বৈরী সম্পর্কের মধ্যেও পাশের দেশ ভারতে রপ্তানি বাড়ছিল। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে দুদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে। কিন্তু তার প্রভাব বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যে পড়ছিল না। ভারত থেকে পণ্য আসা যেমন কমেনি। তেমনি বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি তো কমেইনি, বরং বাড়ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ভারত সরকার। আর এতে ভারতে পণ্য রপ্তানি আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের শেষ মাস জুনে ভারতে ৯ কোটি ৯৯ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। আগের মাস মে মাসে এই অঙ্ক ছিল ১৪ কোটি ৬৫ লাখ ডলার।
৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের শেষ মাস জুনে ভারতে ৯ কোটি ৯৯ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। আগের মাস মে মাসে এই অঙ্ক ছিল ১৪ কোটি ৬৫ লাখ ডলার।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জুনে মে মাসের চেয়ে ভারতে রপ্তানি কমেছে ৩২ শতাংশ। আর এতে অর্থ বছরের সামগ্রিক হিসাবে প্রবৃদ্ধি অনেকটা কমে গেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বৃহস্পতিবার রপ্তানি আয়ের দেশভিত্তিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে (১২ মাস ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন) ভারতে ১৭৬ কোটি ৪২ লাখ (১.৭৬ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। যা আগের অর্থ বছরের (২০২৩-২৪) চেয়ে ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেশি। অথচ ১১ মাসে (জুলাই-মে) হিসাবে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) হিসাবে ছিল ১৫ দশমিক ২৭ শতাংশ। নয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-মার্চ সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল আরও বেশি ১৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ। জুলাই-জানুয়ারি সময়ে বেড়েছিল ১৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথমার্ধে (ছয় মাস, (জুলাই-ডিসেম্বর) প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে (জুলাই-জুন) প্রতি মাসে গড়ে ১৪ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে ভারতে। অর্থ বছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে এসেছে ১৫ কোটি ১৩ লাখ ডলার।
ভারতে প্রধান রপ্তানি পণ্য হচ্ছে—তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাতপণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং প্লাস্টিক দ্রব্য। এছাড়া কিছু কটন ও কটন প্রোডাক্টস রপ্তানি হয় ভারতে। এর মধ্যে বাজারে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হতো তৈরি পোশাক। মোট রপ্তানির প্রায় অর্ধেকই ছিল পোশাক। গত ১৮ মে স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি নিষিদ্ধ করে ভারত। ওই দিন ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশটির বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তর (ডিজিএফটি) এক প্রজ্ঞাপনে ঘোষণা দেয় যে, শুধু ভারতের নব সেবা ও কলকাতা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে দেশটির আমদানিকারকেরা বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করতে পারবেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামে ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন (এলসিএস), ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট (আইসিপি) দিয়ে ফল, ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক পণ্য, সুতা, সুতার উপজাত, আসবাবপত্র রপ্তানি করা যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের চ্যাংড়াবান্ধা ও ফুলবাড়ী শুল্ক স্টেশন বা এলসিএসের জন্যও এ সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য হবে।
এর পর গত ২৮ জুন ভারতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে আরেকটি ধাক্কা আসে। এবার বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে পাট ও পাটজাত পণ্য এবং কাপড় আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় ভারত। ভারতে পণ্য রপ্তানির তালিকায় পাট ও পাটজাত পণ্য অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য। দেশটিতে মোট রপ্তানি আয়ের ২৫ শতাংশের মতো আসে এই খাত থেকে।
