কমবে আমদানি নির্ভরতা
ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণে দেশেই তেলজাতীয় ফসল চাষের পথ দেখাচ্ছেন বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা। তাদের তেলজাতীয় ফসল চাষের আগ্রহে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা ধীরে ধীরে কমবে বলেও মনে করেন কৃষকরা। প্রাচীন কাল থেকে আমাদের দেশের কৃষকরা দেশেই উৎপাদিত ভোজ্যতেলের চাহিদা মিটিয়ে আসছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাজশাহী অঞ্চলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধানের উৎপাদন না কমিয়ে বাড়তি ফসল হিসেবে তেলের প্রধান ফসল তেলজাতীয় বীজ চাষ করলে দেশের কৃষি খাত বিরাট উপকৃত হবে। কর্মকর্তারা বলেন, আমরা বছরে বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেল আমদানি করি। এজন্য অনেক বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়। তেল ফসলের মধ্যে সরিষা অন্যতম। এক সময় দেশের শতভাগ মানুষ সরিষার তেল দিয়েই বিভিন্ন খাবার রান্না করে খেত। সে সময় মানুষের শরীরে নানা অজানা রোগও কম হতো। কালের বিবর্তনে গত কয়েক বছর ধরে কৃষক পর্যায়ে সরিষার আবাদ হ্রাস পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ধরনের তেল বিদেশ থেকে আমদানি করে দেশের বাজার সয়লাব করে দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ অর্থের অপচয় করেছেন। এ কারণে দেশের কৃষকরা সরিষা চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। তাই দেশের সব মানুষের স্বাস্থ্য ও সব কৃষকের লাভজনক কৃষি উৎপাদনের বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন উচ্চ ফলনশীল জাতের সরিষা বারি ১৪, ১৫ ও ১৮। বিশেষ করে বারি সরিষা ১৮-এর মধ্যে ইউরেসিক এসিডের পরিমাণ একেবারেই কম থাকায় এটি মানবদেহের জন্য খুবই উৎকৃষ্টমানের তেল। তাছাড়া অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ বেশি এবং খৈলে গোকোসিনুলেটর পরিমাণও ক্ষতিকর মাত্রার চেয়ে কম।
এদিকে রাজশাহীতে মুজিববর্ষ উপলক্ষে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করে তেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে ও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তরুণ সূর্যমুখী ফুলচাষিরা।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী জেলার ৬টি উপজেলা দুর্গাপুর, পুঠিয়া, চারঘাট, তানোর, বাগমারা, মোহনপুরে এই মৌসুমে ১৫৬ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী ফুল চাষে হয়েছে।
দুর্গাপুর উপজেলায় পৌর সদরের সিংগা গ্রামের আনোয়ার হোসেন, আকরাম আলী, জাহিদ হোসেন, আব্দুল জলিলসহ আরও অনেকে হাইসান-৩৩ জাতের সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেছেন।
দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহসীন মৃধা বলেন, স্বাস্থ্যসম্মত বিশুদ্ধ তেল উৎপাদনে সূর্যমুখীর জুড়ি নেই। দেশের অন্যান্য জেলা উপজেলার মতো দুর্গাপুর উপজেলায় এখন বাণিজ্যিকভাবে সূর্যমুখী চাষ হচ্ছে।
সারাক্ষণ এ ফুলের ওপর বসে মৌমাছিরা মধু আহরণ করায় বিপুল পরিমাণ মধু সংগ্রহ করাও সম্ভব। এ কারণে সূর্যমুখী চাষ করে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন দেখছেন দুর্গাপুর এলাকার চাষিরা।
