দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য হঠাৎ করে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ট্রাক চলাচলের সীমাবদ্ধতার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমদানি কমেছে ৬ লাখ ৩১ হাজার ৩৩০ মেট্রিক টন এবং রপ্তানি কমেছে ৭৫ হাজার ২৩২ মেট্রিক টন। ফলে এ বন্দরকেন্দ্রীক ব্যবসা, শ্রমিক ও পরিবহন খাতে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। আগে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ভারত থেকে প্রায় ৫৫০ থেকে ৬০০ ট্রাক পণ্য আমদানি এবং ২৫০ থেকে ৩০০ ট্রাক পণ্য রপ্তানি হতো। এখন তা নেমে এসেছে ২৫০ থেকে ৩০০ ট্রাক। একই ভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতেও রপ্তানি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে দিনে ১০০ ট্রাকের নিচে। ফলে বেনাপোল ও পেট্রাপোল বন্দর এলাকায় পরিবহন, গুদাম, হ্যান্ডলিং শ্রমিক ও ব্যবসায় স্থবিরতা ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়েছে দু’দেশের বন্দর এলাকায়।
ভারত-বাংলাদেশের পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞায় দেশের সর্ববৃহৎ বেনাপোল স্থলবন্দরে বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি ও সংকট তৈরি হয়েছে। বৈশ্বিক মন্দা আর গত ৫ আগস্টের পর একের পর এক দু’দেশের পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞায় ধস নেমেছে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে। ভারত থেকে যেমন কমে আসছে আমদানিকৃত পণ্যবাহী ট্রাকের সংখ্যা, তেমনি ভারতে রপ্তানির ট্রাকও কমে আসছে। এর ফলে গভীর সংকটে পড়েছেন বেনাপোলের কয়েকশ’ সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মালিক, কর্মচারী ও বেনাপোল স্থলবন্দরে কর্মরত এক হাজারের বেশি শ্রমিক। ভারত-বাংলাদেশ রাজনৈতিক টানাপোড়েন, একাধিক নিষেধাজ্ঞা এবং কেন্দ্রীয় নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ীসহ শ্রমিকদের কাজ হারানোর আশঙ্কা ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠছে। ইতোমধ্যে অনেক সিআন্ডএফ অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। সিঅ্যান্ডএফ কর্মচারী ও শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। একই অবস্থা ওপারের পেট্রাপোল বন্দরে। ওপারের সরকারের বিরুদ্ধে ওপারের শ্রমিক-কর্মজীবী মানুষ প্রায় দিন মিছিল মিটিং করছে। তাদের দাবি স্থলপথে যেসব পণ্য আমদানি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সেগুলো আবার চালু করা হোক। ভারত সরকার কী কারণে একের পর এক এ পথে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করে দিয়ে ভারতীয়দের অসহনীয় দুভোর্গের মধ্যে ফেলেছে।
বাংলাদেশ স্থলবন্দরের পরিসংখ্যান বলছে, পণ্যে আমদানি নিষেধাজ্ঞা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ট্রাক চলাচলের সীমাবদ্ধতার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল ২১ লাখ ৩০ হাজার ২২৮ মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের পণ্য। অন্যদিকে কাস্টমসের পরিসংখ্যান বলছে, গেল ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ১৪ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৮ মেট্রিক টন পণ্য। এতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চাইতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমদানি বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়েছে ৬ লাখ ৩১ হাজার ৩৩০ মেট্রিক টন। অন্যদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পণ্য ভারত রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৬৭২ মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের পণ্য। অন্যদিকে গেল ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারতে রপ্তানি হয়েছে ৩ লাখ ৮১ হাজার ৪৪০ মেট্রিক টন পণ্য। এতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চাইতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এসে রপ্তানি কমেছে ৭৫ হাজার ২৩২ মেট্রিক টন।
গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত চ্যাচিস বাদে আমদানি-রপ্তানিতে ধস নেমেছে। এ সময়ে আমদানি হয়েছে ৫৫ হাজার ৩৯০ ট্রাক পণ্য ও রপ্তানি হয়েছে ২১ হাজার ৭৩৮ ট্রাক পণ্য। চলতি আগস্ট মাসে আমদানি-রপ্তানিতে ব্যাপক ধস নামতে শুরু করেছে। গত ২ আগস্ট থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ছুটি বাদে ১১ দিনে মাত্র ৩২০৬ ট্রাক পণ্য ভারত থেকে আমদানি হয়েছে আর ভারতে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৫৯৩ ট্রাক পণ্য। যা গড়ে আমদানির ক্ষেত্রে প্রতিদিন ২৯০ ট্রাক ও রপ্তানির ক্ষেত্রে ৫৩ ট্রাক।
আমদানি পণ্যের মধ্যে ছিল শিল্প কারখানার কাঁচামাল, তৈরি পোশাক, গার্মেন্টস, শিশু খাদ্য, মাছ, কেমিক্যাল, মোটরপার্টস, কসমেটিকসসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য। এর মধ্যে উচ্চ শুল্কারোপকৃত পণ্যের আমদানি কমে গেছে। অন্যদিকে রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ছিল পাট, পাটের তৈরি পণ্য, তৈরি পোশাক, কেমিক্যাল, বসুন্ধরা টিস্যু, মেলামাইন, মাছ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু দু’দেশের সরকারের বিধি-নিষেধের কারণে পূর্বের তুলনায় বর্তমানে তা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে।
বন্দরসংশ্লিস্ট ব্যবসায়ীরা জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে দেশের সর্ববৃহৎ বেনাপোল স্থলবন্দরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য টানাপোড়েন চলছেই। বাণিজ্য কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা, বাণিজ্য কমে যাওয়ায় কমে গেছে কাজকর্ম। ফলে আয়ও কমে গেছে। দু’দেশের মধ্যে বিধি-নিষেধ আরোপ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন ক্ষতির মুখে থাকা ব্যবসায়ীরা। গত বছর গণআন্দোলনের জেরে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা হারায় এবং দেশ ছেড়ে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ভারতে আশ্রয় নেন। তারপর থেকেই দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বাণিজ্যবান্ধব নীতিই পারে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে।
বন্দরের ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা ও আমদানি বিধি-নিষেধ শিথিল না করলে বেনাপোল বন্দরের বাণিজ্য আরও তলানিতে পৌঁছাবে। এ অবস্থায় সরকার ও বেসরকারি খাতের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এ সংকট কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাণিজ্যিক সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞায় গত ৮ এপ্রিল থেকে ভারতের আকাশ পথ ব্যবহার করে বাইরের দেশে বাংলাদেশি পণ্য স্থলপথে রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ টেক্সাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের দাবিতে দেশীয় শিল্প রক্ষার কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশ সরকার স্থলপথে ভারত থেকে সুতা আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। পরবর্তী ১৭ মে ভারত সরকার আরেকটি নিষেধাজ্ঞায় গার্মেন্টস, তৈরি পোশাক, তুলা, সুতির বর্জ্য, প্লাস্টিক, কাঠের তৈরি আসবাবপত্র ও ফল জাতীয় পণ্য স্থলপথে রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এছাড়া গত ২৬ জুনে পাট ও পাট তৈরি পণ্য স্থলপথে রপ্তানি বন্ধ করে ভারত।
সর্বশেষ গত সোমবার নতুন করে বস্ত্র ও পাটজাত চার ধরনের পণ্য স্থলবন্দর ব্যবহার করে আমদানিতে না করেছে ভারত। এগুলো হলো- পাট কিংবা অন্য কোনো ধরনের উদ্ভিজ্জ তন্তু থেকে উৎপাদিত কাপড়, পাট দিয়ে তৈরি দড়ি, রশি, সুতলি ইত্যাদি অন্য তন্তু দিয়ে তৈরি দড়ি, রশি, সুতলি এবং পাটের বস্তা ও ব্যাগ।
