alt

সারাদেশ

পশ্চিমাঞ্চল রেল : লেভেল ক্রসিং যেন মরণফাঁদ

সুব্রত দাস, রাজশাহী : বুধবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২২

রাজশাহী : অরক্ষিত রেলগেট -সংবাদ

কোথাও নিরাপত্তারক্ষী নেই, গেটও নেই। এমনই দিনের পর দিন মানুষ পারাপার করছে রেললাইন। আর তাতেই ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে দিনের পর দিন। সোমবার (২৪ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ৮টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে অরক্ষিত একটি রেলক্রসিংয়ে ভটভটি অতিক্রম করার সময় ট্রেনের ধাক্কায় তিনজন মাছ ব্যবসায়ী নিহত হয়। এর আগে গত ৮ ডিসেম্বর নীলফামারী সদরের বউবাজার রেলস্টেশন এলাকায় ট্রেনের নিচে কাটাপড়ে একই পরিবারের তিন শিশু চারজন নিহত হয়েছেন। গত ৫ জানুয়ারি দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ট্রেন ও ট্রাকের সংঘর্ষে ট্রেন চালক আবদুর রশিদ সরকার ও সহকারী চালক ইউনুস আলী গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তাদের দুজনকে চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। গত ৬ ডিসেম্বর ভোর ৪টায় নাটোর শহরের তেবাড়িয়া রেলক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাকের সঙ্গে ও ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা কুড়িগ্রামগামী কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ট্রেনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে পাঁচ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন যোগাযোগ চালু হয়। অথচ ওই লেভেল ক্রসিংয়ে কোন গেটম্যান ছিল না। গত ২ ডিসেম্বর পাবনার ভাঙ্গুড়া ও পার্বতীপুর রেলওয়ে জংশনে দুটি ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া গত এক ডিসেম্বর নাটোরের লালপুরের আজিমপুর রেলওয়ে স্টেশনে রেললাইন পারাপারের সময় ঢাকাগামী দ্রুতযান এক্সপ্রেসের চাকায় পিষ্ট হয়ে ছেলেকে বিশ^বিদ্যালয়ের ভর্তি করাতে এসে খুলনা সদরের হেমায়েত উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি মারা যান। এর আগে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় এমনই একটি অরক্ষিত ক্রসিংয়ে ২০১৯ সালের ২০ জুলাই দুর্ঘটনায় বর-কনেসহ ১২ জন প্রাণ হারান। এভাবেই অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং গেটের কারণে দুর্ঘটনায় শত শত প্রাণ ঝড়ে যাচ্ছে। রেলওয়ের হিসাবমতে ২০১৪ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এক হাজার ১৯৯টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওইসব দুর্ঘটনায় ২০৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে রেলগেটে সংঘটিত দুর্ঘটনায় ১৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ তাদের প্রায় সবাই লেভেল ক্রসিং পার হতে যাওয়া বাস, মাইক্রোবাস ও ছোট যানবাহনের আরোহী।

রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগ নিয়ে গঠিত পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের এক হাজার ৫৬৮ কিলোমিটার রেলপথে এক হাজার ৪৩৯টি রেল ক্রসিং গেটের প্রায় অর্ধেকই যেন মৃত্যুপুরী। রেল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা আর সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে অনুমতির বৈধতা-অবৈধতার মারপ্যাঁচেই যেন বন্দী এসব লেভেল ক্রসিং। প্রায় দেড় হাজার লেভেল ক্রসিংয়ে কাগজে-কলমে নিয়োগপ্রাপ্ত ১৮৯ জন গেটকিপারের তথ্য পাওয়া গেছে। তবে কর্তৃপক্ষের দাবি, প্রকল্পের মাধ্যমে আরও ৭০০ জন গেটকিপার দায়িত্বে রয়েছে। হিসাব অনুযায়ী পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রায় অর্ধেক লেভেল ক্রসিং গেট অরক্ষিত থাকায় ট্রেন দুর্ঘটনায় বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রেলওয়ের পাকশী ও লালমনিরহাট বিভাগ নিয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগের আওতায় অনুমোদিত বা বৈধ লেভেল ক্রসিং (ট্রাফিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং) গেট রয়েছে ৮০৮টি এবং অননুমোদিত বা অবৈধ গেট রয়েছে ১২৩টি। আর লালমনিরহাট বিভাগে অনুমোদিত বা বৈধ লেভেল ক্রসিং গেট (ট্রাফিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং) রয়েছে ৪১৭টি এবং অননুমোদিত বা অবৈধ গেট রয়েছে ৯৯টি। সেই হিসাবে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের আওতায় এক হাজার ৪৩৯টি লেভেল ক্রসিং গেটের ২২২টিই অননুমোদিত বা অবৈধ। আর এসব অননুমোদিত গেটের মধ্যে এলজিইডির রয়েছে ১৮৪টি। এছাড়া সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সওজের রয়েছে পাঁচটি। বাকিগুলো ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশনের অধীনে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক হাজার ৪৩৯টি লেভেল ক্রসিং গেটের জন্য মঞ্জুুরিকৃত গেটকিপার ছিল ১৮৯ জন। এদের মধ্যে ১১৯ জন গেটকিপার স্বপদে কর্মরত। বাকি ৭০ জনকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এছাড়া পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দাবি, মঞ্জুরিকৃত ১৮৯ জন ছাড়াও প্রায় ৭০০ জন গেটকিপার প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করছেন। হিসাব অনুযায়ী, ৬২০টি লেভেল ক্রসিং গেটে কোন গেটকিপার না থাকায় গেটগুলো পুরোপুরি অরক্ষিত।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে বৈধ ও অবৈধ এসব লেভেল ক্রসিং গেটের মধ্যে ৮১৯টিতে গেটম্যান থাকার কথা বলা হলেও এসব গেটম্যানের বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলার বিষয়টি অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। মঞ্জুরিকৃত ১১৯ জন গেটকিপার কোনরকম তাদের দায়িত্ব কিছুটা পালন করলেও প্রকল্পের মাধ্যমে দায়িত্বে থাকা ৭০০ গেটকিপারের অধিকাংশই তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেন না। আবার যে লেভেল ক্রসিং গেটগুলোতে গেটম্যান নেই সেগুলোর সামনে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড থাকলেও অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ২২২টি ক্রসিংয়ের অধিকাংশের সামনেই নেই সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড। ফলে অনেক সময় পথচারীরা লেভেল ক্রসিং অতিক্রমের সময় অসাবধানতাবশত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। বৈধ-অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের মাইর-প্যাঁচসহ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এভাবেই প্রতিনিয়ত ঘটছে রেল দুর্ঘটনা। রেল সংশ্লিষ্ট অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছেন, রেল পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদাসীনতা এবং অন্যান্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানেরই সৃষ্ট পশ্চিম রেলের এসব অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং গেট। আর এসব অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের কারণেই ট্রেন চলাচলে প্রতিনিয়ত বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ রেলওয়ে আইন-১৮৯০ এর ১২৮ ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি ট্রেন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করলে বা বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তার সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদ-ের বিধান রয়েছে। তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিনিয়ত সরকারের অন্য কোন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি কিংবা জনপ্রতিনিধি অবৈধভাবে লেভেল ক্রসিং গেট তৈরি করছে। যার কারণেই প্রতিনিয়ত অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং গেট বাড়ছে, ঘটছে দুর্ঘটনাও।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে প্রতিনিয়ত নিজেদের প্রয়োজনের ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে জনপ্রতনিধি কিংবা অন্যরা লেভেল ক্রসিং গেট সৃষ্টি করছে, যা অবৈধ। প্রতিনিয়ত এভাবে অবৈধ গেট সৃষ্ট হলে রাতারাতি সেখানে জনবল দেয়া রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সম্ভব না। অবৈধ লেভেল ক্রসিং যাতে তৈরি না হয় সেজন্য সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে স্থায়ী কিছু গেটকিপার রয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৭০০ গেটকিপার অস্থায়ী ভিত্তিতে কর্মে নিয়োজিত রয়েছে।’

তবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে লেভেল ক্রসিং গেটগুলোতে ঠিকমত গেটকিপার রাখা সম্ভব নয়। সঙ্গত কারণেই এভাবে ট্রেন দুর্ঘটনা লাঘব করা যাবে না বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘বিজ্ঞানসম্মতভাবে দেশের লেভেল ক্রসিংগুলো করা হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী, লেভেল ক্রসিং হবে রাস্তার সমান্তরাল। কিন্তু দেশের অধিকাংশ লেভেল ক্রসিং হয় উঁচু, নয়তো নিচু। যার কারণে লেভেল ক্রসিং অতিক্রম করার সময় যানবাহন ক্রসিং আটকে যায় নয়তো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা, প্রতিনিয়ত ক্রসিংয়ে ঝড়ে যাচ্ছে তাজা প্রাণ। তবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে ‘ওভারপাস’ এবং ‘আন্ডারপাস’ তৈরি করা সম্ভব হলে দেশে লেভেল ক্রসিংয়ে মৃত্যুর মিছিল কিছুটা হলেও কমবে।’

ছবি

স্বামীর পুরুষ অঙ্গ কেটে আত্মহত্যা করলেন স্ত্রী

ছবি

বিজিবি-বিএসএফ বৈঠক ও দুই দেশের শিশুদের খেলাধুলা অনুষ্ঠিত

ছবি

সাবমেরিন কেবল বিচ্ছিন্ন, ধীরগতি হতে পারে ইন্টারনেট

ছবি

বনের আগুন নেভালেন জেলা প্রশাসক, জানে না বনের কর্তারা

ছবি

বিশেষজ্ঞ প্যানেল ও বারি’র জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিনিময় কর্মশালা

ছবি

৪২ ডিগ্রি ছাড়াল চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা, গলে যাচ্ছে রাস্তার পিচ

ছবি

টাঙ্গাইলে সংঘ‌র্ষ থামাতে গিয়ে হামলার শিকার এসআই, ১৬ জন আটক

ছবি

কক্সবাজারে জলকেলি উৎসবের সমাপনীতে আলোকিত জীবনের প্রত্যাশা

ছবি

মায়ানমারের বিজিপির আরও ২৪ সদস্য বাংলাদেশে

ছবি

রাজশাহীতে মোটরসাইকেলে ট্রাকের ধাক্কায় নিহত ৩

ছবি

ইউএসএআইডি এবং সিমিট প্রতিনিধি দলের বারি পরিদর্শন

ছবি

পঞ্চগড় এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনে নারীর ঝুলন্ত মরদেহ

ছবি

‘আনন্দে’ শুরুর পর সড়কের ঈদযাত্রা কেন ‘বিষাদে’

ছবি

ঘটনা চাপা দিতে ১৫০ বস্তা সিমেন্ট সরিয়ে ফেলার অভিযোগ

মীরসরাইয়ে শিলাবৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি, ঘরের চাল ছিদ্র হয়ে গেছে

ছবি

মাধবপুরে বিরল প্রজাতির লজ্জাবতী বানর উদ্ধার

ছবি

টঙ্গীতে আগুনে পুড়ল ১২টি খাদ্য গুদাম

ছবি

জলকেলি উৎসবে মুখরিত কক্সবাজরের রাখাইন পল্লী

শেরপুরে বিনামূল্যে সার বীজ বিতরণ উদ্বোধন

কেশবপুরে সকাল-সন্ধ্যা বাজারের দখল নিয়ে দু’পক্ষ মুখোমুখি উচ্ছেদ আতঙ্কে অর্ধশতাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী

ছবি

ভালুকায় বোরো ধানে চিটা কৃষকের মাথায় হাত

ছবি

ভালুকায় বোরো ধানে চিটা কৃষকের মাথায় হাত

ছবি

গোবিন্দগঞ্জে সরকারি রাস্তার ১২০টি গাছ কর্তনের অভিযোগ প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে

পুঠিয়ায় শাশুড়িকে হত্যা করেন পুত্রবধূ

ছবি

মির্জাগঞ্জে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে যুবকের মৃত্যু

ছবি

নড়াইলের শ্রীনগর গ্রামে ভ্যানচালককে পুলিশি হয়রানির প্রতিবাদে মানববন্ধন

ছবি

প্রচণ্ড তাপদাহে পুড়ছে বাগান, ঝরছে আম, শঙ্কায় চাষীরা

ছবি

প্রেমিকার ওপর অভিমান প্রেমিকের আত্মহত্যা

ছবি

শ্যামনগর পদ্মপুকুরের প্রধান সড়কের একাংশ যেন বালুর স্তুপে পরিণত

আমার চেয়ে খারাপ লোক এ জেলায় নাই : তাহেরপুত্র বিপ্লব

ছবি

কক্সবাজারে রিসোর্টে পযটক তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ, অভিযুক্ত গ্রেপ্তার

ছবি

ঝালকাঠিতে ট্রাকচাপায় নিহতের পরিবার পাবে ৫ লাখ টাকা

ছবি

সুনামগঞ্জে বাস-অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত ২

ছবি

টোলপ্লাজায় ট্রাকের ধাক্কা, নিহত ১৪

ছবি

গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন, বেশিরভাগ অঞ্চলে বইছে তাপপ্রবাহ

