alt

অর্থ-বাণিজ্য

কী থাকবে অর্থমন্ত্রীর কালো ব্যাগে

রেজাউল করিম : বুধবার, ৩১ মে ২০২৩

বিশ্ব অর্থনীতির সংকট আর দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আইএমএফের শর্ত- ভর্তুকি তুলে দিতে হবে, বাড়তে হবে রাজস্ব বা কর আয়। এই পরিস্থিতিতে আজ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দুপুর ৩টায় সংসদে আগামী অর্থবছরের (জুলাই’২৩-জুন’২৪) বাজেট পেশ করবেন। সবার আগ্রহ থাকবে, কী আছে কালো ব্যাগে, যেটার মধ্যে বাজেটের বিভিন্ন প্রস্তাবনার দলিল থাকবে।

বাজেট মূলত সরকারের এক বছরের রাজনৈতিক দলিল। তবে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থের টানাপোড়েনে বাজেট শেষ বিচারে আপোষের দলিল। একজন অর্থমন্ত্রী সেই আপোষটা কত মুন্সিয়ানার সঙ্গে করতে পারছেন, তার ওপরই নির্ভর করে তিনি জনসংখ্যার কত শতাংশ মানুষকে খুশি করতে পারছেন? তিনি কোথা থেকে আয় করবেন আর কোথায় ব্যয় করবেন? আপোষটা কার পক্ষে করবেন?

এবারের বাজেটের আকার হতে পারে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। চলতি (২০২৩-২৪) বাজেটের তুলনায় আসন্ন বাজেটের আকার বাড়ছে ৮৩ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। এবার মোট আয় ও ব্যয়ের মধ্যে যে ব্যবধান (ঘাটতি), তা নতুন অর্থবছরের জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশের ঘরে রাখা হয়েছে। টাকার অঙ্কে ঘাটতি (অনুদানসহ) ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা।

বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ‘উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে।’ প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশ ধরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা।

আইএমএফের শর্ত যদি মানতে হয়, সরকারকে এবার বাড়তি ৬৫ হাজার কোটি টাকা আয় বাড়াতে হবে কর থেকে। অর্থাৎ সরকার মোট রাজস্ব প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৫ লাখ কোটি টাকা।

এর মধ্যে রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর থেকে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আসবে। এনবিআর বহির্ভূত কর থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা।

প্রতি বছর যে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয় সেই লক্ষ্যমাত্রাই পূরণ করতে পারে না এনবিআর। তাহলে আগামী অর্থবছরে বাড়তি রাজস্ব কীভাবে আসবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ আইএমএফের হিসাবে আগামী অর্থবছরে কর রাজস্ব বাড়াতে হবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা।

এছাড়া শর্ত অনুযায়ী সঞ্চয়পত্র থেকে চলতি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা কম ঋণ নেয়ার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ কমানোর শর্ত রয়েছে আইএমএফের। সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমানোর ফলে সরকারের ঋণের যে ঘাটতি হবে, সেটি পূরণ করতে বাড়ানো হচ্ছে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা।

মন্ত্রীরা বলছেন, এবার কর না বাড়িয়ে করের আওতা বাড়ানো হচ্ছে। তবে এরপরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর কিছুটা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটাও জানা গেছে, যাদের করযোগ্য আয় নেই তাদেরকেও ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে। এই বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

তারা বলছেন, বর্তমানে দেশে কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীর (টিআইএন) সংখ্যা প্রায় ৮২ লাখ। এর মধ্যে রিটার্ন দাখিল করেন মাত্রা ২৬ লাখের মতো। যদি করযোগ্য আয় না থাকে তারপরও কর দিতে হয় তাহলে মানুষ রিটার্ন দাখিল করতে নিরুৎসাহিত হবেন।

