মধুপুর (টাঙ্গাইল) : লোকজ সংস্কৃতির ধুয়া গানের বয়াতি আব্দুল খালেকের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন প্রতিবেদক। ডান পাশে বয়াতি আব্দুল খালেক, বাম পাশে প্রতিবেদক -সংবাদ
মাথায় পাতলা পাতলা চুল। মুখের সাদা দাড়ি। মাথা যতটুকুই চুল রয়েছে তার একটিই মনে হয় কাঁচা নেই। বয়সের ভারে সাদা রঙ ধারণ করেছে। মুখে ভাষাও তুতলানো। শক্তি সামর্থ্যও ক্ষীণ। শরীরটাও শুকিয়ে গেছে। হালকা পাতলা গড়ন। বাড়িতে বসে সময় কাটান। কখনো বাজার কিংবা চায়ের দোকানের এক পাশে বসে বিকেলে চা পান করে সূর্য ঘরের যাওয়ার আগেই আপন গৃহে ফিরেন। গ্রামের কাছাকাছি দোকান হাট-বাজারে বসে গল্প করে সময়ের ভেলায় চলছে। পাঞ্জাবি লুঙ্গি পড়ে চলাই যার চিরায়ত অভ্যাস। বলছিলাম একজন লোকজ সংস্কৃতির ধূয়া গানের গায়কের কথা। তিনি হচ্ছেন টাঙ্গাইলের মধুপুরের আব্দুল খালেক বয়াতি। তার বাড়ি পৌরসভার জটাবাড়ি গ্রামে। তার বয়স প্রায় ৯০ এর কাছাকাছি। যৌবনের উত্তাল সময় পাড়ি দিয়েছে লোকজ সংস্কৃতির ধূয়া গান গেয়ে। তাকে স্থানীয়রা ধূয়া গানের উস্তাদ বলে ডাকে। তিনি ছিলেন এ গানের দল প্রধান। গায়ক হিসেবেও তাকে চিনে জানে।
আব্দুল খালেক ডাইকা বলে শোনো রফিক কই তোমারে। স্বাধীন দেশে থাকি আমরা। পইড়া গেছে কলির কাল। স্বামী স্ত্রী ঝগড়া করে চলে তার বাপের বাড়ি
আব্দুল খালেক বলে। ১৯৮৮ সালে। বন্যায় বাংলাদেশের চতুরদিকে দিকে ঘিরে। কত মানুষ মরে। কত মানুষ রাস্তায় গিয়ে পড়ে। খাবার নাইকা ঘরে
এমন অসংখ্য গানের রচয়িতা এই আব্দুল খালেক বয়াতি। লোকজ সংস্কৃতির ধূয়া গানের দাপুটে আসর জমাতেন যৌবনের উত্তাল সময়ে। পালায় গিয়ে কখনো হেরেছেন, কখনো জিতেছেন। এ গান নিয়ে রয়েছে তার নানা স্মৃতি। তার মনের মন্দিরে অসংখ্য গানের প্রশ্ন আর জবাবের ছিল বিকেল ভান্ডার। উপস্থিত বুদ্ধি মত্তার ভিত্তিতে দর্শক বিচারক মন্ডলীসহ সবার মন মাতিয়ে দিতেন তিনি। কিন্তু কালের পরিক্রমায় দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে এ গান।
এ বিষয়ে গল্প করে জানা যায়, লোকজ সংস্কৃতির প্রতি তার গভীর প্রেম অঘাত মমত্ববোধ। সংস্কৃতির প্রতি তার দরদ। আলাপের মধ্যে ধূয়া গানের নানা বিষয়ে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে তার কথা হয়।
এ প্রতিবেদককে তিনি জানান, ২০ বছর বয়স থেকে তিনি ধূয়া গান শুরু করে। প্রথমে তার উস্তাদের কাছে শিখেন। তারপর উপস্থিত বুদ্ধি আর স্মরণশক্তি প্রখরতার কারণে লেখাপড়া না জেনেও গান লিখতেন। সে রাতে ভেবে ভেবে মুখস্থ করতেন। সকালে কাউকে দিয়ে গান লেখাতেন। এভাবে তিনি প্রায় শতাধিক গান রচনার স্মৃতি গড়ে তোলেছে। সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে হয়ে থাকে এ গান। ঐ বিষয়ের উপর চলে গান।