সূর্যমুখীর বাম্পার ফলনে গ্রামীণ অর্থনীতিতে সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে। দুর্গাপুরের সূর্যমুখী চাষি আনোয়ার হোসেন জানান, আগে তিনি বিভিন্ন ধরনের শস্য, ফল, ফুলসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করতেন। উপজেলা কৃষি অফিসের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মকলেছুর রহমানের পরামর্শে তিনি প্রথমবারের মতো হাইসান-৩৩ জাতের সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেছেন। কৃষকদের সূর্যমুখী ফুল চাষে আগ্রহী করতে তার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। ইতোমধ্যে প্রতিটি গাছে ফুল ধরেছে।
প্রথমবারেই সূর্যমুখী চাষে সফলতা ও লাভের আশা করছেন তিনি। কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে বীজ দিয়েছে। বাগানে ফুল আসার পর প্রতিদিনই লোকজন আসছে বাগান দেখতে। তিনিও আশা করছেন আগামীতে সরকারি প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পাওয়া গেলে আরও বড় পরিসরে বাণিজ্যিকভাবে সূর্যমুখী চাষ করার।
বাগমারা উপজেলার শ্রীপুর এলাকার সূর্যমুখী চাষি আবদুল জলিল জানান, ধান এবং সবজি চাষ করে প্রতি বছর তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। যার ফলে অনেক প্রান্তিক চাষি এখন দেনার দায়ে দিশেহারা। তাই বিকল্প পথ হিসেবে সূর্যমুখী চাষে ঝুঁকছেন।
তানোর উপজেলার সরনজাই এলাকার সূর্যমুখী ফুলচাষি মোশাররফ হোসেন বলেন, সূর্যমুখী চাষে সার কীটনাশক ও সেচ পানির খুব একটা প্রয়োজন হয় না। তারা অনেকে এ বছর নতুনভাবে এ ফুলের চাষ করেছেন।
সূর্যমুখী ফুলচাষ নিয়ে দুর্গাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মসিউর রহমান বলেন, দুর্গাপুরের কৃষকরা বাণিজ্যিকভাবে এই প্রথমবারের মতো সূর্যমুখী ফুলের চাষ শুরু করেছেন। দুর্গাপুর উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে চাষিদের বিভিন্ন ধরনের সহায়তা করা হয়েছে। সূর্যমুখী ফুল চাষে উদ্বুদ্ধ করতে কৃষকদের বিনামূল্যে সূর্যমুখীর বীজ দেয়া হয়েছে। আশা করি ফলন খুবই ভালো হবে। আগামীতে আরও বেশি জমিতে সূর্যমুখীর চাষ হবে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক উম্মে সালমা বলেন, জেলার ৬টি উপজেলায় এর আগে কৃষকদের সূর্যমুখী ফুল চাষে তেমন একটা আগ্রহ ছিল না। মুজিববর্ষ উপলক্ষে এবার কৃষি কর্মকর্তাদের উদ্বুদ্ধকরণে রাজশাহীতে এক হাজার ২২৩ জন কৃষক সূর্যমুখী চাষ করেছেন।
সূর্যমুখী বীজ রোপণের ৯০-১০৫ দিনের মধ্যেই কৃষকরা ফুল থেকে বীজ ঘরে তুলতে পারবেন। তিনি আরও জানান, যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে কোন প্রকার ক্ষতি না হয় তাহলে প্রতি বিঘা জমিতে ৮ থেকে ১০ মণ সূর্যমুখী ফুলের বীজ পাওয়া যাবে। এক মণ বীজ থেকে ১৮ কেজি তেল পাওয়া যাবে। বিঘাপ্রতি কৃষক ১০-১১ হাজার টাকার বীজ বিক্রি করতে পারবেন। সূর্যমুখীর তেল ছাড়াও খৈল দিয়ে মাছের খাবার এবং সূর্যমুখী গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এই গাছের কোন অংশই ফেলে দেয়ার প্রয়োজন হয় না।
এদিকে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে সূর্যমুখীর পরীক্ষামূলক চাষ শুরু হয় গত কয়েক বছর আগে। এখানেও সফলতা পেয়েছেন চাষিরা। প্রাপ্ত সফল্যে আগামীতে বরেন্দ্রজুড়ে উচ্চমূল্যের পেরিলা ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। বাংলাদেশে যে পেরিলার চাষ হচ্ছে সেটি কোরিয়ান পেরিলা।
