সিলেটে পাথর কোয়ারী নিয়ন্ত্রণ নিতে সব রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য এক। দখল নিতে হবে টাকার খনির। দল আলাদা, আদর্শ আলাদা, প্যাড আলাদা কিন্তু; দাবি এক। পরিবেশ ধ্বংস হলেও পাথরের খনি আসতে হবে নিজ দখলে। বিবৃতি দিয়ে নয়, আন্দোলনের ময়দানে একাট্টা সব মহারথীরা। আর এই ইস্যু নিয়েই এখন ব্যস্ত সব রাজনৈতিক দল।
পাথর কোয়ারী খুলে দেয়ার দাবিতে হঠাৎ করেই এক হয়ে যায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং এন সি পি।
গত বুধবার পাথর সংশ্লিষ্টদের সাথে আদালত চত্বরে এক সমাবেশে সাবেক মেয়র ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী সিলেটের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়েন। অন্যদিকে বৃহস্পতিবার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা জামায়াতে ইসলাম পাথর কোয়ারি খুলে দেয়ার দাবিতে প্রকাশ্যে আসে। দলটি এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এগুলো খুলে দেয়ার দাবি জানায়। অন্যদিকে আরিফুল হক চৌধুরী ডিসির অপসারণ দাবি করে শনিবার থেকে লাগাতার আন্দোলনের হুমকি দেন।
বুধবার সকালে সমাবেশে ডিসি মুরাদকে প্রশাসনিকভাবে ‘অদক্ষ ও ব্যর্থ’ আখ্যা দিয়ে করে তার প্রত্যাহার দাবি করেন আরিফ।
ওই সমাবেশে পাথর কোয়ারি খুলে দেয়া, স্টোন ক্রাশার মিলের বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধসহ আরিফ বিভিন্ন দাবি জানালেও নিজের বক্তৃতার বেশিরভাগ অংশজুড়ে আরিফ মূলত ডিসির প্রতি বিষেদগার করেন।
এরপর থেকেই নগরজুড়ে প্রশ্ন ওঠেছে ডিসির প্রতি কেন এতো ক্ষোভ আরিফের।
আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, "জেলা প্রশাসক, আমাদের মধ্যে বিভাজন করার পায়তারা যেটা করছেন, দু’একজন নেতাকে বশ করে আপনি মনে করবেন না পার পেয়ে যাবেন। আমাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যারা যাবে তারা জেলা প্রশাসকের দালাল হিসেবে চিহ্নিত হবে।"
তিনি বলেন, "এই জেলা প্রশাসক বর্তমান অন্তবর্তী সরকারকে বিব্রত করার জন্য কাজ করছেন। জনগনকে সরকারের বিরুদ্ধে দাড় করাচ্ছেন। আর না হলে এসব কাজ (স্টোন ক্রাশার মিল ও কিছু স্থাপনার বিরুদ্ধে অভিযান) করার আগে প্রত্যকটা রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে বসতেন। তাদের পরামর্শ নিতেন।"
আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, এই যে জালালাবাদ অন্ধ কল্যান হাসপাতালের মার্কেট গুড়িয়ে দেওয়া হলো এটির অনুমোদন তো উনার মতোই একজন জেলা প্রশাসক দিয়েছিলেন।"
তিনি আরও বলেন, "আপনি বলেন, আপনি আমাদের লোক। কিসের আপনি আমাদের লোক। আপনি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। আপনি চোখ রাঙিয়ে জনগনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। আপনাকে সাবধান করে বলে দিতে চাই, সিলেটের মানুষকে অপমান করবেন না।"
গত ১৭ বছর সিলেটে লুটপাট হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, "বিগত ১৭ বছর অবৈধ চোরাচালান, পাথর তোলা-বালু তোলা ছিলো। তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিয়েছেন। জেলা প্রশাসক জবাব দিতে হবে। ১৭ বছর যারা লুটপাট করেছে তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিয়েছেন তার সঠিক উত্তর দিতে হবে। ...আজকে শুধু বলে গেলাম। ৫ তারিখের পরে কিন্তু তুমি জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আর কোন আলোচনা হবে না। এই জেলা প্রশাসককে প্রত্যাহার করা না হলে ৫ তারিখের পরে আরও কঠোর আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে।"
‘জেলা প্রশাসক নাকি বলে, আরিফুল হক এখন আর জপ্রিতিনিধি নয়’ এমনটি উল্লেখ করে সাবেক এই মেয়র বলেন, ‘সিলেটের মানুষ দশ বছর আমাকে জনপ্রতিনিধি করেছেন। তুমি জেলা প্রশাসক, কোথাকার কি, তোমার মতো কয়েকজন জেলা প্রশাসক তো আমার আন্ডারে কাজ করেছেন। কথাবার্তা সাবধান করে বলবা। জনপ্রতিনিধি কে আছেন কে নাই, এটা তোমার নির্ধারণ করার কথা না।’