বাজেট তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন আগামী অর্থবছরে প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে।’ এ আদায় নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সম্প্রতি ঢাকা সফর করে যাওয়া আইএমএফ প্রতিনিধি দল। তবে রাজস্ব আদায় বাড়াতে সর্বজনীন করব্যবস্থা, পুরনো করছাড় পদ্ধতি বাতিল এবং নতুন আওতা বাড়ানোসহ বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’

এবারের বাজেটেও মূল্যস্ফীতিকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে ধরা হয়েছে। গত মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ থাকলেও আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। সরকার ধারণা করছে, ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দাম কমছে। আগামী দিনে জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য পণ্যের মূল্য কমবে। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিতে।

গত কয়েক বছর ধরেই সরকার বলে যে প্রধান চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু কীভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে তার নির্দিষ্ট রূপরেখা থাকে না। এবারের বাজেটে সেই নির্দেশনা থাকবে- এমনটা আশা করেন অর্থনীতিবিদরা।

এ প্রসঙ্গে ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জটিই আগামী বাজেটে সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হবে। এটি নিয়ন্ত্রণে বাজেটে দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। এই নির্দেশনা যেন স্পষ্ট করে বলা হয় যে কোথায় এবং কীভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে।’ এ বিষয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেছেন, ‘জনগণের বড় উদ্বেগের জায়গা মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং প্রবৃদ্ধিকে প্রধান লক্ষ্য ধরে আগামী অর্থবছরের বাজেট করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় এবার বাজেটের আকার জিডিপির অনুপাতে আগের চেয়ে বাড়ানো হচ্ছে না।’

বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে আটটি প্রধান চ্যালেঞ্জ নির্ধারণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ; তেল, গ্যাস ও সারের ভর্তুকি, রাজস্ব আহরণ বাড়ানো, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানোর মতো বিষয়গুলোকে মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

এদিকে ভর্তুকি কমাতে আইএমএফের চাপ থাকলেও কৃষিতে ভর্তুকি না কমিয়ে উল্টো বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। প্রতিমন্ত্রী দাবি করেছেন, ‘আইএমএফের শর্ত এ ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হবে না।’

বিদায়ী অর্থবছরে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণের জন্য বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকার মতো, যা জিডিপির ৩.৯ শতাংশ। এবার তা বেড়ে ৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আভাস মিলেছে। তবে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানো হবে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘জ্বালানির দামটা কিছুটা সমন্বয় করতে হবে।’

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেট ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার। সেই অঙ্ক বাড়তে বাড়তে ২৯২২-২৩ অর্থবছরের ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা হয়।

বিদায়ী অর্থবছরের এই বাজেট ছিল জিডিপির ১৫ শতাংশ। আনুপাতিক হারে এবারও তা একই রকম থাকছে।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাজেটের আকার অনেক বেড়েছে। কিন্তু তা জিডিপির ১৫ শতাংশের আশপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছে। স্বাভাবিক অবস্থায় একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে বাজেটের আকার জিডিপির ২৫-৩০ শতাংশের মধ্যে হওয়া বাঞ্ছনীয়। সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্রপরিচালনা ও উন্নয়ন কার্যক্রম চালু রাখতে হলে সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই।

এছাড়া বৈদেশিক অনুদান হিসেবে আসবে ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে মোট রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে বাজেটে অনুদান ব্যতীত মোট ঘাটতি নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং জিডিপি ৫ দশমিক ২ শতাংশ।

ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এর মধ্যে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়া হবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩২ কোটি, আর সঞ্চয়পত্র থেকে ১৮ হাজার এবং অন্যান্য খাত থেকে নেয়া হবে ৫ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণ নেয়া হবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকার।

আগামী অর্থবছরের জন্য সরকার পরিচালন ব্যয়ের প্রাক্কলন করেছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। এছাড়া উন্নয়ন ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা।

আজ মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যা প্রস্তাবিত বাজেট হিসাবে দীর্ঘ আলোচনার পর ২৫ জুন পাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর সেটি কার্যকর হবে ১ জুলাই থেকে।