পেরিলার তেল বিশেষকরে হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক ও ত্বকসহ ডায়াবেটিস রোগপ্রতিরোধে বেশ কার্যকর। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীন, নেপাল, ভিয়েতনাম এবং ভারতের কিছু অঞ্চলে পেরিলার চাষ হয়।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডসমৃদ্ধ তেলটি দেশের তেলের ঘাটতি কমিয়ে আনার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে যথেষ্ট অবদান রাখতে সক্ষম বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। বাণিজ্যিক চাহিদা বেশি থাকায় ইতোমধ্যে বাণিজ্যিকভাবে সাউ পেরিলা-১ চাষের উৎসাহ দেখিয়েছে বেসরকারি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। জাতীয় বীজ বোর্ডে ‘সাউ পেরিলা-১’ নামে পেরিলার নতুন জাতটির নিবন্ধন পায় ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি।
গোদাগাড়ীর পেরিলা চাষি শাহাদাত হোসাইন জানান, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তার ফেইসবুক পোস্টে উপজেলায় পেরিলার গবেষণা পট বিষয়ে জানতে পারেন। যোগাযোগ করার পর তিনিও সেই সুযোগ পেয়ে যান। পরে পেরিলা বীজ, সার ও কীটনাশকসহ সব ধরনের সহায়তা নেন কৃষি অধিদপ্তর থেকে।
বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এ যুবক জানান, প্রথমে সাত কাঠা জমিতে পেরিলা আবাদ করেন। তা থেকে বীজ পেয়েছিলেন ৯ কেজি। বীজ ভাঙিয়ে তেল হয়েছে এক লিটার ৮০০ গ্রাম। পুরো তেলই উপজেলা কৃষি দপ্তর সংগ্রহ করেছে।
পেরিলা চাষে তেমন বাড়তি যত্ন নেয়ার প্রয়োজন নেই বলে জানান তরুণ এই কৃষি উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, বীজতলায় বীজ বপন করে এক মাসের মাথায় এর চারা তৈরি হয়। এরপর জমি তৈরি করে সাধারণত মরিচ কিংবা বেগুন চারা রোপণের মতো সারিবদ্ধ করে পেরিলা চারা রোপণ করতে হয়। পেরিলা চাষের সমস্যা প্রসঙ্গে বলেন, শুধু শুয়োপোকা পেরিলার পাতা খেয়ে ফেলছিল। তা ছাড়া কিছু গাছে ছত্রাকের আক্রমণে কান্ড পচে যায়। এ দুই বালাই নিয়ন্ত্রণে তিনি কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ মেনে কীটনাশক প্রয়োগ করেন।
এ বিষয়ে গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম জানান, দেশের ১৪টি অঞ্চলে একযোগে পেরিলার গবেষণা পট ছিল। বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া এবং গোদাগাড়ী পৌর এলাকার লালবাগ রামনগর এলাকায় দুটি প্রদর্শনী পট ছিল পেরিলার। নতুন এ ফসল চাষে সাফল্য পাওয়া গেছে। তিনি আরও জানান, পেরিলার চারা আগস্টে জমিতে রোপণ করতে হয়। কিন্তু গোদাগাড়ীতে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে রোপণ করেছিলেন তারা। আর ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে তোলা হয় ফসল। জমিতে পেরিলার জীবনকাল ৭০ থেকে ৭৫ দিন। এটি সহজেই চার ফসলি জমিতে চাষের আওতায় আনা সম্ভব। পেরিলার প্রতিটি পুষ্পমঞ্জুরিতে ১০০ থেকে ১৫০টি বীজ পাওয়া যায়। এরপর স্থানীয় সরিষা ভাঙানোর মেশিনে পেরিলার বীজ ভাঙানো হয়েছে। প্রতি কেজি পেরিলায় তেল পাওয়া গেছে ৪০০ গ্রামের মতো।
তিনি আরও জানান, বীজে ২৫ শতাংশের ওপরে আমিষ থাকায় তেল আহরণের পর তা থেকে প্রাপ্ত খৈল গবাদিপশুর জন্য পুষ্টিকর খাবারসহ জৈবসার হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। ৭০-৭৫ দিনের এ ফসল থেকে হেক্টরপ্রতি সর্বোচ্চ ১.৫ টন পরিমাণ বীজ সংগ্রহ করা যায়। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, বাণিজ্যিকভাবে চাষে যেমন তেলের আমদানির পরিমাণ কমে যাবে, তেমনি সাউ পেরিলা-১ দেশের অর্থনীতিতেও আনতে পারে আমূল পরিবর্তন।