কোম্পানীগঞ্জে পর্যটকের সঙ্গে এএসপির মারামারি

tab

সারাদেশ

পশ্চিমাঞ্চল রেল : লেভেল ক্রসিং যেন মরণফাঁদ

সুব্রত দাস, রাজশাহী

রাজশাহী : অরক্ষিত রেলগেট -সংবাদ

বুধবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২২

কোথাও নিরাপত্তারক্ষী নেই, গেটও নেই। এমনই দিনের পর দিন মানুষ পারাপার করছে রেললাইন। আর তাতেই ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে দিনের পর দিন। সোমবার (২৪ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ৮টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে অরক্ষিত একটি রেলক্রসিংয়ে ভটভটি অতিক্রম করার সময় ট্রেনের ধাক্কায় তিনজন মাছ ব্যবসায়ী নিহত হয়। এর আগে গত ৮ ডিসেম্বর নীলফামারী সদরের বউবাজার রেলস্টেশন এলাকায় ট্রেনের নিচে কাটাপড়ে একই পরিবারের তিন শিশু চারজন নিহত হয়েছেন। গত ৫ জানুয়ারি দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ট্রেন ও ট্রাকের সংঘর্ষে ট্রেন চালক আবদুর রশিদ সরকার ও সহকারী চালক ইউনুস আলী গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তাদের দুজনকে চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। গত ৬ ডিসেম্বর ভোর ৪টায় নাটোর শহরের তেবাড়িয়া রেলক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাকের সঙ্গে ও ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা কুড়িগ্রামগামী কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ট্রেনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে পাঁচ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন যোগাযোগ চালু হয়। অথচ ওই লেভেল ক্রসিংয়ে কোন গেটম্যান ছিল না। গত ২ ডিসেম্বর পাবনার ভাঙ্গুড়া ও পার্বতীপুর রেলওয়ে জংশনে দুটি ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া গত এক ডিসেম্বর নাটোরের লালপুরের আজিমপুর রেলওয়ে স্টেশনে রেললাইন পারাপারের সময় ঢাকাগামী দ্রুতযান এক্সপ্রেসের চাকায় পিষ্ট হয়ে ছেলেকে বিশ^বিদ্যালয়ের ভর্তি করাতে এসে খুলনা সদরের হেমায়েত উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি মারা যান। এর আগে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় এমনই একটি অরক্ষিত ক্রসিংয়ে ২০১৯ সালের ২০ জুলাই দুর্ঘটনায় বর-কনেসহ ১২ জন প্রাণ হারান। এভাবেই অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং গেটের কারণে দুর্ঘটনায় শত শত প্রাণ ঝড়ে যাচ্ছে। রেলওয়ের হিসাবমতে ২০১৪ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এক হাজার ১৯৯টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওইসব দুর্ঘটনায় ২০৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে রেলগেটে সংঘটিত দুর্ঘটনায় ১৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ তাদের প্রায় সবাই লেভেল ক্রসিং পার হতে যাওয়া বাস, মাইক্রোবাস ও ছোট যানবাহনের আরোহী।

রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগ নিয়ে গঠিত পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের এক হাজার ৫৬৮ কিলোমিটার রেলপথে এক হাজার ৪৩৯টি রেল ক্রসিং গেটের প্রায় অর্ধেকই যেন মৃত্যুপুরী। রেল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা আর সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে অনুমতির বৈধতা-অবৈধতার মারপ্যাঁচেই যেন বন্দী এসব লেভেল ক্রসিং। প্রায় দেড় হাজার লেভেল ক্রসিংয়ে কাগজে-কলমে নিয়োগপ্রাপ্ত ১৮৯ জন গেটকিপারের তথ্য পাওয়া গেছে। তবে কর্তৃপক্ষের দাবি, প্রকল্পের মাধ্যমে আরও ৭০০ জন গেটকিপার দায়িত্বে রয়েছে। হিসাব অনুযায়ী পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রায় অর্ধেক লেভেল ক্রসিং গেট অরক্ষিত থাকায় ট্রেন দুর্ঘটনায় বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রেলওয়ের পাকশী ও লালমনিরহাট বিভাগ নিয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগের আওতায় অনুমোদিত বা বৈধ লেভেল ক্রসিং (ট্রাফিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং) গেট রয়েছে ৮০৮টি এবং অননুমোদিত বা অবৈধ গেট রয়েছে ১২৩টি। আর লালমনিরহাট বিভাগে অনুমোদিত বা বৈধ লেভেল ক্রসিং গেট (ট্রাফিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং) রয়েছে ৪১৭টি এবং অননুমোদিত বা অবৈধ গেট রয়েছে ৯৯টি। সেই হিসাবে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের আওতায় এক হাজার ৪৩৯টি লেভেল ক্রসিং গেটের ২২২টিই অননুমোদিত বা অবৈধ। আর এসব অননুমোদিত গেটের মধ্যে এলজিইডির রয়েছে ১৮৪টি। এছাড়া সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সওজের রয়েছে পাঁচটি। বাকিগুলো ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশনের অধীনে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক হাজার ৪৩৯টি লেভেল ক্রসিং গেটের জন্য মঞ্জুুরিকৃত গেটকিপার ছিল ১৮৯ জন। এদের মধ্যে ১১৯ জন গেটকিপার স্বপদে কর্মরত। বাকি ৭০ জনকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এছাড়া পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দাবি, মঞ্জুরিকৃত ১৮৯ জন ছাড়াও প্রায় ৭০০ জন গেটকিপার প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করছেন। হিসাব অনুযায়ী, ৬২০টি লেভেল ক্রসিং গেটে কোন গেটকিপার না থাকায় গেটগুলো পুরোপুরি অরক্ষিত।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে বৈধ ও অবৈধ এসব লেভেল ক্রসিং গেটের মধ্যে ৮১৯টিতে গেটম্যান থাকার কথা বলা হলেও এসব গেটম্যানের বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলার বিষয়টি অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। মঞ্জুরিকৃত ১১৯ জন গেটকিপার কোনরকম তাদের দায়িত্ব কিছুটা পালন করলেও প্রকল্পের মাধ্যমে দায়িত্বে থাকা ৭০০ গেটকিপারের অধিকাংশই তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেন না। আবার যে লেভেল ক্রসিং গেটগুলোতে গেটম্যান নেই সেগুলোর সামনে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড থাকলেও অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ২২২টি ক্রসিংয়ের অধিকাংশের সামনেই নেই সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড। ফলে অনেক সময় পথচারীরা লেভেল ক্রসিং অতিক্রমের সময় অসাবধানতাবশত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। বৈধ-অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের মাইর-প্যাঁচসহ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এভাবেই প্রতিনিয়ত ঘটছে রেল দুর্ঘটনা। রেল সংশ্লিষ্ট অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছেন, রেল পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদাসীনতা এবং অন্যান্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানেরই সৃষ্ট পশ্চিম রেলের এসব অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং গেট। আর এসব অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের কারণেই ট্রেন চলাচলে প্রতিনিয়ত বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ রেলওয়ে আইন-১৮৯০ এর ১২৮ ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি ট্রেন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করলে বা বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তার সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদ-ের বিধান রয়েছে। তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিনিয়ত সরকারের অন্য কোন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি কিংবা জনপ্রতিনিধি অবৈধভাবে লেভেল ক্রসিং গেট তৈরি করছে। যার কারণেই প্রতিনিয়ত অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং গেট বাড়ছে, ঘটছে দুর্ঘটনাও।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে প্রতিনিয়ত নিজেদের প্রয়োজনের ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে জনপ্রতনিধি কিংবা অন্যরা লেভেল ক্রসিং গেট সৃষ্টি করছে, যা অবৈধ। প্রতিনিয়ত এভাবে অবৈধ গেট সৃষ্ট হলে রাতারাতি সেখানে জনবল দেয়া রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সম্ভব না। অবৈধ লেভেল ক্রসিং যাতে তৈরি না হয় সেজন্য সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে স্থায়ী কিছু গেটকিপার রয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৭০০ গেটকিপার অস্থায়ী ভিত্তিতে কর্মে নিয়োজিত রয়েছে।’

তবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে লেভেল ক্রসিং গেটগুলোতে ঠিকমত গেটকিপার রাখা সম্ভব নয়। সঙ্গত কারণেই এভাবে ট্রেন দুর্ঘটনা লাঘব করা যাবে না বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘বিজ্ঞানসম্মতভাবে দেশের লেভেল ক্রসিংগুলো করা হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী, লেভেল ক্রসিং হবে রাস্তার সমান্তরাল। কিন্তু দেশের অধিকাংশ লেভেল ক্রসিং হয় উঁচু, নয়তো নিচু। যার কারণে লেভেল ক্রসিং অতিক্রম করার সময় যানবাহন ক্রসিং আটকে যায় নয়তো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা, প্রতিনিয়ত ক্রসিংয়ে ঝড়ে যাচ্ছে তাজা প্রাণ। তবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে ‘ওভারপাস’ এবং ‘আন্ডারপাস’ তৈরি করা সম্ভব হলে দেশে লেভেল ক্রসিংয়ে মৃত্যুর মিছিল কিছুটা হলেও কমবে।’

back to top