ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
অবশেষে বাংলাদেশি পণ্যে পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোয় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে বাংলাদেশ সরকার, ব্যবসায়ী মহল ও অর্থনীতিবিদরা। দীর্ঘদিনের অনিশ্চয়তা কাটিয়ে রপ্তানি বাজারে এক ধরনের স্থিতিশীলতা ফিরে আসার আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের এক নির্বাহী আদেশে নতুন এ হার ঘোষণা করা হয়। ট্রাম্পের ওই নির্বাহী আদেশ হোয়াইট হাউজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। আদেশে বাংলাদেশ ছাড়াও কয়েকডজন দেশের ওপর মার্কিন শুল্কেরহার তুলে ধরা হয়েছে।
অন্য দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের ওপর ১৯ শতাংশ, আফগানিস্তানের ওপর ১৫ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ, চীনের ওপর ৩০ শতাংশ, ব্রাজিলের ওপর ১০ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ওপর ১৯ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ওপর ১৯ শতাংশ, মায়ানমারের ওপর ৪০ শতাংশ, ফিলিপাইনের ওপর ১৯ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ওপর ২০ শতাংশ ও ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ওয়াশিংটন।
পাল্টা শুল্ক নিয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সফরে রয়েছে। শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে টানা তিন দিন আলোচনা করেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। গত মঙ্গল ও বুধবারের পর গত বৃহস্পতিবার তৃতীয় দিনের মতো আলোচনা করা হয়।
বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন- বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। এছাড়াও দলে ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী।
আলোচনাকে সফল বলছে সরকার
দীর্ঘ এই কূটনৈতিক আলোচনাকে সফল বলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে সরকারের বিভিন্ন মহল। বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেছেন, ‘আজ আমরা সম্ভাব্য ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক এড়াতে সফল হয়েছি। এটা আমাদের পোশাক খাত ও এ খাতের ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ মানুষের জন্য সুসংবাদ। আমরা সতর্কতার সঙ্গে আলোচনা করেছি, যাতে আমাদের প্রতিশ্রুতিগুলো জাতীয় স্বার্থ ও সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের পোশাকশিল্পকে সুরক্ষা দেয়া ছিল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। তবে আমরা মার্কিন কৃষিপণ্য কেনার প্রতিশ্রুতিতেও গুরুত্ব দিয়েছি। এতে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার লক্ষ্য পূরণে সহায়তা মিলবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপ্রধান অঙ্গরাজ্যগুলোর সঙ্গে সদ্ভাব গড়ে উঠবে। আমরা আমাদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতাও ধরে রেখেছি এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভোক্তাবাজারে প্রবেশের নতুন সুযোগ তৈরি করেছি।’
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্টা শুল্ক কমানোর আলোচনায় বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে শুক্রবার (১ আগস্ট) এক পোস্টে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, ‘দেশের অভ্যন্তরীণ পণ্যমূল্য স্থিতিশীলতা বজায় রাখা থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল শুল্ক আলোচনায় তিনি (বাণিজ্য উপদেষ্টা) নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন, সমালোচকদের হতাশ করে। আল্লাহ তাকে (বাণিজ্য উপদেষ্টা) হায়াতে তাইয়্যেবা দান করুন, যাতে তিনি দেশকে সেবা দিতে পারেনÑ হোক তা সরকারে বা বেসরকারি খাতে।’
এই শুল্কহারে স্বস্তিতে ব্যবসায়ীরাও
এই শুল্কহারে ব্যবসায়ীরাও স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক থেকে। এই শুল্কারোপে স্বস্তি প্রকাশ করে বিজিএমই-এর (বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেছেন, ‘পাল্টা শুল্ক নিয়ে গত তিন মাস ধরে আমরা এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলাম। অনিশ্চয়তার মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করা কঠিন। মার্কিন ক্রেতারাও পরিস্থিতি কোন দিকে যায় সেটি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। শেষ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক ৩৫ থেকে কমে ২০ শতাংশ হওয়াটা আমাদের জন্য স্বস্তির।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছিলাম, প্রতিযোগী দেশের তুলনায় আমাদের পণ্যে পাল্টা শুল্ক বেশি হলে ব্যবসা কঠিন হয়ে যাবে। তবে প্রতিযোগী দেশ পাকিস্তানের চেয়ে আমাদের পাল্টা শুল্ক ১ শতাংশ বেশি হলেও ভারতের চেয়ে ৫ শতাংশ কম। এছাড়া চীনের চেয়ে ১০ শতাংশ কম। এটি আমাদের জন্য বড় স্বস্তির।’