মনিটরিং অফিসার, তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রাজশাহী অঞ্চল মো. সাজ্জাদ হোসেন সংবাদ-কে জানান, রাজশাহী অঞ্চ
লে (রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ) তেলজাতীয় ফসলের আবাদ- সরিষা ৮৬২৫৯ হেক্টর, চিনাবাদাম ১৪১৮ হেক্টর, সূর্যমুখী ৩১৪ হেক্টর, তিল ৬০ হেক্টর। আমাদের দেশে যে পরিমাণ তেলজাতীয় ফসল উৎপাদন হয় তা দ্বারা চাহিদার মাত্র ১০ ভাগ পূরণ হয়। বাকি ৯০ ভাগ আমদানি করতে হয়। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যেমে আবাদি এরিয়া বাড়ানো ও নতুন নতুন জাত ও প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তেলের ঘাটতি পূরণ ও দেশে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে বরেন্দ্র অঞ্চলে তেলজাতীয় ফসল চাষের পথ দেখাচ্ছেন কৃষকরা। এর ফলে ভোজ্যতেলের আমদানি নিভর্রতা ধীরে ধীরে কমবে বলেও মনে করেন কৃষকরা। এই অঞ্চলের কৃষরা তেল ফসলের মধ্যে সরিষা, সুর্যমুখী, পেরিলা চাষ করছেন বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাজশাহী অঞ্চলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। ধানের উৎপাদন না কমিয়ে বাড়তি ফসল হিসেবে তেলের প্রধান ফসল তেলজাতীয় ফসল চাষ করলে দেশের কৃষি খাত বিরাট উপকৃত হবে। কর্মকর্তারা বলেন, আমরা বছরে বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেল আমদানি করি। এজন্য অনেক বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়।
কমবে আমদানি নির্ভরতা
শনিবার, ১৪ মে ২০২২
ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণে দেশেই তেলজাতীয় ফসল চাষের পথ দেখাচ্ছেন বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা। তাদের তেলজাতীয় ফসল চাষের আগ্রহে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা ধীরে ধীরে কমবে বলেও মনে করেন কৃষকরা। প্রাচীন কাল থেকে আমাদের দেশের কৃষকরা দেশেই উৎপাদিত ভোজ্যতেলের চাহিদা মিটিয়ে আসছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাজশাহী অঞ্চলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধানের উৎপাদন না কমিয়ে বাড়তি ফসল হিসেবে তেলের প্রধান ফসল তেলজাতীয় বীজ চাষ করলে দেশের কৃষি খাত বিরাট উপকৃত হবে। কর্মকর্তারা বলেন, আমরা বছরে বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেল আমদানি করি। এজন্য অনেক বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়। তেল ফসলের মধ্যে সরিষা অন্যতম। এক সময় দেশের শতভাগ মানুষ সরিষার তেল দিয়েই বিভিন্ন খাবার রান্না করে খেত। সে সময় মানুষের শরীরে নানা অজানা রোগও কম হতো। কালের বিবর্তনে গত কয়েক বছর ধরে কৃষক পর্যায়ে সরিষার আবাদ হ্রাস পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ধরনের তেল বিদেশ থেকে আমদানি করে দেশের বাজার সয়লাব করে দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ অর্থের অপচয় করেছেন। এ কারণে দেশের কৃষকরা সরিষা চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। তাই দেশের সব মানুষের স্বাস্থ্য ও সব কৃষকের লাভজনক কৃষি উৎপাদনের বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন উচ্চ ফলনশীল জাতের সরিষা বারি ১৪, ১৫ ও ১৮। বিশেষ করে বারি সরিষা ১৮-এর মধ্যে ইউরেসিক এসিডের পরিমাণ একেবারেই কম থাকায় এটি মানবদেহের জন্য খুবই উৎকৃষ্টমানের তেল। তাছাড়া অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ বেশি এবং খৈলে গোকোসিনুলেটর পরিমাণও ক্ষতিকর মাত্রার চেয়ে কম।
