সিরাজগঞ্জ : হারিয়ে যাচ্ছে এক সময়ের জনপ্রিয় খাদ্যশস্য কাউন -সংবাদ
সিরাজগঞ্জে কাউনের আবাদ হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময় যমুনার চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকভাবে কাউনের আবাদ হতো। কালের আবর্তে এই পুষ্টিকর খাদ্যশস্য কাউন আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কৃষিজীবী মানুষের খাবারের অংশ হয়ে থাকা এই শস্য এখন আর চরাঞ্চলের মাঠে আগের মতো দেখা যায় না। জেলার প্রত্যন্ত চরের কৃষকরা কাউন চাষ ছেড়ে ঝুঁকছেন বেশি লাভজনক ও উচ্চ ফলনের ফসলের দিকে।
সিরাজগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় কাউনের চাষ নেমে এসেছে মাত্র ১২০ হেক্টর জমিতে। এক সময় যে চরভূমিতে সোনালি কাউনের ঢেউ উঠত, সেখানে এখন চাষ হচ্ছে ধান, মরিচ, ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়াসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক ফসল। কাউন বা ফক্সটেল মিলেট শুষ্ক সহনশীল ও কম খরচের একটি শস্য। বন্যা বা দুর্ভিক্ষের সময়গুলোতে চরবাসীর ভরসা ছিল এই কাউন। ধানের চেয়ে অনেক কম পানি ও সার লাগে বলে দরিদ্র কৃষকরা সহজে এটি চাষ করতেন এবং ভাতের বিকল্প খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতেন। তবে সময় বদলেছে। এখনকার কৃষকেরা ভাবেন লাভের কথা।
কাউনে লাভ নেই বলে জানান চরগিরিশের কৃষক নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘গতবছর তিন বিঘায় চাষ করেছিলাম, এবার করেছি এক বিঘায়। প্রতিবিঘা থেকে চার থেকে ছয় মণ কাউন পাওয়া যায়। প্রতি মণ বিক্রি হয় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায়, কিন্তু খরচ পড়ে আড়াই হাজার টাকা। হিসাব মেলে না।’ বাড়তি উৎপাদন খরচ, শ্রমিক সংকট আর ভোক্তার রুচির পরিবর্তনে কাউন আজ অতীতের স্মৃতি হওয়ার পথে। অনেকেই মনে করেন, এই শস্য আর যুগের সঙ্গে খাপ খায় না।
কাজিপুর উপজেলার চরাঞ্চলের মনসুর নগর ইউনিয়নের চরছিন্না গ্রামের কৃষক সোলায়মান হোসেন বলেন, ‘আগে বন্যার কারণে ধান হতো না, তখন কাউনই ছিল ভাত। এখন হাইব্রিড ধান করি, ভুট্টাও হয় ভালো। কেউ আর কাউন খায় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এক সময় আমরা কাউনের ভাত খেতাম নিয়মিত, শরীরে শক্তিও পেতাম। এখন সেই স্বাদই ভুলে গেছি।’ মানুষ না খেলেও, এই শস্য এখন পাখির খাবার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
নাটুয়ারপাড়া হাটের ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষকের কাছ থেকে কাউন কিনে আমি ঢাকার পাখির বাজারে পাঠাই। এখন পাখিপ্রেমীরাই কাউনের বড় ক্রেতা।’ তার মতে, এক সময়ের নিত্যপ্রয়োজনীয় শস্য আজ সংস্কৃতি ও অর্থনীতির দিক থেকে পরিণত হয়েছে এক প্রান্তিক পণ্যে।
কাজিপুর উপজেলার চরগিরিশ ইউনিয়নের দ্বায়িত্ব প্রাপ্তি উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, বর্তমান ধারায় পরিবর্তন না এলে এক দশকের মধ্যেই চরাঞ্চল থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে কাউন। এটি শুধু ফসলচক্রের পরিবর্তন নয়, বরং একটি গ্রামীণ খাদ্য ঐতিহ্যের অবক্ষয়। কাজিপুর উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ শরিফুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে কাউনের মতো খরাসহনশীল ও কম খরচের ফসল অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু সরকারি উদ্যোগ ও বাজার উৎসাহ না থাকলে চাষিরা এই ফসল টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী হবেন না।
এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আ. জা. মু আহসান শহীদ সরকার জানান, এ বছর জেলায় ১২০ হেক্টর জমিতে কাউনের চাষ হয়েছে । তিনি বলেন এক সময় চরসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় কাউনের চাষ হতো। কিন্তু বর্তমানে কৃষি আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিকীকরণের ফলে জেলার প্রত্যন্ত চরের কৃষকরা কাউন চাষ ছেড়ে ঝুঁকছেন বেশি লাভজনক ও উচ্চ ফলনের ফসলের আবাদের দিকে।
