নতুন বছরের দ্বিতীয় মাস এবং ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের অষ্টম মাস ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ২৫২ কোটি ৮০ লাখ (২.৫৩ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২২ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৩০ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৯ কোটি ২ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে যা ১ হাজার ১০১ কোটি ৪৮ লাখ কোটি টাকা।
অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় থাকা প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে উল্লম্ফন অব্যাহত রয়েছে। আর এই সূচকের উপর ভর করে দীর্ঘদিন ধরে চাপের মধ্যে থাকা বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও বেড়েছে। বিপিএম-৬ হিসাবে প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক রোববার রেমিটেন্সের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, নতুন বছরের দ্বিতীয় মাস এবং ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের অষ্টম মাস ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ২৫২ কোটি ৮০ লাখ (২.৫৩ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২২ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৩০ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৯ কোটি ২ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে যা ১ হাজার ১০১ কোটি ৪৮ লাখ কোটি টাকা।
ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনে শেষ হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই মাসে এত প্রবাসী আয় কখনই আসেনি। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ২১৬ কোটি ৪৫ লাখ (২.১৬ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। এ হিসাবে এই ফেব্রুয়ারিতে রেমিটেন্স বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। এ নিয়ে টানা সাত মাস ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স দেশে আসল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এমনটা দেখা যায়নি। দুই মাসে এসেছে আড়াই বিলিয়ন (২.৫০ বিলিয়ন) ডলারের বেশি। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ২৬৪ কোটি (২.৬৪ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা যা ছিল একক মাসের হিসাবে এ যাবতকালের সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স।
এর আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে সর্বোচ্চ ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ (২.৬ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। চলতি অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ (১.৯১ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন। দ্বিতীয় মাস আগস্টে পাঠান ২২২ কোটি ৪১ লাখ (২.২২ বিলিয়ন) ডলার। তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে এসেছিল ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ (২.৪০ বিলিয়ন) ডলার। । চতুর্থ মাস অক্টোবরে আসে ২৩৯ কোটি ৫১ লাখ (২.৩৯ বিলিয়ন) ডলার। পঞ্চম মাস নভেম্বরে এসেছিল ২১৯ কোটি ৯৫ লাখ (২ বিলিয়ন) ডলার। চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে আসে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ (২.১৮ বিলিয়ন) ডলার।
অর্থবছরের আট মাসের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) হিসাবে এক হাজার ৮৪৭ কোটি (১৮.৪৭বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ১ হাজার ৪৯৩ কোটি (১৪.৯৩ বিলিয়ন) ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল দেশে। পুরো অর্থবছরে (জুলাই-জুন) এসেছিল ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসেছিল ২২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থ বছরে এসেছিল ২১ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে আসে ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। যা ছিল অর্থ বছরের হিসাবে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে এসেছিল ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তার ও প্রবাসীদের উৎকণ্ঠার প্রেক্ষাপটে জুলাই মাসে রেমিটেন্স কমেছিল বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। ওই সময় আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার জন্য সরকারকে দায়ী করে দেশে রেমিটেন্স না পাঠাতে সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম চলে মাত্র এক দিন। শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনের মধ্যে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করে বিদায়ী সরকার। এরপর ২৩ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ ছিল। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ব্যাংকের অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল। কয়েক দিন লেনদেন বন্ধের পর ২৪ জুলাই ব্যাংক চালু হয়। ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ১৯ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই বৈধ পথে তথা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে কোনো প্রবাসী আয় আসেনি। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর রেমিটেন্স প্রবাহে আরও ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূনের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় অন্তর্র্বতী সরকারের। রেমিটেন্স প্রবাহেও গতি ফেরে।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি মুদ্রার সংকট চলছে। কোভিড মহামারীর সময়ে আমদানি তলানিতে নামায় একপর্যায়ে দেশে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি খরচ অনেক বেড়ে যায়। একই সাথে প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে যথেষ্ট প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় রিজার্ভ দ্রুত কমতে থাকে।সংকট কাটাতে ও রিজার্ভ বাড়াতে প্রবাসী আয়সহ বিদেশ থেকে অর্থ আনতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত কয়েক মাসে এসব পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে এই সূচকে। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে রেমিটেন্স। এই সূচক বাড়ায় রিজার্ভও বেড়েছে।
গত ৯ জানুয়ারি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের ১ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। আকুর দেনা শোধের আগে ৮ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।
