উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা সমাজের সব স্তরের মানুষ। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। এর ওপর নতুন করে ভ্যাট বৃদ্ধির ঘোষণায় জনজীবনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, ভ্যাট বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত হয়তো আগুনের ওপর ঘি ঢালার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। পরিবার সংগ্রামে লড়াইয়ে থাকা স্বল্প আয়ের মানুষ এই নতুন করভার কীভাবে সামলাবে, তা নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝপথে এসে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। এর ফলে মুঠোফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির ফলে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ বাড়বে। আবার পোশাকের দামও বাড়তে পারে ভ্যাট বৃদ্ধির কারণে। বাড়তে পারে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার খরচও। এ ছাড়া মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে মিষ্টি, ওষুধ, এলপি গ্যাস, ফলের রস, ড্রিংক, বিস্কুট, চশমার ফ্রেম, সিগারেটসহ নানা পণ্যের।
আতিকুর রহমান বাবুল একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। ভ্যাট বৃদ্ধির এই খবরে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘এমনিতেই যে পরিমান মূল্যস্ফীতি তাতেই পরিবার পরিবার নিয়ে টিকে থাকতে হাঁসফাঁস অবস্থা। এই ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে দাম যে আরও কত বাড়বে তা চিন্তা করলে গা শিহরে উঠে।’
গত ৯ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে এ সংক্রান্ত দুটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। অধ্যাদেশ দুটি হলো মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ এবং দি এক্সাইজ অ্যান্ড সল্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫। এই দুটি অধ্যাদেশ জারির প্রেক্ষাপটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট বিভাগ এ সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করে। এর ফলে এই অধ্যাদেশের পরিবর্তনগুলো সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়ে গেছে।
এর আগে ১ জানুয়ারি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির এনবিআরের প্রস্তাব পাস করা হয়। এরপর আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়। জাতীয় সংসদ না থাকায় অধ্যাদেশ দিয়েই শুল্ক-কর বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশকে দেয়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের শর্ত হিসেবে অর্থবছরের মাঝপথে এসে একশ’র বেশি পণ্য ও সেবায় শুল্ক-কর বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আইএমএফের চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড় এবং বাড়তি ঋণ পেতে শর্ত হিসেবে শুল্ক-কর বাড়ানো হয়েছে। সরকার এটা ইচ্ছা করে করেনি। আইএমএফের অর্থ পেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে এবং বিনিময় হারের চাপ কমবে।’
সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির ফলে মুঠোফোনে কথা বলার খরচ আগের চেয়ে বাড়বে। এ ছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচও বেড়ে যাবে। কারণ, মুঠোফোনের সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৩ শতাংশ করা হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার গত জুনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় মুঠোফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করেছিল। এ কারণে মোবাইল অপারেটরগুলো তাদের সেবার দামও বাড়িয়েছে। যার মাশুল গুনতে হয়েছে মুঠোফোনের গ্রাহকদের।
ব্র্যান্ডের দোকান বা বিপণিবিতান থেকে তৈরি পোশাক কিনতে গেলেও এখন আগের চেয়ে বেশি ভ্যাট দিতে হবে। পোশাকের আউটলেটের বিলের ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে এক লাফে দ্বিগুণ করা হয়েছে। আগে এ খাতে ভ্যাট হার ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। এখন তা ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে পোশাকের দাম বাড়বে বলে জানান পোশাক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি তারা ব্যবসা কমে যাওয়ারও আশঙ্কাও করছেন। ব্র্যান্ডের পোশাক বা ব্র্যান্ড ব্যতীত পোশাকের দোকান উভয় ক্ষেত্রেই নতুন ভ্যাট হার প্রযোজ্য হবে। এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, কোভিডের পর থেকে এমনিতেই পোশাকের ব্যবসা মন্দা। রোজার ঈদের আগে নতুন করে ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে ব্যবসা আরও শ্লথ হবে।
সব ধরনের রেস্তোরাঁর বিলের ওপর ভ্যাট এক লাফে ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এত দিন এই হার ছিল ৫ শতাংশ। তাতে ১ হাজার টাকা খাবারের বিলে খরচ বাড়বে ১০০ টাকা। সারাদেশে প্রায় সোয়া পাঁচ লাখ রেস্তোরাঁ রয়েছে। শহর এলাকায় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আধুনিক এবং বৈচিত্র্যময় খাবারের দোকান আছে। শহুরে মানুষের মধ্যে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার প্রচলন চালু রয়েছে। ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী পরিবার-পরিজন নিয়ে রেস্তোরাঁর খেতে গেলে আগের চেয়ে বেশি অর্থ খরচ হবে।
বার ও বারযুক্ত হোটেল মোটেলে সেবায় ভ্যাট হার ২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া মিষ্টির দোকানের ভ্যাটও সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে মিষ্টির দামও বেড়ে পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিস্কুট, জুস, ড্রিংক, ফলের রস, ইলেকট্রোলাইট ড্রিংক, কেক (৩০০ টাকার বেশি দামের), আচার, টমেটো সস ও কেচাপ ইত্যাদি শিশুরা বেশি পছন্দ করে। এসব পণ্যভেদে ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের ট্র্যান্সফরমার, নারকেল ছোবড়ার ম্যাট্রেস, আম, আনারস, কলা, পেয়ারা ও তেঁতুলের পেস্ট বিআরটিএ থেকে সরবরাহ করা লেমেনেটেড ড্রাইভিং লাইসেন্সের ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। চাটনি কেচাপ, হাতে তৈরি বিস্কুট, কেক, আচারের ভ্যাট হার একইভাবে বাড়ানো হয়েছে।
ফেসিয়াল টিস্যু, পকেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, টয়লেট টিস্যু, কিচেন টিস্যুসহ বিভিন্ন ধরনের টিস্যুর ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে নতুন অধ্যাদেশে। আগে এই হার ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। ভ্যাট বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার ফলে টিস্যুর দাম বাড়তে পারে।
এ ছাড়া এলপি গ্যাসের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। অন্যদিকে এলপি গ্যাসের স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে বিদ্যমান ২ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। ওষুধের ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট হার ২ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। পাশাপাশি যেকোনো ধরনের স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
এনবিআরের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, তালিকায় থাকা অর্ধশতাধিক পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। শুল্ক-কর বৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে আমদানি করা বাদাম, আম, কমলালেবু, আঙুর, আপেল ও নাশপাতি, ফলের রস, যেকোনো ধরনের তাজা ফল, রং, ডিটারজেন্ট।
এ ছাড়া স্থানীয় উৎস বা দেশের মধ্যে উৎপাদিত তামাকযুক্ত সিগারেট, মদের বিল, পটেটো ফ্ল্যাকসেস, প্লাস্টিক ও মেটাল চশমার ফ্রেম, রিডিং গ্লাস, সান গ্লাস, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ও তাতে ব্যবহৃত তেল, বৈদ্যুতিক খুঁটি, সিআর কয়েল ও জিআই তারে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ৫০ লাখ টাকা থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত বার্ষিক লেনদেন হলে টার্নওভার কর দিতে হতো। এখন বার্ষিক লেনদেন ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা হলেই টার্নওভার বা লেনদেন কর দিতে হবে।
আবগারি শুল্ক বাড়ানোয় আকাশপথে ভ্রমণে খরচও বাড়বে। অভ্যন্তরীণ পথে বিমানযাত্রায় আবগারি শুল্ক ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হয়েছে। সার্কভুক্ত দেশ ভ্রমণে আবগারি শুল্ক ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা এবং সার্কভুক্ত দেশের বাইরে (এশিয়ার মধ্যে) ২ হাজার থেকে বাড়িয়ে আড়াই হাজার টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণে আবগারি শুল্ক ৩ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা করেছে এনবিআর। বিমান টিকিটের দামের সঙ্গে যাত্রীদের কাছ থেকে এই শুল্ক আদায় করা হয়।
মূল্যস্তর পরিবর্তন ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে সব ধরনের সিগারেটের দাম বাড়বে। নিম্ন, মধ্য, উচ্চ ও অতিউচ্চ সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক ৬৭ শতাংশ করা হয়েছে। আগে যা ছিল যথাক্রমে ৬০, ৬৫.৫, ৬৫.৫ ও ৬৫.৫ শতাংশ। স্থানীয় ব্যবসায় ভ্যাটের হার ৫ থেকে ৭.৫ শতাংশ করা হয়েছে। তবে ওষুধ ব্যবসার ক্ষেত্রে এ হার ২.৪ থেকে ৩ শতাংশ করা হয়েছে।
চলচ্চিত্র প্রদর্শক (প্রেক্ষাগৃহ), চলচ্চিত্র পরিবেশক, মেরামত ও সার্ভিসং, স্বয়ংক্রিয় ও যন্ত্রচালিত করাতকল, খেলাধুলার আয়োজক, পরিবহন ঠিকাদার, টেইলার্স, ভবন রক্ষণাবেক্ষণ সংস্থা, খেলাধুলার ক্লাব, বোর্ড সভায় যোগদানকারী, মোটর গ্যারেজ, ডকইয়ার্ড, ছাপাখানা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, ইলেকট্রিক পোলের ভ্যাট ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
এদিকে মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট সব ধরনের মানুষ। ডিসেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও দুই অংকের ঘরে থেকে বছর শেষ হয়েছে। ডিসেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বেশি ছিল। খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ। এই পরিমান মূল্যস্ফীতি হওয়ার অর্থ হলো, গত বছরের ডিসেম্বরে যে খাদ্যপণ্য ১০০ টাকায় কেনা গেছে একই পরিমাণ খাদ্যপণ্য কিনতে এখন ১২ টাকা ৯২ পয়সা বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে ভোক্তাদের।
এ প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এ ধরনের কর এমন এক সময় বাড়ানো হলো, যখন দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে শুধু নি¤œ আয় ও প্রান্তিক আয়ের মানুষ নয়, মধ্যবিত্তরাও হিমশিম খাচ্ছে। তাদের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এখন নতুন শুল্ক-কর আরোপের ফলে এই শ্রেণীর মানুষের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে।’
শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫
উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা সমাজের সব স্তরের মানুষ। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। এর ওপর নতুন করে ভ্যাট বৃদ্ধির ঘোষণায় জনজীবনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, ভ্যাট বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত হয়তো আগুনের ওপর ঘি ঢালার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। পরিবার সংগ্রামে লড়াইয়ে থাকা স্বল্প আয়ের মানুষ এই নতুন করভার কীভাবে সামলাবে, তা নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝপথে এসে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। এর ফলে মুঠোফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির ফলে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ বাড়বে। আবার পোশাকের দামও বাড়তে পারে ভ্যাট বৃদ্ধির কারণে। বাড়তে পারে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার খরচও। এ ছাড়া মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে মিষ্টি, ওষুধ, এলপি গ্যাস, ফলের রস, ড্রিংক, বিস্কুট, চশমার ফ্রেম, সিগারেটসহ নানা পণ্যের।
আতিকুর রহমান বাবুল একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। ভ্যাট বৃদ্ধির এই খবরে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘এমনিতেই যে পরিমান মূল্যস্ফীতি তাতেই পরিবার পরিবার নিয়ে টিকে থাকতে হাঁসফাঁস অবস্থা। এই ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে দাম যে আরও কত বাড়বে তা চিন্তা করলে গা শিহরে উঠে।’
গত ৯ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে এ সংক্রান্ত দুটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। অধ্যাদেশ দুটি হলো মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ এবং দি এক্সাইজ অ্যান্ড সল্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫। এই দুটি অধ্যাদেশ জারির প্রেক্ষাপটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট বিভাগ এ সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করে। এর ফলে এই অধ্যাদেশের পরিবর্তনগুলো সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়ে গেছে।
এর আগে ১ জানুয়ারি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির এনবিআরের প্রস্তাব পাস করা হয়। এরপর আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়। জাতীয় সংসদ না থাকায় অধ্যাদেশ দিয়েই শুল্ক-কর বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশকে দেয়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের শর্ত হিসেবে অর্থবছরের মাঝপথে এসে একশ’র বেশি পণ্য ও সেবায় শুল্ক-কর বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আইএমএফের চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড় এবং বাড়তি ঋণ পেতে শর্ত হিসেবে শুল্ক-কর বাড়ানো হয়েছে। সরকার এটা ইচ্ছা করে করেনি। আইএমএফের অর্থ পেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে এবং বিনিময় হারের চাপ কমবে।’
সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির ফলে মুঠোফোনে কথা বলার খরচ আগের চেয়ে বাড়বে। এ ছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচও বেড়ে যাবে। কারণ, মুঠোফোনের সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৩ শতাংশ করা হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার গত জুনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় মুঠোফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করেছিল। এ কারণে মোবাইল অপারেটরগুলো তাদের সেবার দামও বাড়িয়েছে। যার মাশুল গুনতে হয়েছে মুঠোফোনের গ্রাহকদের।
ব্র্যান্ডের দোকান বা বিপণিবিতান থেকে তৈরি পোশাক কিনতে গেলেও এখন আগের চেয়ে বেশি ভ্যাট দিতে হবে। পোশাকের আউটলেটের বিলের ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে এক লাফে দ্বিগুণ করা হয়েছে। আগে এ খাতে ভ্যাট হার ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। এখন তা ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে পোশাকের দাম বাড়বে বলে জানান পোশাক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি তারা ব্যবসা কমে যাওয়ারও আশঙ্কাও করছেন। ব্র্যান্ডের পোশাক বা ব্র্যান্ড ব্যতীত পোশাকের দোকান উভয় ক্ষেত্রেই নতুন ভ্যাট হার প্রযোজ্য হবে। এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, কোভিডের পর থেকে এমনিতেই পোশাকের ব্যবসা মন্দা। রোজার ঈদের আগে নতুন করে ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে ব্যবসা আরও শ্লথ হবে।
সব ধরনের রেস্তোরাঁর বিলের ওপর ভ্যাট এক লাফে ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এত দিন এই হার ছিল ৫ শতাংশ। তাতে ১ হাজার টাকা খাবারের বিলে খরচ বাড়বে ১০০ টাকা। সারাদেশে প্রায় সোয়া পাঁচ লাখ রেস্তোরাঁ রয়েছে। শহর এলাকায় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আধুনিক এবং বৈচিত্র্যময় খাবারের দোকান আছে। শহুরে মানুষের মধ্যে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার প্রচলন চালু রয়েছে। ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী পরিবার-পরিজন নিয়ে রেস্তোরাঁর খেতে গেলে আগের চেয়ে বেশি অর্থ খরচ হবে।
বার ও বারযুক্ত হোটেল মোটেলে সেবায় ভ্যাট হার ২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া মিষ্টির দোকানের ভ্যাটও সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে মিষ্টির দামও বেড়ে পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিস্কুট, জুস, ড্রিংক, ফলের রস, ইলেকট্রোলাইট ড্রিংক, কেক (৩০০ টাকার বেশি দামের), আচার, টমেটো সস ও কেচাপ ইত্যাদি শিশুরা বেশি পছন্দ করে। এসব পণ্যভেদে ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের ট্র্যান্সফরমার, নারকেল ছোবড়ার ম্যাট্রেস, আম, আনারস, কলা, পেয়ারা ও তেঁতুলের পেস্ট বিআরটিএ থেকে সরবরাহ করা লেমেনেটেড ড্রাইভিং লাইসেন্সের ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। চাটনি কেচাপ, হাতে তৈরি বিস্কুট, কেক, আচারের ভ্যাট হার একইভাবে বাড়ানো হয়েছে।
ফেসিয়াল টিস্যু, পকেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, টয়লেট টিস্যু, কিচেন টিস্যুসহ বিভিন্ন ধরনের টিস্যুর ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে নতুন অধ্যাদেশে। আগে এই হার ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। ভ্যাট বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার ফলে টিস্যুর দাম বাড়তে পারে।
এ ছাড়া এলপি গ্যাসের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। অন্যদিকে এলপি গ্যাসের স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে বিদ্যমান ২ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। ওষুধের ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট হার ২ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। পাশাপাশি যেকোনো ধরনের স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
এনবিআরের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, তালিকায় থাকা অর্ধশতাধিক পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। শুল্ক-কর বৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে আমদানি করা বাদাম, আম, কমলালেবু, আঙুর, আপেল ও নাশপাতি, ফলের রস, যেকোনো ধরনের তাজা ফল, রং, ডিটারজেন্ট।
এ ছাড়া স্থানীয় উৎস বা দেশের মধ্যে উৎপাদিত তামাকযুক্ত সিগারেট, মদের বিল, পটেটো ফ্ল্যাকসেস, প্লাস্টিক ও মেটাল চশমার ফ্রেম, রিডিং গ্লাস, সান গ্লাস, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ও তাতে ব্যবহৃত তেল, বৈদ্যুতিক খুঁটি, সিআর কয়েল ও জিআই তারে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ৫০ লাখ টাকা থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত বার্ষিক লেনদেন হলে টার্নওভার কর দিতে হতো। এখন বার্ষিক লেনদেন ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা হলেই টার্নওভার বা লেনদেন কর দিতে হবে।
আবগারি শুল্ক বাড়ানোয় আকাশপথে ভ্রমণে খরচও বাড়বে। অভ্যন্তরীণ পথে বিমানযাত্রায় আবগারি শুল্ক ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হয়েছে। সার্কভুক্ত দেশ ভ্রমণে আবগারি শুল্ক ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা এবং সার্কভুক্ত দেশের বাইরে (এশিয়ার মধ্যে) ২ হাজার থেকে বাড়িয়ে আড়াই হাজার টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণে আবগারি শুল্ক ৩ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা করেছে এনবিআর। বিমান টিকিটের দামের সঙ্গে যাত্রীদের কাছ থেকে এই শুল্ক আদায় করা হয়।
মূল্যস্তর পরিবর্তন ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে সব ধরনের সিগারেটের দাম বাড়বে। নিম্ন, মধ্য, উচ্চ ও অতিউচ্চ সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক ৬৭ শতাংশ করা হয়েছে। আগে যা ছিল যথাক্রমে ৬০, ৬৫.৫, ৬৫.৫ ও ৬৫.৫ শতাংশ। স্থানীয় ব্যবসায় ভ্যাটের হার ৫ থেকে ৭.৫ শতাংশ করা হয়েছে। তবে ওষুধ ব্যবসার ক্ষেত্রে এ হার ২.৪ থেকে ৩ শতাংশ করা হয়েছে।
চলচ্চিত্র প্রদর্শক (প্রেক্ষাগৃহ), চলচ্চিত্র পরিবেশক, মেরামত ও সার্ভিসং, স্বয়ংক্রিয় ও যন্ত্রচালিত করাতকল, খেলাধুলার আয়োজক, পরিবহন ঠিকাদার, টেইলার্স, ভবন রক্ষণাবেক্ষণ সংস্থা, খেলাধুলার ক্লাব, বোর্ড সভায় যোগদানকারী, মোটর গ্যারেজ, ডকইয়ার্ড, ছাপাখানা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, ইলেকট্রিক পোলের ভ্যাট ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
এদিকে মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট সব ধরনের মানুষ। ডিসেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও দুই অংকের ঘরে থেকে বছর শেষ হয়েছে। ডিসেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বেশি ছিল। খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ। এই পরিমান মূল্যস্ফীতি হওয়ার অর্থ হলো, গত বছরের ডিসেম্বরে যে খাদ্যপণ্য ১০০ টাকায় কেনা গেছে একই পরিমাণ খাদ্যপণ্য কিনতে এখন ১২ টাকা ৯২ পয়সা বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে ভোক্তাদের।
এ প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এ ধরনের কর এমন এক সময় বাড়ানো হলো, যখন দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে শুধু নি¤œ আয় ও প্রান্তিক আয়ের মানুষ নয়, মধ্যবিত্তরাও হিমশিম খাচ্ছে। তাদের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এখন নতুন শুল্ক-কর আরোপের ফলে এই শ্রেণীর মানুষের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে।’