন

মাদারগঞ্জে সরকারি জমিতে বদরুলের ৭ তলা ভবন!

দোহারে বিএনপি নেতাকে গুলি করে হত্যা

নোয়াখালীতে চালের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ

ছবি

ঘাটাইলের রানাদহ বিলে দেখা মিলল শামুকখোল পাখির

ফের ভাঙনের মুখে গুয়াবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

দোহারে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে একজনের মৃত্যু

কাপাসিয়ায় মাদকসেবীকে পিটিয়ে হত্যা

মহেশপুরে বজ্রপাত থেকে বাঁচতে তালগাছ রোপণ

ছবি

লামায় পাহাড় কাটার মহোৎসব ২ ইটভাটায় ২ লাখ টাকা জরিমানা

চলন্ত পাঠাগারের বই আড্ডা

উলিপুরে গাছচাপায় নৈশপ্রহরীর মৃত্যু

ছবি

মোংলা বন্দরে নোঙর করেছে বিদেশি বাণিজ্য জাহাজ

হাতিয়ায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে আটক ৪

ছবি

নয়াবাড়ীতে চেয়ারম্যান প্রার্থী হওয়ার আগেই খুন হলেন বিএনপি নেতা হারুন

মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপের দাবিতে রাজশাহীতে মানববন্ধন

হলি আর্টিজানে নিহত এসি রবিউলের মৃত্যুবার্ষিকী মানিকগঞ্জে পালিত

ছবি

ফের গৌরীপুর-কলতাপাড়া সড়ক বেহাল

গাংনী সড়কে ডাকাতি, ককটেল বিস্ফোরণ

দেওয়ানগঞ্জে ডিবি পুলিশের ওপর অতর্কিত হামলা করে আসামি ছিনতাই

ডিপিএড প্রশিক্ষণের বকেয়া ভাতায় শিক্ষক নেতাদের ঘুষ বাণিজ্য

টঙ্গীবাড়ীতে খাল উদ্ধারের দাবিতে মানববন্ধন

ছবি

সাতক্ষীরা পৌর এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সংকটে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে জারের পানির ওপর

কমলনগরে নামজারিতে জাল খতিয়ান দাখিল করায় যুবক দণ্ডিত

পাকুন্দিয়ায় ব্রহ্মপুত্রে নৌকাডুবি, তিনজনের মরদেহ উদ্ধার

ছবি

বোয়ালখালীতে৩ প্রতিষ্ঠানকে ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা

জুলাই বিপ্লব নিয়ে পুলিশ সদস্যের কটূক্তি

ছবি

শিবগঞ্জ মহাস্থান হাটের কাঁঠাল যাচ্ছে সারাদেশে

tab

সারাদেশ

ভালুকায় বিলুপ্ত হচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ

প্রতিনিধি ভালুকা (ময়মনসিংহ)

বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

ভরা মৌসুমে ভালুকার বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রাম গুলিতে খাল বিলে মিলছে না দেশীয় প্রজাতির কোনো ধরনের মাছ। ফলে এক সময়ের মাছে ভাতে বাঙালি এ অঞ্চলের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষদের খাদ্য তালিকায় শাকসবজি, কচুর লতি, আলু ভর্তা, মশুর ডাল ইত্যাদি প্রাধান্য পেয়েছে। সব গ্রামে খাল বিলে মাছ ধরার জন্য প্রত্যেক বাড়িতে মাটির দেয়ালে খাড়া থাকতো বাঁশের তৈরি তিন কাঠির হাত জালি ও মাছ রাখার খালই (ডোলা)। বাড়ির পাশের বিল খাল ডোবায় কিছু সময় হাত জালি দিয়ে মাছ ধরলে দেশীয় প্রজাতির শিং, মাগুর, কৈ, টাকি, পুঁটি, টেংরা, চাটা, মলা, বেদাইরা, চান্দা ইত্যাদি ছোট মাছে ডোলা ভরে বাড়ি ফিরতেন গ্রামের গৃহস্থ লোকেরা। নিজের ক্ষেতে উৎপাদিত বেগুন, ঝিংগা, বরবটি, শসা, কুমড়া, রেগা, কচু ইত্যাদি সবজি দিয়ে আমিষ জাতীয় তরকারী পাক করে পরিবারের ছেলে মেয়েদের নিয়ে তৃপ্তি সহ দু’বেলা খাবার খেতেন।

