দোয়ারাবাজার (সুনামগঞ্জ) : অবহেলিত টেংরাটিলার গ্যাসক্ষ -সংবাদ
সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্র এক সময় যা ছিল দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার। আজ তা পড়ে আছে প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায়। ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি ও ২৪ জুন নাইকো রিসোর্সেসের ভুল ড্রিলিংয়ের ফলে দুই দফা ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। যার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়। ঘটনার ২০ বছর পেরিয়ে গেলেও ক্ষতিপূরণ আদায়, দায় নিরূপণ ও গ্যাসক্ষেত্র পুনঃখননের উদ্যোগ অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়ে গেছে।
২০০৫ সালের বিস্ফোরণ: ভয়াবহতা ও ক্ষয়ক্ষতি : ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকো রিসোর্সেস বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধানের সময় ভুল ড্রিলিংয়ের মাধ্যমে টেংরাটিলায় প্রথম বিস্ফোরণ ঘটায়। পরবর্তীতে গ্যাসচাপ নিয়ন্ত্রণে ওই বছরের ২৪ জুন দ্বিতীয় দফা রিলিফ কূপ খননের সময় আরও একটি ভয়াবহ অগ্নিকা- ঘটে। এই দুটি বিস্ফোরণে গ্যাসক্ষেত্রের দুটি কূপ ধ্বংস হয়ে যায়। আগুনের শিখা ২৫০-৩০০ ফুট পর্যন্ত ওঠে। পুড়ে যায় কোটি টাকার রিজার্ভ গ্যাস, আশপাশের গাছপালা ও কৃষিজমি। আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায় আজবপুর, গিরিশনগর, খৈয়াজুরি, আলীপুরসহ অন্তত ছয় গ্রামের মানুষ।
পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি : বিস্ফোরণের ফলে গ্যাস ও আগুনে আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকার কৃষিজমি, গৃহস্থালি এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নলকূপের পানিতে লোহা ও অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদানের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় দেখা দেয় পানির সংকট। এ ছাড়া স্থানীয়দের মধ্যে চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি ও অ্যাজমার মতো রোগের প্রকোপ বাড়ে। অনেক পরিবার এখনও এসব সমস্যার সঙ্গে বসবাস করছে।
বিচার ও ক্ষতিপূরণ : দুই দশকেও নিষ্পত্তিহীন বিস্ফোরণের পর বাংলাদেশ সরকার ও বাপেক্স নাইকোকে দায়ী করে ক্ষতিপূরণ দাবি করে। নাইকো অপরাধ অস্বীকার করে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালত ওঈঝওউ-এ মামলা করে। এরপর বাংলাদেশও পাল্টা নালিশ জানায়। ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক সালিশী আদালত আদালত নাইকোকে দায়ী করে রায় দেন এবং বাংলাদেশকে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দেন। তবে এতদিনেও ক্ষতিপূরণের অর্থ বাংলাদেশ পায়নি।
একইসাথে দেশের ভেতরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ আটজনের বিরুদ্ধে নাইকো দুর্নীতি মামলা করে। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার পর চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি আদালত আসামিদের খালাস দেন। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজনৈতিক ফায়দার জন্য মামলা হলেও গ্যাসক্ষেত্রের ক্ষতিপূরণ ও পুনঃখননের বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কোনো সরকার।
গ্যাসক্ষেত্রের বর্তমান অবস্থা
বাপেক্স সূত্রে জানা গেছে, বিস্ফোরণের পর থেকে টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রের কূপগুলো বন্ধ রয়েছে। এখন পর্যন্ত নতুন করে খনন কিংবা গ্যাস উত্তোলনের কোনো সরকারি ঘোষণা আসেনি। গ্যাসক্ষেত্রের মূল্যবান যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে।
বাপেক্সের টেংরাটিলা ইনচার্জ প্রকৌশলী এম. এম. নাজিম উদ্দিন বলেন,“নাইকো চলে যাওয়ার পর গ্যাসক্ষেত্রটির তত্ত্বাবধান বাপেক্স করছে। তবে এখনো পুরোনো অবস্থাতেই পড়ে আছে এটি।”
টেংরাটিলা গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা হাছান আলী বলেন, “সেই দিনের আগুন আর বিস্ফোরণের শব্দ এখনও কানে বাজে। চোখের সামনে কোটি কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেল। অথচ কিছুই ফিরে পেলাম না।” একই গ্রামের বাসিন্দা মোস্তফা আহমেদ বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম গ্যাস উঠবে, চাকরি হবে, কারখানা হবে—কিন্তু কিছুই হয়নি। দুই দশক কেটে গেলো। আশা ধুলিসাৎ।”
সুরমা ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান হারুন অর রশীদ বলেন, “এটি জাতীয় সম্পদ। দ্রুত জিওলজিক্যাল জরিপ, নিরাপদ পুনঃখনন ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া প্রয়োজন।”
দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অরূপ রতন সিংহ বলেন, “বাপেক্স এখন এই গ্যাসক্ষেত্রের দায়িত্বে রয়েছে। তবে গ্যাস উত্তোলনের পুনরায় উদ্যোগ নেওয়া হবে কিনা, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।”