তবে বিভিন্ন টানাপোড়েন আর স্বার্থের সংঘাতে অর্থমন্ত্রী কোথায় ভারসাম্য টানবেন সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।

ছবি

সুদসহ সব ঋণ পরিশোধ করল শ্রীলঙ্কা

ছবি

কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না, নিত্যপণ্যের দাম

ছবি

এশিয়ার বাণিজ্যিক কেন্দ্র বাংলাদেশ হতে পারে : এফবিসিসিআই

অভিযানেও কমছে না খুলনার ‘অসাধু’ ব্যবসায়ীদের কারসাজি

ছবি

চলতি বছরেই পোশাক খাতে নতুন ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা

বাংলাদেশ ব্যাংকে অ্যালার্ম, ফায়ার সার্ভিস গিয়ে দেখল আগুন লাগেনি

শিশু জুনায়েদের বিমানে চড়ার ‘স্বপ্ন পূরণ’ করলো ওয়ালটন প্লাজা

ছবি

দেশের উন্নয়নে নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে বিআরআই : দীপু মনি

ছবি

সবজির বাজারে আগুন, বাড়তি ফার্মের মুরগির দামও

আরও ৬ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি

সূচকের সামান্য পতন, কমেছে লেনদেনও

এসএমই ফাউন্ডেশনের ‘ন্যাচারাল ডাইং’ প্রশিক্ষণে পোশাকে প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহার করা শিখছেন উদ্যোক্তারা

অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি : বাংলাদেশ ব্যাংক

ছবি

দুই মাসে রাজস্ব ঘাটতি ৪ হাজার ৮৭ কোটি টাকা

পিপলস লিজিংয়ের লেনদেন বন্ধের মেয়াদ বেড়েছে ৯৫ দফা

রিজার্ভ কমে ২ হাজার ১৪৫ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে

ছবি

সাউথইস্ট ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান হলেন মো. আকিকুর রহমান

ছবি

আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানতের চেয়ে ঋণ বেশি

ছবি

শেষ কার্যদিবসে দেশের পুঁজিবাজারে লেনদেন কমেছে

ছবি

বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বৃদ্ধি পাবে : এডিবি

ছবি

সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে আলু আমদানির সুপারিশ

ছবি

মামলা নিষ্পত্তি বাড়লেও ঋণ আদায় কম

ব্যাংকের ৪৩ শতাংশ আমানত কোটি টাকার হিসাবধারীদের

ছবি

বেশি দামে ডলার বেচায় ১০ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

বীমা খাতে ধস, শেয়ারবাজারে পতন

রিজার্ভ চুরির প্রতিবেদন পেছালো

বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী সুইস উদ্যোক্তারা

ছবি

শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলে ২৫.৯৯ কোটি টাকা জমা দিয়েছে গ্রামীণফোন

ছবি

কোটি টাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তিন মাসে বেড়েছে ৩৩৬২টি

ছবি

আয় ৫ লাখ টাকার কম হলেই এক পাতার রিটার্ন

ছবি

ডিমের দামে ওঠা-নামা, ১২-১৩ প্রতিষ্ঠানের হাতে নিয়ন্ত্রণ, বলছেন খামারিরা

ছবি

ব্যাংক খাতে নারী কর্মীর সংখ্যা বাড়ছে

বীমার দাপটে শেয়ারবাজারে উত্থান

আমদানির তথ্য যাচাইয়ে কড়াকড়ি আরোপ

রপ্তানিতে ৩৮ পণ্যে মিলবে নগদ সহায়তা

ছবি

ফের উৎপাদনে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র

tab

অর্থ-বাণিজ্য

কী থাকবে অর্থমন্ত্রীর কালো ব্যাগে

রেজাউল করিম

বুধবার, ৩১ মে ২০২৩

বিশ্ব অর্থনীতির সংকট আর দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আইএমএফের শর্ত- ভর্তুকি তুলে দিতে হবে, বাড়তে হবে রাজস্ব বা কর আয়। এই পরিস্থিতিতে আজ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দুপুর ৩টায় সংসদে আগামী অর্থবছরের (জুলাই’২৩-জুন’২৪) বাজেট পেশ করবেন। সবার আগ্রহ থাকবে, কী আছে কালো ব্যাগে, যেটার মধ্যে বাজেটের বিভিন্ন প্রস্তাবনার দলিল থাকবে।

