বাংলাদেশে চায়ের সুবাস বহুদিন ধরেই গ্রামীণ আড্ডার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে এখন ধীরে ধীরে সেই চায়ের বিকল্প হিসেবে জায়গা করে নিচ্ছে কফি। রাজধানী থেকে শুরু করে জেলা শহর, এমনকি গ্রামীণ চায়ের দোকানেও কফির কাপ সাজানো হয় গরম ধোঁয়া তুলে।
কফির বাজার বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে এর চাষও। দীর্ঘ দুই যুগ আগে পাহাড়ে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে পরীক্ষামূলকভাবে কফি চাষ শুরু হয়েছিল। সেই ছোট উদ্যোগ আজ রূপ নিচ্ছে বাণিজ্যিক সম্ভাবনায়। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির ঢালু জমি এখন সবুজ কফি গাছে ভরে উঠছে।
কেবল পাহাড়েই নয়, সিলেট বিভাগের অনাবাদি টিলাতেও ছড়িয়ে পড়েছে কফি চাষ। গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ ও জৈন্তাপুরে প্রায় ২০ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে অ্যারাবিকা ও রোবাস্টা। অনাবাদি টিলাকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় উদ্যোক্তারা নতুন অর্থনীতির স্বপ্ন দেখছেন।
কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে প্রবাসী বিনিয়োগকারীরাও এগিয়ে এসেছেন। তারা বলছেন, কয়েক বছর আগে যে জমি ঝোপঝাড়ে ভরে গিয়েছিল, আজ সেখানে সারি সারি কফি গাছ। ইতিমধ্যে কিছু বাগানে ফল এসেছে, আগামী দুই বছরের মধ্যে বাজারজাত করার প্রস্তুতিও চলছে।
বান্দরবানের পাহাড়ি গ্রামে এখন শুধু ফলের বাগান নয়, কফির সারি সারি চারা। কৃষকরা বলছেন, তিন বছর পরেই গাছ ফল দেয়, আর দামও অন্যান্য ফসলের তুলনায় অনেক ভালো। পাহাড়ি কৃষক সুরেন চাকমার ভাষায়, সেচ দিলে কফির ফলন বেড়ে যায়, তাছাড়া অন্য ফসলের মতো আলাদা জমিরও প্রয়োজন হয় না।
অ্যারাবিকা আর রোবাস্টা দুটি জাতের কফি বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। অ্যারাবিকা সাধারণত উঁচু জমিতে ভালো হয়, আর রোবাস্টা জন্মায় প্রায় সব উচ্চতায়। প্রতি হেক্টরে রোবাস্টার ফলন ৭,৫০০ থেকে ১১,০০০ কেজি পর্যন্ত হয়, যা অর্থনৈতিকভাবে কৃষকদের আকৃষ্ট করছে। বাংলাদেশে ২০২২ সালে মাত্র ৬২ টন কফি উৎপাদন হয়েছে, অথচ চাহিদা প্রায় ৯০০ থেকে ১,০০০ টন। অর্থাৎ, স্থানীয় উৎপাদন দিয়ে চাহিদার খুব অল্প অংশই পূরণ করা সম্ভব হয়েছে, বাকি প্রায় পুরোটাই আসছে আমদানির মাধ্যমে। অথচ স্থানীয় বাজারের হিসাবই প্রায় ৫০০ কোটি টাকার।
নতুন প্রজন্মের কফি-প্রীতি এই বাজারকে আরও উষ্ণ করে তুলছে। রাজধানীর অভিজাত কফিশপ থেকে শুরু করে গ্রামের রাস্তার পাশের চায়ের দোকান—সব জায়গাতেই কফি পাওয়া যাচ্ছে এখন।
কফি চাষ সম্প্রসারণে সরকারি উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য। কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রায় ২১১ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যার আওতায় রয়েছে প্রদর্শনী প্লট, উন্নতমানের চারা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা। ৭৫টি হর্টিকালচার সেন্টারে এখন কফির চারা উৎপাদিত হচ্ছে, নির্ধারিত মূল্যে কৃষকদের সরবরাহ করা হচ্ছে।
এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় বহু কফি বাগান গড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল ও টিলার মাটি ও জলবায়ু কফি চাষের জন্য আদর্শ। অনাবাদি জমিকে আবাদে এনে কৃষকরা নতুন আয়ের উৎস পাচ্ছেন। শুধু স্থানীয় বাজার নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও বাংলাদেশের কফি জায়গা করে নিতে পারে। যথাযথ উদ্যোগ, আধুনিক প্রক্রিয়াজাত প্রযুক্তি ও দক্ষ মানবসম্পদ থাকলে কফি হতে পারে দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল। যেমন একসময় চা বাংলাদেশের পাহাড়ি অর্থনীতিকে বদলে দিয়েছিল, তেমনি কফিও দিতে পারে নতুন স্বপ্নের সুবাস।
বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট ২০২৫
বাংলাদেশে চায়ের সুবাস বহুদিন ধরেই গ্রামীণ আড্ডার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে এখন ধীরে ধীরে সেই চায়ের বিকল্প হিসেবে জায়গা করে নিচ্ছে কফি। রাজধানী থেকে শুরু করে জেলা শহর, এমনকি গ্রামীণ চায়ের দোকানেও কফির কাপ সাজানো হয় গরম ধোঁয়া তুলে।
কফির বাজার বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে এর চাষও। দীর্ঘ দুই যুগ আগে পাহাড়ে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে পরীক্ষামূলকভাবে কফি চাষ শুরু হয়েছিল। সেই ছোট উদ্যোগ আজ রূপ নিচ্ছে বাণিজ্যিক সম্ভাবনায়। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির ঢালু জমি এখন সবুজ কফি গাছে ভরে উঠছে।
কেবল পাহাড়েই নয়, সিলেট বিভাগের অনাবাদি টিলাতেও ছড়িয়ে পড়েছে কফি চাষ। গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ ও জৈন্তাপুরে প্রায় ২০ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে অ্যারাবিকা ও রোবাস্টা। অনাবাদি টিলাকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় উদ্যোক্তারা নতুন অর্থনীতির স্বপ্ন দেখছেন।
কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে প্রবাসী বিনিয়োগকারীরাও এগিয়ে এসেছেন। তারা বলছেন, কয়েক বছর আগে যে জমি ঝোপঝাড়ে ভরে গিয়েছিল, আজ সেখানে সারি সারি কফি গাছ। ইতিমধ্যে কিছু বাগানে ফল এসেছে, আগামী দুই বছরের মধ্যে বাজারজাত করার প্রস্তুতিও চলছে।
বান্দরবানের পাহাড়ি গ্রামে এখন শুধু ফলের বাগান নয়, কফির সারি সারি চারা। কৃষকরা বলছেন, তিন বছর পরেই গাছ ফল দেয়, আর দামও অন্যান্য ফসলের তুলনায় অনেক ভালো। পাহাড়ি কৃষক সুরেন চাকমার ভাষায়, সেচ দিলে কফির ফলন বেড়ে যায়, তাছাড়া অন্য ফসলের মতো আলাদা জমিরও প্রয়োজন হয় না।
অ্যারাবিকা আর রোবাস্টা দুটি জাতের কফি বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। অ্যারাবিকা সাধারণত উঁচু জমিতে ভালো হয়, আর রোবাস্টা জন্মায় প্রায় সব উচ্চতায়। প্রতি হেক্টরে রোবাস্টার ফলন ৭,৫০০ থেকে ১১,০০০ কেজি পর্যন্ত হয়, যা অর্থনৈতিকভাবে কৃষকদের আকৃষ্ট করছে। বাংলাদেশে ২০২২ সালে মাত্র ৬২ টন কফি উৎপাদন হয়েছে, অথচ চাহিদা প্রায় ৯০০ থেকে ১,০০০ টন। অর্থাৎ, স্থানীয় উৎপাদন দিয়ে চাহিদার খুব অল্প অংশই পূরণ করা সম্ভব হয়েছে, বাকি প্রায় পুরোটাই আসছে আমদানির মাধ্যমে। অথচ স্থানীয় বাজারের হিসাবই প্রায় ৫০০ কোটি টাকার।
নতুন প্রজন্মের কফি-প্রীতি এই বাজারকে আরও উষ্ণ করে তুলছে। রাজধানীর অভিজাত কফিশপ থেকে শুরু করে গ্রামের রাস্তার পাশের চায়ের দোকান—সব জায়গাতেই কফি পাওয়া যাচ্ছে এখন।
কফি চাষ সম্প্রসারণে সরকারি উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য। কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রায় ২১১ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যার আওতায় রয়েছে প্রদর্শনী প্লট, উন্নতমানের চারা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা। ৭৫টি হর্টিকালচার সেন্টারে এখন কফির চারা উৎপাদিত হচ্ছে, নির্ধারিত মূল্যে কৃষকদের সরবরাহ করা হচ্ছে।
এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় বহু কফি বাগান গড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল ও টিলার মাটি ও জলবায়ু কফি চাষের জন্য আদর্শ। অনাবাদি জমিকে আবাদে এনে কৃষকরা নতুন আয়ের উৎস পাচ্ছেন। শুধু স্থানীয় বাজার নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও বাংলাদেশের কফি জায়গা করে নিতে পারে। যথাযথ উদ্যোগ, আধুনিক প্রক্রিয়াজাত প্রযুক্তি ও দক্ষ মানবসম্পদ থাকলে কফি হতে পারে দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল। যেমন একসময় চা বাংলাদেশের পাহাড়ি অর্থনীতিকে বদলে দিয়েছিল, তেমনি কফিও দিতে পারে নতুন স্বপ্নের সুবাস।