alt

জীবনযুদ্ধে অদম্য প্রতিবন্ধী কাজল রেখা

আফতাব হোসেন, গাইবান্ধা : রোববার, ১৩ জুলাই ২০২৫

গাইবান্ধা : বাড়ির আঙিনায় হুইল চেয়ারে কাজল রেখা -সংবাদ

কাজল রেখা। শারিরীক প্রতিবন্ধিতা পেছনে ফেলে এলাকায় হয়ে উঠেছেন হাজারের মানুষের আশার অবলম্বন। তবে, নিজের ইচ্ছে শক্তি, জ্ঞান ও দক্ষতায় প্রতিবন্ধিতা জয় করে এখন নিজের কাজল রেখা শুধু নিজ এলাকাতেই না দেশ ও বিদেশেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ে সাহসী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে অনুকরণীয় হয়ে উঠেছেন। তার বেড়েছে আত্মপ্রত্যয়ী ও সম্মান।

দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা ছয় ভাই আর তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট সে। জন্ম ১৯৮৫ সালে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর লাহিরী খামার গ্রামে। গ্রামীণ পরিবেশে আর দশজন কিশোরীর এত স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে ওঠে কাজল রেখা। এসএসসি পাশও করে কিন্তু এরপর একটি দুর্ঘটনা কাজল রেখার জীবনকে আটকে দেয় প্রতিবন্ধকতায় বেড়াজলে। ১১ সদস্যের সংসারের অভাব অনটন থাকলেও কাজল রেখার বাবা আবুল কাশেম মিয়ার স্বপ্ন ছিল অন্তত ছোট মেয়েকে (কাজল রেখা) সাধ্য এতো পড়াশোনা করানোর। কিন্তু যখন কাজল রেখা ৯ম শ্রেণিতে পড়ে তখন বাবা আবুল কাশেমের মৃত্যু হলে পড়ালেখার স্বপ্নে অনেকটাই থমকে যায়। দুবছর পর ২০০১ সালে এসএসসি পরীক্ষার সময় মৃত্যু হয় মা খোদেজা বেগমের। আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়েন কাজল রেখা।

এরপর কাজল রেখার দায়িত্ব পড়ে বড় ভাইদের উপর। ২০০২ সালে বিয়ে দেন সদর উপজেলার উত্তর গিদারীতে। পড়ালেখার স্বপ্ন শেষ হয় এখানে। তবে, কাজল রেখার বিয়ের পর স্বামীর বাড়িটিকেই আপন করে নেন। কিন্তু সেই আপন বাড়িটি বেশিদিন আপন থাকেনি।

মাস দশেক সংসার করার পর গৃহাস্থালী কাজ হিসাবে মই দিয়ে সীম পাড়ার সময় পড়ে গিয়ে পিঠের হার ভেঙে যায়। স্বামী-শ্বশুর বাড়ির লোকজন মাসখানেক চিকিৎসা করে কাজল রেখাকে ভাই এর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।

কিছুদিন বড় ভাই ভাবীরা গ্রাম্য চিকিৎসক ও পরে রংপুরে চিকিৎসা করালেও সুস্থ হয়ে ওঠতে পারেনি। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর এত সক্ষমতা ফিরে পান না কাজল রেখা। এই একটি ছোট দুর্ঘটনা কিছু সময়ের জন্য জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়।

ভাই-ভাবির অভাবের সংসারের কাজল রেখার ভাইয়েরা চারটি টিন দিয়ে ছাপড়া ঘর তুলে ঠাঁই দেয়া বাড়ির বাহিরে। কিভাবে জীবন বাঁচিয়ে রাখবেন এ নিয়ে চোখে মুখে অন্ধকার দেখেন এই কিশোরী।

