বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক এবং বামপন্থি আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক যতীন সরকার আর নেই। বুধবার,(১৩ আগস্ট ২০২৫) বেলা পৌনে তিনটার দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ৮৯ বছর বয়সী যতীন সরকার দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।
উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী নেত্রকোণা জেলা নেতাকর্মীদের তথ্যমতে, ময়মনসিংহ থেকে যতীন সরকারের মরদেহ প্রথমে সরাসরি তার বাসস্থান শহরের রামকৃষ্ণ মিশন রোডের ‘বানপ্রস্থে’ নেয়া হয়েছে। সেখানে পরিবার ও স্বজনরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ বাড়িতেই তিনি আড়াই দশকের বেশি সময় বসবাস করেন। বুধবার রাত ৮টায় যতীন সরকারের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় নেত্রকোণা শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে শহরের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, ময়মনসিংহ ও ঢাকা থেকে আসা ভক্ত-অনুরাগীরা এই শিক্ষাগুরুর প্রতি তাদের শেষ শ্রদ্ধা জানান।
যতীন সরকার ১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট নেত্রকোনার কেন্দুয়ার চন্দপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নেত্রকোণা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় ছাত্রসংসদের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে ১৯৫৭ সালে ময়মনসিংহে গিয়ে ভর্তি হন আনন্দমোহন কলেজে। বিএ পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন নেত্রকোণার আশুজিয়া হাইস্কুলে। বারহাট্টা সিকেপি পাইলট হাইস্কুলেও পড়িয়েছেন কিছুদিন। পরে বাংলাভাষা ও সাহিত্য পড়তে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে এমএ পাস করে ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর হাইস্কুলে বাংলার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন যতীন সরকার। ১৯৬৪ সালে বাংলার প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ময়মনসিংহ শহরের নাসিরাবাদ কলেজে।
এই শিক্ষক সুদীর্ঘকাল ধরে মননশীল সাহিত্যচর্চা, বাম রাজনীতি ও প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সাম্যবাদী দর্শনের পতাকাবাহী যতীন সরকার ছিলেন বায়ান্নর ভাষাসংগ্রামী অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। ষাটের দশক থেকে ময়মনসিংহ শহরে সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন যতীন সরকার। দুই মেয়াদে পালন করেছেন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব।
৪২ বছরের বেশি সময় শিক্ষকতা পেশায় থেকে ২০০২ সালে অবসরগ্রহণের পর যতীন সরকার স্ত্রীকে নিয়ে শিকড়ের টানে চলে যান নিজ জেলা নেত্রকোণায়। তিনি সেখানে নিভৃতে নিজ বাড়িতেই জীবন কাটান। স্ত্রী কানন সরকার, ছেলে সুমন সরকার ও মেয়ে সুদীপ্তা সরকারসহ অসংখ্য শিক্ষার্থী, স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন তিনি।
ছাত্রজীবনে লেখালেখি শুরু হলেও যতীন সরকারের প্রথম বই ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’ প্রকাশিত হয় ৫০ বছর বয়সে ১৯৮৫ সালে। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের কবি গান, বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সংগ্রাম, গল্পে গল্পে ব্যাকরণ, মানবমন মানব ধর্ম ও সমাজ বিপ্লব, পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন, পাকিস্তানের ভূত দর্শন, দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়তিবাদ ও বিজ্ঞান চেতনা, ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের ভূতভবিষ্যৎ, বিনষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতি, প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন, ভাবনার মুক্তবাতায়নসহ অর্ধশত বই। সেই সঙ্গে তিনি সম্পাদনা করেছেন অনেক গ্রন্থ। সমাজ অর্থনীতি ও রাষ্ট্র নামে তত্ত্বমূলক ত্রৈমাসিক একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন তিনি।
পঞ্চাশের দশকে কমরেড জ্যোতিষ বোস ও অজয় রায়ের কাছ থেকে মার্কসবাদের দীক্ষা পাওয়া যতীন সরকার ২০০৭ সালে সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেছিলেন। ছিলেন ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবের সদস্য।
২০০৫ সালে প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যু-দর্শন’ গ্রন্থটি সাম্যবাদী বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত যতীন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। এরপর ১৯৮৫ সালে বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় তার ‘বাংলাদেশী কবি গান’।‘বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য’, ‘সংস্কৃতির সংগ্রাম’, ‘মানবমন, মানবধর্ম ও সমাজবিপ্লব’, ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব, নিয়তিবাদ ও বিজ্ঞান-চেতনা’, ‘সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবী সমাচার’, ‘সাহিত্য নিয়ে নানাকথা’ তার প্রকাশিত আড়াই ডজন বইয়ের অন্যতম। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় তার সর্বশেষ বই ‘প্রত্যয় প্রতিজ্ঞা প্রতিভা’।
লেখক হিসেবে যতীন সরকার ২০১০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার, ২০০৭ সালে বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্যপদক, ২০০৫ সালে পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন গ্রন্থের জন্য প্রথম আলো বর্ষসেরা গ্রন্থ পুরস্কার পান। এ ছাড়া তিনি ড. এনামুল হক স্বর্ণপদক, খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার, মনিরুদ্দীন ইউসুফ সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা লাভ করেন।
বুধবার, ১৩ আগস্ট ২০২৫