দোয়ারাবাজার (সুনামগঞ্জ) : অবহেলিত টেংরাটিলার গ্যাসক্ষ -সংবাদ
শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫
সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্র এক সময় যা ছিল দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার। আজ তা পড়ে আছে প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায়। ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি ও ২৪ জুন নাইকো রিসোর্সেসের ভুল ড্রিলিংয়ের ফলে দুই দফা ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। যার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়। ঘটনার ২০ বছর পেরিয়ে গেলেও ক্ষতিপূরণ আদায়, দায় নিরূপণ ও গ্যাসক্ষেত্র পুনঃখননের উদ্যোগ অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়ে গেছে।
২০০৫ সালের বিস্ফোরণ: ভয়াবহতা ও ক্ষয়ক্ষতি : ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকো রিসোর্সেস বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধানের সময় ভুল ড্রিলিংয়ের মাধ্যমে টেংরাটিলায় প্রথম বিস্ফোরণ ঘটায়। পরবর্তীতে গ্যাসচাপ নিয়ন্ত্রণে ওই বছরের ২৪ জুন দ্বিতীয় দফা রিলিফ কূপ খননের সময় আরও একটি ভয়াবহ অগ্নিকা- ঘটে। এই দুটি বিস্ফোরণে গ্যাসক্ষেত্রের দুটি কূপ ধ্বংস হয়ে যায়। আগুনের শিখা ২৫০-৩০০ ফুট পর্যন্ত ওঠে। পুড়ে যায় কোটি টাকার রিজার্ভ গ্যাস, আশপাশের গাছপালা ও কৃষিজমি। আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায় আজবপুর, গিরিশনগর, খৈয়াজুরি, আলীপুরসহ অন্তত ছয় গ্রামের মানুষ।
পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি : বিস্ফোরণের ফলে গ্যাস ও আগুনে আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকার কৃষিজমি, গৃহস্থালি এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নলকূপের পানিতে লোহা ও অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদানের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় দেখা দেয় পানির সংকট। এ ছাড়া স্থানীয়দের মধ্যে চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি ও অ্যাজমার মতো রোগের প্রকোপ বাড়ে। অনেক পরিবার এখনও এসব সমস্যার সঙ্গে বসবাস করছে।
বিচার ও ক্ষতিপূরণ : দুই দশকেও নিষ্পত্তিহীন বিস্ফোরণের পর বাংলাদেশ সরকার ও বাপেক্স নাইকোকে দায়ী করে ক্ষতিপূরণ দাবি করে। নাইকো অপরাধ অস্বীকার করে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালত ওঈঝওউ-এ মামলা করে। এরপর বাংলাদেশও পাল্টা নালিশ জানায়। ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক সালিশী আদালত আদালত নাইকোকে দায়ী করে রায় দেন এবং বাংলাদেশকে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দেন। তবে এতদিনেও ক্ষতিপূরণের অর্থ বাংলাদেশ পায়নি।
একইসাথে দেশের ভেতরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ আটজনের বিরুদ্ধে নাইকো দুর্নীতি মামলা করে। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার পর চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি আদালত আসামিদের খালাস দেন। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজনৈতিক ফায়দার জন্য মামলা হলেও গ্যাসক্ষেত্রের ক্ষতিপূরণ ও পুনঃখননের বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কোনো সরকার।
গ্যাসক্ষেত্রের বর্তমান অবস্থা
বাপেক্স সূত্রে জানা গেছে, বিস্ফোরণের পর থেকে টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রের কূপগুলো বন্ধ রয়েছে। এখন পর্যন্ত নতুন করে খনন কিংবা গ্যাস উত্তোলনের কোনো সরকারি ঘোষণা আসেনি। গ্যাসক্ষেত্রের মূল্যবান যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে।
বাপেক্সের টেংরাটিলা ইনচার্জ প্রকৌশলী এম. এম. নাজিম উদ্দিন বলেন,“নাইকো চলে যাওয়ার পর গ্যাসক্ষেত্রটির তত্ত্বাবধান বাপেক্স করছে। তবে এখনো পুরোনো অবস্থাতেই পড়ে আছে এটি।”
টেংরাটিলা গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা হাছান আলী বলেন, “সেই দিনের আগুন আর বিস্ফোরণের শব্দ এখনও কানে বাজে। চোখের সামনে কোটি কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেল। অথচ কিছুই ফিরে পেলাম না।” একই গ্রামের বাসিন্দা মোস্তফা আহমেদ বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম গ্যাস উঠবে, চাকরি হবে, কারখানা হবে—কিন্তু কিছুই হয়নি। দুই দশক কেটে গেলো। আশা ধুলিসাৎ।”
সুরমা ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান হারুন অর রশীদ বলেন, “এটি জাতীয় সম্পদ। দ্রুত জিওলজিক্যাল জরিপ, নিরাপদ পুনঃখনন ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া প্রয়োজন।”
দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অরূপ রতন সিংহ বলেন, “বাপেক্স এখন এই গ্যাসক্ষেত্রের দায়িত্বে রয়েছে। তবে গ্যাস উত্তোলনের পুনরায় উদ্যোগ নেওয়া হবে কিনা, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।”