এভাবেই একটি ঘরে আবদ্ধ অবস্থায় কাটে ছয়টি বছর। ২০০৯ সালে তার সন্ধান পায় বেসরকারি একটি সংস্থা। প্রথমে তাকে একটি হুইল চেয়ার দিতে চাইলে সে তা নিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে অবশ্য পরিবারের অন্য সদস্য ও এনজিও কথায় রাজী হয়ে হুইল চেয়ারটি গ্রহণ করে ঘরের বাহিরে বের হয়। এ সময় এনজিওটির পক্ষ থেকে তাকে সেলাই মেশিন চালানোর উপর ৩মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে একটি সেলাই মেশিন প্রদান করে। আর তার এই প্রশিক্ষণই জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন উজ্জ্বীবিত করে তাকে। হুইল চেয়ারে বসেই সে বাড়িতে জামা কাপড় সেলাই করতে থাকে। এতে করে সে নিজের উপার্জন থেকে খাবার ও প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটার পথ খুঁজে পান।

ইতোমধ্যে সে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসাবে সমাজসেবা অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত হন। এরপর আর তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। প্রচ- ইচ্ছে শক্তির কারণে আর কিছুটা পড়ালেখা জানার কারণে বেশ কিছু প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন কাজল রেখা। নিজের সমস্যা উপলব্দি করে সব প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সমস্যা করার ক্ষমতা অর্জন করেন তিনি।

এ ছাড়া নারী হিসাবে এবং দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় নারীদের যে অবস্থা হয় এগুলোও নিয়ে তিনি কথা বলেন বিভিন্ন সভা সেমিনারে।

প্রতিবেশী সোহেল রানা জানান, কাজল রেখা এলাকার অসহায় মানুষের অবলম্বন। তার কাছে এখন সবাই সহযোগিতা ও পরামর্শ নিতে আসেন।

এই গ্রামের সাবিনা ইয়াসমিন বলেন কাজল রেখা প্রতিবন্ধিতা শিকার হয়ে কতই না কষ্ট করেছে, কিন্তু সেই কষ্ট এখন আর নেই। নিজের ইচ্ছে শক্তি ও পরিশ্রমে জীবনে সফলতা এনেছেন।

বেসরকারি সংস্থা সিডিডি ও গণউন্নয়ন কেন্দ্র এর মাধ্যমে ২০১১ সালে প্রথমে ইন্দোনেশিয়া যাওয়া সুযোগ হয় তার। এরপর জাপান, সুইজারল্যান্ড, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুরসহ ৭টি দেশে আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারে যাওয়ার সুযোগ হয় তার।

এসব দেশে তিনি বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়ে বেশ প্রশংসিত হন।

জাতীয় পর্যায়ে অসংখ্য সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। ২০২৮ সালে একটি জাতীয় সম্মেলনে বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় উঠে আসেন এই কাজল রেখা। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়ন ধারা থেকে বাদ রেখে এসডিজিও অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব না। আর এই বক্তব্যে অংশগ্রহণকারীদের টনক নড়ে। তারা বলেন, কাজল রেখা শুধু একজন গ্রামের কাজল রেখা না সে এখন সব পৃথিবীর প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার আদায়ের একজন সফল প্রতিবাদী কিশোরী নারী।

কাজল রেখা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে উপজেলা ওজলা পর্যায়ের বিভিন্ন কমিটিতে সক্রিয় সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।

প্রতিবন্ধীদের প্রবেশগম্যতায় এই কাজল রেখা এ্যাডভোকেসি করে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা অফিস ২য় তলা থেকে নীচ তলায় নিয়ে এসেছেন। নিজ ইউনিয়ন শ্রীপুর ও আশপাশের ইউনিয়ন পরিষদের বার্ষিক বাজেটে প্রতিবন্ধীদের জন্য বাজেট নিশ্চিত করেছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ অসংখ্য সাফল্য রয়েছে তার। অসংখ্য প্রতিবন্ধীদের কার্ড ও ভাতা পেতে সহায়তা করেছেন তিনি।

