আজ থেকে প্রায় ৩৫ বছর আগের কথা, সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যেতেন রিমা জুলফিকার। তার মতো অনেক মা আসতেন সন্তানদের নিয়ে। স্কুলের সামনে বসে থাকতেন, গল্প করতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। শুধুই অলস সময় কাটানো।
এই ‘শুধু বসে বসে গল্প করা’ মানুষদের নিয়ে কী করা যায় বিষয়টা ইঞ্জিনিয়ার স্বামী মুঈনউদ্দীনের সঙ্গে আলাপ করেন। মুঈনউদ্দীন বলেন, ‘তোমার তো রান্নার হাত ভালো, রান্না শেখাও।’ পরামর্শ মনে ধরলো। কিছুটা সংকোচ, কিছুটা দ্বিধা নিয়ে পরদিন কয়েকজন অভিভাবক নারীর সঙ্গে বিষয়টি আলাপ করলেন। তারা কিন্তু হেসে উড়িয়ে দিলেন না, কারণ এরই মধ্যে রিমার বানানো খাবার খেয়ে অনেকেই জেনে গেছেন ‘রিমার হাতে জাদু আছে’।
স্বামীর পরামর্শ আর ছেলের বন্ধুর মায়েদের উৎসাহে বাসার কাজ শেষ করে অবসর সময়টুকু কাজে লাগিয়ে শৈল্পিক কর্মে মনোযোগী হলেন রিমা। ছোটবেলার সখের কাজগুলোই বেছে নিলেন তার ভবিষ্যৎ পথ চলার অবলম্বন হিসেবে। জানা কাজগুলোকে ‘আধুনিক ও দর্শনীয়’ করার কাজে মন দিলেন। এক সময় দেখলেন আশপাশের মানুষগুলো তার কাজ বেশ পছন্দ করছে, জানতে ও শিখতে চাচ্ছে। তিনি পরিবার এবং প্রতিবেশীদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠলেন।
তাদের সেই উৎসাহকে পুঁজি করে মাত্র ১২ হাজার টাকা পুঁজি ও ১২ জন প্রশিক্ষণার্থী নিয়ে ১৯৯০ সালে শুরু করেন স্বপ্ন বাস্তবায়নের রণযাত্রা। শুরুটা খুলনায়। খুলনায় যখন ছড়িয়ে পড়েছে রান্নাও শেখা যায় আর শেখাচ্ছেন প্রিয় মুখ রিমা জুলফিকার, আশপাশের অনেকেই আসতে শুরু করেন। ‘গৃহ সুখন’-এ যখন প্রশিক্ষণার্থী বাড়তে শুরু করে ঠিক তখনি চাকরির সুবাদে ১৯৯৪ সালে স্বামী বদলি হয়ে আসেন নারায়ণগঞ্জে।
কিছুদিন নারায়াণগঞ্জে থাকতে হয়। নারায়ণগঞ্জে থাকা অবস্থায় তিনি নিজেকে ভেঙেচ‚রে তৈরি করার কাজে লাগেন। রিমার ভাষায় ‘নিজেকে আরেকটু পারফেক্ট’ করতে পর্যটন থেকে কয়েকটি প্রশিক্ষণ নেন।
কিছুদিন পর চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকায় এসে থিতু হওয়ার সময়টুকু নেন। এরপর কাজের পরিসর বাড়িয়ে ফেলেন রিমা জুলফিকার। ‘প্রশিক্ষণ নিন, আয় করুন’ স্লোগান নিয়ে নতুন করে শুরু করেন ‘গৃহ সুখন’-এর যাত্রা। গ্রিন রোডের গ্রিন স্কয়ারে ব্যাপকভাবে শুরু করেন ‘গৃহ সুখনের’ কর্মকাণ্ড।
বিভিন্ন রকম রান্না, ফুড প্রসেসিং, হস্তশিল্প, ¿েস মেকিং, ট্রেইলারিং, ফ্যাশন ডিজাইন, বিউটিফিকেশনের বিভিন্ন দিক নিয়ে এক এক করে প্রায় শ’ খানেক বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। প্রায় ৫০-৬০ জন কর্মচারী, ১০ জন ট্রেইনার, ম্যানেজার নিয়ে বিশাল কর্মকাণ্ড শুরু করেন। বছর না ঘুরতেই ছড়িয়ে পড়ে গৃহ সুখনের নাম।
আজ থেকে ৪০ বছর আগে স্বামী-সস্তান, আত্মীয়-স্বজনদের মজার রান্না করে খাওয়ানো এই ছিল যার শুরু, সেই রান্নাই তাকে বানিয়ে দেয় সেলিব্রিটি। ডাক আসতে থাকে বিভিন্ন রান্নার আয়োজন থেকে। রান্না প্রতিযোগিতায় বিচারকের আসনেই শুধু নয়, বিভিন্ন টেলিভিশনে নিয়মিতভাবে রান্নাবিষয়ক অনুষ্ঠানে ব্যস্ত হয়ে পড়েন রিমা জুলফিকার।
তিনি ‘নেসলে ঝটপট রান্না’, ‘রাঁধুনি রান্না এখন খেলা’, ‘ডিপ্লোমা গুঁড়া দুধ মিষ্টি লড়াই’য়ের সঙ্গে কাজ করেন। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন-এর বিভিন্ন প্রকল্পে ট্রেনিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এছাড়া তিনি অসহায়, দুস্থদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্নভাবে কাজ করে আসছেন।
সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়েছেন পুরস্কার ও সম্মাননা। রিমা জুলফিকার এফবিসিসিআই থেকে শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পরপর ৩ বার, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি থেকে একবার ১ম পুরস্কার অর্জন করেন। তিনি ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন কনফারেন্সে ট্রেনিং ও বাংলাদেশি ট্র্যাডিশনাল পণ্য নিয়ে মেলা ও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন অনেকবার।
স্বাধীনতা সংসদ থেকে বিশিষ্ট মহিলা উদ্যোক্তা পদক লাভ করেন ২০০৩ সালে। বাংলাদেশ ইউথ বিজনেস ফোরাম থেকে ২০০৪ সালে অর্জন করেন বিশিষ্ট মহিলা স্বর্ণপদক, জসীম উদ্দীন স্মৃতি পুরস্কার, মীর মোশারফ হোসেন স্মৃতি পুরস্কার, কালচারাল রিপোর্টাস অ্যাসোসিয়েশন থেকে মেলায় শ্রেষ্ঠ স্টল, বেগম রোকেয়া শাইনিং পারসোনালিটি ও দেশের কাগজ বিজনেস অ্যাওয়ার্ড, উইমেন পারসোনালিটি অ্যাওয়ার্ড। আন্তর্জাতিক মৈত্রী সম্মাননা ২০১৯ শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তা, কলকাতা ও বারিসাস পুরস্কার পেয়েছেন। এবার পাচ্ছেন বেকিং ও কুকিং এন্টারপ্রেনার বিডি থেকে সম্মাননা।
এই পুরস্কার পাওয়া নিয়ে রীমা বলেন, ‘পুরস্কার পাওয়াটা সম্মানের। এটা অবশ্যই একটা স্বীকৃতি। অনেক পুরস্কার বা সম্মাননা পেয়েছি। কিন্তু এই সম্মাননা আমার কাছে বিশেষ। যারা সম্মাননা দিচ্ছেন তারা নিজেরাও আমার মতো উদ্যোক্তা। এ ধরনের আয়োজন অনেক নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে সাহায্য করবে, অনেকেই অনুপ্রাণিত হবেন।’ নারীদের বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে পারাটাকে তিনি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন বলে মনে করেন।
শুক্রবার, ১৭ জুন ২০২২
আজ থেকে প্রায় ৩৫ বছর আগের কথা, সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যেতেন রিমা জুলফিকার। তার মতো অনেক মা আসতেন সন্তানদের নিয়ে। স্কুলের সামনে বসে থাকতেন, গল্প করতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। শুধুই অলস সময় কাটানো।
এই ‘শুধু বসে বসে গল্প করা’ মানুষদের নিয়ে কী করা যায় বিষয়টা ইঞ্জিনিয়ার স্বামী মুঈনউদ্দীনের সঙ্গে আলাপ করেন। মুঈনউদ্দীন বলেন, ‘তোমার তো রান্নার হাত ভালো, রান্না শেখাও।’ পরামর্শ মনে ধরলো। কিছুটা সংকোচ, কিছুটা দ্বিধা নিয়ে পরদিন কয়েকজন অভিভাবক নারীর সঙ্গে বিষয়টি আলাপ করলেন। তারা কিন্তু হেসে উড়িয়ে দিলেন না, কারণ এরই মধ্যে রিমার বানানো খাবার খেয়ে অনেকেই জেনে গেছেন ‘রিমার হাতে জাদু আছে’।
স্বামীর পরামর্শ আর ছেলের বন্ধুর মায়েদের উৎসাহে বাসার কাজ শেষ করে অবসর সময়টুকু কাজে লাগিয়ে শৈল্পিক কর্মে মনোযোগী হলেন রিমা। ছোটবেলার সখের কাজগুলোই বেছে নিলেন তার ভবিষ্যৎ পথ চলার অবলম্বন হিসেবে। জানা কাজগুলোকে ‘আধুনিক ও দর্শনীয়’ করার কাজে মন দিলেন। এক সময় দেখলেন আশপাশের মানুষগুলো তার কাজ বেশ পছন্দ করছে, জানতে ও শিখতে চাচ্ছে। তিনি পরিবার এবং প্রতিবেশীদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠলেন।
তাদের সেই উৎসাহকে পুঁজি করে মাত্র ১২ হাজার টাকা পুঁজি ও ১২ জন প্রশিক্ষণার্থী নিয়ে ১৯৯০ সালে শুরু করেন স্বপ্ন বাস্তবায়নের রণযাত্রা। শুরুটা খুলনায়। খুলনায় যখন ছড়িয়ে পড়েছে রান্নাও শেখা যায় আর শেখাচ্ছেন প্রিয় মুখ রিমা জুলফিকার, আশপাশের অনেকেই আসতে শুরু করেন। ‘গৃহ সুখন’-এ যখন প্রশিক্ষণার্থী বাড়তে শুরু করে ঠিক তখনি চাকরির সুবাদে ১৯৯৪ সালে স্বামী বদলি হয়ে আসেন নারায়ণগঞ্জে।
