alt

সারাদেশ

প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাটিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মাছ চাষিরা মাছ উৎপাদন বাড়াচ্ছে

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক, বরিশাল : সোমবার, ১৮ আগস্ট ২০২৫

ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

একের পর এক ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও অতি বর্ষণের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াই করেই বরিশাল অঞ্চলের মৎস্যজীবীরা ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ বাস্তব উদাহরন সৃষ্টি করলেও মাঠ পর্যায়ে কারিগরি সহায়তাসহ নানা সীমাবদ্ধতায় এ খাতের কাঙ্খিত উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। খাদ্য উদ্বৃত্ত বরিশাল অঞ্চল দুধ, ডিম ও মাংসের সঙ্গে মাছের উৎপাদনও এখন চাহিদার প্রায় দ্বিগুনের কাছে। তবে নানা সীমাবদ্ধতা সত্বেও গত এক দশকে দক্ষিণাঞ্চলে মাছের উৎপাদন প্রায় ৭৫% বৃদ্ধি পেয়ে ৩ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে এখন প্রায় আড়াই লাখ টন উদ্বৃত্ত এলাকা। এমনকি গত এক দশকে দেশে মাছের উৎপাদন ৫৩% বাড়লেও ১৪ লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত বরিশাল অঞ্চলে মৎস্যখাতে প্রবৃদ্ধির হার ৭৫%। মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, গত এক দশকে দক্ষিণাঞ্চলে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ১১২%। আর সারা দেশে ইলিশের ৬৬-৬৮% ভাগ আহরতি হয় বরিশালসহ সন্নিহিত অঞ্চলে।

এ অবস্থাতেই ‘অভায়শ্রম গড়ে তুলি-দেশী মাছে দেশভরি’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ থেকে সারা দেশের মত বরিশালেও জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ পালিত হতে যাচ্ছে। এ উপলক্ষে বরিশালে মৎস্য র‌্যলী ও বেলস পার্ক সংলগ্ন লেকে মাছের পোনা অবমুক্ততরণসহ শিল্পকলা অ্যাকাডেমী মিলনায়তনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে একজন মানুষের দৈনন্দিন ৬০ গ্রাম মাছের চাহিদার বিপরীতে আমাদের দেশে তা ইতোমধ্যে ৬৪ গ্রামে উন্নীত হয়েছে। ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমিক্ষা-২০১৮’এর হিসেব অনুযায়ী দেশের মোট জিডিপি’র ৩.৫৭% এবং কৃষিজ জিডিপির ২৫.৩০% মৎস্যখাতের অবদান। কিন্তু বরিশাল অঞ্চলে এ হার আরো বেশি বলে মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। অধিদপ্তরের মতে, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশরও বেশি মানুষ মৎস্য সেক্টর থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। ২০১৬-১৭ সালে দেশ মাছ উৎপাদনে স¦য়ম্ভরতা অর্জন করলেও আরো ৫ বছর আগেই বরিশাল এ খাতে স্বনির্ভর হয়েছে।

জাতিসংঘের ‘খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-ফাও’ এর ২০১৮ সনের প্রতিবেদন অনুযায়ী মুক্ত ও অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মাছ আহরনে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে তৃতীয় স্থানে এবং বদ্ধ জলাশয়ের মৎস্য উৎপাদনে ৫ম স্থানে রয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলও এক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এ অঞ্চলের ৪২টি উপজেলার প্রায় ২৬ হাজার হেক্টর বদ্ধ জলাশয়, ৪ লাখ ২৭ হাজার ৪৮২ হেক্টর উন্মুক্ত জলাশয় ছাড়াও প্রায় আড়াই হাজার বেসরকারি মৎস্য খামার, ৫০টির মত সরকারি-বেসরকারি মৎস্য হ্যাচারী, ৯২০টি নার্সারি খামার ছাড়াও প্রায় ৯ হাজার চিংড়ি খামার মৎস্য উৎপাদনে ব্যাপক অবদান রাখছে। মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষি ফসলের চেয়ে মাছে মুনফা বেশি হওয়ায় বরিশাল অঞ্চলের মানুষ মাছ চাষে ঝুঁকছে। তবে ২০০৮ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পরে মহাশেন, আম্পান, আয়লা ও সিত্রং ও হামুন এর মত ঘূর্ণিঝড়সহ বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালার প্রবল বর্ষণে বরিশাল অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক মাছের ঘের, পুকুর ও দীঘি প্লবিত হয়ে কোটি কোটি মাছ ও পোনা ভেসে গিয়ে চাষিরা সর্বশান্ত হচ্ছে বার বার। তবে তারা দমে থাকেনি। বরিশাল অঞ্চলের ৪২টি উপজেলাতেই মাছ চাষে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে বরিশালের ১১টি নদ-নদীকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে। যা এ অঞ্চলের উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বলে জানা গেছে।