বাজেট মূলত সরকারের এক বছরের রাজনৈতিক দলিল। তবে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থের টানাপোড়েনে বাজেট শেষ বিচারে আপোষের দলিল। একজন অর্থমন্ত্রী সেই আপোষটা কত মুন্সিয়ানার সঙ্গে করতে পারছেন, তার ওপরই নির্ভর করে তিনি জনসংখ্যার কত শতাংশ মানুষকে খুশি করতে পারছেন? তিনি কোথা থেকে আয় করবেন আর কোথায় ব্যয় করবেন? আপোষটা কার পক্ষে করবেন?

এবারের বাজেটের আকার হতে পারে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। চলতি (২০২৩-২৪) বাজেটের তুলনায় আসন্ন বাজেটের আকার বাড়ছে ৮৩ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। এবার মোট আয় ও ব্যয়ের মধ্যে যে ব্যবধান (ঘাটতি), তা নতুন অর্থবছরের জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশের ঘরে রাখা হয়েছে। টাকার অঙ্কে ঘাটতি (অনুদানসহ) ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা।

বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ‘উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে।’ প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশ ধরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫০ লাখ ৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা।

আইএমএফের শর্ত যদি মানতে হয়, সরকারকে এবার বাড়তি ৬৫ হাজার কোটি টাকা আয় বাড়াতে হবে কর থেকে। অর্থাৎ সরকার মোট রাজস্ব প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৫ লাখ কোটি টাকা।

এর মধ্যে রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর থেকে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আসবে। এনবিআর বহির্ভূত কর থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা।

প্রতি বছর যে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয় সেই লক্ষ্যমাত্রাই পূরণ করতে পারে না এনবিআর। তাহলে আগামী অর্থবছরে বাড়তি রাজস্ব কীভাবে আসবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ আইএমএফের হিসাবে আগামী অর্থবছরে কর রাজস্ব বাড়াতে হবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা।

এছাড়া শর্ত অনুযায়ী সঞ্চয়পত্র থেকে চলতি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা কম ঋণ নেয়ার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ কমানোর শর্ত রয়েছে আইএমএফের। সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমানোর ফলে সরকারের ঋণের যে ঘাটতি হবে, সেটি পূরণ করতে বাড়ানো হচ্ছে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা।

মন্ত্রীরা বলছেন, এবার কর না বাড়িয়ে করের আওতা বাড়ানো হচ্ছে। তবে এরপরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর কিছুটা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটাও জানা গেছে, যাদের করযোগ্য আয় নেই তাদেরকেও ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে। এই বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

তারা বলছেন, বর্তমানে দেশে কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীর (টিআইএন) সংখ্যা প্রায় ৮২ লাখ। এর মধ্যে রিটার্ন দাখিল করেন মাত্রা ২৬ লাখের মতো। যদি করযোগ্য আয় না থাকে তারপরও কর দিতে হয় তাহলে মানুষ রিটার্ন দাখিল করতে নিরুৎসাহিত হবেন।

বাজেট তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন আগামী অর্থবছরে প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে।’ এ আদায় নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সম্প্রতি ঢাকা সফর করে যাওয়া আইএমএফ প্রতিনিধি দল। তবে রাজস্ব আদায় বাড়াতে সর্বজনীন করব্যবস্থা, পুরনো করছাড় পদ্ধতি বাতিল এবং নতুন আওতা বাড়ানোসহ বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’

এবারের বাজেটেও মূল্যস্ফীতিকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে ধরা হয়েছে। গত মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ থাকলেও আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। সরকার ধারণা করছে, ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দাম কমছে। আগামী দিনে জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য পণ্যের মূল্য কমবে। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিতে।

গত কয়েক বছর ধরেই সরকার বলে যে প্রধান চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু কীভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে তার নির্দিষ্ট রূপরেখা থাকে না। এবারের বাজেটে সেই নির্দেশনা থাকবে- এমনটা আশা করেন অর্থনীতিবিদরা।

এ প্রসঙ্গে ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জটিই আগামী বাজেটে সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হবে। এটি নিয়ন্ত্রণে বাজেটে দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। এই নির্দেশনা যেন স্পষ্ট করে বলা হয় যে কোথায় এবং কীভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে।’ এ বিষয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেছেন, ‘জনগণের বড় উদ্বেগের জায়গা মূল্যস্ফীতির হার কমিয়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং প্রবৃদ্ধিকে প্রধান লক্ষ্য ধরে আগামী অর্থবছরের বাজেট করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় এবার বাজেটের আকার জিডিপির অনুপাতে আগের চেয়ে বাড়ানো হচ্ছে না।’

বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে আটটি প্রধান চ্যালেঞ্জ নির্ধারণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ; তেল, গ্যাস ও সারের ভর্তুকি, রাজস্ব আহরণ বাড়ানো, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানোর মতো বিষয়গুলোকে মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

এদিকে ভর্তুকি কমাতে আইএমএফের চাপ থাকলেও কৃষিতে ভর্তুকি না কমিয়ে উল্টো বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। প্রতিমন্ত্রী দাবি করেছেন, ‘আইএমএফের শর্ত এ ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হবে না।’

বিদায়ী অর্থবছরে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণের জন্য বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকার মতো, যা জিডিপির ৩.৯ শতাংশ। এবার তা বেড়ে ৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আভাস মিলেছে। তবে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানো হবে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘জ্বালানির দামটা কিছুটা সমন্বয় করতে হবে।’

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেট ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার। সেই অঙ্ক বাড়তে বাড়তে ২৯২২-২৩ অর্থবছরের ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা হয়।

বিদায়ী অর্থবছরের এই বাজেট ছিল জিডিপির ১৫ শতাংশ। আনুপাতিক হারে এবারও তা একই রকম থাকছে।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাজেটের আকার অনেক বেড়েছে। কিন্তু তা জিডিপির ১৫ শতাংশের আশপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছে। স্বাভাবিক অবস্থায় একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে বাজেটের আকার জিডিপির ২৫-৩০ শতাংশের মধ্যে হওয়া বাঞ্ছনীয়। সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্রপরিচালনা ও উন্নয়ন কার্যক্রম চালু রাখতে হলে সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই।

এছাড়া বৈদেশিক অনুদান হিসেবে আসবে ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে মোট রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে বাজেটে অনুদান ব্যতীত মোট ঘাটতি নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং জিডিপি ৫ দশমিক ২ শতাংশ।

ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এর মধ্যে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়া হবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩২ কোটি, আর সঞ্চয়পত্র থেকে ১৮ হাজার এবং অন্যান্য খাত থেকে নেয়া হবে ৫ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণ নেয়া হবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকার।

আগামী অর্থবছরের জন্য সরকার পরিচালন ব্যয়ের প্রাক্কলন করেছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। এছাড়া উন্নয়ন ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা।

আজ মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যা প্রস্তাবিত বাজেট হিসাবে দীর্ঘ আলোচনার পর ২৫ জুন পাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর সেটি কার্যকর হবে ১ জুলাই থেকে।

তবে বিভিন্ন টানাপোড়েন আর স্বার্থের সংঘাতে অর্থমন্ত্রী কোথায় ভারসাম্য টানবেন সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।

back to top