কিছুদিন নারায়াণগঞ্জে থাকতে হয়। নারায়ণগঞ্জে থাকা অবস্থায় তিনি নিজেকে ভেঙেচ‚রে তৈরি করার কাজে লাগেন। রিমার ভাষায় ‘নিজেকে আরেকটু পারফেক্ট’ করতে পর্যটন থেকে কয়েকটি প্রশিক্ষণ নেন।
কিছুদিন পর চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকায় এসে থিতু হওয়ার সময়টুকু নেন। এরপর কাজের পরিসর বাড়িয়ে ফেলেন রিমা জুলফিকার। ‘প্রশিক্ষণ নিন, আয় করুন’ স্লোগান নিয়ে নতুন করে শুরু করেন ‘গৃহ সুখন’-এর যাত্রা। গ্রিন রোডের গ্রিন স্কয়ারে ব্যাপকভাবে শুরু করেন ‘গৃহ সুখনের’ কর্মকাণ্ড।
বিভিন্ন রকম রান্না, ফুড প্রসেসিং, হস্তশিল্প, ¿েস মেকিং, ট্রেইলারিং, ফ্যাশন ডিজাইন, বিউটিফিকেশনের বিভিন্ন দিক নিয়ে এক এক করে প্রায় শ’ খানেক বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। প্রায় ৫০-৬০ জন কর্মচারী, ১০ জন ট্রেইনার, ম্যানেজার নিয়ে বিশাল কর্মকাণ্ড শুরু করেন। বছর না ঘুরতেই ছড়িয়ে পড়ে গৃহ সুখনের নাম।
আজ থেকে ৪০ বছর আগে স্বামী-সস্তান, আত্মীয়-স্বজনদের মজার রান্না করে খাওয়ানো এই ছিল যার শুরু, সেই রান্নাই তাকে বানিয়ে দেয় সেলিব্রিটি। ডাক আসতে থাকে বিভিন্ন রান্নার আয়োজন থেকে। রান্না প্রতিযোগিতায় বিচারকের আসনেই শুধু নয়, বিভিন্ন টেলিভিশনে নিয়মিতভাবে রান্নাবিষয়ক অনুষ্ঠানে ব্যস্ত হয়ে পড়েন রিমা জুলফিকার।
তিনি ‘নেসলে ঝটপট রান্না’, ‘রাঁধুনি রান্না এখন খেলা’, ‘ডিপ্লোমা গুঁড়া দুধ মিষ্টি লড়াই’য়ের সঙ্গে কাজ করেন। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন-এর বিভিন্ন প্রকল্পে ট্রেনিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এছাড়া তিনি অসহায়, দুস্থদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্নভাবে কাজ করে আসছেন।
সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়েছেন পুরস্কার ও সম্মাননা। রিমা জুলফিকার এফবিসিসিআই থেকে শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পরপর ৩ বার, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি থেকে একবার ১ম পুরস্কার অর্জন করেন। তিনি ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন কনফারেন্সে ট্রেনিং ও বাংলাদেশি ট্র্যাডিশনাল পণ্য নিয়ে মেলা ও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন অনেকবার।
স্বাধীনতা সংসদ থেকে বিশিষ্ট মহিলা উদ্যোক্তা পদক লাভ করেন ২০০৩ সালে। বাংলাদেশ ইউথ বিজনেস ফোরাম থেকে ২০০৪ সালে অর্জন করেন বিশিষ্ট মহিলা স্বর্ণপদক, জসীম উদ্দীন স্মৃতি পুরস্কার, মীর মোশারফ হোসেন স্মৃতি পুরস্কার, কালচারাল রিপোর্টাস অ্যাসোসিয়েশন থেকে মেলায় শ্রেষ্ঠ স্টল, বেগম রোকেয়া শাইনিং পারসোনালিটি ও দেশের কাগজ বিজনেস অ্যাওয়ার্ড, উইমেন পারসোনালিটি অ্যাওয়ার্ড। আন্তর্জাতিক মৈত্রী সম্মাননা ২০১৯ শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তা, কলকাতা ও বারিসাস পুরস্কার পেয়েছেন। এবার পাচ্ছেন বেকিং ও কুকিং এন্টারপ্রেনার বিডি থেকে সম্মাননা।
এই পুরস্কার পাওয়া নিয়ে রীমা বলেন, ‘পুরস্কার পাওয়াটা সম্মানের। এটা অবশ্যই একটা স্বীকৃতি। অনেক পুরস্কার বা সম্মাননা পেয়েছি। কিন্তু এই সম্মাননা আমার কাছে বিশেষ। যারা সম্মাননা দিচ্ছেন তারা নিজেরাও আমার মতো উদ্যোক্তা। এ ধরনের আয়োজন অনেক নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে সাহায্য করবে, অনেকেই অনুপ্রাণিত হবেন।’ নারীদের বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে পারাটাকে তিনি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন বলে মনে করেন।