বাস, নৌকা, ট্রেন, দুর্যোগে আশ্রয় কেন্দ্র, হাটবাজার, অফিস আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছেন।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন কাজল রেখা। এসব পুরুস্কার অর্জনে তিনি গর্ববোধ করেন এবং সামনে এগুতে প্রেরণা দেয়। তিনি জানান, একজন প্রতিবন্ধী নারীও সুযোগ ও সহায়তা পেলে পারে জীবনের স্বনির্ভর হয়ে বাঁচতে।

তিনি মনে করেন, জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা থাকলে মানুষ তার জীবনের অবস্থার উন্নয়ন করেত পারে। তিনি জানান, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে সরকারি ও আন্তর্জাতিকভাবে যেসব পলিসি ও আইন রয়েছে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হওয়া উচিত। এ ছাড়া কিছু আইন ও পলিসি ডেভেলপ করা করার প্রস্তাবনাও রাখেন তিনি।

গাইবান্ধা জেলা সমাজসেবা অফিসের উপ-পরিচালক ফজলুল হক জানান, প্রতিবন্ধীতা একটি সমস্যা মাত্র, কিন্তু এর কারণে জীবন থেমে থাকতে পারে না। কাজল রেখা এখন মডেল। তার অবদান অনুকরণীয়।

একারণে তিনি জানান, প্রতিবন্ধীদের পেছেনে রেখে দেশের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব না, এ কারণে সব উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয়টি লক্ষ্য রেখে ডিজাইন করতে হবে। আর এসব পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়নে প্রয়োজন নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রাখা। এ কারণেই আগামী স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কাজল রেখা প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করতে চান।

ছবি

ডিমলার তিস্তায় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধের দাবি

ছবি

১০ লাখ গাছ লাগিয়ে গ্রীন চট্টগ্রাম গড়বো: মেয়র শাহাদাত

ছবি

চসিকের অভিযান: প্রায় ৩ লাখ টাকার রাজস্ব আদায়

ছবি

কুমিল্লায় যুবককে গলা কেটে হত্যা

ছবি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কালনী এক্সপ্রেসের কাপলিং হুক ভেঙে ৩ বগি বিচ্ছিন্ন

ছবি

পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার টার্মিনাল পরিচালনায় বিআইডব্লিউটিএ- চট্টগ্রাম বন্দরের সমঝোতা স্মারক সই

ছবি

বকেয়া বেতনের দাবিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক অবরোধ পোশাক শ্রমিকদের

ছবি

একদিনে ডেঙ্গুতে বছরের সর্বোচ্চ ৬ জনের মৃত্যু

ছবি

কুয়াকাটার মোকামে এক ইলিশের দাম ৮ হাজার ৮৫০ টাকা!

ছবি

সবচেয়ে বেশি বেকার ঢাকা বিভাগে, স্নাতক ডিগ্রিধারীরা শীর্ষে

ছবি

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দাবি পূরণে ১০ অক্টোবরের মধ্যে প্রজ্ঞাপন না হলে লাগাতার কর্মসূচির হুমকি

ছবি

নির্বাচনী আসন ফিরে পেতে ডাকা হরতালে বাগেরহাট সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন

ছবি

ভূমি অফিসে হয়রানির অভিযোগে ক্ষুব্ধ সেবাপ্রত্যাশীরা

ছবি

সৈয়দপুরে ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে সঞ্চয়ের ৮ লাখ টাকা লোপাটের অভিযোগ

ছবি

জাতীয়ভাবে পালিত হবে লালন তিরোধান দিবস

ছবি

পাটগ্রামে ট্রাকের চাপায় বাইক আরোহীর মৃত্যু

ছবি

সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ না থাকলে কোন সুফল আসবে না - প্রেস কাউন্সিল চেয়ারম্যান