ভারতের পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং এজেন্টস স্টাফ ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তীর মতে, দুই দেশের পক্ষ থেকে একাধিক বিধিনিষেধ এ সংকটের মূলে। ভারত বাংলাদেশকে দেয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে ৮ এপ্রিল, আর ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পাশাপাশি ভারতও কিছু পণ্যের আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার ফলে ব্যবসায়ী, শ্রমিক, পরিবহন সংস্থা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে।
ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি অরুণাভ পোদ্দার (দেবু) বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত আমাদের মেনে নিতে হবে। তবে এক্ষেত্রে শ্রমিকদের কথাও সরকারের ভাবা উচিত। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের পেট্রাপোল এবং তৎসংলগ্ন এলাকার অনেক মানুষের রুটি রুজির একমাত্র ঠিকানা পেট্রাপোল বন্দর। যে হারে আমদানি কমছে, তাতে আমাদের লোড-আনলোডের কাজও বন্ধ হতে বসেছে। যা শ্রমিকদের রোজগারে বড়সড় প্রভাব ফেলছে। বর্তমানে কেউ কেউ দৈনিক ১০০ টাকাও উপার্জন করতে পারছেন না। অনেকেই রাজমিস্ত্রির জোগালি কিংবা মাঠের কাজ করছেন। তবে বর্ষার কারণে তাও জোটে না। পরিবারের মুখে দু’বেলা খাবার তুলে দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। পণ্য লোডিং-আনলোডিং, গোডাউন সংরক্ষণ, ক্লিয়ারিং প্রক্রিয়াসহ নানা স্তরে কাজ করে আসছিলেন কয়েক হাজার মুটে-মজদুর ও সাধারণ শ্রমিক। আজ অনেকে বেকার হয়ে বসে আছে।
বেনাপোল ল্যান্ডপোর্ট ইমপোর্টাস অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান জানান, এ বন্দর দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের সিংহভাগ বাণিজ্য সম্পন্ন হলেও ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পালাবদলের পর কমেছে পণ্যবাহী ট্রাক আসা যাওয়া। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বাণিজ্য কমে গেছে। বাণিজ্যের পরিমাণ কমে আসায় বন্দর দিয়ে সরকারের রাজস্ব আয়েও প্রভাব পড়েছে। এতে শুধু বাংলাদেশের নয় ভারতের ক্ষতি হচ্ছে। তিনি আরও জানান, দু’দেশের পক্ষ থেকে আরোপিত নানা বিধি-নিষেধই বাণিজ্যের এ ধসের মূল কারণ। দ্রুত এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ব্যবসায়ীরা জানান, বেনাপোল বন্দরে বাণিজ্য স্বাভাবিক করতে হলে ভিসা নীতি সহজ করতে হবে। আগে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিক ভিসায় ভারতে গিয়ে সরাসরি পণ্য দেখে, বেছে নিয়ে আমদানি করতো। বর্তমান দু’দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক অবনতি হওয়ায় বাণিজ্যে ভিসা বন্ধ রয়েছে। ফলে আমদানি-রপ্তানি দুটোই কমে যাচ্ছে। ভারতে যেতে না পেরে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনিশ্চিয়তা কাজ করছে। নতুন করে উদ্যোক্তা ও আমদানিকারকরা কেউ ঝুঁকি নিতে চাইছেন না।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, একের পর এক যেসব পণ্য বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানিতে স্থল বন্দর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আসছে, সেগুলোর প্রায় পুরোটাই ভারতে রপ্তানি করা হতো স্থল বন্দর ব্যবহার করেই। এখন সেগুলো সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে পাঠাতে হলে একদিকে সময় যেমন বেশি লাগবে, অন্যদিকে খরচও বাড়বে।
বেনাপোল বন্দরের পরিচালক মো. শামিম হোসেন বলেন, বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে বেশ কিছু পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে দু’দেশের সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যার অধিকাংশ উৎপাদন হয় দেশেই। এসব পণ্য আমদানি না করায় স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বাণিজ্য অনেক কমে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ভারত থেকে প্রায় ৫৫০ ট্রাক পণ্য আমদানি এবং ২৫০ থেকে ৩০০ ট্রাক পণ্য রপ্তানি হতো। এখন তা নেমে এসেছে ২৫০ ট্রাক ও রপ্তানি ১০০ ট্রাকের নিচে। গত সোমবার আমদানি হয়েছে ২৯১ ট্রাক ও রপ্তানি হয়েছে ৫০ ট্রাক পণ্য।
মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট ২০২৫
দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য হঠাৎ করে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ট্রাক চলাচলের সীমাবদ্ধতার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমদানি কমেছে ৬ লাখ ৩১ হাজার ৩৩০ মেট্রিক টন এবং রপ্তানি কমেছে ৭৫ হাজার ২৩২ মেট্রিক টন। ফলে এ বন্দরকেন্দ্রীক ব্যবসা, শ্রমিক ও পরিবহন খাতে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। আগে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ভারত থেকে প্রায় ৫৫০ থেকে ৬০০ ট্রাক পণ্য আমদানি এবং ২৫০ থেকে ৩০০ ট্রাক পণ্য রপ্তানি হতো। এখন তা নেমে এসেছে ২৫০ থেকে ৩০০ ট্রাক। একই ভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতেও রপ্তানি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে দিনে ১০০ ট্রাকের নিচে। ফলে বেনাপোল ও পেট্রাপোল বন্দর এলাকায় পরিবহন, গুদাম, হ্যান্ডলিং শ্রমিক ও ব্যবসায় স্থবিরতা ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়েছে দু’দেশের বন্দর এলাকায়।
ভারত-বাংলাদেশের পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞায় দেশের সর্ববৃহৎ বেনাপোল স্থলবন্দরে বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি ও সংকট তৈরি হয়েছে। বৈশ্বিক মন্দা আর গত ৫ আগস্টের পর একের পর এক দু’দেশের পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞায় ধস নেমেছে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে। ভারত থেকে যেমন কমে আসছে আমদানিকৃত পণ্যবাহী ট্রাকের সংখ্যা, তেমনি ভারতে রপ্তানির ট্রাকও কমে আসছে। এর ফলে গভীর সংকটে পড়েছেন বেনাপোলের কয়েকশ’ সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মালিক, কর্মচারী ও বেনাপোল স্থলবন্দরে কর্মরত এক হাজারের বেশি শ্রমিক। ভারত-বাংলাদেশ রাজনৈতিক টানাপোড়েন, একাধিক নিষেধাজ্ঞা এবং কেন্দ্রীয় নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ীসহ শ্রমিকদের কাজ হারানোর আশঙ্কা ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠছে। ইতোমধ্যে অনেক সিআন্ডএফ অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। সিঅ্যান্ডএফ কর্মচারী ও শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। একই অবস্থা ওপারের পেট্রাপোল বন্দরে। ওপারের সরকারের বিরুদ্ধে ওপারের শ্রমিক-কর্মজীবী মানুষ প্রায় দিন মিছিল মিটিং করছে। তাদের দাবি স্থলপথে যেসব পণ্য আমদানি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সেগুলো আবার চালু করা হোক। ভারত সরকার কী কারণে একের পর এক এ পথে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করে দিয়ে ভারতীয়দের অসহনীয় দুভোর্গের মধ্যে ফেলেছে।
বাংলাদেশ স্থলবন্দরের পরিসংখ্যান বলছে, পণ্যে আমদানি নিষেধাজ্ঞা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ট্রাক চলাচলের সীমাবদ্ধতার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল ২১ লাখ ৩০ হাজার ২২৮ মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের পণ্য। অন্যদিকে কাস্টমসের পরিসংখ্যান বলছে, গেল ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ১৪ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৮ মেট্রিক টন পণ্য। এতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চাইতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমদানি বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়েছে ৬ লাখ ৩১ হাজার ৩৩০ মেট্রিক টন। অন্যদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পণ্য ভারত রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৬৭২ মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের পণ্য। অন্যদিকে গেল ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারতে রপ্তানি হয়েছে ৩ লাখ ৮১ হাজার ৪৪০ মেট্রিক টন পণ্য। এতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চাইতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এসে রপ্তানি কমেছে ৭৫ হাজার ২৩২ মেট্রিক টন।
গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত চ্যাচিস বাদে আমদানি-রপ্তানিতে ধস নেমেছে। এ সময়ে আমদানি হয়েছে ৫৫ হাজার ৩৯০ ট্রাক পণ্য ও রপ্তানি হয়েছে ২১ হাজার ৭৩৮ ট্রাক পণ্য। চলতি আগস্ট মাসে আমদানি-রপ্তানিতে ব্যাপক ধস নামতে শুরু করেছে। গত ২ আগস্ট থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ছুটি বাদে ১১ দিনে মাত্র ৩২০৬ ট্রাক পণ্য ভারত থেকে আমদানি হয়েছে আর ভারতে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৫৯৩ ট্রাক পণ্য। যা গড়ে আমদানির ক্ষেত্রে প্রতিদিন ২৯০ ট্রাক ও রপ্তানির ক্ষেত্রে ৫৩ ট্রাক।
আমদানি পণ্যের মধ্যে ছিল শিল্প কারখানার কাঁচামাল, তৈরি পোশাক, গার্মেন্টস, শিশু খাদ্য, মাছ, কেমিক্যাল, মোটরপার্টস, কসমেটিকসসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য। এর মধ্যে উচ্চ শুল্কারোপকৃত পণ্যের আমদানি কমে গেছে। অন্যদিকে রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ছিল পাট, পাটের তৈরি পণ্য, তৈরি পোশাক, কেমিক্যাল, বসুন্ধরা টিস্যু, মেলামাইন, মাছ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু দু’দেশের সরকারের বিধি-নিষেধের কারণে পূর্বের তুলনায় বর্তমানে তা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে।
বন্দরসংশ্লিস্ট ব্যবসায়ীরা জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে দেশের সর্ববৃহৎ বেনাপোল স্থলবন্দরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য টানাপোড়েন চলছেই। বাণিজ্য কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা, বাণিজ্য কমে যাওয়ায় কমে গেছে কাজকর্ম। ফলে আয়ও কমে গেছে। দু’দেশের মধ্যে বিধি-নিষেধ আরোপ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন ক্ষতির মুখে থাকা ব্যবসায়ীরা। গত বছর গণআন্দোলনের জেরে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা হারায় এবং দেশ ছেড়ে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ভারতে আশ্রয় নেন। তারপর থেকেই দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বাণিজ্যবান্ধব নীতিই পারে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে।
বন্দরের ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা ও আমদানি বিধি-নিষেধ শিথিল না করলে বেনাপোল বন্দরের বাণিজ্য আরও তলানিতে পৌঁছাবে। এ অবস্থায় সরকার ও বেসরকারি খাতের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এ সংকট কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাণিজ্যিক সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞায় গত ৮ এপ্রিল থেকে ভারতের আকাশ পথ ব্যবহার করে বাইরের দেশে বাংলাদেশি পণ্য স্থলপথে রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ টেক্সাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের দাবিতে দেশীয় শিল্প রক্ষার কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশ সরকার স্থলপথে ভারত থেকে সুতা আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। পরবর্তী ১৭ মে ভারত সরকার আরেকটি নিষেধাজ্ঞায় গার্মেন্টস, তৈরি পোশাক, তুলা, সুতির বর্জ্য, প্লাস্টিক, কাঠের তৈরি আসবাবপত্র ও ফল জাতীয় পণ্য স্থলপথে রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এছাড়া গত ২৬ জুনে পাট ও পাট তৈরি পণ্য স্থলপথে রপ্তানি বন্ধ করে ভারত।
সর্বশেষ গত সোমবার নতুন করে বস্ত্র ও পাটজাত চার ধরনের পণ্য স্থলবন্দর ব্যবহার করে আমদানিতে না করেছে ভারত। এগুলো হলো- পাট কিংবা অন্য কোনো ধরনের উদ্ভিজ্জ তন্তু থেকে উৎপাদিত কাপড়, পাট দিয়ে তৈরি দড়ি, রশি, সুতলি ইত্যাদি অন্য তন্তু দিয়ে তৈরি দড়ি, রশি, সুতলি এবং পাটের বস্তা ও ব্যাগ।