তিনি আরও বলেন, এ গান একক অথবা দলবদ্ধভাবে গাওয়া হয়। কখনও দুই দলের প্রতিযোগিতার মাধ্যমেও এ গান পরিবেশিত হয়ে থাকে। এতে দুজন বয়াতি বা গায়েন থাকে। তাদের একজন গানের সুরে প্রশ্ন করে, অপরজন গানের সুরেই তার উত্তর দেয়। অনেক সময় উত্তরদাতাও পাল্টা প্রশ্ন করে। এ দুজনের প্রশ্নোত্তরের ফাঁকে ফাঁকে উভয়ের সহকারীরা ধুয়া গেয়ে নিজ নিজ বয়াতিকে সাহায্য করে এবং সেই সঙ্গে গানের ধারাবাহিকতাও রক্ষা করে।
এ গান গ্রাম কিংবা অঞ্চলে নতুন হাট বাজার, কোন দর্শনীয় স্থান পরিচিতি বা প্রসিদ্ধ করতে অনেক সময় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। শীত গ্রীষ্মকালের জ্যোৎস্নারাতে বসতবাড়ির উঠানে এ গানের আসর বসে তবে মাঠে-ঘাটে কিংবা নৌকায়ও আসর হতো। এ গানের শিল্পীদের অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরিধান করে থাকে। একতারা, দোতারা, খোল, করতাল সহযোগে উদাত্ত কণ্ঠে ধুয়া গান পরিবেশন করা হয়। অনেক সময় এতে নৃত্যেরও ব্যবস্থা থাকে।
ধুয়া গানে ভাব অঙ্গ ভঙ্গি নির্মল হাস্যরসে পরিবেশিত হয়ে থাকে। এতে ধর্মতত্ত¦, দেহতত্ত¦, সামাজিক অন্যায়-অবিচার সমসাময়িক ইত্যাদি বিষয়ে সহজ ভাষায় আলোকপাত করা হয়। আধুনিকতাকে ব্যঙ্গ করেও ধুয়া গান রচিত হতে দেখা যায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে অনেক ধুয়াা গান রচিত হয়েছে।
আব্দুল খালেক বয়াতি আরও বলেন, এক সময় আগ্রহ ভরে কিতাব পাঠ শোনত। ধূয়া, ঘেটুগান সহ গ্রামীণ গান মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যমে ছিল। এখন মোবাইল ুটেলিভিশন আসার ফলে এখন আর এসব গান শোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। আর এসব গানের শিল্পীও কমে গেছে।
পাঁচ সন্তানের জনক তিনি। দুই মেয়ে তিন ছেলে রয়েছে নাতি নাতনি। তিনি ৮ জন শিষ্য তৈরি করেছিলেন। বিভিন্ন স্থানে গান করতে যেতেন। জীবন সায়াহ্নে এসে তার নেই কোন আপসোস, নেই কোন অনুসূচনা। তিনি চান লোকজ সংস্কৃতির এসব গান সংরক্ষণ হলে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে বুঝতে পারবে বাংলার লোকসংস্কৃতি।
পিরোজপুর গ্রামের খালেক মন্ডল বলেন, এক সময় গ্রামে অনেক ধূয়া গান হতো। খালেক বয়াতির কন্ঠে অনেক গান তিনি শুনেছেন।
মুক্তার হোসেন খান বলেন, জোস্না রাতে গ্রামের মানুষের মন ভরে এসব গান শোনতেন। খালেক বয়াতি ঐ সময়ে ধূয়া গানের আসর জমাতেন মজা করে।