সিরাজগঞ্জ : হারিয়ে যাচ্ছে এক সময়ের জনপ্রিয় খাদ্যশস্য কাউন -সংবাদ
মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫
সিরাজগঞ্জে কাউনের আবাদ হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময় যমুনার চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকভাবে কাউনের আবাদ হতো। কালের আবর্তে এই পুষ্টিকর খাদ্যশস্য কাউন আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কৃষিজীবী মানুষের খাবারের অংশ হয়ে থাকা এই শস্য এখন আর চরাঞ্চলের মাঠে আগের মতো দেখা যায় না। জেলার প্রত্যন্ত চরের কৃষকরা কাউন চাষ ছেড়ে ঝুঁকছেন বেশি লাভজনক ও উচ্চ ফলনের ফসলের দিকে।
সিরাজগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় কাউনের চাষ নেমে এসেছে মাত্র ১২০ হেক্টর জমিতে। এক সময় যে চরভূমিতে সোনালি কাউনের ঢেউ উঠত, সেখানে এখন চাষ হচ্ছে ধান, মরিচ, ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়াসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক ফসল। কাউন বা ফক্সটেল মিলেট শুষ্ক সহনশীল ও কম খরচের একটি শস্য। বন্যা বা দুর্ভিক্ষের সময়গুলোতে চরবাসীর ভরসা ছিল এই কাউন। ধানের চেয়ে অনেক কম পানি ও সার লাগে বলে দরিদ্র কৃষকরা সহজে এটি চাষ করতেন এবং ভাতের বিকল্প খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতেন। তবে সময় বদলেছে। এখনকার কৃষকেরা ভাবেন লাভের কথা।
কাউনে লাভ নেই বলে জানান চরগিরিশের কৃষক নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘গতবছর তিন বিঘায় চাষ করেছিলাম, এবার করেছি এক বিঘায়। প্রতিবিঘা থেকে চার থেকে ছয় মণ কাউন পাওয়া যায়। প্রতি মণ বিক্রি হয় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায়, কিন্তু খরচ পড়ে আড়াই হাজার টাকা। হিসাব মেলে না।’ বাড়তি উৎপাদন খরচ, শ্রমিক সংকট আর ভোক্তার রুচির পরিবর্তনে কাউন আজ অতীতের স্মৃতি হওয়ার পথে। অনেকেই মনে করেন, এই শস্য আর যুগের সঙ্গে খাপ খায় না।
কাজিপুর উপজেলার চরাঞ্চলের মনসুর নগর ইউনিয়নের চরছিন্না গ্রামের কৃষক সোলায়মান হোসেন বলেন, ‘আগে বন্যার কারণে ধান হতো না, তখন কাউনই ছিল ভাত। এখন হাইব্রিড ধান করি, ভুট্টাও হয় ভালো। কেউ আর কাউন খায় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এক সময় আমরা কাউনের ভাত খেতাম নিয়মিত, শরীরে শক্তিও পেতাম। এখন সেই স্বাদই ভুলে গেছি।’ মানুষ না খেলেও, এই শস্য এখন পাখির খাবার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
নাটুয়ারপাড়া হাটের ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষকের কাছ থেকে কাউন কিনে আমি ঢাকার পাখির বাজারে পাঠাই। এখন পাখিপ্রেমীরাই কাউনের বড় ক্রেতা।’ তার মতে, এক সময়ের নিত্যপ্রয়োজনীয় শস্য আজ সংস্কৃতি ও অর্থনীতির দিক থেকে পরিণত হয়েছে এক প্রান্তিক পণ্যে।
কাজিপুর উপজেলার চরগিরিশ ইউনিয়নের দ্বায়িত্ব প্রাপ্তি উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, বর্তমান ধারায় পরিবর্তন না এলে এক দশকের মধ্যেই চরাঞ্চল থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে কাউন। এটি শুধু ফসলচক্রের পরিবর্তন নয়, বরং একটি গ্রামীণ খাদ্য ঐতিহ্যের অবক্ষয়। কাজিপুর উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ শরিফুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে কাউনের মতো খরাসহনশীল ও কম খরচের ফসল অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু সরকারি উদ্যোগ ও বাজার উৎসাহ না থাকলে চাষিরা এই ফসল টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী হবেন না।
এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আ. জা. মু আহসান শহীদ সরকার জানান, এ বছর জেলায় ১২০ হেক্টর জমিতে কাউনের চাষ হয়েছে । তিনি বলেন এক সময় চরসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় কাউনের চাষ হতো। কিন্তু বর্তমানে কৃষি আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিকীকরণের ফলে জেলার প্রত্যন্ত চরের কৃষকরা কাউন চাষ ছেড়ে ঝুঁকছেন বেশি লাভজনক ও উচ্চ ফলনের ফসলের আবাদের দিকে।