কালের পরিক্রমায় একান্নবর্তী পরিবারের ঐতিহ্য এখন নেই বললেই চলে। সংসারের ঠুনকো দ্বন্দ্ব আর স্বার্থের টানাপড়েনে এক সাথে সংসার করা দূরে থাক ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব সংঘাত সামাজিক ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয়েছে, সেই সময় একান্নবর্তী পরিবার ও যৌথ ব্যাবসা বাণিজ্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বোয়ালমারী পাল পরিবার। প্রায় অর্ধশত বছর যাবত একছাতার নিচে চলছে ছয় ভাই এক হাঁড়িতে পরিবারের সবার জন্য রান্না হয়। এখনও পরিবারের সবার চিন্তা ও মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয় সমানভাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বোয়ালমারী উপজেলার ঠাকুরপুর গ্রামের মৃত ষষ্ঠী চরণ পাল। মাটির হাড়ি পাতিল বানিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে বিক্রি করে চলাতো তার অভাবের সংসার। ষষ্ঠী পালের স্বপ্ন ছিল ছেলেদেরকে তিনি বাপ-দাদার পালের কাজ করাবেন না। সেই ভাবনা থেকে অর্ধশত বছর আগে বোয়ালমারী বাজারে নিজের স্ত্রীর নামে গড়ে তোলেন মহামায়া ভান্ডার নামের একটি মুদির দোকান। শুরুতে ব্যবসা তার ভালো চলতো না। ১৯৯৭ সালে ১৪ এপ্রিল ষষ্ঠী পাল (৭৩) গত হন। মৃতকালে তার ছেলেদের নির্দ্দেশ দেন সারা জীবন একসাথে থাকার। পিতার আদেশ গুরু দায়িত্ব মনে করে ছয় ভাই পরিকল্পনা করে বাবার হাতে গড়ে তোলা মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত জরাজীর্ণ মুদি দোকানটিই তারা একসাথে পরিচালনা করবেন। সেই থেকে ষষ্ঠী পালে ছয় ছেলে এক সাথে মুদি দোকানটি চালাচ্ছেন। এখন আর জড়াজীর্ণ দোকান নয়। দোকানটি পরিপূর্ণ একটি দোকান। সব ধরনের মালের সমাহার রয়েছে এখানে। কি নাই এখানে। নুন থেকে চাল,ডাল, তেল, কোরোসিন এমনকি বিবাহের সব ধরণের উপকরণ। জেলা পরিসংখ্যান কার্যালয় সুত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ ২০২২ সালের জন শুমারী-গৃহগণণা তথ্য অনুযায়ী ফরিদপুরে মোট জনসংখ্যা ২১ লাখ ৬২ হাজার ৭৫৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ- ১০ লাখ ৫০ হাজার ৩৭৭ জন। মহিলার সংখ্যা ১১ লাখ ১২ হাজার ৩৭৭ জন। জেলায় মোট পরিবারের সংখ্যা ৫ লাখ ২৫ হাজার ৫৮০ টি। তবে এর মধ্যে যৌথ পরিবারের সংখ্যার কোন পরিসংখ্যান নেই। মহামায়া ভান্ডারের কর্মচারী রনজিৎ কুমার বিশ্বাস বলেন, আমারা কয়েকজন কর্মচারী আছি। এখানে কাজ করেও আলাদা শান্তি আছে। নিজের কাছে ভালো লাগে। ভাইয়ে ভাইয়ে কত মিল। কোন ঝগড়াঝাঁটি নেই। পরিবারের সবাই আমাদের সাথেও ভালো আচরণ করেন।