মধুপুর (টাঙ্গাইল) : লোকজ সংস্কৃতির ধুয়া গানের বয়াতি আব্দুল খালেকের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন প্রতিবেদক। ডান পাশে বয়াতি আব্দুল খালেক, বাম পাশে প্রতিবেদক -সংবাদ
শুক্রবার, ০১ আগস্ট ২০২৫
মাথায় পাতলা পাতলা চুল। মুখের সাদা দাড়ি। মাথা যতটুকুই চুল রয়েছে তার একটিই মনে হয় কাঁচা নেই। বয়সের ভারে সাদা রঙ ধারণ করেছে। মুখে ভাষাও তুতলানো। শক্তি সামর্থ্যও ক্ষীণ। শরীরটাও শুকিয়ে গেছে। হালকা পাতলা গড়ন। বাড়িতে বসে সময় কাটান। কখনো বাজার কিংবা চায়ের দোকানের এক পাশে বসে বিকেলে চা পান করে সূর্য ঘরের যাওয়ার আগেই আপন গৃহে ফিরেন। গ্রামের কাছাকাছি দোকান হাট-বাজারে বসে গল্প করে সময়ের ভেলায় চলছে। পাঞ্জাবি লুঙ্গি পড়ে চলাই যার চিরায়ত অভ্যাস। বলছিলাম একজন লোকজ সংস্কৃতির ধূয়া গানের গায়কের কথা। তিনি হচ্ছেন টাঙ্গাইলের মধুপুরের আব্দুল খালেক বয়াতি। তার বাড়ি পৌরসভার জটাবাড়ি গ্রামে। তার বয়স প্রায় ৯০ এর কাছাকাছি। যৌবনের উত্তাল সময় পাড়ি দিয়েছে লোকজ সংস্কৃতির ধূয়া গান গেয়ে। তাকে স্থানীয়রা ধূয়া গানের উস্তাদ বলে ডাকে। তিনি ছিলেন এ গানের দল প্রধান। গায়ক হিসেবেও তাকে চিনে জানে।
আব্দুল খালেক ডাইকা বলে শোনো রফিক কই তোমারে। স্বাধীন দেশে থাকি আমরা। পইড়া গেছে কলির কাল। স্বামী স্ত্রী ঝগড়া করে চলে তার বাপের বাড়ি
আব্দুল খালেক বলে। ১৯৮৮ সালে। বন্যায় বাংলাদেশের চতুরদিকে দিকে ঘিরে। কত মানুষ মরে। কত মানুষ রাস্তায় গিয়ে পড়ে। খাবার নাইকা ঘরে
এমন অসংখ্য গানের রচয়িতা এই আব্দুল খালেক বয়াতি। লোকজ সংস্কৃতির ধূয়া গানের দাপুটে আসর জমাতেন যৌবনের উত্তাল সময়ে। পালায় গিয়ে কখনো হেরেছেন, কখনো জিতেছেন। এ গান নিয়ে রয়েছে তার নানা স্মৃতি। তার মনের মন্দিরে অসংখ্য গানের প্রশ্ন আর জবাবের ছিল বিকেল ভান্ডার। উপস্থিত বুদ্ধি মত্তার ভিত্তিতে দর্শক বিচারক মন্ডলীসহ সবার মন মাতিয়ে দিতেন তিনি। কিন্তু কালের পরিক্রমায় দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে এ গান।
এ বিষয়ে গল্প করে জানা যায়, লোকজ সংস্কৃতির প্রতি তার গভীর প্রেম অঘাত মমত্ববোধ। সংস্কৃতির প্রতি তার দরদ। আলাপের মধ্যে ধূয়া গানের নানা বিষয়ে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে তার কথা হয়।
এ প্রতিবেদককে তিনি জানান, ২০ বছর বয়স থেকে তিনি ধূয়া গান শুরু করে। প্রথমে তার উস্তাদের কাছে শিখেন। তারপর উপস্থিত বুদ্ধি আর স্মরণশক্তি প্রখরতার কারণে লেখাপড়া না জেনেও গান লিখতেন। সে রাতে ভেবে ভেবে মুখস্থ করতেন। সকালে কাউকে দিয়ে গান লেখাতেন। এভাবে তিনি প্রায় শতাধিক গান রচনার স্মৃতি গড়ে তোলেছে। সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে হয়ে থাকে এ গান। ঐ বিষয়ের উপর চলে গান।