এদিকে রাজশাহীতে মুজিববর্ষ উপলক্ষে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করে তেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে ও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তরুণ সূর্যমুখী ফুলচাষিরা।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী জেলার ৬টি উপজেলা দুর্গাপুর, পুঠিয়া, চারঘাট, তানোর, বাগমারা, মোহনপুরে এই মৌসুমে ১৫৬ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী ফুল চাষে হয়েছে।
দুর্গাপুর উপজেলায় পৌর সদরের সিংগা গ্রামের আনোয়ার হোসেন, আকরাম আলী, জাহিদ হোসেন, আব্দুল জলিলসহ আরও অনেকে হাইসান-৩৩ জাতের সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেছেন।
দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহসীন মৃধা বলেন, স্বাস্থ্যসম্মত বিশুদ্ধ তেল উৎপাদনে সূর্যমুখীর জুড়ি নেই। দেশের অন্যান্য জেলা উপজেলার মতো দুর্গাপুর উপজেলায় এখন বাণিজ্যিকভাবে সূর্যমুখী চাষ হচ্ছে।
সারাক্ষণ এ ফুলের ওপর বসে মৌমাছিরা মধু আহরণ করায় বিপুল পরিমাণ মধু সংগ্রহ করাও সম্ভব। এ কারণে সূর্যমুখী চাষ করে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন দেখছেন দুর্গাপুর এলাকার চাষিরা।
সূর্যমুখীর বাম্পার ফলনে গ্রামীণ অর্থনীতিতে সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে। দুর্গাপুরের সূর্যমুখী চাষি আনোয়ার হোসেন জানান, আগে তিনি বিভিন্ন ধরনের শস্য, ফল, ফুলসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করতেন। উপজেলা কৃষি অফিসের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মকলেছুর রহমানের পরামর্শে তিনি প্রথমবারের মতো হাইসান-৩৩ জাতের সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেছেন। কৃষকদের সূর্যমুখী ফুল চাষে আগ্রহী করতে তার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। ইতোমধ্যে প্রতিটি গাছে ফুল ধরেছে।
প্রথমবারেই সূর্যমুখী চাষে সফলতা ও লাভের আশা করছেন তিনি। কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে বীজ দিয়েছে। বাগানে ফুল আসার পর প্রতিদিনই লোকজন আসছে বাগান দেখতে। তিনিও আশা করছেন আগামীতে সরকারি প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পাওয়া গেলে আরও বড় পরিসরে বাণিজ্যিকভাবে সূর্যমুখী চাষ করার।
বাগমারা উপজেলার শ্রীপুর এলাকার সূর্যমুখী চাষি আবদুল জলিল জানান, ধান এবং সবজি চাষ করে প্রতি বছর তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। যার ফলে অনেক প্রান্তিক চাষি এখন দেনার দায়ে দিশেহারা। তাই বিকল্প পথ হিসেবে সূর্যমুখী চাষে ঝুঁকছেন।
তানোর উপজেলার সরনজাই এলাকার সূর্যমুখী ফুলচাষি মোশাররফ হোসেন বলেন, সূর্যমুখী চাষে সার কীটনাশক ও সেচ পানির খুব একটা প্রয়োজন হয় না। তারা অনেকে এ বছর নতুনভাবে এ ফুলের চাষ করেছেন।