এছাড়াও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেছেন, ‘আমরা আমাদের শুল্ককে এই অঞ্চল এবং প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে পেরেছি, যা একটি ভালো দিক।’
তবে তিনি কিছু পরামর্শ দিয়ে আরও বলেন, ‘যদি আমরা চীন বা ভারতের কাপড় বা সুতা ব্যবহার করে তৈরি পোশাক রপ্তানি করি, তবে আমাদের শুল্ক উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। সাম্প্রতিক এসব শুল্ক আলোচনা আমাদের দুর্বলতাগুলো তুলে ধরেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের আমদানি অনেক কম, যার কারণ আমরা ওই হিসেবে যন্ত্রাংশ ধরি না। যেমন- অ্যাপল, কোয়ালকম, ইন্টেল বা এএমডি চিপ ব্যবহার করা হলেও সেটা হিসেবে আসে না। প্রকৃতপক্ষে হিসাব করে দেখলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বাস্তবে সরকারি প্রতিবেদনের চেয়ে অনেক কম। এই ধরনের হিসাবের অসঙ্গতি শুধরে না নিলে ভবিষ্যতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আলোচনায় বাংলাদেশ দুর্বল অবস্থানে পড়তে পারে।’
রপ্তানি খাতের জন্য ইতিবাচক ও আশাব্যঞ্জক বলছেন অর্থনীতিবিদরা
এই শুল্কহারকে আশাব্যঞ্জক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের আরোপ করা পাল্টা শুল্কেরহার ৩৫ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে আনা রপ্তানি খাতের জন্য একটি ইতিবাচক ও স্বাগতযোগ্য পদক্ষেপ। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যে ওপর পাল্টা শুল্কের নতুন হার এখন প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনামূলকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা বাণিজ্যবিচ্যুতির ঝুঁকি হ্রাসের ইঙ্গিত দেয়। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানিতে বড় ধরনের বিঘেœর ঝুঁকি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে।’
তবে তিনি সর্তক করে আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের হারের এ হ্রাস আশাব্যঞ্জক হলেও আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই বা জায়গা তৈরি করে না। বরং এটি একটি সুযোগ এবং একই সঙ্গে একটি সতর্কবার্তা। বাংলাদেশকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে একটি বৈচিত্র্যময়, প্রতিযোগিতামূলক ও সহনশীল বাণিজ্য কৌশল প্রতিষ্ঠা করা যায়।’
যেভাবে এই আলোচনা হলো
গত ২ এপ্রিল বাণিজ্য ঘাটতির কথা উল্লেখ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর উচ্চহারে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। তখন বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। পরে গত ৯ এপ্রিল বিভিন্ন দেশের ওপর ওই শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়। এ সময় শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন দেশকে আলোচনার সুযোগ দেয় ওয়াশিংটন।
যুক্তরাষ্ট্রের তিন মাসের সময়সীমা গত ৯ জুলাই শেষ হয়। এর আগের দিন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দিয়ে ট্রাম্প জানান, বাংলাদেশের পাল্টা শুল্ক ২ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও ৯ জুলাইয়ের পর পাল্টা শুল্ক কার্যকর করেনি মার্কিন প্রশাসন। শুল্কেরহার কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তির জন্য গতকাল ৩১ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন দেশকে সময় দেয়া হয়।
সেই সময়সীমা শেষে শুক্রবার থেকে নতুন শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা। সে হিসাবে শুক্রবার থেকে বাংলাদেশকে বর্তমানের গড় ১৫ শতাংশ ও নতুন পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ, অর্থাৎ মোট ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করতে হবে। তবে এর মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট শুল্কহার কমানোর ঘোষণা দিল। কানাডা বাদে আগামী ৭ আগস্ট থেকে সব দেশে নতুন এই শুল্ক কার্যকর হবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের পণ্যে আরোপ করা ২০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হবে।
বাণিজ্য আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিজয়: প্রধান উপদেষ্টা
যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা সম্পূরক শুল্কের পরিমাণ আলোচনার মধ্য দিয়ে কমিয়ে আনতে পারাকে একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিজয়’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় অংশ নেয়া বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলকে অভিনন্দন জানিয়ে শুক্রবার এক বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক বাণিজ্য চুক্তি নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের শুল্ক আলোচক দলকে আমরা গর্বের সঙ্গে অভিনন্দন জানাই, যা এক গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিজয়।’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার পর গত ২ এপ্রিল শতাধিক দেশের ওপর চড়া হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের ওপর বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্কের ঘোষণা আসে।
এ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই গত ৭ জুলাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা দেন, বাংলাদেশের ওপর সম্পূরক শুল্কের হার হবে ৩৫ শতাংশ, যা কার্যকর হবে ১ আগস্ট (শুক্রবার)।
এরপরও দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি অনুযায়ী বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ। মার্কিন উড়োজাহাজ নির্মাতা কোম্পানি বোয়িংয়ের কাছে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার ঘোষণা আসে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম, সয়াবিন তেল ও তুলা আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরপর গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন ও ইউএসটিআরের সঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলের বৈঠক শেষে সম্পূরক শুল্কেরহার কমিয়ে ২০ শতাংশের ঘোষণা দেয় ওয়াশিংটন।
এ প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেনÑ প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান ও অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী।
তাদের প্রশংসা করে প্রধান উপদেষ্টা তার বার্তায় বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা এবং আরও এগিয়ে নিতে আমাদের আলোচকরা অসাধারণ কৌশলী দক্ষতা এবং অটল প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করেছেন।’
ইউনূস বলেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে তারা নিরলস পরিশ্রম করে এই জটিল আলোচনা চালিয়ে এসেছেন, যার মধ্যে ছিল শুল্ক, অশুল্ক বাধা ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক নানা চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, ‘এই চুক্তি বাংলাদেশের তুলনামূলক বাণিজ্যিক সুবিধা বজায় রেখেছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভোক্তাবাজারে প্রবেশাধিকার আরও সম্প্রসারিত করেছে এবং দেশের মৌলিক স্বার্থ সুরক্ষিত করেছে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এই অর্জন কেবল বাংলাদেশের বৈশ্বিক প্রভাব বৃদ্ধির সাক্ষ্যই দেয় না, বরং এটি বৃহত্তর সম্ভাবনার দ্বারও খুলে দিয়েছে, যার মধ্য দিয়ে দ্রুততর প্রবৃদ্ধি ও টেকসই সমৃদ্ধির পথ তৈরি হবে।’
‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যে উজ্জ্বল, আজকের সাফল্যই তা প্রমাণ করে। এ অর্জন জাতির দৃঢ়তা এবং একটি শক্তিশালী অর্থনীতির ভবিষ্যতের প্রতি আমাদের সাহসী দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিচ্ছবি।’
এর আগে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ৭০টি দেশের পণ্যে সর্বোচ্চ ৪১ শতাংশ পর্যন্ত নতুন শুল্কহার ঘোষণা করেছেন। শুক্রবারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত করার যে সময়সীমা দেয়া হয়েছিল, তার ঠিক আগ মুহূর্তে এই ঘোষণা এসেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই চুক্তিগুলো শুধু শুল্ক সমন্বয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং যেসব দেশের অভ্যন্তরীণ নীতিমালায় যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা তৈরি করছে, সেসব ক্ষেত্রেও সংস্কার আনতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা ও বৃহত্তর অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। আলোচনার অংশ হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য কিনতে প্রতিশ্রুতি দেয়া ছিল বাধ্যতামূলক, যেন বাণিজ্য ঘাটতি কমানো যায়। বিষয়টির পরিধি অনেক বিস্তৃত হওয়ায় এ আলোচনার প্রক্রিয়া ছিল জটিল ও সময়সাপেক্ষ। কেবল যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যে শুল্ক কমালেই সেখানে রপ্তানি করা পণ্যে শুল্ক ছাড় মেলেনি। বরং অশুল্ক বাধা, বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা এবং নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ দূর করতে পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কোনো দেশের ওপর শুল্কহার কত হবে, তা নির্ধারিত হবে এসব ক্ষেত্রে তাদের প্রতিশ্রুতির গভীরতার ভিত্তিতে।’
বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ শুল্কহার নির্ধারণ করা হয়েছে, যা প্রতিদ্বন্দ্বী পোশাক রপ্তানিকারক দেশ শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার প্রায় সমান, যাদের শুল্কহার ১৯ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে।
এক বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘এর ফলে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার কোনো ক্ষতি হয়নি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ চুক্তিতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ায় ভারতকে ২৫ শতাংশ শুল্কের মুখে পড়তে হয়েছে।’
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানকে উদ্ধৃত করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ এবং সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আলোচনা করেছি। আমাদের পোশাক শিল্পকে রক্ষা করা ছিল প্রধান অগ্রাধিকার। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য কেনার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে আমরা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মার্কিন কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্কও বজায় রাখছি।’
তিনি বলেন, ‘আজ আমরা সম্ভাব্য ৩৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এড়াতে পেরেছি। এটা আমাদের পোশাক শিল্প এবং এই খাতের ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ মানুষের জন্য সুখবর। একই সঙ্গে আমরা আমাদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছি এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভোক্তাবাজারে প্রবেশের নতুন সুযোগ তৈরি করেছি।’
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
শুক্রবার, ০১ আগস্ট ২০২৫
অবশেষে বাংলাদেশি পণ্যে পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোয় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে বাংলাদেশ সরকার, ব্যবসায়ী মহল ও অর্থনীতিবিদরা। দীর্ঘদিনের অনিশ্চয়তা কাটিয়ে রপ্তানি বাজারে এক ধরনের স্থিতিশীলতা ফিরে আসার আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের এক নির্বাহী আদেশে নতুন এ হার ঘোষণা করা হয়। ট্রাম্পের ওই নির্বাহী আদেশ হোয়াইট হাউজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। আদেশে বাংলাদেশ ছাড়াও কয়েকডজন দেশের ওপর মার্কিন শুল্কেরহার তুলে ধরা হয়েছে।
অন্য দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের ওপর ১৯ শতাংশ, আফগানিস্তানের ওপর ১৫ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ, চীনের ওপর ৩০ শতাংশ, ব্রাজিলের ওপর ১০ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ওপর ১৯ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ওপর ১৯ শতাংশ, মায়ানমারের ওপর ৪০ শতাংশ, ফিলিপাইনের ওপর ১৯ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ওপর ২০ শতাংশ ও ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ওয়াশিংটন।
পাল্টা শুল্ক নিয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সফরে রয়েছে। শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে টানা তিন দিন আলোচনা করেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। গত মঙ্গল ও বুধবারের পর গত বৃহস্পতিবার তৃতীয় দিনের মতো আলোচনা করা হয়।
বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন- বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। এছাড়াও দলে ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী।
আলোচনাকে সফল বলছে সরকার
