রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এক দশক
এক দশক আগে ঠিক এই দিনেই তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে পৃথক করে প্রতিষ্ঠা করা হয় রেলপথ মন্ত্রণালয়। প্রতিষ্ঠার পর ৪০টি প্রকল্প গ্রহণ করে রেলওয়ে। লক্ষ্য ছিল সারা দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা। কিন্তু গত ১০ বছরে একটি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজও শেষ হয়নি। এর মধ্যে দুটি ফিজিবিলিটি স্টাডি ও একটি অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপন প্রকল্পের শতভাগ কাজ শেষ হলেও বেশির ভাগ প্রকল্পই ঝুলে আছে। রেলওয়ে বলছে করোনার কারণে পিছিয়ে গেছে কাজ। আবার জমি অধিগ্রহণের ঝামেলাও কাজের গতি থামিয়ে দিয়েছে বলছে তারা।
বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় ২০২০ সালের মার্চে। এর আগেই ২০১৪-১৫ সালের মধ্যেই অধিকাংশ প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পের ব্যয় ও সময়।
রেলওয়ে মেগা প্রকল্প দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনদুম রেলপথ নির্মাণ। প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয় ২০১০ সালে ১ জুলাই। ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ কাজ তিন বছরের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১০ বছরেও প্রকল্পের কাজ শেষ হয় নি।
চার দফা মেয়াদ বৃদ্ধি করে সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যয় এক হাজার ৮৫২ কোটি টাকা ৩৫ লাখ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। গত জুন পর্যন্ত ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
একই অবস্থা খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের। ৬৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ কাজ ২০১০ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়ে ৩ বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। চার দফা সময় বৃদ্ধি করে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রকল্পের ব্যয় এক হাজার ৭২১ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়ে তিন হাজার ৮০১ কোটি টাকা। তিন দফা ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে। গত ৩০ জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পের ৮৪ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা মৌলভীবাজারের কুলাউড়া-শাহবাজপুর পর্যন্ত ৫১ কিলোমিটার রেলপথ পুনঃনির্মাণ প্রকল্প ও ৭০টি মিটার গেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) ক্রয় প্রকল্পের। এই প্রকল্প দুটি ২০১১ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়েছে। কিন্তু গত ১০ বছরের কোন অগ্রগতি নেই বললেই চলে।
ব্রিটিশ শাসনামলে তৈরি করা হয়েছিল রেলপথটি। এ রেলপথ দিয়ে ‘লাতুর ট্রেনে’ ভারতের করিমগঞ্জ পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করা হতো। ২০০২ সালে এই রেলপথটি বন্ধ হয় যায়। ট্রান্স-এশিয়ান রেল রুটের অন্তর্ভুক্তির জন্য রেলপথটি পুনঃনির্মাণের প্রকল্প নেয়া হয়।
গত জুন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ২৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। তিন দফা মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যয় ১১৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৬৭৮ কোটি টাকা হয়েছে।
বিডার্স ফাইন্যান্স বা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ঋণের অর্থায়নে ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন ক্রয়ের প্রকল্প নেয়া হয়েছিল ১০ বছর আগে। গত জুন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ০ দশমিক ৫০ শতাংশ। ইঞ্জিন ক্রয়ে বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানির সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি হলেও এখনো ঋণ চুক্তি হয়নি। প্রকল্পের ব্যয় এক হাজার ৯৪৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৬৫৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। প্রকল্পের ধীরগতি বিষয়ে রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন সংবাদকে বলেন, ‘চলতি বছরের জুনে রেলওয়ে অনেকগুলো প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনভাইরাসের কারণে দুই বছর প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে গেছে। মহামারীর কারণে যেখারে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল সেখানে প্রকল্পের কাজ কিভাবে হয়। তাই বাস্তবতা বিবেচনায় কিছু কিছু প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ব্যয় বাড়ানো হয় নি।’