এক সপ্তাহ পর ১৫ জানুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার; গ্রস হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। পরের সপ্তাহে (২২ জানুয়ারি) বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে ১৯ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে; গ্রস হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। ২৯ জানুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার; গ্রস হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। গত ৬ ফেব্রুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। ১৩ ফেব্রুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়ে ২০ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। গ্রস হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার। ২০ ফেব্রুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়ে ২০ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। গ্রস হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার।
সবশেষ গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ ব্যাংক যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ আরও বেড়ে ২০ দশমিক ৯০বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। গ্রস হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। তবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে মাসের প্রথম সপ্তাহে আকুর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ ফের কমে আসবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
রমজান মাসকে সামনে রেখে আমদানি বেড়েছে। সে কারণে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদের আকুর বিল বেশি হবে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা। প্রতি সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার ‘সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে রিজার্ভ, রেমিটেন্স রপ্তানি আয়সহ অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর হালনাগাদ তথ্য থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ হিসেবে দাবি করে। সবশেষ গত ডিসেম্বর মাসের আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ওই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৬ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে ২০ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুদ থাকতে হয়। আকু হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যকার একটি আন্তঃআঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। এশিয়ার ৯টি দেশের মধ্যে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয়, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তা প্রতি দুই মাস পরপর নিষ্পত্তি হয়। অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেন তাৎক্ষণিকভাবে সম্পন্ন হয়। আকুর সদস্য দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভুটান ও মালদ্বীপ। তবে দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় সম্প্রতি এ ব্যবস্থা থেকে বাদ পড়ে শ্রীলঙ্কা।
রিজার্ভের প্রধান উৎস হচ্ছে রপ্তানি আয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে অর্থাৎ জুলাই-জানুয়ারি সময়ে মোট ২ হাজার ৮৯৬ কোটি ৯৫ লাখ (প্রায় ২৯ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেশি।
নতুন বছরের দ্বিতীয় মাস এবং ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের অষ্টম মাস ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ২৫২ কোটি ৮০ লাখ (২.৫৩ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২২ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৩০ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৯ কোটি ২ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে যা ১ হাজার ১০১ কোটি ৪৮ লাখ কোটি টাকা।
সোমবার, ০৩ মার্চ ২০২৫
অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় থাকা প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে উল্লম্ফন অব্যাহত রয়েছে। আর এই সূচকের উপর ভর করে দীর্ঘদিন ধরে চাপের মধ্যে থাকা বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও বেড়েছে। বিপিএম-৬ হিসাবে প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক রোববার রেমিটেন্সের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, নতুন বছরের দ্বিতীয় মাস এবং ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের অষ্টম মাস ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ২৫২ কোটি ৮০ লাখ (২.৫৩ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২২ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৩০ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৯ কোটি ২ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে যা ১ হাজার ১০১ কোটি ৪৮ লাখ কোটি টাকা।
ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনে শেষ হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই মাসে এত প্রবাসী আয় কখনই আসেনি। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ২১৬ কোটি ৪৫ লাখ (২.১৬ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। এ হিসাবে এই ফেব্রুয়ারিতে রেমিটেন্স বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। এ নিয়ে টানা সাত মাস ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স দেশে আসল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এমনটা দেখা যায়নি। দুই মাসে এসেছে আড়াই বিলিয়ন (২.৫০ বিলিয়ন) ডলারের বেশি। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ২৬৪ কোটি (২.৬৪ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা যা ছিল একক মাসের হিসাবে এ যাবতকালের সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স।
এর আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে সর্বোচ্চ ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ (২.৬ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। চলতি অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ (১.৯১ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন। দ্বিতীয় মাস আগস্টে পাঠান ২২২ কোটি ৪১ লাখ (২.২২ বিলিয়ন) ডলার। তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে এসেছিল ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ (২.৪০ বিলিয়ন) ডলার। । চতুর্থ মাস অক্টোবরে আসে ২৩৯ কোটি ৫১ লাখ (২.৩৯ বিলিয়ন) ডলার। পঞ্চম মাস নভেম্বরে এসেছিল ২১৯ কোটি ৯৫ লাখ (২ বিলিয়ন) ডলার। চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে আসে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ (২.১৮ বিলিয়ন) ডলার।
