মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কুতুবপুর এলাকায় রোববার (১৯ মার্চ) ঢাকাগামী ইমাদ পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস ‘নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে’ খাদে পড়ে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এদিন ভোরে পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই ১৪ জন নিহত হন। পরে রাত ৮টা পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৯ জনে দাঁড়ায়। নিহতদের বেশিরভাগেরই মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত বলে জানা গেছে। এছাড়া অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন, যাদের ঢাকা মেডিকেলসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
এই ঘটনায় ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে বাসটির সামনের চাকা ফেটে বা দ্রুতগতির কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অবশ্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বলছে, ফিটনেস সনদ ছাড়াই চলছিল ইমাদ পরিবহনের বাসটি (ঢাকা মেট্রো ব ১৫-৩৩৪৮)। এর ফিটনেস সনদের মেয়াদ চলতি বছরের জানুয়ারিতে শেষ হয়ে গেছে। তবে বাসটির বৈধ নিবন্ধন ও ট্যাক্স টোকেন রয়েছে বলেও জানা গেছে। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, এদিন ভোররাতে খুলনা থেকে যাত্রীবোঝাই করে ইমাদ পরিবহনের বাসটি ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। এটি গোপালগঞ্জের ঘোনাপাড়া থেকে ১৫ জন যাত্রী তোলে। পদ্মা সেতুর আগে ঢাকা-খুলনা এক্সপ্রেসওয়ের মাদারীপুরের শিবচরের কুতুবপুর সীমানা এলাকায় আসলে বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিচে পড়ে যায়। এতে বাসটি এক্সপ্রেসওয়ের নিচের আন্ডারপাসের গাইড ওয়ালের সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুমড়ে-মুচড়ে যায়।
এতে ঘটনাস্থলেই ১৪ জন নিহত হয়। আহতাবস্থায় অনেককে উদ্ধার করে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পাঁচ্চর রয়েল হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরমধ্যে বেশ কয়েকজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও নিয়ে আসা হয়। হাসপাতালে নেয়ার পর আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও আহতদের বর্ণানা
দুর্ঘটনায় ছেলেসহ বেঁচে যাওয়া আহত আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘বাসটি চলতে চলতে হঠাৎ বিকট শব্দ হলো। তারপর দেখি উপর থেকে অনেক নিচে পড়ে গেলাম। তারপর স্থানীয়রা আমাদের উদ্ধার করে।’ আরেক আহত দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি একেবারে বাসের পেছনের সিটে বসে ছিলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমের মধ্যেই বিকট শব্দ পাই। সঙ্গে সঙ্গেই বাসটি উল্টে নিচে পড়ে যায়। পরে উদ্ধার হয়ে চিকিৎসা নিয়েছি এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।’
স্থায়ীয় উদ্ধারকর্মীদের ভাষ্য, বাসটি ভরা যাত্রী ছিল। সড়ক থেকে বাসটি পড়ার সময় ডিগবাজি খায়। এ কারণে এত প্রাণহানি। স্থানীয় দোকানি আবুল হোসেন বলেন, ‘সকালে দোকান খুলতেই বিকট শব্দে চেয়ে দেখি বাসটি হাইওয়ে থেকে পড়ে গেল।’ আরেক স্থানীয় ইউসুফ মিয়া বলেন, ‘বাসটি অনেক গতিতে চলছিল।’
উদ্ধারকর্মী চন্দন রায় বলেন, ‘এক্সপ্রেসওয়েতে এর আগেও বাস, প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় পড়েছে। কিন্তু এবারই প্রথম বাস খাদে পড়ে ১৬ জন মারা গেছেন। এক্সপ্রেসওয়েতে চালকেরা অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালান, যা এখানে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।’
পুলিশ যা বলছে
শিবচর হাইওয়ে পুলিশের ওসি আবু নাঈম মো. মোফাজ্জেল হক বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে অতিরিক্ত গতির কারণে বাসটির চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে সেটি খাদে পড়ে যায়।’
ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার ওসি তৈমুর ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ধারণা বাসটি বেপরোয়া গতিতে চলেছে। সেই কারণে চাকা ফেটে যাওয়ার পর চালক নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। তবে তদন্তের পর এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।’ এ বিষয়ে মাদারীপুর পুলিশ সুপার মো. মাসুদ আলম বলেন, ‘সামনের চাকা ফেটে বা দ্রুতগতির কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।’
১৭ জনের পরিচয় শনাক্ত, মরদেহ হস্তান্তর
দুর্ঘটনায় নিহত ১৯ জনের মধ্যে ১৭ জনের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। তাদের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ১৭ জনের মরদেহ শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছিল এবং বাকি ২ জনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ রয়েছে। এ তথ্য নিশ্চিত করেন শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাজিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘নিহতদের পরিবারগুলোকে ২৫ হাজার করে অনুদান দেয়া হয়েছে।’
নিহতরা হলেন ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার মো. ইসমাইল (৩৮), গোপালগঞ্জের সদরের মো. হেদায়েত বাহার, মোস্তাক আহম্মেদ, মো. সজিব, সুইটি, আফসানা মিমি, টুঙ্গিপাড়ার মো. কবির শেখ, মকসুদপুরের মাসুদ, নড়াইলের কালনার মো. ফরহাদ সিকদার, বাগেরহাটের মোল্লারহাটের অনাদি রঞ্জন মজুমদার, খুলনা সদরের শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল-মামুন, চিন্ময় ঘোষ, মো. আশফাকুজ্জামান লিংকন, ডুমুরিয়ার মহাদেব কুমার, সাতক্ষীরার দেবহাটার রাশেদ সরদার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার মো. জাহিদ এবং পাবনার সুজানগরের ইউসুফ।
নিহত আহত স্বজনদের আহাজারি
দুর্ঘটনায় নিহত আশফাকুজ্জামান লিংকন পেশায় ঠিকাদার। ঢাকা ও খুলনায় তার কাজ চলছে। আর ছোট ভাই ইশরাকুজ্জামান রাজবাড়ীতে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত। তারা খুলনার টুটপাড়া আমতলা মসজিদ এলাকার শাহাজাহান মোল্লার ছেলে। ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত ছিলেন লিংকন। ভোরে বাড়ি থেকে একসঙ্গে বের হয়েছিলেন দুই ভাই। পথে ছোট ভাই গোপালগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে নেমে ট্রেনে করে রাজবাড়ীর উদ্দেশে চলে যান। কিছুক্ষণ পর জানতে পারেন বাসটি দুর্ঘটনায় পড়েছে। পরে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে ভাইয়ের সর্বশেষ তথ্য জানার চেষ্টা করেন ব্যাংক কর্মকর্তা ইশরাকুজ্জামান। শেষে উপজেলা প্রশাসন থেকে তাকে জানানো হয় তার ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
আক্ষেপ করে ইশরাক বলেন, ‘বাসে আমার পেছনের আসনে বসেছিল লিংকন। শুরু থেকেই গাড়িটি খুব দ্রুতগতিতে চলছিল। চালককে এ বিষয়ে সতর্ক করা হলেও সে শোনেনি। ভোর ৬টার দিকে গাড়িটি গোপালগঞ্জে পৌঁছায়। সেখান নামার আগে লিংকন বলেছিল, ‘ভালো থাকিস’। এটাই তার সঙ্গে আমার শেষ কথা।’ এদিন দুপুরে মাদারীপুর থেকে ভাইয়ের মরদেহ নিয়ে খুলনার উদ্দেশে রওনা হন ইশরাক। তিনি বলেন, ‘দুই ভাই একসঙ্গে বের হলাম। এখন ভাইয়ের লাশ নিয়ে ফিরছি। বাবা-মাকে কি বলে সান্তনা দেবো জানি না।’
ঈদে দুই মেয়ের জন্য লাল জামা ও পুতুল কেনা হলো না শিবচর বাস দুর্ঘটনায় নিহত ব্যাংকার রাশেদ সরদারের। রাশেদ সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা উপজেলার সখীপুর এলাকার আসমত আলী সরদারের ছেলে। ঢাকায় ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের হেড অফিসে লোন শাখায় কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করতেন। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে সাতক্ষীরা গিয়েছিলেন শ্যালিকার মৃত্যুবার্ষিকীর দোয়া মাহফিলে অংশ নিতে। এখন তিন দিন পর রাশেদ সরদারের দোয়া মাহফিল করতে হবে।
নিহত রাশেদ সরদারের শ্বশুর শফিকুল ইসলাম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘গতকাল (বৃহস্পতিবার) রাতে রাশেদের দুই মেয়ে সারা ও সাফা আমার কোলে বসেছিল। বাবা ঈদের আগে আর ছুটিতে আসবে না জেনে তারা তাদের বাবাকে বলেছিল এবার ঈদে কিন্তু আমাদের লাল জামা ও পুতুল চাই। না হলে কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব না। এই ছোট দুটি বাচ্চার কথাই সত্যি হলো, তাদের বাবা কখনোই আর তাদের সঙ্গে কথা বলবে না। তারা এখন বাবার জন্য পথ চেয়ে থাকবে। কে তাদের ঈদের নতুন জামা আর পুতুল কিনে দেবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমি ছাড়া আমার দুই নাতনি আর তাদের মায়ের কেউ রইল না। এখন এই পরিবারটিকে আমাকেই দেখতে হবে। প্রশাসনের কাছে একটাই অনুরোধ- আপনারা খেয়াল রাখবেন যেন দ্রুতগতিতে কেউ গাড়ি না চালায়, কেউ সন্তানহারা না হয়।’
ঘটনা তদন্তে কমিটি
এ ঘটনায় ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী দুই কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন।
তিনি বলেন, মাদারীপুর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পল্লব কুমার হাজরাকে প্রধান করে এই তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন মাদারীপুর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান ফকির (পিপিএম), বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক শাহ নেওয়াজ হাসানাত-ই-রাব্বি, মাদারীপুর বিআরটিএর সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল হোসেন।
রোববার, ১৯ মার্চ ২০২৩
মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কুতুবপুর এলাকায় রোববার (১৯ মার্চ) ঢাকাগামী ইমাদ পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস ‘নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে’ খাদে পড়ে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এদিন ভোরে পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই ১৪ জন নিহত হন। পরে রাত ৮টা পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৯ জনে দাঁড়ায়। নিহতদের বেশিরভাগেরই মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত বলে জানা গেছে। এছাড়া অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন, যাদের ঢাকা মেডিকেলসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
এই ঘটনায় ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে বাসটির সামনের চাকা ফেটে বা দ্রুতগতির কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অবশ্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বলছে, ফিটনেস সনদ ছাড়াই চলছিল ইমাদ পরিবহনের বাসটি (ঢাকা মেট্রো ব ১৫-৩৩৪৮)। এর ফিটনেস সনদের মেয়াদ চলতি বছরের জানুয়ারিতে শেষ হয়ে গেছে। তবে বাসটির বৈধ নিবন্ধন ও ট্যাক্স টোকেন রয়েছে বলেও জানা গেছে। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, এদিন ভোররাতে খুলনা থেকে যাত্রীবোঝাই করে ইমাদ পরিবহনের বাসটি ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। এটি গোপালগঞ্জের ঘোনাপাড়া থেকে ১৫ জন যাত্রী তোলে। পদ্মা সেতুর আগে ঢাকা-খুলনা এক্সপ্রেসওয়ের মাদারীপুরের শিবচরের কুতুবপুর সীমানা এলাকায় আসলে বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিচে পড়ে যায়। এতে বাসটি এক্সপ্রেসওয়ের নিচের আন্ডারপাসের গাইড ওয়ালের সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুমড়ে-মুচড়ে যায়।
এতে ঘটনাস্থলেই ১৪ জন নিহত হয়। আহতাবস্থায় অনেককে উদ্ধার করে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পাঁচ্চর রয়েল হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরমধ্যে বেশ কয়েকজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও নিয়ে আসা হয়। হাসপাতালে নেয়ার পর আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও আহতদের বর্ণানা
দুর্ঘটনায় ছেলেসহ বেঁচে যাওয়া আহত আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘বাসটি চলতে চলতে হঠাৎ বিকট শব্দ হলো। তারপর দেখি উপর থেকে অনেক নিচে পড়ে গেলাম। তারপর স্থানীয়রা আমাদের উদ্ধার করে।’ আরেক আহত দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি একেবারে বাসের পেছনের সিটে বসে ছিলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমের মধ্যেই বিকট শব্দ পাই। সঙ্গে সঙ্গেই বাসটি উল্টে নিচে পড়ে যায়। পরে উদ্ধার হয়ে চিকিৎসা নিয়েছি এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।’
স্থায়ীয় উদ্ধারকর্মীদের ভাষ্য, বাসটি ভরা যাত্রী ছিল। সড়ক থেকে বাসটি পড়ার সময় ডিগবাজি খায়। এ কারণে এত প্রাণহানি। স্থানীয় দোকানি আবুল হোসেন বলেন, ‘সকালে দোকান খুলতেই বিকট শব্দে চেয়ে দেখি বাসটি হাইওয়ে থেকে পড়ে গেল।’ আরেক স্থানীয় ইউসুফ মিয়া বলেন, ‘বাসটি অনেক গতিতে চলছিল।’
উদ্ধারকর্মী চন্দন রায় বলেন, ‘এক্সপ্রেসওয়েতে এর আগেও বাস, প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় পড়েছে। কিন্তু এবারই প্রথম বাস খাদে পড়ে ১৬ জন মারা গেছেন। এক্সপ্রেসওয়েতে চালকেরা অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালান, যা এখানে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।’
পুলিশ যা বলছে
শিবচর হাইওয়ে পুলিশের ওসি আবু নাঈম মো. মোফাজ্জেল হক বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে অতিরিক্ত গতির কারণে বাসটির চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে সেটি খাদে পড়ে যায়।’
ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার ওসি তৈমুর ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ধারণা বাসটি বেপরোয়া গতিতে চলেছে। সেই কারণে চাকা ফেটে যাওয়ার পর চালক নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। তবে তদন্তের পর এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।’ এ বিষয়ে মাদারীপুর পুলিশ সুপার মো. মাসুদ আলম বলেন, ‘সামনের চাকা ফেটে বা দ্রুতগতির কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।’
১৭ জনের পরিচয় শনাক্ত, মরদেহ হস্তান্তর
দুর্ঘটনায় নিহত ১৯ জনের মধ্যে ১৭ জনের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। তাদের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ১৭ জনের মরদেহ শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছিল এবং বাকি ২ জনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ রয়েছে। এ তথ্য নিশ্চিত করেন শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাজিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘নিহতদের পরিবারগুলোকে ২৫ হাজার করে অনুদান দেয়া হয়েছে।’
নিহতরা হলেন ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার মো. ইসমাইল (৩৮), গোপালগঞ্জের সদরের মো. হেদায়েত বাহার, মোস্তাক আহম্মেদ, মো. সজিব, সুইটি, আফসানা মিমি, টুঙ্গিপাড়ার মো. কবির শেখ, মকসুদপুরের মাসুদ, নড়াইলের কালনার মো. ফরহাদ সিকদার, বাগেরহাটের মোল্লারহাটের অনাদি রঞ্জন মজুমদার, খুলনা সদরের শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল-মামুন, চিন্ময় ঘোষ, মো. আশফাকুজ্জামান লিংকন, ডুমুরিয়ার মহাদেব কুমার, সাতক্ষীরার দেবহাটার রাশেদ সরদার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার মো. জাহিদ এবং পাবনার সুজানগরের ইউসুফ।
নিহত আহত স্বজনদের আহাজারি
দুর্ঘটনায় নিহত আশফাকুজ্জামান লিংকন পেশায় ঠিকাদার। ঢাকা ও খুলনায় তার কাজ চলছে। আর ছোট ভাই ইশরাকুজ্জামান রাজবাড়ীতে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত। তারা খুলনার টুটপাড়া আমতলা মসজিদ এলাকার শাহাজাহান মোল্লার ছেলে। ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত ছিলেন লিংকন। ভোরে বাড়ি থেকে একসঙ্গে বের হয়েছিলেন দুই ভাই। পথে ছোট ভাই গোপালগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে নেমে ট্রেনে করে রাজবাড়ীর উদ্দেশে চলে যান। কিছুক্ষণ পর জানতে পারেন বাসটি দুর্ঘটনায় পড়েছে। পরে বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে ভাইয়ের সর্বশেষ তথ্য জানার চেষ্টা করেন ব্যাংক কর্মকর্তা ইশরাকুজ্জামান। শেষে উপজেলা প্রশাসন থেকে তাকে জানানো হয় তার ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
আক্ষেপ করে ইশরাক বলেন, ‘বাসে আমার পেছনের আসনে বসেছিল লিংকন। শুরু থেকেই গাড়িটি খুব দ্রুতগতিতে চলছিল। চালককে এ বিষয়ে সতর্ক করা হলেও সে শোনেনি। ভোর ৬টার দিকে গাড়িটি গোপালগঞ্জে পৌঁছায়। সেখান নামার আগে লিংকন বলেছিল, ‘ভালো থাকিস’। এটাই তার সঙ্গে আমার শেষ কথা।’ এদিন দুপুরে মাদারীপুর থেকে ভাইয়ের মরদেহ নিয়ে খুলনার উদ্দেশে রওনা হন ইশরাক। তিনি বলেন, ‘দুই ভাই একসঙ্গে বের হলাম। এখন ভাইয়ের লাশ নিয়ে ফিরছি। বাবা-মাকে কি বলে সান্তনা দেবো জানি না।’
ঈদে দুই মেয়ের জন্য লাল জামা ও পুতুল কেনা হলো না শিবচর বাস দুর্ঘটনায় নিহত ব্যাংকার রাশেদ সরদারের। রাশেদ সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা উপজেলার সখীপুর এলাকার আসমত আলী সরদারের ছেলে। ঢাকায় ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের হেড অফিসে লোন শাখায় কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করতেন। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে সাতক্ষীরা গিয়েছিলেন শ্যালিকার মৃত্যুবার্ষিকীর দোয়া মাহফিলে অংশ নিতে। এখন তিন দিন পর রাশেদ সরদারের দোয়া মাহফিল করতে হবে।
নিহত রাশেদ সরদারের শ্বশুর শফিকুল ইসলাম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘গতকাল (বৃহস্পতিবার) রাতে রাশেদের দুই মেয়ে সারা ও সাফা আমার কোলে বসেছিল। বাবা ঈদের আগে আর ছুটিতে আসবে না জেনে তারা তাদের বাবাকে বলেছিল এবার ঈদে কিন্তু আমাদের লাল জামা ও পুতুল চাই। না হলে কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব না। এই ছোট দুটি বাচ্চার কথাই সত্যি হলো, তাদের বাবা কখনোই আর তাদের সঙ্গে কথা বলবে না। তারা এখন বাবার জন্য পথ চেয়ে থাকবে। কে তাদের ঈদের নতুন জামা আর পুতুল কিনে দেবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমি ছাড়া আমার দুই নাতনি আর তাদের মায়ের কেউ রইল না। এখন এই পরিবারটিকে আমাকেই দেখতে হবে। প্রশাসনের কাছে একটাই অনুরোধ- আপনারা খেয়াল রাখবেন যেন দ্রুতগতিতে কেউ গাড়ি না চালায়, কেউ সন্তানহারা না হয়।’
ঘটনা তদন্তে কমিটি
এ ঘটনায় ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী দুই কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন।
তিনি বলেন, মাদারীপুর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পল্লব কুমার হাজরাকে প্রধান করে এই তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন মাদারীপুর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান ফকির (পিপিএম), বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক শাহ নেওয়াজ হাসানাত-ই-রাব্বি, মাদারীপুর বিআরটিএর সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল হোসেন।