তবে অব্যাহত নগরায়নের ফলে বরিশাল মহানগরীসহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলা শহরগুলোর পুকুর, দীঘি ও খালগুলো ক্রমাগত ভড়াট হয়ে যাচ্ছে। যা মৎস্য সেক্টরের জন্য একটি হুমকি বলেই মনে করছেন মৎস্য বিশেষজ্ঞগণ। এরপরেও বরিশাল অঞ্চলে ৪ লাখ ২৭ হাজার পুুকুর ও দীঘি, ৬৬৭টি বরোপীট, ৯০টি প্রবাহমান নদ-নদী, ৪৩টি বিল, একটি বাঁওড় বা মরা নদী, প্রায় দেড় হাজার খাল ও সোয়া ৬শ প্লাবন ভূমিসহ মোট ৫৪ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টরে কম বেশি মাছ উৎপাদন হচ্ছে। এ সব জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ২০০৮-০৯ সালে ২ লাখ ৯৮ হাজার টন থেকে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৫ লাখ ২৩ হাজার টন ও ২১-২২ অর্থ বছরে তা ৫ লাখ ৩২ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। যার মধ্যে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার টনের মত। ২১-২২ অর্থ বছরে দেশে ইলিশের সহনীয় আহরন ছিল ৫.৬৬ লাখ টন।

এছাড়াও ৬০ হাজার টন কার্প জাতীয় মাছ এবং পাঙ্গাস, শিং, মাগুর, কৈ, তেলাপিয়া এবং চিংড়ি ছাড়াও অন্য মাছের উৎপাদনও ছিল দেড় লাখ টনের মত। এ সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের সরকারি- বেসরকারি ৫০টি হ্যাচারি ও ৯২৩টি নার্সারীতে প্রায় ১৮ হাজার কেজি রেনু ও ২৫ লাখ ১৮ হাজার মাছের পোনা উৎপাদন হয়েছে।

বরিশাল অঞ্চলের প্রায় ৫ লাখ জেলে মৎস্য সেক্টরের ওপর নির্ভরশীল। যার মধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৩ লাখ ২ হাজার ৪৭৪।

অধিদপ্তরের মতে, এ অঞ্চলে জেলে পরিবারের সংখ্যা আড়াই লাখের মত। মৎস্য অধিদপ্তরের অপর এক পরিসংখ্যানে দেশের ৮টি বিভাগের মধ্যে শুধুমাত্র বরিশাল বিভাগেই সাড়ে ৩ লাখ জেলে ইলিশ আহরনে জড়িত। যার ৬৫% সার্বক্ষণিক ও ৩৫% খ-কালীন বলে জানা গেছে। বিগত ২২-২৩ অর্থ বছরে বরিশাল অঞ্চলের ২ হাজার জলাশয়ে রাজস্ব ও উন্নয়ন খাতে ৫৩ লাখ বিভিন্ন মাছের পোনা অবমুক্ত করেছে মৎস্য অধিদপ্তর।

সরকার ২০১২-১৩ অর্থ বছরকে ভিত্তি হিসেবে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দেশের মৎস্য চাষি ও মৎস্যজীবীদের আয় ২০% বৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারন করে। এলক্ষ্যে দক্ষিণাঞ্চলেও বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প ও কর্মসূচী গ্রহনের কথা জানান হয়েছে। দেশের বিভিন্ন উন্মূক্ত জলাশয়ে খাঁচায় মাছ চাষ কার্যক্রম অতীতে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও অতি সম্প্রতি তা কিছুটা স্তিমিত হয়ে পরেছে। বরিশাল অঞ্চলে বর্তমানে প্রায় দেড় হাজার খাঁচায় ১২শ মৎস্যজীবী মাছ চাষ করে বছরে প্রায় এক হাজার টন বিভিন্ন ধরনের মিঠা পানির মাছ উৎপাদন করছেন।