মিল ফ্যাক্টরি থেকে বর্জ্য মিশ্রিত বিষাক্ত কালো পানি খীরু নদী সহ বিভিন্ন খাল বিলে ছড়িয়ে যাওয়ায় দেশীয় প্রায় ৫০ প্রজাতির মাছ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অন্যদিকে প্রভাবশালীরা ছোট বড় খাস ও মালিকানাধীন খাল বিল জলাশয়ে অপরিকল্পিত ভাবে রুই কাতল ও পাঙ্গাস মাছের চাষ করায় দেশীয় মাছের বিলুপ্তি ঘটছে। খাল বিল পুকুরে মাছ চাষ করার সময় ক্ষতিকর পোকা মাকড় নিধনের জন্য জলাশয় গুলিতে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিষ প্রয়োগ করে থাকে। যে কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছ সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ফলে এলাকার মানুষ প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ হারিয়ে আমিষ জাতীয় খাদ্য হতে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে মুক্ত জলাশয়ে মাছ শিকারের সঙ্গে জড়িত পেশাজীবি জেলেরাও আয় রোজগারের পথ হারিয়ে অন্য পেশার দিকে ছুটতে বাধ্য হচ্ছে। এ ছাড়া শুকনা মৌসুমে উপজেলার ভালুকা, ভরাডোবা ও হবিরবাড়ী ইউনিয়নের জামিরদিয়া ও কাশর এলাকার অসংখ্য ডাইং মিল থেকে বিরামহীন দুর্গন্ধযুক্ত ঘন কালোপানি লাউতি ও বেতিয়া হাঙ্গুন খাল দিয়ে খীরু নদীতে নামায় পানি বিষাক্ত হয়ে মাছসহ সব রকম পোকা মাকর মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়রা জানায় নদীর কিনার সহ মাটি আলকাতরার মত কিচকিচে কালো হয়ে গেছে। এসব কালো পানিতে নামলে শরীরে চুলকানিসহ নানা রকম চর্ম রোগের সৃষ্টি হয়।

অভিজ্ঞজনের মতে দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হওয়ার পিছনে মিল ফ্যক্টরির বর্জ্য পানির সঙ্গে খাল বিল ও প্লাবন ভূমিতে বাঁধ দিয়ে ব্যক্তি মালিকানায় মৎস্য চাষ, খীরু নদীর সঙ্গে খাল বিলের সংযোগ স্থলে বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহের গতিপথ অবরুদ্ধ করা বিলের কচুরিপানা ও ঘাস পরিষ্কার করে মাছের প্রজনন ও আবাস স্থল নষ্ট করে ফেলা উল্লেখযোগ্য কারণ। গ্রাম এলাকার খাল বিল ও প্লাবন ভূমিগুলো ব্যক্তি মালিকানায় মৎস্য চাষ হওয়ার কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছগুলি আর জন্মাতে পারছে না। ফলে সারা বছর মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ ধরা হতে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকার জন সাধারণ। এক সময় বর্ষা এলে খীরু নদীর মিঠা পানিতে পাওয়া যেত অনেক প্রজাতির সুস্বাদু দেশীয় মাছ। যেমন রুই, কাতল, বাউস, কালি বাউস, বোয়াল, গোলসা, টেংরা, কাচকি, চাপিলা, পাবদা, বাইলা, বড় বাইন, তারা বাইন, মলা, ঢেলা, ছেলা, বাঘাই, আইড়, বাছা, বড়চিংড়ি, বাইলা, কাইক্কা আরও অনেক প্রজাতির মাছ। বর্ষা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব মাছ প্রচুর ধরা পরতো জেলেদের জালে।