দীর্ঘ এই কূটনৈতিক আলোচনাকে সফল বলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে সরকারের বিভিন্ন মহল। বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেছেন, ‘আজ আমরা সম্ভাব্য ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক এড়াতে সফল হয়েছি। এটা আমাদের পোশাক খাত ও এ খাতের ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ মানুষের জন্য সুসংবাদ। আমরা সতর্কতার সঙ্গে আলোচনা করেছি, যাতে আমাদের প্রতিশ্রুতিগুলো জাতীয় স্বার্থ ও সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের পোশাকশিল্পকে সুরক্ষা দেয়া ছিল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। তবে আমরা মার্কিন কৃষিপণ্য কেনার প্রতিশ্রুতিতেও গুরুত্ব দিয়েছি। এতে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার লক্ষ্য পূরণে সহায়তা মিলবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপ্রধান অঙ্গরাজ্যগুলোর সঙ্গে সদ্ভাব গড়ে উঠবে। আমরা আমাদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতাও ধরে রেখেছি এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভোক্তাবাজারে প্রবেশের নতুন সুযোগ তৈরি করেছি।’
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্টা শুল্ক কমানোর আলোচনায় বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে শুক্রবার (১ আগস্ট) এক পোস্টে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, ‘দেশের অভ্যন্তরীণ পণ্যমূল্য স্থিতিশীলতা বজায় রাখা থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল শুল্ক আলোচনায় তিনি (বাণিজ্য উপদেষ্টা) নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন, সমালোচকদের হতাশ করে। আল্লাহ তাকে (বাণিজ্য উপদেষ্টা) হায়াতে তাইয়্যেবা দান করুন, যাতে তিনি দেশকে সেবা দিতে পারেনÑ হোক তা সরকারে বা বেসরকারি খাতে।’
এই শুল্কহারে স্বস্তিতে ব্যবসায়ীরাও
এই শুল্কহারে ব্যবসায়ীরাও স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক থেকে। এই শুল্কারোপে স্বস্তি প্রকাশ করে বিজিএমই-এর (বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেছেন, ‘পাল্টা শুল্ক নিয়ে গত তিন মাস ধরে আমরা এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলাম। অনিশ্চয়তার মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করা কঠিন। মার্কিন ক্রেতারাও পরিস্থিতি কোন দিকে যায় সেটি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। শেষ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক ৩৫ থেকে কমে ২০ শতাংশ হওয়াটা আমাদের জন্য স্বস্তির।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছিলাম, প্রতিযোগী দেশের তুলনায় আমাদের পণ্যে পাল্টা শুল্ক বেশি হলে ব্যবসা কঠিন হয়ে যাবে। তবে প্রতিযোগী দেশ পাকিস্তানের চেয়ে আমাদের পাল্টা শুল্ক ১ শতাংশ বেশি হলেও ভারতের চেয়ে ৫ শতাংশ কম। এছাড়া চীনের চেয়ে ১০ শতাংশ কম। এটি আমাদের জন্য বড় স্বস্তির।’
এছাড়াও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেছেন, ‘আমরা আমাদের শুল্ককে এই অঞ্চল এবং প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে পেরেছি, যা একটি ভালো দিক।’
তবে তিনি কিছু পরামর্শ দিয়ে আরও বলেন, ‘যদি আমরা চীন বা ভারতের কাপড় বা সুতা ব্যবহার করে তৈরি পোশাক রপ্তানি করি, তবে আমাদের শুল্ক উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। সাম্প্রতিক এসব শুল্ক আলোচনা আমাদের দুর্বলতাগুলো তুলে ধরেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের আমদানি অনেক কম, যার কারণ আমরা ওই হিসেবে যন্ত্রাংশ ধরি না। যেমন- অ্যাপল, কোয়ালকম, ইন্টেল বা এএমডি চিপ ব্যবহার করা হলেও সেটা হিসেবে আসে না। প্রকৃতপক্ষে হিসাব করে দেখলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বাস্তবে সরকারি প্রতিবেদনের চেয়ে অনেক কম। এই ধরনের হিসাবের অসঙ্গতি শুধরে না নিলে ভবিষ্যতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আলোচনায় বাংলাদেশ দুর্বল অবস্থানে পড়তে পারে।’
রপ্তানি খাতের জন্য ইতিবাচক ও আশাব্যঞ্জক বলছেন অর্থনীতিবিদরা
এই শুল্কহারকে আশাব্যঞ্জক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের আরোপ করা পাল্টা শুল্কেরহার ৩৫ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে আনা রপ্তানি খাতের জন্য একটি ইতিবাচক ও স্বাগতযোগ্য পদক্ষেপ। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যে ওপর পাল্টা শুল্কের নতুন হার এখন প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনামূলকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা বাণিজ্যবিচ্যুতির ঝুঁকি হ্রাসের ইঙ্গিত দেয়। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানিতে বড় ধরনের বিঘেœর ঝুঁকি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে।’
