alt

নগর-মহানগর

সবুজ, জলাধার ধ্বংস করে ‘তপ্ত দ্বীপ’ ঢাকা

শাফিউল আল ইমরান : মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

নানামুখী চাপে দিন দিন ‘তপ্ত দ্বীপে (হিট আইল্যান্ড)’ পরিণত হচ্ছে রাজধানী ঢাকা। তাপমাত্রা বাড়ার যতগুলো উপাদান আছে, এর সবগুলোই আছে এ নগরীতে। আর তাপ কমানোর উদ্যানগুলো কমতে কমতে এখন একেবারে নিঃশেষ হওয়ার পথে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সত্তরোর্ধ চা দোকানি চুন্নু মিয়া। ওই এলাকায় ৫০ বছর ধরে চা বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ‘এই বয়সে কত কী দেখলাম, আশপাশে কত পুকুর ছিল। শিয়া মসজিদের ঢালে যে রিং রোড ওহানে (ওখানে) তো জাহাজ ঘাট আছিল। ওই ঘাটে কত জাহাজ আসতো, এখন কেউ চিনবার পারবো?’

কাশিনাথ বশাক বেশ কয়েক দশক ধরে ঢাকার ‘বেড়ে ওঠা’ দেখছেন। তার অফিস রাজধানীর পুরানা পল্টনে। দীর্ঘদিন ধরে সেখানে কাজ করছেন। তিনি বলছেন, ‘ওই যে দেখতাছেন হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের বিল্ডিং সেখানে আগে তো শান বাঁধানো পুকুর ছিল। মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে এসে গোসল করতো। এখন সেখানে কোন কিছুর অস্তিত্ব আছে!’

এই আক্ষেপ শুধু চুন্নু মিয়া বা কাশিনাথেরই নয়, আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগের ঢাকা যারা চিনেন তাদের প্রত্যেকের। অত পেছনে যাবারও প্রয়োজন নেই। গবেষকরা বলছেন, গত ২৮ বছরে যে পরিবর্তন হয়েছে তাতেই চড়া মুল্য দিতে হচ্ছে এই নগরের বাসিন্দাদের। জলাশয় ভরাট করে ও সবুজ খালি জায়গায় একের পর এক কংক্রিটের স্থাপনা তৈরির চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে।

গত ২৮ বছরে ঢাকায় জলাধার ও জলাভূমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৯০ শতাংশ। আর সবুজ বা গাছপালা, মাঠ, পার্কের পরিমাণ কমেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। আর নির্মাণ বা কংক্রিটের স্থাপনা বেড়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ মেহেদী আহসানের এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। ‘ব্লু এন্ড গ্রিন স্পেস ইন ঢাকা সিটি : রিয়েলিটি অ্যান্ড ওয়ে ফরওয়ার্ড’ শীর্ষক এই গবেষণাটি করা হয় ২০২৩ সালে।

ওই গবেষণায় বলছে, প্রায় ৩০৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ঢাকা শহরে ১৯৯৫ সালে জলাধার ও জলাভূমি ছিল নগরীর মোট আয়তনের ৩০ দশমিক ২৫ শতাংশ। এখন তা কমে ৩ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে।

সেই সময় সবুজ এলাকার পরিমাণ ছিল ১৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ। তা এখন কমে হয়েছে ৭ দশমিক ৯ শতাংশে। ওই সময় ৪৩ দশমিক ৭২ শতাংশ এলাকা নির্মাণের আওতায় এসেছিল, যা এখন বেড়ে হয়েছে ৭৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

কোনো ধরনের নিয়ম না মেনে খেলার মাঠ দখল করে ক্লাব, বিপণি বিতান, হাটবাজারসহ নানা স্থাপনা এবং জলাভূমি ভরাট করে প্রতিনিয়ত আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন তৈরি করায় সবুজ ও জলাভূমি কমেছে আশঙ্কাজনক হারে বলে এ গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে জানানো হয়।

