ঘরে সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভ্যানগাড়ি। তাতে মালামাল তুলছেন শামীম। তার বোন আসমা কুমুদিনী বাগান ছেড়ে যাচ্ছেন। তল্লার সরদারপাড়া এলাকায় মাসে ৪ হাজার টাকায় এক কক্ষের একটি ঘর ভাড়া করেছেন। নতুন বাসস্থানে ঘরের আসবাবপত্র নেওয়া হচ্ছে। বোনকে সহযোগিতা করছেন শামীম। শুধু আসমা নন শহরের খানপুর এলাকার উত্তর কুমুদিনী ছেড়ে যাচ্ছেন অনেকেই। জানতে চাইলে একজন বললেন, ‘আতঙ্কে ঘর ছাড়তেছি, আনন্দে না।’
কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের বেঙ্গল বিডি লিমিটেড পাট কারখানার আড়াইশ’ শ্রমিক পরিবার বাস করেন উত্তর কুমুদিনী বাগানে। আরও একশ’ বিহারি পরিবারও থাকে এই বাগানে। নারায়ণগঞ্জে কুমুদিনী ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্স এন্ড ক্যান্সার রিসার্চ (কেআইআইএমএস কেয়ার) স্থাপন করা হবে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। এই প্রকল্পের আওতাধীন ছাত্রী হোস্টেল নির্মাণের জন্য ঈশা খাঁ সড়কের নারায়ণগঞ্জ ৩শ’ শয্যা হাসপাতালের পাশের উত্তর কুমুদিনী বাগানের জায়গা নেওয়া হবে। এজন্য এই বাগানে বসবাসরত শ্রমিকদের ঘর ছাড়তে হবে। তবে শ্রমিকদের দাবি ছিল, দীর্ঘদিন জুট প্রেসে (পাট কারখানা) কাজ করা শ্রমিকদের শ্রম আইন অনুযায়ী পাওনাদি পরিশোধের। অন্যথায় পুনর্বাসন দাবি করেছিলেন তারা।
শ্রমিকদের দাবি থাকলেও মালিকপক্ষ তা দিতে নারাজ। গত ৮ জুন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাংসদ একেএম সেলিম ওসমানের উপস্থিতিতে এক বৈঠকে ঘর ছেড়ে দিলে মালামাল আনা-নেওয়া বাবদ ৩ হাজার টাকা প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। আগামী ৩০ জুনের মধ্যে এই শর্তে ঘর ছেড়ে দিতে হবে। তবে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছিল আন্দোলনরত শ্রমিকরা। শ্রমিকদের অভিযোগ, প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর থেকে তাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ঘর ছেড়ে না দিলে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হবে। গত ১২ জুন আন্দোলনরত শ্রমিকরা ‘ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণ বন্ধের পায়তারা করছে’- এমন অভিযোগ তুলে মানববন্ধনও করা হয়। নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের ব্যানারে এই মানববন্ধনে অংশ নেয় বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের প্রায় তিন হাজার নেতা-কর্মী। মানববন্ধন থেকে আন্দোলনরত শ্রমিকদের হুশিয়ার করা হয়।
মানববন্ধনের পরদিন রোববার (১৩ জুন) উত্তর কুমুদিনী বাগানে দেখা গেল, শ্রমিক পরিবারগুলো বাসা ছেড়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে মালামাল স্থানান্তর করতে। বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত দুইদিনে অন্তত ২০ পরিবার তাদের মালামাল অন্যত্র স্থানান্তর করেছেন। বাকিরাও ভাড়া বাসা খুঁজছেন। তবে মাসের মাঝামাঝি অবস্থায় হওয়ার কারণে অনেকেই কাক্সিক্ষত ভাড়ায় বাসা পাচ্ছেন না।
বাগানের বাসিন্দারা জানান, সকালে কারখানার কর্মকর্তারা আসেন একটা ঘর ভাঙতে। তবে সেই ঘর ভাঙলে পাশের আরও কয়েকটি ঘর ভেঙে পড়ে যাবে। ওই ঘরের বাসিন্দারা কয়েকদিন সময় চান ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার। তবে তাতে নারাজ ছিলেন কারখানার উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পরে ওই ঘরগুলোর বাসিন্দারা বাধা দিলে পুলিশের উপস্থিতিতে চালের দু’টো টিন খুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি সদর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি ওই সময় বাগানে উপস্থিত ছিলেন। পরিদর্শক মোস্তাফিজুর বলেন, ‘এমনিতেই বাগানে গেছিলাম। তেমন কোনো কারণ নাই।’ এই বলে তিনি ফোন কেটে দেন।