তবে তিনি সর্তক করে আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের হারের এ হ্রাস আশাব্যঞ্জক হলেও আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই বা জায়গা তৈরি করে না। বরং এটি একটি সুযোগ এবং একই সঙ্গে একটি সতর্কবার্তা। বাংলাদেশকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে একটি বৈচিত্র্যময়, প্রতিযোগিতামূলক ও সহনশীল বাণিজ্য কৌশল প্রতিষ্ঠা করা যায়।’
যেভাবে এই আলোচনা হলো
গত ২ এপ্রিল বাণিজ্য ঘাটতির কথা উল্লেখ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর উচ্চহারে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। তখন বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। পরে গত ৯ এপ্রিল বিভিন্ন দেশের ওপর ওই শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়। এ সময় শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন দেশকে আলোচনার সুযোগ দেয় ওয়াশিংটন।
যুক্তরাষ্ট্রের তিন মাসের সময়সীমা গত ৯ জুলাই শেষ হয়। এর আগের দিন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দিয়ে ট্রাম্প জানান, বাংলাদেশের পাল্টা শুল্ক ২ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও ৯ জুলাইয়ের পর পাল্টা শুল্ক কার্যকর করেনি মার্কিন প্রশাসন। শুল্কেরহার কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তির জন্য গতকাল ৩১ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন দেশকে সময় দেয়া হয়।
সেই সময়সীমা শেষে শুক্রবার থেকে নতুন শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা। সে হিসাবে শুক্রবার থেকে বাংলাদেশকে বর্তমানের গড় ১৫ শতাংশ ও নতুন পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ, অর্থাৎ মোট ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করতে হবে। তবে এর মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট শুল্কহার কমানোর ঘোষণা দিল। কানাডা বাদে আগামী ৭ আগস্ট থেকে সব দেশে নতুন এই শুল্ক কার্যকর হবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের পণ্যে আরোপ করা ২০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হবে।
বাণিজ্য আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিজয়: প্রধান উপদেষ্টা
যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা সম্পূরক শুল্কের পরিমাণ আলোচনার মধ্য দিয়ে কমিয়ে আনতে পারাকে একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিজয়’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় অংশ নেয়া বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলকে অভিনন্দন জানিয়ে শুক্রবার এক বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক বাণিজ্য চুক্তি নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের শুল্ক আলোচক দলকে আমরা গর্বের সঙ্গে অভিনন্দন জানাই, যা এক গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিজয়।’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার পর গত ২ এপ্রিল শতাধিক দেশের ওপর চড়া হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের ওপর বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্কের ঘোষণা আসে।
এ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই গত ৭ জুলাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা দেন, বাংলাদেশের ওপর সম্পূরক শুল্কের হার হবে ৩৫ শতাংশ, যা কার্যকর হবে ১ আগস্ট (শুক্রবার)।
এরপরও দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি অনুযায়ী বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ। মার্কিন উড়োজাহাজ নির্মাতা কোম্পানি বোয়িংয়ের কাছে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার ঘোষণা আসে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম, সয়াবিন তেল ও তুলা আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরপর গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন ও ইউএসটিআরের সঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলের বৈঠক শেষে সম্পূরক শুল্কেরহার কমিয়ে ২০ শতাংশের ঘোষণা দেয় ওয়াশিংটন।
এ প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেনÑ প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান ও অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী।
তাদের প্রশংসা করে প্রধান উপদেষ্টা তার বার্তায় বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা এবং আরও এগিয়ে নিতে আমাদের আলোচকরা অসাধারণ কৌশলী দক্ষতা এবং অটল প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করেছেন।’