পাশাপাশি এ অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় কাকড়া ও কুচিয়া চাষ যথেষ্ট সম্প্রসারন ঘটছে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে এ অঞ্চলের ৩ হাজার টন কুচিয়া ও সাড়ে ৭শ খামারে ৩শ টন কাকড়া উৎপাদন হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর। ৬টি জেলার ১১টি উপজেলায় পুকুরে কিশোর কাকড়া চাষ, পেনে কাকড়া মোটাতাজা করন, খাঁচায় কাকড়া মোটাতাজা করন ও সামাজিক পর্যায়ে কুচিয়া চাষের ২৫টি প্রদর্শনী খামার স্থাপন করা হয়েছে।

এছাড়াও বরিশাল অঞ্চলের ৮টি উপজেলার প্রায় ৩ হাজার মৎসজীবী বছরে দেড় থেকে ২ হাজার টন শুটকি উৎপাদন করেছে। যার পুরোটাই ছিল রোদে শুকানোর মত লাগসই প্রযুক্তির এবং কীটনাশক মুক্ত বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে।

বরিশালের মৎস্য সেক্টর নিয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচলকের সঙ্গে আলাপ করা হলে তিনি বলেন, নদ-নদী বহুল দক্ষিণাঞ্চলে মাছ চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি উন্নত প্রযুক্তিতে মাছচাষ সম্প্রসারনে। এ লক্ষ্যে মাছ চাষে সাধারন মানুষকে আগ্রহী করে তোলাসহ সব মৎস্যচাষীকে উন্নত প্রযুক্তিতে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। অধিদপ্তরে জনবল সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিষয়টি সদর দপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে নিয়মিত অবহিত করা হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে এ সংকট কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

ছবি

পলাশে মৎস্য সপ্তাহ উদ্বোধনে বক্তারা , মৎস্য সম্পদ রক্ষায় সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন

ছবি

পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া-কাজীরহাট নৌ-পথে ফেরি চলাচল ব্যাহত ঘাটে ৪ কিলোমিটার যানজট যাত্রীদের দুর্ভোগ

ছবি

সিএমপি কমিশনারের ‘দেখামাত্র গুলির নির্দেশনা’ ফাঁস করে কনস্টেবল ধরা

ছবি

সিংড়ায় বাবার হাতে মাদকাসক্ত ছেলে নিহত

ছবি

বঙ্গোপসাগরে জেলের জালে ধরা পড়ল বিরল প্রজাতির ‘পাফার ফিশ’

ছবি

রাজশাহীতে পান বরজে কৃষকের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

ছবি

চান্দিনায় শিক্ষার্থীদের মাঝে গাছের চারা বিতরণ

ছবি

কুড়িগ্রামে দুর্যোগ মোকাবিলায় উঠান বৈঠকের সুফল পাচ্ছে দুর্যোগপ্রবণ এলাকার জনগোষ্ঠী

ছবি

চট্টগ্রামে মিষ্টি কারখানায় পোড়া তেল, লাখ টাকা জরিমানা

ছবি

মাদারগঞ্জে ৩০ হাজার মানুষের ভরসা নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো

ছবি

বগুড়ায় মাছ ধরার সময় ৬টি গ্রেনেড উদ্ধার

ছবি

নরসিংদীতে ঝুট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ৫

ছবি

বেগমগঞ্জে ভুয়া র‌্যাব গ্রেপ্তার

ছবি

বেগমগঞ্জে পলিথিন কারখানায় অভিযান, জরিমানা

ছবি

হবিগঞ্জে বাংলার ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা

ছবি

অবৈধ ড্রেজারে সয়লাব চান্দিনা ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ৬ ড্রেজার ধ্বংস

