টাঙ্গুয়ার হাওর। দেশের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক রামসার সাইট। সুনামগঞ্জের মধ্যনগর ও তাহিরপুরে এ জলাভূমি। বর্তমানে এটি বিপর্যয়ের মুখে। ‘মাদার ফিশারি’ খ্যাত হাওরটি আজ মাছ, পাখি, জলজ উদ্ভিদ ও স্থানীয় সংস্কৃতি হারানোর পথে।
১৯৯৯ সালে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণার পরের বছর ‘রামসার সাইট’ হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও হাওরের প্রাণ-প্রকৃতিরক্ষা পায়নি। এটির ৯ হাজার ৭২৭ হেক্টরের মধ্যে প্রায় ৬৭ শতাংশই মধ্যনগরে।
এটি প্রায় ৭০ বছর ধরে ইজারাভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় চলছিল। তবে ২০০০ সালে এটি বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসা হয়। এরপর টাঙ্গুয়ার হাওর ঘিরে নানা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু কার্যকর সংরক্ষণের অভাবে এর অবস্থার কোনো উন্নয়ন হয়নি।
হাওরের ভান্ডারচাপুর গ্রামের গোলাম নূর জানান, আইইউসিএনের সহব্যবস্থাপনা প্রকল্পে তিনি কাজ করেছেন। প্রকল্পের কোনো টেকসই সুফল তারা দেখেননি।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, একসময় টাঙ্গুয়ার হাওরে ১৪১ প্রজাতির দেশীয় মাছ ছিল, সেখানে এখন আছে মাত্র ৫৮টি। অধ্যাপক মৃত্যুঞ্জয় কুন্ডু বলেন, নিষিদ্ধ জাল, অতিরিক্ত শিকার, পানিদূষণ ও হাউসবোটের উপদ্রবে মাছের প্রজনন ভয়ানকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সুনামগঞ্জের মধ্যনগর শুধু মাছ নয়, অতিথি পাখির সংখ্যাও ভয়াবহভাবে কমেছে। বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের তথ্যমতে, টাঙ্গুয়ার হাওরে আগে প্রত্যেক শীত মৌসুমে প্রায় ৫ লাখ পাখি আসত, এবার সেখানে এসেছে মাত্র ২৩ হাজার। এত কম পাখি আসার কারণ শব্দদূষণ, বিষটোপ, খাদ্যাভাব এবং প্লাস্টিক দূষণ।
টাঙ্গুয়ার হাওরে যেসব পর্যটক আসনে, তারা নিয়ম মেনে চলেন না। বাড়াবাড়ি পর্যায়ের সবকিছু করেন। উচ্চ শব্দে গান, গাছের গোড়ায় ছবি তোলা, বিশাল আকারের হাউজবোটের প্রপেলারে জলজ উদ্ভিদ ছেঁটে ফেলা ইত্যাদি। পর্যটকদের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়িসহ সব কিছু মিলিয়ে হাওরের জীববৈচিত্র্য প্রচণ্ড হুমকির মুখে রয়েছে। এ বছরে একটি যৌথ গবেষণায় (নোবিপ্রবি, বুয়েট ও বিসিএসআইআর) হাওরের পানিতে নিকেল, সিসা, জিংক, তামা ও ম্যাঙ্গানিজের মতো ভারী ধাতু পাওয়া গেছে। গবেষকরা বলেন, এসব বিষাক্ত উপাদান আসে ভারতীয় কয়লাখনি, কীটনাশক ও হাউসবোটের বর্জ্য থেকে।
বিশেষজ্ঞ এএসএম সাইফুল্লাহ বলেন, এই পানি শুধু মাছ নয়। মানুষের শরীরেও ক্যানসারসহ ভয়াবহ রোগ ছড়াতে পারে।
প্রতিদিন প্রায় ৪০০ হাউসবোট হাওরে চলাচল করে। বেশিরভাগই নিয়মকে তোয়াক্কা করে না। এসব হাউসবোট থেকে উচ্চ শব্দে গান বাজানো হয়। পর্যটকরা মদের বোতল, প্লাস্টিকসহ নানা বর্জ্য হাওড়ে ফেলে দেন। এতে প্রজনন কেন্দ্র ও গাছের গোড়া নষ্ট হচ্ছে। কৃষকরাও আহত হচ্ছেন কাচের টুকরোয়।
পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘ডাহুক’-এর পরিচালক মাগফি রেজা বলেন, হাওরের নিচে কয়েক কোটি টাকার প্লাস্টিক বর্জ্য জমে আছে; যা জীববৈচিত্র্যের জন্য ভয়ানক হুমকি।
এই অবস্থা দেখে টাঙ্গুয়ার হাওরে পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে হাউসবোট জব্দে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
২৭ জুলাই সুনামগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মোহাম্মদ আলমগীর এই নির্দেশ দেন। এই আদেশের ভিত্তি হিসেবে আদালত গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ করা হয়েছে। টাঙ্গুয়ার হাওড়ে হাউসবোটগুলো প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে। আদালত পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটক আসলেও স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। বরং হাওরের পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে।
এদিকে জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, ইউএনডিপির অর্থায়নে ৫ বছর মেয়াদি ৪.০৫ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চারটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে টাঙ্গুয়ার হাওরের ভবিষ্যৎ। দেশীয় মাছ সংরক্ষণ, হিজল-করচসহজলজ উদ্ভিদ রক্ষা, পাখিদের নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা এবং দূষণমুক্ত পানি ব্যবস্থা।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে বর্তমানে ইউএনডিপি একটি প্রকল্প নিয়েছে। জেলা প্রশাসন হাওরের দেখভাল করছে। হাওড়ের অভয়াশ্রম সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি আমরা বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি।