ইউনূস বলেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে তারা নিরলস পরিশ্রম করে এই জটিল আলোচনা চালিয়ে এসেছেন, যার মধ্যে ছিল শুল্ক, অশুল্ক বাধা ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক নানা চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, ‘এই চুক্তি বাংলাদেশের তুলনামূলক বাণিজ্যিক সুবিধা বজায় রেখেছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভোক্তাবাজারে প্রবেশাধিকার আরও সম্প্রসারিত করেছে এবং দেশের মৌলিক স্বার্থ সুরক্ষিত করেছে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এই অর্জন কেবল বাংলাদেশের বৈশ্বিক প্রভাব বৃদ্ধির সাক্ষ্যই দেয় না, বরং এটি বৃহত্তর সম্ভাবনার দ্বারও খুলে দিয়েছে, যার মধ্য দিয়ে দ্রুততর প্রবৃদ্ধি ও টেকসই সমৃদ্ধির পথ তৈরি হবে।’
‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যে উজ্জ্বল, আজকের সাফল্যই তা প্রমাণ করে। এ অর্জন জাতির দৃঢ়তা এবং একটি শক্তিশালী অর্থনীতির ভবিষ্যতের প্রতি আমাদের সাহসী দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিচ্ছবি।’
এর আগে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ৭০টি দেশের পণ্যে সর্বোচ্চ ৪১ শতাংশ পর্যন্ত নতুন শুল্কহার ঘোষণা করেছেন। শুক্রবারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত করার যে সময়সীমা দেয়া হয়েছিল, তার ঠিক আগ মুহূর্তে এই ঘোষণা এসেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই চুক্তিগুলো শুধু শুল্ক সমন্বয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং যেসব দেশের অভ্যন্তরীণ নীতিমালায় যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা তৈরি করছে, সেসব ক্ষেত্রেও সংস্কার আনতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা ও বৃহত্তর অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। আলোচনার অংশ হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য কিনতে প্রতিশ্রুতি দেয়া ছিল বাধ্যতামূলক, যেন বাণিজ্য ঘাটতি কমানো যায়। বিষয়টির পরিধি অনেক বিস্তৃত হওয়ায় এ আলোচনার প্রক্রিয়া ছিল জটিল ও সময়সাপেক্ষ। কেবল যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যে শুল্ক কমালেই সেখানে রপ্তানি করা পণ্যে শুল্ক ছাড় মেলেনি। বরং অশুল্ক বাধা, বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা এবং নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ দূর করতে পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কোনো দেশের ওপর শুল্কহার কত হবে, তা নির্ধারিত হবে এসব ক্ষেত্রে তাদের প্রতিশ্রুতির গভীরতার ভিত্তিতে।’
বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ শুল্কহার নির্ধারণ করা হয়েছে, যা প্রতিদ্বন্দ্বী পোশাক রপ্তানিকারক দেশ শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার প্রায় সমান, যাদের শুল্কহার ১৯ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে।
এক বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘এর ফলে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতার কোনো ক্ষতি হয়নি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ চুক্তিতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ায় ভারতকে ২৫ শতাংশ শুল্কের মুখে পড়তে হয়েছে।’
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানকে উদ্ধৃত করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ এবং সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আলোচনা করেছি। আমাদের পোশাক শিল্পকে রক্ষা করা ছিল প্রধান অগ্রাধিকার। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য কেনার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে আমরা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মার্কিন কৃষিপ্রধান রাজ্যগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্কও বজায় রাখছি।’
তিনি বলেন, ‘আজ আমরা সম্ভাব্য ৩৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এড়াতে পেরেছি। এটা আমাদের পোশাক শিল্প এবং এই খাতের ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ মানুষের জন্য সুখবর। একই সঙ্গে আমরা আমাদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছি এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভোক্তাবাজারে প্রবেশের নতুন সুযোগ তৈরি করেছি।’