ডিসি পাথর–সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে বুধবার এক সভা ডাকেন জানিয়ে আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, তবে পাথর–সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী কিংবা পরিবহনশ্রমিক নেতা, কেউ তার বৈঠকে যাননি। নির্যাতন–নিষ্পেষণ করার পর ডিসি বলছেন, এখন এসো। তাই সবাই ঘৃণাভরে এ বৈঠক প্রত্যাখ্যান করেছেন।
এদিকে স্থানীয় বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, ডিসির সঙ্গে ‘কিছু বিষয় নিয়ে’ আরিফুল হক চৌধুরীর মনোমালিন্য ও দূরত্ব চলছে। এখন ইজারা বন্ধ থাকা সিলেটের পাথরকোয়ারি চালুর দাবিতে পাথর–সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সাম্প্রতিক আন্দোলন এবং মেজরটিলা এলাকায় উচ্ছেদের শিকার ব্যবসায়ীদের ক্ষুব্ধতার সুযোগে আরিফুল হক ‘জেলা প্রশাসক হটাও’ কর্মসূচিতে নেমেছেন।
এ ব্যাপারে মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী বলেন, ‘আরিফুল হক চৌধুরীর জেলা প্রশাসক হটাও কর্মসূচির সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এটা একান্তই তাঁর নিজস্ব কর্মসূচি। তবে সিলেটে একটা অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে।’
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের পাথরকোয়ারিগুলো ইজারা দিয়ে এবং পাথর ভাঙার যন্ত্রের বিদ্যুৎ-সংযোগ আবার চালুর দাবিতে সম্প্রতি পাথর–সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-শ্রমিকেরা কর্মবিরতি, পরিবহন বন্ধ রাখাসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন। এমন পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে রাজনৈতিক নেতা, পাথর–সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে বসেন ডিসি। সেই বৈঠকে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী, মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, জেলা জামায়াতের আমির হাবিবুর রহমান ও সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন, মহানগর জামায়াতের আমির মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম ও সেক্রেটারি মো. শাহজাহান আলীসহ পাথর–সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও শ্রমিক প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
তবে ওই বৈঠকে আরিফুল হক চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে জানা গেছে।
আরিফুল হক চৌধুরীর অভিযোগ সত্য নয় দাবি করে ডিসি মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতেই পাথর ভাঙার যন্ত্রের বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। এ ছাড়া সিলেট-তামাবিল আঞ্চলিক মহাসড়ক প্রশস্তকরণকাজের অংশ হিসেবে সড়ক ও জনপথ (সওজ) তাদের জায়গায় গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নেমেছে। সরকারি কর্মকর্তারা তাঁদের কাজের অংশ হিসেবেই এখানে দায়িত্ব পালন করছেন। এখন হঠাৎ করে আমার অপসারণ চেয়ে এমন কর্মসূচি পালন করার বিষয়টি একেবারেই দুঃখজনক।’
সমাবেশ থেকে আরিফুল হক এ কর্মসূচিকে শ্রমিক, মালিক ও ব্যবসায়ীদের অধিকার আদায়ের কর্মসূচি বলে ঘোষণা দেন। কর্মসূচিতে স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গ–সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের পাশাপাশি পরিবহন শ্রমিকনেতারাও যোগ দেন।