ছবি

জেলেদের সুরক্ষার দাবিতে সোচ্ছার মৎস্যজীবীরা

ছবি

নারীকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ

ছবি

মীরসরাইয়ে মহাসড়কের পাশে ধসে যাওয়া ড্রেন পড়ে আছে মাসের পর মাস

ছবি

ডুমুরিয়ায় বালুর বস্তায় টিকে আছে ইস্পাতের সেতু

ছবি

রুয়েটে প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত

ছবি

ডিমলায় বুড়ি তিস্তার ভাঙনে শতাধিক পরিবার গৃহহীন

ছবি

আদমদীঘিতে বিএনপি অফিসে হামলা মামলায় একজন গ্রেপ্তার

ছবি

বাগাতিপাড়ায় ডিবি পরিচয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে দুজন আটক

ছবি

চাটমোহরে মৎস্য সপ্তাহের উদ্বোধন

ছবি

শরীয়তপুরে অ্যাম্বুলেন্স চক্রের দৌরাত্ম্য, জিম্মি রোগীরা

ছবি

পানির দাবিতে পৌরবাসীর বিক্ষোভ মিছিল

ছবি

আদমদীঘিতে শিশুকন্যাকে যৌন নিপীড়ন, একজন গ্রেপ্তার

ছবি

বেগমগঞ্জে দুই জামায়াত কর্মী গুলিবিদ্ধ

ছবি

ভাঙ্গুড়ায় অজ্ঞাত দুই নারীর লাশ উদ্ধার

ছবি

কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জনবল সংকটে ব্যাহত সেবা

ছবি

মালিবাগের হোসাফ শপিং কমপ্লেক্সে এসি থেকে আগুন, ধোঁয়ায় আতঙ্ক

ছবি

মান্দায় রাণী নদীতে পড়ে প্রতিবন্ধী কিশোর নিহত

ছবি

দেয়ালে কিশোরীর ছবি সাঁটানোয় তরুণকে গ্রেপ্তার

ছবি

সাভারে ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনিতে যুবকের মৃত্যু

ছবি

শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে কোটি টাকার সরকারি জমি উদ্ধার

tab

সারাদেশ

প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাটিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মাছ চাষিরা মাছ উৎপাদন বাড়াচ্ছে

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক, বরিশাল

ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

সোমবার, ১৮ আগস্ট ২০২৫

একের পর এক ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও অতি বর্ষণের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াই করেই বরিশাল অঞ্চলের মৎস্যজীবীরা ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ বাস্তব উদাহরন সৃষ্টি করলেও মাঠ পর্যায়ে কারিগরি সহায়তাসহ নানা সীমাবদ্ধতায় এ খাতের কাঙ্খিত উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। খাদ্য উদ্বৃত্ত বরিশাল অঞ্চল দুধ, ডিম ও মাংসের সঙ্গে মাছের উৎপাদনও এখন চাহিদার প্রায় দ্বিগুনের কাছে। তবে নানা সীমাবদ্ধতা সত্বেও গত এক দশকে দক্ষিণাঞ্চলে মাছের উৎপাদন প্রায় ৭৫% বৃদ্ধি পেয়ে ৩ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে এখন প্রায় আড়াই লাখ টন উদ্বৃত্ত এলাকা। এমনকি গত এক দশকে দেশে মাছের উৎপাদন ৫৩% বাড়লেও ১৪ লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত বরিশাল অঞ্চলে মৎস্যখাতে প্রবৃদ্ধির হার ৭৫%। মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, গত এক দশকে দক্ষিণাঞ্চলে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ১১২%। আর সারা দেশে ইলিশের ৬৬-৬৮% ভাগ আহরতি হয় বরিশালসহ সন্নিহিত অঞ্চলে।