২০২৩ সালের ৯ মে মার্কিন-ভিত্তিক জার্নাল পিএলওএস সাসটেইনেবিলিটি অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশনে প্রকাশিত ‘প্রোসপেক্টস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস অফ অ্যাচিভিং সাস্টেইনেবল আরবান গ্রিন স্পেসেস : আ কেস স্টাডি অফ আরবান গ্রিনিং ইন ঢাকা নর্থ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৯২ সালে ঢাকার উত্তরের ১৯৪ দশমিক ২ বর্গ কিলোমিটার এলাকার প্রায় ৪৭ শতাংশই ছিল সবুজ, যা ২০০২ সালে ৩১ শতাংশে, ২০১২ সালে ১৮ শতাংশে এবং ২০২২ সালে আরও কমে ১৬ দশমিক ১৭ শতাংশে এসে দাঁড়ায়।

১৯৯২ ওই অঞ্চলে ৯২ দশমিক ২১ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছিল গাছপালা, যা ২০২২ সালে এসে প্রায় ৬৬ শতাংশ কমে ৩১ দশমিক ৪০ বর্গ কিলোমিটারে দাঁড়ায়।

এছাড়া, ঢাকা উত্তরে গাছ লাগানোর মতো অনূর্বর ভূমি এলাকা ২০১২ সালের প্রায় ১১ বর্গ কিলোমিটার থেকে কমে ২০২২ সালে ২.২ বর্গ কিলোমিটারে নেমে এসেছে।

সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালে ঢাকার মোট এলাকার ৪৪ দশমিক ৮ শতাংশ ফাঁকা জায়গা ছিল, যা ২০০৫ সালে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসে।

গবেষকরা ২০১৩ সালের একটি সমীক্ষাকে উদ্ধৃত করেছেন; ওই সমীক্ষা অনুযায়ী, ঢাকা শহরের ব্যস্ততম কেন্দ্রের প্রায় ৮৮ শতাংশ এলাকাই সবুজ অঞ্চল বা জলাভূমি ধ্বংস করে গড়ে উঠেছে। তাদের সুপারিশ, যেকোনো শহরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে পার্ক, খেলার মাঠ এবং শহুরে বনাঞ্চলের মতো সবুজ এলাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

‘তাপপ্রবাহ : বাংলাদেশ, আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে রাজধানীর মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ অঞ্চল কামরাঙ্গীরচর ও আদাবর এলাকা। এ ছাড়া ধানমন্ডি এলাকায়ও উষ্ণতার মাত্রা তীব্র হয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৯০ শতাংশ এলাকা তীব্র তাপপ্রবাহের বিপদে রয়েছে।

তবে, শাহবাগ, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বসবাসকারীরা এই গ্রীষ্মে তুলনামূলক কম বিপদে আছেন। ঢাকার মধ্যে এসব এলাকায় উষ্ণতার মাত্রা সবচেয়ে কম, কারণ এসব এলাকায় তুলনামূলক গাছ বা সবুজ অঞ্চল বেশি।

প্রচণ্ড দাবদাহের এ পরিস্থিতিতে দরিদ্র মানুষের বিপদগুলো চিহ্নিত করতে গত ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সমীক্ষা প্রতিবেদন ও কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে চূড়ান্ত করা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং অ্যান্ড জিআইএসের এক গবেষণা সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার ২০ শতাংশ স্থানে গাছপালা থাকা উচিত হলেও আছে মাত্র ২ শতাংশে।

তুলনামূলক এক চিত্রে দেখা গেছে, ঢাকার অদূরে সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ শতাংশ এলাকায় গাছপালা ও ২২ শতাংশে জলাভূমি। এ কারণে একই সময় ঢাকার চেয়ে সেখানকার তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থাকে। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রমনা পার্ক এলাকার তুলনায় ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকায় তাপমাত্রা থাকে ২ ডিগ্রি বেশি।

যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরে ১৯৮৯ থেকে ২০২০ সাল, অর্থাৎ ৩১ বছরে ৫৬ শতাংশ গাছপালা কমেছে। এখন এ শহরের মাত্র ২ শতাংশ এলাকাজুড়ে সমৃদ্ধ ও পরিবেশবান্ধব প্রজাতির গাছপালা ও লতাগুল্ম টিকে আছে। আর মোট বৃক্ষ-আচ্ছাদিত এলাকা রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ।

রাজধানী বা মেট্রোপলিটন সিটিতে মিনিমান কত শতাংশ সবুজ বা জলাধার থাকা প্রয়োজন এমন প্রশ্নে বিআইপির সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান সংবাদকে বলেন, ‘সবুজ ও পানি মিলিয়ে সর্বনিম্ন ৩৫ শতাংশ থাকা প্রয়োজন। তাহলে বাসযোগ্য থাকে। অনেক শহরে আরও বেশিও আছে।’