এদিকে হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে মানববন্ধনে দেওয়া বক্তব্য এবং বাগানে বহিরাগতদের মহড়া দেখে আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন ভীত শ্রমিকরা। ‘শ্রম আইন অনুযায়ী প্রাপ্য পাওনা পরিশোধ না করে বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না’ এই দাবিতে বাগানের বাসিন্দাদের আন্দোলনে অগ্রভাগে ছিলেন মো. জুয়েল। তার পূর্বপুরুষরা কুমুদিনীর পাট কারখানায় কাজ করেছেন। একরকম ওয়ারিশ সূত্রে পাওয়া ঘরেই পরিবার-পরিজন নিয়ে কুমুদিনী বাগানেই থাকতেন তিনি। নিজেও কুমুদিনীর শ্রমিক। তবে তিনি গণমাধ্যমে আর কিছু বলতে রাজি হননি। জুয়েল বলেন, ‘এতকিছুর পর আর কথা বলার সাহস নাই। আজ মিডিয়ায় কথা বললে কাল আমার লাশও পাইতে পারেন। আমরা গরীব, আমাগো আল্লাহ ছাড়া কেউ নাই। আমরা তো হাসপাতালের বিপক্ষে ছিলাম না। কেবল নিজেদের পাওনা পাওয়ার আশায় রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শ্রমিক ও উত্তর কুমুদিনী বাগানের বাসিন্দা বলেন, ‘এই কয়দিন তো ভয়ে ভয়ে ন্যায্য পাওনার দাবিতে আন্দোলন করছি। কিন্তু মানববন্ধনে তো সরাসরি আমাগো হুমকি দেওয়া হইছে। রাস্তায় আবার নামলে বাহিনী দিয়া পিটাইয়া মাইরা ফেলবো বলতেছে। সবাই যাইবো গা। পাওনার দরকার নাই। জীবন বাঁচলে রাস্তায়ও থাকোন যাইবো। তয় আল্লায় দেখলো সব।’
রোববার, ১৩ জুন ২০২১
ঘরে সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভ্যানগাড়ি। তাতে মালামাল তুলছেন শামীম। তার বোন আসমা কুমুদিনী বাগান ছেড়ে যাচ্ছেন। তল্লার সরদারপাড়া এলাকায় মাসে ৪ হাজার টাকায় এক কক্ষের একটি ঘর ভাড়া করেছেন। নতুন বাসস্থানে ঘরের আসবাবপত্র নেওয়া হচ্ছে। বোনকে সহযোগিতা করছেন শামীম। শুধু আসমা নন শহরের খানপুর এলাকার উত্তর কুমুদিনী ছেড়ে যাচ্ছেন অনেকেই। জানতে চাইলে একজন বললেন, ‘আতঙ্কে ঘর ছাড়তেছি, আনন্দে না।’
কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের বেঙ্গল বিডি লিমিটেড পাট কারখানার আড়াইশ’ শ্রমিক পরিবার বাস করেন উত্তর কুমুদিনী বাগানে। আরও একশ’ বিহারি পরিবারও থাকে এই বাগানে। নারায়ণগঞ্জে কুমুদিনী ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্স এন্ড ক্যান্সার রিসার্চ (কেআইআইএমএস কেয়ার) স্থাপন করা হবে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। এই প্রকল্পের আওতাধীন ছাত্রী হোস্টেল নির্মাণের জন্য ঈশা খাঁ সড়কের নারায়ণগঞ্জ ৩শ’ শয্যা হাসপাতালের পাশের উত্তর কুমুদিনী বাগানের জায়গা নেওয়া হবে। এজন্য এই বাগানে বসবাসরত শ্রমিকদের ঘর ছাড়তে হবে। তবে শ্রমিকদের দাবি ছিল, দীর্ঘদিন জুট প্রেসে (পাট কারখানা) কাজ করা শ্রমিকদের শ্রম আইন অনুযায়ী পাওনাদি পরিশোধের। অন্যথায় পুনর্বাসন দাবি করেছিলেন তারা।
শ্রমিকদের দাবি থাকলেও মালিকপক্ষ তা দিতে নারাজ। গত ৮ জুন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাংসদ একেএম সেলিম ওসমানের উপস্থিতিতে এক বৈঠকে ঘর ছেড়ে দিলে মালামাল আনা-নেওয়া বাবদ ৩ হাজার টাকা প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। আগামী ৩০ জুনের মধ্যে এই শর্তে ঘর ছেড়ে দিতে হবে। তবে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছিল আন্দোলনরত শ্রমিকরা। শ্রমিকদের অভিযোগ, প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর থেকে তাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ঘর ছেড়ে না দিলে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হবে। গত ১২ জুন আন্দোলনরত শ্রমিকরা ‘ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণ বন্ধের পায়তারা করছে’- এমন অভিযোগ তুলে মানববন্ধনও করা হয়। নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের ব্যানারে এই মানববন্ধনে অংশ নেয় বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের প্রায় তিন হাজার নেতা-কর্মী। মানববন্ধন থেকে আন্দোলনরত শ্রমিকদের হুশিয়ার করা হয়।
মানববন্ধনের পরদিন রোববার (১৩ জুন) উত্তর কুমুদিনী বাগানে দেখা গেল, শ্রমিক পরিবারগুলো বাসা ছেড়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে মালামাল স্থানান্তর করতে। বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত দুইদিনে অন্তত ২০ পরিবার তাদের মালামাল অন্যত্র স্থানান্তর করেছেন। বাকিরাও ভাড়া বাসা খুঁজছেন। তবে মাসের মাঝামাঝি অবস্থায় হওয়ার কারণে অনেকেই কাক্সিক্ষত ভাড়ায় বাসা পাচ্ছেন না।
বাগানের বাসিন্দারা জানান, সকালে কারখানার কর্মকর্তারা আসেন একটা ঘর ভাঙতে। তবে সেই ঘর ভাঙলে পাশের আরও কয়েকটি ঘর ভেঙে পড়ে যাবে। ওই ঘরের বাসিন্দারা কয়েকদিন সময় চান ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার। তবে তাতে নারাজ ছিলেন কারখানার উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পরে ওই ঘরগুলোর বাসিন্দারা বাধা দিলে পুলিশের উপস্থিতিতে চালের দু’টো টিন খুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি সদর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি ওই সময় বাগানে উপস্থিত ছিলেন। পরিদর্শক মোস্তাফিজুর বলেন, ‘এমনিতেই বাগানে গেছিলাম। তেমন কোনো কারণ নাই।’ এই বলে তিনি ফোন কেটে দেন।
এদিকে হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে মানববন্ধনে দেওয়া বক্তব্য এবং বাগানে বহিরাগতদের মহড়া দেখে আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন ভীত শ্রমিকরা। ‘শ্রম আইন অনুযায়ী প্রাপ্য পাওনা পরিশোধ না করে বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না’ এই দাবিতে বাগানের বাসিন্দাদের আন্দোলনে অগ্রভাগে ছিলেন মো. জুয়েল। তার পূর্বপুরুষরা কুমুদিনীর পাট কারখানায় কাজ করেছেন। একরকম ওয়ারিশ সূত্রে পাওয়া ঘরেই পরিবার-পরিজন নিয়ে কুমুদিনী বাগানেই থাকতেন তিনি। নিজেও কুমুদিনীর শ্রমিক। তবে তিনি গণমাধ্যমে আর কিছু বলতে রাজি হননি। জুয়েল বলেন, ‘এতকিছুর পর আর কথা বলার সাহস নাই। আজ মিডিয়ায় কথা বললে কাল আমার লাশও পাইতে পারেন। আমরা গরীব, আমাগো আল্লাহ ছাড়া কেউ নাই। আমরা তো হাসপাতালের বিপক্ষে ছিলাম না। কেবল নিজেদের পাওনা পাওয়ার আশায় রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শ্রমিক ও উত্তর কুমুদিনী বাগানের বাসিন্দা বলেন, ‘এই কয়দিন তো ভয়ে ভয়ে ন্যায্য পাওনার দাবিতে আন্দোলন করছি। কিন্তু মানববন্ধনে তো সরাসরি আমাগো হুমকি দেওয়া হইছে। রাস্তায় আবার নামলে বাহিনী দিয়া পিটাইয়া মাইরা ফেলবো বলতেছে। সবাই যাইবো গা। পাওনার দরকার নাই। জীবন বাঁচলে রাস্তায়ও থাকোন যাইবো। তয় আল্লায় দেখলো সব।’