ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল। প্রতিদিন সকাল থেকে এ হাসপাতালের টিকাদান কেন্দ্রের সামনে সেবা প্রত্যাশীদের ভিড় দেখা যায়। কুকুর, বিড়াল কিংবা শিয়ালের কামড়ে আক্রান্তরা এখানে বিনামূল্যের টিকা নিতে আসেন। অথচ কম খরচে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার এই কেন্দ্রে জীবনরক্ষাকারী গুরুত্বপূর্ণ টিকা র্যাবিসইমিউনোগ্লেবুলিনবা আর আইজির সরবরাহ নেই। একদিন- দুই দিন নয়, টানা ছয় মাস ধরে এ অবস্থা। একই সঙ্গে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী আরেকটি টিকা অ্যান্টির্যাবিস ভ্যাকসিন (এআরভি) সরবরাহ এক মাস বন্ধ ছিল।
শিয়ালের কামড়ের শিকার হয়ে হাসপাতালে এসেছি। ভেবেছিলাম টিকা তো ফ্রি। কিন্তু এখানে এসে জানতে পারলাম বাইরে থেকে কিনতে হবে: ভুক্তভোগী
আরআইজি কবে আসবে, তা বলতে পারছি না। বারবার যোগাযোগ করেও কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাচ্ছি না: আরএমও
গত ৩ জুলাই যে, পরিমাণ এআরভি এসেছে, তার চাহিদা তুলনায় অনেক কম। এ অবস্থায় বিভিন্ন পশুর কামড়ে বা আচড়ে আক্রান্ত রোগীরা পড়েছেন বিপাকে। কেউ ফিরে যাচ্ছেন খালি হাতে, আবার কেউ বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে টিকাগুলো কিনছেন। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে যে সেবা পাওয়ার কথা, তা না পেয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম হতাশ হচ্ছেন। বিশেষ করে যাদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা নেই তারা জীবন-মৃত্যুর অনিশ্চয়তা নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, তুলনামূলক কম খরচ ও বিনামূল্যের সেবা যেখানে পাওয়ার কথা সেখানে এমন সংকট তৈরি হলে তারা কোথায় যাবেন? সংশ্লিষ্টদের দাবি, দ্রুত টিকা সরবরাহ করা না হলে ঠাকুরগাঁওয়ে জলাতঙ্ক পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। তাই অবিলম্বে এই সংকট মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি তাদের।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার
নারগুন গ্রামের বাসিন্দা নাসিরুল ইসলাম। সরকারি হাসপাতালে এসে জলাতঙ্কের টিকা না পেয়ে তিনি বিপাকে পড়েন। অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও তাকে বাইরে থেকে এ টিকা কিনতে হয়েছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার ছেলেকে কুকুরে কামড়েছে। শুনেছিলাম, সরকারি হাসপাতালে ভ্যাকসিন বিনামূল্যে পাওয়া যায়। তাই এখানে আসি। কিন্তু এসে শুনি, আরআইজি নেই। শেষ পর্যন্ত বাজার থেকে ১ হাজার টাকায় কিনতে হয়। এত টাকা জোগাড় করতেই কষ্ট হয়ে গেছে।’
হাসপাতালের টিকাদান কেন্দ্রের সামনে কথা হয় পীরগঞ্জ থেকে আসাসাদিয়া আক্তারের সঙ্গে। তিনিও বিনামূল্যের এ টিকাটি পাননি। বলেন, ‘আমার স্বামী মারা গেছেন। খুব কষ্ট করে চলি। শিয়ালের কামড়ের শিকার হয়ে হাসপাতালে এসেছি। ভেবেছিলাম টিকা তো ফ্রি। কিন্তু এখানে এসে জানতে পারলাম বাইরে থেকে কিনতে হবে।’
পশুর কামড়ে আক্রান্ত আরেক রোগীর স্বজন আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘ভেবেছিলাম সরকারি হাসপাতালে অন্তত এ টিকা পাওয়া যাবে। কিন্তু এখানে তো আসলেই কিছু নেই। বাইরের ফার্মেসিতে অনেক দাম। গরিব মানুষ আমরা। কোথায় যাব?’ জেলা শহরের মুসলিমনগরের বাসিন্দা প্রবীন নাগরিক আমজাদ আলী বলেন, ‘হাসপাতালে এসে টিকা না পেয়ে মনে হয়েছে জীবনটাই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেল। বাইরে যে দাম, তাতে কেনা সম্ভব না। সরকার যদি এ টিকা দিতে না পারে, তাহলে আমার মতো সাধারণ মানুষের জন্য আর কোনো ভরসা থাকে না।’
হাসপাতাল সূত্র জানায়, জেলার পাঁচ উপজেলা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে প্রতিদিন ৯০-১০০ রোগী টিকার জন্য এখানে আসেন। কিন্তু সীমিত সরবরাহের কারণে অনেককে ফেরত পাঠানো হয়।
হাসপাতালের স্টোরকিপার মাহবুবুর রশিদ জানান, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত পাঁচবার চাহিদা পাঠানো হয়েছে। এআরভি চাওয়া হয়েছিল ২৫ হাজার ডোজ, পাওয়া গেছে ৩ হাজার। আরআইজি চাওয়া হয়েছিল ৫ হাজার, সরবরাহ হয়েছে মাত্র ৩০০ ডোজ।
চিকিৎসক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জলাতঙ্ক একটি প্রাণঘাতী ভাইরাসজনিত রোগ। কুকুর বা অন্য প্রাণীর কামড়ের পর দ্রুত চিকিৎসা না পেলে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বর্ষাকালে এসব প্রাণীর কামড়ের ঘটনা বাড়ে। তাই এ সময় পর্যাপ্ত টিকা সরবরাহ থাকা খুবই জরুরি।
হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মনজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যতটুকু জানি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ক্রয় প্রক্রিয়া চলমান। এআরভি অল্প অল্প করে পাচ্ছি, ২০০ থেকে ৫০০ ডোজ। তবে আরআইজি কবে আসবে, তা বলতে পারছি না। বারবার যোগাযোগ করেও কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাচ্ছি না।’