‘আমাদের রাজধানী শহরে ১০ ভাগ আছে। এর ৮ ভাগ সবুজ ও ২ ভাগের মতো পানি,’ তথ্য দেন তিনি।

এর জন্য কারা দায়ী প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘নির্মিত এলাকা যেটাকে আমরা ভবন বা অবকাঠামো বলি এটা ১৯৯৮ সালে ছিল ৪৩ শতাংশের মতো আর ২০২৩ সালে এসে হয়েছে ৭৬ শতাংশের মতো। আর এটা সবাই করেছে। সরকার, সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, বেসরকারি আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। সবাই মিলে করেছে।’

অনেকের চোখে এটাই উন্নয়ন, তবে কী আমরা উন্নয়ন বন্ধ করে দিব? মেহেদী আহসানের জবাব, ‘এটা টেকসই উন্নয়ন না। উন্নয়ন পরিবেশ সম্মতভাবে করা সম্ভব। আর পরিবেশ প্রকৃতিকে ঠিক রেখে যে উন্নয়ন সেটাই প্রকৃত উন্নয়ন।’

‘আপনি পরিবেশ প্রকৃতির যে পরিমাণ ক্ষতি করছেন আর এখন যে দাবদাহ চলছে সেখানে মানুষের টিকে থাকাই মুশকিল, এই উন্নয়নের লাভ কিভাবে হিসেব করবেন। যদি পরিবেশ ঠিক না থাকে তবে ওই উন্নয়ন টিকেই থাকবে না, ধ্বংস হয়ে যাবে।’

রাজধানীর মতো মেগাসিটিতে মানুষের চাপ কমাতে কী করতে হবে, ‘কোন তাৎক্ষণিক সমাধান নেই। এটার মধ্য মেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আছে। সারাদেশে নগরায়ণটা কেমন হবে তার একটা পরিকল্পনা করতে হবে। আমি ঢাকায় কত লোক রাখব, দিনাজপুরে কত লোক রাখব, সাতক্ষীরায় কত লোক রাখব। সারাদেশের নগরায়ণের একটা পরিকল্পনা করে সেই অনুযায়ী অবকাঠামো ও সেবাসমূহের উন্নয়ন করলে বিকেন্দ্রীকরণ করা সম্ভব হবে।’

বায়তুল মোকাররমে কঠোর নিরাপত্তা

কারফিউ পুরোপুরি তুলে না নেয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

ছবি

জনজীবনে স্বস্তি, রাজধানীতে যানজট

ছবি

স্বাভাবিকতার পথে নগরজীবন

ছবি

কোটা সংস্কার আন্দোলনের ‘শাটডাউন’ কর্মসূচিতে রামপুরায় বিটিভি ভবনে অগ্নিকাণ্ড

ছবি

বাড্ডায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ, একজন নিহত

ছবি

মেট্রোরেলের মিরপুর অংশে চলাচল বন্ধ

ছবি

বাড্ডায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকে পুলিশের রাবার বুলেট ও ছররা গুলিতে আহত অনেকে

ছবি

উত্তাল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, যান চলাচল বন্ধ

ছবি

মিরপুর-১০ রণক্ষেত্র, আ.লীগের সমাবেশ পণ্ড

ছবি

রামপুরা পুলিশ বক্সে আগুন, সড়কে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া

ছবি

সংঘর্ষে রণক্ষেত্র যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া

ছবি

সহিংসতা পরিহার করুনঃ পুলিশ সদর দপ্তর

ছবি

ঢাকার শনির আখড়ায় পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ, শিশুসহ ৬ জন গুলিবিদ্ধ

ছবি

ঢাকায় কোটা সংঘর্ষে নিহত ২ঃ পুলিশ বলছে দায় আন্দোলনকারীদের

ছবি

আজ গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল কর্মসূচি

ছবি

সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ

ছবি

"তাণ্ডবের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশের মোতায়েন"

ছবি

"কোটা আন্দোলন: ঢাকা মেডিকেলের সামনে সংঘর্ষ ও হাত বোমা বিস্ফোরণ"

রাজধানীতে গ্যাস সংকট, চুলা জ্বলে না বাসাবাড়িতে

ছবি

ডিএনসিসির চিঠি, ‘আতঙ্কে’ গরুর খামারিরা

ছবি

চার দফা দাবিতে রাজধানীতে হরিজন সম্প্রদায়ের বিক্ষোভ সমাবেশ

ছবি

প্রবল বর্ষণে রাজধানীতে বিদ্যুতায়িত হয়ে চার শ্রমজীবীর মৃত্যু

৫ বছর পড়ে আছে ৩৮ কোটির সিজেএম ভবন

ছবি

কোটাবিরোধী আন্দোলন: শিক্ষার্থীদের নামে পুলিশের মামলা

ছবি

সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টি, ভাসছে ঢাকা

ছবি

বেবিচক এর মাঠ পর্যায়ের কার্যালয়সমূহের সাথে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) স্বাক্ষর অনু্ষ্ঠান

ছবি

‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগানে উত্তাল শাহবাগ, পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে দিল শিক্ষার্থীরা

ছবি

আত্মসাত মামলা: ইউনূসের আবেদনের রায় ২১ জুলাই

ছবি

এসি নষ্ট, আকাশে ৩৭ মিনিট উড়ে ঢাকায় ফিরল বিমান

ছবি

কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে হরিজনদের ওপর হামলার অভিযোগ

ছবি

বাংলাদেশ এগ্রিকালচার রিপোর্টার্স ফোরামের নেতৃত্বে সবুজ-কাওসার

ছবি

বিসিএস ও মেডিকেল প্রশ্নফাঁসকারীদের বিচার চায় জবি শিক্ষার্থীরা

ছবি

কোটা : ঢাবির পর এবার জবি শিক্ষার্থীদের জিরো পয়েন্ট অবরোধ

ছবি

বাংলা ব্লকেডে’ অচল সড়ক, মেট্রোতে উপচেপড়া ভিড়

ছবি

কোটা : স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ আপিল বিভাগের

tab

নগর-মহানগর

সবুজ, জলাধার ধ্বংস করে ‘তপ্ত দ্বীপ’ ঢাকা

শাফিউল আল ইমরান

মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

নানামুখী চাপে দিন দিন ‘তপ্ত দ্বীপে (হিট আইল্যান্ড)’ পরিণত হচ্ছে রাজধানী ঢাকা। তাপমাত্রা বাড়ার যতগুলো উপাদান আছে, এর সবগুলোই আছে এ নগরীতে। আর তাপ কমানোর উদ্যানগুলো কমতে কমতে এখন একেবারে নিঃশেষ হওয়ার পথে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সত্তরোর্ধ চা দোকানি চুন্নু মিয়া। ওই এলাকায় ৫০ বছর ধরে চা বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ‘এই বয়সে কত কী দেখলাম, আশপাশে কত পুকুর ছিল। শিয়া মসজিদের ঢালে যে রিং রোড ওহানে (ওখানে) তো জাহাজ ঘাট আছিল। ওই ঘাটে কত জাহাজ আসতো, এখন কেউ চিনবার পারবো?’

কাশিনাথ বশাক বেশ কয়েক দশক ধরে ঢাকার ‘বেড়ে ওঠা’ দেখছেন। তার অফিস রাজধানীর পুরানা পল্টনে। দীর্ঘদিন ধরে সেখানে কাজ করছেন। তিনি বলছেন, ‘ওই যে দেখতাছেন হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের বিল্ডিং সেখানে আগে তো শান বাঁধানো পুকুর ছিল। মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে এসে গোসল করতো। এখন সেখানে কোন কিছুর অস্তিত্ব আছে!’

এই আক্ষেপ শুধু চুন্নু মিয়া বা কাশিনাথেরই নয়, আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগের ঢাকা যারা চিনেন তাদের প্রত্যেকের। অত পেছনে যাবারও প্রয়োজন নেই। গবেষকরা বলছেন, গত ২৮ বছরে যে পরিবর্তন হয়েছে তাতেই চড়া মুল্য দিতে হচ্ছে এই নগরের বাসিন্দাদের। জলাশয় ভরাট করে ও সবুজ খালি জায়গায় একের পর এক কংক্রিটের স্থাপনা তৈরির চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে।

গত ২৮ বছরে ঢাকায় জলাধার ও জলাভূমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৯০ শতাংশ। আর সবুজ বা গাছপালা, মাঠ, পার্কের পরিমাণ কমেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। আর নির্মাণ বা কংক্রিটের স্থাপনা বেড়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ মেহেদী আহসানের এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। ‘ব্লু এন্ড গ্রিন স্পেস ইন ঢাকা সিটি : রিয়েলিটি অ্যান্ড ওয়ে ফরওয়ার্ড’ শীর্ষক এই গবেষণাটি করা হয় ২০২৩ সালে।

ওই গবেষণায় বলছে, প্রায় ৩০৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ঢাকা শহরে ১৯৯৫ সালে জলাধার ও জলাভূমি ছিল নগরীর মোট আয়তনের ৩০ দশমিক ২৫ শতাংশ। এখন তা কমে ৩ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে।

সেই সময় সবুজ এলাকার পরিমাণ ছিল ১৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ। তা এখন কমে হয়েছে ৭ দশমিক ৯ শতাংশে। ওই সময় ৪৩ দশমিক ৭২ শতাংশ এলাকা নির্মাণের আওতায় এসেছিল, যা এখন বেড়ে হয়েছে ৭৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

কোনো ধরনের নিয়ম না মেনে খেলার মাঠ দখল করে ক্লাব, বিপণি বিতান, হাটবাজারসহ নানা স্থাপনা এবং জলাভূমি ভরাট করে প্রতিনিয়ত আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন তৈরি করায় সবুজ ও জলাভূমি কমেছে আশঙ্কাজনক হারে বলে এ গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে জানানো হয়।

২০২৩ সালের ৯ মে মার্কিন-ভিত্তিক জার্নাল পিএলওএস সাসটেইনেবিলিটি অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশনে প্রকাশিত ‘প্রোসপেক্টস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস অফ অ্যাচিভিং সাস্টেইনেবল আরবান গ্রিন স্পেসেস : আ কেস স্টাডি অফ আরবান গ্রিনিং ইন ঢাকা নর্থ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৯২ সালে ঢাকার উত্তরের ১৯৪ দশমিক ২ বর্গ কিলোমিটার এলাকার প্রায় ৪৭ শতাংশই ছিল সবুজ, যা ২০০২ সালে ৩১ শতাংশে, ২০১২ সালে ১৮ শতাংশে এবং ২০২২ সালে আরও কমে ১৬ দশমিক ১৭ শতাংশে এসে দাঁড়ায়।

১৯৯২ ওই অঞ্চলে ৯২ দশমিক ২১ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছিল গাছপালা, যা ২০২২ সালে এসে প্রায় ৬৬ শতাংশ কমে ৩১ দশমিক ৪০ বর্গ কিলোমিটারে দাঁড়ায়।

এছাড়া, ঢাকা উত্তরে গাছ লাগানোর মতো অনূর্বর ভূমি এলাকা ২০১২ সালের প্রায় ১১ বর্গ কিলোমিটার থেকে কমে ২০২২ সালে ২.২ বর্গ কিলোমিটারে নেমে এসেছে।

সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালে ঢাকার মোট এলাকার ৪৪ দশমিক ৮ শতাংশ ফাঁকা জায়গা ছিল, যা ২০০৫ সালে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসে।

গবেষকরা ২০১৩ সালের একটি সমীক্ষাকে উদ্ধৃত করেছেন; ওই সমীক্ষা অনুযায়ী, ঢাকা শহরের ব্যস্ততম কেন্দ্রের প্রায় ৮৮ শতাংশ এলাকাই সবুজ অঞ্চল বা জলাভূমি ধ্বংস করে গড়ে উঠেছে। তাদের সুপারিশ, যেকোনো শহরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে পার্ক, খেলার মাঠ এবং শহুরে বনাঞ্চলের মতো সবুজ এলাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

‘তাপপ্রবাহ : বাংলাদেশ, আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে রাজধানীর মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ অঞ্চল কামরাঙ্গীরচর ও আদাবর এলাকা। এ ছাড়া ধানমন্ডি এলাকায়ও উষ্ণতার মাত্রা তীব্র হয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৯০ শতাংশ এলাকা তীব্র তাপপ্রবাহের বিপদে রয়েছে।

তবে, শাহবাগ, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বসবাসকারীরা এই গ্রীষ্মে তুলনামূলক কম বিপদে আছেন। ঢাকার মধ্যে এসব এলাকায় উষ্ণতার মাত্রা সবচেয়ে কম, কারণ এসব এলাকায় তুলনামূলক গাছ বা সবুজ অঞ্চল বেশি।

প্রচণ্ড দাবদাহের এ পরিস্থিতিতে দরিদ্র মানুষের বিপদগুলো চিহ্নিত করতে গত ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সমীক্ষা প্রতিবেদন ও কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে চূড়ান্ত করা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং অ্যান্ড জিআইএসের এক গবেষণা সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার ২০ শতাংশ স্থানে গাছপালা থাকা উচিত হলেও আছে মাত্র ২ শতাংশে।

তুলনামূলক এক চিত্রে দেখা গেছে, ঢাকার অদূরে সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ শতাংশ এলাকায় গাছপালা ও ২২ শতাংশে জলাভূমি। এ কারণে একই সময় ঢাকার চেয়ে সেখানকার তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থাকে। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রমনা পার্ক এলাকার তুলনায় ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকায় তাপমাত্রা থাকে ২ ডিগ্রি বেশি।

যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরে ১৯৮৯ থেকে ২০২০ সাল, অর্থাৎ ৩১ বছরে ৫৬ শতাংশ গাছপালা কমেছে। এখন এ শহরের মাত্র ২ শতাংশ এলাকাজুড়ে সমৃদ্ধ ও পরিবেশবান্ধব প্রজাতির গাছপালা ও লতাগুল্ম টিকে আছে। আর মোট বৃক্ষ-আচ্ছাদিত এলাকা রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ।

রাজধানী বা মেট্রোপলিটন সিটিতে মিনিমান কত শতাংশ সবুজ বা জলাধার থাকা প্রয়োজন এমন প্রশ্নে বিআইপির সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান সংবাদকে বলেন, ‘সবুজ ও পানি মিলিয়ে সর্বনিম্ন ৩৫ শতাংশ থাকা প্রয়োজন। তাহলে বাসযোগ্য থাকে। অনেক শহরে আরও বেশিও আছে।’

‘আমাদের রাজধানী শহরে ১০ ভাগ আছে। এর ৮ ভাগ সবুজ ও ২ ভাগের মতো পানি,’ তথ্য দেন তিনি।

এর জন্য কারা দায়ী প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘নির্মিত এলাকা যেটাকে আমরা ভবন বা অবকাঠামো বলি এটা ১৯৯৮ সালে ছিল ৪৩ শতাংশের মতো আর ২০২৩ সালে এসে হয়েছে ৭৬ শতাংশের মতো। আর এটা সবাই করেছে। সরকার, সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, বেসরকারি আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। সবাই মিলে করেছে।’

অনেকের চোখে এটাই উন্নয়ন, তবে কী আমরা উন্নয়ন বন্ধ করে দিব? মেহেদী আহসানের জবাব, ‘এটা টেকসই উন্নয়ন না। উন্নয়ন পরিবেশ সম্মতভাবে করা সম্ভব। আর পরিবেশ প্রকৃতিকে ঠিক রেখে যে উন্নয়ন সেটাই প্রকৃত উন্নয়ন।’

‘আপনি পরিবেশ প্রকৃতির যে পরিমাণ ক্ষতি করছেন আর এখন যে দাবদাহ চলছে সেখানে মানুষের টিকে থাকাই মুশকিল, এই উন্নয়নের লাভ কিভাবে হিসেব করবেন। যদি পরিবেশ ঠিক না থাকে তবে ওই উন্নয়ন টিকেই থাকবে না, ধ্বংস হয়ে যাবে।’

রাজধানীর মতো মেগাসিটিতে মানুষের চাপ কমাতে কী করতে হবে, ‘কোন তাৎক্ষণিক সমাধান নেই। এটার মধ্য মেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আছে। সারাদেশে নগরায়ণটা কেমন হবে তার একটা পরিকল্পনা করতে হবে। আমি ঢাকায় কত লোক রাখব, দিনাজপুরে কত লোক রাখব, সাতক্ষীরায় কত লোক রাখব। সারাদেশের নগরায়ণের একটা পরিকল্পনা করে সেই অনুযায়ী অবকাঠামো ও সেবাসমূহের উন্নয়ন করলে বিকেন্দ্রীকরণ করা সম্ভব হবে।’

back to top