ভারতের পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং এজেন্টস স্টাফ ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তীর মতে, দুই দেশের পক্ষ থেকে একাধিক বিধিনিষেধ এ সংকটের মূলে। ভারত বাংলাদেশকে দেয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে ৮ এপ্রিল, আর ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পাশাপাশি ভারতও কিছু পণ্যের আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার ফলে ব্যবসায়ী, শ্রমিক, পরিবহন সংস্থা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে।
ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি অরুণাভ পোদ্দার (দেবু) বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত আমাদের মেনে নিতে হবে। তবে এক্ষেত্রে শ্রমিকদের কথাও সরকারের ভাবা উচিত। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের পেট্রাপোল এবং তৎসংলগ্ন এলাকার অনেক মানুষের রুটি রুজির একমাত্র ঠিকানা পেট্রাপোল বন্দর। যে হারে আমদানি কমছে, তাতে আমাদের লোড-আনলোডের কাজও বন্ধ হতে বসেছে। যা শ্রমিকদের রোজগারে বড়সড় প্রভাব ফেলছে। বর্তমানে কেউ কেউ দৈনিক ১০০ টাকাও উপার্জন করতে পারছেন না। অনেকেই রাজমিস্ত্রির জোগালি কিংবা মাঠের কাজ করছেন। তবে বর্ষার কারণে তাও জোটে না। পরিবারের মুখে দু’বেলা খাবার তুলে দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। পণ্য লোডিং-আনলোডিং, গোডাউন সংরক্ষণ, ক্লিয়ারিং প্রক্রিয়াসহ নানা স্তরে কাজ করে আসছিলেন কয়েক হাজার মুটে-মজদুর ও সাধারণ শ্রমিক। আজ অনেকে বেকার হয়ে বসে আছে।
বেনাপোল ল্যান্ডপোর্ট ইমপোর্টাস অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান জানান, এ বন্দর দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের সিংহভাগ বাণিজ্য সম্পন্ন হলেও ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পালাবদলের পর কমেছে পণ্যবাহী ট্রাক আসা যাওয়া। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বাণিজ্য কমে গেছে। বাণিজ্যের পরিমাণ কমে আসায় বন্দর দিয়ে সরকারের রাজস্ব আয়েও প্রভাব পড়েছে। এতে শুধু বাংলাদেশের নয় ভারতের ক্ষতি হচ্ছে। তিনি আরও জানান, দু’দেশের পক্ষ থেকে আরোপিত নানা বিধি-নিষেধই বাণিজ্যের এ ধসের মূল কারণ। দ্রুত এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ব্যবসায়ীরা জানান, বেনাপোল বন্দরে বাণিজ্য স্বাভাবিক করতে হলে ভিসা নীতি সহজ করতে হবে। আগে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিক ভিসায় ভারতে গিয়ে সরাসরি পণ্য দেখে, বেছে নিয়ে আমদানি করতো। বর্তমান দু’দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক অবনতি হওয়ায় বাণিজ্যে ভিসা বন্ধ রয়েছে। ফলে আমদানি-রপ্তানি দুটোই কমে যাচ্ছে। ভারতে যেতে না পেরে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনিশ্চিয়তা কাজ করছে। নতুন করে উদ্যোক্তা ও আমদানিকারকরা কেউ ঝুঁকি নিতে চাইছেন না।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, একের পর এক যেসব পণ্য বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানিতে স্থল বন্দর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আসছে, সেগুলোর প্রায় পুরোটাই ভারতে রপ্তানি করা হতো স্থল বন্দর ব্যবহার করেই। এখন সেগুলো সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে পাঠাতে হলে একদিকে সময় যেমন বেশি লাগবে, অন্যদিকে খরচও বাড়বে।
বেনাপোল বন্দরের পরিচালক মো. শামিম হোসেন বলেন, বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে বেশ কিছু পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে দু’দেশের সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যার অধিকাংশ উৎপাদন হয় দেশেই। এসব পণ্য আমদানি না করায় স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বাণিজ্য অনেক কমে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ভারত থেকে প্রায় ৫৫০ ট্রাক পণ্য আমদানি এবং ২৫০ থেকে ৩০০ ট্রাক পণ্য রপ্তানি হতো। এখন তা নেমে এসেছে ২৫০ ট্রাক ও রপ্তানি ১০০ ট্রাকের নিচে। গত সোমবার আমদানি হয়েছে ২৯১ ট্রাক ও রপ্তানি হয়েছে ৫০ ট্রাক পণ্য।