রোববার, ০৩ আগস্ট ২০২৫
টাঙ্গুয়ার হাওর। দেশের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক রামসার সাইট। সুনামগঞ্জের মধ্যনগর ও তাহিরপুরে এ জলাভূমি। বর্তমানে এটি বিপর্যয়ের মুখে। ‘মাদার ফিশারি’ খ্যাত হাওরটি আজ মাছ, পাখি, জলজ উদ্ভিদ ও স্থানীয় সংস্কৃতি হারানোর পথে।
১৯৯৯ সালে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণার পরের বছর ‘রামসার সাইট’ হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও হাওরের প্রাণ-প্রকৃতিরক্ষা পায়নি। এটির ৯ হাজার ৭২৭ হেক্টরের মধ্যে প্রায় ৬৭ শতাংশই মধ্যনগরে।
এটি প্রায় ৭০ বছর ধরে ইজারাভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় চলছিল। তবে ২০০০ সালে এটি বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসা হয়। এরপর টাঙ্গুয়ার হাওর ঘিরে নানা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু কার্যকর সংরক্ষণের অভাবে এর অবস্থার কোনো উন্নয়ন হয়নি।
হাওরের ভান্ডারচাপুর গ্রামের গোলাম নূর জানান, আইইউসিএনের সহব্যবস্থাপনা প্রকল্পে তিনি কাজ করেছেন। প্রকল্পের কোনো টেকসই সুফল তারা দেখেননি।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, একসময় টাঙ্গুয়ার হাওরে ১৪১ প্রজাতির দেশীয় মাছ ছিল, সেখানে এখন আছে মাত্র ৫৮টি। অধ্যাপক মৃত্যুঞ্জয় কুন্ডু বলেন, নিষিদ্ধ জাল, অতিরিক্ত শিকার, পানিদূষণ ও হাউসবোটের উপদ্রবে মাছের প্রজনন ভয়ানকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সুনামগঞ্জের মধ্যনগর শুধু মাছ নয়, অতিথি পাখির সংখ্যাও ভয়াবহভাবে কমেছে। বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের তথ্যমতে, টাঙ্গুয়ার হাওরে আগে প্রত্যেক শীত মৌসুমে প্রায় ৫ লাখ পাখি আসত, এবার সেখানে এসেছে মাত্র ২৩ হাজার। এত কম পাখি আসার কারণ শব্দদূষণ, বিষটোপ, খাদ্যাভাব এবং প্লাস্টিক দূষণ।
টাঙ্গুয়ার হাওরে যেসব পর্যটক আসনে, তারা নিয়ম মেনে চলেন না। বাড়াবাড়ি পর্যায়ের সবকিছু করেন। উচ্চ শব্দে গান, গাছের গোড়ায় ছবি তোলা, বিশাল আকারের হাউজবোটের প্রপেলারে জলজ উদ্ভিদ ছেঁটে ফেলা ইত্যাদি। পর্যটকদের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়িসহ সব কিছু মিলিয়ে হাওরের জীববৈচিত্র্য প্রচণ্ড হুমকির মুখে রয়েছে। এ বছরে একটি যৌথ গবেষণায় (নোবিপ্রবি, বুয়েট ও বিসিএসআইআর) হাওরের পানিতে নিকেল, সিসা, জিংক, তামা ও ম্যাঙ্গানিজের মতো ভারী ধাতু পাওয়া গেছে। গবেষকরা বলেন, এসব বিষাক্ত উপাদান আসে ভারতীয় কয়লাখনি, কীটনাশক ও হাউসবোটের বর্জ্য থেকে।
বিশেষজ্ঞ এএসএম সাইফুল্লাহ বলেন, এই পানি শুধু মাছ নয়। মানুষের শরীরেও ক্যানসারসহ ভয়াবহ রোগ ছড়াতে পারে।
প্রতিদিন প্রায় ৪০০ হাউসবোট হাওরে চলাচল করে। বেশিরভাগই নিয়মকে তোয়াক্কা করে না। এসব হাউসবোট থেকে উচ্চ শব্দে গান বাজানো হয়। পর্যটকরা মদের বোতল, প্লাস্টিকসহ নানা বর্জ্য হাওড়ে ফেলে দেন। এতে প্রজনন কেন্দ্র ও গাছের গোড়া নষ্ট হচ্ছে। কৃষকরাও আহত হচ্ছেন কাচের টুকরোয়।
পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘ডাহুক’-এর পরিচালক মাগফি রেজা বলেন, হাওরের নিচে কয়েক কোটি টাকার প্লাস্টিক বর্জ্য জমে আছে; যা জীববৈচিত্র্যের জন্য ভয়ানক হুমকি।
এই অবস্থা দেখে টাঙ্গুয়ার হাওরে পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে হাউসবোট জব্দে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
২৭ জুলাই সুনামগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মোহাম্মদ আলমগীর এই নির্দেশ দেন। এই আদেশের ভিত্তি হিসেবে আদালত গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ করা হয়েছে। টাঙ্গুয়ার হাওড়ে হাউসবোটগুলো প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে। আদালত পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটক আসলেও স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। বরং হাওরের পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে।
এদিকে জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, ইউএনডিপির অর্থায়নে ৫ বছর মেয়াদি ৪.০৫ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চারটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে টাঙ্গুয়ার হাওরের ভবিষ্যৎ। দেশীয় মাছ সংরক্ষণ, হিজল-করচসহজলজ উদ্ভিদ রক্ষা, পাখিদের নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা এবং দূষণমুক্ত পানি ব্যবস্থা।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে বর্তমানে ইউএনডিপি একটি প্রকল্প নিয়েছে। জেলা প্রশাসন হাওরের দেখভাল করছে। হাওড়ের অভয়াশ্রম সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি আমরা বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি।