alt

অর্থ-বাণিজ্য

তথ্যের অভাব, সংস্কারে গড়িমসি, বড় বিপদে পড়বে অর্থনীতি : আহসান মনসুর

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক : রোববার, ১৪ জুলাই ২০২৪

দেশে সঠিক তথ্যের ‘অভাব’, আর্থিক খাতের সমস্যা ‘লুকিয়ে’ রাখা হচ্ছে, আর তাতে ‘বড় বিপদের দিকে যাচ্ছে’ অর্থনীতি, বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। এই ‘সমস্যা থেকে উত্তরণের’ জন্য আর্থিক খাতের ‘ক্লিনিং’ বা ‘ধোলাই’ বা ‘ঝাড়পোছ’ দরকার বলে বলছেন আইএমএফের সাবেক এই কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, ‘দেশে খেলাপি ঋণ থেকে শুরু করে আমদানি ও রপ্তানি, কোনো কিছরই সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের সবচেয়ে বেশি তথ্য লুকানো হয় আর্থিক খাতে। যেখানে সঠিক তথ্য সবচেয়ে বেশি জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ১১ শতাংশ খেলাপি ঋণ দেখাচ্ছে। আসলে খেলাপি বা মন্দ ঋণ ২৫ শতাংশ। এভাবে আর বেশি দিন চলতে পারবে না।’

ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থার কারণ’ শীর্ষক সেমিনারে গতকাল এসব কথা বলেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর।

তিনি বলেন, ‘দেশে তথ্যের ব্যাপক গরমিল রয়েছে। দেশে যে চালের উৎপাদন দেখানো হচ্ছে, তাতে চাল আমদানির প্রয়োজন নেই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রতি বছর ভারত থেকে ২০ হাজার টন চাল আমদানি করতে হচ্ছে।

আইএমএফের সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাত এখন ব্যাপক দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে। ব্যাংক খাতে টাকা নেই, আর ডলারও নেই।  শেয়ারবাজার ও বন্ড মার্কেট এবং ইন্স্যুরেন্সসহ আথির্ক খাতের অবস্থা খুবই খারাপ।’

আহসান মনসুর বলেন, ‘ঋণ আদায় না করে ঋণের সুদকে আয় দেখিয়ে মুনাফা দেখাচ্ছে ব্যাংক। সেই মুনাফার অর্থ থেকে লভ্যাংশ দিচ্ছে। সরকারকে ট্যাক্সও দিচ্ছে। আসলে কোনো আয়ই হয়নি, আমানতের অর্থ লুটে খাচ্ছে। ঘরের থালাবাটি বেচে কোরমা-পোলাও খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। এভাবে আর কতদিন চলতে পারবে? আমানত শেষ হবে, গ্রাহকের অর্থ আর ফেরত দিতে পারবে না।‘

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘সরকার ঋণ নির্ভর হয়েছে পড়েছে। শুধু ব্যাংক থেকেই ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫ কোটি টাকা ঋণ নিবে। এত টাকা তো ব্যাংকে নেই। আর যদি এত টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়, তাহলে প্রাইভেট সেক্টরে ধস নামবে। কারণ এত টাকা সরকার নিলে প্রাইভেট সেক্টরে ঋণ দিতে পারবে না। তাতে অর্থনীতিতে আরও বড় ধস নামবে।’

‘সাধারণ মানুষ আমানত নিয়ে নিশ্চয়তা পাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা বেশি সুদ দিয়েও ঋণ পাচ্ছে না। টাকা বাইরে চলে গেলে তো সঞ্চয় থাকবে না। রাজস্ব খাতে সরকারের ব্যাপক ব্যর্থতা। সামর্থ্য সরকার নিজেই হারিয়ে ফেলেছে। ধার করার সক্ষমতাও নেই। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নেই।’