সমাবেশে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ছাড়াও কেন্দ্রীয় বিএনপির ক্ষুদ্রঋণ–বিষয়ক সহসম্পাদক আবদুর রাজ্জাক, জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইশতিয়াক আহমদ চৌধুরী, মহানগর বিএনপির সহসভাপতি সাদিকুর রহমান, জেলা সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি হাজী ময়নুল ইসলাম, জেলা সড়ক পরিবহন বাস মিনিবাস কোচ মালিক সমিতির সভাপতি হাজী আবদুর রহিম, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সহসম্পাদক মো. আবদুস সালাম, জেলা শ্রমিক দলের সদস্যসচিব নুরুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সমাবেশ থেকে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকনেতারা আগামী শুক্রবারের মধ্যে সিলেটের ডিসিকে অপসারণ না করলে শনিবার থেকে সিলেটের সব সড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেন।
পাথর কোয়ারিসমূহ খুলে দিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ডলারের অপচয় বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা জামায়াত। সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সিলেট অঞ্চলে বৃহৎ উপার্জন ক্ষেত্র পাথর কোয়ারিগুলো বন্ধ থাকায় লাখো মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। মানবিক বিপর্যয় এড়াতে ও দেশের অর্থনীতির স্বার্থে সিলেটের পাথর কোয়ারীগুলো দ্রুত খুলে দেয়ার আহবান জানানো হয়। বৃহস্পতিবার সিলেট প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা ফয়জুর রহমান।
জামায়াত নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, জুলাই বিপ্লবের পর দেশ থেকে ফ্যাসিবাদ দূর হলে আমরা আশাবাদী ছিলাম সরকার হয়তো নিয়মতান্ত্রিক ও পরিবেশ সম্মতভাবে পাথর আহরনণের সুযোগ করে দেবেন। যথারীতি সরকারের পক্ষ থেকে পাথর কোয়ারী থেকে অর্পিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, স¤প্রতি প্রশাসনের পক্ষ থেকে টাস্কফোর্স দিয়ে পাথর কোয়ারী বন্ধ ও স্টোন ক্রাশার মেশিন উচ্ছেদ এবং ওইসব মেশিনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। প্রশাসন কর্তৃক আকস্মিক এ পদক্ষেপের ফলে পাখর সংশ্লিষ্ট জীবিকায় সম্পৃক্তরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
বিগত প্রতিটি সরকারের আমলে সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের কথা বলে ধ্বংসের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) -এর সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক এডভোকেট শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের কথা বলে ব্যবসায়ীরা কখনো তা করেননি। যখন যন্ত্রের মাধ্যমে পাথর উত্তোলন শুরু হলো এবং একের পর এক গর্তে প্রাণহানি এবং ভূখণ্ড বিলীন হচ্ছিল তখনই সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ বিষয় নিয়ে পক্ষে- বিপক্ষে অনেকগুলো মামলা রয়েছে। সবগুলো মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ রায় পেয়েছেন। বর্তমানে হঠাৎ করে পাথর ব্যবসায়ী বা একসাথে অন্যরা কেন আন্দোলন করছেন তা বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, যেহেতু এসব নিয়ে অনেকগুলো মামলা বেচারা দিন তাই সিদ্ধান্ত দেয়ার আদালতের।
সম্প্রতি পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মোঃ ফাওজুল কবির খান জাফলং সফরে গেলে পাথর ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদের তোপের মুখে পড়েন। এরপরই সরকার থেকে কঠোর নির্দেশনা আসে। এই নির্দেশনার পরেই জেলা প্রশাসন পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টরা পাথর কেয়ারী এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা স্টোন ক্রাশার মেশিন উচ্ছেদ এবং বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন কার্যক্রম শুরু হয়।
এদিকে গত বুধবার পাথর ব্যবসায়ীরা আন্দোলনের নামে কোম্পানীগঞ্জে পর্যটকদের গাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় দুজনকে আটক করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫
সিলেটে পাথর কোয়ারী নিয়ন্ত্রণ নিতে সব রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য এক। দখল নিতে হবে টাকার খনির। দল আলাদা, আদর্শ আলাদা, প্যাড আলাদা কিন্তু; দাবি এক। পরিবেশ ধ্বংস হলেও পাথরের খনি আসতে হবে নিজ দখলে। বিবৃতি দিয়ে নয়, আন্দোলনের ময়দানে একাট্টা সব মহারথীরা। আর এই ইস্যু নিয়েই এখন ব্যস্ত সব রাজনৈতিক দল।
পাথর কোয়ারী খুলে দেয়ার দাবিতে হঠাৎ করেই এক হয়ে যায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং এন সি পি।
গত বুধবার পাথর সংশ্লিষ্টদের সাথে আদালত চত্বরে এক সমাবেশে সাবেক মেয়র ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী সিলেটের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়েন। অন্যদিকে বৃহস্পতিবার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা জামায়াতে ইসলাম পাথর কোয়ারি খুলে দেয়ার দাবিতে প্রকাশ্যে আসে। দলটি এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এগুলো খুলে দেয়ার দাবি জানায়। অন্যদিকে আরিফুল হক চৌধুরী ডিসির অপসারণ দাবি করে শনিবার থেকে লাগাতার আন্দোলনের হুমকি দেন।
বুধবার সকালে সমাবেশে ডিসি মুরাদকে প্রশাসনিকভাবে ‘অদক্ষ ও ব্যর্থ’ আখ্যা দিয়ে করে তার প্রত্যাহার দাবি করেন আরিফ।
ওই সমাবেশে পাথর কোয়ারি খুলে দেয়া, স্টোন ক্রাশার মিলের বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধসহ আরিফ বিভিন্ন দাবি জানালেও নিজের বক্তৃতার বেশিরভাগ অংশজুড়ে আরিফ মূলত ডিসির প্রতি বিষেদগার করেন।
এরপর থেকেই নগরজুড়ে প্রশ্ন ওঠেছে ডিসির প্রতি কেন এতো ক্ষোভ আরিফের।
আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, "জেলা প্রশাসক, আমাদের মধ্যে বিভাজন করার পায়তারা যেটা করছেন, দু’একজন নেতাকে বশ করে আপনি মনে করবেন না পার পেয়ে যাবেন। আমাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যারা যাবে তারা জেলা প্রশাসকের দালাল হিসেবে চিহ্নিত হবে।"
তিনি বলেন, "এই জেলা প্রশাসক বর্তমান অন্তবর্তী সরকারকে বিব্রত করার জন্য কাজ করছেন। জনগনকে সরকারের বিরুদ্ধে দাড় করাচ্ছেন। আর না হলে এসব কাজ (স্টোন ক্রাশার মিল ও কিছু স্থাপনার বিরুদ্ধে অভিযান) করার আগে প্রত্যকটা রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে বসতেন। তাদের পরামর্শ নিতেন।"
আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, এই যে জালালাবাদ অন্ধ কল্যান হাসপাতালের মার্কেট গুড়িয়ে দেওয়া হলো এটির অনুমোদন তো উনার মতোই একজন জেলা প্রশাসক দিয়েছিলেন।"
তিনি আরও বলেন, "আপনি বলেন, আপনি আমাদের লোক। কিসের আপনি আমাদের লোক। আপনি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। আপনি চোখ রাঙিয়ে জনগনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না। আপনাকে সাবধান করে বলে দিতে চাই, সিলেটের মানুষকে অপমান করবেন না।"
গত ১৭ বছর সিলেটে লুটপাট হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, "বিগত ১৭ বছর অবৈধ চোরাচালান, পাথর তোলা-বালু তোলা ছিলো। তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিয়েছেন। জেলা প্রশাসক জবাব দিতে হবে। ১৭ বছর যারা লুটপাট করেছে তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিয়েছেন তার সঠিক উত্তর দিতে হবে। ...আজকে শুধু বলে গেলাম। ৫ তারিখের পরে কিন্তু তুমি জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আর কোন আলোচনা হবে না। এই জেলা প্রশাসককে প্রত্যাহার করা না হলে ৫ তারিখের পরে আরও কঠোর আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে।"