ছবি

ফরিদপুরে রেলপথ অবরোধ, ট্রেন চলাচল বন্ধ

ছবি

ব্যাবসায়ী আলম হত্যার রহস্য উন্মোচন ছেলের হাতেই বাবা খুন

ছবি

পুত্রবধূদের সাথে ঝগড়ার জেরে শাশুড়ির রহস্যজনক মৃত্যু

ছবি

সাদ্রি: বাংলাদেশের চা-বাগানের অদৃশ্য সেতুবন্ধন

ছবি

জয়পুরহাটে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষাবৃত্তির চেক বিতরণ

ছবি

চাটখিল পোস্ট অফিস কর্মচারীদের অবহেলায় দুর্ভোগে এলাকাবাসী

ছবি

কলাপাড়ায় কন্যা শিশুদের গাছের চারা বিতরণ

ছবি

দৌলতপুরে মাকে গলা কেটে হত্যা, ছেলে পলাতক

ছবি

মহেশপুর সীমান্তে ১৩ বাংলাদেশি আটক

ছবি

পলাশের জজ মিয়া নিজেই নির্মান করে দিলেন অবহেলিত গ্রামের রাস্তাটি

ছবি

গৌরনদীতে বিনামূল্যে পিপিআর রোগের টিকা

ছবি

ফসলের খেতে ইঁদুরের হানা, দুশ্চিন্তায় কৃষক

ছবি

চান্দিনায় অতিরিক্ত ওজনের ড্রাম্প ট্রাকে ভাঙছে আঞ্চলিক সড়ক-ব্রিজ-কালভার্ট

ছবি

দোয়ারাবাজারে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে নারীর মৃত্যু ও যুবকের মরদেহ উদ্ধার

ছবি

‘প্রতি ৪ জনে ১ জন উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত’

ছবি

বেতাগিতে জামায়াত নেতার বাড়িতে তালা ভেঙে চুরি

ছবি

নরসিংদীতে তুচ্ছ ঘটনায় দুই সহোদরকে কুপিয়ে হত্যা

ছবি

নরসিংদীতে নিরাপদ অভিবাসন বিষয়ক কর্মশালা

ছবি

গাইবান্ধার চরাঞ্চলে ওয়ানস্টপ নাগরিক সেবা কেন্দ্রের উদ্বোধন

tab

news » bangladesh

জীবনযুদ্ধে অদম্য প্রতিবন্ধী কাজল রেখা

আফতাব হোসেন, গাইবান্ধা

গাইবান্ধা : বাড়ির আঙিনায় হুইল চেয়ারে কাজল রেখা -সংবাদ

রোববার, ১৩ জুলাই ২০২৫

কাজল রেখা। শারিরীক প্রতিবন্ধিতা পেছনে ফেলে এলাকায় হয়ে উঠেছেন হাজারের মানুষের আশার অবলম্বন। তবে, নিজের ইচ্ছে শক্তি, জ্ঞান ও দক্ষতায় প্রতিবন্ধিতা জয় করে এখন নিজের কাজল রেখা শুধু নিজ এলাকাতেই না দেশ ও বিদেশেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ে সাহসী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে অনুকরণীয় হয়ে উঠেছেন। তার বেড়েছে আত্মপ্রত্যয়ী ও সম্মান।

দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা ছয় ভাই আর তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট সে। জন্ম ১৯৮৫ সালে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর লাহিরী খামার গ্রামে। গ্রামীণ পরিবেশে আর দশজন কিশোরীর এত স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে ওঠে কাজল রেখা। এসএসসি পাশও করে কিন্তু এরপর একটি দুর্ঘটনা কাজল রেখার জীবনকে আটকে দেয় প্রতিবন্ধকতায় বেড়াজলে। ১১ সদস্যের সংসারের অভাব অনটন থাকলেও কাজল রেখার বাবা আবুল কাশেম মিয়ার স্বপ্ন ছিল অন্তত ছোট মেয়েকে (কাজল রেখা) সাধ্য এতো পড়াশোনা করানোর। কিন্তু যখন কাজল রেখা ৯ম শ্রেণিতে পড়ে তখন বাবা আবুল কাশেমের মৃত্যু হলে পড়ালেখার স্বপ্নে অনেকটাই থমকে যায়। দুবছর পর ২০০১ সালে এসএসসি পরীক্ষার সময় মৃত্যু হয় মা খোদেজা বেগমের। আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়েন কাজল রেখা।

