গত অর্থ বছরের ধারাবাহিকতায় নতুন অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রবিবার রেমিটেন্স প্রবাহের মাসিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা ২৪৭ কোটি ৭৯ লাখ (২.৪৮ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।
এই অঙ্ক গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ের চেয়ে ২৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ১৯১ কোটি ৩৮ লাখ (১.৯১ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। তবে ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম রেমিটেন্স এসেছে এই জুলাইয়ে। চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ (২.১৮ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল। এরপর সব মাসেই আড়াই বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছে। এক মাসে (মার্চ) এসেছে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি, ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার; দুই মাসে (মে ও জুন) প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার। এপ্রিলে এসেছিল পৌনে ৩ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থ বছরের ধারাবাহিকতায় ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ের শুরুতেও রেমিটেন্সে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে এসে ধীরগতি দেখা যায়। শেষ দিকে গতি ফেরার মধ্য দিয়ে মাস শেষ হয়েছে।
এর মধ্যে প্রথম পাঁচ দিনে অর্থাৎ ১ থেকে ৫ জুলাই এসেছিল ৪১ কোটি ৭ লাখ ডলার। দ্বিতীয় সপ্তাহে (৬ থেকে ১২ জুলাই) এসেছিল ৬৬ কোটি ডলার। তৃতীয় সপ্তাহে অর্থাৎ ১৩ থেকে ১৯ জুলাই এসেছে ৪৫ কোটি ১৮ লাখ ডলার। ২০ থেকে ২৬ জুলাই সপ্তাহে এসেছে ৪১ কোটি ৩ লাখ ডলার।
শেষের পাঁচ দিনেই (২৭ থেকে ৩১ জুলাই) এসেছে ৫৪ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। রেমিটেন্সে প্রতি ডলারে এখন ১২২ টাকা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে টাকার অঙ্কে জুলাইয়ে ৩০ হাজার ২৩০ কোটি টাকা দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৭ কোটি ৯৯ ডলার; টাকার অঙ্কে যা ৯৭৫ কোটি।
বেশ কিছুদিন ডলারের দাম স্থিতিশীল ছিল। রেমিটেন্সে ১২৩ টাকা দিত ব্যাংকগুলো। অর্থাৎ প্রবাসীরা ১ ডলার পাঠালে যার নামে পাঠাতেন তিনি ১২৩ টাকা পেতেন। এমনকি টাকা-ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরও বাজার স্থিতিশীল ছিল।
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে কমতে থাকে ডলারের দর। কমতে কমতে মুদ্রাবাজারে ডলারের দর ১২০ টাকয় নেমে আসে। দরপতন ঠেকাতে নিলামে ডলার কেনা শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে পতন ঠেকেছে; প্রায় আগের জায়গায় ফিরে এসেছে। ডলারের দর কমায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে ধীরগতি দেখা দিয়েছিল বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ডলারের দর বাড়ায় প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানোয় রেমিটেন্স প্রবাহ ফের বেড়েছে বলে জানান তারা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘ডলারের দাম কমায় রেমিটেন্সে কিছুটা প্রভাব পড়েছিল হয়ত। ডলারের দর বেড়ে ফের আগের জায়গায় ফিরে এসেছে। সে কারণে প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স নিয়ে মাস শেষ হয়েছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ২৯ শতাংশ। নতুন অর্থ বছরের প্রথম মাস বেশ ভালোভাবেই শুরু হয়েছে বলে আমি মনে করি।’
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ১৩৪ কোটি (১.৩৪ বিলিয়ন) পেতে গত মে মাসে ডলারের বিনিময় মূল্য বাজারভিত্তিক করার ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ১৪ মে টাকা-ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরদিন ১৫ মে ছিল বৃহস্পতিবার; ওই দিন খোলা বাজারে ডলারের দর খানিকটা বাড়লেও ব্যাংকে তেমন হেরফের হয়নি।
সাপ্তাহিক দুই দিন (১৬ ও ১৭ মে, শুক্র ও শনিবার) ছুটির পর ১৮ মে রবিবার মুদ্রাবাজারে ডলারের বিক্রয় মূল্য ছিল ১২২ টাকা ৭৮ পয়সা। এরপর গত ৭ জুলাই পর্যন্ত ১২২ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ১২২ টাকা ৮৫ পয়সার মধ্যে ডলার কেনাবেচা হয়। ৮ জুলাই থেকে কমতে থাকে ডলারের দর; শক্তিশালী হতে থাকে টাকা। ৮ জুলাই মুদ্রাবাজারে ডলারের বিক্রয় মূল্য ছিল ১২২ টাকা ৫৫ পয়সা। ৯ জুলাই তা কমে ১২২ টাকা ৩০ পয়সায় নেমে আসে। ১০ জুলাই তা আরও কমে ১২১ টাকা ৮৫ পয়সায় নেমে আসে। ১১ ও ১২ জুলাই (শুক্র ও শনিবার) ছিল সাপ্তাহিক ছুটি। ১৩ জুলাই রবিবার ডলারের দর আরও কমে ১২১ টাকা ২০ পয়সায় নেমে আসে।
১৪ জুলাই ডলারের বিক্রয় মূল্য আরও কমে ১২০ টাকা ১০ পয়সায় নেমে আসে। এরই মধ্যে ডলারের পতন ঠেকাতে নিলামে ডলার কেনা শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে এ পর্যন্ত ৫০ কোটি ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
১৩ জুলাই প্রথমবার ১৮টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে ১২১ টাকা ৫০ পয়সা দরে ১৭ কোটি ১০ লাখ ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর ১৫ জুলাই দ্বিতীয় দফায় ১২১ টাকা ৫০ পয়সা দরে কেনে ৩১ কোটি ৩০ লাখ ডলার। সবশেষ ২৪ জুলাই ১২১ টাকা ৯৫ পয়সা দরে ১ কোটি ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এতে ১৫ জুলাই একদিনেই ডলারের দর ১ টাকা ৪০ পয়সা বেড়ে ১২১ টাকা ৫০ পয়সায় ওঠে। গত কয়েক দিনে আরও আরও বেশি দামে কেনাবেচা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, দেশের মুদ্রাবাজারে গতকাল রোববার ডলারের সর্বোচ্চ দাম ছিল ১২২ টাকা ৮৯ পয়সা এবং সর্বনিম্ন দাম ছিল ১২২ টাকা। গড় দাম ছিল ১২২ টাকা ৩০ পয়সা।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দর ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কিনছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। তারা বলছেন, ডলার কিনে মুদ্রাবাজার শান্ত রাখার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমান বাজারের বাস্তবতায় এটাই করা উচিৎ।
দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে এ মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়। বলা যায়, সঙ্কটে পড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে যাচ্ছে রেমিটেন্স। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ৩ হাজার ৩২ কোটি ৭৫ লাখ (৩০.৩৩ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা আগের অর্থ বছরের (২০২৩-২৪) চেয়ে ২৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেশি। প্রতি মাসের গড় হিসাবে এসেছে ২৫১ কোটি ৯৮ লাখ (২.৫২ বিলিয়ন) ডলার।
রোজা ও ঈদ সামনে রেখে গত মার্চে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ৩২৯ কোটি ৫৬ লাখ (৩.২৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স আসে দেশে, যা ছিল গত বছরের মার্চ মাসের চেয়ে ৬৫ শতাংশ বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৯৬ কোটি ৯৬ লাখ (২.৯৭ বিলিয়ন) ডলার আসে গত মে মাসে। তৃতীয় সর্বোচ্চ আসে গত অর্থ বছরের শেষ মাস জুনে, ২৮২ কোটি ১২ লাখ (২.৮২ বিলিয়ন) ডলার। চতুর্থ সর্বোচ্চ আসে এপ্রিল মাসে, ২৭৫ কোটি ১৯ লাখ (২.৭৫ বিলিয়ন) ডলার।
২০২৪-২৫ অর্থ বছর শুরু হয়েছিল গত বছরের জুলাই থেকে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে ওই মাস ছিল উত্তাল; দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল। কয়েক দিন ব্যাংক ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল। সে কারণে জুলাই মাসে রেমিটেন্স প্রবাহ কিছুটা কমেছিল; এসেছিল ১৯১ কোটি ৩৭ কোটি (১.৯১ বিলিয়ন) ডলার। তার আগের তিন মাস অবশ্য ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি এসেছিল। আবার জুলাইয়ের পর থেকে প্রতি মাসেও ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স দেশে এসেছে। ২০২৫ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ (২.১৮ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে এসেছিল ২৬৪ কোটি (২.৬৪ বিলিয়ন) ডলার। গত অর্থ বছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে এসেছিল ২২২ কোটি ৪১ লাখ (২.২২ বিলিয়ন) ডলার। তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে এসেছিল ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ (২.৪০ বিলিয়ন) ডলার।
চতুর্থ মাস অক্টোবরে আসে ২৩৯ কোটি ৫১ লাখ (২.৩৯ বিলিয়ন) ডলার। পঞ্চম মাস নভেম্বরে এসেছিল ২১৯ কোটি ৯৫ লাখ (২ বিলিয়ন) ডলার। অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের ১২ মাসের ১১ মাসেই (আগস্ট-জুন) ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছে। এক মাসে (মার্চ) আসে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ২ হাজার ৩৯১ কোটি ২২ লাখ (২৩.৯১ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
সোমবার, ০৪ আগস্ট ২০২৫
গত অর্থ বছরের ধারাবাহিকতায় নতুন অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রবিবার রেমিটেন্স প্রবাহের মাসিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা ২৪৭ কোটি ৭৯ লাখ (২.৪৮ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।
এই অঙ্ক গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ের চেয়ে ২৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ১৯১ কোটি ৩৮ লাখ (১.৯১ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। তবে ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম রেমিটেন্স এসেছে এই জুলাইয়ে। চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ (২.১৮ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছিল। এরপর সব মাসেই আড়াই বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছে। এক মাসে (মার্চ) এসেছে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি, ৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার; দুই মাসে (মে ও জুন) প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার। এপ্রিলে এসেছিল পৌনে ৩ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থ বছরের ধারাবাহিকতায় ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ের শুরুতেও রেমিটেন্সে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে এসে ধীরগতি দেখা যায়। শেষ দিকে গতি ফেরার মধ্য দিয়ে মাস শেষ হয়েছে।
এর মধ্যে প্রথম পাঁচ দিনে অর্থাৎ ১ থেকে ৫ জুলাই এসেছিল ৪১ কোটি ৭ লাখ ডলার। দ্বিতীয় সপ্তাহে (৬ থেকে ১২ জুলাই) এসেছিল ৬৬ কোটি ডলার। তৃতীয় সপ্তাহে অর্থাৎ ১৩ থেকে ১৯ জুলাই এসেছে ৪৫ কোটি ১৮ লাখ ডলার। ২০ থেকে ২৬ জুলাই সপ্তাহে এসেছে ৪১ কোটি ৩ লাখ ডলার।
শেষের পাঁচ দিনেই (২৭ থেকে ৩১ জুলাই) এসেছে ৫৪ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। রেমিটেন্সে প্রতি ডলারে এখন ১২২ টাকা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে টাকার অঙ্কে জুলাইয়ে ৩০ হাজার ২৩০ কোটি টাকা দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৭ কোটি ৯৯ ডলার; টাকার অঙ্কে যা ৯৭৫ কোটি।
বেশ কিছুদিন ডলারের দাম স্থিতিশীল ছিল। রেমিটেন্সে ১২৩ টাকা দিত ব্যাংকগুলো। অর্থাৎ প্রবাসীরা ১ ডলার পাঠালে যার নামে পাঠাতেন তিনি ১২৩ টাকা পেতেন। এমনকি টাকা-ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরও বাজার স্থিতিশীল ছিল।
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে কমতে থাকে ডলারের দর। কমতে কমতে মুদ্রাবাজারে ডলারের দর ১২০ টাকয় নেমে আসে। দরপতন ঠেকাতে নিলামে ডলার কেনা শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে পতন ঠেকেছে; প্রায় আগের জায়গায় ফিরে এসেছে। ডলারের দর কমায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে ধীরগতি দেখা দিয়েছিল বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ডলারের দর বাড়ায় প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানোয় রেমিটেন্স প্রবাহ ফের বেড়েছে বলে জানান তারা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘ডলারের দাম কমায় রেমিটেন্সে কিছুটা প্রভাব পড়েছিল হয়ত। ডলারের দর বেড়ে ফের আগের জায়গায় ফিরে এসেছে। সে কারণে প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স নিয়ে মাস শেষ হয়েছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ২৯ শতাংশ। নতুন অর্থ বছরের প্রথম মাস বেশ ভালোভাবেই শুরু হয়েছে বলে আমি মনে করি।’
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ১৩৪ কোটি (১.৩৪ বিলিয়ন) পেতে গত মে মাসে ডলারের বিনিময় মূল্য বাজারভিত্তিক করার ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ১৪ মে টাকা-ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরদিন ১৫ মে ছিল বৃহস্পতিবার; ওই দিন খোলা বাজারে ডলারের দর খানিকটা বাড়লেও ব্যাংকে তেমন হেরফের হয়নি।
সাপ্তাহিক দুই দিন (১৬ ও ১৭ মে, শুক্র ও শনিবার) ছুটির পর ১৮ মে রবিবার মুদ্রাবাজারে ডলারের বিক্রয় মূল্য ছিল ১২২ টাকা ৭৮ পয়সা। এরপর গত ৭ জুলাই পর্যন্ত ১২২ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ১২২ টাকা ৮৫ পয়সার মধ্যে ডলার কেনাবেচা হয়। ৮ জুলাই থেকে কমতে থাকে ডলারের দর; শক্তিশালী হতে থাকে টাকা। ৮ জুলাই মুদ্রাবাজারে ডলারের বিক্রয় মূল্য ছিল ১২২ টাকা ৫৫ পয়সা। ৯ জুলাই তা কমে ১২২ টাকা ৩০ পয়সায় নেমে আসে। ১০ জুলাই তা আরও কমে ১২১ টাকা ৮৫ পয়সায় নেমে আসে। ১১ ও ১২ জুলাই (শুক্র ও শনিবার) ছিল সাপ্তাহিক ছুটি। ১৩ জুলাই রবিবার ডলারের দর আরও কমে ১২১ টাকা ২০ পয়সায় নেমে আসে।