সূর্যমুখী ফুলচাষ নিয়ে দুর্গাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মসিউর রহমান বলেন, দুর্গাপুরের কৃষকরা বাণিজ্যিকভাবে এই প্রথমবারের মতো সূর্যমুখী ফুলের চাষ শুরু করেছেন। দুর্গাপুর উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে চাষিদের বিভিন্ন ধরনের সহায়তা করা হয়েছে। সূর্যমুখী ফুল চাষে উদ্বুদ্ধ করতে কৃষকদের বিনামূল্যে সূর্যমুখীর বীজ দেয়া হয়েছে। আশা করি ফলন খুবই ভালো হবে। আগামীতে আরও বেশি জমিতে সূর্যমুখীর চাষ হবে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক উম্মে সালমা বলেন, জেলার ৬টি উপজেলায় এর আগে কৃষকদের সূর্যমুখী ফুল চাষে তেমন একটা আগ্রহ ছিল না। মুজিববর্ষ উপলক্ষে এবার কৃষি কর্মকর্তাদের উদ্বুদ্ধকরণে রাজশাহীতে এক হাজার ২২৩ জন কৃষক সূর্যমুখী চাষ করেছেন।
সূর্যমুখী বীজ রোপণের ৯০-১০৫ দিনের মধ্যেই কৃষকরা ফুল থেকে বীজ ঘরে তুলতে পারবেন। তিনি আরও জানান, যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে কোন প্রকার ক্ষতি না হয় তাহলে প্রতি বিঘা জমিতে ৮ থেকে ১০ মণ সূর্যমুখী ফুলের বীজ পাওয়া যাবে। এক মণ বীজ থেকে ১৮ কেজি তেল পাওয়া যাবে। বিঘাপ্রতি কৃষক ১০-১১ হাজার টাকার বীজ বিক্রি করতে পারবেন। সূর্যমুখীর তেল ছাড়াও খৈল দিয়ে মাছের খাবার এবং সূর্যমুখী গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এই গাছের কোন অংশই ফেলে দেয়ার প্রয়োজন হয় না।
এদিকে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে সূর্যমুখীর পরীক্ষামূলক চাষ শুরু হয় গত কয়েক বছর আগে। এখানেও সফলতা পেয়েছেন চাষিরা। প্রাপ্ত সফল্যে আগামীতে বরেন্দ্রজুড়ে উচ্চমূল্যের পেরিলা ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। বাংলাদেশে যে পেরিলার চাষ হচ্ছে সেটি কোরিয়ান পেরিলা।
পেরিলার তেল বিশেষকরে হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক ও ত্বকসহ ডায়াবেটিস রোগপ্রতিরোধে বেশ কার্যকর। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীন, নেপাল, ভিয়েতনাম এবং ভারতের কিছু অঞ্চলে পেরিলার চাষ হয়।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডসমৃদ্ধ তেলটি দেশের তেলের ঘাটতি কমিয়ে আনার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে যথেষ্ট অবদান রাখতে সক্ষম বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। বাণিজ্যিক চাহিদা বেশি থাকায় ইতোমধ্যে বাণিজ্যিকভাবে সাউ পেরিলা-১ চাষের উৎসাহ দেখিয়েছে বেসরকারি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। জাতীয় বীজ বোর্ডে ‘সাউ পেরিলা-১’ নামে পেরিলার নতুন জাতটির নিবন্ধন পায় ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি।
গোদাগাড়ীর পেরিলা চাষি শাহাদাত হোসাইন জানান, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তার ফেইসবুক পোস্টে উপজেলায় পেরিলার গবেষণা পট বিষয়ে জানতে পারেন। যোগাযোগ করার পর তিনিও সেই সুযোগ পেয়ে যান। পরে পেরিলা বীজ, সার ও কীটনাশকসহ সব ধরনের সহায়তা নেন কৃষি অধিদপ্তর থেকে।
বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এ যুবক জানান, প্রথমে সাত কাঠা জমিতে পেরিলা আবাদ করেন। তা থেকে বীজ পেয়েছিলেন ৯ কেজি। বীজ ভাঙিয়ে তেল হয়েছে এক লিটার ৮০০ গ্রাম। পুরো তেলই উপজেলা কৃষি দপ্তর সংগ্রহ করেছে।