আহসান মনসুর বলেন, ‘দেশের আর্থিক খাতের তথ্য সবচেয়ে বেশি লুকানো হচ্ছে। তবে এই খাতের তথ্য বেশি প্রকাশ্যে রাখা উচিত ছিল। ব্যাংক খাত না পারছে সরকারকে কিছু দিতে, আর না পারছে নিজেকে রক্ষা করতে। আমানতকারীদের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। দেশের ব্যাংক খাত একেবারে শুরু থেকে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছে।‘ ব্যাংক খাত ‘কখনও পুরো সফলতার মধ্যে ছিল না’ বলেও মন্তব্য তার।

তিনি বলেন, গত শতকের আটের দশকে ‘ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলোর আবির্ভাব ঘটে। তখনো খেলাপি ঋণ ছিল। এরপর নয়ের দশকের শুরুতে ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টরে বেশ কিছু রিফর্ম করা হলো। আইএমএফ’র অধীনে এ প্রোগ্রামটি বেশ সফলতা পেয়েছিল।‘

‘এরপর দ্বিতীয় ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টরের রিফর্ম হয় ২০০১ সালে। তখনও ভালো সফলতা পাওয়া যায়। তখন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমে আসছিল।‘ যার ‘ধারাবাহিকতা ২০০৯-১০ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল’ বলে জানান আহসান মনসুর।

তিনি বলেন, ‘আর্থিক খাত ঊর্ধ্বমুখী করার ব্যাপারে আমরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছি। ভারতের স্টক মার্কেট কোথায়, আর আমরা কোথায়?’

আহসান মনসুর বলেন, ‘আমাদের ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলো সমাধান না করে জিইয়ে রাখা হচ্ছে। ঘরের দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা ঝাড়ু দিয়ে কার্পেটের নিচে রেখে দিচ্ছে। এতে কি দুর্গন্ধ দূর হবে? না, এটা আবার দুর্গন্ধ ছড়াবে। ব্যাংকে মন্দ ঋণ, অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ পাচার লুকিয়ে এ খাতের সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।

এজন্য আর্থিক খাতের ক্লিনিংয়ের উদ্যোগ নিতে হবে। এ উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককেও দায়িত্ব নিতে হবে।

আহসান মনসুর বলেন, ‘আর্থিক দুরবস্থার কারণে দেশ দিন দিন ঋণ-নির্ভর হয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে ঋণ পাওয়ার সক্ষমতাও কমছে। সরকার বাজেট বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত রাজস্ব আদায় করতে পারছে না। এখন বাজেট বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় টাকাও নেই, ডলারও নেই আমাদের। কীভাবে বাস্তবায়ন হবে? আর্থিক খাতের সংকট মোকাবিলায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো বিকল্প নেই।‘

তিনি বলেন, ‘আমাদের বিদ্যুতের ক্ষেত্রে দুই বিলিয়ন ডলার বকেয়া পড়েছে। পর্যাপ্ত ডলার না থাকার কারণে জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন খাতের বিল পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। যদি স্বাস্থ্য ভালো না থাকে তাহলে তার ভার বহনও করা যায় না।

‘এখন ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশ। চলতি বছর যদি বাড়ে, তাহলে সেটা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হতে পারে। সেই হিসাবে এবছর আমানত আসবে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। তাহলে নতুন অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা কীভাবে দেবে ব্যাংক? সরকার এক লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিলে ব্যক্তি খাত টাকা পাবে না। আবার বাজেটে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ২৭ শতাংশ। এখন পর্যন্ত ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ২২ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। ব্যাংক খাতের আমানতের প্রবৃদ্ধি যদি না হয়, সরকারকে যদি ঋণ দিতে হয় তাহলে ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কীভাবে অর্জন হবে?,’ প্রশ্ন তার।

তিনি বলেন, ‘ব্যাংক খাত নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা দরকার। সেটা সরকারকেই করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়ে নয়। ব্যাংক খাতে আজকের এই অবস্থার কারণ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।’

ইআরএফ সম্পাদক আবুল কাশেমের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা। অনুষ্ঠানে ব্যাংকিং খাতের ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দুজন অর্থনৈতিক প্রতিবেদক ওবায়দুল্লাহ রনি ও সানাউল্লাহ সাকিব।

প্রবন্ধ উপস্থানকালে তারা বলেন, পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন অবকাঠমো তৈরি করে সরকার যে প্রশংসা অর্জন করেছে তা অনেকটাই ম্লান হয়ে যাচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ও নানা আর্থিক কেলেঙ্কারিতে। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হিসেবে এ দায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর বর্তায়। এখনই যদি উদ্যোগ না নেয়া হয় তবে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হবে ব্যাংক খাতে।

ছবি

দেশে মোটরসাইকেল বিক্রি বেড়েছে

ছবি

বাজার সম্প্রসারণে আঞ্চলিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে জোর ব্যবসায়ীদের

নথি গায়েব করে ১৪৬ কোটি টাকার কর ফাঁকি

অধিকাংশ ব্যাংকের অডিট রিপোর্টে ‘ফিকশন’ পাওয়া গেছে: গভর্নর

ছবি

আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচার, কঠোর অবস্থানে বাংলাদেশ ব্যাংক

স্টার্টআপ তহবিল: বয়সের ঊর্ধ্বসীমা উঠে গেল

হাউজ লোন ও ক্রেডিট কার্ড ঋণের সীমা বাড়ছে

সরকারি দফতরে গাড়ি কেনা ও বিদেশ সফর বন্ধ করা হলো

বহুজাতিক কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে সরাসরি তালিকাভুক্তির উদ্যোগ

ছবি

চীনে বিডা’র অফিস খোলার পরিকল্পনা চলছে: আশিক চৌধুরী

দুই বাণিজ্য সংগঠনে প্রশাসক নিয়োগ

ছবি

গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ

ছবি

আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক নয়, সরকারের নিজস্ব উদ্যোগে সংস্কার: অর্থ উপদেষ্টা

ছবি

সততা-দক্ষতার সঙ্গে কাজ করলে কোনো ভয় নেই: এনবিআর চেয়ারম্যান

শেয়ারবাজারে বছরের সর্বোচ্চ লেনদেন

জুলাইয়ের ৭ দিনে রেমিট্যান্স এলো ৮১২৫ কোটি টাকা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থানে হতাহতদের জন্য বিশেষ তহবিল গঠন করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

ছবি

জুলাই হতাহতদের সহায়তায় ২৫ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক

ছবি

বাণিজ্য রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রকে অগ্রাধিকার দিয়ে পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ

ছবি

বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ

ছবি

আকু দায় মিটিয়ে রিজার্ভ ২৪ বিলিয়নের ঘরে

ছবি

ডিএসইতে লেনদেন ৬০০ কোটি টাকা ছাড়ালো

৬ মাসের কম সময়ে আইপিও প্রক্রিয়া শেষ করা হবে: ডিএসই চেয়ারম্যান

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভিশন সংরক্ষণে নতুন নির্দেশনা

জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ

ছবি

ফুডির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলো স্কিটো

ছবি

বাজারে আসছে নতুন স্মার্টফোন ওয়ানপ্লাস নর্ড ৫ সিরিজ

ছবি

বাংলাদেশসহ ১৪ দেশে নতুন শুল্কের সময়সীমা ‘চূড়ান্ত নয়’ আলোচনার দরজা খোলা

ছবি

বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলেন ট্রাম্প

ছবি

বিদেশে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন সবচেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্রে, ভারত ছয় নম্বরে

পাঁচ কার্যদিবসে বিদেশি ও প্রবাসী বিও হিসাব কমেছে প্রায় পাঁচশ’

সূচকের উত্থানে সপ্তাহ শুরু, লেনদেন ৫৭৩ কোটি

ছবি

ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হলেন আদিল চৌধুরী

ছবি

খাদ্যপণ্যের দাম কমায় স্বস্তি, জুনে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ৮.৪৮%

২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে গড় ব্যয় ৩০ পয়সা

রিটার্ন জমায় যেসব খাতে মিলবে করছাড়

tab

অর্থ-বাণিজ্য

তথ্যের অভাব, সংস্কারে গড়িমসি, বড় বিপদে পড়বে অর্থনীতি : আহসান মনসুর

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক

রোববার, ১৪ জুলাই ২০২৪

দেশে সঠিক তথ্যের ‘অভাব’, আর্থিক খাতের সমস্যা ‘লুকিয়ে’ রাখা হচ্ছে, আর তাতে ‘বড় বিপদের দিকে যাচ্ছে’ অর্থনীতি, বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। এই ‘সমস্যা থেকে উত্তরণের’ জন্য আর্থিক খাতের ‘ক্লিনিং’ বা ‘ধোলাই’ বা ‘ঝাড়পোছ’ দরকার বলে বলছেন আইএমএফের সাবেক এই কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, ‘দেশে খেলাপি ঋণ থেকে শুরু করে আমদানি ও রপ্তানি, কোনো কিছরই সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের সবচেয়ে বেশি তথ্য লুকানো হয় আর্থিক খাতে। যেখানে সঠিক তথ্য সবচেয়ে বেশি জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ১১ শতাংশ খেলাপি ঋণ দেখাচ্ছে। আসলে খেলাপি বা মন্দ ঋণ ২৫ শতাংশ। এভাবে আর বেশি দিন চলতে পারবে না।’

ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থার কারণ’ শীর্ষক সেমিনারে গতকাল এসব কথা বলেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর।

তিনি বলেন, ‘দেশে তথ্যের ব্যাপক গরমিল রয়েছে। দেশে যে চালের উৎপাদন দেখানো হচ্ছে, তাতে চাল আমদানির প্রয়োজন নেই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রতি বছর ভারত থেকে ২০ হাজার টন চাল আমদানি করতে হচ্ছে।

আইএমএফের সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাত এখন ব্যাপক দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে। ব্যাংক খাতে টাকা নেই, আর ডলারও নেই।  শেয়ারবাজার ও বন্ড মার্কেট এবং ইন্স্যুরেন্সসহ আথির্ক খাতের অবস্থা খুবই খারাপ।’

আহসান মনসুর বলেন, ‘ঋণ আদায় না করে ঋণের সুদকে আয় দেখিয়ে মুনাফা দেখাচ্ছে ব্যাংক। সেই মুনাফার অর্থ থেকে লভ্যাংশ দিচ্ছে। সরকারকে ট্যাক্সও দিচ্ছে। আসলে কোনো আয়ই হয়নি, আমানতের অর্থ লুটে খাচ্ছে। ঘরের থালাবাটি বেচে কোরমা-পোলাও খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। এভাবে আর কতদিন চলতে পারবে? আমানত শেষ হবে, গ্রাহকের অর্থ আর ফেরত দিতে পারবে না।‘

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘সরকার ঋণ নির্ভর হয়েছে পড়েছে। শুধু ব্যাংক থেকেই ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫ কোটি টাকা ঋণ নিবে। এত টাকা তো ব্যাংকে নেই। আর যদি এত টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়, তাহলে প্রাইভেট সেক্টরে ধস নামবে। কারণ এত টাকা সরকার নিলে প্রাইভেট সেক্টরে ঋণ দিতে পারবে না। তাতে অর্থনীতিতে আরও বড় ধস নামবে।’

‘সাধারণ মানুষ আমানত নিয়ে নিশ্চয়তা পাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা বেশি সুদ দিয়েও ঋণ পাচ্ছে না। টাকা বাইরে চলে গেলে তো সঞ্চয় থাকবে না। রাজস্ব খাতে সরকারের ব্যাপক ব্যর্থতা। সামর্থ্য সরকার নিজেই হারিয়ে ফেলেছে। ধার করার সক্ষমতাও নেই। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নেই।’

আহসান মনসুর বলেন, ‘দেশের আর্থিক খাতের তথ্য সবচেয়ে বেশি লুকানো হচ্ছে। তবে এই খাতের তথ্য বেশি প্রকাশ্যে রাখা উচিত ছিল। ব্যাংক খাত না পারছে সরকারকে কিছু দিতে, আর না পারছে নিজেকে রক্ষা করতে। আমানতকারীদের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। দেশের ব্যাংক খাত একেবারে শুরু থেকে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছে।‘ ব্যাংক খাত ‘কখনও পুরো সফলতার মধ্যে ছিল না’ বলেও মন্তব্য তার।

তিনি বলেন, গত শতকের আটের দশকে ‘ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলোর আবির্ভাব ঘটে। তখনো খেলাপি ঋণ ছিল। এরপর নয়ের দশকের শুরুতে ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টরে বেশ কিছু রিফর্ম করা হলো। আইএমএফ’র অধীনে এ প্রোগ্রামটি বেশ সফলতা পেয়েছিল।‘

‘এরপর দ্বিতীয় ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টরের রিফর্ম হয় ২০০১ সালে। তখনও ভালো সফলতা পাওয়া যায়। তখন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমে আসছিল।‘ যার ‘ধারাবাহিকতা ২০০৯-১০ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল’ বলে জানান আহসান মনসুর।

তিনি বলেন, ‘আর্থিক খাত ঊর্ধ্বমুখী করার ব্যাপারে আমরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছি। ভারতের স্টক মার্কেট কোথায়, আর আমরা কোথায়?’

আহসান মনসুর বলেন, ‘আমাদের ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলো সমাধান না করে জিইয়ে রাখা হচ্ছে। ঘরের দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা ঝাড়ু দিয়ে কার্পেটের নিচে রেখে দিচ্ছে। এতে কি দুর্গন্ধ দূর হবে? না, এটা আবার দুর্গন্ধ ছড়াবে। ব্যাংকে মন্দ ঋণ, অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ পাচার লুকিয়ে এ খাতের সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।

এজন্য আর্থিক খাতের ক্লিনিংয়ের উদ্যোগ নিতে হবে। এ উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককেও দায়িত্ব নিতে হবে।

আহসান মনসুর বলেন, ‘আর্থিক দুরবস্থার কারণে দেশ দিন দিন ঋণ-নির্ভর হয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে ঋণ পাওয়ার সক্ষমতাও কমছে। সরকার বাজেট বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত রাজস্ব আদায় করতে পারছে না। এখন বাজেট বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় টাকাও নেই, ডলারও নেই আমাদের। কীভাবে বাস্তবায়ন হবে? আর্থিক খাতের সংকট মোকাবিলায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো বিকল্প নেই।‘

তিনি বলেন, ‘আমাদের বিদ্যুতের ক্ষেত্রে দুই বিলিয়ন ডলার বকেয়া পড়েছে। পর্যাপ্ত ডলার না থাকার কারণে জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন খাতের বিল পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। যদি স্বাস্থ্য ভালো না থাকে তাহলে তার ভার বহনও করা যায় না।

‘এখন ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশ। চলতি বছর যদি বাড়ে, তাহলে সেটা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হতে পারে। সেই হিসাবে এবছর আমানত আসবে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। তাহলে নতুন অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা কীভাবে দেবে ব্যাংক? সরকার এক লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিলে ব্যক্তি খাত টাকা পাবে না। আবার বাজেটে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ২৭ শতাংশ। এখন পর্যন্ত ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ২২ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। ব্যাংক খাতের আমানতের প্রবৃদ্ধি যদি না হয়, সরকারকে যদি ঋণ দিতে হয় তাহলে ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কীভাবে অর্জন হবে?,’ প্রশ্ন তার।

তিনি বলেন, ‘ব্যাংক খাত নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা দরকার। সেটা সরকারকেই করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়ে নয়। ব্যাংক খাতে আজকের এই অবস্থার কারণ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।’

ইআরএফ সম্পাদক আবুল কাশেমের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা। অনুষ্ঠানে ব্যাংকিং খাতের ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দুজন অর্থনৈতিক প্রতিবেদক ওবায়দুল্লাহ রনি ও সানাউল্লাহ সাকিব।

প্রবন্ধ উপস্থানকালে তারা বলেন, পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন অবকাঠমো তৈরি করে সরকার যে প্রশংসা অর্জন করেছে তা অনেকটাই ম্লান হয়ে যাচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ও নানা আর্থিক কেলেঙ্কারিতে। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হিসেবে এ দায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর বর্তায়। এখনই যদি উদ্যোগ না নেয়া হয় তবে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হবে ব্যাংক খাতে।

back to top