এ অবস্থাতেই ‘অভায়শ্রম গড়ে তুলি-দেশী মাছে দেশভরি’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ থেকে সারা দেশের মত বরিশালেও জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ পালিত হতে যাচ্ছে। এ উপলক্ষে বরিশালে মৎস্য র‌্যলী ও বেলস পার্ক সংলগ্ন লেকে মাছের পোনা অবমুক্ততরণসহ শিল্পকলা অ্যাকাডেমী মিলনায়তনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে একজন মানুষের দৈনন্দিন ৬০ গ্রাম মাছের চাহিদার বিপরীতে আমাদের দেশে তা ইতোমধ্যে ৬৪ গ্রামে উন্নীত হয়েছে। ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমিক্ষা-২০১৮’এর হিসেব অনুযায়ী দেশের মোট জিডিপি’র ৩.৫৭% এবং কৃষিজ জিডিপির ২৫.৩০% মৎস্যখাতের অবদান। কিন্তু বরিশাল অঞ্চলে এ হার আরো বেশি বলে মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। অধিদপ্তরের মতে, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশরও বেশি মানুষ মৎস্য সেক্টর থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। ২০১৬-১৭ সালে দেশ মাছ উৎপাদনে স¦য়ম্ভরতা অর্জন করলেও আরো ৫ বছর আগেই বরিশাল এ খাতে স্বনির্ভর হয়েছে।

জাতিসংঘের ‘খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-ফাও’ এর ২০১৮ সনের প্রতিবেদন অনুযায়ী মুক্ত ও অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মাছ আহরনে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে তৃতীয় স্থানে এবং বদ্ধ জলাশয়ের মৎস্য উৎপাদনে ৫ম স্থানে রয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলও এক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এ অঞ্চলের ৪২টি উপজেলার প্রায় ২৬ হাজার হেক্টর বদ্ধ জলাশয়, ৪ লাখ ২৭ হাজার ৪৮২ হেক্টর উন্মুক্ত জলাশয় ছাড়াও প্রায় আড়াই হাজার বেসরকারি মৎস্য খামার, ৫০টির মত সরকারি-বেসরকারি মৎস্য হ্যাচারী, ৯২০টি নার্সারি খামার ছাড়াও প্রায় ৯ হাজার চিংড়ি খামার মৎস্য উৎপাদনে ব্যাপক অবদান রাখছে। মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষি ফসলের চেয়ে মাছে মুনফা বেশি হওয়ায় বরিশাল অঞ্চলের মানুষ মাছ চাষে ঝুঁকছে। তবে ২০০৮ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পরে মহাশেন, আম্পান, আয়লা ও সিত্রং ও হামুন এর মত ঘূর্ণিঝড়সহ বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালার প্রবল বর্ষণে বরিশাল অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক মাছের ঘের, পুকুর ও দীঘি প্লবিত হয়ে কোটি কোটি মাছ ও পোনা ভেসে গিয়ে চাষিরা সর্বশান্ত হচ্ছে বার বার। তবে তারা দমে থাকেনি। বরিশাল অঞ্চলের ৪২টি উপজেলাতেই মাছ চাষে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে বরিশালের ১১টি নদ-নদীকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে। যা এ অঞ্চলের উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বলে জানা গেছে।

তবে অব্যাহত নগরায়নের ফলে বরিশাল মহানগরীসহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলা শহরগুলোর পুকুর, দীঘি ও খালগুলো ক্রমাগত ভড়াট হয়ে যাচ্ছে। যা মৎস্য সেক্টরের জন্য একটি হুমকি বলেই মনে করছেন মৎস্য বিশেষজ্ঞগণ। এরপরেও বরিশাল অঞ্চলে ৪ লাখ ২৭ হাজার পুুকুর ও দীঘি, ৬৬৭টি বরোপীট, ৯০টি প্রবাহমান নদ-নদী, ৪৩টি বিল, একটি বাঁওড় বা মরা নদী, প্রায় দেড় হাজার খাল ও সোয়া ৬শ প্লাবন ভূমিসহ মোট ৫৪ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টরে কম বেশি মাছ উৎপাদন হচ্ছে। এ সব জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ২০০৮-০৯ সালে ২ লাখ ৯৮ হাজার টন থেকে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৫ লাখ ২৩ হাজার টন ও ২১-২২ অর্থ বছরে তা ৫ লাখ ৩২ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। যার মধ্যে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার টনের মত। ২১-২২ অর্থ বছরে দেশে ইলিশের সহনীয় আহরন ছিল ৫.৬৬ লাখ টন।