তিনি আরও বলেন, এ গান একক অথবা দলবদ্ধভাবে গাওয়া হয়। কখনও দুই দলের প্রতিযোগিতার মাধ্যমেও এ গান পরিবেশিত হয়ে থাকে। এতে দুজন বয়াতি বা গায়েন থাকে। তাদের একজন গানের সুরে প্রশ্ন করে, অপরজন গানের সুরেই তার উত্তর দেয়। অনেক সময় উত্তরদাতাও পাল্টা প্রশ্ন করে। এ দুজনের প্রশ্নোত্তরের ফাঁকে ফাঁকে উভয়ের সহকারীরা ধুয়া গেয়ে নিজ নিজ বয়াতিকে সাহায্য করে এবং সেই সঙ্গে গানের ধারাবাহিকতাও রক্ষা করে।
এ গান গ্রাম কিংবা অঞ্চলে নতুন হাট বাজার, কোন দর্শনীয় স্থান পরিচিতি বা প্রসিদ্ধ করতে অনেক সময় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। শীত গ্রীষ্মকালের জ্যোৎস্নারাতে বসতবাড়ির উঠানে এ গানের আসর বসে তবে মাঠে-ঘাটে কিংবা নৌকায়ও আসর হতো। এ গানের শিল্পীদের অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরিধান করে থাকে। একতারা, দোতারা, খোল, করতাল সহযোগে উদাত্ত কণ্ঠে ধুয়া গান পরিবেশন করা হয়। অনেক সময় এতে নৃত্যেরও ব্যবস্থা থাকে।
ধুয়া গানে ভাব অঙ্গ ভঙ্গি নির্মল হাস্যরসে পরিবেশিত হয়ে থাকে। এতে ধর্মতত্ত¦, দেহতত্ত¦, সামাজিক অন্যায়-অবিচার সমসাময়িক ইত্যাদি বিষয়ে সহজ ভাষায় আলোকপাত করা হয়। আধুনিকতাকে ব্যঙ্গ করেও ধুয়া গান রচিত হতে দেখা যায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে অনেক ধুয়াা গান রচিত হয়েছে।
আব্দুল খালেক বয়াতি আরও বলেন, এক সময় আগ্রহ ভরে কিতাব পাঠ শোনত। ধূয়া, ঘেটুগান সহ গ্রামীণ গান মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যমে ছিল। এখন মোবাইল ুটেলিভিশন আসার ফলে এখন আর এসব গান শোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। আর এসব গানের শিল্পীও কমে গেছে।
পাঁচ সন্তানের জনক তিনি। দুই মেয়ে তিন ছেলে রয়েছে নাতি নাতনি। তিনি ৮ জন শিষ্য তৈরি করেছিলেন। বিভিন্ন স্থানে গান করতে যেতেন। জীবন সায়াহ্নে এসে তার নেই কোন আপসোস, নেই কোন অনুসূচনা। তিনি চান লোকজ সংস্কৃতির এসব গান সংরক্ষণ হলে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে বুঝতে পারবে বাংলার লোকসংস্কৃতি।
পিরোজপুর গ্রামের খালেক মন্ডল বলেন, এক সময় গ্রামে অনেক ধূয়া গান হতো। খালেক বয়াতির কন্ঠে অনেক গান তিনি শুনেছেন।
মুক্তার হোসেন খান বলেন, জোস্না রাতে গ্রামের মানুষের মন ভরে এসব গান শোনতেন। খালেক বয়াতি ঐ সময়ে ধূয়া গানের আসর জমাতেন মজা করে।