এলাকার সব মানুষ ইচ্ছে মতো মাছ ধরায় মেতে উঠতো। শুকনা মৌসুমে ডোবা খাল বিলে পাওয়া যেত শিং, মাগুর, কৈ, শোল, গজার, টাকি, ফইলা, খৈলা, ভেদা, ছোট চিংড়ি, পুটি, টেংরা, গুলসা ইত্যাদি। গ্রামাঞ্চলের যেখানেই ছোট বড় জলাশয় চোখে পরতো সেখানেই এসব মাছ পাওয়া যেতো। অথচ ওইসব জলাশয় প্রভাবশালীরা কৌশলে নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে পোকা মাকড় মারার অজুহাতে বিষঢেলে দেশীয় প্রজাতির মাছ ধ্বংস করে তাতে থাই পাঙ্গাসের চাষ করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে মলা ঢেলা শিং মাগুর ও কৈ মাছের মতো আমিষ জাতীয় খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এলাকার নারী শিশু সহ সর্ব সাধারণ। প্রসূতিপর মায়েদের শরীর স্বাস্থ্য পুনঃগঠনে শিং মাছ ও কাঁচা কলার ঝোল রান্না করে খাওয়ানো একটি উত্তম সেবার মধ্যে থাকতো। শিশুদের চোখের জ্যোতি বাড়াতে মলা ঢেলা মাছ খাওয়ানোর জন্য ডাক্তার পরামর্শ দিতেন। এক কথায় প্রাকৃতিক উপায়ে এসব মাছ এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। মৎস্য অধিদপ্তরের উদ্ভাবিদ কয়েক প্রজাতির মাছ বিভিন্ন খামারে চাষ হলেও চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য। তাছাড়া অধিক মূল্যের কারণে এসব মাছ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। হাওর এলাকা থেকে আমদানী করা স্থানীয় বাজারে ৬০০ টাকা কেজি শিং, ৬০০ টাকা কেজি টেংরা, ৮০০ টাকা কেজি পাবদা, ৮০০ টাকা দেশি ছোট চিংড়ি, ৬০০ টাকা কেজি মলা মাছ কিনে খাওয়া এখন গরিব ও মধ্যবিত্তদের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো। উপজেলার ভরাডোবা গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি জিন্নত আলী (৬০) জানান বৈশাখ জৈষ্ঠ মাসে যখন বৃষ্টি হতো তখন বিলের দাম ও কচুরি পানার নিচ থেকে শিং, মাগুর, কৈ, মাছ পানির ঢল পেয়ে ডাঙ্গায় উঠতে শুরু করলে ছেলে বুড়ো সবাই মেতে উঠতেন উজাই মাছ ধরায়। গ্রামের প্রচলিত ভাষায় যাকে বলা হতো উজাই মাছ ধরা। আবার অতি বৃষ্টি হলে খাল নালা দিয়ে পানি নামার সময় তিন কাঠির হাত জাল, ঝাকি জাল, শিবজাল ও হাত বরশি দিয়ে মাছ ধরায় মেতে উঠতো সকলে। গ্রামের খালে বিলে বর্ষার নতুন পানিতে বরশি দিয়ে লাল টেংড়া, পুটি পাবদা, শিং কৈ মাছ ধরা যেন উৎসবে পরিণত হতো। অথচ বর্ষার ভরা মৌসুমে নদী খালে পানি থাকলেও এখন আর মাছ ধরার দৃশ্য চোখে পরে না।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ভালুকা আঞ্চলিক শাখার সদস্য সচিব ভালুকা প্রেসক্লাব সভাপতি কামরুল হাসান পাঠান কামাল জানান খীরু নদী হতে অসংখ্য সংযোগ খাল দিয়ে উপজেলার বিভিন্ন বিল ও ডোবায় পানি প্রবাহিত হয়। দেশীয় প্রজাতির মাছের আবাস ও প্রজনন স্থল খীরু নদীতে প্রতিনিয়ত অসংখ্য ডাইং মিল হতে দূষিত বর্জ্য মিশ্রিত কালো পানি নামার কারণে ডিম ওয়ালা মা মাছ সহ সব ধরনের মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

তিনি জানান, মিল কারখানা হতে ইটিপির মাধ্যমে বর্জ্য পানি পরিশোধন করে নদীতে ফেললে দেশীয় প্রজাতির মাছগুলো ফিরে পাওয়া সম্ভব। সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতি সচেতন মহলের দাবি দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য প্রজনন স্থল সরকারি জল মহাল ও প্লাবন ভূমি মুক্ত জলাশয়গুলো প্রভাবশালীদের হাত থেকে উদ্ধার করে উন্মুক্ত রাখা ও মিল কারখানার বর্জ্যপানি নদীখালে ফেলা বন্ধ হলে পুনরায় নানা প্রজাতির দেশীয় মাছে ভরে উঠবে নদীনালা-খাল-বিল।

back to top