২৮ মে’র প্রজ্ঞাপনে ডিজিএফটি জানায়, বাংলাদেশ থেকে এসব পণ্য নবসেবা বা জওহরলাল নেহরু সমুদ্রবন্দর দিয়ে ভারতে ঢুকতে পারবে। বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটানে এসব পণ্য রপ্তানিতে কোনও বিধিনিষেধ নেই। তবে, এসব পণ্য পুনরায় রপ্তানি করা যাবে না। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের মধ্য দিয়ে যেসব পণ্য নেপাল ও ভুটানে যাবে, সেসব পণ্য নেপাল বা ভুটান থেকে ভারতে যেতে পারবে না। ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, গেল অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ভারতে ১৩ কোটি ৩০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেন বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা। দ্বিতীয় মাস আগস্টে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ১৫ কোটি ৫২ লাখ ডলার। তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বর বেড়ে দাঁড়ায় ২০ কোটি ১৯ লাখ ডলার। এর পর শুধু জুন মাস ছাড়া সব মাসেই ১৫ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি হয়েছে ভারতে।
ভারতে প্রায় সব পণ্যই স্থলপথে রপ্তানি হয়। এর মধ্যে সিংহভাগই যেতো বেনোপোল স্থলবন্দর দিয়ে। এখন কেবল চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ছাড়া অন্য সব পণ্য স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ভারত সরকার।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, মে মাসে ভারতে ২ কোটি ৬৯ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। জুন মাসে তা অর্ধেকে- ১ কোটি ৩৩ লাখ ডলারে নেমে এসেছে। মে মাসে ৫ কোটি ১০ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছিল। জুনে হয়েছে ৩ কোটি ৫ লাখ ডলার।
মে মাসে ১ কোটি ৭ লাখ ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। জুনে হয়েছে ৬০ লাখ ৮০ হাজার ডলারের। মে মাসে ৩৩ লাখ ১০ হাজার ডলারের প্লাস্টিক দ্রব্য রপ্তানি হয়েছিল। জুনে হয়েছে ২৬ লাখ ৬০ হাজার ডলারের। অপ্রচলিত বা নতুন বাজারের মধ্যে ভারতে রপ্তানি বাড়ছিল চোখে পড়ার মতো। পোশাক রপ্তানিকারকরা আশা করেছিলেন, গেল ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ভারতে ১ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হবে। সামগ্রিক রপ্তানি ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
কিন্তু গত বছরের জুলাই মাসে অর্থ বছরের শুরুতেই বাংলাদেশে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়। তা আগস্টের শুরুতেই জনবিস্ফোরণে রূপ নিলে পতন ঘটে শেখ হাসিনার সরকারের। তিনি আশ্রয় নেন ভারতে। এরপর থেকে ঢাকা-নয়া দিল্লি কূটনৈতিক টানাপড়েন চলছেই। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তার জেরেই ভারত সরকার ধাপে ধাপে স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি এখন ৮০০ কোটি (৮ বিলিয়ন) ডলারের মতো। অর্থাৎ বাংলাদেশ যত পণ্য আমদানি করে, তার অনেক কমই রপ্তানি করে থাকে। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ভারতে ২১৩ কোটি (২.১৩ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। ভারতে রপ্তানি করে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় বাংলাদেশের সেটাই প্রথম। তার আগের অর্থ বছরে (২০২১-২২) ভারতে পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ আয় করেছিল ১৯৯ কোটি ১৪ লাখ (১.৯৯ বিলিয়ন) ডলার, যা ছিল ২০২০-২১ অর্থ বছরের চেয়ে ৫৫ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি।
গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে সেই রপ্তানিতে ভাটা পড়ে; আয় নেমে আসে ১৫৬ কোটি ৯২ লাখ (১.৫৭ বিলিয়ন) ডলারে। নানা বাধাবিপত্তির মধ্যেও গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ১৭৬ কোটি ৪২ লাখ (১.৭৬ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ২০১১ সালে ভারত বাংলাদেশকে অস্ত্র ও মাদক বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দেয়। তবে সেই সুবিধা খুব বেশি কাজে লাগাতে পারছিলেন না বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা।
ওই বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশের বেশ কিছু কারখানার কাছ থেকে পোশাক নিয়ে টাকা দেয়নি ভারতীয় কোম্পানি লিলিপুট। সেজন্য বেশ কয়েক বছর পোশাক রপ্তানিতেও ভাটা পড়েছিল। এরপর ভারতে রপ্তানি ধীরে ধীরে বাড়ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে প্রথমবারের মতো দেশটিতে পণ্য রপ্তানি আয় ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। পাঁচ বছরের মাথায় ২০২২-২৩ অর্থ বছরে সেই আয় দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।
২০২০-২১ অর্থ বছরে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ভারতের বাজারে ১২৮ কোটি (১.২৮ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেন। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ১২৫ কোটি (১.২৫ বিলিয়ন) ডলার। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে তা কমে ১০৯ কোটি ৬২ লাখ (১.০৯ বিলিয়ন) ডলারে নেমে আসে।