জানতে চাইলে পরিবারের বড় ছেলে গোবিন্দ পাল (৭৪) বলেন, বাবা-মা মারা যাওয়ার পরও আমরা ছয় ভাই সবাই একসঙ্গে আছি। মুলত: ব্যক্তি শাসনতন্ত্র প্রথাকে এড়িয়ে চলেছি। আমাদের কারও মধ্যে কোনও হিংসা-প্রতিহিংসা তৈরি করি না। বাড়ির বৌদের সেভাবে গড়ে তুলেছি। কারণ তারা তো অন্য পরিবার থেকে এসেছে। তাদের মধ্যে আমাদের চিন্তার প্রতিফলন ঘটতে নাও পারে। সেজন্য তাদের আমরা যৌথ পরিবারের ভালো দিকগুলো তুলে ধরেছি। আমাদের মতো করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি।
মেঝ ছেলে বিমল পাল বলেন,বাবার আদর্শ বুকে ধারণ করে বেঁচে আছি। বাবা বলে গেছেন, ছয় ভাই একসাথে মিলেমিশে থাকতে। বাবার নির্দেশ পালন করছি। আমাদের ছয় ভাইয়ের মধ্যে কোন বিভেদ নেই। খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য সব একসাথেই চলে। প্রতিদিন গড়ে এক হাড়িতে ৩০ থেকে ৩২ জনের খাবার রান্না হয়। বোয়ালমারী শিল্পকলা একাডেমির সদস্য আমীর চারু বাবলু বলেন, যৌথ পরিবার ভাঙার মারাত্মক কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদেশি চ্যানেলগুলো। বর্তমানে নানা কারণেই যৌথ পরিবারগুলোর এক থাকা খুবই কষ্টকর। আমাদের দাদা-বাবারা যেভাবে যৌথ পরিবার দুঃখ দুর্দশার মধ্যে টেনে নিয়েছেন বছরের পর বছর-এখন আর সেটা নেই। সবাই যার যার স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। মনে করেন আলাদা হলেই জীবনব্যবস্থা আরও উন্নত হবে। আমি মনে করি এটা সর্ম্পণ ভুল ধারণা।
বোয়ালমারী উপজেলা সাংস্কৃতিক ঐক্য মঞ্চের সভাপতি কৃষ্ণ পাল বলেন, এখন যৌথ পরিবার তেমন দেখা যায় না। সবাই মিলেমিশে থাকাটা এখন স্বপ্নের মতো হয়ে গেছে। মুল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই বৃদ্ধ মা-বাবাকে সন্তানরা বৃদ্ধাশ্রমে রাখছেন। যদি যৌথ পরিবারগুলো একই ছাদের নিচে থাকতো তাহলে এই সমস্যা প্রকট হতো না। সবাই মিলেমিশে থাকার মধ্যে যে আনন্দ রয়েছে তা আলাদা হয়ে গেলে আর থাকে না। সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যৌথ পরিবার এক থাকলে তা কতটুকু শক্তি সঞ্চার করে তা বলে শেষ করা যাবে না। বোয়ালমারীর মহামায়া ভান্ডারের ছয় ভাই তারা এখনও যৌথ পরিবার ও যৌথ ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। তারা সমাজের দৃষ্টান্ত ও অনুকরণীয়।
বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর হাসান চৌধুরী বলেন, যৌথ পরিবার সমাজে অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। আসলে বিষয়টি শুনে খুবই ভালো লাগলো যে বোয়ালমারীতে যৌথ পরিবার যৌথ ব্যবসা এখনও টিকে আছে। পরিবারের সদস্যদের ধন্যবাদ জানাই।
এ বিষয়ে ফরিদপুর জেলা পরিসংখ্যান কার্যালয়ের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. নাজমুল হক বলেন, কালের বিবর্তনে যৌথ পরিবার, যৌথ ব্যবসা যেন বিলুপ্তির পথে। তবে সুনির্দিষ্ট করে ফরিদপুরে যৌথ পরিবারের সংখ্যা বলা না গেলেও যৌথ পরিবার, যৌথ ব্যবসা অনেকাংশে কমেছে। এক কথায় অনেকটাই বিলুপ্তির পথে।
বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫
কালের পরিক্রমায় একান্নবর্তী পরিবারের ঐতিহ্য এখন নেই বললেই চলে। সংসারের ঠুনকো দ্বন্দ্ব আর স্বার্থের টানাপড়েনে এক সাথে সংসার করা দূরে থাক ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব সংঘাত সামাজিক ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয়েছে, সেই সময় একান্নবর্তী পরিবার ও যৌথ ব্যাবসা বাণিজ্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বোয়ালমারী পাল পরিবার। প্রায় অর্ধশত বছর যাবত একছাতার নিচে চলছে ছয় ভাই এক হাঁড়িতে পরিবারের সবার জন্য রান্না হয়। এখনও পরিবারের সবার চিন্তা ও মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয় সমানভাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বোয়ালমারী উপজেলার ঠাকুরপুর গ্রামের মৃত ষষ্ঠী চরণ পাল। মাটির হাড়ি পাতিল বানিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে বিক্রি করে চলাতো তার অভাবের সংসার। ষষ্ঠী পালের স্বপ্ন ছিল ছেলেদেরকে তিনি বাপ-দাদার পালের কাজ করাবেন না। সেই ভাবনা থেকে অর্ধশত বছর আগে বোয়ালমারী বাজারে নিজের স্ত্রীর নামে গড়ে তোলেন মহামায়া ভান্ডার নামের একটি মুদির দোকান। শুরুতে ব্যবসা তার ভালো চলতো না। ১৯৯৭ সালে ১৪ এপ্রিল ষষ্ঠী পাল (৭৩) গত হন। মৃতকালে তার ছেলেদের নির্দ্দেশ দেন সারা জীবন একসাথে থাকার। পিতার আদেশ গুরু দায়িত্ব মনে করে ছয় ভাই পরিকল্পনা করে বাবার হাতে গড়ে তোলা মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত জরাজীর্ণ মুদি দোকানটিই তারা একসাথে পরিচালনা করবেন। সেই থেকে ষষ্ঠী পালে ছয় ছেলে এক সাথে মুদি দোকানটি চালাচ্ছেন। এখন আর জড়াজীর্ণ দোকান নয়। দোকানটি পরিপূর্ণ একটি দোকান। সব ধরনের মালের সমাহার রয়েছে এখানে। কি নাই এখানে। নুন থেকে চাল,ডাল, তেল, কোরোসিন এমনকি বিবাহের সব ধরণের উপকরণ। জেলা পরিসংখ্যান কার্যালয় সুত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ ২০২২ সালের জন শুমারী-গৃহগণণা তথ্য অনুযায়ী ফরিদপুরে মোট জনসংখ্যা ২১ লাখ ৬২ হাজার ৭৫৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ- ১০ লাখ ৫০ হাজার ৩৭৭ জন। মহিলার সংখ্যা ১১ লাখ ১২ হাজার ৩৭৭ জন। জেলায় মোট পরিবারের সংখ্যা ৫ লাখ ২৫ হাজার ৫৮০ টি। তবে এর মধ্যে যৌথ পরিবারের সংখ্যার কোন পরিসংখ্যান নেই। মহামায়া ভান্ডারের কর্মচারী রনজিৎ কুমার বিশ্বাস বলেন, আমারা কয়েকজন কর্মচারী আছি। এখানে কাজ করেও আলাদা শান্তি আছে। নিজের কাছে ভালো লাগে। ভাইয়ে ভাইয়ে কত মিল। কোন ঝগড়াঝাঁটি নেই। পরিবারের সবাই আমাদের সাথেও ভালো আচরণ করেন।
জানতে চাইলে পরিবারের বড় ছেলে গোবিন্দ পাল (৭৪) বলেন, বাবা-মা মারা যাওয়ার পরও আমরা ছয় ভাই সবাই একসঙ্গে আছি। মুলত: ব্যক্তি শাসনতন্ত্র প্রথাকে এড়িয়ে চলেছি। আমাদের কারও মধ্যে কোনও হিংসা-প্রতিহিংসা তৈরি করি না। বাড়ির বৌদের সেভাবে গড়ে তুলেছি। কারণ তারা তো অন্য পরিবার থেকে এসেছে। তাদের মধ্যে আমাদের চিন্তার প্রতিফলন ঘটতে নাও পারে। সেজন্য তাদের আমরা যৌথ পরিবারের ভালো দিকগুলো তুলে ধরেছি। আমাদের মতো করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি।
মেঝ ছেলে বিমল পাল বলেন,বাবার আদর্শ বুকে ধারণ করে বেঁচে আছি। বাবা বলে গেছেন, ছয় ভাই একসাথে মিলেমিশে থাকতে। বাবার নির্দেশ পালন করছি। আমাদের ছয় ভাইয়ের মধ্যে কোন বিভেদ নেই। খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য সব একসাথেই চলে। প্রতিদিন গড়ে এক হাড়িতে ৩০ থেকে ৩২ জনের খাবার রান্না হয়। বোয়ালমারী শিল্পকলা একাডেমির সদস্য আমীর চারু বাবলু বলেন, যৌথ পরিবার ভাঙার মারাত্মক কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদেশি চ্যানেলগুলো। বর্তমানে নানা কারণেই যৌথ পরিবারগুলোর এক থাকা খুবই কষ্টকর। আমাদের দাদা-বাবারা যেভাবে যৌথ পরিবার দুঃখ দুর্দশার মধ্যে টেনে নিয়েছেন বছরের পর বছর-এখন আর সেটা নেই। সবাই যার যার স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। মনে করেন আলাদা হলেই জীবনব্যবস্থা আরও উন্নত হবে। আমি মনে করি এটা সর্ম্পণ ভুল ধারণা।
বোয়ালমারী উপজেলা সাংস্কৃতিক ঐক্য মঞ্চের সভাপতি কৃষ্ণ পাল বলেন, এখন যৌথ পরিবার তেমন দেখা যায় না। সবাই মিলেমিশে থাকাটা এখন স্বপ্নের মতো হয়ে গেছে। মুল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই বৃদ্ধ মা-বাবাকে সন্তানরা বৃদ্ধাশ্রমে রাখছেন। যদি যৌথ পরিবারগুলো একই ছাদের নিচে থাকতো তাহলে এই সমস্যা প্রকট হতো না। সবাই মিলেমিশে থাকার মধ্যে যে আনন্দ রয়েছে তা আলাদা হয়ে গেলে আর থাকে না। সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যৌথ পরিবার এক থাকলে তা কতটুকু শক্তি সঞ্চার করে তা বলে শেষ করা যাবে না। বোয়ালমারীর মহামায়া ভান্ডারের ছয় ভাই তারা এখনও যৌথ পরিবার ও যৌথ ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। তারা সমাজের দৃষ্টান্ত ও অনুকরণীয়।
বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর হাসান চৌধুরী বলেন, যৌথ পরিবার সমাজে অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। আসলে বিষয়টি শুনে খুবই ভালো লাগলো যে বোয়ালমারীতে যৌথ পরিবার যৌথ ব্যবসা এখনও টিকে আছে। পরিবারের সদস্যদের ধন্যবাদ জানাই।
এ বিষয়ে ফরিদপুর জেলা পরিসংখ্যান কার্যালয়ের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. নাজমুল হক বলেন, কালের বিবর্তনে যৌথ পরিবার, যৌথ ব্যবসা যেন বিলুপ্তির পথে। তবে সুনির্দিষ্ট করে ফরিদপুরে যৌথ পরিবারের সংখ্যা বলা না গেলেও যৌথ পরিবার, যৌথ ব্যবসা অনেকাংশে কমেছে। এক কথায় অনেকটাই বিলুপ্তির পথে।