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক এবং বামপন্থি আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক যতীন সরকার আর নেই। বুধবার,(১৩ আগস্ট ২০২৫) বেলা পৌনে তিনটার দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ৮৯ বছর বয়সী যতীন সরকার দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।
উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী নেত্রকোণা জেলা নেতাকর্মীদের তথ্যমতে, ময়মনসিংহ থেকে যতীন সরকারের মরদেহ প্রথমে সরাসরি তার বাসস্থান শহরের রামকৃষ্ণ মিশন রোডের ‘বানপ্রস্থে’ নেয়া হয়েছে। সেখানে পরিবার ও স্বজনরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ বাড়িতেই তিনি আড়াই দশকের বেশি সময় বসবাস করেন। বুধবার রাত ৮টায় যতীন সরকারের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় নেত্রকোণা শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে শহরের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, ময়মনসিংহ ও ঢাকা থেকে আসা ভক্ত-অনুরাগীরা এই শিক্ষাগুরুর প্রতি তাদের শেষ শ্রদ্ধা জানান।
যতীন সরকার ১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট নেত্রকোনার কেন্দুয়ার চন্দপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নেত্রকোণা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় ছাত্রসংসদের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে ১৯৫৭ সালে ময়মনসিংহে গিয়ে ভর্তি হন আনন্দমোহন কলেজে। বিএ পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন নেত্রকোণার আশুজিয়া হাইস্কুলে। বারহাট্টা সিকেপি পাইলট হাইস্কুলেও পড়িয়েছেন কিছুদিন। পরে বাংলাভাষা ও সাহিত্য পড়তে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে এমএ পাস করে ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর হাইস্কুলে বাংলার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন যতীন সরকার। ১৯৬৪ সালে বাংলার প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ময়মনসিংহ শহরের নাসিরাবাদ কলেজে।
এই শিক্ষক সুদীর্ঘকাল ধরে মননশীল সাহিত্যচর্চা, বাম রাজনীতি ও প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সাম্যবাদী দর্শনের পতাকাবাহী যতীন সরকার ছিলেন বায়ান্নর ভাষাসংগ্রামী অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। ষাটের দশক থেকে ময়মনসিংহ শহরে সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন যতীন সরকার। দুই মেয়াদে পালন করেছেন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব।
৪২ বছরের বেশি সময় শিক্ষকতা পেশায় থেকে ২০০২ সালে অবসরগ্রহণের পর যতীন সরকার স্ত্রীকে নিয়ে শিকড়ের টানে চলে যান নিজ জেলা নেত্রকোণায়। তিনি সেখানে নিভৃতে নিজ বাড়িতেই জীবন কাটান। স্ত্রী কানন সরকার, ছেলে সুমন সরকার ও মেয়ে সুদীপ্তা সরকারসহ অসংখ্য শিক্ষার্থী, স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন তিনি।
ছাত্রজীবনে লেখালেখি শুরু হলেও যতীন সরকারের প্রথম বই ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’ প্রকাশিত হয় ৫০ বছর বয়সে ১৯৮৫ সালে। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের কবি গান, বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সংগ্রাম, গল্পে গল্পে ব্যাকরণ, মানবমন মানব ধর্ম ও সমাজ বিপ্লব, পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন, পাকিস্তানের ভূত দর্শন, দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়তিবাদ ও বিজ্ঞান চেতনা, ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের ভূতভবিষ্যৎ, বিনষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতি, প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন, ভাবনার মুক্তবাতায়নসহ অর্ধশত বই। সেই সঙ্গে তিনি সম্পাদনা করেছেন অনেক গ্রন্থ। সমাজ অর্থনীতি ও রাষ্ট্র নামে তত্ত্বমূলক ত্রৈমাসিক একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন তিনি।
পঞ্চাশের দশকে কমরেড জ্যোতিষ বোস ও অজয় রায়ের কাছ থেকে মার্কসবাদের দীক্ষা পাওয়া যতীন সরকার ২০০৭ সালে সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেছিলেন। ছিলেন ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবের সদস্য।
২০০৫ সালে প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যু-দর্শন’ গ্রন্থটি সাম্যবাদী বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত যতীন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। এরপর ১৯৮৫ সালে বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় তার ‘বাংলাদেশী কবি গান’।‘বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য’, ‘সংস্কৃতির সংগ্রাম’, ‘মানবমন, মানবধর্ম ও সমাজবিপ্লব’, ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব, নিয়তিবাদ ও বিজ্ঞান-চেতনা’, ‘সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবী সমাচার’, ‘সাহিত্য নিয়ে নানাকথা’ তার প্রকাশিত আড়াই ডজন বইয়ের অন্যতম। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় তার সর্বশেষ বই ‘প্রত্যয় প্রতিজ্ঞা প্রতিভা’।
লেখক হিসেবে যতীন সরকার ২০১০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার, ২০০৭ সালে বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্যপদক, ২০০৫ সালে পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যু দর্শন গ্রন্থের জন্য প্রথম আলো বর্ষসেরা গ্রন্থ পুরস্কার পান। এ ছাড়া তিনি ড. এনামুল হক স্বর্ণপদক, খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার, মনিরুদ্দীন ইউসুফ সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা লাভ করেন।