অর্থবছরের আট মাসের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) হিসাবে এক হাজার ৮৪৭ কোটি (১৮.৪৭বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ১ হাজার ৪৯৩ কোটি (১৪.৯৩ বিলিয়ন) ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল দেশে। পুরো অর্থবছরে (জুলাই-জুন) এসেছিল ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসেছিল ২২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থ বছরে এসেছিল ২১ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে আসে ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। যা ছিল অর্থ বছরের হিসাবে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে এসেছিল ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তার ও প্রবাসীদের উৎকণ্ঠার প্রেক্ষাপটে জুলাই মাসে রেমিটেন্স কমেছিল বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। ওই সময় আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার জন্য সরকারকে দায়ী করে দেশে রেমিটেন্স না পাঠাতে সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম চলে মাত্র এক দিন। শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনের মধ্যে দেশজুড়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই রাত থেকে কারফিউ জারি করে বিদায়ী সরকার। এরপর ২৩ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ ছিল। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ব্যাংকের অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল। কয়েক দিন লেনদেন বন্ধের পর ২৪ জুলাই ব্যাংক চালু হয়। ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ১৯ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই বৈধ পথে তথা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে কোনো প্রবাসী আয় আসেনি। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর রেমিটেন্স প্রবাহে আরও ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূনের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় অন্তর্র্বতী সরকারের। রেমিটেন্স প্রবাহেও গতি ফেরে।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি মুদ্রার সংকট চলছে। কোভিড মহামারীর সময়ে আমদানি তলানিতে নামায় একপর্যায়ে দেশে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি খরচ অনেক বেড়ে যায়। একই সাথে প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে যথেষ্ট প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় রিজার্ভ দ্রুত কমতে থাকে।সংকট কাটাতে ও রিজার্ভ বাড়াতে প্রবাসী আয়সহ বিদেশ থেকে অর্থ আনতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত কয়েক মাসে এসব পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে এই সূচকে। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে রেমিটেন্স। এই সূচক বাড়ায় রিজার্ভও বেড়েছে।
গত ৯ জানুয়ারি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের ১ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক ২০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। আকুর দেনা শোধের আগে ৮ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার।
এক সপ্তাহ পর ১৫ জানুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার; গ্রস হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। পরের সপ্তাহে (২২ জানুয়ারি) বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে ১৯ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে; গ্রস হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। ২৯ জানুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার; গ্রস হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। গত ৬ ফেব্রুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। ১৩ ফেব্রুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়ে ২০ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। গ্রস হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার। ২০ ফেব্রুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়ে ২০ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। গ্রস হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার।
সবশেষ গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ ব্যাংক যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ আরও বেড়ে ২০ দশমিক ৯০বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। গ্রস হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। তবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে মাসের প্রথম সপ্তাহে আকুর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ ফের কমে আসবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
রমজান মাসকে সামনে রেখে আমদানি বেড়েছে। সে কারণে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদের আকুর বিল বেশি হবে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা। প্রতি সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার ‘সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে রিজার্ভ, রেমিটেন্স রপ্তানি আয়সহ অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর হালনাগাদ তথ্য থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ হিসেবে দাবি করে। সবশেষ গত ডিসেম্বর মাসের আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ওই মাসে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ৬ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সে হিসাবে ২০ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুদ থাকতে হয়। আকু হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যকার একটি আন্তঃআঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। এশিয়ার ৯টি দেশের মধ্যে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয়, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তা প্রতি দুই মাস পরপর নিষ্পত্তি হয়। অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেন তাৎক্ষণিকভাবে সম্পন্ন হয়। আকুর সদস্য দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভুটান ও মালদ্বীপ। তবে দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় সম্প্রতি এ ব্যবস্থা থেকে বাদ পড়ে শ্রীলঙ্কা।
রিজার্ভের প্রধান উৎস হচ্ছে রপ্তানি আয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে অর্থাৎ জুলাই-জানুয়ারি সময়ে মোট ২ হাজার ৮৯৬ কোটি ৯৫ লাখ (প্রায় ২৯ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেশি।