১৯৮০-এর দশকের শেষার্ধ থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দর্শনে বড় পরিবর্তন আসে। অর্থনীতিতে উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থা এবং মুক্ত-বাণিজ্যের মাধ্যমে রপ্তানিমুখী শিল্পায়নকে প্রবৃদ্ধি অর্জন ও দারিদ্র্য নিরসনের চালিকাশক্তি হিসেবে দেখা হয়। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়লেও বৈষম্য তৈরি হয় এবং অর্থনীতিতে নানা ধরনের অস্থিরতা ও ঝুঁকি তৈরি হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এসব কথা বলেন।
গতকাল রাষ্ট্রায়ত্ত গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) আয়োজিত তিন দিনব্যাপী বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলনের প্রথম দিন গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ‘উন্নয়নশীল দেশের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র : একটি রূপরেখা’ প্রবন্ধে তিনি এসব কথা বলেন। সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন সংস্থাটির মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন।
প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘১৯৫০-এর দশকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া কিছু দেশ ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের সমাজতান্ত্রিক নীতি গ্রহণের দিকে ঝুঁকতে দেখা যায়। এই অর্থনৈতিক নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বেসরকারি বিনিয়োগ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর সরকারের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ এবং আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশীয় শিল্পের সংরক্ষণ ও সরকারি মালিকানায় ভারী যন্ত্রশিল্প গড়ে তোলা। প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য নিরসন এ নীতির মূল লক্ষ্য হলেও পরবর্তী তিন-চার দশকে এ লক্ষ্য অর্জনে অগ্রগতি হয়েছে খুব ধীরগতিতে এবং সমাজে বৈষম্য বেড়েছে ব্যাপক হারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এর স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায়। কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের ভেতরে এবং বিভিন্ন স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক টানাপোড়েন দেখা দেয়। ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সরকার পরিবর্তনের পর অর্থনৈতিক নীতির এ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে। আর্থিক খাতের অস্থিতিশীলতা, প্রাচুর্যের পাশাপাশি চরম বৈষম্য ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ক্রমবর্ধমান আধিপত্য এ ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি বর্তমান কালের একচ্ছত্র প্রভাবশালী অর্থনৈতিক দর্শন হিসেবে আবির্ভূত হলেও একে ক্ষোভ ও এক ধরনের অনিবার্যতার দৃষ্টি থেকে দেখা হচ্ছে।’
সমাজে বৈষম্য কমানোর একটি উপায় উল্লেখ্য করে তিনি বলেন, ‘করপোরেট খাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর বাড়তি কর বসানোর পরিবর্তে ক্ষেত্রবিশেষে তাদের মালিকানার কিছু অংশ শেয়ারের মাধ্যমে সরকার অধিগ্রহণ করতে পারে। তবে অবশ্যই এটা কোন জোর জবরদস্তির বিষয় নয় এবং ওইসব ব্যবসা পরিচালনায় সরকারি হস্তক্ষেপের প্রশ্নই আসে না। সরকারের প্রতিনিধিরা শেয়ারের বিপরীতে কোম্পানির পর্ষদে বসলেও ভোট প্রয়োগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কেবল ন্যূনতম ভূমিকা রাখবেন। কাজেই এখানে সরকারি মালিকানাধীন ব্যবসায়ের ইতিপূর্বেকার তিক্ত অভিজ্ঞতায় ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা নেই।’
যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক আর্থিক খাতের ধসের সময় বারাক ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন অনেক বড় বড় আর্থিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া হওয়া থেকে রক্ষা করেছিল। ওই সময় কোম্পানিগুলোর শেয়ার কিনেছিল সরকার। তবে আদর্শিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র এতই ব্যক্তি খাতমুখী যে পরবর্তী সময়ে সরকারি শেয়ারগুলো ওইসব কোম্পানিকে কিনে নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়।’
বৈষম্য কমানোর আরেকটি উপায় হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, তাত্ত্বিকভাবে ব্যক্তি খাতের কোম্পানির আংশিক মালিকানা থেকে রাজস্ব আয়ের সুযোগের কথা প্রথম দেখিয়েছিলেন নোবেল বিজয়ী ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জেমস মিড। তার প্রস্তাব ছিল স্বাধীন ট্রাস্ট গঠনের মাধ্যমে সরকারের এই আয় সামাজিককল্যাণে ব্যয় করা যেতে পারে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ ধারণা বাস্তবায়নের বিশেষ সুযোগ আছে।
দেশে বড় বড় শিল্প-প্রতিষ্ঠানের ঋণ খেলাপির উদারহণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘কিছু বড় বড় শিল্প গ্রুপের মুনাফা অর্জনকারী শিল্প-প্রতিষ্ঠান থাকলেও তারা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে খেলাপি হয়ে যায়। এর একটা কারণ অবৈধভাবে বিদেশে মুনাফা পাচার। এক্ষেত্রে শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে বারবার ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ, সুদ মওকুফ ইত্যাদি সুবিধা দিতে হয়। কিন্তু এর পরিবর্তে সরকার আর্থিক সহায়তার শর্ত হিসেবে মুনাফা অর্জনকারী কোম্পানিগুলোর কিছু শেয়ার ‘সমমূল্যে’ অর্থাৎ শেয়ারপত্রে উল্লিখিত দামে কিনে নিতে পারে। এছাড়া ভালো কোম্পানি বাজারে শেয়ার ছাড়লে সরকার আইন করে তার কিছু অংশও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উল্লিখিত দামে কিনে নিতে পারে।’
দেশে রাজস্ব আয় বাড়ানোর উপায় হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে সম্পত্তির উত্তরাধিকারে কর নেই। অথচ শিল্পোন্নত দেশগুলোতে উচ্চ হারে এ ধরনের কর আরোপ করা হয়। এমনকি অধিকাংশ স্বল্পনোন্নত দেশে সম্পদ করও নেই বা থাকলেও তার প্রয়োগ দুর্বল। এ কারণে আমাদের দেশে বংশানুক্রমিকভাবে বৈষম্য বাড়ছে। বিশেষত, যেসব ধনসম্পত্তি ব্যবসা-বাণিজ্যেও পরিবর্তে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে, সেগুলো উৎপাদনশীল শিল্পে বিনিয়োগের পরিবর্তে সাধারণত বিভিন্ন ধরনের স্থাবর সম্পত্তির ওপরই। এ ধরনের সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে উচ্চ হারে কর আরোপিত হলে বাজার অর্থনীতির প্রণোদনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই।’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশগুলোর সরকার সম্পদ আহরণের মুনাফা থেকে বড় অঙ্কের রাজস্ব আয় করতে পারে। তবে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার নির্ভর করে সরকারের দক্ষতা ও শাসকগোষ্ঠীর শ্রেণী চরিত্রের ওপর। মালয়েশিয়ায় ১৯৭৪ সালে সম্পূর্ণ সরকারি মালিকানায় পেট্রোনাস নামের তেল ও গ্যাস কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়া সরকার ১৯৭৩ সালে ‘পোসকো’ নামের যে লোহা ও ইস্পাত তৈরির কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিল, তা সে দেশের শিল্পায়নে বড় ভূমিকা রেখেছে। বর্তমানে এই কোম্পানিতে সরকারের মালিকানা ৭০ শতাংশ, যা থেকে সরকারের বড় অঙ্কের আয় হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্যের খনিজ তেল উৎপাদন থেকে পাওয়া মুনাফা সে রাজ্যের বাসিন্দাদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কিছু উপাদান অর্থনৈতিক সাম্য ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার আরেকটি বড় উপায় হলো দুর্বল জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করা। ন্যায্য অধিকার বা মজুরি আদায়ে শিল্পশ্রমিক, ভূমিহীন কৃষক, মৎস্যজীবী এসব দুর্বল গোষ্ঠীকে সংগঠিত করে তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা বাজার অর্থনীতির আদর্শের পরিপন্থী নয়।’
সংগঠনভিত্তিক গণতন্ত্রের কথাও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘ভারতের বিশ্বখ্যাত দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘আমুল’ সৃষ্টি হয়েছিল গরিব দুগ্ধ উৎপাদনকারী খামারিদের নিয়ে সমবায় সমিতি গঠন করে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের শোষণ থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে। অনেক ক্ষেত্রে এসব সংগঠন সাধারণের ব্যবহার্য প্রাকৃতিক সম্পদ, যেমন মুক্ত জলাশয় বা বনভূমি সংরক্ষণেও ভূমিকা রাখতে পারে।’
পার্র্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বৈষম্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা আজ দুটি ভারত দেখতে পাই। একটি তথ্য-প্রযুক্তিতে উন্নত ভারত। আরেকটি পিছিয়ে পড়া হতদারিদ্রের ভারত। অর্থাৎ এখানে বৈষম্য এত পরিমাণ বেড়েছে যে, একই দেশের মানুষের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।’ একটি দেশের জীবনযাত্রার মান যাচাইয়ে জিডিপি ভালো মাপকাঠি নয় উল্লেখ করেন তিনি।
সমাজে বৈষম্য নিরসণে এসব কার্যকর উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ ব্যবস্থা বাজার অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। সেজন্য দরকার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও জনসমর্থন। কিছু ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক এজেন্ডা নিয়ে নির্বাচিত হওয়ার পর সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকার যথেষ্ট সাফল্য দেখিয়েছে।’
শুক্রবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২২
১৯৮০-এর দশকের শেষার্ধ থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দর্শনে বড় পরিবর্তন আসে। অর্থনীতিতে উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থা এবং মুক্ত-বাণিজ্যের মাধ্যমে রপ্তানিমুখী শিল্পায়নকে প্রবৃদ্ধি অর্জন ও দারিদ্র্য নিরসনের চালিকাশক্তি হিসেবে দেখা হয়। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়লেও বৈষম্য তৈরি হয় এবং অর্থনীতিতে নানা ধরনের অস্থিরতা ও ঝুঁকি তৈরি হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এসব কথা বলেন।
গতকাল রাষ্ট্রায়ত্ত গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) আয়োজিত তিন দিনব্যাপী বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলনের প্রথম দিন গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ‘উন্নয়নশীল দেশের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র : একটি রূপরেখা’ প্রবন্ধে তিনি এসব কথা বলেন। সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন সংস্থাটির মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন।
প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘১৯৫০-এর দশকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া কিছু দেশ ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের সমাজতান্ত্রিক নীতি গ্রহণের দিকে ঝুঁকতে দেখা যায়। এই অর্থনৈতিক নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বেসরকারি বিনিয়োগ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর সরকারের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ এবং আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশীয় শিল্পের সংরক্ষণ ও সরকারি মালিকানায় ভারী যন্ত্রশিল্প গড়ে তোলা। প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য নিরসন এ নীতির মূল লক্ষ্য হলেও পরবর্তী তিন-চার দশকে এ লক্ষ্য অর্জনে অগ্রগতি হয়েছে খুব ধীরগতিতে এবং সমাজে বৈষম্য বেড়েছে ব্যাপক হারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এর স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায়। কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের ভেতরে এবং বিভিন্ন স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক টানাপোড়েন দেখা দেয়। ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সরকার পরিবর্তনের পর অর্থনৈতিক নীতির এ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে। আর্থিক খাতের অস্থিতিশীলতা, প্রাচুর্যের পাশাপাশি চরম বৈষম্য ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ক্রমবর্ধমান আধিপত্য এ ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি বর্তমান কালের একচ্ছত্র প্রভাবশালী অর্থনৈতিক দর্শন হিসেবে আবির্ভূত হলেও একে ক্ষোভ ও এক ধরনের অনিবার্যতার দৃষ্টি থেকে দেখা হচ্ছে।’
সমাজে বৈষম্য কমানোর একটি উপায় উল্লেখ্য করে তিনি বলেন, ‘করপোরেট খাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর বাড়তি কর বসানোর পরিবর্তে ক্ষেত্রবিশেষে তাদের মালিকানার কিছু অংশ শেয়ারের মাধ্যমে সরকার অধিগ্রহণ করতে পারে। তবে অবশ্যই এটা কোন জোর জবরদস্তির বিষয় নয় এবং ওইসব ব্যবসা পরিচালনায় সরকারি হস্তক্ষেপের প্রশ্নই আসে না। সরকারের প্রতিনিধিরা শেয়ারের বিপরীতে কোম্পানির পর্ষদে বসলেও ভোট প্রয়োগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কেবল ন্যূনতম ভূমিকা রাখবেন। কাজেই এখানে সরকারি মালিকানাধীন ব্যবসায়ের ইতিপূর্বেকার তিক্ত অভিজ্ঞতায় ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা নেই।’
যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক আর্থিক খাতের ধসের সময় বারাক ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন অনেক বড় বড় আর্থিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া হওয়া থেকে রক্ষা করেছিল। ওই সময় কোম্পানিগুলোর শেয়ার কিনেছিল সরকার। তবে আদর্শিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র এতই ব্যক্তি খাতমুখী যে পরবর্তী সময়ে সরকারি শেয়ারগুলো ওইসব কোম্পানিকে কিনে নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়।’
বৈষম্য কমানোর আরেকটি উপায় হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, তাত্ত্বিকভাবে ব্যক্তি খাতের কোম্পানির আংশিক মালিকানা থেকে রাজস্ব আয়ের সুযোগের কথা প্রথম দেখিয়েছিলেন নোবেল বিজয়ী ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জেমস মিড। তার প্রস্তাব ছিল স্বাধীন ট্রাস্ট গঠনের মাধ্যমে সরকারের এই আয় সামাজিককল্যাণে ব্যয় করা যেতে পারে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ ধারণা বাস্তবায়নের বিশেষ সুযোগ আছে।
দেশে বড় বড় শিল্প-প্রতিষ্ঠানের ঋণ খেলাপির উদারহণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘কিছু বড় বড় শিল্প গ্রুপের মুনাফা অর্জনকারী শিল্প-প্রতিষ্ঠান থাকলেও তারা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে খেলাপি হয়ে যায়। এর একটা কারণ অবৈধভাবে বিদেশে মুনাফা পাচার। এক্ষেত্রে শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে বারবার ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ, সুদ মওকুফ ইত্যাদি সুবিধা দিতে হয়। কিন্তু এর পরিবর্তে সরকার আর্থিক সহায়তার শর্ত হিসেবে মুনাফা অর্জনকারী কোম্পানিগুলোর কিছু শেয়ার ‘সমমূল্যে’ অর্থাৎ শেয়ারপত্রে উল্লিখিত দামে কিনে নিতে পারে। এছাড়া ভালো কোম্পানি বাজারে শেয়ার ছাড়লে সরকার আইন করে তার কিছু অংশও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উল্লিখিত দামে কিনে নিতে পারে।’
দেশে রাজস্ব আয় বাড়ানোর উপায় হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে সম্পত্তির উত্তরাধিকারে কর নেই। অথচ শিল্পোন্নত দেশগুলোতে উচ্চ হারে এ ধরনের কর আরোপ করা হয়। এমনকি অধিকাংশ স্বল্পনোন্নত দেশে সম্পদ করও নেই বা থাকলেও তার প্রয়োগ দুর্বল। এ কারণে আমাদের দেশে বংশানুক্রমিকভাবে বৈষম্য বাড়ছে। বিশেষত, যেসব ধনসম্পত্তি ব্যবসা-বাণিজ্যেও পরিবর্তে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে, সেগুলো উৎপাদনশীল শিল্পে বিনিয়োগের পরিবর্তে সাধারণত বিভিন্ন ধরনের স্থাবর সম্পত্তির ওপরই। এ ধরনের সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে উচ্চ হারে কর আরোপিত হলে বাজার অর্থনীতির প্রণোদনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই।’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশগুলোর সরকার সম্পদ আহরণের মুনাফা থেকে বড় অঙ্কের রাজস্ব আয় করতে পারে। তবে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার নির্ভর করে সরকারের দক্ষতা ও শাসকগোষ্ঠীর শ্রেণী চরিত্রের ওপর। মালয়েশিয়ায় ১৯৭৪ সালে সম্পূর্ণ সরকারি মালিকানায় পেট্রোনাস নামের তেল ও গ্যাস কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়া সরকার ১৯৭৩ সালে ‘পোসকো’ নামের যে লোহা ও ইস্পাত তৈরির কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিল, তা সে দেশের শিল্পায়নে বড় ভূমিকা রেখেছে। বর্তমানে এই কোম্পানিতে সরকারের মালিকানা ৭০ শতাংশ, যা থেকে সরকারের বড় অঙ্কের আয় হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্যের খনিজ তেল উৎপাদন থেকে পাওয়া মুনাফা সে রাজ্যের বাসিন্দাদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কিছু উপাদান অর্থনৈতিক সাম্য ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার আরেকটি বড় উপায় হলো দুর্বল জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করা। ন্যায্য অধিকার বা মজুরি আদায়ে শিল্পশ্রমিক, ভূমিহীন কৃষক, মৎস্যজীবী এসব দুর্বল গোষ্ঠীকে সংগঠিত করে তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা বাজার অর্থনীতির আদর্শের পরিপন্থী নয়।’
সংগঠনভিত্তিক গণতন্ত্রের কথাও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘ভারতের বিশ্বখ্যাত দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘আমুল’ সৃষ্টি হয়েছিল গরিব দুগ্ধ উৎপাদনকারী খামারিদের নিয়ে সমবায় সমিতি গঠন করে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের শোষণ থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে। অনেক ক্ষেত্রে এসব সংগঠন সাধারণের ব্যবহার্য প্রাকৃতিক সম্পদ, যেমন মুক্ত জলাশয় বা বনভূমি সংরক্ষণেও ভূমিকা রাখতে পারে।’
পার্র্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বৈষম্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা আজ দুটি ভারত দেখতে পাই। একটি তথ্য-প্রযুক্তিতে উন্নত ভারত। আরেকটি পিছিয়ে পড়া হতদারিদ্রের ভারত। অর্থাৎ এখানে বৈষম্য এত পরিমাণ বেড়েছে যে, একই দেশের মানুষের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।’ একটি দেশের জীবনযাত্রার মান যাচাইয়ে জিডিপি ভালো মাপকাঠি নয় উল্লেখ করেন তিনি।
সমাজে বৈষম্য নিরসণে এসব কার্যকর উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ ব্যবস্থা বাজার অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। সেজন্য দরকার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও জনসমর্থন। কিছু ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক এজেন্ডা নিয়ে নির্বাচিত হওয়ার পর সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকার যথেষ্ট সাফল্য দেখিয়েছে।’