ধীরগতির কারণে সঠিক সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত
সারা দেশের রেলপথ উন্নয়নে ঋণদাতা সংস্থার অর্থায়নে মোট এক লাখ ৪১ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তয়িত হচ্ছে। এর মধ্যে ৯১ হাজার ১৯১ কোটি ২২ লাখ অর্থ সহায়তা করেছে বিভিন্ন দাতা সংস্থা। বাকি ৫০ হাজার ৫০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা সরকারি ফান্ড থেকে ব্যয় হবে।
প্রকল্পের ধীরগতির কারণে ঋণের সুদের পরিমাণ বেড়ে যায়। এ ছাড়া প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘সাধারণত প্রকল্প প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি সময় লাগলে অর্থনীতির কয়েকটি ক্ষতি হয়। দীর্ঘ সময় ধরে প্রকল্প চলমান থাকলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। এতে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পায়। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় মানুষ। যেমন- যাত্রী ও ভোক্তার প্রকল্পের সেবা পেতে বিলম্ব হয়। প্রকল্পের ব্যয় বাড়ার কারণে ভাড়া ও পণ্য পরিবহনের ব্যয় বেড়ে যায়। তখন সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে সেবা দিতে হয়।’
মূল কথা হলো- ‘সারা দেশের রেলপথ উন্নয়নে সরকার নজর দিয়েছে এটা ভালো লক্ষণ। কারণ গত ৪০ বছরে রেলওয়ে তেমন বিনিয়োগ হয়নি। এইসব প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলে রেলের সেবা দেয়া কঠিন হবে। সারা পৃথিবীতে রেল একটি সাশ্রয়ী পরিবহন মাধ্যম। রেলওয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলে সড়কের ওপর চাপ কমবে।’ রেল উন্নয়নের সরকারের এ সব পরিকল্পনা ভালো বলে মনে করেন তিনি।
প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণে ভোক্তা, উৎপাদক, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার সক্ষমতা ও প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর ফলে ঋণ পরিষেবার দায়ভার বাড়বে, ঋণের দায়ভার বাড়ে ও ভোক্তারা সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয় বলে জানান এই অর্থনীতিবিদ।
জমি অধিগ্রহণে রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের সিন্ডিকেট
জমি অধিগ্রহণ ঝামেলার কারণে তিন দফা মেয়াদ পিছিয়ে আখাউড়া-লাকসাম ডুয়েলগেজ ডাবললাইন নির্মাণ প্রকল্পটি। ২০১৪ সালে জুলাইয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রথম পর্যায়ে ৬ বছরের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে জমি বুঝিয়ে দিতে তিন বছর চলে যায়। স্থানীয় প্রশাসনের সিন্ডিকেটের কারণে জমি অধিগ্রহণে প্রকল্পের অধিক সময় চলে যায় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক সংবাদকে বলেন, ‘জটিল থেকে জটিল হয়ে পড়ছে প্রকল্পের জমিঅধিগ্রণ। ক্ষতিগ্রস্তদের তিনগুণ ক্ষতিপূরণ দেয়াটায় এখন কাল হয়ে পড়েছে। কারণ এই ক্ষতিপূরণের অর্থের ৫-১০ শতাংশ ভাগ দিতে হয় স্থানীয় প্রশাসনকে। এর সঙ্গে রয়েছে ডিসি, এসিল্যান্ড, স্থানীয় রাজনীতি ব্যক্তিত্ব ও পুলিশ। জমি প্রকৃত মালিকের কাগজপত্র সব ঠিক থাকলেও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে চুক্তিতে না আসলে সে ক্ষতিপূরণ পায় না। এ নিয়ে তৈরি হয় ঝামেলা। মামলা হলে আদালতের রায়ের অপেক্ষায় প্রকল্পের কাজ ঝুলে যায়।’ তাই প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি।
প্রকল্প সূত্র জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় হাজার ৫০৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ২০২০ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা পিছিয়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। মেয়াদ বৃদ্ধির প্রধান কারণ জমি অধিগ্রহণ। জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার পরও অনেক এলাকায় ক্ষতিপূরণের দাবিতে বিভিন্ন এলাকায় মিছিলও করেছে ক্ষতিগ্রস্তরা। কারণ স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহায়তায় জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া ঝামেলা তৈরি করেছে স্থানীয় প্রশাসন। এতে অনেক সময় চলে যায়। এ ছাড়া প্রকল্পের অর্থায়নে ১০ তলা ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিতেও অনেক সময় চলে গেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. শহীদুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণে অনেক সময় চলে গেছে। তাই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে জমি বুঝিয়ে দিতে দেরি হয়েছে। এ ছাড়া করোনার কারণে গত দুই বছরের প্রকল্পের তেমন অগ্রগতি হয়নি।’ তাই প্রকল্পে ব্যয় না বাড়িয়ে মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এক দশক