এছাড়াও ৬০ হাজার টন কার্প জাতীয় মাছ এবং পাঙ্গাস, শিং, মাগুর, কৈ, তেলাপিয়া এবং চিংড়ি ছাড়াও অন্য মাছের উৎপাদনও ছিল দেড় লাখ টনের মত। এ সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের সরকারি- বেসরকারি ৫০টি হ্যাচারি ও ৯২৩টি নার্সারীতে প্রায় ১৮ হাজার কেজি রেনু ও ২৫ লাখ ১৮ হাজার মাছের পোনা উৎপাদন হয়েছে।

বরিশাল অঞ্চলের প্রায় ৫ লাখ জেলে মৎস্য সেক্টরের ওপর নির্ভরশীল। যার মধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৩ লাখ ২ হাজার ৪৭৪।

অধিদপ্তরের মতে, এ অঞ্চলে জেলে পরিবারের সংখ্যা আড়াই লাখের মত। মৎস্য অধিদপ্তরের অপর এক পরিসংখ্যানে দেশের ৮টি বিভাগের মধ্যে শুধুমাত্র বরিশাল বিভাগেই সাড়ে ৩ লাখ জেলে ইলিশ আহরনে জড়িত। যার ৬৫% সার্বক্ষণিক ও ৩৫% খ-কালীন বলে জানা গেছে। বিগত ২২-২৩ অর্থ বছরে বরিশাল অঞ্চলের ২ হাজার জলাশয়ে রাজস্ব ও উন্নয়ন খাতে ৫৩ লাখ বিভিন্ন মাছের পোনা অবমুক্ত করেছে মৎস্য অধিদপ্তর।

সরকার ২০১২-১৩ অর্থ বছরকে ভিত্তি হিসেবে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দেশের মৎস্য চাষি ও মৎস্যজীবীদের আয় ২০% বৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারন করে। এলক্ষ্যে দক্ষিণাঞ্চলেও বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প ও কর্মসূচী গ্রহনের কথা জানান হয়েছে। দেশের বিভিন্ন উন্মূক্ত জলাশয়ে খাঁচায় মাছ চাষ কার্যক্রম অতীতে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও অতি সম্প্রতি তা কিছুটা স্তিমিত হয়ে পরেছে। বরিশাল অঞ্চলে বর্তমানে প্রায় দেড় হাজার খাঁচায় ১২শ মৎস্যজীবী মাছ চাষ করে বছরে প্রায় এক হাজার টন বিভিন্ন ধরনের মিঠা পানির মাছ উৎপাদন করছেন।

পাশাপাশি এ অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় কাকড়া ও কুচিয়া চাষ যথেষ্ট সম্প্রসারন ঘটছে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে এ অঞ্চলের ৩ হাজার টন কুচিয়া ও সাড়ে ৭শ খামারে ৩শ টন কাকড়া উৎপাদন হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর। ৬টি জেলার ১১টি উপজেলায় পুকুরে কিশোর কাকড়া চাষ, পেনে কাকড়া মোটাতাজা করন, খাঁচায় কাকড়া মোটাতাজা করন ও সামাজিক পর্যায়ে কুচিয়া চাষের ২৫টি প্রদর্শনী খামার স্থাপন করা হয়েছে।

এছাড়াও বরিশাল অঞ্চলের ৮টি উপজেলার প্রায় ৩ হাজার মৎসজীবী বছরে দেড় থেকে ২ হাজার টন শুটকি উৎপাদন করেছে। যার পুরোটাই ছিল রোদে শুকানোর মত লাগসই প্রযুক্তির এবং কীটনাশক মুক্ত বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে।

বরিশালের মৎস্য সেক্টর নিয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচলকের সঙ্গে আলাপ করা হলে তিনি বলেন, নদ-নদী বহুল দক্ষিণাঞ্চলে মাছ চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি উন্নত প্রযুক্তিতে মাছচাষ সম্প্রসারনে। এ লক্ষ্যে মাছ চাষে সাধারন মানুষকে আগ্রহী করে তোলাসহ সব মৎস্যচাষীকে উন্নত প্রযুক্তিতে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। অধিদপ্তরে জনবল সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিষয়টি সদর দপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে নিয়মিত অবহিত করা হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে এ সংকট কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

back to top