এরপর কাজল রেখার দায়িত্ব পড়ে বড় ভাইদের উপর। ২০০২ সালে বিয়ে দেন সদর উপজেলার উত্তর গিদারীতে। পড়ালেখার স্বপ্ন শেষ হয় এখানে। তবে, কাজল রেখার বিয়ের পর স্বামীর বাড়িটিকেই আপন করে নেন। কিন্তু সেই আপন বাড়িটি বেশিদিন আপন থাকেনি।

মাস দশেক সংসার করার পর গৃহাস্থালী কাজ হিসাবে মই দিয়ে সীম পাড়ার সময় পড়ে গিয়ে পিঠের হার ভেঙে যায়। স্বামী-শ্বশুর বাড়ির লোকজন মাসখানেক চিকিৎসা করে কাজল রেখাকে ভাই এর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।

কিছুদিন বড় ভাই ভাবীরা গ্রাম্য চিকিৎসক ও পরে রংপুরে চিকিৎসা করালেও সুস্থ হয়ে ওঠতে পারেনি। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর এত সক্ষমতা ফিরে পান না কাজল রেখা। এই একটি ছোট দুর্ঘটনা কিছু সময়ের জন্য জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়।

ভাই-ভাবির অভাবের সংসারের কাজল রেখার ভাইয়েরা চারটি টিন দিয়ে ছাপড়া ঘর তুলে ঠাঁই দেয়া বাড়ির বাহিরে। কিভাবে জীবন বাঁচিয়ে রাখবেন এ নিয়ে চোখে মুখে অন্ধকার দেখেন এই কিশোরী।

এভাবেই একটি ঘরে আবদ্ধ অবস্থায় কাটে ছয়টি বছর। ২০০৯ সালে তার সন্ধান পায় বেসরকারি একটি সংস্থা। প্রথমে তাকে একটি হুইল চেয়ার দিতে চাইলে সে তা নিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে অবশ্য পরিবারের অন্য সদস্য ও এনজিও কথায় রাজী হয়ে হুইল চেয়ারটি গ্রহণ করে ঘরের বাহিরে বের হয়। এ সময় এনজিওটির পক্ষ থেকে তাকে সেলাই মেশিন চালানোর উপর ৩মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে একটি সেলাই মেশিন প্রদান করে। আর তার এই প্রশিক্ষণই জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন উজ্জ্বীবিত করে তাকে। হুইল চেয়ারে বসেই সে বাড়িতে জামা কাপড় সেলাই করতে থাকে। এতে করে সে নিজের উপার্জন থেকে খাবার ও প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটার পথ খুঁজে পান।

ইতোমধ্যে সে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসাবে সমাজসেবা অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত হন। এরপর আর তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। প্রচ- ইচ্ছে শক্তির কারণে আর কিছুটা পড়ালেখা জানার কারণে বেশ কিছু প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন কাজল রেখা। নিজের সমস্যা উপলব্দি করে সব প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সমস্যা করার ক্ষমতা অর্জন করেন তিনি।

এ ছাড়া নারী হিসাবে এবং দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় নারীদের যে অবস্থা হয় এগুলোও নিয়ে তিনি কথা বলেন বিভিন্ন সভা সেমিনারে।

প্রতিবেশী সোহেল রানা জানান, কাজল রেখা এলাকার অসহায় মানুষের অবলম্বন। তার কাছে এখন সবাই সহযোগিতা ও পরামর্শ নিতে আসেন।

এই গ্রামের সাবিনা ইয়াসমিন বলেন কাজল রেখা প্রতিবন্ধিতা শিকার হয়ে কতই না কষ্ট করেছে, কিন্তু সেই কষ্ট এখন আর নেই। নিজের ইচ্ছে শক্তি ও পরিশ্রমে জীবনে সফলতা এনেছেন।

বেসরকারি সংস্থা সিডিডি ও গণউন্নয়ন কেন্দ্র এর মাধ্যমে ২০১১ সালে প্রথমে ইন্দোনেশিয়া যাওয়া সুযোগ হয় তার। এরপর জাপান, সুইজারল্যান্ড, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুরসহ ৭টি দেশে আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারে যাওয়ার সুযোগ হয় তার।

এসব দেশে তিনি বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়ে বেশ প্রশংসিত হন।

জাতীয় পর্যায়ে অসংখ্য সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। ২০২৮ সালে একটি জাতীয় সম্মেলনে বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় উঠে আসেন এই কাজল রেখা। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়ন ধারা থেকে বাদ রেখে এসডিজিও অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব না। আর এই বক্তব্যে অংশগ্রহণকারীদের টনক নড়ে। তারা বলেন, কাজল রেখা শুধু একজন গ্রামের কাজল রেখা না সে এখন সব পৃথিবীর প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার আদায়ের একজন সফল প্রতিবাদী কিশোরী নারী।

কাজল রেখা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে উপজেলা ওজলা পর্যায়ের বিভিন্ন কমিটিতে সক্রিয় সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।

প্রতিবন্ধীদের প্রবেশগম্যতায় এই কাজল রেখা এ্যাডভোকেসি করে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা অফিস ২য় তলা থেকে নীচ তলায় নিয়ে এসেছেন। নিজ ইউনিয়ন শ্রীপুর ও আশপাশের ইউনিয়ন পরিষদের বার্ষিক বাজেটে প্রতিবন্ধীদের জন্য বাজেট নিশ্চিত করেছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ অসংখ্য সাফল্য রয়েছে তার। অসংখ্য প্রতিবন্ধীদের কার্ড ও ভাতা পেতে সহায়তা করেছেন তিনি।

বাস, নৌকা, ট্রেন, দুর্যোগে আশ্রয় কেন্দ্র, হাটবাজার, অফিস আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছেন।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন কাজল রেখা। এসব পুরুস্কার অর্জনে তিনি গর্ববোধ করেন এবং সামনে এগুতে প্রেরণা দেয়। তিনি জানান, একজন প্রতিবন্ধী নারীও সুযোগ ও সহায়তা পেলে পারে জীবনের স্বনির্ভর হয়ে বাঁচতে।

তিনি মনে করেন, জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা থাকলে মানুষ তার জীবনের অবস্থার উন্নয়ন করেত পারে। তিনি জানান, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে সরকারি ও আন্তর্জাতিকভাবে যেসব পলিসি ও আইন রয়েছে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হওয়া উচিত। এ ছাড়া কিছু আইন ও পলিসি ডেভেলপ করা করার প্রস্তাবনাও রাখেন তিনি।

গাইবান্ধা জেলা সমাজসেবা অফিসের উপ-পরিচালক ফজলুল হক জানান, প্রতিবন্ধীতা একটি সমস্যা মাত্র, কিন্তু এর কারণে জীবন থেমে থাকতে পারে না। কাজল রেখা এখন মডেল। তার অবদান অনুকরণীয়।

একারণে তিনি জানান, প্রতিবন্ধীদের পেছেনে রেখে দেশের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব না, এ কারণে সব উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয়টি লক্ষ্য রেখে ডিজাইন করতে হবে। আর এসব পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়নে প্রয়োজন নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রাখা। এ কারণেই আগামী স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কাজল রেখা প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করতে চান।

back to top