রোববার, ১৩ জুলাই ২০২৫
বৈরী সম্পর্কের মধ্যেও পাশের দেশ ভারতে রপ্তানি বাড়ছিল। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে দুদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে। কিন্তু তার প্রভাব বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যে পড়ছিল না। ভারত থেকে পণ্য আসা যেমন কমেনি। তেমনি বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি তো কমেইনি, বরং বাড়ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ভারত সরকার। আর এতে ভারতে পণ্য রপ্তানি আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের শেষ মাস জুনে ভারতে ৯ কোটি ৯৯ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। আগের মাস মে মাসে এই অঙ্ক ছিল ১৪ কোটি ৬৫ লাখ ডলার।
৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের শেষ মাস জুনে ভারতে ৯ কোটি ৯৯ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। আগের মাস মে মাসে এই অঙ্ক ছিল ১৪ কোটি ৬৫ লাখ ডলার।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জুনে মে মাসের চেয়ে ভারতে রপ্তানি কমেছে ৩২ শতাংশ। আর এতে অর্থ বছরের সামগ্রিক হিসাবে প্রবৃদ্ধি অনেকটা কমে গেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বৃহস্পতিবার রপ্তানি আয়ের দেশভিত্তিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে (১২ মাস ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন) ভারতে ১৭৬ কোটি ৪২ লাখ (১.৭৬ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। যা আগের অর্থ বছরের (২০২৩-২৪) চেয়ে ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেশি। অথচ ১১ মাসে (জুলাই-মে) হিসাবে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) হিসাবে ছিল ১৫ দশমিক ২৭ শতাংশ। নয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-মার্চ সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল আরও বেশি ১৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ। জুলাই-জানুয়ারি সময়ে বেড়েছিল ১৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথমার্ধে (ছয় মাস, (জুলাই-ডিসেম্বর) প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে (জুলাই-জুন) প্রতি মাসে গড়ে ১৪ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে ভারতে। অর্থ বছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে এসেছে ১৫ কোটি ১৩ লাখ ডলার।
ভারতে প্রধান রপ্তানি পণ্য হচ্ছে—তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাতপণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং প্লাস্টিক দ্রব্য। এছাড়া কিছু কটন ও কটন প্রোডাক্টস রপ্তানি হয় ভারতে। এর মধ্যে বাজারে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হতো তৈরি পোশাক। মোট রপ্তানির প্রায় অর্ধেকই ছিল পোশাক। গত ১৮ মে স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি নিষিদ্ধ করে ভারত। ওই দিন ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশটির বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তর (ডিজিএফটি) এক প্রজ্ঞাপনে ঘোষণা দেয় যে, শুধু ভারতের নব সেবা ও কলকাতা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে দেশটির আমদানিকারকেরা বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করতে পারবেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামে ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন (এলসিএস), ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট (আইসিপি) দিয়ে ফল, ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক পণ্য, সুতা, সুতার উপজাত, আসবাবপত্র রপ্তানি করা যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের চ্যাংড়াবান্ধা ও ফুলবাড়ী শুল্ক স্টেশন বা এলসিএসের জন্যও এ সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য হবে।
এর পর গত ২৮ জুন ভারতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে আরেকটি ধাক্কা আসে। এবার বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে পাট ও পাটজাত পণ্য এবং কাপড় আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় ভারত। ভারতে পণ্য রপ্তানির তালিকায় পাট ও পাটজাত পণ্য অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য। দেশটিতে মোট রপ্তানি আয়ের ২৫ শতাংশের মতো আসে এই খাত থেকে।