‘জেলা প্রশাসক নাকি বলে, আরিফুল হক এখন আর জপ্রিতিনিধি নয়’ এমনটি উল্লেখ করে সাবেক এই মেয়র বলেন, ‘সিলেটের মানুষ দশ বছর আমাকে জনপ্রতিনিধি করেছেন। তুমি জেলা প্রশাসক, কোথাকার কি, তোমার মতো কয়েকজন জেলা প্রশাসক তো আমার আন্ডারে কাজ করেছেন। কথাবার্তা সাবধান করে বলবা। জনপ্রতিনিধি কে আছেন কে নাই, এটা তোমার নির্ধারণ করার কথা না।’
ডিসি পাথর–সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে বুধবার এক সভা ডাকেন জানিয়ে আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, তবে পাথর–সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী কিংবা পরিবহনশ্রমিক নেতা, কেউ তার বৈঠকে যাননি। নির্যাতন–নিষ্পেষণ করার পর ডিসি বলছেন, এখন এসো। তাই সবাই ঘৃণাভরে এ বৈঠক প্রত্যাখ্যান করেছেন।
এদিকে স্থানীয় বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, ডিসির সঙ্গে ‘কিছু বিষয় নিয়ে’ আরিফুল হক চৌধুরীর মনোমালিন্য ও দূরত্ব চলছে। এখন ইজারা বন্ধ থাকা সিলেটের পাথরকোয়ারি চালুর দাবিতে পাথর–সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সাম্প্রতিক আন্দোলন এবং মেজরটিলা এলাকায় উচ্ছেদের শিকার ব্যবসায়ীদের ক্ষুব্ধতার সুযোগে আরিফুল হক ‘জেলা প্রশাসক হটাও’ কর্মসূচিতে নেমেছেন।
এ ব্যাপারে মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী বলেন, ‘আরিফুল হক চৌধুরীর জেলা প্রশাসক হটাও কর্মসূচির সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এটা একান্তই তাঁর নিজস্ব কর্মসূচি। তবে সিলেটে একটা অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে।’
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের পাথরকোয়ারিগুলো ইজারা দিয়ে এবং পাথর ভাঙার যন্ত্রের বিদ্যুৎ-সংযোগ আবার চালুর দাবিতে সম্প্রতি পাথর–সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-শ্রমিকেরা কর্মবিরতি, পরিবহন বন্ধ রাখাসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন। এমন পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে রাজনৈতিক নেতা, পাথর–সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে বসেন ডিসি। সেই বৈঠকে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী, মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, জেলা জামায়াতের আমির হাবিবুর রহমান ও সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন, মহানগর জামায়াতের আমির মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম ও সেক্রেটারি মো. শাহজাহান আলীসহ পাথর–সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও শ্রমিক প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
তবে ওই বৈঠকে আরিফুল হক চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে জানা গেছে।
আরিফুল হক চৌধুরীর অভিযোগ সত্য নয় দাবি করে ডিসি মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতেই পাথর ভাঙার যন্ত্রের বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। এ ছাড়া সিলেট-তামাবিল আঞ্চলিক মহাসড়ক প্রশস্তকরণকাজের অংশ হিসেবে সড়ক ও জনপথ (সওজ) তাদের জায়গায় গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নেমেছে। সরকারি কর্মকর্তারা তাঁদের কাজের অংশ হিসেবেই এখানে দায়িত্ব পালন করছেন। এখন হঠাৎ করে আমার অপসারণ চেয়ে এমন কর্মসূচি পালন করার বিষয়টি একেবারেই দুঃখজনক।’
সমাবেশ থেকে আরিফুল হক এ কর্মসূচিকে শ্রমিক, মালিক ও ব্যবসায়ীদের অধিকার আদায়ের কর্মসূচি বলে ঘোষণা দেন। কর্মসূচিতে স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গ–সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের পাশাপাশি পরিবহন শ্রমিকনেতারাও যোগ দেন।
সমাবেশে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ছাড়াও কেন্দ্রীয় বিএনপির ক্ষুদ্রঋণ–বিষয়ক সহসম্পাদক আবদুর রাজ্জাক, জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইশতিয়াক আহমদ চৌধুরী, মহানগর বিএনপির সহসভাপতি সাদিকুর রহমান, জেলা সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি হাজী ময়নুল ইসলাম, জেলা সড়ক পরিবহন বাস মিনিবাস কোচ মালিক সমিতির সভাপতি হাজী আবদুর রহিম, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সহসম্পাদক মো. আবদুস সালাম, জেলা শ্রমিক দলের সদস্যসচিব নুরুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সমাবেশ থেকে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকনেতারা আগামী শুক্রবারের মধ্যে সিলেটের ডিসিকে অপসারণ না করলে শনিবার থেকে সিলেটের সব সড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেন।
পাথর কোয়ারিসমূহ খুলে দিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ডলারের অপচয় বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা জামায়াত। সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সিলেট অঞ্চলে বৃহৎ উপার্জন ক্ষেত্র পাথর কোয়ারিগুলো বন্ধ থাকায় লাখো মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। মানবিক বিপর্যয় এড়াতে ও দেশের অর্থনীতির স্বার্থে সিলেটের পাথর কোয়ারীগুলো দ্রুত খুলে দেয়ার আহবান জানানো হয়। বৃহস্পতিবার সিলেট প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা ফয়জুর রহমান।
জামায়াত নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, জুলাই বিপ্লবের পর দেশ থেকে ফ্যাসিবাদ দূর হলে আমরা আশাবাদী ছিলাম সরকার হয়তো নিয়মতান্ত্রিক ও পরিবেশ সম্মতভাবে পাথর আহরনণের সুযোগ করে দেবেন। যথারীতি সরকারের পক্ষ থেকে পাথর কোয়ারী থেকে অর্পিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, স¤প্রতি প্রশাসনের পক্ষ থেকে টাস্কফোর্স দিয়ে পাথর কোয়ারী বন্ধ ও স্টোন ক্রাশার মেশিন উচ্ছেদ এবং ওইসব মেশিনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। প্রশাসন কর্তৃক আকস্মিক এ পদক্ষেপের ফলে পাখর সংশ্লিষ্ট জীবিকায় সম্পৃক্তরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
বিগত প্রতিটি সরকারের আমলে সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের কথা বলে ধ্বংসের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) -এর সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক এডভোকেট শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের কথা বলে ব্যবসায়ীরা কখনো তা করেননি। যখন যন্ত্রের মাধ্যমে পাথর উত্তোলন শুরু হলো এবং একের পর এক গর্তে প্রাণহানি এবং ভূখণ্ড বিলীন হচ্ছিল তখনই সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ বিষয় নিয়ে পক্ষে- বিপক্ষে অনেকগুলো মামলা রয়েছে। সবগুলো মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ রায় পেয়েছেন। বর্তমানে হঠাৎ করে পাথর ব্যবসায়ী বা একসাথে অন্যরা কেন আন্দোলন করছেন তা বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, যেহেতু এসব নিয়ে অনেকগুলো মামলা বেচারা দিন তাই সিদ্ধান্ত দেয়ার আদালতের।
সম্প্রতি পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মোঃ ফাওজুল কবির খান জাফলং সফরে গেলে পাথর ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদের তোপের মুখে পড়েন। এরপরই সরকার থেকে কঠোর নির্দেশনা আসে। এই নির্দেশনার পরেই জেলা প্রশাসন পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টরা পাথর কেয়ারী এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা স্টোন ক্রাশার মেশিন উচ্ছেদ এবং বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন কার্যক্রম শুরু হয়।
এদিকে গত বুধবার পাথর ব্যবসায়ীরা আন্দোলনের নামে কোম্পানীগঞ্জে পর্যটকদের গাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় দুজনকে আটক করেছে পুলিশ।