পেরিলা চাষে তেমন বাড়তি যত্ন নেয়ার প্রয়োজন নেই বলে জানান তরুণ এই কৃষি উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, বীজতলায় বীজ বপন করে এক মাসের মাথায় এর চারা তৈরি হয়। এরপর জমি তৈরি করে সাধারণত মরিচ কিংবা বেগুন চারা রোপণের মতো সারিবদ্ধ করে পেরিলা চারা রোপণ করতে হয়। পেরিলা চাষের সমস্যা প্রসঙ্গে বলেন, শুধু শুয়োপোকা পেরিলার পাতা খেয়ে ফেলছিল। তা ছাড়া কিছু গাছে ছত্রাকের আক্রমণে কান্ড পচে যায়। এ দুই বালাই নিয়ন্ত্রণে তিনি কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ মেনে কীটনাশক প্রয়োগ করেন।
এ বিষয়ে গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম জানান, দেশের ১৪টি অঞ্চলে একযোগে পেরিলার গবেষণা পট ছিল। বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া এবং গোদাগাড়ী পৌর এলাকার লালবাগ রামনগর এলাকায় দুটি প্রদর্শনী পট ছিল পেরিলার। নতুন এ ফসল চাষে সাফল্য পাওয়া গেছে। তিনি আরও জানান, পেরিলার চারা আগস্টে জমিতে রোপণ করতে হয়। কিন্তু গোদাগাড়ীতে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে রোপণ করেছিলেন তারা। আর ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে তোলা হয় ফসল। জমিতে পেরিলার জীবনকাল ৭০ থেকে ৭৫ দিন। এটি সহজেই চার ফসলি জমিতে চাষের আওতায় আনা সম্ভব। পেরিলার প্রতিটি পুষ্পমঞ্জুরিতে ১০০ থেকে ১৫০টি বীজ পাওয়া যায়। এরপর স্থানীয় সরিষা ভাঙানোর মেশিনে পেরিলার বীজ ভাঙানো হয়েছে। প্রতি কেজি পেরিলায় তেল পাওয়া গেছে ৪০০ গ্রামের মতো।
তিনি আরও জানান, বীজে ২৫ শতাংশের ওপরে আমিষ থাকায় তেল আহরণের পর তা থেকে প্রাপ্ত খৈল গবাদিপশুর জন্য পুষ্টিকর খাবারসহ জৈবসার হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। ৭০-৭৫ দিনের এ ফসল থেকে হেক্টরপ্রতি সর্বোচ্চ ১.৫ টন পরিমাণ বীজ সংগ্রহ করা যায়। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, বাণিজ্যিকভাবে চাষে যেমন তেলের আমদানির পরিমাণ কমে যাবে, তেমনি সাউ পেরিলা-১ দেশের অর্থনীতিতেও আনতে পারে আমূল পরিবর্তন।
মনিটরিং অফিসার, তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রাজশাহী অঞ্চল মো. সাজ্জাদ হোসেন সংবাদ-কে জানান, রাজশাহী অঞ্চ
লে (রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ) তেলজাতীয় ফসলের আবাদ- সরিষা ৮৬২৫৯ হেক্টর, চিনাবাদাম ১৪১৮ হেক্টর, সূর্যমুখী ৩১৪ হেক্টর, তিল ৬০ হেক্টর। আমাদের দেশে যে পরিমাণ তেলজাতীয় ফসল উৎপাদন হয় তা দ্বারা চাহিদার মাত্র ১০ ভাগ পূরণ হয়। বাকি ৯০ ভাগ আমদানি করতে হয়। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যেমে আবাদি এরিয়া বাড়ানো ও নতুন নতুন জাত ও প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তেলের ঘাটতি পূরণ ও দেশে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে বরেন্দ্র অঞ্চলে তেলজাতীয় ফসল চাষের পথ দেখাচ্ছেন কৃষকরা। এর ফলে ভোজ্যতেলের আমদানি নিভর্রতা ধীরে ধীরে কমবে বলেও মনে করেন কৃষকরা। এই অঞ্চলের কৃষরা তেল ফসলের মধ্যে সরিষা, সুর্যমুখী, পেরিলা চাষ করছেন বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাজশাহী অঞ্চলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। ধানের উৎপাদন না কমিয়ে বাড়তি ফসল হিসেবে তেলের প্রধান ফসল তেলজাতীয় ফসল চাষ করলে দেশের কৃষি খাত বিরাট উপকৃত হবে। কর্মকর্তারা বলেন, আমরা বছরে বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেল আমদানি করি। এজন্য অনেক বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়।