১৪ জুলাই ডলারের বিক্রয় মূল্য আরও কমে ১২০ টাকা ১০ পয়সায় নেমে আসে। এরই মধ্যে ডলারের পতন ঠেকাতে নিলামে ডলার কেনা শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে এ পর্যন্ত ৫০ কোটি ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
১৩ জুলাই প্রথমবার ১৮টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে ১২১ টাকা ৫০ পয়সা দরে ১৭ কোটি ১০ লাখ ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর ১৫ জুলাই দ্বিতীয় দফায় ১২১ টাকা ৫০ পয়সা দরে কেনে ৩১ কোটি ৩০ লাখ ডলার। সবশেষ ২৪ জুলাই ১২১ টাকা ৯৫ পয়সা দরে ১ কোটি ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এতে ১৫ জুলাই একদিনেই ডলারের দর ১ টাকা ৪০ পয়সা বেড়ে ১২১ টাকা ৫০ পয়সায় ওঠে। গত কয়েক দিনে আরও আরও বেশি দামে কেনাবেচা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, দেশের মুদ্রাবাজারে গতকাল রোববার ডলারের সর্বোচ্চ দাম ছিল ১২২ টাকা ৮৯ পয়সা এবং সর্বনিম্ন দাম ছিল ১২২ টাকা। গড় দাম ছিল ১২২ টাকা ৩০ পয়সা।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দর ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কিনছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। তারা বলছেন, ডলার কিনে মুদ্রাবাজার শান্ত রাখার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমান বাজারের বাস্তবতায় এটাই করা উচিৎ।
দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে এ মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়। বলা যায়, সঙ্কটে পড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে যাচ্ছে রেমিটেন্স। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ৩ হাজার ৩২ কোটি ৭৫ লাখ (৩০.৩৩ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা আগের অর্থ বছরের (২০২৩-২৪) চেয়ে ২৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেশি। প্রতি মাসের গড় হিসাবে এসেছে ২৫১ কোটি ৯৮ লাখ (২.৫২ বিলিয়ন) ডলার।
রোজা ও ঈদ সামনে রেখে গত মার্চে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ৩২৯ কোটি ৫৬ লাখ (৩.২৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স আসে দেশে, যা ছিল গত বছরের মার্চ মাসের চেয়ে ৬৫ শতাংশ বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৯৬ কোটি ৯৬ লাখ (২.৯৭ বিলিয়ন) ডলার আসে গত মে মাসে। তৃতীয় সর্বোচ্চ আসে গত অর্থ বছরের শেষ মাস জুনে, ২৮২ কোটি ১২ লাখ (২.৮২ বিলিয়ন) ডলার। চতুর্থ সর্বোচ্চ আসে এপ্রিল মাসে, ২৭৫ কোটি ১৯ লাখ (২.৭৫ বিলিয়ন) ডলার।
২০২৪-২৫ অর্থ বছর শুরু হয়েছিল গত বছরের জুলাই থেকে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে ওই মাস ছিল উত্তাল; দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল। কয়েক দিন ব্যাংক ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল। সে কারণে জুলাই মাসে রেমিটেন্স প্রবাহ কিছুটা কমেছিল; এসেছিল ১৯১ কোটি ৩৭ কোটি (১.৯১ বিলিয়ন) ডলার। তার আগের তিন মাস অবশ্য ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি এসেছিল। আবার জুলাইয়ের পর থেকে প্রতি মাসেও ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স দেশে এসেছে। ২০২৫ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ (২.১৮ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে এসেছিল ২৬৪ কোটি (২.৬৪ বিলিয়ন) ডলার। গত অর্থ বছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে এসেছিল ২২২ কোটি ৪১ লাখ (২.২২ বিলিয়ন) ডলার। তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে এসেছিল ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ (২.৪০ বিলিয়ন) ডলার।
চতুর্থ মাস অক্টোবরে আসে ২৩৯ কোটি ৫১ লাখ (২.৩৯ বিলিয়ন) ডলার। পঞ্চম মাস নভেম্বরে এসেছিল ২১৯ কোটি ৯৫ লাখ (২ বিলিয়ন) ডলার। অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের ১২ মাসের ১১ মাসেই (আগস্ট-জুন) ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছে। এক মাসে (মার্চ) আসে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ২ হাজার ৩৯১ কোটি ২২ লাখ (২৩.৯১ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।