শুক্রবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২১
এক দশক আগে ঠিক এই দিনেই তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে পৃথক করে প্রতিষ্ঠা করা হয় রেলপথ মন্ত্রণালয়। প্রতিষ্ঠার পর ৪০টি প্রকল্প গ্রহণ করে রেলওয়ে। লক্ষ্য ছিল সারা দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা। কিন্তু গত ১০ বছরে একটি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজও শেষ হয়নি। এর মধ্যে দুটি ফিজিবিলিটি স্টাডি ও একটি অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপন প্রকল্পের শতভাগ কাজ শেষ হলেও বেশির ভাগ প্রকল্পই ঝুলে আছে। রেলওয়ে বলছে করোনার কারণে পিছিয়ে গেছে কাজ। আবার জমি অধিগ্রহণের ঝামেলাও কাজের গতি থামিয়ে দিয়েছে বলছে তারা।
বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় ২০২০ সালের মার্চে। এর আগেই ২০১৪-১৫ সালের মধ্যেই অধিকাংশ প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পের ব্যয় ও সময়।
রেলওয়ে মেগা প্রকল্প দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনদুম রেলপথ নির্মাণ। প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয় ২০১০ সালে ১ জুলাই। ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ কাজ তিন বছরের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১০ বছরেও প্রকল্পের কাজ শেষ হয় নি।
চার দফা মেয়াদ বৃদ্ধি করে সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যয় এক হাজার ৮৫২ কোটি টাকা ৩৫ লাখ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। গত জুন পর্যন্ত ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
একই অবস্থা খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের। ৬৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ কাজ ২০১০ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়ে ৩ বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। চার দফা সময় বৃদ্ধি করে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রকল্পের ব্যয় এক হাজার ৭২১ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়ে তিন হাজার ৮০১ কোটি টাকা। তিন দফা ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে। গত ৩০ জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পের ৮৪ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা মৌলভীবাজারের কুলাউড়া-শাহবাজপুর পর্যন্ত ৫১ কিলোমিটার রেলপথ পুনঃনির্মাণ প্রকল্প ও ৭০টি মিটার গেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) ক্রয় প্রকল্পের। এই প্রকল্প দুটি ২০১১ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়েছে। কিন্তু গত ১০ বছরের কোন অগ্রগতি নেই বললেই চলে।
ব্রিটিশ শাসনামলে তৈরি করা হয়েছিল রেলপথটি। এ রেলপথ দিয়ে ‘লাতুর ট্রেনে’ ভারতের করিমগঞ্জ পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করা হতো। ২০০২ সালে এই রেলপথটি বন্ধ হয় যায়। ট্রান্স-এশিয়ান রেল রুটের অন্তর্ভুক্তির জন্য রেলপথটি পুনঃনির্মাণের প্রকল্প নেয়া হয়।
গত জুন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ২৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। তিন দফা মেয়াদ বৃদ্ধি করে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যয় ১১৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৬৭৮ কোটি টাকা হয়েছে।
বিডার্স ফাইন্যান্স বা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ঋণের অর্থায়নে ৭০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন ক্রয়ের প্রকল্প নেয়া হয়েছিল ১০ বছর আগে। গত জুন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ০ দশমিক ৫০ শতাংশ। ইঞ্জিন ক্রয়ে বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানির সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি হলেও এখনো ঋণ চুক্তি হয়নি। প্রকল্পের ব্যয় এক হাজার ৯৪৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৬৫৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। প্রকল্পের ধীরগতি বিষয়ে রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন সংবাদকে বলেন, ‘চলতি বছরের জুনে রেলওয়ে অনেকগুলো প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনভাইরাসের কারণে দুই বছর প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে গেছে। মহামারীর কারণে যেখারে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল সেখানে প্রকল্পের কাজ কিভাবে হয়। তাই বাস্তবতা বিবেচনায় কিছু কিছু প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ব্যয় বাড়ানো হয় নি।’
ধীরগতির কারণে সঠিক সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত
সারা দেশের রেলপথ উন্নয়নে ঋণদাতা সংস্থার অর্থায়নে মোট এক লাখ ৪১ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তয়িত হচ্ছে। এর মধ্যে ৯১ হাজার ১৯১ কোটি ২২ লাখ অর্থ সহায়তা করেছে বিভিন্ন দাতা সংস্থা। বাকি ৫০ হাজার ৫০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা সরকারি ফান্ড থেকে ব্যয় হবে।
প্রকল্পের ধীরগতির কারণে ঋণের সুদের পরিমাণ বেড়ে যায়। এ ছাড়া প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘সাধারণত প্রকল্প প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি সময় লাগলে অর্থনীতির কয়েকটি ক্ষতি হয়। দীর্ঘ সময় ধরে প্রকল্প চলমান থাকলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। এতে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পায়। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় মানুষ। যেমন- যাত্রী ও ভোক্তার প্রকল্পের সেবা পেতে বিলম্ব হয়। প্রকল্পের ব্যয় বাড়ার কারণে ভাড়া ও পণ্য পরিবহনের ব্যয় বেড়ে যায়। তখন সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে সেবা দিতে হয়।’
মূল কথা হলো- ‘সারা দেশের রেলপথ উন্নয়নে সরকার নজর দিয়েছে এটা ভালো লক্ষণ। কারণ গত ৪০ বছরে রেলওয়ে তেমন বিনিয়োগ হয়নি। এইসব প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলে রেলের সেবা দেয়া কঠিন হবে। সারা পৃথিবীতে রেল একটি সাশ্রয়ী পরিবহন মাধ্যম। রেলওয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলে সড়কের ওপর চাপ কমবে।’ রেল উন্নয়নের সরকারের এ সব পরিকল্পনা ভালো বলে মনে করেন তিনি।
প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণে ভোক্তা, উৎপাদক, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার সক্ষমতা ও প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর ফলে ঋণ পরিষেবার দায়ভার বাড়বে, ঋণের দায়ভার বাড়ে ও ভোক্তারা সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয় বলে জানান এই অর্থনীতিবিদ।
জমি অধিগ্রহণে রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের সিন্ডিকেট
জমি অধিগ্রহণ ঝামেলার কারণে তিন দফা মেয়াদ পিছিয়ে আখাউড়া-লাকসাম ডুয়েলগেজ ডাবললাইন নির্মাণ প্রকল্পটি। ২০১৪ সালে জুলাইয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রথম পর্যায়ে ৬ বছরের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে জমি বুঝিয়ে দিতে তিন বছর চলে যায়। স্থানীয় প্রশাসনের সিন্ডিকেটের কারণে জমি অধিগ্রহণে প্রকল্পের অধিক সময় চলে যায় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক সংবাদকে বলেন, ‘জটিল থেকে জটিল হয়ে পড়ছে প্রকল্পের জমিঅধিগ্রণ। ক্ষতিগ্রস্তদের তিনগুণ ক্ষতিপূরণ দেয়াটায় এখন কাল হয়ে পড়েছে। কারণ এই ক্ষতিপূরণের অর্থের ৫-১০ শতাংশ ভাগ দিতে হয় স্থানীয় প্রশাসনকে। এর সঙ্গে রয়েছে ডিসি, এসিল্যান্ড, স্থানীয় রাজনীতি ব্যক্তিত্ব ও পুলিশ। জমি প্রকৃত মালিকের কাগজপত্র সব ঠিক থাকলেও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে চুক্তিতে না আসলে সে ক্ষতিপূরণ পায় না। এ নিয়ে তৈরি হয় ঝামেলা। মামলা হলে আদালতের রায়ের অপেক্ষায় প্রকল্পের কাজ ঝুলে যায়।’ তাই প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি।
প্রকল্প সূত্র জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় হাজার ৫০৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ২০২০ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা পিছিয়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। মেয়াদ বৃদ্ধির প্রধান কারণ জমি অধিগ্রহণ। জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার পরও অনেক এলাকায় ক্ষতিপূরণের দাবিতে বিভিন্ন এলাকায় মিছিলও করেছে ক্ষতিগ্রস্তরা। কারণ স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহায়তায় জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া ঝামেলা তৈরি করেছে স্থানীয় প্রশাসন। এতে অনেক সময় চলে যায়। এ ছাড়া প্রকল্পের অর্থায়নে ১০ তলা ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিতেও অনেক সময় চলে গেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. শহীদুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণে অনেক সময় চলে গেছে। তাই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে জমি বুঝিয়ে দিতে দেরি হয়েছে। এ ছাড়া করোনার কারণে গত দুই বছরের প্রকল্পের তেমন অগ্রগতি হয়নি।’ তাই প্রকল্পে ব্যয় না বাড়িয়ে মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।