২৮ মে’র প্রজ্ঞাপনে ডিজিএফটি জানায়, বাংলাদেশ থেকে এসব পণ্য নবসেবা বা জওহরলাল নেহরু সমুদ্রবন্দর দিয়ে ভারতে ঢুকতে পারবে। বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটানে এসব পণ্য রপ্তানিতে কোনও বিধিনিষেধ নেই। তবে, এসব পণ্য পুনরায় রপ্তানি করা যাবে না। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের মধ্য দিয়ে যেসব পণ্য নেপাল ও ভুটানে যাবে, সেসব পণ্য নেপাল বা ভুটান থেকে ভারতে যেতে পারবে না। ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, গেল অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ভারতে ১৩ কোটি ৩০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেন বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা। দ্বিতীয় মাস আগস্টে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ১৫ কোটি ৫২ লাখ ডলার। তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বর বেড়ে দাঁড়ায় ২০ কোটি ১৯ লাখ ডলার। এর পর শুধু জুন মাস ছাড়া সব মাসেই ১৫ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি হয়েছে ভারতে।
ভারতে প্রায় সব পণ্যই স্থলপথে রপ্তানি হয়। এর মধ্যে সিংহভাগই যেতো বেনোপোল স্থলবন্দর দিয়ে। এখন কেবল চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ছাড়া অন্য সব পণ্য স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ভারত সরকার।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, মে মাসে ভারতে ২ কোটি ৬৯ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। জুন মাসে তা অর্ধেকে- ১ কোটি ৩৩ লাখ ডলারে নেমে এসেছে। মে মাসে ৫ কোটি ১০ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছিল। জুনে হয়েছে ৩ কোটি ৫ লাখ ডলার।
মে মাসে ১ কোটি ৭ লাখ ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। জুনে হয়েছে ৬০ লাখ ৮০ হাজার ডলারের। মে মাসে ৩৩ লাখ ১০ হাজার ডলারের প্লাস্টিক দ্রব্য রপ্তানি হয়েছিল। জুনে হয়েছে ২৬ লাখ ৬০ হাজার ডলারের। অপ্রচলিত বা নতুন বাজারের মধ্যে ভারতে রপ্তানি বাড়ছিল চোখে পড়ার মতো। পোশাক রপ্তানিকারকরা আশা করেছিলেন, গেল ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ভারতে ১ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হবে। সামগ্রিক রপ্তানি ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
কিন্তু গত বছরের জুলাই মাসে অর্থ বছরের শুরুতেই বাংলাদেশে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়। তা আগস্টের শুরুতেই জনবিস্ফোরণে রূপ নিলে পতন ঘটে শেখ হাসিনার সরকারের। তিনি আশ্রয় নেন ভারতে। এরপর থেকে ঢাকা-নয়া দিল্লি কূটনৈতিক টানাপড়েন চলছেই। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তার জেরেই ভারত সরকার ধাপে ধাপে স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি এখন ৮০০ কোটি (৮ বিলিয়ন) ডলারের মতো। অর্থাৎ বাংলাদেশ যত পণ্য আমদানি করে, তার অনেক কমই রপ্তানি করে থাকে। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ভারতে ২১৩ কোটি (২.১৩ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। ভারতে রপ্তানি করে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় বাংলাদেশের সেটাই প্রথম। তার আগের অর্থ বছরে (২০২১-২২) ভারতে পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ আয় করেছিল ১৯৯ কোটি ১৪ লাখ (১.৯৯ বিলিয়ন) ডলার, যা ছিল ২০২০-২১ অর্থ বছরের চেয়ে ৫৫ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি।
গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে সেই রপ্তানিতে ভাটা পড়ে; আয় নেমে আসে ১৫৬ কোটি ৯২ লাখ (১.৫৭ বিলিয়ন) ডলারে। নানা বাধাবিপত্তির মধ্যেও গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ১৭৬ কোটি ৪২ লাখ (১.৭৬ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ২০১১ সালে ভারত বাংলাদেশকে অস্ত্র ও মাদক বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দেয়। তবে সেই সুবিধা খুব বেশি কাজে লাগাতে পারছিলেন না বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা।
ওই বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশের বেশ কিছু কারখানার কাছ থেকে পোশাক নিয়ে টাকা দেয়নি ভারতীয় কোম্পানি লিলিপুট। সেজন্য বেশ কয়েক বছর পোশাক রপ্তানিতেও ভাটা পড়েছিল। এরপর ভারতে রপ্তানি ধীরে ধীরে বাড়ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে প্রথমবারের মতো দেশটিতে পণ্য রপ্তানি আয় ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। পাঁচ বছরের মাথায় ২০২২-২৩ অর্থ বছরে সেই আয় দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।
২০২০-২১ অর্থ বছরে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ভারতের বাজারে ১২৮ কোটি (১.২৮ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেন। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ১২৫ কোটি (১.২৫ বিলিয়ন) ডলার। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে তা কমে ১০৯ কোটি ৬২ লাখ (১.০৯ বিলিয়ন) ডলারে নেমে আসে।